বোধিচিত্ত বিকাশের জন্য সপ্তাংশ কারণ এবং ফলের ধ্যান

অন্যকে যথাসম্ভব সম্পূর্ণরূপে সহায়তা করার জন্য বুদ্ধত্ব লাভ করার লক্ষ্য বা প্রার্থনা হল বোধিচিত্ত। এই লক্ষ্যটি বিকাশ করার জন্য নির্ধারিত সপ্তাংশ কারণ এবং ফল পদ্ধতি, আর এটা বিকশিত হওয়ার পর এটাকে আরও দৃঢ় করে আমরা সমতা ভাবনার সাথে অনুশীলন শুরু করি। এটা করার জন্য আমরা সকলকে আমাদের মায়ের মতো মনে ক’রে, তাদের মাতৃ-স্নেহ বা ভালবাসা স্মরণ ক’রে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাবনা জাগিয়ে তাদের কৃতজ্ঞতা শোধ করার জন্য আমরা অগ্রসর হই আর আমরা এটা করি আমাদের আবেগ এবং বোধগম্যতার একটা অনুক্রমের মাধ্যমে। সকলের প্রতি মৈত্রী এবং করুণার ভাবনা, একটা অসাধারণ সংকল্প এবং কারণ সম্পর্কিত এই ক্রমের ফলস্বরূপ বোধিচিত্তের লক্ষ্য বিকশিত হয়।

পরিচয়

আমাদের কাছে আছে সমস্ত অবকাশ এবং সম্পদ সম্পন্ন মানব জীবন যা আমাদের বৌদ্ধ পথ অনুসরণ করার অবকাশ প্রদান করে। কিন্তু এই অবকাশ বা স্বাধীনতা এবং সুযোগগুলি চিরকালের জন্য স্থায়ী হয় না। অতএব আমাদের কাছে বর্তমানে যে সুযোগগুলি রয়েছে তা থেকে আমাদের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করা প্রয়োজন।

আমাদের মূল্যবান মানব জীবনের সদ্ব্যবহার করার সর্বোত্তম উপায়টি হল বোধিচিত্তের লক্ষ্যটি বিকাশ করার জন্য ব্যবহার করা। বোধিচিত্ত লক্ষ্য বলতে আমাদের মন এবং হৃদয়কে বোঝায় যা আমাদের নিজস্ব বোধিকে মনোনিবেশ করে যেটা এখনও প্রাপ্ত হয়নি, তবে আমাদের বুদ্ধ-স্বভাব (তথাগতগর্ভ)- এর কারণগুলির ভিত্তিতে আমাদের চিত্ত-সন্ততির উপর নির্ভর ক’রে চিহ্নিত করা যেতে পারে যা এটাকে অর্জন করতে সক্ষম করে তোলে। এই কারণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আমাদের ইতিবাচক শক্তি, গভীর সচেতনতার নেটওয়ার্ক, আমাদের বিভিন্ন ভালো গুণ এবং আমাদের মনের প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতা। এই বোধিচিত্ত লক্ষ্যটি দুটো প্রয়োজনের সাথে যুক্ত হয়ে আছেঃ যথাশীঘ্র বোধি লাভ করা এবং তার মাধ্যমে সমস্ত প্রাণীর কল্যাণ করা।

বোধিচিত্তকে বিকাশ করার সময় আমরা দুটি উদ্দেশ্যকে বিপরীতক্রমে বিকাশ করি। প্রথমতঃ আমরা সমস্ত প্রাণীর কল্যাণ করার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করি, শুধু মানুষ মাত্রের জন্য নয়। এটা আমরা করি আমাদের মৈত্রী, করুণা এবং অসাধারণ সংকল্পের সহায়তায়। এই বিষয়ে আমরা পরবর্তী বক্তৃতায় আলোচনা করব। তারপর সবচেয়ে কার্যকর ভাবে তাদের কল্যাণ করার জন্য আমরা বোধিলাভ করতে এবং বুদ্ধত্ব লাভ করতে সম্পূর্ণভাবে সংকল্পবদ্ধ হই। আমাদের সমস্ত সীমাবদ্ধতা এবং ভুল-ত্রুটিগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের বোধিলাভ করার প্রয়োজন হয়, কারণ আমরা বুঝতে পারি যে তারা আমাদের অপরকে সাহায্য করতে সর্বোত্তমভাবে বাধা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি অন্যের উপর রেগে যাই তাহলে আমরা কীভাবে ঐ সময় তাদের সহায়তা করতে পারব? এছাড়াও, আমাদের সমস্ত সম্ভাব্যতা উপলব্ধি করার জন্য আমাদের বোধিলাভ করতেই হবে। অন্যদের উপকারে সেগুলি ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়ার জন্য আমাদের সেগুলি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে হবে। বোধিচিত্তের লক্ষ্য বিকাশ করার সময় আমরা প্রথমেই বুদ্ধ হতে চাই না এই মনে করে যে, বুদ্ধত্বটা হল সর্বোচ্চ অবস্থা এবং ন্যাকারজনক করের মতো বুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমাদেরকে পরকল্যাণ করতে হবে, সেটাও আমরা চাই না।

বোধিচিত্তের লক্ষ্য বিকাশের দুটি পদ্ধতি আছে। একটি হল সপ্তাংশ কারণ এবং ফল-উপদেশ আর অন্যটি হল স্ব-পর সমতা ও স্ব-পর মনোভাবের বিনিময়। এখানে আমরা উপরোক্ত দুটি পদ্ধতির মধ্যে প্রথমটি নিয়ে আলোচনা করব।

সমতার বিকাশ

সপ্তাংশ কারণ এবং ফল-উপদেশের ছয়টি ধাপ আছে যেগুলি সপ্তমটির কারণ রূপে কাজ করে। সপ্তমটি হল বোধিচিত্ত লক্ষ্যের প্রকৃত বিকাশ। এটা শুরু হয় একটি প্রাথমিক পদক্ষেপের সাথে যেটা ঐ উক্ত সাতটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। এটা হল সমতার বিকাশ যার মাধ্যমে আমরা কারও প্রতি আকর্ষিত হওয়া অথবা আসক্ত হওয়া, অন্যদের দ্বারা বিতাড়িত হওয়া আর কারও প্রতি নিরপেক্ষ থাকার ভাবনাকে কাটিয়ে উঠি। এই প্রাথমিক পদক্ষেপের বিষয়টি সকলের জন্য সমান ভাবে উন্মুক্ত।

জগতের সকল প্রাণী সমান যা সকলের জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত হওয়া প্রয়োজন, এই বোধগম্যতাটি তখনই জাগে যখন কেউ উপলব্ধি করে যে, চিত্ত-সন্ততি বা চিত্ত-ধারার না আছে আদি না আছে অন্ত। অতএব প্রত্যেকেই কোন এক সময় আমাদের বন্ধু ছিল, কোন এক সময় প্রত্যেকেই ছিল আমাদের শত্রু, আবার কোন এক সময় প্রত্যেকে ছিল অপরিচিত। আর এই অবস্থাটি সবসময় পরিবর্তন হয়েই চলেছে। এই অর্থে প্রত্যেকেই সমান।

