অন্তরের শান্তির মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ

Study buddhism universal values 06

দৈহিক ও মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্য

পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ যেদিকেই বসবাস করুন না কেন শান্তি সবার কাঙ্খিত বিষয়। ধনী-গরীব, যাই হোন না কেন, প্রত্যেক কে শান্তির জন্য আন্তরিক হতে হবে। আমরা মানুষ, তাই আমাদের সবার ভাবনা মোটামুটি একই রকম এবং যেটা হল সুখ চাই, একটি সুখী জীবন চাই। একটি সুখী জীবন পাওয়ার যোগ্য আমরা। সেরকম ভাবনা নিয়ে এখানে আমরা কথা বলছি। ‘আমি’ বা ‘ব্যক্তি সত্ত্বা’ এর অনুভূতি সকলের আছে। এই ‘আমি’ বা ‘ব্যক্তি সত্ত্বা’টি আসলে কী তা আমরা পুরোপুরি জানিনা। তা যাই হোক না কেন, তবু ‘আমি’ নামে আমাদের একটি জোরালো অনুভূতি আছে। সুখ লাভ বা দুঃখ না পাওয়ার কামনা ওই অনুভূতির কারণে জাগে। এগুলো স্বয়ম্ভু। বলতে গেলে এর ভিত্তিতে সকলের সুখী হওয়ার অধিকার রয়েছে।

আমাদের জীবনে বহু বাধা ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটবেই। এদের দুটি শ্রেণীতে ফেলা যায়। দৈহিক কারণ, যেমন ধরুন অসুস্থতা বা জরাগ্রস্থ হওয়া, এ হল একধরণের কষ্ট। ইতিমধ্যে আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। শুনতে, দেখতে ও হাঁটতে অসুবিধা হয় আমার। এগুলি ঘটবেই। অন্য শ্রেণীটি প্রধানত মানসিক স্তরে ঘটে। দৈহিক দৃষ্টিকোণে আরাম ও বিলাসীতায় পরিপূর্ণ জীবনে সব কিছু থাকলেও দেখা যায় আমরা চাপে আছি। নিজের উপরই সংশয় জাগে। এমনকি একাকিত্ব অনুভব করি। সুতরাং আমরা মানসিক ভাবে দৈহিক দুঃখ থেকেও অনেক বেশী দুঃখ পেতে পারি।

হ্যাঁ, আমরা টাকা দিয়ে দৈহিক আরামের জন্য কিছু দুঃখ কম করতে পারি। পেতে পারি কিছু দৈহিক তুষ্টি। দৈহিক স্তরে ক্ষমতা, নাম, যশ ইত্যাদি থাকলেও তা আমাদের অন্তরে শান্তি আনতে পারে না। সত্যি বলতে কি, কোন কোন সময় প্রচুর অর্থ-সম্পদ আমাদের অতিরিক্ত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নাম, যশের জন্য অতিমাত্রায় ভাবিত আমরা। এসব আমাদের ভন্ডামি, চাপ ও অস্বস্তির দিকে নিয়ে যায়। অতএব, মানসিক শান্তি বাহ্যিক উপাদানের উপর ততটা নির্ভর করে না। অন্তরে আমরা কী ভাবছি তার উপর নির্ভর করে।

আমরা দেখি যে অনেক দরিদ্র মানুষ আছেন, যারা অন্ততঃ মানসিক ভাবে ভীষণ শক্তিশালী এবং সুখী। সত্যি বলতে কি, অন্তরে সন্তুষ্টি থাকলে আমরা যে কোন গুরুতর দৈহিক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারি। তার রূপান্তরও করতে পারি। এইভাবে দেখলে, দৈহিক ও মানসিক কষ্টের মধ্যে আমি মনে করি মানসিক কষ্ট অনেকবেশী যাতনাময়। কারণ, মানসিক প্রফুল্লতার পরশে দৈহিক কষ্ট দমিত হয় কিন্তু দৈহিক আরাম দিয়ে মানসিক কষ্ট দূর করা যায় না।

