আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কর্মের প্রাসঙ্গিকতা

কর্ম সম্বন্ধে বোধশক্তি

আজ আমি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কর্মের প্রাসঙ্গিকতা সম্বন্ধে কথা বলবো। এই প্রসঙ্গে শুরু করার আগে আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে, কর্ম বলতে কী বোঝায়। এর দুটি সাধারণ ব্যাখ্যা আছে। প্রথমটি হল- কর্ম বলতে বোঝায় যে, আমাদের যে বাধ্যকারী মানসিক উত্তেজনাগুলি আছে, যেগুলি আমাদের অনেক রকমের কর্ম করতে প্রেরিত করে, যেমন- শারীরিকভাবে কিছু করা, বাচসিকভাবে কিছু বলা অথবা মানসিকভাবে কিছু চিন্তা-ভাবনা করা। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটির একটি আলাদা বিবৃতি আছে যা শারীরিক এবং বাচসিকভাবে কিছু করার সাথে সম্পর্কিত। এই ধরণের কর্মের ক্ষেত্রে, কর্ম হল আমাদের শারীরিক কর্মের বাধ্যকারী আকৃতি, আমাদের বাচসিক কর্মের বাধ্যকারী শব্দ এবং বাধ্যকারী সূক্ষ্ম শক্তি যেটা দুটি কাজের সাথে যুক্ত আছে এবং পরবর্তীকালে আমাদের মানসিক ধারাবাহিকতার মধ্যে চলতে থাকে। এটা লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই ব্যাখ্যাগুলির কোনটির মধ্যেই কর্ম নিজেই আসল কর্ম নয়, যদিও কর্মের জন্য তিব্বতী চলিত ভাষায় যে শব্দটি আছে তার অর্থ হল “ক্রিয়া”।

এই বাধ্যতামূলক কার্মিক পদ্ধতির মধ্যে একবার কোনও কাজ করলে, সেটা আমাদের চিত্ত-সন্ততিতে নির্দিষ্ট ধরণের কার্মিক পরিণতির ছাপ ফেলে যায়। আসুন, এগুলির মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত, ইতিবাচক বা নেতিবাচক কার্মিক সম্ভাবনা এবং কার্মিক প্রবণতা সম্পর্কে কথা বলি। এই দুটির মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে, তবে আমাদের এখনই সেই প্রায়গিক বিষয়ের বিশদে যাওয়ার দরকার নেই। এই কার্মিক সম্ভাবনা এবং প্রবণতাগুলির একটা দিকে কোনও ফলের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা আছে, যদি সেখানে পর্যাপ্ত প্রত্যয় উপস্থিত থাকে। প্রযুক্তিগত জাগরণে, একটা ফলের টুকরোর মতো, তারা “পরিপক্ক” হয়ে যায়।

কার্মিক সম্ভাবনা এবং প্রবণতাগুলি থেকে কী পরিপক্ক হয়?

এই কার্মিক সম্ভাবনা এবং প্রবণতাগুলি থেকে বিভিন্ন ধরণের ফলাফল আসে। তাদের মধ্যে সবথেকে সাধারণ হ’ল- আমাদের অভিজ্ঞতার প্রতিটি মুহুর্তে কিছুটা সুখ বা দুঃখ অনুভব করা। যদি এটা দুঃখ হয়, তাহলে এটা হবে ধ্বংসাত্মক আচরণের ফল এবং যদি এটা সুখ হয়, তাহলে এটা হবে গঠনমূলক আচরণের ফল।

এছাড়াও এখানে পূর্ববর্তী কর্মের পুনরাবৃত্তি করার অনুভূতিও রয়েছে। কর্ম সরাসরি কার্মিক পরিণতি থেকে পরিণত হয় না। প্রথমে একটি অনুভূতি উৎপন্ন হয়, যেমন কারও উপর চিৎকার করা বা তাদের আলিঙ্গণ করার মতো অনুভূতি। সেই অনুভূতির উপর ভিত্তি করে, তখনই এটি করার প্রেরণা জাগবে, যা আমাদের বাস্তবে কর্মটা করতে আকর্ষিত করে। অনুভূতি এবং প্রেরণার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। কিছু করার মতো অনুভূতি হ’ল এটি করতে চাওয়া বা করার ইচ্ছা। কিন্তু আমি মনে করি “অনুভূতি” হ’ল কমপক্ষে ইংরেজি ভাষায়, করতে চাওয়া বা করার ইচ্ছার থেকে একটু বেশী বর্ণনাত্মক। এটা কম ইচ্ছাকৃত। আমরা আগে যা করেছি সেরকমই কিছু পুনরাবৃত্তি করার মতো অনুভব করি এবং আমরা এমন পরিস্থিতিতে পড়ার মতোও বোধ করি, যেখানে আমাদের সাথে একই রকমের কিছু ঘটতে চলেছে। তবে আমরা যেভাবে অন্যদের প্রতি আচরণ করেছিলাম, তদনুরূপ তারা যে আচরণ করে সেটা অবশ্যই আমাদের কার্মিক সম্ভাবনা এবং প্রবণতাগুলির ফল নয়। স্পষ্টতই তাদের কার্মিক সম্ভাবনা এবং প্রবণতাগুলির পরিণতি, আমাদেরগুলির নয়। আমাদের দিক থেকে কেবল যে জিনিসগুলি পরিপক্ক হয়ে যায়, সেটা হ’ল আমাদের অনুভূতি যেটা আমাদের সেই পরিস্থিতিতে যুক্ত হতে, সেই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতে হয় ইত্যাদি।

আর একটা জিনিস যা পরিপক্ক হয়, বিশেষতঃ আমাদের কার্মিক সম্ভাবনার দিক থেকে, যেটা হ’ল আসল জীবন রূপ, শরীর এবং মানসিক ক্রিয়াকলাপ, যা আমাদের আছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমাদের কুকুরের মস্তিষ্ক বা মানুষের মস্তিষ্ক থাকে, তাহলে আমরা আলাদা-আলাদা মানসিক ক্ষমতা অর্জন করব। কার্মিক সম্ভাবনাগুলি হ’ল যা আসলে চিত্ত-সন্ততি নিয়ে আসে, একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসাবে পুনর্জন্মের প্রসঙ্গে, পিতা-মাতার একটি নির্দিষ্ট শুক্রাণু এবং ডিমের সাথে সংযোগ স্থাপন করা। এইভাবে জীবনের অস্তিত্ব এবং শরীর ধারণ করি, সেটা এই কার্মিক সম্ভাবনারই ফল।

এই জীবনের কার্মিক পরিণতিগুলি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পূর্ববর্তী জীবনে সম্পন্ন কর্মগুলি থেকে আসে

আমরা যখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি লক্ষ্য করি, আমরা প্রায়শই মনে করি যে, আমরা সুখ অথবা দুঃখ যা কিছু অনুভব করি এবং যা কিছু আমরা করি অথবা কিছু বলি সেগুলি হ’ল আমাদের পূর্ব কর্মের কার্মিক সম্ভাবনা এবং প্রবণতার ফল যা এই জন্মে ফলিভূত হয়েছে। তবে এই জন্মে শুধু নির্দিষ্ট কার্মিক আচরণই উক্ত সম্ভাবনা এবং প্রবণতাকে ফলিভূত করে। এগুলির মধ্যে নেতিবাচক এবং ইতিবাচক আচরণ অন্তর্ভুক্ত যা খুব দৃঢ়ভাবে অনুপ্রাণিত করে, বিশেষতঃ যারা আমাদের প্রতি অত্যন্ত সদয় আচরণ করেছেন যদি তাদের দিকে নির্দেশিত হয়, যেমন- আমাদের শিক্ষকগণ অথবা পিতা-মাতা। এই জীবনে যা পরিপক্ক হয় এবং আমাদের এই জীবনে পরিপক্ক ফলরূপে যা কিছু অনুভব করি, তার বিস্তৃত অংশটি হ’ল আমাদের পূর্ববর্তী জীবনকালের কর্ম থেকে তৈরী কার্মিক সম্ভাবনা এবং প্রবণতার ফলাফল।

