আসক্তিঃ অশান্তকারী আবেগগুলির মোকাবিলা করা

কোন ব্যক্তির প্রতি অশান্তকারী আবেগ (ক্লেশ) রূপী আসক্তি আমাদের মনের শান্তি এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ নষ্ট ক’রে দেয়। এই কারণে আমরা কোন ব্যক্তির ভাল গুণাবলীকে, যেমন- তাদের চেহারাকে অতিরঞ্জিত ক’রে দেখি, এবং ব্যক্তিকে বস্তুতে পরিণত ক’রে সেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই ও সেটাকে ছাড়তে চাই না। কিন্তু ধ্যান-সাধনার বিভিন্ন পদ্ধতির সহায়তায় আমরা আমাদের আসক্তিকে কাটিয়ে উঠতে পারি এবং সেই ব্যক্তির সাথে একটি সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি।

আমাদের সমস্ত অশান্তকারী আবেগ এবং মনোভাবের মূলে তাদের গভীরতম কারণ হিসাবে রয়েছে অসচেতনতা। আর এই অসচেতনতা হেতু এবং ফল সম্পর্কিত হতে পারে- আমাদের আচরণের ফলের বিষয়- অথবা সাধারণতঃ বাস্তবতা সম্পর্কে অসচেতনতা হতে পারে। আচরণগত হেতু এবং ফল সম্পর্কিত অসচেতনতা ধ্বংসাত্মক আচরণ এবং ভুল কাজ করার জন্য দায়ী বলে বর্ণনা করা হয়। তবে বাস্তবিকতা এবং পরিস্থিতির বিষয়ে অসচেতনতা যেকোন ধরণের সাংসারিক আচরণের আধার হতে পারে, তাতে সেই আচরণ গঠনাত্মক হোক অথবা ধ্বংসাত্মক। সুতরাং, আমরা যদি দেখতে চাই যে কীভাবে অসচেতনতা আমাদের অশান্তকারী আবেগ এবং অশান্তকারী মনোভাবে অন্তর্নিহিত আছে। তাহলে আমাদের পরিস্থিতিগুলির বিষয়ে অসচেতনতা এবং বাস্তবতার বিষয়ে অসচেতনতার উপর আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

এখন, এই “বাস্তবতা” শব্দটি হল একটা মজার শব্দ। এটারও অনেকগুলি আলাদা-আলাদা অর্থ হতে পারে। এর জন্য সাধারণতঃ “সত্য” শব্দের প্রয়োগ করা হয়, কোন বস্তুর বিষয়ে সত্য। যেকোন বিষয়ের দুটি সত্য থাকে। একটা হল আপেক্ষিক, সাংবৃতিক বা অগভীর সত্য, সেটা হল যে কোন বস্তু যেমন প্রতীয়মান হয় আর অন্যটা হল পরমার্থ সত্য। এটা হল যে, কোন বস্তু বাস্তবে যেভাবে অস্তিমান। এটা এমন নয় যে, একটা সত্য অন্য কোন সত্যের থেকে অধিক সত্য, যেমন আমরা সত্যের “স্তর”-এর অভিব্যক্তি দ্বারা দেখতে পারি। তারা উভয়ই সত্য। আমি এই দুটির মধ্যে দ্বিতীয় সত্যের জন্য “পরম” শব্দের প্রয়োগ করা পছন্দ করি না, কারণ পরম শব্দের প্রয়োগ করলে মনে হয় যেন, এটা প্রথম সত্যের থেকে অধিক যথার্থ; পরিবর্তে আমি “গভীর” শব্দের প্রয়োগ করা পছন্দ করি। এইজন্য, দুটি সত্য কেবল অগভীর সত্যরূপে দর্শায় অর্থাৎ কোন বস্তু যেমন প্রতীয়মান হয় এবং গভীর সত্য দেখায় যে, সেই বস্তুটা যেভাবে অস্তিমান।

আসক্তি কী?

এবার আমরা অশান্তকারী আবেগ সম্পর্কিত দুটি সত্যকে দেখব; তাহলে সম্ভবতঃ এর বিষয়টা কিছুটা স্পষ্ট বা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আসক্তি বা লালসা কী? এটা মনের অশান্তকারী অবস্থা যা কোনও ব্যক্তি বা বস্তুর ভাল গুণগুলিকে অতিরঞ্জিত করে। এটা প্রধানতঃ দুটি রূপে প্রকাশিত হয়। লালসা বলতে এমন কিছুকে লক্ষ্যসন্ধান করা হয় যেটা আমাদের কাছে নেই আর আমাদের মনোভাব এরকম হয় যে, “আমাকে এই জিনিসগুলি পেতে হবে, আমার কাছে এটা থাকতেই হবে।” আসক্তি হল এমন কিছুকে লক্ষ্য করা যেটা আমাদের কাছে ইতিমধ্যে আছে এবং এরকম অনুভব করা, “আমি এটাকে হারাতে চাই না!” দুটি ভাবনাই কোন বস্তুর ইতিবাচক গুণগুলিকে অতিরঞ্জিততার উপর ভিত্তি করে অথবা আমরা যে গুণগুলিকে ইতিবাচক রূপে দেখি। তৃতীয় প্রকারটি হল লোভ, এটা কোন এমন জিনিসের উপর লক্ষ্যসন্ধান করা হয়, যেটা আমাদের কাছে আছে, কিন্তু আমরা সেটাতে কখনো সন্তুষ্ট হই না, আমরা সবসময় সেটাকে আরও অধিক মাত্রায় পাওয়ার কামনা করি।

এই বিভিন্ন রূপের মধ্যে আমরা প্রকৃত বাস্তবতা বা কোন বস্তুর প্রকৃত সত্যের সাথে অবগত নই। অন্য কথায়, আমরা কোন বস্তুর শুধু ইতিবাচক গুণ অথবা ভাল দিকগুলিই দেখি তা নয়, বরং সেই গুণগুলিকে অতিরঞ্জিত ক’রে দেখি অথবা সেই বস্তুর সাথে আরও ভাল গুণাবলীকে জুড়ে দিই, যেগুলি তার মধ্যে আদেও থাকে না। সাধারণতঃ এর সাথে-সাথে এটাও দেখা যায় যে, আমরা সেই বস্তুর বিষয়ে নেতিবাচক দিকগুলি অথবা ত্রুটিগুলিকে ছোট ক’রে দেখি অথবা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করি। এইভাবে আমরা এই বিষয়ে অসচেতন থাকি যে, বাস্তবে কোনগুলি বস্তুর ভাল গুণাবলী এবং সেই বস্তুর প্রকৃত দুর্বল দিকগুলি কী। সেই “বস্তুগুলি” আমাদের কোন পরিচিত ব্যক্তি হতে পারে যাকে আমার আকর্ষণীয় লাগে এবং ভালো লাগে, অথবা আইসক্রিমের মতো কোন বস্তু।

এমন একজনের উদাহরণ নেওয়া যাক যার প্রতি আমাদের লালসা এবং আসক্তি আছে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা অতিরঞ্জিত করি যে, এই ব্যক্তিটি দেখতে কত সুন্দর অথবা তার যেকোন গুণই হোক না কেন আমরা সেটাকে আকর্ষণীয় মনে করি। আমরা অতিরঞ্জিত করি যে, সে আমাদের দেখা সবচেয়ে সুন্দর ব্যক্তি ইত্যাদি। আর আমরা সত্যিই সেই ব্যক্তির ত্রুটিগুলি উপেক্ষা করতে শুরু করি; আমরা সত্যিই সেগুলির বিষয়ে বেশী ভাবতেও চাই না যে, যেমন- সে খুব বিরক্তিকর হতে পারে, অথবা সে অদ্ভূতভাবে খাবার খায়, অথবা সে নাক ডাকে। হতে পারে, ঐ ব্যক্তিটি অপেক্ষাকৃত দেখতে সুন্দর কিন্তু আমাদের তাকে আরও অধিক সুন্দর মনে হয়। আমরা সেটা অস্বীকার করি না, কিন্তু সেই গুণকে অনেক বেশি অতিরঞ্জিত করার ফলে আমাদের মধ্যে আসক্তির উৎপত্তি হয় এবং সেইজন্য ঐ ব্যক্তির ত্রুটিগুলিকে উপেক্ষা করা হয় অথবা কম করে দেখা হয়। অবশেষে, মনের এইরকম অবস্থা সমস্যার দিকে পরিচালিত হয়, কারণ অবশেষে সেই প্রমত্ততা মুছে যায়। তারপর আমাদের ভালবাসা, আসক্তি সহজেই ব্যক্তিটির প্রতি সত্যিকারের বিরক্তি এবং ক্রোধে পরিণত হতে থাকে যখন তাদের ত্রুটিগুলি প্রকট হতে শুরু করে।