মানুষের মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্য ও সমস্যা পশুদের থেকে অনেক বেশী জোরালো ও কষ্টদায়ক। সম্ভবত দৈহিক দুঃখকষ্ট উভয়ের একইরকম। কিন্তু মানুষের বেলায় বুদ্ধিমত্তার জন্য আমাদের মধ্যে সংশয়, নিরাপত্তাহীনতা ও চাপ দেখা দেয়। এগুলি আমাদের হতাশাগ্রস্থ করে। আমাদের উন্নত বুদ্ধিমত্তার জন্য এসব দেখা দেয়। তাদের প্রতিরোধ করার জন্যও বুদ্ধিকেই ব্যবহার করতে হবে। আবেগের মধ্যে এমন কিছু আবেগ আছে যা দেখা দেওয়া মাত্র আমাদের মনের শান্তি বিঘ্নিত হয়। অন্যদিকে কিছু আবেগ এমন যা আমাদের শক্তি জোগায়। সেগুলি হল শক্তি এবং আত্মবিশ্বাসের আধার এবং তা আমাদের নিয়ে যায় প্রশান্ত মনের দিকে।

দুই ধরণের আবেগ

অতএব, আবেগ দুই প্রকার। একটি ক্রোধ ও ঘৃণার মতো, বিনাশী আবেগ বা মানসিক শান্তির পক্ষে ক্ষতিকর। ওরা শুধু এই মুহুর্তের মানসিক শান্তি নষ্ট করছে না, বরং কায় ও বাক্‌-এর পক্ষেও অত্যন্ত বিনাশী হয়ে দাঁড়ায়। অন্যভাবে বলতে গেলে ওরা আমাদের কর্মে বাধা সৃষ্টি করে। আমাদের ক্ষতিকর পথে চালিত করে। তাই ওরা বিনাশী। অপরদিকে করুণার মতো আবেগগুলি অন্তরে শান্তি ও শক্তি প্রদান করে। যেমন, ওরা আমাদের দেয় ক্ষমা-শক্তি। এমনকি কোন ব্যক্তির সঙ্গে কখনও যদি কোন সমস্যা হয়, ক্ষমা ভাবনা আমাদের উত্তেজনা প্রশমিত করবে এবং নিয়ে যাবে মানসিক শান্তির পথে। তাতে যার প্রতি আমরা বিরূপ ছিলাম তিনিই হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হবেন।

বাহ্যিক শান্তি

শান্তির কথা বলতে হলে অন্তরের শান্তি ও এই আবেগগুলির কথা অবশ্যই বলতে হবে। তাই কোন আবেগ আমাদের শান্তির পথে নিয়ে যায় তা খুঁজে দেখতে হবে। তবে প্রথমে আমি বাহ্যিক শান্তির প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাইব।

বাহ্যিক শান্তি মানে হিংস্রতা নেই তা নয়। শীতল যুদ্ধের সময় সম্ভবত আমরা আপাতদৃষ্টিতে শান্তিতে ছিলাম। কিন্তু সেই শান্তি ছিল ভয় জাত। সে ভয় পরমাণু যুদ্ধের ভয়াবহতার ভয়। বিপক্ষ বোমাবর্ষণ করবে- উভয়পক্ষ এই ভয়ে থাকত। তাই সে সময় প্রকৃত অর্থে শান্তি ছিল না। অন্তরের শান্তি থেকেই আসে প্রকৃত শান্তি। আমি অনুভব করি, যখনই দ্বন্দ্ব দেখা দেবে, আলোচনার মাধ্যমে তার শান্তিপূর্ণ সমাধান আমাদের খুঁজতেই হবে। হৃদয়ের উষ্ণতা, অপরের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যের ক্ষতি করার প্রবৃত্তিবোধ এবং নিজের জীবনের মতো অপরের জীবনও পবিত্র এরকম মনোভাবের মাধ্যমে শান্তি অনেক কিছু করতে পারে। তাকে সম্মান করা প্রয়োজন। এই মনোভাব নিয়ে আমরা যদি অপরকে সাহায্য করতে পারি তবে তা করতে চেষ্টা করা উচিৎ।

