ভূমিকা

চারটি আর্যসত্য

বুদ্ধ প্রায় ২৫০০ বছর আগে ভারতে বসবাস করতেন। যেহেতু তাঁর শিষ্যদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্ষমতা ছিল, অতএব তিনি তাদের প্রত্যেককে পৃথকভাবে তাঁর সর্বোত্তম উপায়ে উপদেশ দিয়েছিলেন, যাতে তারা সেটাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারে। তবে তিনি সকলকে সর্বপ্রথম যে বিষয়টির উপর উপদেশ দিয়েছিলেন সেটা ছিল তাঁর মূল অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে। এর দ্বারা তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। তিনি যার উপর উপদেশ দিয়েছিলেন সেগুলিকে বলা হয় “চার আর্যসত্য”। এগুলি হ’ল জীবনের চারটি ঘটনা যা সাধারণ মানুষ সত্য রূপে দেখে না। তবে যথাযথই উপলব্ধি করা সত্ত্ব (আর্য পুরুষ) যারা বাস্তবকে নির্বিকল্পিতভাবে দেখেছেন তাঁরা এগুলিকে সত্য রূপে দেখেন। সংক্ষেপে, এই চারটি সত্য নিম্নলিখিত প্রশ্নের উত্তর প্রস্তুত করেঃ

  • জীবনে দুঃখ এবং সমস্যাগুলির সত্য ধরণগুলি কী কী যা প্রত্যেকে ভোগ করে?
  • তাদের কারণগুলি কী?
  • আসলে এই সমস্যাগুলি থেকে কি মুক্তি পাওয়া সম্ভব, সেগুলির নিরোধ করা কি সম্ভব যাতে তাদের আর কখনও পুনরাবৃত্তি না হয়?
  • বোধগম্যতা বা জ্ঞানটা কী যা ঐ নিরোধ-অবস্থাটাকে প্রাপ্ত করাবে, কারণ এটাই দুঃখের কারণগুলি থেকে মুক্তি লাভ করবে?

এই প্রশ্নের উত্তরগুলি মৌলিক কাঠামো গঠন করে যা বুদ্ধ সারাজীবন গভীরতার সাথে উপদেশ দিয়েছিলেন এবং এটার উপরেই তিনি সর্বপ্রথম শিক্ষাদান করেছিলেন।

আমরা যখন এই চারটি আর্যসত্যকে দেখি, তখন এগুলি নিজেদের পক্ষ থেকে আলাদা ভাবে বোঝার পরে একটা লক্ষ্য পর্যন্ত নিয়ে যায়। সহজ কথায়, এই চারটি সত্যের ভিত্তি অর্থাৎ জীবনের এই চারটি সত্য ঘটনা হ’ল বাস্তবতা।

আমরা যদি বৌদ্ধধর্মকে একটা শব্দে সংক্ষিপ্ত করতে চাই তাহলে আমার এক বন্ধু, যিনি একজন বৌদ্ধ শিক্ষকও বটে, বলেছিলেন সেই একটা শব্দ হবে “বাস্তববাদ”।

আমরা যদি বাস্তবতা দেখতে পেতাম এবং অসম্ভব ও অবাস্তব কোন কিছুর অভিক্ষেপ ব্যতীত এটাকে বুঝতে এবং গ্রহণ করতে পারতাম তাহলে আমরা আমাদের সমস্যা যুক্ত পরিস্থিতিকে বাস্তব সম্মত উপায়ে মোকাবিলা করতে সক্ষম হতাম।

সুতরাং বাস্তবতার উপর শিক্ষা হল এই চারটি সত্যের ভিত্তি। তাসত্ত্বেও কীভাবে বস্তুর অস্তিত্ব কেমনভাবে আছে এবং সেগুলি জীবনে কীভাবে কাজ করে সেটাই বিভিন্ন স্তরের বাস্তবতায় অন্তর্ভুক্ত। বুদ্ধ সে সব সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছিলেন।

ত্রি-রত্ন

এই চারটি আর্যসত্য থেকে যা স্পষ্ট হয়ে যায় সেটা হল আমাদের জীবনে দুঃখ ও সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় দিকটা। এই দিকটা বৌদ্ধ “জারগণ” (অপভাষা) “ত্রিরত্ন” বা “শরণের তিনটি রত্ন”- বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘ বলে চিহ্নিত করে। এদের প্রত্যেকটির বিভিন্ন স্তরের অর্থ রয়েছে, তবে গভীর স্তরে তাদের অর্থ বোঝায়ঃ