এই বিষয়টি আমাদের অনেকের পক্ষেই খুব কঠিন হতে পারে, সম্ভবতঃ আমাদের বেশির ভাগেরই পক্ষে বুঝতে। পাশ্চাত্য মানুষ হিসাবে, আমরা বেশীরভাগ মানুষই অতীত এবং ভবিষ্যতের জীবন সম্পর্কে মোটেই বিশ্বাসী নই। সেটি একটি পৃথক সমস্যা এবং দুর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের অতীত ভবিষ্যতের জীবন সম্বন্ধে এই উপলক্ষ্যে অনুসন্ধান করার সময় নেই এবং আমরা কীভাবে তাদের সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি। তবুও আমি মনে করি, পুনর্জন্মে বিশ্বাস না করেও, কর্মফলের পুরো আলোচনাটাতে, আমাদের জীবনে খুব দৃঢ় প্রাসঙ্গিকতা থাকতে পারে এবং আমাদের সাথে যা কিছু ঘটবে আমরা কীভাবে তার মোকাবিলা করব।

আমাদের বাধ্যতামূলক আচরণ সম্পর্কে মনোযোগ, স্মৃতি এবং প্রভেদমূলক সচেতনতার বিকাশ করা

আমরা জীবনে যা অভিজ্ঞতা অর্জন করি সেটার মোকাবিলা করার জন্য আমাদের মনোযোগ বিকাশ করতে হবে। মনোযোগ অথবা মনোযোগ দেওয়া হ’ল এমন মানসিক উপাদান (চৈত্ত) যা আমাদের মানসিক ক্রিয়াকে একটি নির্দিষ্ট বস্তুর সাথে যুক্ত করে। যখন সেই বস্তুটি আমরা প্রতি মুহুর্তে অনুভব করি, পাশ্চাত্যের মানুষেরা এটাকে বলে “স্মৃতি”, যদিও এটা আসলে বৌদ্ধধর্মের অর্থে মানসিক উপাদানের “স্মৃতি” নয়। আমরা যখন আমাদের মানসিক এবং আবেগপূর্ণ জীবনে যা চলছে তার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠি, তখন স্মৃতি হ’ল একটি মানসিক উপাদান যা একটি মানসিক আঁঠা হিসাবে আমাদের মনোযোগ হারাতে বাধা দেয়। আমরা যখন আরও বেশী মনোযোগী হয়ে উঠি, তখন আমরা আরও বেশী লক্ষ্য করতে সক্ষম হই যে, আমরা কিছু করার মতো বোধ করি অথবা কিছু বলার মতো বোধ করি। আমরা অনুভব করতে পারি যখন সেটি বিকশিত হয় এবং একটি নির্দিষ্ট ব্যবধান লক্ষ্য করতে পারি, যখন আমরা কিছু করার মতো অনুভব করি এবং যখন আমরা আমাদের বাধ্যতামূলক আবেগ অনুভব করি যা আসলে আমাদের অনুরূপ আচরণের মধ্যে নিয়ে আসে।

ইংরেজি কথ্য ভাষায়, আমরা কিছু মানুষের বিষয়ে বর্ণনা করি যারা বলে কিছু চিন্তা-ভাবনা না করা ছাড়াই প্রথম তাদের মাথায় আসে। তাদের কোন আভ্যন্তরীণ বিবেচনাই নেই যে, তারা কী বলে অথবা তারা কী করে। যাই হোক না কেন, তারা শুধু ঝোঁকের বশে করে বা বলে। কিন্তু যখন আমরা লক্ষ্য করি যে, যেখানে অনুভূতি বিকশিত হয় এবং যখন আমরা অনুভূতির ভিত্তিতে কাজ করি তার মধ্যে একটি ব্যবধান থাকে, যেটাকে আমরা “প্রভেদমূলক সচেতনতা” বলি। এই প্রভেদমূলক সচেতনতা আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে অনুভূতির উপর কাজ করব কি না। আমরা আলাদা করতে পারি কোন কাজটি করলে সহায়ক হবে অথবা কোনটা অনেক সমস্যার সৃষ্টি করবে। যদি এটা অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে, তাহলে আমরা বুঝতে পারব এটা ধ্বংসাত্মক এবং আমরা এই কাজটি করব না। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের কাউকে বললে চলবে না, “আপনি একটা কী কুৎসিত পোশাক পরে আছেন।” এটি আসলে সহায়ক নয়, তাই নয় কী?

মূল বক্তব্যটি হ’ল- আমরা বুঝতে পারি যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজ করা অথবা কথা বলার এই অনুভূতিগুলি অভ্যাস থেকে উদ্ভূত হয়। আমি একাহ্নে “অভ্যাস” শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবহার করছি কার্মিক সম্ভাবনা এবং প্রবণতাগুলির জন্য। এই অভ্যাসগুলি এই জীবন থেকে আসুক অথবা পূর্ববর্তী জন্মগুলি থেকে, সেটা আসলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল যে, আমরা শুধু আমাদের পূর্ববর্তী নিদর্শন এবং পূর্ববর্তী অভ্যাসের উপর ভিত্তি করে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করছি এবং আমরা কেন তাদের দাস হয়ে যাচ্ছি, তার কোনও কারণ নেই। আমরা মানুষ, কোনও পশু নই, যারা তাদের প্রবৃত্তির উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কর্ম করে। মানুষ হিসাবে, আমাদের বুদ্ধি আছে। এর অর্থ হ’ল কোনটা সহায়ক আর কোনটা ক্ষতিকারক তার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা আমাদের আছে। পূর্বজন্ম বিদ্যমান থাকুক অথবা না থাকুক, আমরা দেখতে পারি যে, আমাদের খারাপ অভ্যাসগুলির ভিত্তিতে কাজ করা অত্যন্ত মুর্খামি, এটা আমাদের জীবনে শুধু আরও বেশী সমস্যা নিয়ে আসে। যেহেতু আমরা নির্বুদ্ধিতার কারণে আরও সমস্যা তৈরী করতে চাই না, সেইজন্য আমরা খারাপ অভ্যাসগুলির ভিত্তিতে বাধ্যতামূলক কাজ করাটাকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি।

কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে, আমাদের বাধ্যতামূলক আচরণের পুনরাবৃত্ত নিদর্শনগুলি দেখতে হবে কারণ সেগুলি হ’ল আসক্তি। আমরা মদ্য, সিগারেট অথবা মাদকাসক্ত হতে পারি। এছাড়াও আমরা জুয়াখেলা অথবা যৌনতা অথবা মানুষের উপর চিৎকার করার মতো কার্যকলাপেও আসক্ত হতে পারি। আসক্তি কাটিয়ে ওঠার জন্য বৌদ্ধ এবং অবৌদ্ধ উভয়েরই অনেক পদ্ধতি রয়েছে। আমাদের এই পদ্ধতিগুলি আন্তরিকতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে, অন্যথায় আমরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাব এবং আরও বেশী সমস্যা তৈরী করব।

যেকোনও আসক্তি কর্মসূচীর প্রথম পদক্ষেপটি হ’ল আমরা আসক্ত বলে স্বীকৃতি দেওয়া এবং স্বীকার করা। এটা খুব প্রয়োজন। সমস্যাটি দূর করতে কাজ করার জন্য আগে আমাদের সনাক্ত করতে হবে। কিন্তু কিছু আসক্তি কর্মসূচী মানুষকে বিশ্বাস করতে পরিচালিত করতে পারে যে, আসক্ত হওয়া তাদের আসল ও অপরিবর্তনীয় পরিচয় এবং আসক্ত হওয়া থেকে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না; আমরা কখনই আমাদের আসক্তিপূর্ণ আচরণকে নিরোধ করতে পারি না। যদিও বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী আমরা আত্মধ্বংসাত্মক আচরণ সহ সব ধরণের আসক্তিগুলি সত্যি করেই নিরোধ করতে পারি, যাতে সেগুলি আর যেন কখনও উৎপন্ন না হয়। বৌদ্ধ অনুশীলনকারী হিসাবে এটিই আমাদের লক্ষ্য।