আমরা যখন অসুবিধার সম্মূখীন হই এবং কেউ আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে; অবশ্যই আমরা তার প্রশংসা করি। কেউ কষ্ট পাচ্ছে দেখে আমরা যদি শুধু মানবিকতাও দেখাই, তাতে ব্যক্তিটি আমাদের প্রশংসা করে, অত্যন্ত আনন্দিত হয়। সুতরাং, অন্তরের করুণা ও মানসিক শান্তি সঞ্জাত সকল কর্ম শান্তিপূর্ণ হয়। আমরা অন্তরে যদি শান্তি-স্থাপন করতে পারি, তার দ্বারা বাইরেও শান্তি প্রতিষ্টা করতে পারব।

মানুষ হিসেবে একে অপরের সঙ্গে মত বিনিময়ের সময় সর্বদা মত পার্থক্য থাকে। কিন্তু ‘আমি’ এবং ‘ওরা’ একটি জোরালো ধারণা, একে নির্ভর করে অন্য একটি ধারণা পাই তা হল ‘আমার স্বার্থ’ ও ‘তোমার স্বার্থ’। এমন কি এনিয়ে যুদ্ধও বেঁধে যেতে পারে। আমরা ভাবি শত্রু নিপাত হলে আমার জয় হবে। এখন কিন্তু বাস্তব এসেছে নব-রূপে। পরিবেশ ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আমরা বর্তমানে গভীর ভাবে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তাই ‘আমি’ এবং ‘ওরা’, এই ধারণা এখন অপ্রাসঙ্গিক। যাঁদের ‘ওরা’ ভাবতাম, এখন আমাদের অংশ হয়ে গেছে। অতএব, আমরা ছয়শত কোটি পৃথিবীবাসীর সকলের সুখী হওয়ার অধিকার আছে। তা মেনে নিয়ে মনে শান্তি আনতে চাইলে, তার প্রধান উপাদান হল করুণা। আমরা যে সবাইকে গুরুত্ব দিই তার আধার হল করুণা। এই ভাবেই বাহ্যিক জগতে শান্তি স্থাপনে আমাদের সফল হওয়া উচিৎ।

ক্ষুদ্র পরিসর থেকে শুরু

সুতরাং শান্তির জন্য প্রথমে আমাদের নিজেদের মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা প্রয়োজন। তারপর পরিবারে, অবশেষে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি উদাহরণ দিচ্ছি- মেক্সিকোর এক বন্ধু তার সমাজে ‘শান্তির অঞ্চল’ স্থাপন করেছেন। সমাজের প্রতিটি নাগরিককে অঙ্গীকার করিয়ে সে তা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই শান্তির অঞ্চলে সকলে স্বেচ্ছায় হিংসা ত্যাগ করবে। লড়াই বা মতানৈক্য হবে এমন পরিস্থিতিতে ওরা ‘শান্তির অঞ্চল’ ছেড়ে যাবে বাইরে। এতে রাজী হয়েছে সবাই। অতি উত্তম।

কতটা বিশ্ব-শান্তির জন্য তা বলা কঠিন, কিন্তু বিশ্ব আবহে শেষ পর্যন্ত তাই সর্বোত্তম হতে পারে। কিন্তু নগণ্য হলেও আপনার পরিবার, গোষ্ঠি, জেলা ইত্যাদিতে ‘শান্তির অঞ্চল’-এর মতো বিষয় প্রতিষ্ঠা করে এখনই শুরু করা যায়। সেটি হবে অধিক বিশ্বাসযোগ্য। তাহলে দেখা যাচ্ছে অন্তরের শান্তি করুণার সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত।