এই ভাবনার পিছনে আমাদের যে মূল বিষয়টি বুঝতে হবে সেটি হল অনাদি চিত্ত। এটি বৌদ্ধধর্মের একটি প্রাথমিক ধারণা। পুনর্জন্মের বিষয়টি অভিজ্ঞতার সন্ততির সাথে সম্পর্কিত। চিত্ত-সন্ততি হল অভিজ্ঞতার সন্ততি। এর স্বতন্ত্র এবং মানুষ, পশু, পুরুষ বা স্ত্রী হিসাবে কোন সহজাত পরিচয় নেই। কোন চিত্ত-সন্ততি যেকোন নির্দিষ্ট পুনর্জন্মে উদ্ভূত হয় আর তার জীবনরূপ এবং লিঙ্গ পূর্ববর্তী কার্মিক আচরণ এবং পরবর্তী অবস্থার উপর নির্ভরশীল।

অনাদি চিত্ত সম্পর্কিত এই বিষয়টি হল বোধিচিত্তকে বিকাশ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য একটি মৌলিক, প্রয়োজনীয় বোধগম্যতা, কারণ এই বোধগম্যতার ভিত্তিতে সম্পূর্ণরূপে সকলের প্রতি করুণা বিকাশ করা সম্ভব হয়। উদাহরণ স্বরূপ, ঐ সময় আমরা অন্যান্য প্রাণীকে নিছক একটি মশারূপে দেখব না বরং এটিকে একটি দীর্ঘকালীন ব্যক্তিগত চিত্ত-সন্ততি হিসাবে দেখব, যে এই জীবনে তার কর্মের কারণে মশার রূপ ধারণ করেছে; এটি সহজাত ভাবে একটা মশা নয়। এই ভাবনা ঐ মশাটিকে একজন মানুষ হিসাবে ভাবতে আমাদের হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেয়। উক্ত বিষয় থেকে উদ্ভূত বোধিচিত্তের শক্তির ফলে আমরা সম্পূর্ণভাবে সকলের কল্যাণ করার কামনা করি। অবশ্যই এটা সহজ নয়।

সকলকে আমাদের মা হয়েছেন বলে স্বীকৃতি দেওয়া (মাতৃজ্ঞান)

একবার যখন আমরা সমতার সাথে সমস্ত প্রাণীদের ব্যক্তিগত অনাদি চিত্ত-সন্ততির সাথে যুক্তরূপে দেখতে সক্ষম হই, যা তাদের বর্তমান জীবনকালে তাদের রূপকে অস্বীকার করা যায় না, আমরা তখন সপ্তাংশ কারণ এবং ফলরূপী ধ্যানের প্রথম পদক্ষেপের জন্য তৈরী হয়ে যাই। এই পদক্ষেপে আমাদের উপলব্ধি করতে হয় যে প্রত্যেকটা প্রাণী কোন এক সময় আমাদের মা ছিলেন। এর পিছনে যে যুক্তি আছে সেটা হল এই জীবনকালে কেউ যেমন আমাদের মা হয়েছেন, ঠিক তেমনই প্রত্যেক জন্মে আমরা কোন মাতৃগর্ভ বা ডিম থেকে জন্ম নিয়েছি এবং তখনও কেউ আমাদের মা হয়েছিলেন। অনাদি পুনর্জন্মের যুক্তি এবং এই তথ্যের ভিত্তিতে প্রত্যেকে অসংখ্যবার আমাদের মা হয়েছেন, যেহেতু প্রাণীদের সংখ্যাও অসংখ্য আর আমরাও তাদের মা হয়েছি। তারা আমাদের পিতাও হয়েছেন, আবার হয়েছেন আমাদের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু এবং আরও অনেক কিছু।

প্রত্যেককে আমাদের মা হওয়া রূপে দেখার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত যে প্রত্যেকে যে আমাদের মা হয়েছেন সেটা তার সহজাত পরিচয় বা গুণ নয়। এরকারণ হল ঐ রূপে দেখলে এটা কিছুটা সমস্যা তৈরী করতে পারে। আমাদের অবশ্যই কখনো শূন্যতার দৃষ্টিকে অর্থাৎ সহজাত নির্দিষ্ট পরিচয়ের অভাবের দৃষ্টিকে হারানো উচিত নয়।

প্রত্যেককে আমাদের মা রূপে উপলব্ধি করাটা অন্যের সাথে আমাদের সম্পর্ককে আমূল পরিবর্তন করে। এখানে আমরা সকলের সাথে সমতার ভাবকেও অতিক্রম করে এগিয়ে যাই। আমরা দেখি যে প্রত্যেকের সাথে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, উষ্ণ ও প্রীতিকর ছিল এবং আগামীদিনেও সেটা থাকতে পারে।

মাতৃসুলভ কৃতজ্ঞতা স্মরণ (মাতৃঋণ-স্মরণ)

সাতটি পদক্ষেপের মধ্যে দ্বিতীয়টি হল মাতৃস্নেহের কৃতজ্ঞতা স্মরণ করা। অনেক পাশ্চাত্য লোকজনদের কাছে ধ্যানের ক্ষেত্রে এটি একটি সমস্যা যুক্ত পদক্ষেপ হয়ে ওঠে, কারণ ভারতীয় এবং তিব্বতীরা সবসময় এই জন্মে তাদের মায়ের উদাহরণটি নেয়। এই সমাজগুলিতে দেখে মনে হয় যে পাশ্চাত্য সমাজগুলির তুলনায় মানুষের সম্পর্ক মায়ের সাথে কম স্নায়বিক এবং কঠিন রয়েছে। এটা সত্যি কি না জানিনা তবে অবশ্যই ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকে। তবে আমার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমি বলব, ২৯ বছর ধরে তিব্বতী এবং ভারতীয় সমাজে বসবাস করে দেখেছি যে সেখানে বড় হওয়া শিশু এবং তাদের মায়েদের সম্পর্ক পাশ্চাত্যদের চেয়ে অনেক কম স্নায়বিক বা অস্থির বলে মনে হয়।

ধ্যানের এই পদক্ষেপটি হল আমাদের মা আমাদের জন্য কতটা কৃতজ্ঞ অথবা কৃতজ্ঞ ছিলেন, যদি তিনি মারা গিয়ে থাকেন তাহলে আমরা তার ঐ সময়ের কৃতজ্ঞতাকে স্মরণ করি যখন তিনি আমাদের তার গর্ভে ধারণ করে রেখেছিলেন। তারপর আমরা এই ধরণের ভাবনা প্রসারিত করি যে কীভাবে প্রত্যেকে আমাদের আগের জন্মে কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছিলেন।

অনেকে এই বিষয়ের উপর যখন পাশ্চাত্য লোকজনদের শিক্ষা দেয় তখন তারা বলে, ঠিক আছে, যদি আপনার মায়ের সাথে আপনার সমস্যা থাকে তাহলে তার পরিবর্তে আপনি আপনার পিতা, ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথবা অন্য যে কেউ যিনি আপনার উপর কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছেন তার বিষয়ে ভাবতে পারেন। এইভাবে আপনি এই ধ্যানটি করার চেষ্টা করতে গিয়ে মাঝখানে আটকে থাকবেন না। আমি মনে করি এটা একটা সহায়ক উপায়। তবে আমার মনে হয় এটা খুব গুরুত্বপূর্ণও। কারণ যদি আমাদের মায়েদের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় তাহলে সমস্যাটার সমাধান করা উচিত না কি অবহেলা করা উচিত। আমরা যদি আমাদের মায়ের সাথে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক না রাখতে পারি তাহলে অন্য কারও সাথে সুস্থ স্নেহপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা খুব কঠিন হয়ে উঠবে। ফলে সেখানে সবসময় একটা না একটা সমস্যা হতেই থাকবে। অতএব আমি মনে করি আমাদের মায়ের সাথে আমাদের প্রকৃত সম্পর্কটি যতই কঠিন হয়ে থাকুক না কেন বা বর্তমানে কঠিন হয়ে উঠুক না কেন আমাদের পক্ষ থেকে তার দিকে ধ্যান দেওয়া এবং তার কৃতজ্ঞতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত আমাদের আদর্শ মাতৃস্নেহের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলি এর বর্ণনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছেঃ উদাহরণস্বরূপ, এই ধরণের স্নেহ আপনি অনেক প্রাণীদের মধ্যে দেখতে পান। একটি মা পাখি তার যতই শীত বা গরম লাগুক না কেন সে কিন্তু তার ডিমের উপর বসে তা দিতে থাকে আর যখন ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে যায় সে পোকামাকড় ধরে আর চিবাতে থাকে। তারপর সে সেটাকে নিজে না গিলে খেয়ে তার ছানাগুলিকে খাওয়ায়। এটা সত্যিই বেশ অসাধারণ।