  • ধর্ম- আমরা যে লক্ষ্যটির জন্য প্রয়াস করছি, যেমন- যা আমাদের সমস্যা এবং তার কারণ থেকে মুক্ত করে এবং সম্পূর্ণ বোধগম্যতা অর্জন করায় এবং যা আমাদের চিরতরে তাদের থেকে মুক্তি দেয়।
  • বুদ্ধগণ- যারা সম্পূর্ণ লক্ষ্যটি অর্জন করেছেন এবং যারা মার্গ দর্শন করেন যে সেটাকে কীভাবে নিজেরাই অর্জন করতে পারে।
  • সংঘ- যারা এই শিক্ষাগুলি অনুসরণ করে এবং কিছু আংশিক লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে, তবে পুরোপুরি নয়।

সতেরোজন নালন্দার আচার্যদের জন্য একটি প্রার্থনা

পরম পূজ্য দালাই লামা প্রাচীন ভারতের মহান বৌদ্ধবিহার থেকে উদিত সতেরোজন বৌদ্ধ আচার্যদের অনুপ্রেরণার অনুরোধ হিসাবে একটা খুব সুন্দর পাঠ রচনা করেছেন। একে নালন্দা বলা হতো এবং এটা প্রায় এক হাজার বছর ধরে অস্তিত্বে ছিল। এটা মঠের মতো চালিত হতো এবং এটা তাঁর সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছিল। এই বিহারটি ভারতীয় বৌদ্ধ পরম্পরার সর্বশ্রেষ্ঠ আচার্যদের জন্ম দিয়েছিল। দালাই লামা এই পাঠ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সতেরোজনের প্রত্যেককে প্রার্থনা আকারেই নিম্নবৎ কথাটি লিখেছেনঃ “আমাকে আপনাদের পদক্ষেপে চলতে অনুপ্রাণিত করুন!” স্বতন্ত্র অনুরোধের এই শ্লোকগুলির পরে পরম পূজ্য তাদের সকলকে সম্বোধন ক’রে আরও বেশ কয়েকটি সাধারণ শ্লোক দিয়ে সমাপ্ত করেছেন।

এখানে আমি যা উপস্থাপন করতে চাই সেগুলি সমাপ্তিসূচক শ্লোকগুলির মধ্যে একটির ব্যাখ্যা। এতে কেবলমাত্র বাস্তবতা (দুটি সত্য), চারটি আর্যসত্য এবং শরণগমণের তিনটি রত্ন সম্পর্কে সংক্ষিপ্তসার রয়েছে যা আমি একটু আগে ব্যাখ্যা করেছি। শরণের অর্থ হ’ল- আমরা যদি এই তিনটি দ্বারা নির্দেশিত পথে চলি তাহলে আমরা নিজেকে দুঃখ ও সমস্যা থেকে রক্ষা করতে পারব।

শ্লোকটি প্রস্তুত করেঃ

আধার রূপী এই দুটি সত্যের অর্থ জেনে, যেভাবে সমস্ত বস্তু অবস্থান করে।

“অবস্থান করে”, এর অর্থ বোঝায় যে, বস্তু কীভাবে অস্তিত্বে আছে এবং বস্তু কীভাবে কাজ করে। অন্য কথায়, বাস্তবতাকে জানা।

চারটি সত্যের মাধ্যমে, আমরা নিশ্চিত হয়ে উঠি যে, আমরা সংসারে আসতে (জন্ম নিতে) থাকি। 

তবে এই সত্যের বোধগম্যতার দ্বারা আমরা আমাদের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্তের পুনর্জন্ম থেকে বিমুখ হতে পারি।

আমরা যদি বাস্তবতাকে বুঝতে পারি তাহলে আমরা এই সত্য দ্বারা বুঝতে পারব যে, আমরা কীভাবে আমাদের সমস্যাগুলিকে স্থায়ী করি এবং পাশাপাশি কীভাবে সেগুলি থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারি।

তিনটি শরণ হ’ল সত্য, আমাদের এই বিশ্বাসটি বৈধ জ্ঞানের কারণে দৃঢ় হয়।

মনে রাখবেন, তিনটি শরণকে আসল লক্ষ্য প্রসঙ্গে প্রস্তুত করা হয়েছে যা আমরা অর্জন করতে পারি, অর্থাৎ আমাদের সমস্যাগুলির একটা সম্পূর্ণ নিরোধ অবস্থা যাতে সেগুলি আর কখনও পুনরুত্থান না হয় এবং সেই বোধগম্যতা যা উক্ত অবস্থাকে লাভ করায়।