এই মুহুর্তে জগতে সত্যিই সবকিছুর পরিবর্তন ঘটছে। কয়েক বছর আগের কথা আমার মনে পড়ছে। আমার জার্মান বন্ধু প্রয়াত ফ্রেডরিখ ভন উইজ্‌সাকার, যাকে আমার একজন শিক্ষক বলে মনে করি। তিনি বলতেন তার ছোটবেলায় জার্মানদের নজরে ফরাসীরা ছিল শত্রু। আবার ফরাসীদের নজরে জার্মানরাও ছিল শত্রু। এখন কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। আমরা পেয়েছি একটি সংঘবদ্ধ শক্তি- ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তা খুবই ভাল হল। আগের দিনে প্রতিটি দেশ তার সার্বভৌমত্বকে খুবই মূল্যবান মনে করত। কিন্তু বর্তমানে বাস্তবিক সত্য ইউরোপে দেখা দিয়েছে নতুন ভাবে। নিজেদের মঙ্গল চিন্তা ছেড়ে সবার মঙ্গল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেখানে। অর্থনীতির উন্নতি হলে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের উন্নতি হয়। অতএব এই ভাবনাটি ছয় শত কোটি বিশ্ববাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই বিশাল মানব পরিবারের এক একজন সদস্য। এই ভাবনার প্রয়োজন আছে।

করুণা একটি জৈবিক উপাদান

এখন করুণার কথাই ধরুন, মানুষ সহ সকল স্তন্যপায়ী প্রানী মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়, যাঁদের, এমনকি পাখি ইত্যাদি; লালন-পালনের উপর তাদের বিকাশ নির্ভর করে। সামুদ্রিক কচ্ছপ, প্রজাপতি ও স্যামন মাছের মতো কয়েকটি মাত্র প্রজাতি ডিম দিয়ে মরে যায়। এই সত্ত্বগুলি ব্যতিক্রমী। নয়তো তাই ঘটে। উদাহরণ স্বরূপ, সামুদ্রিক কচ্ছপের কথাই ধরুন। সমুদ্র সৈকতে মায়েরা ডিম পেড়ে চলে যায়। কচ্ছপের ছানাটির বেঁচে থাকা তার নিজের উদ্যমের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে। মায়ের মমতা তাদের দরকার নেই তবু ওরা বেঁচে যায়। আমি কতিপয় দর্শনের উদ্দেশ্যে বলছি, এটি খুবই কৌতুহলোদ্দীপক বৈজ্ঞানিক গবেষণা হতে পারে। ডিম ফুটে কচ্ছপের ছানাটি বেরিয়ে এলে একরত্তি ছানাটিকে তার মায়ের কাছে রেখে দেখুন তো; একে অপরের প্রতি কোনরকম স্নেহানুভূতি আছে কি না! আমার মনে হয় না থাকবে। প্রকৃতি তাদের এই ভাবেই সৃষ্টি করেছে, তাই তাদের স্নেহের দরকার নেই। কিন্তু স্তন্যপায়ী, বিশেষ করে মানবজাতি, মায়ের যত্ন ছাড়া আমরা সবাই স্রেফ মারা যাবো।

দুধের শিশুর যত্ন নেবার জন্য কিছু আবেগ-অনুভূতির প্রয়োজন হয়। করুণা, স্নেহ-মমতা, অপরের জন্য ভাবনা, যত্ন ইত্যাদি রূপে তা হতে পারে। বৈজ্ঞানিকরা বলছেন- শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য জন্মের পর কয়েক সপ্তাহ মায়ের পরশ অপরিহার্য্য। আমরা দেখি, যে সকল শিশু স্নেহ-ভালবাসাময় আনন্দোচ্ছল পরিবারে বেড়ে ওঠে ওদের মধ্যে সুখি হওয়ার প্রবণতা থাকে। ওরা শারীরিক ভাবেও থাকে সুস্থ। কিন্তু শৈশবেই স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে নানারকম সমস্যার প্রবণতা দেখা যায়।

