মৌলিক বৌদ্ধ অনুশীলন আমাদের তিনটি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত করায়। আমরা আমাদের নিজের ভালোর জন্য, নিজের সমস্যা এবং দুঃখকে অতিক্রম করার জন্য এই তিনটি বিষয়ে প্রশিক্ষিত হতে পারি। অথবা আমরা অপরের বেশী উপকার করার জন্য মৈত্রী এবং করুণার সঙ্গে এই বিষয়গুলিতে প্রশিক্ষিত হতে পারি।

ত্রি-শিক্ষা কী কী?

  • নৈতিক অনুশাসন (শীল)- এটি হল ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত থাকার ক্ষমতা। আমরা গঠনমূলক ব্যবহারে নিযুক্ত হওয়ার জন্য এই গুণটিকে বিকশিত করতে পারি। এই প্রথম শিক্ষাটি হল স্ব-অনুশাসন; এখানে আমরা অন্যদের অনুশাসিত করতে চাই না।
  • একাগ্রতা (সমাধি)- নিজের চিত্তকে কেন্দ্রিত করার ক্ষমতা, যাতে অসঙ্গত বিচারগুলির কারণে আমাদের চিত্ত বিচলিত না হয়ে যায়। এর ফলে আমরা আমাদের চিত্তকে তীক্ষ্ণ এবং কেন্দ্রিত করি, নিস্তেজ নয়। মানসিক স্থিরতা ছাড়াও, আমাদের আবেগপ্রবণতার স্থিরতাও বিকশিত করা প্রয়োজন, যাতে আমাদের চিত্ত ক্রোধ, আসক্তি, ঈর্ষা ইত্যাদি দ্বারা পরাভূত না হয়ে যায়।
  • প্রভেদমূলক সচেতনতা (প্রজ্ঞা)- কী গ্রহণ করণীয় এবং কী বর্জনীয়, এর বিচার করা অথবা পার্থক্য করার ক্ষমতাকে বোঝায়। ঠিক যেমন- আপনি যখন সবজী বাজার করতে যান, আপনি বিচার করেন যে, “এটা দেখতে ভালো না, বরং ওটা দেখতে খুব ভালো”। এখানে, আমরা ব্যবহারের দিক থেকে বিচার করি অর্থাৎ আমরা যে পরিস্থিতিতে মানুষের সাথে আছি তাদের উপর নির্ভর করে বিচার করি কোনটা উপযুক্ত আর কোনটা উপযুক্ত নয়। আরও অধিক গভীর স্তরে গিয়ে, আমরা বিচার করি কোনটা প্রকৃতপক্ষে বাস্তবিক এবং কোনগুলি শুধু আমাদের কল্পনার অভিক্ষেপ।

বৌদ্ধ বিজ্ঞান, বৌদ্ধ দর্শন এবং বৌদ্ধ ধর্ম

আমরা যদি আমাদের নিজেদের লাভের জন্য অথবা অন্যের লাভের জন্য এই তিনটি শিক্ষার অনুশীলন করি, তাহলে দুটি দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে যে কোনও একটির দিকে অভিমুখ করতে পারি। এই দুটি ওই প্রভেদ থেকে পাওয়া যায়, যার উল্লেখ পরমপূজ্য দালাই লামা সাধারণ সভাগুলিতে করেন। তিনি বলেন বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি ভাগ আছেঃ বৌদ্ধ বিজ্ঞান, বৌদ্ধ দর্শন এবং বৌদ্ধ ধর্ম।

বৌদ্ধ বিজ্ঞান প্রধানতঃ চিত্ত-বিজ্ঞানকেই বোঝায়। অর্থাৎ সেটা কী করে কাজ করে, আমাদের আবেগ, এবং যেগুলিকে দালাই লামা মানসিক এবং আবেগপ্রবণ স্বাস্থ্যবিধি বলতে পছন্দ করেন। বৌদ্ধ ধর্মে বিভিন্ন প্রকারের আবেগপ্রবণ অবস্থা, তারা কী করে কাজ করে এবং তাদের মধ্যে কার সাথে কার খাপ খায়, এর সম্পর্কে বিস্তৃত বিশ্লেষণ আছে।