আপনি যদি বৌদ্ধ পথ অনুশীলন করতে চান, এর অর্থ হচ্ছে আপনি একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করছেন। আপনি কীভাবে বুঝবেন যে, সেই লক্ষ্যটা অর্জন করা সম্ভব? এটি কি শুধু একটি কাল্পনিক কথা? এটা কি একটা সুন্দর গল্প অথবা এটা আসলে সত্য? অনেক মানুষ শুধু বিশ্বাসের ভিত্তিতে লক্ষ্যটা অর্জন করার চেষ্টা করেঃ “আমার শিক্ষক এরকম বলেছিলেন এবং তাই জন্য আমি বিশ্বাস করতে চাই, আমি বিশ্বাস করি।”

এটা অনেক লোকের পক্ষে কাজ করে যেতে পারে, তবে অনুশীলনের ক্ষেত্রে এটা সর্বদা সবচেয়ে স্থিতিশীল পদ্ধতি নয়। দীর্ঘ সময় ধরে অনুশীলন করার পর যেটা ঘন-ঘন ঘটে সেটা হ’ল আপনি প্রশ্ন করতে শুরু করেন, আমি কী করছি? কারণ, আপনি তখনও রাগ, আসক্তি, স্বার্থপরতা এবং আরও অনেক কিছু অনুভব করেন। এগুলিই হ’ল আসল সমস্যা সৃষ্টিকারী এগুলি থেকে মুক্তি পাওয়া সত্যিই কঠিন। সুতরাং উন্নতি খুবই ধীর হয়ে যায়। তবে আপনার উপলব্ধি করা দরকার যে, অগ্রগতিও কখনও রৈখিক হয় না; এর সবসময় উত্থান এবং পতন হতে থাকে অর্থাৎ কিছুদিন খুব ভাল যায় কিছুদিন খুব খারাপও হয়। আপনি যদি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে বৌদ্ধ পদ্ধতিগুলি অনুশীলন করেন তাহলে আপনি নিরুৎসাহিত হতে পারেন, কারণ দেখে মনে হবে না যে আপনি কোথাও পৌঁছেছেন। তারপরে আপনি প্রশ্ন করবেন, “আদেও লক্ষ্য অর্জন করাটা কি সম্ভব?” অন্য কথায় আপনি যখন সত্যিই বুঝতে পেরেছেন যে, যুক্তি এবং কারণের উপর ভিত্তি করে যে লক্ষ্যটি বিদ্যমান এবং বাস্তবে এটা অর্জন করা সম্ভব তখন লক্ষ্য সম্পর্কে আপনার বিশ্বাস, এটা অর্জনের সম্ভাব্যতা এবং এমন লোক রয়েছে যারা আসলে এটা অর্জন করেছে তাদের প্রতি খুব দৃঢ় বিশ্বাস তৈরী হয়। আপনি বিশ্বাস করেন যে, এই বিষয়গুলি কোন পবিত্র গ্রন্থে লেখা আছে তার কারণে নয়, বরং এগুলি সত্য। আপনি নিশ্চিত হয়ে যান যে, এগুলি সত্য, কারণ দুটি সত্যই বাস্তব এবং চারটি সত্য ও তিনটি শরণ বাস্তবতার ভিত্তিতে যুক্তিযুক্ত ভাবে অনুসরণ করে।

“আমাকে মুক্তির দিকে নিয়ে যাওয়া মনের পথের মূলটি প্রতিস্থাপনে অনুপ্রেরণা দিন।”

আপনি একটি বীজ রোপন করেন কিন্তু আপনি এখানে একটি বীজ নয় বরং একটি মূল রোপন করেন। শব্দের এই পছন্দটি এই বোঝায় যে দুটি সত্য, চারটি সত্য এবং ত্রি-শরণের কাঠামো সম্পূর্ণ বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক পথের মূল কারণ এটা থেকে সবকিছুই অনুসরণ করা হয়। আপনার মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে রোপন করা এই মূলের সাথে আপনার সমস্ত অনুশীলন দৃঢ়তার উপর ভিত্তি করে। আপনি যা কিছু করেন আপনি সেটা বুঝতে পারেন, আপনি বুঝতে পারেন যে, লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব এবং আপনি এটাও বুঝতে পারেন যে লক্ষ্যটি কী।