কয়েকজন বৈজ্ঞানিক একটি পরীক্ষা করেছিলেন। তাতে ওঁরা কয়েকটি শিশু বানরকে তাদের মায়েদের কাছ থেকে সরিয়ে দেন। ওরা লক্ষ্য করলেন যে শিশু বানরগুলি সবসময় তিরিক্ষি মেজাজে থাকত, করত লড়াই। ওরা ভালকরে খেলতোও না। মায়ের কাছে যে বানর শিশুগুলি ছিল, ওরা প্রানোচ্ছল, সুন্দরভাবে খেলত। আর মানব শিশুরা! শৈশবে স্নেহ-মমতা বঞ্চিত শিশুদের প্রানোচ্ছলতার প্রবণতা কম দেখা যায়। অন্যের প্রতি স্নেহ-ভালবাসা প্রকাশ করতে অসুবিধা হয় তাদের। কোন-কোন সময় অপরের প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠে। অতএব স্নেহ-মমতা হল একটি জৈবিক উপাদান। জৈবতত্ত্ব নির্ভর উপাদান।

এছাড়াও আমি মনে করি করুণা ও আবেগ যেহেতু এই জৈব দেহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তারও প্রভাব থাকবে। কতিপয় বৈজ্ঞানিকের মতে আমরা যদি ক্রমাগত ক্রোধী, ঘৃণা পোষণ করি ও ভীত থাকি তাহলে আমাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস পায়। দেহ হতে থাকে দুর্বল। কিন্তু করুণাময় চিত্ত রোগ প্রতিরোধ-প্রক্রিয়াটি শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।

অপর একটি উদাহরণ দিচ্ছি। যদি আমরা চিকিৎসা জগতের দিকে তাকাই, সেখানে একদিকে সেবিকা ও ডাক্তারের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, এবং অন্যদিকে রুগীর আস্থা; এই বিষয়টি রুগীর আরোগ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে আস্থার ভিত্তিটি কী? ডাক্তার ও সেবিকা যদি প্রকৃতার্থে রুগীর আরোগ্যের জন্য সেবাযত্ন ও চিন্তা-ভাবনা করে, তবে আস্থা জন্মায়। অন্যদিকে ডাক্তার দক্ষ হলেও তিনি যদি রুগীর সঙ্গে যান্ত্রিক আচরণ করেন, সেক্ষেত্রে আস্থা প্রায় থাকে না। তবে ডাক্তার অত্যন্ত অভিজ্ঞ হলে কিছুটা আস্থা থাকবে। আর ডাক্তার দয়ালু হলে আস্থাটি হবে দৃঢ়তর। তাতে রুগী নিশ্চিন্তে ঘুমোবে আর তার কষ্টও হবে কম। অনাস্থা যদি গভীর হয়, তাহলে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, আরোগ্য লাভে বাধা পড়ে।

তবে জীবনে সমস্যা থাকবেই আর তা অবশ্যম্ভাবী। মহান ভারতীয় বৌদ্ধ আচার্য শান্তিদেব বলেছেন যে সমস্যার সম্মূখীন হলে তাদের বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন “যদি কোনও ভাবে তা সমাধান করা যায় তাহলে উদ্বিগ্ন হয়ো না; পদ্ধতিটি প্রয়োগ কর। আর যদি একেবারেই অসম্ভব হয়, তবে নিরুদ্বিগ্ন হও। তাতে আমাদের কোন উপকার (সমস্যাটির দ্বারা) হবে না”। এই বাক্যগুলি চিন্তা করলে পরম উপকার হবে। যদি আমরা এ ভাবে চিন্তা করতে পারি, বিরাট সমস্যা এলেও তাকে কমিয়ে আনতে পারবো। যেমন ধরুন, আমরা যখন ছোট্ট শিশু-অবস্থায় থাকি সেই সময়ের মতো যতদিন পর্যন্ত আমাদের অপরের সেবাযত্ন প্রয়োজন হবে, করুণা ও স্নেহ-মমতাও থাকবে আমাদের মধ্যে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ে স্বাধীনতা। আর আমরা ভাবি করুণা থেকে অগ্রাসী হওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই ভাবে নিজেদের পথ করে নেব। কিন্তু ছয়শত কোটি মানুষ সবাই মায়েদের থেকেই এসেছে। মায়েদের মমতাভরা ভালবাসায় সুখ ও তুষ্টি অনুভব করে সকলে। আর মা না থাকলেও অন্য কারও কাছ থেকে ছোট্ট শিশুটি স্নেহ-মমতা পায়। ধীরে-ধীরে বয়োপ্রাপ্তির সঙ্গে এই আদর্শগুলি হতে থাকে ক্ষীণ। আর আমরা হয়ে উঠি অগ্রাসী, উৎপীড়ক। সেই সঙ্গে সৃষ্টি করি বহু সমস্যা।