আমাদের বাধ্যতামূলক আচরণের নিদর্শনগুলি পরিত্যাগ করা

এটাই সেই বিন্দু যেখানে পরিত্যাগের উদয় হয় আমাদের বাধ্যতামূলক আচরণের আসক্তিপূর্ণ নিদর্শনগুলি কাটিয়ে উঠতে। পরিত্যাগ হ’ল কিছু থেকে মুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্প এবং সেটা ত্যাগ করার আগ্রহ। এর সাথে জড়িত সংবেদনশীল অনুভূতি হ’ল সম্পূর্ণ বিতৃষ্ণাজনক এবং একঘেয়েমিঃ আমরা কেবল আমাদের আচরগত আসক্তির কারণে বিরক্ত হই, সেগুলি স্ব-ধ্বংসাত্মক নেতিবাচক আসক্তি হোক অথবা স্নায়বিক ইতিবাচক বিষয়গুলিই হোক না কেন। উদাহরণস্বরূপ, আমরা সর্বদা আমাদের মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে বিরক্ত হয়ে পড়ি, অথবা আমরা পাগলের মতো হাতগুলি ধুয়ে বিরক্ত হই। অতএব, যখন আমরা চিৎকার করার মতো অনুভব করি অথবা আমরা আমাদের হাতগুলি আবার পরিষ্কার করি, যদিও হাতগুলি পরিষ্কার করার পরই আমরা নিজেকে এমন সদৃশ্য থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের দৃঢ় সংকল্পকে পুনরায় নিশ্চিত করি। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে, আমরা কমপক্ষে এইরকম অনুভূতিগুলির উপর কাজ না করার জন্য প্রথমে দৃঢ় সংকল্পকে পুনরায় নিশ্চিত করি এবং তারপর আমরা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করি এবং তারপর এটা করি না। কিন্তু অবশ্যই আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হ’ল কেবল প্রথম পদক্ষেপ। আমাদের বাধ্যতামূলক আচরণের গভীরতম কারণটি দূর করতে আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে।

কর্ম সম্বন্ধে ভুল বোঝাবুঝি

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কর্মের উপর শিক্ষাগুলি প্রয়োগ করতে চেষ্টা করার সময় আমাদের এই ভুল বোঝাবুঝির জন্য নজর রাখা দরকার যে, আমরা যেভাবেই অভিজ্ঞতা অর্জন করি সেটার প্রাপ্য কারণ হ’ল- সেটা আমাদের কর্মফলের পরিণতি। এই পরাস্ত মনোভাবের সাথে, আমরা ভাবি যে, আমরা অতীতে খারাপ ছেলে বা মেয়ে ছিলাম, এবং এখন যা ঘটছে তা আমাদের শাস্তি হিসাবে প্রাপ্য। আমরা শান্তিদেবের শিক্ষা থেকে খুঁজে পাই যে, আমরা যদি লক্ষ্যই না রাখি, তাহলে কেউ সেটার দিকে তীর ছুঁড়তে পারবে না। যদি অতীতে আমরা ধ্বংসাত্মক আচরণ না করে থাকি, তাহলে মানুষ এখন আমাদের উপর ক্রোধ করবে এবং আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, এমন অনুভব আমরা করব না। শান্তিদেবের কথার অর্থটি হ’ল অন্যদের দোষারোপ করা উচিত নয়, বরং নিজেকে দোষারোপ করা উচিত। যাইহোক, এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের অনুভূতির চূড়ান্ত দিকে যাওয়া উচিত যে, আমরা খারাপ ব্যক্তি এবং আমাদের যে দুঃখগুলির মুখোমুখি হতে হয় সেগুলি আমাদের প্রাপ্য, তাই আমাদের চুপ করে থেকে, অভিযোগ না করে আমাদের শাস্তি গ্রহণ করা উচিত। আমি মনে করি যে, এগুলি কর্মের উপর শিক্ষাগ্রহণের স্বাস্থ্যকর উপায় নয়, নাই বা এগুলি বাস্তবে অনুশীলন করার উপায়।

এই মারাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে, প্রতিদিনের জীবনে কীভাবে তাদের থেকে উপকৃত হতে হয়, সেটা দেখতে আমাদের কর্মফলের অন্যান্য দিকগুলি পরীক্ষা করা দরকার। যখন আমাদের সাথে কিছু ঘটতে দেখি, তখন আমরা কর্মের শিক্ষা থেকে অনুমান করতে পারি যে, কারণটি ছিল আমাদের আগের আচরণের ফল। অনেক শিক্ষায় আমরা এখন কী অভিজ্ঞতা অর্জন করি এবং পূর্ব আচরণের মধ্যে সংযোগটি বিশদভাবে বর্ণনা করা আছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা সবসময় এমন সম্পর্কগুলি অনুভব করি, যেগুলি স্থায়ী হয় না, আমরা প্রিয়জনের সাথে থাকতে পারি না, অথবা লোকেরা আমাদের সাথে সবসময় সম্পর্ক ছিন্ন করে, এটি অন্যদের সম্পর্কে বিভাজনমূলক কথা বলার ফল। আমরা লোকেদের সামনে তাদের বন্ধুদের সম্পর্কে বাজে কথা বলেছিলাম, যাতে এটি তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে। যখন আমাদের নিজস্ব বন্ধু আমাদের ছেড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়, এটা হ’ল আমাদের ঐ কর্মের ফল, এর মধ্যে আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই যেখানে অন্যরা আমাদের মতো কিছু অনুভব করছে।

বিভাজনমূলক কথা বলার কারণে একটা অতিরিক্ত জিনিস ফলিভূত হবে যা এই ধরণের আচরণের পুনরাবৃত্তি করার বাধ্যতামূলক অনুভূতি। তারপর এই পয়েন্টটিতে দেওয়া হয়েছে যে, কর্মসম্বন্ধে আমাদের বোধগম্যতাকে একটি গঠনমূলক সরঞ্জাম হিসাবে তৈরী করার জন্য আমাদের সততার সাথে নিজেকে পরীক্ষা করা দরকার। যারা পছন্দ করে, কাজ করে, পড়াশোনা করে বা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তাদের কাছে অন্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে বাজে বিষয়গুলির সমালোচনা বা বলার প্রবণতা আমাদের রয়েছে কী? আমরা সম্ভবতঃ খুঁজে পাব, আমাদের অত্যাধিক সমালোচনা করার প্রবণতা রয়েছে। আমরা খুব কমই কারও সম্পর্কে ভাল কথা বলি, পরিবর্তে কেবল তাদের সম্পর্কে খারাপ কথা বলি। এটা খুব সাধারণ বিষয়, নয় কী? আমরা অন্যের ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করতে, তাদের সম্পর্কে প্রত্যেককে জানাতে এবং এটি সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে সত্যিই উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমরা কতক্ষণ অন্যের ভাল গুণগুলির উপর মনোনিবেশ করি এবং অন্যান্য লোকের কাছে তাদের প্রশংসা করি? আমাদের বেশীরভাগের মধ্যে এটি খুব বিরল।

এটি সবচেয়ে কার্যকরী বিন্দুগুলির মধ্যে একটি যেখান থেকে আমরা কর্মের এইসব শিক্ষার বিষয়ে জানতে পারি এবং যেটা আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারি। আমরা আমাদের সাধারণ আচরণে এমন নিদর্শনগুলি খুঁজে পেতে পারি যা আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারপর পরাস্ত মনোভাবের মধ্যে না পড়ে অর্থাৎ “এটাই আমার প্রাপ্য কারণ পূর্ব জন্মে আমি খুব খারাপ ছিলাম, অন্যদের সমালোচনা করতাম,” তার পরিবর্তে আমরা এখন আমাদের আচরণের দিকে মনোনিবেশ করতে পারি। আমরা যখন কারও সম্পর্কে খুব খারাপ কিছু বলার মতো অনুভব করি তাদেরই জায়গায়, আমরা তাদের ভাল গুণগুলির বিষয়ে আরও চিন্তা-ভাবনা করতে পারি এবং তাদের প্রশংসা করতে পারি।

