সুতরাং, জীবনে সবসময় উত্থান এবং পতন হতেই থাকে- কখনো-কখনো আমরা সুখী হই এবং দুর্দান্ত অনুভব করি- আবার কখনো-কখনো আমরা দুঃখী এবং অসুখী হই। প্রায়শই, আমরা শুধু বলি, “এটাই জীবন।” এবং পরিস্থিতির গভীরতার দিকে তাকাই না। তবে আসলে আমরা আমাদের জীবনকে কি এইভাবেই দেখতে চাই- পরের মুহূর্তে আমরা কেমন অনুভব করব সেটা কখনো না জেনে? সৌভাগ্যবশতঃ বুদ্ধ বিষয়টা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং সবকিছুর অন্তর্নিহিত আসল সমস্যাটির খোঁজ করেছিলেন। আসল সমস্যা অর্থাৎ দুঃখসত্য হল আমাদের কাছে যে ধরণের শরীর এবং মন আছে সেটাকে বোঝায়। যে শরীর এবং মন আমাদের কাছে আছে সেটা হল আধার, যার মাধ্যমে আমরা এই উত্থান এবং পতন অনুভব করি, যা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে রাখে। আমরা যদি আরও গভীরভাবে তাকাই, আমরা বুঝতে পারব যে আসল সমস্যাটি হল এই ধরণের শরীর এবং মন থাকার কারণে আমরা এই উত্থান এবং পতনগুলি বেশি করে সৃষ্টি করি এবং সেগুলিকে চিরস্থায়ী ক’রে রাখি। আর আমরা সেটা করি শুধু এই মুহূর্ত বা আগামী সপ্তাহের জন্য নয়, বরং আমাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, বুদ্ধ বলেছেন যে আমরা আমাদের নিজেদের সমস্যাগুলিকে কেবল এই জন্মে চিরস্থায়ী করি না, বরং পরের জন্ম, ভবিষ্যতের জীবনের ক্ষেত্রেও এটাকে চিরস্থায়ী ক’রে তুলি। আমরা যদি এখনো পুনর্জন্মের অস্তিত্বকে বুঝতে না পারি এবং স্বীকার না করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কীভাবে এই সমস্যাগুলিকে চিরস্থায়ী ক’রে তুলে রাখি। বর্তমান জলবায়ু সংকটের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে আমাদের ক্রিয়াকলাপ কীভাবে সমস্যাগুলিকে চিরস্থায়ী করে যা এই গ্রহে আমাদের অস্তিত্বের বাইরেও চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।
তাহলে আমাদের শরীর এবং মনের প্রকৃত সমস্যা কী? সমস্যাটি হল তারা সীমিত। আমাদের শরীর সীমিত, কারণ এটা অসুস্থ হয় এবং বৃদ্ধ হওয়ার সাথে-সাথে এর অধঃপতন হয়। দুধের বোতলের মতো এর মেয়াদ শেষ হয়; কিন্তু দুধের চেয়েও এর খারাপ দিকটা হল এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কোন স্পষ্ট তারিখ নির্ধারিত থাকে না। আমাদের শরীরের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নেই। যখন শরীরটা স্থায়ী থাকে, আপনারা ভাবুন যে এর যত্ন নেওয়ার জন্য আমাদের কতটা সময় ব্যয় করার প্রয়োজন হয়। এটাকে আমাদের পরিষ্কার করতে হয়, পোষাক পরাতে হয়, আহার প্রদান করতে হয়, শৌচালয়ে নিয়ে যেতে হয়, ব্যায়াম করাতে হয়, বিশ্রাম দিতে হয় এবং ঘুম পাড়াতে হয় আর আহত বা অসুস্থ হলে এর যত্ন নিতে হয়। এটাকে নিয়ে কত তামাশাই না করতে হয়। একজন মহান ভারতীয় বৌদ্ধ আচার্য সুন্দরভাবে বলেছেন যে আমরা সকলেই আমাদের শরীরের দাস।
আমাদের আবেগ এবং অনুভূতি সহ আমাদের মনও সীমিত। আমাদের মনকে শিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ দিতে হয়, কিন্তু তার পরেও এমন অনেক কিছু অবশিষ্ট রয়ে যায় যা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা কোন কিছুর পূর্ণ চিত্র দেখতে পাই না- উদাহরণ স্বরূপ, বৈশ্বিক উষ্ণতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আন্তর্জালিক তত্ত্ব পরিবেশ (ভারচুয়াল রিয়েলিটি এনভায়রনমেন্ট) ইত্যাদির পরিণতি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা ঘটছে সেটা তো ছেড়েই দিন। আর এর থেকে আরও খারাপ হল, আমাদের শরীরের মতো মনও আমাদের বার্ধক্যের সাথে ক্ষয়প্রাপ্ত করে, যেমন- আমাদের স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিশক্তির অবসান ঘটে, আমাদের মন আরও ধীরে-ধীরে কাজ করতে লাগে আর আমরা সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।
এসব কিছুর উপরে, আমাদের অনুভূতিগুলি সহজেই আঘাত পায় এবং আমাদের আবেগগুলি হিংস্র হয়ে ওঠে যা আমাদের স্পষ্টভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে বাধা সৃষ্টি করে। তবে এসব নিয়ে আসল সমস্যা যা হয় সেটা হল আমাদের সীমিত শরীর, মন, আবেগ এবং অনুভূতিগুলি নিজেদেরকে চিরস্থায়ী ক’রে রাখে; সেগুলি শুধু নিজেদের আঁকড়ে ধরে রাখে।