বাস্তবকে দেখার প্রয়োজনীয়তা

সুইডেনের একজন বিজ্ঞানী আমায় বলেছিলেন যে আমাদের মন যখন ক্রোধের বশীভূত হয় এবং মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রোধ; তখন যাকে দেখে আমরা ভয়ঙ্কর ভাবে রেগে যাই তার বিষয়ে ৯০% হলো মনের প্রক্ষেপণ। অন্যভাবে বললে ৯০% নেতিবাচক বিষয়ই মনের প্রক্ষেপণ। তেমনই কারও প্রতি আসক্ত হলে এবং তীব্র কামনা জাগলে তাকে ১০০% সুদর্শন এবং ভাল দেখি। কিন্তু তার একটি বিরাট আদর্শ মানসিক প্রক্ষেপণ যা আমরা বাস্তবে দেখি না। অতএব, বাস্তবকে যথাযথ ভাবে দেখা খুবই মহত্বপূর্ণ।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: কেউ অশান্তি চায় না। তাহলে অশান্তি দেখা দেয় কেন? আমাদের অজ্ঞানতা, ঢিলেঢালা ভাব, মনোবৃত্তি এসব কারণে অশান্তি হয়। আমরা বাস্তবকে দেখি না। আমরা শুধু দুটি মাত্রা দেখি, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। বস্তুকে তিন, চার বা ছয় মাত্রায় দেখার সামর্থ থাকা প্রয়োজন। বিষয়বস্তুকে পরীক্ষা করার আগে আমাদের মনকে শান্ত করা প্রয়োজন।

সমস্ত বিষয়গুলি বোঝার জন্য এখানেও গঠনমূলক ও বিনাশী আবেগগুলির মধ্যে পার্থক্য জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে করুণার জৈব উপাদানটি ক্রমশ হ্রাস পায়। তাই তার পুনঃ বৃদ্ধির জন্য করুণার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার প্রয়োজন হয়। করুণার জৈব ধরণটি পক্ষপাত যুক্ত, কারণ এর আধার হল অপরের স্নেহ মমতা। কিন্তু একে আধার করে তার সঙ্গে আমাদের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান লব্ধ উপাদান ও যুক্তি যোগ করে করুণার জৈব ধরণটিকে শুধু ধরে রাখা নয়, বরং অনেক বাড়িয়ে নিতে পারি। অতএব, সীমিত পক্ষপাত দুষ্ট করুণাকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছয়শত কোটি মানুষ বা তা ছাড়িয়ে অসীম নিরপেক্ষ করুণায় পরিণত করা যায়।