বৌদ্ধ বিজ্ঞানে নিম্নলিখিতগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়-

  • জ্ঞান সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান- আমাদের জ্ঞান কী করে কাজ করে, চেতনার স্বভাব, এবং একাগ্রতা বিকশিত করতে সহায়তা করার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পদ্ধতি।
  • সৃষ্টিতত্ত্ব- একটি বিস্তৃত বিশ্লেষণ, কী করে ব্রহ্মাণ্ড আবির্ভূত হয়েছে, টিকে থাকে এবং সমাপ্তি হয়।
  • পদার্থ- একটি বিস্তৃত বিশ্লেষণ, কী করে পদার্থ, শক্তি, অতিপারমাণবিক কণা ইত্যাদি কাজ করে।
  • চিকিৎসা বিজ্ঞান- শরীরের ভিতরের শক্তি কী করে কাজ করে।

যে কেউ এই বিষয়ে অধ্যয়ন করতে পারে, শিখতে পারে এবং উপরের বিষয়গুলি থেকে লাভ অর্জন করতে পারে। দালাই লামা প্রায়ই বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেন।

দ্বিতীয় ভাগ, বৌদ্ধ দর্শন অন্তর্ভুক্ত করে, যেমন-

  • নীতিশাস্ত্র- দয়া এবং দানের মতো মৌলিক মানব মূল্যবোধের বিষয়ে আলোচনা যা কোনো বিশেষ ধর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়, এবং যার থেকে যে কেউ লাভবান হতে পারেন।
  • ন্যায়শাস্ত্র এবং অধিবিদ্যা- স্থির সিদ্ধান্ত, সার্বজনীন, ব্যক্তিগত, গুণাবলী, বৈশিষ্টগুলি ইত্যাদির বিস্তৃত উপস্থাপনা। এগুলি একসাথে কী করে কাজ করে এবং কী করে আমরা তাদের জানবো।
  • হেতু এবং ফল- কার্য-কারণ সম্বন্ধ, প্রকৃত সত্য কী, এবং আমাদের অভিক্ষেপগুলি কি করে প্রকৃত সত্যকে বিকৃত করে, এই সম্পর্কে বিস্তৃত বিশ্লেষণ।

আবার, বৌদ্ধ দর্শন নেহাৎ বৌদ্ধদের জন্য সীমিত নয়, বরং এমন একটা জিনিস যার থেকে সবাই লাভবান হতে পারে।

তৃতীয় ভাগ, বৌদ্ধ ধর্ম বৌদ্ধ শিক্ষার প্রকৃত কর্মক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই কারণে এর মধ্যে কর্ম, পুনর্জন্ম, বিধি-অনুশীলন, মন্ত্র ইত্যাদি বিষয়গুলি পরিবেষ্টিত হয়। সেই কারণে এটা তাদের জন্যই নির্দিষ্ট যারা বৌদ্ধ মার্গের অনুশীলন করেন।

এই ত্রি-শিক্ষা বৌদ্ধ বিজ্ঞান এবং দর্শনের দৃষ্টিতে সকলের জন্য প্রাসঙ্গিক এবং এটাকে উপযুক্ত ক’রে সহজভাবে প্রস্তুত করা যেতে পারে। অথবা এগুলিকে উক্ত দুটি এবং বৌদ্ধ ধর্মের নামেও প্রস্তুত করা যেতে পারে। এই বর্গীকরণকে আমি বলি “ধর্ম-লাইট” এবং “দি রিয়েল থিং ধর্ম”।

  • ধর্ম-লাইট- কেবল এই জন্মকে উন্নত করার জন্য বৌদ্ধ বিজ্ঞান এবং বৌদ্ধ দর্শনের পদ্ধতিগুলির অনুশীলন করা।
  • দি রিয়েল থিং ধর্ম- তিনটি বৌদ্ধ লক্ষ্যঃ শ্রেষ্ঠতর পুনর্জন্ম, পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি, এবং বোধিপ্রাপ্তির জন্য ত্রি-শিক্ষার অবলম্বন।