আমি মনে করি এটি বৌদ্ধধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, কারণ আমরা যদি একটি আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করি, তাহলে ঐ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা বাস্তবসম্মত। এটি এমন এক ধরণের আদর্শিক কল্পনা নয় যা আমরা আবেগের কারণে আকৃষ্ট হয়ে আছি, যা একেবারেই অসম্ভব। আমরা যদি নিশ্চিত হয়ে যাই যে, আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনে যা করছি সেটা বাস্তববাদী, তাহলে আমরা এর মধ্যে স্বাস্থ্যকর আবেগ রাখতে পারি। আমাদেরকে দুটোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে অর্থাৎ বোধগম্যতা এবং স্বাস্থ্যকর আবেগ, যেমন – করুণা, উৎসাহ, ধৈর্য ইত্যাদি।

দুটি সত্য

আপেক্ষিক, সংবৃতি সত্য

“আধাররূপী এই দুটি সত্যের অর্থ জেনে, যেভাবে সমস্ত কিছু অবস্থান করে।”

উক্ত শ্লোকে বিদ্যমান প্রথম লাইন দুটি সত্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেঃ “আপেক্ষিক সত্য” বা “সংবৃতি সত্য” এবং “গভীরতম সত্য”। অন্য কথায় সমস্ত কিছু বাস্তবতা সম্পর্কে দুটি সত্য বিবরণ প্রস্তুত করে। এর মধ্যে একটা হ’ল অধিক অগভীর অর্থাৎ পৃষ্ঠ-স্তর এবং অন্যটি গভীরতম স্তর। উভয় স্তরই বৈধ, তবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। এই দুটির উপর অনেক উপস্থাপনা আছে তবে পরম পূজ্য দালাই লামা সাধারণ শ্রোতাদের সম্বোধনের সময় প্রায়শই যেটা ব্যবহার করে, আসুন, আমরা এখানে সেটা অনুসরণ করি।

হেতু এবং ফল

আমরা যে সমস্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করি সেই সত্যের পৃষ্ঠ স্তর কী? এটা হ’ল আমরা বর্তমানে যা কিছুই অনুভব করি সেটা কেবল পূর্বের হেতুগুলির সম্পর্কিত কারণেই ঘটে থাকে। অন্য কথায়, হেতু এবং ফলের উপর নির্ভর করেই সবকিছু জন্মায় বা ঘটে। পদার্থবিজ্ঞানও কার্যকারণের এই নীতিটা শেখায়, তবে শুধু শারীরিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যেমন- একটা বলকে লাথি মারা এবং ঐ বলের চলমান অবস্থার সম্পর্ক। এই সম্পর্কটা সহজ যান্ত্রিক, অর্থাৎ হেতু এবং ফল।

অবশ্যই কার্যকারিতাকে আরও জটিল স্তরে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে- যখন কোনও কিছুর সংঘটন ঘটায় আপনি এমন সমস্ত কারণগুলি বিবেচনা করেন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি অর্থনৈতিক সমস্যা, বৈশ্বিক উষ্ণতা, আঞ্চলিক যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনা করেন, তাহলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, সেগুলি কেবল একটা কারণ থেকে উৎপন্ন হয় না, এগুলি কোনও অকারণ থেকে আসে না এবং তারা অপ্রাসঙ্গিক কারণ থেকেও আসে না। পরিবর্তে, এই ধরণের সমস্ত পরিস্থিতি বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে উদ্ভূত হয়। এর মধ্যে কেবল বর্তমানে কী চলছে সেটা নয়, বরং অতীতে কী ঘটেছিল সেটাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। আপনি ইউক্রেনের মতো এই দেশকে বর্তমান পরিস্থিতি সোভিয়েতের অতীত বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি থেকে আলাদা করতে পারবেন না। ইতিহাস জুড়ে ঘটে যাওয়া সমস্ত কিছুর ফলস্বরূপ আজ অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। সুতরাং আপনি বলতে পারবেন না যে, এখন যা ঘটছে তা হ’ল কেবল একজন ব্যক্তির দোষ বা একটা ঘটিত ঘটনার কারণ। বিষয়গুলি হেতু এবং প্রত্যয়ের বিশাল নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করে উদ্ভূত হয়। এটিই বাস্তবতা, তাই নয় কি?