বিভিন্ন ধরণের কার্মিক সিন্ড্রোমের উদাহরণ আছে যা আমরা সনাক্ত করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দরিদ্র হতে পারি। পরীক্ষা করার পর, আমরা দেখতে পারি যে, আমরা সবসময় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করি এবং অন্য লোকেদের জিনিস ব্যবহার করি, তাদের শোষণ করি, আমরা অন্য কাউকে কখনও অর্থ প্রদান করি না, পরিবর্তে সব সময় আশা করি যে, তারা আমাদের অর্থ সাহায্য করবে, এই হ’ল সেই ধরণের জিনিস। আমি বিশেষতঃ অনুমতি ব্যতীত অন্য ব্যক্তির জিনিসগুলি ব্যবহার করার বিষয়ে উল্লেখ করছি, যেমন- জিজ্ঞাসা না করেই তাদের ফ্রিজ থেকে খাবার খাওয়া, এরকম জিনিস। আমাদের অনুভূতি এবং প্রবণতাগুলির সাথে আমরা লক্ষ্য করি, এই পারম্পারিক সম্পর্ক একইভাবে আচরণ করার জন্য আমরা আমাদের সাথে যা ঘটছে সেটা অনুভব করতে পারি। ভারতীয় শিক্ষক ধর্মরক্ষিত তাঁর “আয়ুধচক্র” নামক বুদ্ধি শোধনের গ্রন্থে এই পারম্পারিক সম্পর্ক বিষয়ে নির্দেশ করেছিলেন।

তদতিরিক্ত, আমাদের বুঝতে হবে যে, ফল কেবল একটি কারণ থেকে আসে না। বুদ্ধ বলেছিলেন যে, একটি বালতি (জলের) প্রথম ফোঁটা অথবা শেষ ফোঁটায় ভর্তি হয় না। এটি সমস্ত ফোঁটার কারণে পূর্ণ হয়। আমরা যা কিছু দুঃখ ভোগ করি, সেটা কেবল অতীতে করা একটা কুকর্মের ফল নয়, অথবা কয়েকটি কুকর্মের সমষ্টি নয় যেগুলি আমরা আগে করেছিলাম। বরং এমন অসংখ্য কারণ এবং প্রত্যয় রয়েছে যেগুলি একত্রিত হয়ে আমাদের কিছু অনুভব করায়।

ধরা যাক, আমরা একটি গাড়িতে ধাক্কা খেয়েছি। এটি কেবল এই নয় যে, আমরা গাড়ি দ্বারা অথবা গাড়ি বিনা কাউকে আঘাত করেছি। এটা কেবল তাই নয়, বরং এটির মধ্যে অন্য ব্যক্তিটির সমস্ত কার্মিক সম্ভাবনাগুলি রয়েছে যে বাস্তবে আমাদের আঘাত করেছিল। তারপর সেখানের আবহাওয়া, ট্রাফিকের পরিস্থিতি এবং সেই সময় আমরা যে কারণে বেরিয়েছিলাম। রাস্তাটি যারা তৈরী করেছেন সেই লোকেরাও আছেন। গাড়িটির দ্বারা বাস্তবে ধাক্কা খাওয়ার অভিজ্ঞতা হওয়ার জন্য প্রচুর কারণ এবং প্রত্যয়কে একত্র হতে হয়েছিল।

যখন আমরা কারণ এবং ফল সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করি, এবং বুঝতে পারি যে, কিছু নির্দিষ্ট ফল ফলিভূত হওয়ার জন্য অনেকগুলি কারণ এবং প্রত্যয় একত্রিত হয়েছে, তখন আমি আমার “আমিত্ব”-এর দৃঢ়তাটিকে বিনির্মাণ করতে শুরু করি যে, আমরা দোষী এবং যেটা আমাদের সাথে ঘটছে সেটা আমাদের প্রাপ্য এবং এটি সম্পূর্ণভাবে আমাদের দোষ। অবশ্যই আমরা দায়বদ্ধ, কিন্তু এখানে আমাদের ব্যবহারের জন্য দায়বদ্ধ হওয়ায় একটা খুব বড় পার্থক্য আছে। অন্যদিকে দৃঢ়ভাবে বিদ্যমান “আমিত্ব”-এর দোষ, খারাপ জিনিসটি যার দোষ আছে, সবকিছুর জন্য, তাদের সাথে যেটি ঘটে তার সনাক্তকরণে।

কর্ম সম্পর্কিত শূণ্যতাকে বোঝা

কারণ এবং ফল সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করার পাশাপাশি, আমাদের বিনির্মাণ করতে হবে যেটাকে আমরা “ত্রিমন্ডল” বলি। এই ত্রিমন্ডল গঠনের অনেকগুলি উপায় রয়েছে, কিন্তু কর্মফলের পরিপক্কতা প্রসঙ্গে আমরা তাদেরকে “আমিত্ব” হিসাবে নির্দিষ্ট করতে পারি, যিনি এখন পরিপক্ক কর্মফলটি অনুভব করছেন, যেটা কর্মের দ্বারা পরিপক্ক হয়েছে, সেটা আমরা এখন অনুভব করছি এবং আমরা এখন যে কর্মের পরিপক্কতার অনুভব করছি, সেটা হ’ল অতীতের কৃত কর্মের ফল।

যখন আমরা বুঝতে পারি না যে, ত্রিমন্ডল একে অপরের উপর নির্ভরশীলভাবে উৎপন্ন হয় এবং সাবলম্বী হতে বাধ্য হয় না, তারা স্বতন্ত্রভাবে নির্ভর করে যা কিছু থেকে তারা উদ্ভূত হয়, আমরা মানসিকভাবে তৈরী করে থাকি এবং দৃঢ়ভাবে অস্তিত্বহীন “আমি”কে আঁকড়ে ধরে থাকি যেটা অতীতে এতটাই খারাপ ছিল যে, এখন যেটা ঘটছে সেটা আমাদের প্রাপ্য। এক অর্থে, আমরা শিকার হয়ে উঠি অথবা আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধী হয়ে উঠি। ফলে আমরা ঐ আপাতদৃষ্টির দৃঢ় পরিচয়ে ঝুলে থাকি। এটি মনের একটি খুব অসুখী অবস্থা, তাই নয় কী? আমরা যে দুঃখ অনুভব করছি সেটাকে অতিরঞ্জিত করে নিই আর আমাদের বিগত কর্মের ভয়াবহতাকেও খুব বাড়িয়ে দিই। পুরো পরিস্থিতি অপরাধবোধ এবং আত্ম-গ্লানীতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এর পরিণামস্বরূপ আমাদের দৈনন্দিন জীবন নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর হয়ে যায়।

অতএব, শূন্যতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জ্ঞান না থাকলে বস্তুর ভাবনা আমাদের মধ্যে অত্যন্ত দৃঢ় হয়ে যায়। এর ফলে চরম অবস্থায় চলে যাওয়া সহজ হয়ে যায়। এটা আরও বেশী সমস্যা ও দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে যা আমরা বর্ণনা করে চলেছি। শূন্যতা সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকলেও, কিছু করার সময় আমাদের নিজের চিত্তে এই ধারণাটা জাগাতে হবে যে, আমরা যা কিছু ভাবি, বলি অথবা করি সেটার কার্মিক পরিণাম অবশ্যম্ভাবী। এটি মাথায় রেখে, আমাদের ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং পরিবর্তে গঠনমূলক আচরণ করতে হবে। এটাই করা উচিত।

ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত থাকা

বৌদ্ধধর্ম গ্রন্থে কোনও প্রকারের ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত থাকার কারণ হ’ল- এরকম কর্মের অসুবিধাগুলি কী, তার উপর বিচার করা। কারণ আমরা এই ধরণের আচরণের দুঃখময় ফল অনুভব করতে চাই না। এইজন্য যখন এমন ধ্বংসাত্মক কিছু করার অথবা বলার কোনো ভাবনা জাগবে, তখন আমরা সেটা থেকে বিরত থাকতে চাই। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে, আমরা বাস্তবে ঐ পংক্তিগুলি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি না। আমরা সেটা থেকে বিরত থাকি, কারণ আসলে আমাদের কিছু ধ্বংসাত্মক করা ঠিক মনে হয় না। এটা খুব আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, কারণ এমন কিছু নেতিবাচক আচরণ আছে যা আমাদের ঠিক বলে মনে হয় না, যেমন-প্রতারণা, ভাঙচুর এবং এই ধরণের জিনিস। যদি এরকম হয় তাহলে ঠিক আছে। সম্ভবতঃ আমরা তার নেতিবাচক পরিণতি সম্পর্কে সক্রিয় চিন্তা-ভাবনা করিনি, কিন্তু তাসত্ত্বেও আমরা এই রকম আচরণ করি না।

তাহলে মশা মারার বিষয়ে কী বলা যাবে? আমি আপনার সম্পর্কে জানি না, কিন্তু অবশ্যই আমার অভিজ্ঞতা আছে যে, মশাদের সশব্দে আঘাত করা ঠিক মনে হয় অথবা সেটার পিছনে ঘোরা, যার মানে আমি আফ্রিকায় সাফারী করি আর সেই মশাটির শিকার করে সবশেষে সেটাকে আমার কক্ষে মারা, যেটা আমাকে পুরো রাত্রি ঘুমোতে দেয় না। এটা ঠিক মনে হয়। যদিও আমাদের মশার সাথে সাফারী চালিয়ে যাওয়া যতই হাস্যস্পদ মনে হোক না কেন, তবুও আমরা সেই সাফারীটা চালিয়ে যাই, তাই নয় কী? এই প্রসঙ্গে অযৌক্তিক উদাহরণগুলির চিন্তা-ভাবনা আসলে বেশ সহায়ক হয়।

এই ধরণের ধ্বংসাত্মক আচরণের দুষ্পরিণামগুলির বিষয়ে চিন্তা করা অত্যন্ত আবশ্যক যে, সহনশীলতা ত্যাগ করে মশাদের মেরে ফেলার জন্য কতটা দুষ্পরিণাম ফলিভূত হবে। এর মানে এই নয় যে, অগত্যা আমাদের রক্ত মশাদের খাওয়াতে হবে। এর থেকে ভাল হল মশার সাথে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি ব্যবহার করে মোকাবিলা করার চেষ্টা করা। যখন মশাটি কোনও দেওয়ালের উপর বসবে তখন আমরা তার উপর একটা বয়াম রেখে দিতে পারি, তারপর সেই বয়ামের নিচে একটা কাগজের টুকরো টেনে ঢুকিয়ে দিয়ে আমাদের ঘর থেকে বের করে আনতে পারি। এটা একটা খুবই ব্যবহারিক পদ্ধতি, তবে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যে, আমরা এখনও সাফারী করছি। যদিও পাত্র এবং কাগজের টুকরোটা ব্যবহার করার সময় আমরা একটি মানসিক সাফারী রাখতে পারি।

আসলে এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণযোগ্য। আমরা কী আমাদের ঘর থেকে মশাটি বের করে দিচ্ছি, যেহেতু তার কামড়ানোর পর চুলকানি অনুভব করতে চাই না, অথবা মশার জন্য আমরা সেটার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি? স্পষ্টতই আমরা তাদের খাবারের থেকে বঞ্চিত করছি। আমাদের বিবেচনা করা দরকার যে, আমরা যদি ক্রমাগত মশা বা মাছি ইত্যাদি মারতে থাকি, তাহলে আমরা কোন ধরণের অভ্যাস গড়ে তুলছি? যে অভ্যাসটি আমরা গড়ে তুলছি, সেটা হ’ল আমাদের যে বিরক্ত করবে তাকে তখনই মেরে দেওয়া। এটা এমন একটা প্রবৃত্তি যেখানে বিরক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য হিংসাত্মক মাধ্যম ব্যবহার করার প্রবৃত্তি জাগানো হবে। এই জন্য, যখন আমরা একটা বয়াম এবং একটি কাগজের টুকরো দিয়ে মশাটির শিকার করি, তখন কমপক্ষে আমাদের মশাটির প্রতি যেন বিদ্বেষ ভাব না থাকে। আমাদের এটা ভাবা উচিত নয় যে, এটি একটি অবাঞ্ছনীয় জীব এবং আমাদের এর থেকে মুক্তি পেতে হবে কারণ এটি আমাদের জায়গার উপর আক্রমণ করেছে অর্থাৎ ঘরে ঢুকেছে।

তারপর অবশ্যই এর জন্য আরও উন্নত পদ্ধতি আছে যেগুলি আমরা প্রয়োগ করতে পারি, যেমন, এই মশাটি পূর্বজন্মে আমাদের মা ছিলেন ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের বেশীরভাগের পক্ষে আন্তরিকভাবে এই কাজটি করা খুব কঠিন। মূল বক্তব্যটি হ’ল কিছু জিনিস এমন আছে, যেখানে আমাদের ধ্বংসাত্মকভাবে কাজ করা ঠিক মনে হয় না, তবে অন্যান্য জিনিসগুলি এমনই যেখানে আমরা সচেতনভাবে নিজের প্রেরণাকে শক্তিশালী করি।

যে উপাদানগুলি কার্মিক প্রবণতা এবং সম্ভাবনাকে সক্রিয় করে

আমি অন্য একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, সেটা হ’ল যে নির্দিষ্ট কারণগুলি আমাদের কার্মিক প্রবণতা এবং সম্ভাবনাগুলিকে সক্রিয় করে এবং পরিপক্ক করে তোলে তার বিষয়ে। এটির আলোচনা প্রতীত্যসমুৎপাদের দ্বাদশ অঙ্গ সম্বন্ধীয় শিক্ষাগুলির মধ্যে করা হয়েছে, যে কারণগুলি মৃত্যুর সময় কার্মিক প্রবণতা সক্রিয় করে তোলে। এই কারণগুলি আমাদের চিত্ত-সন্ততিকে ভবিষ্যতের পুনর্জন্মে “নিক্ষিপ্ত” করে।

এই কারণগুলির মধ্যে প্রথম কারণটি হল তৃষ্ণা। “তৃষ্ণা” শব্দটি এই অঙ্গের জন্য তিব্বতী শব্দের অনুবাদ, কিন্তু এর মূল সংস্কৃত শব্দের অর্থ আসলে “তৃষ্ণার্ত”। দ্বিতীয় কারণটির অনুবাদ “উপাদান” রূপে করা হয়। তবে এটি স্পষ্ট অনুবাদ নয় কারণ এমন অন্যান্য পদ রয়েছে যা সাধারণতঃ “উপাদান” রূপে করা হয়। যেমন, “সত্যের অস্তিত্বের জন্য আসক্তি” এবং এটি অন্যান্য শব্দাবলীর মতো নয়। এখানে শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হ’ল “কিছু পাওয়া” অথবা “কিছু নেওয়া”। আমার পছন্দ “প্রাপ্তকর্তা বা গ্রহণকারী” শব্দটি ব্যবহার করা। এটা হল একটি উপাদানের মনোভাব, মনোদৃষ্টি, এটা যদি বিকশিত করা যায়, তাহলে সেটা আমাদের ভবিষ্যতের পুনর্জন্মের জন্য উপাদান হতে পারে। যদিও দ্বাদশ অঙ্গর প্রসঙ্গে এগুলির ব্যাখ্যা উৎপ্রেরক রূপে করা হয়েছে যা প্রক্ষিপ্ত কর্মকে ভবিষ্যতের পুনর্জন্মে জন্য অভিক্ষেপ করতে পারে, কিন্তু এমন একটি বিকল্প উপস্থাপনাও রয়েছে যে তারা প্রতিটি মুহুর্তে আমাদের কর্মফল ও প্রবণতাগুলিও সক্রিয় করে।