ক্রোধ বা বিরক্তি হল আসক্তির ঠিক বিপরীত। এক্ষেত্রে আমরা কোন ব্যক্তি অথবা বস্তুর নেতিবাচক গুণাবলী অথবা ত্রুটিগুলিকে অতিরঞ্জিত ক’রে দেখি এবং তার ভাল গুণগুলিকে উপেক্ষা করি। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা এটাকে অনেক অতিরঞ্জিত ক’রে দেখি যে, ঐ ব্যক্তি নিজের ঘরটা পরিষ্কার রাখে না, সে খুব অলস এবং থালা-বাসন পরিষ্কার করতে সহায়তা করে না ইত্যাদি। আমরা সেটাকে একটা বড় বিষয় তৈরী ক’রে ফেলি; আমরা এটাকে সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত করি ও ক্রোধিত হই এবং বিচলিত হয়ে যাই। একই সময়ে আমরা সেই ব্যক্তির ভাল গুণাবলীকে উপেক্ষা করতে শুরু করি অথবা আমরা সেই গুণগুলি আর দেখতে পাই না, যেমন- সে খুব উদার, খুব দায়িত্বশীল এবং খুব ধীর-স্থির ইত্যাদি। আমার কাছে একমাত্র যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, “আমি এটা সহ্য করতে পারি না কারণ, সে নিজের নোংরা মোজা মেঝেতেই ফেলে রাখে।” আর এইজন্য আমরা ক্রোধিত হয়ে যাই।

গভীরতম (পরমার্থ) সত্য

এই উদাহরণ গুলির মতোই, কোন ব্যক্তির বিষয়ে আপেক্ষিক সত্য, অগভীর সত্য সম্পর্কে আমাদের অসচেতনতা- সেই ব্যক্তির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক পক্ষ কোনগুলি অথবা তার শক্তিশালী এবং দুর্বল পয়েন্টগুলি কী কী- তার প্রতি আমাদের আসক্তি অথবা ক্রোধের কারণ হতে পারে। হয় আমরা তাদের চিনি না, আমরা তাদের উপেক্ষা করি, আমরা তাদের অতিরঞ্জিত করি অথবা আমরা তাদের ভুল বুঝি। কিন্তু এর থেকেও গভীর স্তরে আমাদের আসক্তি অথবা ক্রোধের পিছনে সেই ব্যক্তির বিষয়ে গভীরতম সত্য সম্পর্কে অসচেতনতা থাকে যে, সেই ব্যক্তি কীভাবে অস্তিমান।

যদিও এই বিষয়ে আমরা খুব জটিল অথবা সূক্ষ্ম স্তরে চর্চা করতে পারি, কিন্তু আজ আমাদের সন্ধ্যাকালীন উদ্দেশ্যকে খেয়াল রেখে আমরা এই বিষয়টা নিয়ে সরল স্তরে চর্চা করব। আমাদের মনে হয় যে, ঐ ব্যক্তিটি কোন মূর্ত বস্তুর মতো, বড় রেখা দ্বারা ঘেরা রয়েছে। মনে হয় যেন ঐ ব্যক্তি কোন প্লাস্টিক অথবা এমন কোন জিনিসে আবদ্ধ হয়ে আমাদের সামনে আছে, সেটার অস্তিত্ব তেমনই আছে যেমন প্রতীয়মান হয়, যেটা কোন চিত্রের মতো নিশ্চল। এই ভ্রান্ত ধারণার কারণে আমরা তাকে কোন মূর্ত বস্তু মনে করি, যেটা স্বভাবতঃ প্রতিষ্ঠিত, হেতু, প্রত্যয় এবং প্রভাব ইত্যাদি থেকে স্বতন্ত্র, অপরিবর্তনশীল এবং নিত্য। এটা খুবই বিভ্রান্তিকর; এটা ভুল, কারণ বাস্তবে সেই ব্যক্তির মেজাজ ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন হয়; তার শরীর ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন হয়, তার মানসিক অবস্থা ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন হয়। এটাতে মূর্ত কিছু নেই যা প্লাস্টিকে আবদ্ধ, স্থায়ী অথবা শাশ্বত।

“আপনি”-কে কোন মূর্ত এবং শাশ্বত সত্ত্বার ভুল ধারণার কারণে আমরা ভাবি যে, “আপনি সর্বদা এমনই; আপনি সবসময় নিজের মোজা রেখে দেন!” এই ভুল ধারণা এবং আমাদের এই অসচেতনতা, যা বাস্তবতার অনুরূপ নয়, এটা হল আমাদের সেই প্রবৃত্তির অন্তর্নিহিত কারণ, যে আমাদের বিরক্ত করতে পারে আর এই “জিনিস”-এর নেতিবাচক পক্ষকে অতিরঞ্জিত ক’রে প্রস্তুত করার জন্য বাধ্য করে। তার অস্তিত্বের বিষয়ে আমাদের অসচেতনতাই আমাদের সেই ব্যক্তির ভাল গুণগুলিকেও অতিরঞ্জিত করার জন্য বাধ্য ক’রে তোলে যে, সেটা যেন কোন মূর্ত এবং বিস্ময়কর “বস্তু”। আমাদের এই বিভ্রান্তি আবার সেই ব্যক্তিকে স্পর্শ করার জন্য আমাদের বাধ্য করে। আমরা নিজেদেরকে আটকাতে পারি না, কারণ সে এতটাই আকর্ষক। আমরা এতটা আসক্ত হয়ে যাই যে আমরা তাকে ছাড়তে চাই না আর সেই ব্যক্তিকে ঘুমোতেও দিতে চাই না।

তাই আমরা যদি অসচেতনতার এই দুটি দিক থেকে মুক্ত হতে পারি, যা আমাদের এটা ভাবতে বাধ্য করে যে, সেই ব্যক্তি মূর্ত এবং স্থায়ী, তাহলে আমাদের মধ্যে অশান্তকারী আবেগ উৎপন্ন হবে না। আমরা বুঝতে পারব যে, ঐ ব্যক্তি ক্রমাগতভাবে পরিবর্তনশীল, পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত, প্লাস্টিকে আবদ্ধ কোন ধরণের মূর্ত বস্তু নয়। আমরা যখন সেটা উপলব্ধি করি, তখন আমরা এটা ভাবি না যে, প্লাস্টিকে আবদ্ধ বস্তুর গুণাবলী নিত্য, যেগুলি আমরা অতিরঞ্জিত করি অথবা যেগুলি থাকার কল্পনা করি। আমরা সেই ব্যক্তির প্রকৃত ভাল গুণগুলি এবং খারাপ গুণগুলিকে দেখার জন্য প্রস্তুত হব আর এটা বুঝতে পারব যে সব ব্যক্তির নিজস্ব ভাল এবং খারাপ গুণ থাকে। তাহলে আমরা সেটাকে অতিরঞ্জিতও করব না আর সেটাকে অস্বীকারও করব না। ঐ ভিত্তির উপর আমরা একটা পরিপক্ক, উদার এবং প্রেমময় উপায়ে সহিষ্ণুতা এবং ধৈর্যপূর্বক সেই গুণগুলির বর্ণনা করতে পারব। না আমরা সেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকব আর না আমরা বিরক্ত হব।

যন্ত্রের (মেশিন) প্রতি আসক্তি এবং ক্রোধ

টেপ রেকর্ডারের প্রতিও সেই একই জিনিস প্রযোজ্য, একদম হুবহু। সেটার উপর আসক্তি হওয়া অথবা সেটার উপর ক্রোধিত হওয়ার পিছনে কী ভাবনা থাকে? প্রথমতঃ, আমরা সেটাকে একটা বড় বিমূর্ত বস্তুর রূপ দিয়ে ফেলি আর ভাবতে লাগি, “আমরা এর উপর প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছি”, আর এটা বুঝি যে এর চারিপাশে একটা বড় শক্ত রেখা রয়েছে। আর তারপরে আমরা এর ভাল গুণগুলিকে অতিরঞ্জিত করি, “উপদেশগুলিকে রেকর্ড করার জন্য এটা সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য,” আর এইভাবেই আমরা সেটার উপর নির্ভর হয়ে পড়ি। আমরা কোন বক্তৃতা শোনার সময়ও মনোযোগ দিই না আর নোটও তৈরী করি না, কারণ আমরা ভাবি যে রেকর্ডার হল অক্ষয় এবং স্থায়ী এবং এটা সবসময় কাজ করবে। আর যদি এটা কাজ না করে তাহলে সেটার উপর খুব ক্রোধিত হয়ে যাই।

কিন্তু আসলে সেটা তো একটা যন্ত্র বা মেশিন। এটা যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরী এবং যন্ত্রাংশ পুরোনো হয়ে গেলে তো নষ্ট হয়ে যায়; কিছুই চিরকালের জন্য থাকে না। এটা সত্য, হতে পারে এটা সুন্দরভাবে রেকর্ড করে, কিন্তু কখনো-কখনো সেটা কাজ করে না। আসলে এটা তো একটা মেশিনই- সেটার ব্যাটারী শেষ হয়ে যেতে পারে ইত্যাদি। আমরা যদি এই বিষয়টা বুঝে নিই, তাহলে আমরা ব্যাটারী শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে একটা বড় বিষয় তৈরী করব না। আমরা দায়িত্বশীল পদ্ধতিতে কাজ করব এবং এটা ব্যবহার করার পূর্বে পরীক্ষা ক’রে দেখব যে মেশিনটা ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, ব্যাটারী পুরো চার্জ হয়েছে কিনা ইত্যাদি। কিন্তু তারপরও যদি সেটা কাজ না করে, তাহলে আমরা ক্রোধিত হব না। আমরা নোট করে নেব; আমরা রেকর্ডিং করার এই মেশিনের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে যাব না।

এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে, টেপ রেকর্ডারের মতো মেশিন আর বিশেষ ক’রে আমাদের বর্তমান সময়ে কম্পিউটারের কারণে আমাদের চিত্তে এমন অশান্তকারী আবেগ বিকশিত হয়। যখন ঐ মেশিনটা আমাদের ইচ্ছা মতো কাজ করে না, তখন আমরা খুব ক্রোধিত হয়ে উঠি। আমরা মনে করি যে, “এরও নিজের একটা বুদ্ধি আছে”, এটা হাস্যকর। আমরা মনে করি, “এটার কাজ করা উচিত,” সর্বোপরি এটাকে নিখুঁত বলে মনে করা হয়। কিন্তু সেটা তো শুধুই একটা যন্ত্র বটে আর সেটা তো যন্ত্রাংশ দিয়েই তৈরী; আর এটা এমন মানুষরা তৈরী করেছেন যারা ভুল ক’রে থাকেন এবং তারা জানেন না কীভাবে নিখুঁতভাবে কাজ করতে হয়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমরা কম্পিউটার অথবা টেপ-রেকর্ডারের ব্যবহারই করব না। আমরা ব্যবহারই তো করব, কারণ সেটা খুবই সহায়ক হয়, কিন্তু যখন সেটা ঠিকভাবে কাজ করবে তখন তার প্রতি আসক্ত হব না; আবার যখন সেটা আমাদের ইচ্ছা অনুসারে কাজ না করবে তখন তার উপর ক্রোধিতও হব না। এইভাবে, আমরা সেটার প্রতি একটি ভারসাম্যপূর্ণ, স্বাস্থ্যকর মনোভাব বজায় রাখতে পারব। এটা করা সহজ নয় বিশেষ ক’রে তখন, যখন মেশিনটা খুব মূল্যবান হয়।

কোন ব্যক্তির প্রতি লালসা এবং আসক্তি নিয়ন্ত্রিত করার জন্য একটা অস্থায়ী উপায়

বৌদ্ধধর্মে অশান্তকারী আবেগগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দুটি স্তরের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কিছু অস্থায়ী, তৎকালিক পদ্ধতি আছে যা আমাদের বস্তুর বিষয়ে আপেক্ষিক সত্যকে সঠিকভাবে বুঝতে সহায়ক হয় এবং অন্যদিকে আছে পরম বা গভীরতম পদ্ধতি যা সেই বস্তুর বিষয়ে পরমার্থ সত্যকে বুঝতে সহায়ক হয় এবং যার প্রতি অশান্তকারী আবেগ পরিলক্ষিত হয়। গভীরতম পদ্ধতিকে ব্যবহার করার জন্য অনেক বেশি অধ্যয়ন এবং চিন্তন করা আবশ্যক, কিন্তু যেহেতু অস্থায়ী, তৎকালিক পদ্ধতিগুলিকে বোঝা এবং প্রয়োগ করা সহজ, এইজন্য প্রথমে আমরা এটার অভ্যাস করি আর এটাকে প্রয়োগ করি। এবার আমরা এই অস্থায়ী পদ্ধতিগুলির কিছু উদাহরণ দেখব।

শরীরের ভিতরে যা আছে সেটা নিয়ে চিন্তন করা

যদি আমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তির প্রতি আসক্তি অথবা লালসা থাকে, বিশেষ ক’রে আমরা যদি খুব প্রমত্ত হয়ে যাই এবং সেই ব্যক্তির শারীরিক সৌন্দর্য্যকে অতিরঞ্জিত ক’রে দেখি অথবা আমরা যদি নিজের শরীরের প্রতি আসক্ত হই, তাহলে এরজন্য আমরা একধরণের ধ্যান-সাধনা করি, যাকে প্রায়শই বলা হয় “শরীরের অশূচীতা”-এর উপর ধ্যানকেন্দ্রিত করা। দেখুন, “অশূচী” শব্দটা কিছুটা আমাদের রুচি এবং উৎসাহকে কমিয়ে দেয়। এটা কোন স্বস্তিপূর্ণ শব্দ নয়। এইজন্য আমি মনে করি যে আমাদের এখানে “অশূচী” শব্দের ব্যবহার করা উচিৎ নয়, এমনকি “নোংরা” শব্দটিও কখনও-কখনও ব্যবহার করা হয়, সেটাও করা উচিত নয়। বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে, যেখানে আত্ম-প্রতিষ্ঠার স্তর কম পাওয়া যায়। তাই এই দুটি শব্দের অর্থকে খুব খারাপ বলে মনে করা হয়। পরিবর্তে, আসুন আমরা মানব শরীরের (সেটা অন্যের হতে পারে অথবা আমাদেরও হতে পারে) সৃষ্টি কেবল আমাদের চর্চার বিষয় অথবা কোন বস্তুকে সংবৃত্তি সত্যের দৃষ্টিতে দেখব।

এখানে আমরা কোন প্যাকেজের উপমা ব্যবহার করতে পারি। একটা প্যাকেজ, মনে করুন সেটা কোন উপহার, যাকে বাইরে থেকে কাগজে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। এরপর সেই প্যাকেটের ভিতরে কোন বস্তু রাখা আছে। একইভাবে, আমাদের শরীর, অথবা অন্য কোন ব্যক্তির শরীর, বাইরে থেকে চামড়া দিয়ে মোড়ানো থাকে, আর সাধারণতঃ আমরা বাইরের অংশটাই দেখতে পাই। এখানে চামড়া একটা সুন্দর প্যাকেজিং সামগ্রীরূপে আছে। যেভাবে কোন উপহারকে সুন্দর এবং মূল্যবান কাগজ, ফিতা ইত্যাদি দিয়ে মোড়ানো থাকে, ঠিক তেমনই মানব শরীরকেও সুন্দর এবং মূল্যবান কাপড় দিয়ে সাজানো যায় যাতে সেটাকে আরও বেশি সুন্দর দেখায়। তবে কাপড় শুধুমাত্র প্যাকেজিং-এর সামগ্রী। দোকানের কোন পন্য আরও আকর্ষক করার জন্য তার নির্মাতা পন্যের প্যাকেজিংটি ডিজাইন করতে অনেক কষ্ট করে, আর আমাদের জন্য নজরকাড়া বিজ্ঞাপনও তৈরী করে। এরকমই অনেক মানুষ নিজের ত্বকের প্যাকেজকে আরও চিত্তাকর্ষক তৈরী করার জন্য মেকআপ, অভিনব চুলের বাহার এবং সুগন্ধী, অথবা আরও বেশী নজরকাড়া করার জন্য বড়-বড় ট্যাটু তৈরী করায় অথবা নাক-কান ছিদ্র করায় ইত্যাদি।

কিন্তু কোনও প্যাকেজ কেবল মোড়ানোর সামগ্রী মাত্র হয় না; তার ভিতরের বস্তুরও গুরুত্ব থাকে। শরীরের প্যাকেজের মধ্যে হাড়-কঙ্কাল, মাংসপেশী, বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইত্যাদি থাকে। যদি ব্যক্তির পেটের ভিতরের জিনিস বেরিয়ে আসে, তাহলে সেটা দেখে মানুষ বমি করে ফেলবে। অন্ত্রের ভিতরে মল ভরা থাকে আর মূত্রাশয়ে ভরা থাকে মূত্র, আর আমাদের ধমনী এবং শিরায় থাকে রক্ত। এটাই বাস্তবতা; এটাই সত্য যে আমাদের ত্বকের প্যাকেজের ভিতরে কী আছে। আমরা এটাকে অস্বীকার করতে পারি না। আর আমরা যদি পেট থেকে সব বমি, মুখ থেকে সব থুতু আর নাক থেকে সমস্ত শ্লেষ্মা, মুত্রাশয় থেকে সমস্ত মুত্র আর ধমনী এবং শিরা থেকে সমস্ত রক্ত বের করে দিই এবং ত্বকটা শুধু রেখে দিই, তাহলে সেটা আমাদের প্রিয়জন হতে পারে না, তাই নয় কি? আমাদের সেই প্রিয় জনের বাস্তবতা হল যে, সে একটা পুরো প্যাকেজ। আমরা তো এটা চাই না যে আমাদের প্রিয়জনের ত্বকের ভিতরের অংশটা শুধুমাত্র তুলো অথবা এমনই কোন জিনিসে ভরা থাকুক, যেমন প্রাকৃতিক ইতিহাসের সংগ্রহালয়ে থাকে। আমরা সেই ব্যক্তিকে জীবিত অবস্থায় দেখতে চাই, আর এটাই হল প্যাকেজের ভিতরের বাস্তবতা, আমরা সেটা পছন্দ করি অথবা না করি।