যখন আমি ধর্ম-লাইটের কথা বলি, তখন এটি সাধারণত “দি রিয়েল থিং ধর্ম”-এর দিকে একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হয়। কারণ আরও আধ্যাত্মিক লক্ষ্যের বিষয়ে ভাবার আগে আমাদের সাধারণ জীবনকে উন্নত করার জন্য আমাদের প্রয়োজনকে উপলব্ধি করতে হবে। তবে যাইহোক, বৌদ্ধ বিজ্ঞান এবং দর্শন অপরিহার্যভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রারম্ভিক অংশ নয়। সুতরাং আমরা এটার সম্পর্কে ভাবি বা না ভাবি যে, এটা বৌদ্ধ ধর্মের জন্য একটা প্রারম্ভিক বা সাধারণ অংশ, তবে আমরা দেখতে পারি যে আমাদের জীবনকে উন্নত করার জন্য ত্রি-শিক্ষাকে কী করে অনুশীলন করা যায়।


চার আর্যসত্য

বৌদ্ধ দর্শনের পক্ষ থেকে, পথ সম্পর্কে একটা সাধারণ উপস্থাপনা প্রস্তুত করে যেভাবে বৌদ্ধ চিন্তন কাজ করে, যাকে সাধারণত চার আর্যসত্য বলা হয়। এগুলিকে আমরা জীবনের চারটি তথ্য রূপেও ভাবতে পারি, যা নিম্নানুসারে প্রস্তুত-

  • আমরা যে দুঃখ এবং সমস্যাগুলির মুখোমুখি হই সেগুলিকে দেখা। প্রথম তথ্যটি হল যে জীবন খুব কঠিন।
  • দ্বিতীয় তথ্যটি হল, আমাদের জীবনের সমস্যাগুলি কারণ থেকে উদ্ভুত।
  • তৃতীয় তথ্যটি হল, আমরা এই সমস্যাগুলি থামাতে পারি; আমাদের চুপচাপ থেকে এই সমস্যাগুলি স্বীকার করে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা এইগুলির সমাধান করতে পারি।
  • চতুর্থ তথ্যটি হল, কারণকে পরিহার করে আমরা আমাদের সমস্যাগুলি থেকে মুক্ত হতে পারি। আমরা একটি জ্ঞানের পথ অনুসরণ করি, যা পরামর্শ দেয় যে আমরা কী করে কাজ করব, কথা বলব ইত্যাদি।

সুতরাং, যদি আমাদের আচরণ বা কথা বলার উপায় আমাদের সমস্যার সৃষ্টি করে, তবে আমাদের সেটা পরিবর্তন করা দরকার। এই ত্রি-শিক্ষা তারই অংশ যা আমাদের প্রয়োজন আমাদের সমস্যাগুলির কারণ থেকে মুক্তি পেতে। এই ত্রি-শিক্ষাকে বোঝার একটি খুব সহায়ক উপায়, কারণ এটি নির্দেশ করে যে আমরা কেন তাতে প্রশিক্ষিত হব। সুতরাং, যদি আমরা জীবনে সমস্যার সম্মুখীন হই, তবে আমাদের দেখতে হবে-

  • আমি যেভাবে আচরণ করি এবং কথা বলি তা নিয়ে আমার নৈতিক অনুশাসনে কোনও সমস্যা আছে কি?
  • আমি পুরো জায়গা জুড়ে আছি কি না, আমি আবেগপ্রবণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে আছি কি না, এই সম্পর্কে আমার একাগ্রতায় কোনও সমস্যা আছে কি?
  • বিশেষত, আমার বাস্তবতা এবং বিকৃত অভিক্ষেপের মধ্যে পার্থক্য করার পথে কোনও সমস্যা আছে কি?