আমাদের এই বিষয়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হ’ল যে, কীভাবে আমাদের দৈনিক জীবনের জন্য কর্ম সম্বন্ধীয় শিক্ষাগুলি প্রাসঙ্গিক হয়। প্রথমতঃ তৃষ্ণা কী? এই তৃষ্ণার্ত কী? এটা একটা মানসিক কারণ (চৈত্য) যা সুখ অথবা দুঃখের একটা স্তরের অনুভূতি প্রদান করে যা আমরা অনুভব করি আর যেটা অতিরঞ্জিত ক’রে, সেটাকে বাড়িয়ে বলে। সুখের উপর ধ্যান কেন্দ্রিত ক’রে তৃষ্ণার্ত হই এটাকে সমাপ্ত না করার জন্য, দুঃখ অথবা কষ্টের ক্ষেত্রে আমরা তৃষ্ণার্ত হই এটাকে সমাপ্ত করার জন্য। একটা সমতা অনুভূতির ক্ষেত্রে, এটা সেই অনুভূতিকে বোঝায় যে, যখন আমরা পূর্ণ একাগ্রতার উচ্চতর স্তরের উপর থাকি, যাকে “ধ্যান” বলা হয় আমরা যা কিছু অনুভব করি। ঐ অবস্থায় আমরা তৃষ্ণার্ত হই সমতা অনুভূতির জন্য এবং প্রত্যাখ্যান না করার জন্য। স্পষ্টতই, এমন তৃষ্ণা এবং আসক্তির ভিন্ন-ভিন্ন শ্রেণী থাকতে পারে।

প্রাপ্তকর্তা বা গ্রহণকারী বলতে বোঝায় অশান্তকারী আবেগ এবং  অশান্তকারী মনোভাব। এর মধ্যে এক অথবা একাধিক তৃষ্ণা যুক্ত হয়ে আমাদের কার্মিক প্রবৃত্তিগুলি এবং প্রবণতাগুলিকে সক্রিয় করে। তালিকাটির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হ’ল একটা সত্যতঃ সিদ্ধ “আমি”-যেটা কোনকিছুর সমান হয় এবং যা আমরা আমাদের স্কন্ধের মধ্যে অনুভব করি অর্থাৎ শরীর, চিত্ত, আবেগ ইত্যাদি অথবা সেটাকে বাস্তবে অস্তিত্বমান মনে করে তাকে “আমার” ভাবি।

সংক্ষেপে, তৃষ্ণার্ত কিছুটা আনন্দ অথবা দুঃখের স্তরের কিছু অনুভূতির উপর মনোনিবেশ করে এবং তারপর প্রাপক মনোভাবটি “আমি”-এর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যিনি এটি অনুভব করছেন। যদিও আমাদের অনুভূতি এবং “আমি”-এর শূন্যতা সম্পর্কে উপলব্ধি হয় না, তাহলেও আমরা এই বিশ্লেষণটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারি যা আমাদের কার্মিক প্রবৃত্তিগুলি এবং সম্ভাবনাগুলিকে সক্রিয় করে তোলে। প্রতি মুহুর্তে আমরা সুখ অথবা দুঃখের কোনো স্তর অনুভব করতেই থাকি। তাসত্ত্বেও আমরা সেগুলি উদাহরণস্বরূপ “আট লোকধর্ম”-এর শিক্ষাগুলির উপর প্রয়োগ করতে পারি।

“লোকধর্ম” নামক শব্দাবলীতে বিদ্যমান “লোক” শব্দ তিব্বতীতে “জিগতেন” রূপে অনুবাদ করা হয়েছে। ঐ উক্ত শব্দাবলীটি দুটি শব্দ দিয়ে গঠিত। এখানে “তেন”-এর অর্থ হ’ল আধার অথবা ভিত্তি, এবং “জিগ”-এর অর্থ হল যা খন্ডিত হয়ে নষ্ট বা ধ্বংস হয়ে যাওয়া। “আটটি লোকধর্ম” অথবা “আটটি জাগতিক বস্তু” বলতে আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া পার্থিব ভিত্তিক বিষয়গুলির প্রতি আমাদের যে মনোভাব রয়েছে সেগুলি বোঝায়। আমরা হয়তো আনন্দিত হয়ে যাই অথবা পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ি যা আমাদের জীবনে ঘটে থাকে যার স্থায়ী ভিত্তির অভাব থাকে এবং যা ক্ষণিক বা ক্ষণভঙ্গুর হয়।

কার্মিক সম্ভাবনার এই ক্রিয়াগুলির ক্ষেত্রে, প্রাসঙ্গিক লোক-ধর্মগুলির উপর আমাদের প্রতিক্রিয়া অতিরঞ্জিত হয়, যার মধ্যে সুখী হলে আমরা অতি প্রসন্ন হই এবং দুঃখী হলে আমরা পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ি। এই প্রসঙ্গে এমন কী আছে যার একটা অস্থির আধার আছে? এটা হল সুখ অথবা দুঃখ যা আমরা অনুভব করি। স্থায়ী আধারের অভাবে, এটা ক্ষণভঙ্গুর হয়। কারণ আমরা সেটা বাড়িয়ে দেখি এমন যেন সেটা রূপে অস্তিমান আছে আর ভাবি যে এটা চীরকাল স্থায়ী থাকবে, আর এইজন্য আমাদের প্রতিক্রিয়ায় সমানতা রাখতে পারি না, সেটা ঘটে গেলে আমরা অতিপ্রসন্ন অথবা পূর্ণতঃ হতাশ হয়ে যাই। একটা তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির মতো, যে জলের কেবল এক ঢোক পায়, আমরা সুখের আস্বাদ পেয়ে আনন্দিত হই এবং সেটা কখনই হারাতে চাই না। আর আমরা যখন দুঃখী হই, তখন একটা তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির মতো, যে জল থেকে পূর্ণতঃ বঞ্চিত, আমরা খুবই হতাশ হয়ে পড়ি যে এটা কোনও ভাবে শেষ হয়ে যাক।

সুখ এবং দুঃখের অনুভূতিগুলির প্রতি সমতা

ভারতীয় আচার্য শান্তিদেব এই মনোভাবগুলিকে শিশুসুলভ বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা যে সুখ এবং দুঃখের অনুভূতি অনুভব করি আমাদেরকে ঐ ধরণের শিশুসুলভ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার প্রবৃত্তিকে পরাভূত করতে হবে। এমন করার জন্য, আমাদের সমতার বিকাশ করতে হবে। “সমতা” এর অর্থ হ’ল- সুখ ইত্যাদি অনুভূতির বিষয়ে অতিরঞ্জিত প্রতিক্রিয়া না করা কারণ সহজ ভাষায় বলা যায় যে, সংসারের স্বভাব হ’ল এর উত্থান এবং পতন হতে থাকে। কখনও আমরা খুব সুখী হতে পারি, কখনও আমরা খুব দুঃখী হয়ে যেতে পারি। এটাই স্বাভাবিক। আর এই বিষয়ে ভবিষ্যবাণী করার কোনও রাস্তা নেই যে, আমরা কখন সুখী হব বা কখনই বা দুঃখী হব। কোনও প্রত্যক্ষ কারণ ছাড়াই আমাদের মনোভাব তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। আমাদের দ্বারা সুখ অথবা দুঃখের স্তর নাটকীয় হতে পারে না। এটা খুব সূক্ষ্ম স্তরে হতে পারে। এখানে মূল শব্দগুলি হ’ল আমরা যাই অনুভব করি না কেন এটি “বিশেষ কিছু নয়”।

আসলে এটি একটি গভীর বিন্দু। “বিশেষ কিছু নয়” এর অর্থ হ’ল, অবাক করার মতো কিছুই নেই; কিছুই অসাধারণ নয়। আমরা কী আশা করব? অবশ্যই, জিনিসগুলির উত্থান-পতন হতেই থাকবে, আমাদের সেটাকে বড় করে দেখার দরকার নেই। জীবনের অনুভবে, কখনও আমরা সুখী এবং কখনও আমরা দুঃখী থাকব। নিশ্চিতভাবে আমরা বুঝে যাই যে, ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে দুঃখ উৎপন্ন হয় এবং সুখ গঠনমূলক আচরণ থেকে জন্ম নেয়, কিন্তু আমাদের এই অদ্ভুত অথবা ভয়াবহ বলে মনে হওয়া এই অনুভূতিগুলিকে আঁকড়ে ধরে রাখার দরকার নেই। এবং নিশ্চিতভাবে আমাদের এই মহান “আমিত্ব”-এর সাথেও যুক্ত থাকলে চলবে না, যেমন, “আমি কত খুশী” অথবা “বেচারা আমি, আমি খুব দুঃখী”।