শিক্ষার মহত্ব

এই সব কিছুর মূল চাবিকাঠি হল শিক্ষা। আধুনিক শিক্ষা মস্তিষ্ক ও বুদ্ধির বিকাশে মনোযোগী, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। আমাদের শিক্ষা প্রণালী হৃদয়ের উষ্ণতা বৃদ্ধিতেও সমর্থ হতে হবে। তার প্রয়োজন আছে। কিন্ডার গার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আমেরিকায় কতিপয় বিজ্ঞানী কী ভাবে শিশুদের মধ্যে আরও বেশী করুণা ও মনোযোগ বাড়ানো যায়, তারজন্য শিক্ষা প্রণালী প্রস্তুত করেছেন। শিশুদের নির্বাণ লাভ বা ভবিষ্যতের উন্নতির জন্য তা করা হয়নি। এই জীবনের মঙ্গলের জন্যই তা করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে হৃদয়ের উষ্ণতা ও করুণার বিকাশ কীভাবে হবে তার জন্য শিক্ষার কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে। ওই ধরণের করুণা অপরের আচরণের মুখাপেক্ষী নয় বরং ভাবনাটি হল ‘আমরাও তো মানুষ’। আমরা সবাই পৃথিবীর ছয় শত কোটি জনগণের অংশ বিশেষ। সাম্যের এই নীতি অনুযায়ী সবাই আমাদের করুণা পেতেই পারে।

অন্তর ও বাহিরের নিরস্ত্রীকরণ

অতএব, বিশ্ব-শান্তির জন্য আমাদের ভিতর ও বাহিরের, উভয় ক্ষেত্রে নিরস্ত্রীকরণ প্রয়োজন। মনে করুণা উদ্রেক করে এর ভিত্তিতে বাহিরের জগতের সমস্ত দেশ, সবকিছুকে নিরস্ত্র করতে সমর্থ হবো। এই ভাবনা হল এর অর্থ। অনেকটা ইউরোপীয় সেনাবাহিনীতে ফরাসী-জার্মান যৌথ বাহিনীর মতো, সত্যিই অসাধারণ। সমগ্র ইউরোপে যদি সম্মিলিত বাহিনী গঠিত হয় তবে সদস্য দেশগুলির মধ্যে লড়াই বাঁধবে না।

ব্রাসেল্‌সে একবার বিদেশমন্ত্রীদের এক সভায় আমি বলেছিলাম যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর যদি পূর্ব ইউরোপের কোন দেশ যেমন পোল্যান্ডে সরিয়ে নেওয়া যায় তাহলে ভবিষ্যতে অনেক উপকার হবে। যদি তা বাড়িয়ে রাশিয়াকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়, আরও ভাল। অবশেষে ন্যাটো সদরদপ্তর মস্কোতে স্থানান্তরকরণ। যদি তাই হয় তবে ইউরোপে সত্যিই শান্তি আসবে। আর কোন যুদ্ধের ভয় থাকবে না। এখন রাশিয়া ও জর্জিয়ার মধ্যে কিছু সমস্যা চলছে, তবে আশাবাদী হতে হবে আমাদের।

যেমন, ফ্রান্সের এই অস্ত্র কারখানাগুলি শান্তির এই বিস্তৃত পরিসরের ভিত্তিতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শেষপর্যন্ত সেই অর্থ ব্যায়িত হবে উন্নয়নের স্বার্থে। উদাহরণ স্বরূপ, কারখানাগুলোতে ট্যাঙ্ক তৈরীর পরিবর্তে বুলডোজার তৈরীর কারখানায় পরিণত হতে পারে।

আফ্রিকার দেশগুলিকে আমাদের অনেকবেশী সাহায্য করা প্রয়োজন। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য একটি বিরাট সমস্যা। তা শুধু বিশ্বস্তরে নয়। রাষ্ট্রীয় স্তরেও রয়েছে। ধনী-দরিদ্রের এই পার্থক্য ভীতিজনক। যেমন ফ্রান্সে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অসামঞ্জস্য বিশাল। কিছু মানুষ তো অনাহারেও থাকেন। কিন্তু আমরা তো সবাই মানুষ। সবার আশা, প্রয়োজন ও সমস্যাও রয়েছে। অন্তরের শান্তির মাধ্যমে বৃহত্তর শান্তি প্রচেষ্টার জন্য এসব আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

Top