অথবা আপনি মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে বিবেচনা করুনঃ যদি আপনার পরিবারে কোন সমস্যা থাকে তাহলে আপনি আবার এটা বলতে পারবেন না যে সমস্যাটা কেবল একটা কারণ থেকে অথবা কোন কারণ ছাড়াই উৎপন্ন হয়েছে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য পারিবারিক সমস্যার কার্য-কারণে অবদান রাখে। তেমনি আপনি বলতে পারবেন না যে তাদের প্রত্যেকে যেভাবে আচরণ করে সেটা কাজের সাথে, স্কুলে এবং তাদের বন্ধুদের সাথে যা কিছু ঘটে তার সাথে কোন সম্পর্ক নেই। বাস্তবে সবকিছুই প্রভাবিত করে। তদুপরি পারিবারিক পরিস্থিতি সমাজ এবং এর রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে অবস্থান করে না। এসবগুলি একরকম বা অন্যভাবে সমস্যাটিকেও প্রভাবিত করে।

তাই এখানে বাস্তবতা বলতে বোঝায় যে সমস্ত কিছু পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং অন্য সবকিছুকে প্রভাবিত করে। যা কিছুই ঘটুক না কেন সেসব কিছুই হেতু এবং প্রত্যয়ের একটা বিশাল জটিল নেটওয়ার্কের ফলাফল হিসাবে ঘটেছে। এটাই বাস্তবতা।

দৈহিক বস্তুগুলির পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সমস্যা এবং পারিবারিক সমস্যাগুলির ক্ষেত্রেও যদি এটা হয় তাহলে ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র স্কেল সম্পর্কে কী বলা যাবে? সুখ এবং দুঃখের কী হবে? তাদের কী কোনও কারণ আছে? তারা কি কোন অকারণ থেকে উৎপন্ন হয়? সর্বোপরি কখনো-কখনো আমি খুশি বোধ করি, কখনো-কখনো আমি খুশি বোধ করি না এবং পরের মুহুর্তে আমি কী অনুভব করতে চলেছি তা জানার উপায় নেই। তাহলে কী কোন কারণ ছাড়াই এগুলি ঘটছে? বা এই মুহুর্তে আমি যা করছি ঠিক তার উপর নির্ভর করে ঘটছে? আচ্ছা, এর কোন মানে হয় না, তাই না? আমি একাই জিনিস দুটো আলাদা দিনে খেতে পারি। একদিন এটা খাওয়ার সময় আমি আনন্দ বোধ করি আবার অন্যদিন এটা খাবার সময় দুঃখ অনুভব করি। অতএব এই ভিন্ন অনুভবটা খাবার থেকে আসে না। আমি যাকে সবচেয়ে ভালোবাসি আমি তার সাথে বসবাস করতে পারি কিন্তু তার সাথে থাকা সত্ত্বেও মাঝে-মাঝে খুশি হই আবার কখনো-কখনো দুঃখিত হয়ে পড়ি। আমি ধনী হতে পারি এবং আমার সাথে সবকিছু ঠিকঠাক চলতেও পারে কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি অসুখী হতে পারি।

তাহলে এই সুখ এবং দুঃখ আসে কোথা থেকে? তাদেরকে কি কোনও উচ্চ স্তরের সত্ত্ব দ্বারা প্রেরণ করা হচ্ছে যিনি একটা বোতাম টিপে দিচ্ছেন যাতে আমি কখনও-কখনও আনন্দিত হয়ে উঠি এবং কখনও-কখনও দুঃখিত হয়ে উঠি। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি আপত্তিজনক হতে চাইছি না। আমি এটাকে নিরীহ চরম দিকে নিয়ে যাচ্ছি। তবে, যদি আপনি যা কিছু অনুভব করেন, যেমন- দৈহিক চলমান বস্তু বা আপনার জ্বলতে থাকা হাত এবং আপনি যখন দুর্ঘটনাক্রমে কোনও গরম স্টোভে স্পর্শ করেন তখন ব্যথা হয়, সেগুলি হেতু এবং ফলের নিয়মগুলি অনুসরণ করে। তাহলে কি সুখ এবং দুঃখকেও কার্যকারণের বোধগম্য নিয়ম অনুসরণ করা উচিত নয়? এই শ্লোকটির প্রসঙ্গে আপেক্ষিক সত্যের বিষয়ে এটাই প্রশ্ন এবং বাস্তবতার মূল বিষয়। আমাদের আচরণ এবং পরিণাম হিসাবে সুখ এবং দুঃখের অভিজ্ঞতার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্কের বাস্তবতা বোঝায়।