স্পষ্টতই, প্রচলিতভাবে আমরা সুখী হতে চাই এবং দুঃখী হতে চাই না। এছাড়াও প্রচলিতভাবে, বৌদ্ধধর্মের অনুশীলনগুলির সাথে আমরা মোক্ষ এবং বোধিলাভের লক্ষ্যে নিযুক্ত হয়েছি, যেখানে আমরা দুঃখ এবং কষ্টগুলি থেকে মুক্ত হয়ে যাব। কিন্তু আমরা সেটাকে বড় করে দেখি না। বিষয়টা হ’ল তাই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই কর্ম সম্পর্কে শিক্ষাগুলির প্রাসঙ্গিকতা নির্দেশ করে এবং এটাই আমাদের মানসিক শান্তি প্রদান করে। প্রত্যেকদিন আমরা যেমন পরিবর্তনশীল মেজাজের মধ্য দিয়ে যাই এবং সেখানে সমতা বজায় রাখি। মনের শান্তি আসে সেই সমতা ভাবনা থেকে। কারণ স্বাভাবিকভাবেই, কখনও আমাদের সুখের অনুভূতি হয় আবার কখনও দুঃখের। এটাই সংসারের স্বভাব, এর থেকে এটাই আশা করা যায়। আমাদের নিজেদেরকে ধর্ম অনুশীলন করে যেতে হবে যা আমরা করছি। যখন আমরা কোনও নির্দিষ্ট মুহুর্তে খুশী বোধ করছি না, তাতে কী হবে?

জীবনের উত্থান-পতন

তার মানে এই নয় যে আমরা কোনও অনুভূতি গ্রহণ করব না, আমাদের কোনও সুখ থাকবে না, অথবা আমাদের কোনও দুঃখ থাকবে না এবং আমরা সম্পূর্ণভাবে একটি অনুভূতিহীন ব্যক্তিতে পরিণত হব। এটা অবশ্যই তা নয়। আমাদের সুখ এবং দুঃখ উভয়কে নিয়েই থাকতে হবে। যখন কোন ভাল ঘটনা ঘটবে আমরা আনন্দিত হব। যখন ভাল ঘটনা ঘটবে না তখন আমরা আনন্দিত হব না। উদাহরণস্বরূপ, আমরা একটি রেস্তরাঁয় গেলাম এবং পছন্দের খাবারটি অর্ডার করলাম কিন্তু তাদের কাছে সেই খাবারগুলি নেই। এতে আমরা খুশি হলাম না। যদিও ঘটনাটি দুঃখজনক কিন্তু এই ঘটনাটি খুব বড় করে দেখলে হবে না। এর জন্য মন খারাপ হতে পারে কিন্তু খারাপ মেজাজের সাথে মনে আবদ্ধ হলে চলবে না। 

যদিও উদাহরণ হিসাবে এটি হাস্যকর, তবে আরও প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হ’ল যখন কোনও প্রিয়জনের মৃত্যু হয়। এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা যে আমরা শোকাহত হয়ে পড়ব। এতে কোন ভুল নেই। বাস্তবে আমরা যদি দুঃখিত না হই তাহলে ঘটনাটি অস্বাস্থ্যকর। কিন্তু এই ঘটনাটি নিয়ে সর্বক্ষণ শোকাগ্রস্থ হয়ে থাকলে জীবনটা মারাত্মকভাবে দুঃখদায়ক হয়ে পড়বে। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় কেউ যদি এই ঘটনায় অত্যন্ত আনন্দিত হয় এবং বলে যে আমার খুব ভাল সময় যাচ্ছে তাহলে বাকিদের মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে, তাই না? সেই কারণে আমাদের মধ্যে জীবনের উত্থান এবং পতনের অভিজ্ঞতা থাকা উচিত। সুখ এবং দুঃখ কোন বড় ঘটনা নয় এবং কোন বিশেষ ঘটনাও নয়।

আমরা যখন দুঃখী হই এবং সবকিছু খারাপ যায় তখন আমরা সমতার পাশাপাশি অন্যান্য মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি যা আমরা উৎপন্ন করতে পারি সেটা হ’ল যে, আমাদের দেখতে হবে সেরকম ঘটার কারণ কী হতে পারে। যেমনটি আমরা আগে আলোচনা করেছি, আমরা নমুনাটাকে পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করতে পারি, আমরা দেখতে পারি যে আমরা কিভাবে কোনকিছুর পুনরাবৃত্তি করছি। দেখলে আমরা বুঝতে পারব সে সবকিছুই ঐ গুলির মতো। তারপর তার উপর কাজ করতে পারি। 

মার্গক্রমে অনুপ্রেরণার তিনটি স্তর

আরেকটি বিষয় আমি উল্লেখ্য করতে চাই যা লাম-রিমে উপস্থাপিত অনুপ্রেরণার তিনটি স্তরের সাথে সম্পর্কিত। সাধারণতঃ কর্ম সম্পর্কিত শিক্ষাগুলি অনুপ্রেরণার প্রাথমিক সুযোগের মধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত থাকি কারণ আমরা ভয় পাই, আমরা যদি বিরত না থাকি তাহলে আমরা ঐ ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হব। আমাদের কর্মের ফলস্বরূপ অন্যান্য লোকেরা কী অনুভব করবে তা আমরা জানি না।  আমরা তাদের উপর ঐ ভয়াবহ পরিণতির প্রভাবের গ্যারান্টি দিতে পারি না। তবে আমাদের পক্ষ থেকে, আমরা ঐ দুঃখ ও অসুখীতা অনুভব করতে চাই না যা আমাদের ধ্বংসাত্মক আচরণের পরিণামস্বরূপ ভোগ করতে হবে। আমরা এর কারণে ভয়ভীত ও আতঙ্কিত হই, কিন্তু আমরা এটি স্বাস্থ্যকর উপায়ে করি। আমরা শাস্তির ভয়ের কথা বলছি না। আমরা কেবলমাত্র দুঃখ ও অসুখীতা এড়াতে চাই। আরও সুনির্দিষ্টভাবে, আমরা ভবিষ্যতের জীবনে দুঃখ এবং অসুখী ভাব এড়াতে চাই। এটিই অনুপ্রেরণার প্রাথমিক সুযোগ। আরও সুনির্দিষ্টভাবে, আমরা ভবিষ্যতের জীবনে দুর্দশা এবং অসুখী ভাব এড়াতে চাই। এটি প্রাথমিক প্রেরণার সুযোগ। 

মধ্যবর্তী স্তরে, আমরা সবরকমের বাধ্যতামূলক কার্মিক আচরণ ত্যাগ করতে চাই কারণ আমরা মোক্ষ লাভ করতে চাই। আমরা যদি মোক্ষ লাভ না করি তাহলে সাংসারিক সুখ এবং দুঃখের উত্থান এবং পতন চিরকাল চলতে থাকবে। যদি সেরকম চলতে থাকে সেটা কত ভয়াবহ হবে!