আমরা এটাকে এই জীবনকালে কেবলমাত্র আমাদের সাধারণ জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, অথবা এটাকে ভবিষ্যতের জীবনে আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হব সেই পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। একটি শিক্ষানবিশ স্তরে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই শিক্ষাগুলি সম্পর্কে বিবেচনা করা উচিৎ- সেগুলি কীভাবে আমাদের সহায়তা করতে পারে? আমরা কী করছি যা আমাদের জন্য সমস্যা তৈরী করছে? এগুলি উপশম করার জন্য আমরা কী করতে পারি?

দুঃখের কারণ

বৌদ্ধ দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে, আমাদের দুঃখের কারণ হল অজ্ঞানতা। আমরা বিশেষত দুটি বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞাত বা বিভ্রান্ত।

প্রথম বিষয়টি হল যা আমাদের অজানা, তা হল হেতু এবং ফল, বিশেষত আমাদের আচরণের ক্ষেত্রে। আমাদের মধ্যে যদি বিশৃঙ্খল আবেগ থাকে, যেমন- রাগ, লোভ, আসক্তি, অহংকার, ঈর্ষা ইত্যাদি, তাহলে আমরা ধ্বংসাত্মকভাবে আচরণ করি। আমরা রেগে লোকেদের প্রতি চিৎকার করি, আমরা ঈর্ষা করি এবং মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করি; আমরা আসক্ত হয়ে যাই এবং মানুষের প্রতি অনুরক্ত থাকি। এই সমস্ত কিছুই হল আমাদের সমস্যার কারণ। যেহেতু এই আবেগগুলি আমাদের ধ্বংসাত্মকভাবে কাজ করতে প্রেরিত করে অথবা আত্ম-ধ্বংসাত্মকভাবে, সুতরাং এর পরিণতি হল দুঃখ।

একটি বিরক্তিকর আবেগের সংজ্ঞা দেখতে এটি সহায়ক। এটি মনের একটি অবস্থা যা আমাদের মনের শান্তি এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণকে হারাতে বাধ্য করে, যখন এটি উত্থাপিত হয়। আমরা যখন কারোর উপর ক্রোধিত হয়ে চিৎকার করি, তখন সেটা তাদের বিপর্যস্ত করতেও পারে অথবা নাও পারে। এমনকি আমরা যা বলি তারা সেটা শুনতেও পারে নাও পারে, অথবা তারা কেবল হাসতে পারে এবং মনে করে যে আমরা বোকা। কিন্তু আমরা মনের শান্তি হারিয়ে ফেলি, আর আবেগের সাথে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি, যা প্রায়শই চিৎকার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে। এটি একটি অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা। যেহেতু আমরা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম, এবং তার কারণে আমরা এমন কোনো কথা বলেছিলাম যার জন্য আমরা পরে অনুশোচনাও করি।

আমরা এই ভাবে কাজ করি, কারণ-

  • আমরা সত্যিই হেতু এবং ফল বুঝি না। আমরা প্রায়শই বুঝি না যে, আমরা যদি কোনও নির্দিষ্ট উপায়ে বিশৃঙ্খল আবেগের প্রভাবে কাজ করি, তাহলে তা আমাদের জন্য অসুখীতাই নিয়ে আসবে।
  • অথবা, আমরা হেতু এবং ফল সম্পর্কে বিভ্রান্ত হই এবং এটিকে বিপরীতভাবে বুঝি। আমরা প্রায় ভাবী, “আচ্ছা, আমি যদি এই ব্যক্তির উপর চিৎকার করি তবে এটি আমাকে আরও ভালো অনুভুতি প্রদান করবে,” যেটা অবশ্যই কখনও করে না। বা যখন আমরা সত্যিই কারও প্রতি অনুরক্ত থাকি, তখন আমরা বলতে পারি, “আপনি কেন বেশি করে ফোন করেন না, বা আমার সাথে বেশি ঘন-ঘন দেখা করেন না কেন?” এই আবেগটা আমাদের প্রায়শই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, তাই নয় কী? আমরা যা চাই তা অর্জন করতে পারি না, কারণ হেতু এবং ফল কীভাবে কাজ করে সে বিষয়ে আমরা বিভ্রান্ত।