সুতরাং, এখন এটা খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আমরা কোনটা সুন্দর মনে করি আর কোনটা মনে করি কুৎসিত? আমরা কোনটাকে পরিষ্কার মনে করি আর কোনটাকে নোংরা? কিছু মানুষের ত্বক খুব সুন্দর মনে হয় আর কঙ্কালকে মনে হয় কুৎসিত, কিন্তু কঙ্কালে এমন কী আছে যা তাকে কুৎসিত করে তোলে? এটা তো শুধুমাত্র একটা কঙ্কাল। আমরা যদি কোন হাসপাতালে গিয়ে কোন অস্ত্রপ্রচারকে পর্যবেক্ষণ করি, আর সেখানে দেখি যে শরীরের ভিতরে কী-কী আছে, তাহলে সেখানে কুৎসিত বা ঘৃণ্য হওয়ার কী থাকে? এটা আমাদের দৃষ্টিকোণের বৈষম্য, তাই না? অবশ্যই, অস্ত্রপ্রচারকারী ডাক্তাররা এটাকে কুৎসিত অথবা ঘৃণ্য মনে করেন না। এটা তো হল শরীরের ভিতরের অঙ্গ।

সুন্দরতার মতো গুণাবলীকে অতিরঞ্জিত থেকে এড়ানো

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ভাল গুণগুলিকে অতিরঞ্জিত ক’রে না দেখা, কারণ এমনকি ভাল গুণগুলিও আপেক্ষিক এবং বিষয়গত হয়। উদাহরণ স্বরূপ, হতে পারে যে কোন ব্যক্তিকে আমার খুব সুন্দর লাগে, কিন্তু সেই ব্যক্তিকে আপনার একেবারেই সুন্দর লাগে না। অথবা কোন ব্যক্তিকে আমাদের কুৎসিত মনে হয়, কিন্তু হতে পারে সে আপনার কাছে তাকেই খুব সুন্দর মনে হয়। এটা পুরোপুরি ব্যক্তিনিষ্ঠ। যদি আমাদের কোন ব্যক্তির ত্বক্‌ এবং তার শরীরের আকৃতি আমাদের আকর্ষক মনে হয় তাহলে সেটা ঠিক আছে, সেটা আমাদের কাছে সুন্দর, এতে দোষের কিছু নেই। বিষয়টা হল, আমরা যেন সেটাকে অতিরঞ্জিত না করি। এই বিষয়ে কোন দোষ নেই যে কোন ব্যক্তিকে দেখে আমাদের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি জাগে। আমাদের তার রূপ ভাল লাগে; তাকে দেখে আমরা খুশী হই। সমস্যা তখন উৎপন্ন হয় যখন আমরা এই বিষয়টাকে অতিরঞ্জিত ক’রে দেখি, আর যখন আমরা অনুভব করি, “আমাকে সবসময় তার শরীরকে স্পর্শ করতে হবে; আমি যখনই তাকে দেখব, তখনই তাকে আলিঙ্গন করতে হবে; আমাকে তাকে সবসময় নিজের সামনে দেখতে হবে।” এটাই হল সমস্যা। যদি অন্য কেউ সেই ব্যক্তিকে আসক্তির সাথে দেখে তাহলে আমরা খুব ক্রোধিত হয়ে উঠিঃ “এই ব্যক্তি আর তার শরীরের উপর আমার অধিকার আছে।” আমরা রাস্তায় অনেক লোকের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করি, যারা দেখতে খুব সুন্দর। এটা শুধুমাত্র তখনই বিরক্তিকর হয় যখন আমরা বাধ্যতামূলক ভাবে এটা ভাবি, “আমি যদি এই ব্যক্তিকে স্পর্শ করতে পারতাম, বা এই ব্যক্তির সাথে এটা বা ওটা করতে পারতাম!” এটা আমাদের মানসিকভাবে খুব বিরক্ত ক’রে তোলে।

আমরা যদি সত্যিই প্যাকেজিংকে অতিরঞ্জিত করতে শুরু করি- এই ব্যক্তিটি কেমন দেখতে- তাহলে সেটা আমাদের এক্স-রে-এর মতো দৃষ্টি বিকশিত করতে এবং ঐ ব্যক্তির কঙ্কালের বিষয়ে কল্পনা করতে অনেক সহায়তা পাওয়া যায়। এটা করা ততটা কঠিন নয়, বিশেষ ক’রে যদি আমরা জানি যে একটা কঙ্কাল দেখতে কেমন হয়। এটা কোন শরীর-বিদ্যার পাঠ্য নয়; এটাকে নিখুঁত হতে হবে না। তবে আমরা মুখ ও মাথার ত্বকের নিচে অবস্থিত মাথার খুলিকে কল্পনা করতে পারি। এটা আমাদের শান্ত করতে সাহায্য করে। অথবা আমরা যদি কারও পেটে হাত বোলাই এবং ভাবি, “এটা খুবই চমৎকার”, তাহলে এই বিষয়ে একটু সচেতন হওয়ার চেষ্টা করবেন, আমরা যদি ত্বকের নীচে তিন বা চার সেন্টিমিটার ভিতরে চলে যাই, তাহলে আমরা কিসে হাত বোলাবো। এর মানে এটা নয় যে, সেই পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যে বিতৃষ্ণা জাগবে। এর অর্থ হল, আমরা কারও শরীরে হাত বোলানোর সময় প্রাপ্ত আনন্দকে অতিরঞ্জিত করে দেখব না। এই পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করলে সেটা আমাদের মানসিক ভারসাম্য প্রদান করে।

পূর্ববর্তী পদ্ধতিগুলি হল অস্থায়ীমাত্র; এগুলি আমাদের লালসা অথবা আসক্তি থেকে মুক্তি দেয় না। কিন্তু, যখন সেগুলি কোন নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে উদ্ভূত হয় তখন ঐ পদ্ধতিগুলি অস্থায়ীভাবে, এই অশান্তকারী আবেগগুলিকে কমিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে, সেগুলি থেকে নিজেদের পরিত্রাণ পেতে, আমাদের জানতে হবে যে কোন ব্যক্তির অস্তিত্বের আসল আধার কী এবং আমাদের সেই ব্যক্তিকে কোন বড় “বস্তু” রূপে না দেখা। কিন্তু এটা খুবই কঠিন এবং উন্নত স্তরের। অতএব, প্রথমে আমরা এই অস্থায়ী, তৎকালিক পদ্ধতিগুলিকে প্রয়োগ করি। এটা করতে সক্ষম হওয়ার জন্য শ্রবণ, চিন্তন এবং ধ্যান করার ত্রিস্তরীয় প্রক্রিয়া আবশ্যক।

পদ্ধতিটির বিষয়ে শ্রবণ করা এবং এটা সম্পর্কে চিন্তন করা

প্রথমতঃ, পদ্ধতিটি কী হবে সেটার সম্পর্কে আমাদের শ্রবণ করতে হবে। আমরা যদি কোন ব্যক্তির শারীরিক আকর্ষণ এবং সে দেখতে কেমন, তার প্রতি খুব বেশি আসক্ত হই, তাহলে এর উপায় হল আমাদের এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে যে, ত্বকের নীচে কঙ্কাল ইত্যাদি আর কী আছে আর পেটের ভিতরে কী আছে? এই বিষয়ের উপর শ্রবণ করার পর আমাদের সেটার বিষয়ে চিন্তন করতে হবে যাতে আমরা সেটা বুঝতে পারি আর দৃঢ় বিশ্বাস বিকশিত করতে পারি যে, আমরা যদি কেবল প্যাকেজিং নয়, বরং প্যাকেজিং-এর ভিতরের বস্তু বিষয়েও সচেতন হই, তাহলে আমরা সেই ব্যক্তির প্রতি লালসা এবং আসক্তির কারণে এত অশান্ত হব না। সেই ব্যক্তির সাথে আমাদের কম সমস্যা হবে এবং আমাদের নিজস্ব মানসিক প্রবৃত্তি সম্বন্ধিত সমস্যা কম হবে।

চারটি যুক্তিকে প্রয়োগ করা

আমরা যে উপায়গুলির বিষয়ে শ্রবণ করেছি, সেগুলির সম্পর্কে চিন্তন করার জন্য আমাদের তার বিষয়ে “চারটি যুক্তি”-এর পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা করা আবশ্যক। কোন কিছুতে বিশ্বাসী হওয়ার জন্য এই চারটি উপায় নির্ধারিত।

উপপত্তি-সাধন যুক্তি

প্রথম যুক্তি দ্বারা, এই দেখার জন্য আমরা শিক্ষাগুলি পরীক্ষা করি যে, সেগুলি যুক্তিসঙ্গত এবং যৌক্তিক কিনা।