কর্ম

এটা আমাদেরকে কর্ম প্রসঙ্গে প্রাথমিক বৌদ্ধশিক্ষার দিকে নিয়ে আসে। কর্ম কী? এটা কোনও সহজ বিষয় নয়। এই বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং অনেক ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে, তবে মূলতঃ

কর্ম বলতে বাধ্যমূলকতাকে বোঝায় যা আমাদের কর্ম করা, কথা বলা এবং চিন্তা-ভাবনার উপায়গুলি পরিচালনা করে এবং বৈশিষ্ট্যযুক্ত করে।

আমাদের আচরণ, যেটা ধ্বংসাত্মক, গঠনমূলক বা এমনকি নিরপেক্ষ হোক না কেন, যদি আপনি এটার বিষয়ে নিম্নরূপে চিন্তা করেন তাহলে সেটা বাধ্যতামূলক হবে-

  • আমি বিরক্ত এবং কারও প্রতি চিৎকার করার মতো অনুভব করি এবং তারপরে বাধ্যতামূলকভাবে চিৎকার করি।
  • আমি অত্যধিক এবং শিশুটি ঠিক আছে কিনা তা দেখার সন্ধান করার মতো অনুভব করছি এবং বাধ্যতামূলকভাবে আমি বরাবর যাঁচাই করি, প্রয়োজন বা স্বাস্থ্যকরের থেকেও বেশী।
  • আমি ক্ষুধার্ত এবং মনে হচ্ছে যে, একটা হালকা জলখাবার পেতে ফ্রিজে যেতে হবে এবং তারপরেই আমি বাধ্যতামূলকভাবে শুধু যাই।

এই বাধ্যবাধকতা আসে কোথা থেকে? এবং এটা কী পরিচালনা করে? এগুলিই হ’ল সেই প্রশ্ন যা কর্ম সম্পর্কিত শিক্ষাগুলি জিজ্ঞাসা করে। বৌদ্ধ ব্যাখ্যাটি হ’ল- আপনি যখন বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করেন, কথা বলেন বা চিন্তা-ভাবনা করেন তখন এটা আপনার চিত্ত-সন্ততিতে সম্ভাবনা এবং প্রবণতা তৈরী হয় যা পরে আপনার অভিজ্ঞতার প্রতিটি মুহুর্তে সেখানে অব্যাহত থাকে। যখন সেটাকে কার্যকর করা হয় তখন সেগুলি আচরণের ধরণটি পুনরাবৃত্তি করার মতো আপনার অনুভূতির দিকে পরিচালিত করে। সেই অনুভূতির ভিত্তিতে, বাধ্যবাধকতাটি দেখা যায় যে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে আপনাকে কর্মটি পুনরাবৃত্ত করতে আকৃষ্ট করে। এই বাধ্যবাধকতাই হ’ল সম্পর্কিত প্রকৃত কর্মফল।

অবশ্যই আপনি শারীরবৃত্তিয় স্তরে এই ঘটনাটিও ব্যাখ্যা করতে পারেনঃ একটা নির্দিষ্ট উপায়ে কর্ম করাটা স্নায়বিক পথটিকে নির্মাণ করে এবং শক্তিশালী করে যাতে পরবর্তীকালে আপনি আরও সহজেই আচরণের একটা বিন্যাস অনুসরণ করতে পারেন। বৌদ্ধধর্ম অবশ্যই এই দৈহিক আধারকে অস্বীকার করে না। এটা শুধুমাত্র পরীক্ষামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটির কাছে পৌঁছায়, তবে তখনও এটাকে কারণ এবং ফলের আরও একটা উদাহরণ রূপে বিশ্লেষণ করে।

সুখ এবং দুঃখের ব্যাপারটা কী হবে? বৌদ্ধধর্ম এগুলিকে কার্মিক হেতু এবং ফলরূপে ব্যাখ্যা করে। আপনি যদি দুঃখ অনুভব করেন তাহলে এটা হবে বিরক্তিকর আবেগের প্রভাবের কারণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আপনার বাধ্যতামূলক ধ্বংসাত্মক আচরণের দীর্ঘমেয়াদী পরিণাম। আপনি যদি সাধারণ সুখের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন অর্থাৎ এমন ধরণের সুখ যা স্থায়ী হয় না এবং কখনও সন্তুষ্টি প্রদান করে না কিন্তু তবুও ভাল অনুভূত হয়, এটা ধৈর্য এবং সদয় উদারতার মতো ইতিবাচক আবেগের প্রভাবের অধীনে গঠনমূলক আচরণের দীর্ঘমেয়াদী পরিণাম। এটা কিন্তু এখনও বাধ্যতামূলক। কারণ একটা বাধ্যতামূলক করণীয় উত্তম বা বাধ্যতামূলক নিখুঁত ব্যক্তি হিসাবে এই কর্মটি আমরা কীভাবে অস্তিত্বে আছি, সেই বিষয়ে বিভ্রান্তির সাথে মিশ্রিত হয়েছিল।