অবশ্যই পশু এবং পোকামাকড়ের জগতে এরকম উদাহরণও দেখতে পাওয়া যায় যেখানে মা তাদের সন্তানদের খেয়ে ফেলে তবে সন্তানদের জন্ম দেওয়ার জন্য নিঃসন্দেহে তারা কষ্টগুলি ভোগ করেছে। আর বর্তমানে সে আমার জৈবিক মা হোক বা স্থানাপন্ন মা, কমপক্ষে কেউ তো আমাকে গর্ভে ধারণ করে রেখেছিল। এমনকি আমরা যদি টেষ্টটিউবের মাধ্যমে জন্ম নিয়ে থাকি তাহলে কেউ তো টেষ্টটিউবটার দেখাশোনা করেছিল এবং সঠিক তাপমাত্রায় রেখেছিল। আমাদের মা আমাদেরকে গর্ভে ধারণ করে রাখতে চেয়েছিলেন কিনা সেটা অপ্রাসঙ্গিক, তবে এটা তার অবিশ্বাস্য কৃতজ্ঞতাই ছিল যে তিনি গর্ভপাত না করে তিনি গর্ভে ধারণে করে রেখেছিলেন; এটা তার পক্ষে মোটেই আরামদায়ক ছিল না। আসল জন্মের সময়ও তিনি অত্যন্ত পীড়া সহ্য করেছিলেন। তদুপরি, আমরা যখন শিশু ছিলাম তখন কাউকে আমাদের জন্য মধ্যরাতে জাগতে হয়েছিল; আমাদের খাওয়াতে হয়েছিল এবং যত্ন নিতে হয়েছিল; অন্যথা আমরা জীবিত থাকতে পারতাম না। এই ধরণের জিনিসগুলি প্রাচীন শাস্ত্রীয় গ্রন্থে জোর দিয়ে বর্ণনা করা আছে।

যদি আমাদের মায়ের সাথে আমাদের সমস্যা হয় তাহলে আমি মনে করি যে পঞ্চম দালাই লামার মার্গক্রম (লাম-রিম) নামক গ্রন্থে বর্ণিত গুরু-ধ্যান-সাধনা থেকে একটা সূত্র নিতে পারি কীভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পূর্ববর্তী অনেক গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে যে যার মধ্যে শুধু ভালো গুণ বিদ্যমান আছে সেই ধরণের গুরুর সন্ধান পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কোনো আধ্যাত্মিক গুরু আদর্শ হতে পারেন না; সকলের মধ্যে শক্তিশালী এবং দুর্বল বিষয়ের মিশ্রণ আছে। সুতরাং আমরা আধ্যাত্মিক গুরুর ধ্যান সাধনায় যেটা করতে চাই সেটা হল তার ভালো গুণ এবং কৃতজ্ঞতার উপর মনোনিবেশ করা যাতে আমরা তার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, অনুপ্রেরণা এবং প্রশংসার বিকাশ করতে পারি। এটি আমাদের ভালো গুণাবলী এবং কৃতজ্ঞতা বিকশিত করতে অনুপ্রেরণা করে।

পঞ্চম দালাই লামা ব্যাখ্যা করেছেন এটা করার প্রক্রিয়াতে আমাদের নিজেদের শিক্ষকের অক্ষমতা এবং ভুল-ত্রুটিগুলিকে অস্বীকার করার কোন প্রয়োজন নেই। সেটা করলে মূর্খতা হবে। আমরা ভুল-ত্রুটিগুলিকে স্বীকার করি, তবে মুহুর্তের মধ্যে সেগুলিকে আলাদা করে রাখি, কারণ শিক্ষকের ভুল-ত্রুটিগুলির সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব জাগবে। এটা আমাদের জন্য একেবারেই প্রেরণামূলক হবে না। শুধুমাত্র তার ভাল গুণাবলী এবং কৃতজ্ঞতার উপর মনোনিবেশ করেই অনুপ্রেরণা লাভ করা যায়।

সুতরাং প্রথমে আমরা ভুল-ত্রুটিগুলি স্বীকার করি। তবে আমাদের সততার সাথে পরীক্ষা করতে হবে যে সেগুলি সত্যিই কি ভুল-ত্রুটি, না আমাদের দ্বারা নির্মিত কল্পনা মাত্র। যদি ভুল-ত্রুটিগুলি সত্যি না হয়ে অভিক্ষেপমাত্র হয় তাহলে আমাদের সেগুলিকে পুরোপুরি ত্যাগ করে দিতে হবে। এরপরে আমাদের পরীক্ষা করতে হবে, যে অকাল্পনিক ভুল-ত্রুটিগুলি যা শিক্ষকের মধ্যে রয়েছে সেগুলি বর্তমানের না পুরোনো ইতিহাস সম্পর্কিত যেগুলি আমরা ত্যাগ করতে চাই না। যদি ভুল-ত্রুটিগুলি বর্তমান সম্পর্কিত না হয়, তাহলে আমাদের তার উপর বিচার করা বন্ধ করে দেওয়া উচিত, কারণ সেগুলি আর প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে না। বর্তমানের ভুলগুলি আসলে কী তার বিষয়ে একবার স্পষ্ট হয়ে গেলে আমরা বলি ঠিক আছে সেগুলি তার বর্তমান ভুল-ত্রুটি। তারপরে আমরা এক মুহুর্তের জন্য পাশে রেখে দিই আর তার পরিবর্তে শুধু ভাল গুণাবলীর দিকে মনোনিবেশ করি।

আমি মনে করি যে আমাদের মায়ের কৃতজ্ঞতা সম্পর্কে বিচার করার সময় এই ধরণের পদ্ধতিটি উপযুক্ত হয় এবং এটা খুব ভালোভাবে কাজ করে। বাস্তবে কারও মা আদর্শ হয় না। আমরা নিজেরাই যদি মাতা-পিতা হয়ে থাকি তাহলে আমরা বুঝি যে আদর্শ মাতা-পিতা হওয়া অবিশ্বাস্য ভাবে কঠিন। তাই আমাদের মাতা-পিতা যে আদর্শ ছিলেন এমন আশা করা উচিত নয়। তারপরে আমরা আমাদের মায়ের মধ্যে ভুল-ত্রুটি এবং অক্ষমতা আছে অথবা ছিল সেগুলিকে দেখার চেষ্টা করি আর জানার চেষ্টা করি সেগুলির হেতু এবং প্রত্যয় কী ছিল যার কারণে ভুল-ত্রুটিগুলি ঘটেছে। তিনি তো সহজাতভাবে একজন খারাপ ব্যক্তি নন, যেমনকি কোন চিত্ত-সন্ততি সহজাতভাবে একটা মশা হয় নয় (যা সহজাতভাবে বিরক্তিকরও নয়)। আমরা নিশ্চিত করি যে আমরা ভুল-ত্রুটিগুলি মায়ের উপর উদ্ভাবন করি না অথবা শুধু তাদের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে নজর দিই না। এরপরে আমরা সমস্ত কাল্পনিক ভুল-ত্রুটিগুলি সেই মুহুর্তের জন্য একপাশে সরিয়ে দিই। আর ভুলে যাই সমস্ত অতীত এবং বর্তমানের ভুল-ত্রুটিগুলিও। আমরা বলি ঠিক আছে, তারমধ্যে ভুল-ত্রুটি এবং ছিল, কিন্তু অন্য সকলের মতো তিনিও একজন মানুষ; দোষ আমাদের সকলের মধ্যে আছে। তারপর আমরা সেই ভালো গুণাবলী এবং কৃতজ্ঞতা সম্পর্কে ভাবি যা তিনি আমাদের জন্য করেছেন।