এই উদাহরণের ক্ষেত্রে বিষয়টা মোটামুটি সুস্পষ্ট যে কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব কেবল তার ত্বকের মধ্যেই সীমিত নয়। আমাদের সত্যিই এটা প্রমাণ করার দরকার নেই। কিন্তু আমরা যদি যুক্তি দ্বারা এই বিষয়টি পরীক্ষা করতে চাই, তাহলে অবশ্যই একটা খালি চামড়ার ব্যাগ উঠে দাঁড়াতে পারে না যদি এর ভিতরে একটা কঙ্কাল না থাকে। যদি আমরা কিছু খাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের পেটের ভিতরে এবং অন্ত্রের ভিতরে কিছু ভরা থাকবে। সুতরাং এটা পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত যে, একজন ব্যক্তির শরীর কেবল তাদের ত্বক নয়, কারণ ত্বকের ভিতরে অবশ্যই কিছু থাকবে।

কার্যকারণ যুক্তি

এরপর, আমরা এটা পরীক্ষা করব যে একটি নির্দিষ্ট শিক্ষা নিজের অভিপ্রেত পরিণাম উৎপন্ন করার জন্য কীভাবে কার্য করবে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি সেই ব্যক্তির শরীরের বাইরে এবং ভিতরের এই দুটি স্বরূপ সম্পর্কে সমানভাবে সচেতন থাকতাম, তাহলে সেই বোধগম্যতার কারণে দুটি স্বরূপের মধ্যে থেকে কোন একটাকে আমরা না অতিরঞ্জিত করতাম আর না কোন একটিকে উপেক্ষা করতাম।

আমরা এই বিশ্লেষণও করতে পারি যে যদি কোন ব্যক্তি এত সুন্দর আর আকর্ষক হয়, তাহলে আমাদের কাছে কেন কেবল তার ত্বকই এত সুন্দর লাগে? আমাদের তার পেট থেকে নির্গত বমিও কেন সুন্দর লাগে না? স্পষ্টতই, সেটা আমাদের সুন্দর লাগে না। এইজন্য সেই ব্যক্তির শরীরের বাইরের এবং ভিতরের দুটি স্বরূপেরই বোধগম্যতা অর্জন করার প্রভাব এই রকমের হওয়া উচিত নয় যে, আমাদের বাইরের রূপ সুন্দর লাগে না অথবা সেই ব্যক্তির সৌন্দর্যের আনন্দ নেওয়ার সময় আমাদের খুশি নষ্ট হয়ে যায়। এই বোধটা কেবল এটুকুই করে যে আমাদের আনন্দকে সঠিক প্ররিপ্রেক্ষিতে রাখে। ঠিক আছে, সেই ব্যক্তির শরীর বাইরে থেকে সুন্দর হতে পারে, কিন্তু তার শরীরের ভিতরেও কিছু আছে আর এটা সকলের মধ্যেই থাকে।

আমরা যখন এই বিন্দুগুলি নিয়ে কাজ করি, সেগুলি নিয়ে ভাবি এবং বোঝার চেষ্টা করি, তখন এটাই খুব আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, কারণ প্রায়শই যেটা ঘটে সেটা হল আমরা সত্যিই সেগুলিকে বিশ্বাস করতে চাই না। এই ব্যক্তির পেট এবং অন্ত্রের ভিতরে কী আছে তার বিষয়ে বিচার করার জন্য একটা আবেগগত প্রতিরোধ থাকে। এটা দেখতে খুব আকর্ষণীয়। তবে কথা হল এটাই হল বাস্তবতা; এটাই সত্য। তিব্বতীরা চিত্রলেখ ও মাটির মূর্তি পছন্দ করেন। তারা বলেন, যদি আপনার কাছে কোন বড় বিষ্ঠা (মল) পিন্ড থাকে আর আপনি যদি সেটাকে একটা মানব শরীরের রূপ দেন আর সেটাকে ত্বকের রঙে রাঙিয়ে দেন, তাহলে সেটা দেখতে যতই সুন্দর হোক না কেন, সেটা একটা বিষ্ঠা পিন্ডই থেকে যাবে!

এই বোধগম্যতার ব্যবহারিক কার্যকারিতা এটাও বটে যে, যদি আমরা কোন ব্যক্তির শরীরের বাহ্য এবং আন্তরিক স্বরূপ বিষয়ে সচেতন হই, তাহলে এই বোধগম্যতার পরিণামস্বরূপ তার শরীরের প্রতি লালসা অথবা আসক্তি উৎপন্ন হবে না। এটা এই কারণে হয় যে, এতে না আমরা কোন একটা পরিস্থিতিকে অস্বীকার করি, আর না অন্য পরিস্থিতিকে অতিরঞ্জিত করি। সুতরাং, এই উপলব্ধিটা হল মোহের সাথে বেমানান। যেটা বোধগম্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেটা হল ব্যক্তির প্রতি স্থিতিশীল, দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি, আন্তরিক ভালবাসা এবং ধৈর্য্যের মনোভাবসহ বয়স বাড়ার সাথে-সাথে যেকোনও দেহে যা কিছু ঘটে। আমরা যদি তাদের বর্তমান সৌন্দর্যকে অতিরঞ্জিত করি, তাহলে তারা যখন বৃদ্ধ হতে শুরু করে বা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং সেই সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে, তখন আমরা হয়তো অন্য কাউকে খুঁজতে লাগব যাকে আরও আকর্ষণীয় মনে হবে। কিন্তু আমরা যদি বাস্তবতা বুঝতে পারি এবং স্বীকার করি যে বাইরে এবং ভিতরে উভয়ই সমানভাবে পরিবর্তন হতে থাকবে, তাহলে সেই অন্তর্দৃষ্টি ব্যক্তির সাথে একটি স্থিতিশীল, প্রেমময় সম্পর্ক থাকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

ধর্মতা যুক্তি

এরকম কেন হয় যে মানুষ বাইরে থেকে তো সুন্দর দেখায় কিন্তু তার ভিতরে হাড়-কঙ্কাল, মল ও বমি থাকে? এটা এইজন্য হয়, কারণ এটাই বস্তুর স্বভাব; আমরা হলাম জীব আর জীবের শরীর এই উপাদান দিয়েই তৈরী, এটাই হল বাস্তবতা; এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের কাছে কোন উপায় নেই। এভাবেই শরীর কাজ করে।

অপেক্ষা যুক্তি

পরিশেষে, আমরা পরীক্ষা করি যে এই মানসিক অবস্থা, এই বোধগম্যতার বিকাশ কিসের উপর নির্ভর করে যাতে আমরা এটা বিকাশ করতে সক্ষম হই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, আমাদের কিছু আত্ম-নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। আমরা যখন সেই ব্যক্তিকে দেখি তখন তার শরীরের এখানে-ওখানে স্পর্শ করার নিজের বাধ্যকারী প্রবল ইচ্ছাকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদের এতটাই আত্ম-নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে যাতে আমরা কিছুক্ষণের জন্য পিছনে যেতে পারি আর বিশ্লেষণ এবং আত্ম-নিরীক্ষণ করতে পারি। এই আত্ম-নিয়ন্ত্রণ আমাদের পরিস্থিতিকে আরও অধিক স্পষ্টভাবে এবং গভীরভাবে বুঝতে সহায়তা করবে।

তদুপরি, আমাদের মধ্যে এরকম করার জন্যও এতটা ইচ্ছা এবং উদারতা থাকতে হবে যে আমরা এই ব্যক্তির প্রতি উৎপন্ন হওয়া ঘৃণা থেকে এতটা ভয়ভীত হয়ে যাব না যে, সেই ব্যক্তির সাথে কোন ব্যবহারই করতে পারব না। এই পদ্ধতিটি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা এই সমস্ত কারণের উপর নির্ভর করে। আমরা যদি এই বিষয়টিকে প্রথম থেকেই বুঝে নিই, তাহলে আমরা জানতে পারব যে আমাদের কী রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

ধ্যান সাধনা

একবার যখন আমরা চিন্তন করার এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে ফেলি, যার অর্থ হল, সেই শিক্ষাকে বুঝে নিই আর এই বিষয়টার প্রতি আশ্বস্ত হয়ে যাই যে এই শিক্ষা নিজের বিকাশ করতে সহায়ক এবং এটা এমনকিছু যেটাকে আমরা নিজের ভিতরে বিকশিত করতে চাই, তখন আমরা সেটাকে বাস্তবে করতে চাই, যাকে আমরা “ধ্যান-সাধনা” করা বলি। আমরা যে শিক্ষাকে বুঝেছি এবং তার সম্পর্কে আশ্বস্ত হয়েছি, সেটাকে নিজের জীবনে একীভূত করার প্রক্রিয়াই হল ধ্যান-সাধনা। এই শিক্ষা আমাদের যেমন নির্দেশ করে তদনুরূপ বার-বার চিন্তন এবং কর্ম করার মাধ্যমে একটা উপকারী অভ্যাস হিসাবে নিজেদের জীবনেও একীভূত করি।