আমরা কীভাবে এই কার্যকারণ সম্বন্ধীয় সম্পর্কগুলি বুঝতে পারি? প্রথমতঃ, আমাদের গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক আচরণের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। আপনার আচরণের প্রভাব কারও-কারও উপর থাকে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আঁকা হয় না। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি কারও উপর খুব রেগে যান এবং একটা ছুরি দিয়ে তাকে আঘাত করেন, এটা হবে ধ্বংসাত্মক। অন্যদিকে, যদি একজন সার্জন (শল্যচিকিৎসক) হিসাবে আপনি জীবনরক্ষামূলক অপারেশন (শল্যচিকিৎসা) করতে গিয়ে ছুরি দিয়ে কাউকে কাটা-ছেঁড়া করেন তাহলে এটা হবে গঠনমূলক। স্পষ্টতই, কারও উপর ছুরি চালানো ক্রিয়াটি গঠনমূলক বা ধ্বংসাত্মক কিনা সেটা নির্ধারণের কারণ নয়। এসবকিছুই নির্ভর করে অনুপ্রেরণার উপর অর্থাৎ মনের কেমন অবস্থার সাথে ক্রিয়াটি করা হয় এবং উক্ত কর্ম দ্বারা আপনি যে লক্ষ্যে পৌঁছতে চান।

যদি রাগ, আসক্তি, লোভ, নির্বোধতা, হিংসা, অহংকার, স্বার্থপরতা এবং এই ধরণের কোনও বিরক্তিকর আবেগ দ্বারা প্ররোচিত হয়, তাহলে এটা হবে ধ্বংসাত্মক, এমনকি আপনি যদি এমন কিছু করেন যা আপনার ভাল লাগে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি কাউকে বাসনার আকাঙ্খার সাথে এবং শ্লীলতাহানির ইচ্ছা সহ কাউকে একটা ভাল ম্যাসাজ (অঙ্গমর্দন) দেন, তাহলেও আপনার কাজটা হবে ধ্বংসাত্মক। অন্যদিকে উক্ত ক্রিয়াটি যদি এই বিরক্তিকর আবেগ থেকে আপেক্ষিকভাবে মুক্ত থাকে, তাহলে সেটা হবে গঠনমূলক, এমনকি যদি ক্রিয়াটি মোটেও সুন্দর না হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন মা-বাবা হিসাবে, আপনি আপনার দুর্ব্যবহারকারী সন্তানকে ক্রোধের বশে নয় বরং প্রেম এবং উদ্বেগের বশে তার ঘরে পাঠিয়েছেন, তাকে একটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, সে যেন আর দুষ্টুমি না করে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই, গঠনমূলক ক্রিয়াটি বাধ্যতামূলক হবে, কারণ এসব ক্ষেত্রে একজন ভাল মা-বাবা হিসাবে আপনার কাছ থেকে সত্য পরিচয়ের ধারণাটি অর্জন করতে অজ্ঞান কর্মশক্তির সাথে মিশ্রিত হয়।

তাহলে আমরা কীভাবে বিরক্তিকর আবেগের উপর ভিত্তি করে দুঃখী এবং ধ্বংসাত্মক আচরণের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক এবং বিরক্তির আবেগ থেকে আপেক্ষিক ভাবে মুক্ত সুখ ও গঠনমূলক আচরণের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্কে বুঝতে পারি? এটা কেবল একটা আকর্ষণীয় নয়, বরং একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও, কারণ আমরা কীভাবে অনুভব করি তার কারণ হিসাবে আমরা কীভাবে অস্তিত্বে আছি তার সম্পর্কে বুদ্ধ বিরক্তিকর আবেগ এবং বিভ্রান্তির মতো কর্মকে চিহ্নিত করেছেন। সেগুলি হ’ল অসুখীতা এবং অসন্তুষ্ট সাধারণ সুখের কারণ। উভয় প্রকারের অনুভূতি যা দুঃখকে পোষণ করে তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদেরকে উভয়ের বাইরে যেতে হবে।