একজন পাশ্চাত্য ধার্মিক শিক্ষক- আমি ভুলে গিয়েছি তিনি ঠিক কে ছিলেন- আমাকে ধ্যানের একটি পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমি মনে করি সেটা খুবই উপকারী। এই মূহুর্তে আমাদের মায়েদের নেতিবাচক গুণাবলীকে একপাশে রেখে আমরা পাঁচ বা দশ বছরের মাত্রায় ভাগ করে পরীক্ষা করি। আমরা পাঁচ মিনিট, আধ ঘন্টা, এক ঘন্টা অথবা যতটুকু সময় এই কাজের জন্য ব্যয় করতে চাই ঐ সময়ে আমরা পরীক্ষা করি এবং স্মরণ করার চেষ্টা করি যে আমাদের মায়েরা ঐ পাঁচ বা দশ বছরের দীর্ঘ সময়ে আমাদের জন্য কী কী করেছেন। প্রথমতঃ আমরা যখন তার গর্ভে ছিলাম সেই সময় থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত আমরা স্মরণ করি তিনি কীভাবে আমাদের ডায়াপার (নেংটি) পালটে দিয়েছিলেন, আমাদের খাবার খাইয়েছিলেন, স্নান করিয়েছিলেন আর অন্য সমস্ত কিছু করে আমাদের লালন-পালন করেছিলেন। এরপর পাঁচ থেকে দশ বছর পর্যন্ত যা কিছু করেছেন তার বিষয়ে ভাবি। তিনি আমাদের স্কুলে নিয়ে গেছেন- হতে পারে তিনি আমাদের বাড়ির কাজে সহযোগিতা করেননি; এটাও হতে পারে তিনি করেছিলেন; আমাদের জন্য রান্না করেছিলেন; আর আমাদের জামাকাপড় ধুয়েছিলেন। যখন আমরা কিশোর অবস্থায় পৌঁছেছিলাম সম্ভবতঃ তিনি আমাদের জন্য টাকা-পয়সা ব্যয় করেছিলেন। আমার মায়েরা যতই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠুক না কেন নিঃসন্দেহে আমাদের প্রতি তাদের অনেক কৃতজ্ঞতা ছিল যেটা তারা আমাদের জীবনের প্রতিটি অবস্থায় করেছিলেন।

তারপর একইভাবে আমরা আমাদের পিতা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদিদের সম্পর্কে ভাবতে পারি। ধ্যানের পক্ষে এটা অত্যন্ত উপকারী। এটা বিশেষ করে হতাশার জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিষেধক যা আমরা মাঝে মাঝে অনুভব করি, “কেউ আমাকে ভালোবাসে না।” এইভাবে আমরা যদি এই জীবনে আমাদের মাতৃস্নেহের কথা ভাবি তাহলে এটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে যে প্রত্যেকেই একইভাবে আমাদের জন্য কৃতজ্ঞ হয়েছেন। কেউ একজন আদর্শ মা হতে পারেননি- অবশ্যই, তিনি কোন এক জীবনে কোন এক সময় আমাদের ভক্ষণও করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি আমাদের প্রতি স্নেহও দেখিয়েছেন।

মাতৃস্নেহের কৃতজ্ঞতার প্রতিদান (মাতৃ ঋণ শোধ করা)

সপ্তাংশ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার তৃতীয় ধাপটি হল আমাদের দ্বারা গৃহীত মাতৃস্নেহের কৃতজ্ঞতার প্রতিদান করার ইচ্ছা বিকশিত করা। এরজন্য আমরা কল্পনা করি যে আমার মায়েরা অন্ধ এবং একেবারে বিভ্রান্ত আর সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত; তারা পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে এবং দুঃখের খাদে পড়তে চলেছে। তাদের পুত্র অথবা কন্যা হয়ে আমরা কল্পনা করি যে আমরা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছি এবং জানি খাদে পড়ে যাওয়া থেকে তাদের কীভাবে রক্ষা করা যায়। তাদের সন্তান হয়ে আমরা যদি তাদের সহায়তা না করি তাহলে কে করবে? তারা কার দিকে মুখ চেয়ে থাকবে? এই ধরণের ভাবনা তাদেরকে সব ধরণের দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের কৃতজ্ঞতার প্রতিদান করার আন্তরিক ইচ্ছা বিকাশে সহায়তা করে।

আমাদের ইচ্ছাকে আরও প্রবল করার জন্য আমরা মাতৃস্নেহের প্রতি যে যত্ন দেখিয়েছি তার স্মরণ করার সম্পর্কে আমরা ধ্যান থেকে আরও গ্রহণ করতে পারি। আবার আমরা পাঁচ অথবা দশ বছরের সময়কালে নিজের জীবনের বিষয়ে ভাবতে পারি এবং পরীক্ষা করতে পারি যে কীভাবে আমরা আমাদের মায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে আমরাও কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছি। এই প্রক্রিয়াটি আমরা আমাদের পিতা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদির সাথে একইভাবে করতে পারি।

আমরা যদি তুলনা করি যে আমরা কতটুকু ভালোবাসা এবং সহায়তা পেয়েছি ও পরিবর্তে কতটুকু দিয়েছি। তাহলে আমরা বেশির ভাগই দেখতে পাব আমরা যা দিয়েছি তার তুলনায় আমরা যা পেয়েছি সেটা অনেক বেশি। তবে এর পিছনের ভাবার্থটা এই নয় যে এরকম করে আমরা নিজেদেরকে দোষী মানবো। এটা একধরণের সামান্য স্নায়বিক পাশ্চাত্য প্রতিক্রিয়া হবে। মূল বিষয়টি হল বোধিচিত্তের ধ্যানের পরবর্তী পদক্ষেপে আমাদের সহায়তা করা। আর এর উদ্দেশ্য হল আমরা যে কৃতজ্ঞতা লাভ করেছি তার উপলব্ধি করে গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ বিকাশ করা এবং ঐ কৃতজ্ঞতার প্রতিদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করা। আমি দেখতে পাই এখন যে ধ্যান সাধনার বিষয়ে যে রূপরেখাটি তৈরী করা হয়েছে সেখানে এইভাবে পরিবর্তন করলে আমাদের হৃদয়কে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে খুব সহায়ক হয় যাতে আমরা প্রকৃতপক্ষে কিছু অনুভব করি আর আমি এটাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমি অনেক পাশ্চাত্য বৌদ্ধদের দেখেছি যারা মৈত্রী এবং করুণার উপর ধ্যান-সাধনাগুলি করে এবং তারা বাইরে যায় আর অন্যদের সহায়তা করে। কিন্তু মা-বাবার সাথে তাদের একটা ভয়ঙ্কর সম্পর্ক থাকে এবং তারা তাতে বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। আমি মনে করি এই সাধনাটি তাদের সম্পর্ককে শুধরানোর ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক হবে। আর এটাকে কঠিন মনে করে ত্যাগ করা উচিত না।