অনুপ্রেরণার উন্নত সুযোগের সাথে আমরা সবধরণের বাধ্যতামূলক কার্মিক আচরণ থেকে বিরত থাকতে চাই, কারণ সেগুলি সত্যিই অপরকে সহায়তা করতে আমাদের ক্ষমতায় বাধা সৃষ্টি করে। আমরা যদি ক্রমাগত এই উত্থান এবং পতনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকি এবং যখন কিছু অপ্রীতিকর জিনিস নিয়মিতভাবে আমাদের সঙ্গে ঘটতে থাকে তাহলে আমরা কীভাবে অপরের সহায়তা করতে পারব? আমাদের মূল চিন্তা-ভাবনাটি হল অপরকে সহায়তা করতে এটা নেতিবাচকভাবে আমাদের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করবে। অন্যদের ক্ষতি করার বিষয়ে আমরা আসলে মানবিক উপায়ে চিন্তা-ভাবনা করি না। তাদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষমতায় বাধা-বিঘ্ন ঘটার বিষয়ে বেশী চিন্তা-ভাবনা করি। 

“যতক্ষণ না আমি নিজের কাজ করে কাউকে আঘাত করি, ততক্ষণ এটা ঠিক আছে”, এই নৈতিক আচরণের প্রতি বৌদ্ধ মনোভাব এবং পাশ্চাত্য মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে। অন্যের উপর আমাদের আচরণের প্রভাব কী হবে সে বিষয়ে আমরা আসলে গ্যারান্টি দিতে পারি না, এটা ছাড়া এই পন্থায় কোন ত্রুটি নেই। উদাহরণস্বরূপ, আমরা কারও কাছ থেকে কিছু চুরি করলাম এবং এতে তাঁরা খুব খুশি হয় কারণ এটা তাদের জন্য একটা ভয়াবহ অবস্থা ছিল আর এর কারণে তাঁরা বীমা সংগ্রহ করতে পারে। অন্যদিকে, আমরা কাউকে মোটা অঙ্কের টাকা দিলাম এবং এর কারণে তারা ছিনতাই হয়ে যায় এবং খুন হয়ে যায়। 

অবশ্যই, আমরা বৌদ্ধধর্মে মৈত্রী এবং করুণার বিকাশ করি, পাশাপাশি আমরা অপরের ক্ষতি করতে চাই না। তবে প্রেরণার একটা উন্নত সুযোগ অনুযায়ী প্রধান ঝোঁকটা হ’ল- আমরা এমন কিছু করতে চাই না যা অপরকে সহায়তা করতে আমাদের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এই ধরণের অনুপ্রেরণা জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করার জন্য সম্পূর্ণ বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক পথের সাথে একত্রে ভালোভাবে খাপ খায়। এর ফলে আমরা অপরকে যথাসম্ভব সম্পূর্ণরূপে সহায়তা করতে সক্ষম হওয়ার চেষ্টা করি। এটাই বৌদ্ধ ধর্মে কর্ম সম্পর্কে আলোচনা করার মূল জোর।  

আমাদের দৈনন্দিন আচরণের ক্ষেত্রে, মহাযান অনুপ্রেরণার প্রাসঙ্গিকতা হ’ল- এটা আমাদের নৈতিক আত্ম-শৃঙ্খলার শক্তি জোগায়। আমরা যদি ধ্বংসাত্মকভাবে কাজ করতাম তাহলে আমরা কীভাবে অন্যের সহায়তা করতে পারতাম? উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি সবসময় অন্যদের দম্ভ দেখাতাম বা প্রতারণা করতাম তাহলে কেউ আমাদের বিশ্বাস করত না। তাহলে আমরা বাস্তবে কীভাবে কাউকে সহায়তা করতে পারি? আরও সুনির্দিষ্টভাবে যদি বলা হয়, শিক্ষক হিসেবে আমরা যদি আমাদের কর্মের ফল অনুভব করতাম, যেমন- আমাদের শিক্ষার্থীরা হটাৎ আমাদের ত্যাগ করে চলে যায়, আমাদের আগের উদাহরণটির প্রয়োগ হিসাবে- তাহলে আমরা বাস্তবে কীভাবে অপরের সহায়তা করতে পারতাম? আমাদের শিক্ষার্থীরা কখনই আমাদের সাথে থাকত না। তাঁরা সবসময় ত্যাগ করে চলে যেত। স্পষ্টতই, এটা আমাদেরকে অপরের সমালোচনা করা বন্ধ করতে অনুপ্রাণিত করবে এবং এর পরিবর্তে অপরের ভাল গুণাবলী সম্পর্কে কথা বলতে অনুপ্রাণিত করবে।

গঠনমূলক আচরণের সাথে দুটি চৈত্ত উপস্থিত থাকে

একটা চূড়ান্ত বিষয় আছে। অভিধর্মকোশে, মহান ভারতীয় আচার্য বসুবন্ধু উল্লেখ করেছেন যে, চৈত্ত বা চেতসিক দুই প্রকারের হয় যেগুলি সর্বদা গঠনমূলক কর্মের সাথে উপস্থিত থাকে। যদিও অসঙ্গ তাঁর গ্রন্থে এই চৈত্তগুলিকে অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, তবে আমাদের বসুবন্ধুর সংজ্ঞাটাও বুঝতে হবে।

এই চৈত্তগুলির মধ্যে প্রথমটি হ’ল ভাল গুণাবলী এবং যাদের মধ্যে ঐ গুণাবলীগুলি আছে তাদের প্রতি সম্মান থাকা। দ্বিতীয়টি হ’ল- নির্লজ্জভাবে ধ্বংসাত্মক হওয়া থেকে বিরত থাকা। “নির্লজ্জভাবে” শব্দের অর্থ “আমরা একবারে পাত্তা দিই না” এমন। আমরা কোনও আত্ম-নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চর্চা করি না। এখানে আমরা পাত্তা দিই না এবং তাই আমরা ধ্বংসাত্মক হওয়া থেকে মোটেই বিরত থাকি না। আমাদের যা কিছু করতে মনে হয় আমরা শুধু সেটাই করি। 

গঠনমূলক আচরণের সাথে আমাদের মধ্যে বিপরীত মনোভাব আছেঃ ইতিবাচক গুণাবলী এবং যাদের মধ্যে ঐ গুণাবলীগুলি আছে তাদের প্রতি আমাদের সম্মান আছে আর আমরা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করি। আমাদের কর্ম কখনই নির্লজ্জভাবে ধ্বংসাত্মক হয় না; আমরা যা কিছু বলি এবং করি সে সম্পর্কে আমরা যত্নশীল। এটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, সম্ভবতঃ “এটা সঠিক অনুভব হয়।”

এটা বোঝায় যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কীসের উপর জোর দেওয়া দরকার এবং সবসময় নিজেকে কী স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার। ধৈর্য এবং করুণার মতো ভাল গুণাবলী এবং যাদের মধ্যে এই গুণাবলীগুলি রয়েছে তাদের প্রতি পরম সম্মান আবার নিশ্চিত করতে হবে। কারণ তাঁরা হলেন মহান অনুপ্রেরণার উৎস। তদতিরিক্ত, আমাদের পুনরায় নিশ্চিত করতে হবে যে, আমরা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করতে চাই এবং আমরা কী বলি ও করি সে বিষয়ে যত্নশীল হতে চাই, শুধু সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসাত্মক এবং ভয়াবহভাবে কর্ম করতে চাই না। 

শেষ মন্তব্য

আমরা কর্ম এবং কর্মফল ও কীভাবে এই শিক্ষাগুলিকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারি সে বিষয়ে আমরা বিস্তৃতভাবে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছি। আসুন, এই দুটি কারণকে হজম করার জন্য এক মুহুর্ত সময় নিই। সংক্ষেপে, গঠনমূলক কর্ম করার ক্ষেত্রে আমরা কেবল একটা ভাল ছেলে বা ভাল মেয়ে হওয়ার ইচ্ছার ভিত্তিতে সেটা করি না। আসলে ভিত্তি ওটা নয়। বরং আমরা ভাল গুণাবলী এবং ঐ গুণাবলীগুলি যাদের মধ্যে আছে তাদের প্রতি যে শ্রদ্ধা রয়েছে তার ভিত্তিতে গঠনমূলকভাবে কর্ম করি। ফলে কোনও আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কেবল প্রকাশ্যে ধ্বংসাত্মকভাবে কাজ করা থেকে বিরত থাকা সঠিক বোধ করি। আমাদের এটা করতে হবে এবং সেই রকমভাবে কর্ম করতে হবে।

Top