আমাদের মধ্যে যে দ্বিতীয় ধরণের অজ্ঞানতা আছে সেটা বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত। যেহেতু, আমরা বাস্তবতা সম্পর্কে বিভ্রান্ত, তাই আমাদের মধ্যে বিশৃঙ্খল মনোভাব জাগে। এর একটা উদাহরণ হ’ল আত্ম-তন্ময়তা, যেখানে আমরা সর্বদা আমার, নিজের এবং আমি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি। এটা খুব বিচার্য হতে পারে, কারণ এটি এমন একটি সিন্ড্রোমের মধ্যে পেঁচিয়ে আছে যেখানে আমাদের মনে হয় আমাদের নিখুঁত হতে হবে। এমনকি আমরা যদি গঠনমূলকভাবেও কাজ করি, নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করি, সবকিছু যথাযথভাবে পাই, এটি বেশ বাধ্যকারী হয়ে যায়। যদিও আমরা কিছুটা সাময়িক সুখ অর্জন করতে পারি, তবে তা দ্রুত অসন্তুষ্টিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কারণ আমরা তখনও ভাবী, “আমি যথেষ্ট ভালো নই” এবং নিজের উন্নতির জন্য চাপ দিতেই থাকি।

এমন কোনো ব্যক্তিকে উদাহরণ হিসাবে নেওয়া যাক, যিনি একজন পরিষ্কার খেয়ালের পরিচ্ছন্নবাদী। এবং যখন তিনি তার নিজের বাড়ি পরিষ্কারের ব্যাপারে যুক্ত হন, তিনি একটি ভ্রান্ত ধারণার অধীনে থাকেন যে তিনি সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং, এটিকে পরিষ্কার এবং সুশৃঙ্খল রাখতে পারেন। এটা অসম্ভব! মনে করুন, আপনি সবকিছু পরিষ্কার করেন, আপনি নিখুঁত করেন, আপনি ভালো অনুভব করেন। এরপর বাচ্চারা বাড়ি এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিল; তখন আপনি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়লেন। আপনি ভাবলেন যে আপনাকে আবার পরিষ্কার করতে হবে। এইভাবে এটা বাধ্যকারী হয়ে যায়। প্রতিবার আপনি সুখ অনুভব করবেন, “আহ! এবার সব ঠিকঠাক আছে”। কিন্তু এই অনুভূতিটা দ্রুত চলে যায়। সেখানে সবসময় এমন একটি জায়গা থাকে যা আপনি লক্ষ্যই করেন না!

মনের এই অবস্থাগুলির পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে আপনি পান, যাকে বলা হয় “সর্ব-সংস্কার দুঃখ”। সেটি কোনও বিশৃঙ্খল আবেগ হোক বা বিশৃঙ্খল মনোভাব হোক না কেন, তবে এটি এই ধরণের বাধ্যতামূলক আচরণগুলির পুনরাবৃত্তির কারণে ঘটে। এটি হল তাই, আমরা কী করে আমাদের অভ্যাস গড়ে তুলি, যা আমাদের সমস্যাগুলিকে চিরস্থায়ী করে দেয়।

এটা শুধুমাত্র আমাদের মানসিকভাবে প্রভাবিত করে না, বরং শারীরিকভাবেও করে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি সর্বদা রাগ করে থাকি, আমরা উচ্চ রক্তচাপ হয়। তারপর উদ্বেগ থেকে আমরা নালী-ঘা-এ গ্রস্ত হই ইত্যাদি। অথবা, আমরা যদি পরিচ্ছন্নবাদী হই, তাহলে আরাম করা কঠিন হয়ে যায়। আমরা সর্বদা উত্তেজিত থাকব, কারণ আমাদের মতে, সবকিছুই নিখুঁত হতে হবে, কিন্তু সেটা কখনোই হয় না।