অনুশীলন প্রয়োগের জন্য প্রস্তাবিত পদ্ধতি

এই সব পদক্ষেপগুলির প্রত্যেকটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ হল আমাদের অনুশীলনের পরিধি সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে প্রসারিত করার চেষ্টা করা। প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা অবশ্যই ছোট থেকে শুরু করতে পারি। তারপর ধীরে-ধীরে আমাদের পরিধিকে প্রসারিত করতে হবে। প্রত্যেক সত্ত্বকে ব্যক্তিগত চিত্ত-সন্ততি সম্পন্নরূপে দেখে সমতার ভিত্তিতে আমরা এটা করি। এটা করার একটা কার্যকর উপায় যেটা আমি খুঁজে পেয়েছি তার অর্থ হল এই নয় যে শুধু চোখ বন্ধ করে বসে ধ্যান করা এবং বিমূর্তভাবে সমস্ত প্রাণীদের সম্পর্কে ভাবা। আমার মতে যেটা আরও বেশী কার্যকর সেটা হল সামঞ্জস্যপূর্ণ আবেগ বিকাশের জন্য সংবেদনশীলতা প্রশিক্ষণে আমি যেভাবে পরামর্শ দিই সেইভাবে অনুশীলন করা।

অন্যকথায়, বন্ধু-বান্ধব, এমন ব্যক্তি যাকে আমরা পছন্দ করি না এবং অপরিচিত লোকজনদের মতো বিভিন্ন ব্যক্তির ফটোকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করার সময় সর্বপ্রথম তাদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বিকাশ করার চেষ্টা করুন। তারপরে একটি ধ্যান গোষ্ঠীতে আমাদের চারপাশে বৃত্তাকারে উপবিষ্ট প্রকৃত লোকজনদের দিকে তাকিয়ে তাদের বিকশিত করার চেষ্টা করুন। এরপর ভূ-গর্ভস্থ পথ বা বাসে বসে থাকা লোকজনদের প্রসঙ্গে এর অভ্যাস করার চেষ্টা করুন। এইভাবে আমরা প্রকৃতপক্ষে অন্যদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বিকাশের চেষ্টা করি।

একইভাবে আমরা এই অনুশীলনটি পশু, পোকা-মাকড় ইত্যাদির প্রতিও প্রয়োগ করার চেষ্টা করতে পারি। আর এটা শুধু আমাদের মনে তাত্বিকভাবে নয় বরং আমরা যখন বাস্তবে তাদের দেখি তখন এটাকে অনুশীলন করার চেষ্টা করতে পারি। এটা করার সময় আমাদের চরমপন্থাকে এড়িয়ে চলতে হবে। এর উদাহরণ হিসাবে, আমাদের কখনো-কখনো মানুষের তুলনায় পোকা-মাকড়ের প্রতি সদয় হওয়া বেশি সরল বলে মনে হয়। যদি মন্দিরের মাঝখানে একটা পিঁপড়ে থাকে তখন প্রত্যেকে একটা চরম পন্থার দিকে এগিয়ে যায় যাতে এই পিঁপড়েটির কোন ক্ষতি না হয়। কিন্তু প্রায়শই তারা একই ধরণের উদ্বেগ এবং দয়া মানুষের প্রতি দেখায় না, উদাহরণ স্বরূপ, যখন ভারতীয় ও বিদেশীরা তাদের মন্দিরে যায় এবং তারা যা কিছু দেখে আর তার সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক হয়। আমাদের এখানে একটি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে হবে।

কিছু লোক বলতে পারে মানুষের চেয়ে পিঁপড়েকে সাহায্য করা বেশি সহজ, কারণ পিঁপড়ে আপনার সাথে ফিরে কথা বলবে না আর আপনার জন্য সমস্যা তৈরী করবে না যেমনটা মানুষ প্রায়শই করে। আপনি একটা পিঁপড়েকে ধরে বাইরে নিয়ে যেতে পারেন কিন্তু মানুষ বিরক্ত করলেও আপনি পুরোপুরিভাবে সেটা করতে পারেন না। যাইহোক আমার বক্তব্য হল “সমস্ত প্রাণী”-এর নামে অনেকে বিমূর্তভাবে ধ্যানগুলি করে কিন্তু “বাস্তবিক জগৎ”-এ সেটা প্রয়োগ করে না। এই কারণে এটা কোন পথে অগ্রগতি করতে একটি বড় ধরণের সমস্যার সৃষ্টি করে।

মহামৈত্রী

আমরা যখন সকলকে আমাদের মা বলে উপলব্ধি করি, মাতৃস্নেহের কৃতজ্ঞতা স্মরণ করি এবং কৃতজ্ঞতার সাথে তার সহৃদয়তা পরিশোধ করার চিন্তা-ভাবনা করি তখন স্বাভাবিকভাবে আমাদের মধ্যে একধরণের মনোজ্ঞ মৈত্রী বা ভালোবাসার অনুভূতি জাগে। যখন আমাদের কারও সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয় তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার প্রতি ঘনিষ্ঠতা এবং উষ্ণতার অনুভূতি জাগে। এই অনুভূতিটি বিকাশের জন্য আলাদা ধ্যানের কোন ধাপের প্রয়োজন নেই। একে লালন, উদ্বিগ্ন ভালোবাসা বলা হয়। আর যে ভালোবাসার সাথে আমরা কাউকে লালন করি, তার কল্যাণ করার জন্য উদ্বিগ্ন হই এবং তারসাথে কোন রকমের খারাপ কিছু ঘটলে আমাদের খুব খারাপ লাগে।

মনোজ্ঞ মৈত্রীর উপর ভিত্তি করে আমরা চতুর্থ পদক্ষেপটি অর্থাৎ মহামৈত্রী ধ্যানের দিকে অগ্রসর হই। মৈত্রী শব্দের অর্থ হল অন্য কারও জন্য সুখী হওয়ার কামনা করা, সাধারণত আমরা যাকে পছন্দ করি। তবে মহামৈত্রীর অর্থ হল সমস্ত প্রাণীদের জন্য সুখ এবং সুখের কারণে সম্পন্ন হওয়ার কামনা। এটা সত্যিই খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে এখানে সুখ এবং সুখের কারণ উভয়কে থাকতে হবে। এর অর্থ হল আমাদের মধ্যে এই বিষয়ের পূর্ণ বোধগম্যতা থাকতে হবে যে সুখের জন্ম হয় কারণ থেকে, কোন দেবী-দেবতার অনুগ্রহ বা সৌভাগ্য থেকে নয়, আর তার কারণ আমিও নই।

কর্ম সম্পর্কিত উপদেশে সুখের কারণগুলি উল্লেখ করা হয়েছেঃ মানুষ যদি আসক্তি, ক্রোধ ইত্যাদি রহিত হয়ে গঠনমূলক কর্ম করে তাহলে তারা সুখ ভোগ করবে। তাই এখানে আমাদের ভাবতে হবে, “আপনি সুখ এবং সুখের কারণে সম্পন্ন হন! আপনিই প্রকৃতপক্ষে গঠনমূলক এবং স্বাস্থ্যকর উপায়ে কর্ম করুন যাতে আপনি সুখ ভোগ করতে পারেন।”