এটা হল একটা দ্বৈত প্রক্রিয়া। প্রথমে আমরা বিচার ধ্যান-সাধনা করি যাকে কখনও-কখনও “বিশ্লেষণাত্মক ধ্যান-সাধনা”ও বলা হয়। একটি নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে, অন্য কথায়, একলা বসে অর্থাৎ যখন ঐ ব্যক্তি আমাদের সামনে না থাকে, আমরা সেই ব্যক্তির বিষয়ে অনুশীলন করি যার প্রতি আমাদের আসক্তি থাকে, উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের তার বাহ্য স্বরূপের প্রতি আসক্তির ভাব থাকতে পারে। আমরা সেই ব্যক্তির ছবি রাখি অথবা কেবল তাকে স্মরণ করি এবং তারপর আমরা এইভাবে গবেষণা করি, “হ্যাঁ, ঐ ব্যক্তির একটা কঙ্কাল আছে। হ্যাঁ, তার পেটে কিছু আছে।” আমরা এইভাবে কল্পনা করি যেন তার শরীর স্বচ্ছ এবং তার কঙ্কাল তার পেটের ভিতরের সামগ্রী আর তার ত্বকের নীচের অন্য জিনিসগুলির বিষয়ে কল্পনা করতে-করতে আমরা এই জ্ঞান উৎপন্ন করার চেষ্টা করি যে, এই সমস্ত উপাদান সেই ব্যক্তির শরীরে অস্তিমান। এইভাবে আমরা নিজেদেরকে এটা বিশ্বাস করাই যে আমাদের মনে মনে এই দৃষ্টিটা সত্য। এটা এমন যেন আমাদের কাছে-এক্স-রে-এর মতো দৃষ্টি আছে, কিন্তু এখানে ব্যক্তির বাহ্য স্বরূপের উপরেও আমাদের দৃষ্টি থাকে যেটা বাস্তবে খুবই সুন্দর হতে পারে, তার শরীরের ভিতরটা দেখলে তার ব্যবহারিক বাহ্য সৌন্দর্যকে অবৈধ ক’রে দেয় না।

কিছু সময় পর্যন্ত এই ধরণের ‘বিচার ধ্যান’ করার পর, যে সময় আমাদের মানসিক শক্তি বহিরাগমণ হয়, এক অর্থে, আমাদের ধ্যানের লক্ষ্যের দিকে, সেই ব্যক্তির শরীরের দিকে, তখন আমরা ‘স্থাপিত ধ্যান’ শুরু করি। এই দ্বিতীয় পর্যায়ে, আমরা নিজেদের মানসিক শক্তিকে নিজের ভিতরের দিকে আরও বেশি কেন্দ্রিত করি যেখানে আমরা সক্রিয়ভাবে উপলব্ধি করা বিষয়গুলিকে আত্মসাৎ করি। আমরা সত্যিই অনুভব করার চেষ্টা করি, “হ্যাঁ, এটিই বাস্তবতা; এটাই এই ব্যক্তির শরীরের বাহ্য এবং আভ্যন্তরীণ স্বরূপের সত্য। হ্যাঁ, এটাই সত্য।” আর আমরা যদি সেই ব্যক্তিকে কেবল তার শারীরিক স্বরূপের মাধ্যমেই সনাক্ত করি, তাহলে আমরা নিজেদেরকে এটাই মনে করাই যে সেই ব্যক্তির নিজেরও একটা মন আছে, তার নিজেরও আবেগ আছে। কিন্তু এটা ধ্যান-সাধনার জন্য আরও একটা অন্য বিষয়।

দৈনন্দিন জীবনে পদ্ধতিকে প্রয়োগ করা

একবার যখন আমরা লালসা এবং আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার এই পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুটা পরিচিত হয়ে যাই, এবং যখন এটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, তখন আমরা এই পদ্ধতিগুলিকে বাস্তবিক জীবনে এবং প্রকৃত পরিস্থিতিগুলিকে প্রয়োগ করতে শুরু করি। আমাদের যখন এই পদ্ধতিগুলি আবশ্যক হয়, অর্থাৎ যখন আমাদের মধ্যে আসক্তির প্রবল ভাবনা জাগ্রত হয়, যখন আমাদের ভিতরে সেই ব্যক্তিকে আদর করার প্রবল লালসা জাগে, তখন আমরা এই পদ্ধতিগুলিকে প্রয়োগ করি। উদাহরণ স্বরূপ, নিজেদের উদ্দেশ্যগুলি পরীক্ষা ক’রে আমরা বুঝতে পারি যে, আমরা ব্যক্তিকে কেবল এইজন্য নিজের হাত দিয়ে আদর করতে চাই না, কারণ সেই ব্যক্তির কোন প্রকারের আরাম দেওয়ার জন্য অথবা তাকে ম্যাসাজ করা অথবা এই ধরণের কিছু প্রয়োজন, তবে আমাদের এই বিষয়ে আবশ্যকতার অনুভব এইজন্য হয়, কারণ আমরা সেই ব্যক্তির প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে থাকি। সেই সময় আমরা সেই ব্যক্তির শরীরের পরস্থিতিকে বোঝার জন্য সেই পদ্ধতির প্রয়োগ করি যার অভ্যাস আমরা ধ্যান-সাধনায় করেছিলাম। আমরা এই বিষয়টা বুঝতে পারি যে শরীরে হাড়ের কঙ্কাল থাকা এবং পেটের মধ্যে বমি ইত্যাদির থাকাই সেই ব্যক্তির যথার্থতা, আর আমরা এটা অনুভব করার চেষ্টা করি যে, এটাই হল সত্য।

ফলস্বরূপ, আমরা নিজের মনে স্পষ্টভাবে এটা অনুভব করতে পারি যে এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত আর কী করা অনুচিত। কিন্তু আমরা এখনও এখানে একটা অস্থায়ী, তাৎকালিক পদ্ধতির উপরই কাজ করি। এইজন্য যদি আমাদের সেই ব্যক্তিকে স্পর্শ করতে, তার হাত ধরতে ইত্যাদি করতে ইচ্ছা হয়, তাহলে আমরা এই বিষয়টাকে বুঝতে পারি যে, আমরা এরকম করতে থাকি কারণ এরকম করতে আমাদের ভালো লাগে। এমন নয় যে সেই ব্যক্তির নিজের দিক থেকে এই বিষয়টা আবশ্যক। কিন্তু সেই সময়ে এই ধ্যানটা প্রয়োগ ক’রে, আমরা যেটা করি সেটাকে অতিরঞ্জিত করি না। ফলে, এটা আমাদের পরীক্ষা করার অনুমতি দেয়, এরকম করলে অন্য ব্যক্তি স্বস্তি বোধ করবে? যদি আমরা এরকম করি তাহলে কি সেই ব্যক্তির খারাপ লাগবে না? আর যদি এমন করা উচিত না হয়, তাহলে আমরা সেই ব্যক্তিকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকার জন্য আরও ভালোভাবে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করতে সক্ষম হব।

অবশেষে, এটা স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠবে যে আমরা এই ভারসাম্যপূর্ণ এবং বিবেচ্য উপায়ে কর্ম করতে পারবঃ আমরা বস্তুকে অতিরঞ্জিত ক’রে দেখব না, ভাবনাত্মকরূপে অনেক বেশি নির্ভর হব না ইত্যাদি। ফলস্বরূপ, আমাদের প্রতি তাদের কোন সংবেদনশীলতা থাকলে অন্য ব্যক্তি এটা অনুভব করবে। এর কারণ হল, আমরা যদি সবসময় সেই ব্যক্তির হাত ধরি কারণ, আমরা নিজেদের অসুরক্ষিত এবং একলা অনুভব করি, আর ভাবি, তার হাত ধরলে আমাদের কিছু ভাল অনুভব হবে, এটা করলে আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তখন আমাদের ভিতরে এই অশান্তকারী কম্পন তৈরী হয় আর আসক্তি জাগে। এই পরিস্থিতিটা অন্য ব্যক্তির ক্ষেত্রে আরামদায়ক নয়। যদি সেই ব্যক্তির মধ্যে একটুখানিও সংবেদনশীলতা থাকে, তাহলে সে এই বিষয়টা অনুভব করতে পারবে। কিন্তু আমরা যদি শারীরিক স্পর্শের আনন্দটাকে অতিরঞ্জিত না করি, তাহলে আমরা অনুভব করব, “ঠিক আছে, এটা তো কারও হাতটাকে ধরারই বিষয়, এই স্পর্শের অনুভূতি ভাল লাগে; আমি জানি যে, এই ব্যক্তির হাতের ত্বকের নীচে কী আছে, হাড় ইত্যাদি,” তাই এটা নয়, “ওহ! এটা তো অদ্ভূত!” এর পরিবর্তে, যদি আমরা ভাবি, “এটা ভাল এবং এটা আমাকে কিছুটা ভাল অনুভব করায়, কিন্তু এটা আমার সমস্যার সমাধান করবে না,” তাহলে আমরা এই বিষয়ে স্বস্তি অনুভব করি। এটা স্বতঃস্ফূর্ত, এটা স্বাভাবিক আর অন্য ব্যক্তিরা এটাকে কৃত্রিম বলে মনে করেন না; তারাও এটার সাথে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এটা বিকশিত করাই হল আমাদের লক্ষ্য। আমাদের লক্ষ্য এটা নয় যে, “কাউকেই স্পর্শ করব না, সবাই হল কেবল একটা মলমূত্রের থলি,” এটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এখানে আমরা ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করি যাতে আমরা সত্যিই অন্যদের উপকার করার জন্য কাজ করতে পারি।