ত্রি-শিক্ষা আমাদের সমস্যার কারণগুলি দূর করতে কীভাবে সহায়তা করে

আমাদের সত্যি যা প্রয়োজন তা হল ত্রি-শিক্ষা

  • আমাদের বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে আমাদের প্রভেদমূলক সচেতনতা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, যখন এটি পরিচ্ছন্নবাদ হিসাবে আসে, যেখানে আপনার কল্পনা থাকে “সবকিছু অবশ্যই সর্বদা নিখুঁত এবং পরিষ্কার হতে হবে এবং আমাকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে”। আপনি এটি প্রতিস্থাপন করেন এবং ভাবেন “অবশ্যই আমার ঘরটি নোংড়া হতে চলেছে, কেউ এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না”। আপনি অনেক বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। কারণ হ্যাঁ, আপনি এখনও আপনার বাড়ি পরিষ্কার করবেন, আর আপনি জানেন যে ওটা নিয়ে আপনাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। পরম্পরাগত গ্রন্থগুলি একটি ধারালো কুঠার দিয়ে গাছ কেটে দেওয়ার উদাহরণটি ব্যবহার করে।
  • এই কুঠার দিয়ে গাছ কেটে ফেলার জন্য আমাদের ক্রমাগত একই স্থানে আঘাত করা দরকার, যা হল একাগ্রতা। আমাদের মন যদি সদা বিক্ষিপ্ত থাকে, তাহলে আমরা সেই প্রভেদমূলক সচেতনতা হারিয়ে ফেলি। সুতরাং, আমাদের অবশ্যই একাগ্র থাকতে হবে যাতে আমরা সর্বদা একই জায়গায় কুঠার দিয়ে আঘাত করতে পারি।
  • এই কুঠারটি ব্যবহার করতে আসলে শক্তি প্রয়োজন। যদি আপনার শক্তি না থাকে, তাহলে আপনি কুঠার উঠাতে পারবেন না, এবং এই শক্তি আসে নৈতিক আত্ম-শৃঙ্খলা থেকে।

এইভাবে, আমরা বুঝতে পারি যে, ত্রি-শিক্ষা কীভাবে আমাদের সমস্যার উৎসটিকে কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। আমরা বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক স্থাপন না করেই উপরোক্ত সমস্ত পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করতে পারি। সুতরাং, এটি সবার জন্য উপযুক্ত। আমরা এগিয়ে যাওয়ার আগে, যা শিখেছি সেটা দ্রুত বিচার করি-

  • কল্পনা এবং বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য দেখতে আমরা প্রভেদমূলক সচেতনতা ব্যবহার করি। এর ফলে আমরা আমাদের নিজস্ব আচরণের মধ্যে হেতু এবং ফলটি দেখতে পাই। যখন আমাদের মধ্যে প্রভেদমূলক সচেতনতা না থাকবে, তখন আমাদের আচরণ এবং মনোভাবগুলি জন্ম দেবে অসুখীতা, অথবা একধরণের সুখ, যা আমাদের কখনও সন্তুষ্টি দেয় না।
  • উপরের বিষয়গুলি যথাযথভাবে বুঝতে হলে আমাদের দরকার ভালো একাগ্রতা, যাতে আমরা মনোনিবেশ করে থাকতে পারি।
  • ভালো একাগ্রতা বিকশিত করার জন্য, আমাদের দরকার শৃঙ্খলা (শীল), যাতে যখন আমাদের মন বিক্ষিপ্ত হয়, তখন আমরা এটাকে ফিরিয়ে আনতে পারি।
  • আমাদের সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতে এবং আমাদের জীবনের গুণ উন্নত করতে সহায়তা করার জন্য আমরা এই ত্রি-শিক্ষাকে প্রয়োগ করতে চাই।

এই সমস্ত থেকে দূরে থাকার মূল অন্তর্দৃষ্টিটি হ’ল সুখ এবং অসন্তুষ্টি, যা আমরা আমাদের জীবনে অনুভব করি, এবং এগুলি উৎপন্ন হয় আমাদের নিজস্ব বিভ্রান্তি থেকে। অন্যদের, সমাজকে, অর্থনীতি ইত্যাদি নিয়ে তৈরী হওয়া সমস্যাগুলিকে দোষারোপ করার পরিবর্তে আমাদের গভীর স্তরের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এই পরিস্থিতিগুলির সাথে মোকাবিলা করার জন্য আমাদের মানসিক অবস্থার দিকে নজর রাখতে হবে। আমরা অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি, কিন্তু এখানে আমরা আমাদের সাধারণ দুঃখানুভুতি এবং এক ধরণের ক্ষণিক সুখের কথা বলছি। আমাদের কিন্তু এর থেকে বড় লক্ষ্য থাকা উচিৎ, যা হল এক ধরণের সুখ যা মানসিক শান্তি নিয়ে আসে এবং এটি অনেক বেশী স্থায়ী এবং স্থিতিশীল হয়।