ইতিমধ্যে এই পদক্ষেপটি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই বোধিচিত্ত ধ্যানগুলিতে আমরা সকলকে সহয়তা করতে বুদ্ধ হওয়ার জন্য চেষ্টা করি, কিন্তু তাদের সহায়তা করতে আমরা আমাদের ভূমিকার প্রসার করতে পারি না। আমরা অপরকে পথ দেখাতে পারি কিন্তু তাদের সুখের কারণগুলি তাদের নিজেদেরকেই নির্মাণ করতে হবে।

মহাকরুণা

এরপর আসে পঞ্চম পদক্ষেপ অর্থাৎ মহাকরুণাঃ সমস্ত সত্ত্ব দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হোক এই কামনা। এর ক্ষেত্রে আমরা একইরকম ভাবে পূর্ণ বোধগম্যতা বিকাশ করি যে তাদের দুঃখ কোন কারণ থেকে উদ্ভূত হয় এবং তাদের দুঃখকে নিবারণ করার জন্য ঐ কারণগুলির নিবারণ করা প্রয়োজন। এটি একটি খুবই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি। মহামৈত্রী এবং মহাকরুণা কেবল সংবেদনশীল অনুভূতি নয় যেমন, “সকলেই দুঃখ ভোগ করছে তার জন্য আমি দুঃখিত।” বরং সেগুলি আচরণগত কারণ এবং ফলের বোধগম্যতার সাথে যুক্ত থাকে।


মহাকরুণা অনেক ভাবে সাধারণ করুণাকে অতিক্রম করেঃ

  • মহাকরুণা কিছু প্রাণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সমস্ত সীমাবদ্ধ প্রাণীদের জন্য সমানভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
  • মহামৈত্রীর মতো এতেও একমাত্র সন্তানের প্রতি তার মায়ের স্নেহের মতো প্রত্যেকটি প্রাণীকে লালন-পালনে গুরুত্ব দেয় এবং উদ্বিগ্ন থাকে আর তার সুরক্ষা করে এবং নিরাপদে রাখে।
  • এটির অর্থ হল উক্ত প্রত্যেকটি প্রাণীদের জন্য কামনা করা যে তারা যেন উপাদান-স্কন্ধ সহ বারবার এবং অনিয়ন্ত্রিত পুনর্জন্মের সংস্কার দুঃখ থেকে মুক্ত হয়। কারণ এর ফলে উদ্ভূত হয় বিভ্রান্তি, মিশ্রিত বিভ্রান্তি এবং এটা আরও বেশি বিভ্রান্তি তৈরী করে এবং সৃষ্টি করে চিরস্থায়ী দুঃখ। সুতরাং এটা শুধুমাত্র অন্যদের জন্য এই কামনা করাকে বোঝায় না যে তারা যেন দুঃখ-দুঃখতা এবং বিপরিণাম দুঃখতা থেকে মুক্ত হয়। বিপরিণাম দুঃখতা বলতে সাধারণ পার্থিব সুখকে বোঝায় যা কখনোই চিরস্থায়ী হয় না এবং সন্তুষ্টি প্রদান করে না। মহাকরুণার অর্থ এই কামনা নয় যে প্রাণীরা সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে স্বর্গলোকে গমণ করতে পারে।
  • মহাকরুণা দৃঢ় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে, যে সমস্ত সীমাবদ্ধ প্রাণীদের পক্ষে সংস্কার দুঃখতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এটা শুধু একটি সুন্দর কামনা নয়।

মহাকরুণাকে সর্বদা ত্যাগের মনোভাবের মতো বর্ণনা করা হয়। ত্যাগ বলতে মুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্পকে বোঝায়। আবার ত্যাগ হল এমন একটা মনোভাব যা আমাদের নিজস্ব দুঃখ, তাদের কারণ এবং সেগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার কামণাকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে। আমাদের নিজস্ব দুঃখ এবং তাদের কারণগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার আমাদের দৃঢ় সংকল্পের উপর ভিত্তি ক’রে আমরা অন্যের প্রতি সহানুভূতি বিকাশ করতে পারি। আমরা যেটা করি সেটা হল নিজেদের জন্য যে কামনা করি সেই ধরণের একই মনোভাবকে পরিবর্তন ক’রে তাদের দিকে পরিচালনা করা এবং তাদের দুঃখ ও দুঃখের কারণগুলির দিকে পরিচালনা ক’রে তার থেকে মুক্ত হওয়ার কামনা করা।

প্রায় সবসময় এরকম বলা হয় যে, আমরা আমাদের নিজেদের দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা না ক’রে এবং নিজেরা তার থেকে মুক্ত হতে না চাইলে অন্যের প্রতি সহানুভূতি জাগানো এবং প্রকৃতপক্ষে করুণার বিকাশ করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এইরকম পরিস্থিতিতে আমাদের জানতে হবে যে অন্যরা সত্যিই তাদের দুঃখের কারণে বেদনা অনুভব করে এবং তাদের দুঃখ-কষ্টের অনুভব তাদের তেমনই পীড়া দেয় যেমন আমাদের দুঃখ আমাদের কষ্ট দেয়। এই বোধগম্যতাটি বুঝিয়ে দেয় যে আমাদের নিজস্ব দুঃখ আমাদেরকে কষ্ট দেয়। অন্যথা আমরা অন্যের দুঃখ-কষ্টকে গম্ভীর ভাবে নিই না। মনে রাখবেন আমরা কামনা করছি আমাদের মায়েদের জন্য যারা আমাদের প্রতি সহৃদয়তার সাথে আচরণ করেছেন তারা যেন সুখী হয় এবং দুঃখ থেকে মুক্ত হয়। আমরা ধ্যান শুরু করি আমাদের মা ইত্যাদিদের সাথে যাতে ধ্যান সাধনার সময় প্রকৃতপক্ষে কিছু অনুভূতি জাগে।

হীন আত্ম-সম্মান দূরীকরণে সহায়তার জন্য পদ্ধতিটি প্রসারিত করা

গ্রন্থে যেমন বর্ণনা করা আছে যে করুণা শুধু তখনই আন্তরিকতার সাথে বিকাশ লাভ করতে পারে যখন আমরা প্রথমে নিজেদেরকে দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হওয়ার কামনা করি। তবে আমি মনে করি যে, মৈত্রীর ক্ষেত্রেও আমরা একই নীতি অনুসরণ করতে পারি। এটি আমাদের মধ্যে যারা হীন আত্ম-সম্মানে ভুগছেন তাদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। হীন আত্ম-সম্মান বিশেষ করে একটি পাশ্চাত্য ঘটনা; তিব্বতী বা ভারতীয়দের মধ্যে এই বিষয়ে এমন ঘটনা বেশী ঘটে না। অন্যরা সুখী হওয়া এবং সুখের কারণে যুক্ত হওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করার আগে আমাদের নিজেদেরকে সুখী হওয়া এবং সুখের কারণে যুক্ত হওয়ার জন্য আন্তরিক ভাবে প্রার্থনা করা প্রয়োজন। যদি আমরা মনে করি আমরা সুখী হওয়ার যোগ্য নই তাহলে অন্য কেউ সুখী হওয়ার যোগ্য কেন হবে?