আমরা যখন শান্তিদেবের বোধিচর্যাবতারের মতো কোন মহান বৌদ্ধ গ্রন্থে এই পদ্ধতিগুলির বিষয়ে অধ্যয়ন করি, তখন আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, শান্তিদেব কোন প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ের চর্চা করেছেন। এটা মানসিক স্থিরতা এবং একাগ্রতা অর্জনের প্রেক্ষাপটে বলেছেন। ধ্যানের সবচেয়ে বড় বিক্ষেপের মধ্যে একটা হল ক্রমাগত কাউকে নিয়ে চিন্তা করা, যারজন্য আমাদের মধ্যে লালসা এবং আসক্তি জাগে। এটা অনেক বড় বিক্ষেপ। তাই চিত্তের স্থিরতা এবং একাগ্রতা অর্জন করার জন্য, বিশেষ করে, যেকোন ধ্যান-সাধনার অনুশীলন করার সময়, আমাদের এই পদ্ধতিটিকে প্রয়োগ করতে হবে, যখন সেই ব্যক্তি আমাদের কাছে না থাকে, যার প্রতি আমরা আসক্ত। গ্রন্থটিতে এই পদ্ধতিগুলির উল্লেখ এই প্রেক্ষাপটেই করা হয়েছে।

কিন্তু স্পষ্টতই, এই পদ্ধতিগুলি ধ্যান কেন্দ্রিত করা এবং একাগ্রতা বিকশিত করার জন্য আমাদের অভ্যাসের পরিস্থিতি ছাড়াও অন্য পরিস্থিতিতেও অনেক উপযোগী। অন্যদের সাথে আমাদের সামান্য সম্বন্ধের ক্ষেত্রেও এর অনেক উপযোগীতা আছে। এইজন্য আকাঙ্খা এবং আসক্তির মোকাবিলা করার জন্য এই পদ্ধতিগুলির বিষয়ে গ্রন্থে পড়ার সময় আমাদের এগুলি কেবল একাগ্রতার সাধনা দ্বারা উৎপন্ন হতে থাকা, বিক্ষেপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার শক্তিগুলি প্রয়োগ করার জন্য একটি বিস্তৃত প্রেক্ষাপটের কথা ভাবতে হবে।

গ্রন্থে ক্রোধ, ঈর্ষা ইত্যাদির মতো অন্য অশান্তকারী আবেগগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য বিভিন্ন উপায়গুলিকে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপনার প্রস্তুতিগুলি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এখন সেই সমস্ত বিষয়ে চর্চা করার জন্য সত্যিই আমাদের কাছে সময় নেই। তবে কোন ব্যক্তির বাহ্য স্বরূপের আধারের উপর তাদের প্রতি আসক্তি এবং লালসাকে নিয়ন্ত্রণ করার সম্বন্ধে এই উদাহরণে আমাদের মনোভাবগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা দেখতে পাওয়া যায়।

নিরাপত্তাহীনতার সাথে মোকাবিলা করা

আমরা যদি গভীরভাবে দেখি, তাহলে আমরা বুঝতে পারি কোন ব্যক্তির প্রতি আমাদের আসক্তি এবং লালসার পিছনে আমাদের নিরাপত্তাহীনতা অন্তর্নিহিত আছে। সুরক্ষা পাওয়ার ইচ্ছার কারণে আমাদের এটা মনে হয়, এই ব্যক্তির সাথে আমাদের সম্পর্কের মাধ্যমে সুরক্ষা লাভ হবে। ভয়, একাকীত্ব ইত্যাদির কারণে এই গভীরতম অশান্তকারী আবেগের মতো নিরাপত্তাহীনতা প্রতিপালন করা হয়। এর থেকে আমরা কীভাবে মুক্ত হতে পারি?

এরজন্য আমাদের সত্যিই গভীরতম সত্যকে বুঝতে হবে, অর্থাৎ “আমি” সম্পর্কে গভীরতম বাস্তবতা- মানে, এমন কোন প্লাস্টিকের প্যাকেজিং-এর মধ্যে মোড়ানো মূর্ত “আমি” নই যে বাকী সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন, যাকে সুরক্ষিত করা যায়। এমন কোন বস্তু নেই, যেটাকে আমরা সুরক্ষিত করতে পারি। আমরা যাকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করছি সেটা আমাদের যথার্থ অস্তিত্বের অতিরঞ্জিত স্বরূপ। বাস্তবতা হল আমরা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছিঃ আমাদের মানসিক অবস্থা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে, আমাদের আবেগ ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। ব্যবহারিক দৃষ্টিতে, এই সব বস্তুকেই “আমি”-এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়, কিন্তু এমন কোন মূর্ত “আমি” নেই যার অস্তিত্ব এইসব বস্তু থেকে স্বতন্ত্র, আর যাকে সুরক্ষিত করতে হবে। সবকিছুই সব সময় পরিবর্তন হয়ে চলেছে।

যদি সেই সব বস্তু সবসময় পরিবর্তিত হয় যাকে ব্যবহারিকরূপে “আমি” বলা হয়, তখন আমরা একটাই চেষ্টা করতে পারি যে, আমরা একটা স্পষ্ট দিক, একটা সুরক্ষিত দিক যাকে শরণ বলা হয়- যাতে আমরা এগিয়ে যাই। বাস্তবসম্মত দৃষ্টিতে সেই নিরাপদ দিক হল এটা যে, আমাদের আরও অধিক ইতিবাচক মনোভাব বিকশিত করতে, নিজেদের উন্নতি ইত্যাদির জন্য কাজ করি। কিন্তু এমন কিছু নেই যেটা সুরক্ষিত করা যায়, এমন কিছু নেই যেটা রক্ষা করা যায়। কোনও বস্তু এমনভাবে অস্তিত্বে নেই যে, সেটা অন্য সব বস্তুর থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক এবং তার প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা যদি এই বিষয়ের গভীর বোধ অর্জন করে ফেলি আর তার প্রতি আশ্বস্ত হতে পারি তাহলে আবার অনিরাপদ এবং একাকীত্বের ভাবের সমস্যাগুলি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাবে এবং অদৃশ্য হয়ে যাবে। এক অর্থে, ভয় পাওয়ার কিছু থাকে না। কিন্তু কোন মূর্ত, স্থায়ী “আমি”-এর বোধকে বিনির্মাণ করার সময় এটা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা সেই অনুচ্ছেদবাদ চরমতার চিন্তার শিকার না হয়ে যাই যেখানে আমাদের অস্তিত্বই থাকে না, আর তাই আমরা আমাদের ক্রিয়াকলাপের জন্য দায়বদ্ধ হই না। হতে পারে আমরা নিজেদের কর্মের ফলাফলের বিষয়ে নিশ্চিত নই, কিন্তু তবুও আমরা কর্ম করি এবং তারজন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি।

এখন, অবশ্যই এটা প্রাথমিকভাবে মানসিক নিরাপত্তাহীনতার সাথে মোকাবিলা করছে, এবং নিরাপত্তাহীনতার অন্যান্য দিকও রয়েছে- আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রগুলিতে আমাদের “আমি”-এর আপেক্ষিক সত্য এবং নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের অবশ্যই অর্থনৈতিক দিক বা অন্য যেকোন দিক আছে, যেটা আমাদের নিরাপত্তার একটি প্রথাগত ধারণা প্রদান করে, তার যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সেটা করার সময়, যেমন আবেগের দৃষ্টিতে থাকে, আমাদের পরিস্থিতির বাস্তবতাকে অতিরঞ্জিত করা উচিৎ নয়। আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতা হল, এটা সম্পূর্ণরূপে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের নিজেদের আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক ব্যবস্থা ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি সাম্যবাদের পতন ঘটে, আর একটা নতুন ধরণের সরকার এবং সামাজিক ব্যবস্থা সেটার স্থান নেয়, তাহলে পরিস্থিতি বদলে যায়। এইজন্য যা আমাদের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা প্রদান করে সেটা হল আমরা নিরাপদ দিকে এগিয়ে যেতে হবে এবং অনেক বেশি সংখ্যক এমন সরঞ্জাম একত্রিত করতে হবে, যেটা যেকোন পরিস্থিতি অথবা যা কিছু ঘটুক না কেন, সেটার মোকাবিলা করতে সক্ষম হব। শুধুমাত্র যদি জীবন একেবারে স্থির থাকত এবং কখনোই পরিবর্তিত না হতো, তাহলে আমরা নিরাপদে থাকতে পারতাম, কারণ আমরা জানতাম কী ঘটতে চলেছে। কিন্তু সেটা অসম্ভব।

এছাড়াও, আমাদের ভিতরে সন্তুষ্টি থাকবে হবে, যাতে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের জন্য কতটা যথেষ্ট। আমি এমন ব্যক্তিদেরও জানি যাদের কাছে মিলিয়ন ডলার আছে, তবুও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে কারণ তারা বলে, “আমার কাছে দশ মিলিয়ন ডলার নেই। যদি আমার কাছে দশ মিলিয়ন ডলার থাকত, তাহলে আমি নিরাপদ বোধ করতাম।” এরকম না হওয়ার চেষ্টা করুন। এটা মনের একটি খুব অসুখী অবস্থা।

নিজেদেরকে অসচেতনতা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা কি অর্থহীন?