আমরা যখন সমস্যাগুলির মুখোমুখি হই, তখন আমরা সবাই হতাশ হয়ে পড়ি এবং একেবারে করুণ হয়ে পড়ি। অথবা আমরা আরও মানসিক শান্তির সাথে এটির মুখোমুখি হতে পারি। কারণ কেবল নিজের জন্য দুঃখ প্রকাশ না করে আমরা পরিস্থিতিটি আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। আমরা দেখতে পাই এর সাথে কী জড়িয়ে আছে; এবং এটির সঙ্গে মোকাবিলার উপায়ও আছে।

বিবেচনা করুণ, আপনার শিশু যখন রাত্রিবেলা বাইরে যায়, আপনি তখন সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়েন। আপনি ভাবেন, “তারা কি নিরাপদে বাড়ি ফিরবে?”। পুনরায়, আমাদের উদ্বেগ এবং অসুখীতার উৎস হল এই মনোভাবটি যে, “যে কোনও প্রকারে আমি আমার সন্তানের সুরক্ষার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি,” যা হল অবশ্যই একটি কল্পনা। যখন তারা নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসে, এবং আপনি খুশি হন, আপনি স্বস্তিবোধ করেন। কিন্তু পরের বার যখন তারা বাইরে যায়, আপনি আবার চিন্তিত হয়ে পড়েন। সুতরাং, এই ধরণের অনুভূতি স্থায়ী হয় না, নয় কি? তারপর, আমরা সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকি, তাই এটা স্থায়ী হয়ে যায়। আমরা এটিকে এমন অভ্যাসে পরিণত করে ফেলি, যে আমরা সবকিছুর সম্পর্কে চিন্তা করি। এটি আমাদের স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে। এটি একটি খুব অপ্রীতিকর অবস্থা।

আসল চাবিটি হল আমাদের বোধশক্তি, অর্থাৎ উপলব্ধি করা যে এইগুলির কারণ হল আমাদের নিজস্ব বিভ্রান্তি। আমরা মনে করি যে কাজের কয়েকটি নির্দিষ্ট উপায় আমাদের জীবনে সুখ নিয়ে আসবে, অথবা এমন একটি মনোভাব যেখানে আমরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারব যেটা হবে সঠিক, কিন্তু আসলে সেটা নয়। আমরা এই চিন্তা-ভাবনাটি কেটে ফেলি- “এটা অযৌক্তিক”- এবং এর উপর মনোনিবেশ করি।

সারাংশ

আমরা যখন জীবনের চারটি তথ্যের উপর অনুধাবন করি, তখন আমরা উৎসাহিত হয়ে উঠি, এই দেখে যে আমাদের সমস্যা এবং নেতিবাচক আবেগগুলি স্থির নয় বরং এদের উন্নতি করা যেতে পারে; তাছাড়া এগুলিকে সম্পূর্ণরূপে পরিহারও করা যেতে পারে। একবার যখন আমরা দুঃখের কারণগুলির মোকাবিলা করি, তখন দুঃখের অস্তিত্ব বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু এই কারণগুলি নিজের থেকে অদৃশ্য হয় না।

ত্রি-শিক্ষার সাথে যুক্ত হয়ে আমাদের জীবন-যাপনের একটি অবিশ্বাস্য উপায় হ’ল নৈতিকতা, একাগ্রতা এবং প্রভেদমূলক সচেতনতা। এগুলি একসাথে কাজ করে আর একই সাথে আমাদের সেই জিনিসটির কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যা আমরা সব সময় খুঁজছি- সুখ।

Top