নিজেরা সুখী হওয়ার কামনা করা হল ধ্যানের একটি পদক্ষেপ। অতএব আমি মনে করি যে আমরা যদি হীন আত্ম-সম্মানে ভুগি তাহলে আমরা যদি ঐ ভাবনাটাকে এর সাথে যুক্ত করে নিই তাহলে আমরা নিরাপদে থাকতে পারি। আমি মনে করি এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক প্রাণী সুখী হওয়ার যোগ্য, এই ধরণের চিন্তা-ভাবনার অভ্যাস বিকাশ করলে এটা আমাদের তথাগতগর্ভ সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিতে সহায়ক হয়। আমরা সকলেই কিন্তু খারাপ নই; বাস্তবে কেউই পুরোপুরি ভাবে খারাপ হয় না। আমাদের সকলের মধ্যে বুদ্ধ হয়ে ওঠা, পরকল্যাণ করা, সুখী হওয়া ইত্যাদির সম্ভাবনা রয়েছে।

আর একটি বিষয়ঃ থেরবাদ ও অন্যান্য হীনযান নিকায়েও মৈত্রী এবং করুণাকে বিকশিত করার অনুশীলন করা হয়। তবে সেখানে তাদের ধ্যানের পদ্ধতিতে এই ধরণের সপ্তাংশ কারণ এবং ফল ধ্যানের পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করা হয় না, যা মাতৃস্নেহকে স্মরণ করার মতো কারণগুলির উপর ভিত্তি ক’রে মৈত্রী এবং করুণা বিকশিত করতে সহায়তা করে। তবে এই বলে আমাদের ভাবা উচিত নয় যে থেরবাদ পরম্পরায় মৈত্রী এবং করুণার ধ্যান-সাধনা করা হয় না। তবে বোধিচিত্ত ধ্যানের পরবর্তী পদক্ষেপগুলি সেখানে নেই।

অসাধারণ সংকল্প

বিভিন্ন অনুবাদকগণ ষষ্ঠ পরবর্তী পদক্ষেপটিকে আলাদা-আলাদা ভাবে অনুবাদ করেন। কেউ কেউ এটাকে বলেন “শুদ্ধ নিঃস্বার্থ কামনা”। পরম পূজ্য দালাই লামা এর জন্য ‘সার্বজনীন’ দায়িত্ব শব্দটি ব্যবহার করেন। যদিও আমি নিজেই এটাকে বিভিন্ন ভাবে অনুবাদ করেছি, তবে, এই মুহুর্তে আমি এটাকে “অসাধারণ সংকল্প” শব্দটি পছন্দ করব। সমস্ত প্রাণীদের কল্যাণ করার জন্য মহাকরুণার সাথে আমাদের মধ্যে থাকে পূর্ণ ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্য। এখানে আমরা একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা অবশ্যই এটা করতে চলেছি। অন্যের কষ্ট সম্পর্কে কিছু করার জন্য আমরা নিজেই দায়িত্ব গ্রহণ করি। যদি কেউ একটি হ্রদে ডুবতে থাকে তাহলে আমরা তার কূলে দাঁড়িয়ে শুধু বলতে পারি না, “ঈশ! ঈশ! এরকম না হলে ভালো হতো।” এখানে আমাদের প্রয়োজন বাস্তবে ঝাঁপ দিয়ে ঐ ব্যক্তিটিকে সাহায্য করার চেষ্টা করা। ঠিক তেমনই এখানে বোধিচিত্ত ধ্যানে যতদূর সম্ভব আমাদের সকল প্রাণীকে সহায়তা করার জন্য সার্বজনীন দায়িত্ব নেওয়ার পূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বোধিচিত্ত লক্ষ্য

কারণ হিসাবে এই ছয়টি পদক্ষেপের বিকাশের ভিত্তিতে সপ্তম পদক্ষেপ অর্থাৎ ফলরূপী বোধিচিত্ত লক্ষ্যটি বিকশিত হয়। আমরা যখন পরীক্ষা করি আমাদের বর্তমান সীমাবদ্ধতা এবং বিরক্তিকর আবেগ এবং মনোভাবের সাথে কীভাবে অন্যের সবচেয়ে বেশি কল্যাণ করতে পারি তখন আমরা বুঝতে পারি আমরা সত্যিই খুব বেশি সহায়তা করতে পারব না। আমরা যদি স্বার্থপর এবং অধৈর্য হই, কিছু লোকের প্রতি আকৃষ্ট হই আর অন্যের প্রতি ক্রোধিত, অলস হয়ে পড়ি, আমরা যদি সর্বক্ষণ ক্লান্ত হয়ে থাকি, আমরা যদি সত্যিই অন্যকে বুঝতে না পারি, আমরা যদি সঠিকভাবে অন্যের সাথে যোগাযোগ না রাখতে পারি, আমরা যদি অন্যদের ভয় পাই তাহলে এই সমস্ত জিনিস সত্যিই আমাদের যথাসম্ভব সহায়তা করা থেকে বাধা সৃষ্টি করবে। সুতরাং যেহেতু আমরা সত্যিই সহায়তা করতে চাই, তাই আমাদের এই সমস্ত জিনিস থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের সত্যিই নিজেকে শুধরাতে হবে এবং এই সমস্ত জিনিস থেকে বিরত থাকতে হবে যাতে আমরা বাস্তবে আমাদের প্রতিভা, ক্ষমতা এবং তথাগতগর্ভের গুণাবলীগুলি ব্যবহার করতে পারি পরকল্যাণার্থে। আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে যে, “যতটা সম্ভব”- আমরা কোন সর্বশক্তিমান হতে যাচ্ছি না। এই চিন্তা-ভাবনার ভিত্তিতে প্রত্যেককে যথাসম্ভব সম্পূর্ণরূপে সহায়তা করার জন্য বুদ্ধ হয়ে উঠতে আমরা আমাদের মন ও হৃদয়কে স্থাপন করি। এটাই হল বোধিচিত্ত লক্ষ্যের বিকাশ। এই লক্ষ্যের সাথে আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা অর্জন করতে এবং অন্যদের এই অর্জনে সহায়তা করার উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যক্তিগত বোধিলাভের উপর মনোনিবেশ করি যেটা এখনও লাভ হয়নি।

বোধিসত্ত্বের আচরণ/ বোধিসত্ত্ব চর্যা

একবার আমরা বোধিচিত্ত বিকাশ করে ফেললে আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অন্যকে যথাসম্ভব সহায়তা করার চেষ্টা করি। এর কারণ হল অন্যদের সহায়তা করার দায়িত্ব নেওয়ার অসাধারণ সংকল্প নিয়ে ফেলেছি, যা আমরা ইতিমধ্যে বোধিচিত্ত ধ্যানের পূর্ববর্তী সপ্তাংশ কারণ এবং ফলের পদক্ষেপগুলির সময় বিকশিত করেছি। এর অর্থ হল আমরা যখনই অন্যের মুখোমুখি হই এবং দেখি যে তাদের সমস্যা হচ্ছে, উদাহরণ স্বরূপ তারা গৃহহীন, আমরা তখন তাদেরকে কেবল গৃহহীন ব্যক্তি হিসাবে দেখি না, বরং আমরা যখন তাদেরকে দেখি তখন আমরা ভাবি না যে তারা সহজাতভাবে গরীব, অলস অথবা যেকোন মূল্যবোধের বিচার তাদের সম্পর্কে কল্পনা করি। পরিবর্তে আমরা উপলব্ধি করি যে শুধু এই জন্মে এই নির্দিষ্ট সময়ে আর এই নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের অবস্থা এইরকম। যাইহোক, তাদের চিত্ত-সন্ততি হল অনাদি এবং কোন একসময় তারা আমাদের মা হয়েছেন আর স্নেহের সাথে আমাদের যত্ন নিয়েছেন। তারা আমাদেরকে তাদের গর্ভে ধারণ করেছেন, আমাদের নোংরা ডায়াপার পালটে দিয়েছেন এবং এরকম আরও অনেক কিছু। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ আর সত্যিই আমি এই কৃতজ্ঞতার পরিশোধ করতে চাই। আমরা কামনা করি যে তারা যেন সুখী হয় আর সুখের কারণে যুক্ত হয়। পাশাপাশি তারা যেন দুঃখ এবং দুঃখের কারণগুলি থেকে মুক্ত হতে পারে। এই বিষয়ে কিছু করার চেষ্টা করতে আমরা দায়িত্ব নিতে চাই।