আপনি আপত্তি সহকারে বলতে পারেন, “আমাদের ক্ষমতা সীমিত; আমরা বুদ্ধ নই, এইজন্য আমরা নিজের কর্মের সব পরিণতিগুলিকে জানতে পারি না এবং আমরা নিজের অথবা অন্যদের বাস্তবতাকে দেখতে পাই না। তাহলে কি আমরা কষ্ট করা এবং দুঃখ ভোগ করার জন্য অভিশপ্ত? আমরা কি কখনো নিজেদের অসচেতনতা এবং বিভ্রান্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবো?”

না, আমরা অবশ্যই অভিশপ্ত নই, কারণ এই অসচেতনতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এটা সহজ নয়; এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, কিন্তু বস্তুর বিষয়ে বোঝার ক্ষমতা মনের আছে আর এর কাছে এই সুযোগ আছে যে সব জিনিসকে একসাথে রাখতে পারে। আর এইজন্য, আমরা যেটা করি, সেটা হল আমাদের বোধগম্যতা প্রসারিত করার চেষ্টা। আমরা আরও বেশি জ্ঞানার্জন করার চেষ্টা করি, যাতে আমাদের নিজের ব্যবহারের প্রভাবের বোধ সঠিক না হওয়া সত্ত্বেও, যেহেতু আমাদের এর সাথে যুক্ত সব পরিবর্তিত কারকগুলির বোধ হয় না, আমরা আমাদের জ্ঞানে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে পারি। সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে আমরা সম্ভাব্যতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এটা অনুমান করতে পারি যে আমরা কোন পরিস্থিতির মোকাবিলা কীভাবে করব, আর তারপর আমরা নিজেদের উন্নতির জন্য কাজ চালিয়ে যেতে পারি।

অন্যদের সাথে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমাদের অন্য কোন ব্যক্তি, পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে যতবেশী সম্ভব তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের এটা দেখার চেষ্টা করতে হবে যে সাধারণতঃ কী ঘটবেঃ সাধারণভাবে সেই ব্যক্তি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে ইত্যাদি এবং সাথে-সাথে আমাদের পরিস্থিতি এবং সেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বও বিবেচনায় রাখতে হবে। এইভাবে অন্ততঃ আমাদের একটা অনুমান হয়ে যায় যে সেই ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক রাখতে কেমনভাবে চেষ্টা করা অবশ্যক হয়।

আমাদের সকলের মধ্যে এইসব যোগ্যতা অস্তিমান থাকে, কারণ আমাদের মন এইভাবেই কাজ করে। স্বাভাবিকভাবে আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা আমাদের আশেপাশের সব তথ্য গ্রহণ করি। হতে পারে আমরা সেই সব তথ্যের দিকে মনোযোগ দিই না, হতে পারে সেগুলিতে আমাদের আগ্রহ থাকে না, কিন্তু সেই সব কিছুই ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভূত তথ্য। আর আমরা নমুনাকে বুঝতেও পুরোপুরি সক্ষম হই। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা দেখি যে এই তিনজনই মহিলা, আর এইভাবেই আমরা জিনিসগুলিকে মিলিয়ে দেখতে পারি যে সেগুলি নিজেদের মধ্যে কীভাবে উপযুক্ত। আমরা তথ্যকে নমুনার মধ্যে একত্রে রাখতে পারি এবং এর থেকে তথ্য তৈরী করতে পারি। আমরা চিনতে পারি যে আমার ডান হাতটি আমার বাম হাত নয় এবং এইভাবে আমরা জিনিসের স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে সচেতন হতে পারি। আমাদের বিভিন্ন জিনিসের সাথে ভিন্নভাবে সম্পর্ক তৈরী করার ক্ষমতাও রয়েছে। আমরা জানি কীভাবে শিশুর সাথে কথা বলতে হয় এবং কীভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্কের সাথে কথা বলতে হয়, আর আমরা দুজনের সাথে একইরকমভাবে কথা বলি না। আমরা যদি সত্যিই সংবেদনশীল না হই, তাহলে আমাদের মধ্যে সেই নমনীয়তা থাকে না। সুতরাং, সমস্ত মৌলিক উপকরণ আমাদের মধ্যে আছে।

আমাদের মন বিভিন্নভাবে কাজ করে, তার মধ্যেকার কিছু বৈশিষ্ট্য “তথাগতগর্ভ” নামে পরিচিত। আমাদের সবার মধ্যেই তথাগতগর্ভের গুণ অস্তিমান আছে, যেটা আমাদের বুদ্ধত্ব লাভ করতে সক্ষম ক’রে তোলে। বিষয়টা হল সেগুলিকে উপলব্ধি করতে হবে এবং সেগুলির অনুশীলন করতে হবে।

সারাংশ

সংক্ষেপে, আমরা এইভাবে আমরা কুশল পদ্ধতির প্রয়োগ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ লাভ ক’রে অশান্তকারী আবেগগুলির সাথে মোকাবিলা করতে পারি। সব রকমের অশান্তকারী আবেগের সাথে মোকাবিলা করার অনেক পদ্ধতি আছে আর এই বিভিন্ন প্রকারের পদ্ধতিগুলিকে শিখতে, সেগুলির অনুশীলন করতে এবং প্রয়োগ করতে সক্ষম হওয়া খুবই সহায়ক। এর কারণ হল কিছু পরিস্থিতিতে একটা পদ্ধতি ততটা অধিক কার্যকর নাও হতে পারে অথবা আমরা সেটাকে খুব ভালভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হই না। কিন্তু, যদি আমাদের কাছে অন্য কিছু বিকল্প পদ্ধতি থাকে, তাহলে সেগুলি সেই বিশেষ পরিস্থিতিতে আরও কার্যকর হতে পারে। অথবা, যেমন কখনও যদি আমাদের মধ্যে অসুস্থতার পরিস্থিতি তৈরী হয়, তখন আমাদের ওষুধের সংমিশ্রণ প্রয়োগ করতে হয়, তেমনই কোন বিশেষ শক্তিশালী অশান্তকারী আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, আমাদের পদ্ধতিগুলি সংমিশ্রণ ক’রে প্রয়োগ করতে হবে। সুতরাং, আমরা যত বেশি জিনিস শিখি এবং নিজেদেরকে প্রশিক্ষিত করি, ততবেশি আমরা কঠিন, সমস্যাযুক্ত পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে এবং সেটাকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হই।

এরজন্য শান্তিদেবের ‘বোধিসত্ত্বচর্যাবতার’ গ্রন্থ পড়া এবং অধ্যয়ন করা সত্যিই খুবই উপকারী, কারণ সেটার পুরো উপস্থাপনাটি পরীক্ষা করার উপর ভিত্তিকঃ “কেন আমি এই বিরক্তিকর আবেগগুলিকে আমার উপর শাসন করতে দিচ্ছি? আমি নিজের মনে এটার থাকাকে এত সুবিধাজনক কেন বানিয়ে রাখব? এটা প্রকৃত শত্রু এবং তার সত্যিই কোন শক্তি নেই। একবার যদি আমি এর থেকে মুক্ত হয়ে যাই, এটাকে নিজের মন থেকে বের করে দিই, তাহলে এরা কোথায় যাবে? কোন সাধারণ শত্রুর মতো বাইরে কোথাও দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের উপর পুনরায় আক্রমণ করবে না? এটার নিজস্ব কোন মূর্ত রূপ নেই।” এইভাবে চিন্তা-ভাবনা করা আর সেটাকে সত্য মনে করার প্রতি আশ্বস্ত হয়ে যাওয়া খুবই লাভদায়ক। এর দ্বারা আমাদের নিজেদেরকে এই অশান্তকারী আবেগ থেকে মুক্ত করার জন্য দৃঢ় অভ্যাস গড়ে তোলার ভিত্তি অর্জন করা যায়। তাদের নিয়ন্ত্রণে না যাওয়া আমাদের জীবনের মানদন্ডের জন্য আরও ভাল দায়িত্বভার নিতে সক্ষম করে তোলে।

Top