আমাদের কী করতে হবে, এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলি কাটিয়ে ওঠার জন্য বাড়ি গিয়ে ধ্যান-সাধনা করা আর এই ধরণের লোকজনদের সহায়তা করার জন্য বাস্তবে কিছু করার প্রয়োজন নেই। অবশ্যই আমাদের আরও ধ্যান-সাধনা করার প্রয়োজন আছে, তবে এই মুহুর্তে যা আমাদের অনুপ্রাণিত ক’রে সেটা হল আমাদের লজ্জা, দ্বিধা এবং কৃপণতার উপর বিজয় লাভ করা আর বাস্তবে তাদের কিছু দেওয়া, অন্ততঃপক্ষে তাদের প্রতি একটু মুচকি হাসি অর্থাৎ কমপক্ষে কিছু করা উচিত।

অন্য কথায় আমরা যতটা সম্ভব এই মুহুর্তে আমাদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে প্রেরিত হওয়ার জন্য, আর যতটা সম্ভব অপরকে সহায়তা করতে আমাদের সম্ভাব্যতা প্রয়োগ করার জন্য আমরা অসাধারণ সংকল্প প্রয়োগ করি। অবশ্যই আমরা যখন বাড়ি যাই তখন আমাদের উপর আরও বেশি আত্মমন্থন করতে হবে। তবে এর কারণে ঐ গৃহহীন ব্যক্তিদের ভুলে গেলে চলবে না আর বাড়ি গিয়ে শুধু ধ্যান করলে হবে না। আমাদের সংকল্প যদি আন্তরিক হয় তাহলে এটা আমাদের সচেতন করে রাখে।

প্রতি মুহুর্তে আত্মমন্থন করার প্রবল প্রেরণাটি তখনই জাগে যখন আমরা এমন অন্যান্য প্রাণীদের মুখোমুখি হই যাদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। যেমন আমরা শীতকালে ঠান্ডা মাটিতে বসে একজন বৃদ্ধা মহিলাকে পাতাল রেল স্টেশনের কাছে ভিক্ষা করতে দেখি এবং ভাবি যদি তিনি আমার মা হতেন? তিনি যদি এই জীবনে আমাদের প্রকৃত মা হতেন আর সেখানে ঠান্ডা মাটিতে বসে ভিক্ষা করতেন তাহলে আমরা কি তার পাশ দিয়ে চলাফেরা করতে পারতাম? অথবা এমন এক গৃহহীন যুবক যে পাতাল রেলের উপর অস্থায়ীভাবে খবরের কাগজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত সে যদি আমার ছেলে হতো তাহলে আমি কেমন অনুভব করতাম? এই ছেলেটার মা-বাবা আছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে আমরা কুষ্ঠরোগী এবং অন্যান্য বিকৃত লোকজনদের দেখতে পাই এবং সাধারণত আমরা কখনও ভাবি না যে এই কুষ্ঠরোগীদেরও পরিবার আছে এবং তাদের পরিবার থাকে। তাদের সাথে মানুষের মতো আচরণ করা উচিত।

অবশ্যই এই গৃহহীন মানুষগুলির সাংবৃতিক পরিস্থিতি আলাদা করতে আমাদের প্রভেদমূলক সচেতনতার প্রয়োজন। কারণ কেউ কেউ মাদক অথবা মদ্য পদার্থ কিনতে টাকার জন্য মানুষের আশপাশে ভিড় জমায়। এসব ক্ষেত্রে আমাদের ঐ পদ্ধতিটিকে অনুসরণ করা উচিত যেটাকে বৌদ্ধধর্মে “উপায়-কৌশল” বলে। আমাদের মধ্যে সাহায্য করার ইচ্ছা আছে, আমাদের মধ্যে কিছু ধারণা আছে যে তাদের দুঃখের কারণ কী হতে পারে এবং সুখের কারণ কী হতে পারে। তারপর আমাদের সেই কাজটি করার চেষ্টা করতে হবে যেটা বাস্তবে তাদের জন্য সহায়ক হবে। হতে পারে তাদের টাকা-পয়সা দিলে মোটেও সহায়ক নাও হতে পারে কারণ তারা সেটাকে শুধুমাত্র মাদক বা মদ্যদ্রব্য কেনার জন্য ব্যবহার করবে। তাই আমরা তাদের টাকা-পয়সা না দিয়ে তার পরিবর্তে আমাদের কাছে যদি কিছু খাবার থাকে আমরা তাদেরকে সেটা দিতে পারি। তবে যেকোন ক্ষেত্রে আমরা তাদেরকে মাত্র ভয়াবহ জঘন্য নেশাখোর অথবা মাতালের মতো না ভেবে যত্নশীল মনোভাব এবং সম্মানের সাথে দিতে হবে। কারণ তারা দুঃখ-কষ্টে পীড়িত মানুষ।

কাউকে সাহায্য করার সবচেয়ে ভালো উপায় কী হতে পারে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। আমরা দেখতে পাই যে আমাদের ক্ষমতা এখন সীমিত আমরা সত্যিই জানি না সবচেয়ে ভালোটা কী। এই বিষয়ে যথাযথভাবে জানার জন্য আমাদের বুদ্ধ হতে হবে। তাহলেও আমরা এখন যথাসাধ্য চেষ্টা করে বুঝতে পারি যে আমরা কখনো কখনো ভুল করে থাকি। আমরা অন্ততঃ চেষ্টা করি।

সারাংশ

আমরা যখন সপ্তাংশ কারণ এবং ফলের পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেকে প্রশিক্ষিত ক’রে বোধিচিত্ত বিকাশ করে ফেলি তখন সর্বোত্তম উপায়ে পরকল্যাণ করার উদ্দেশ্যের জন্য বুদ্ধত্ব লাভ করার আমাদের লক্ষ্যটি অনেক সমর্থন লাভ করে অন্যান্য সংবেদনশীল অবস্থা এবং আলাদা অনুভূতিকে একত্রিত করতে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে সকলের সাথে সমান ভাবে ঘনিষ্ঠতা এবং সংযোগের অনুভূতি, অন্যরা যে দয়া দেখিয়েছেন তার উপলব্ধি, কৃতজ্ঞতার গভীর অনুভূতি, উদ্বেগ, মৈত্রী এবং করুণা, পাশাপাশি সকলকে যথাসম্ভব সহায়তা করার দায়িত্ব নেওয়ার দৃঢ় সংকল্প। এই ধরণের আবেগের উপর আধারিত আমাদের বোধিচিত্ত লক্ষ্য হয়ে ওঠে দৃঢ়, আন্তরিক এবং স্থিতিশীল।

Top