এই বিষয়ে ভাবা যাক। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যখন রাগ ক’রে কোনও কিছুর সম্পর্কে বা কারও সাথে কাজ করছেন, কথা বলছেন বা ভাবছেন, তখন কি আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? আপনার শক্তি কি শান্ত থাকে? না, মোটেও শান্ত থাকে না; বরং বিচলিত থাকে। আপনি কি এমন সময়ে খুশী থাকেন? আমার মনে হয় না, কেউ বলবে যে, ক্রোধ বা অন্যান্য বিরক্তিকর আবেগ অনুভব করার সময় তারা খুশী থাকেন। তেমনিভাবে, আপনি যখন নিজেকে লোভী হওয়ার মতো অনুভব করেন তখন আপনি যদি নিজের শক্তিকে পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না; আপনি ভয়ভীত হবেন, এই ভেবে যে, আপনি যথেষ্ট পরিমাণটা পাচ্ছেন না। আপনি যার সাথে খুব মেলামেশা করেন, যদি কখনো তাকে প্রচন্ডভাবে মিস করেন তখন আপনিও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না; আপনার শক্তি খুবই সংবিগ্ন হয়ে ওঠে। তেমনই আপনি যখন কোন প্রকারের রাগ, লোভ, স্বার্থপরতা বা এই ধরণের আবেগ অনুভব না করেন, পরিবর্তে আপনি দয়াবান হওয়ার চেষ্টা করেন তখন আপনার মন আপেক্ষিক ভাবে শান্ত থাকে আর আপনার শক্তি স্বাচ্ছন্দ্য হয়ে ওঠে, তাই নয় কি? আপনি মূলতঃ খুশী বোধ করেন যদিও এটা সূক্ষ্ম স্তরের হতে পারে তবে নাটকীয় কিছু নয়। এমনকি আপনি যদি একজন বাধ্যতামূলক ভালো ব্যক্তি হন এবং সবকিছুকে নিখুঁত করতে চান তাহলে আপনার শক্তি আরও বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ফলে আপনি ক্রোধবশে কিছু না করে, কিছু উপকারী কর্ম করতে আরও আনন্দ বোধ করেন। অবশ্যই যদি ইতিবাচক কিছু করার সময় আপনি কোন ভুল করার বা যথেষ্ট ভালো না হওয়ার ভয় পান তাহলে আপনি অবশ্যই এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা এবং উদ্বেগ নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না।

এখানে যেটা উল্লেখযোগ্য সেটা হ’ল, আপনার কাজ শেষ হয়ে গেলেও অসুখীতা বা আপেক্ষিক সুখের অনুভূতি অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। এটা এই বোঝায় যে, আপনি অন্য কিছু করার পরেও যা অনুভব করেন সেটা আপনি আগে যা করেছিলেন তার কারণে প্রভাবিত হতে পারে। বুদ্ধ যখন কর্মের সাথে সুখ বা দুঃখের স্তর, যা আপনি অনুভব করেন, সেগুলির সম্পর্ক সম্বন্ধে কথা বলেছিলেন। তিনি কোনও কর্ম করার পরেই আমরা প্রধানতঃ যা অনুভব করি তার উল্লেখ করেননি। পরিবর্তে, তিনি অনেক দীর্ঘমেয়াদী পরিণাম সম্পর্কে বলেছিলেন। যাইহোক, আমরা যখন আমাদের বাধ্যতামূলক আবেগপ্রবণ আচরণ এবং আমাদের শক্তি আমাদের শরীরে যেভাবে প্রভাবিত হয় তাদের সম্পর্ক সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করি, তখন আমরা তাঁর উপদেশকে প্রশংসা করতে শুরু করি।

তারপরে আমরা আমাদের মনের সাধারণ অবস্থা সহ যা কিছু অনুভব করি তার সম্পর্কে আপেক্ষিক বা সংবৃতি সত্যটি হ’ল- হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর নির্ভর ক’রে সবকিছুর আবির্ভাব হয়। এটা কেবল আমরা যা কিছু করার মতো অনুভব করি তাই নয়, বরং আমাদের খুশী অথবা অখুশী যাই হোক না কেন, সবকিছুই এতে অন্তর্ভুক্ত। এটা বাস্তবতার একটা দিক। শ্লোকে বিদ্যমান লাইনটি এটাকে আধার বলে যেখানে সমস্ত কিছু অবস্থান করে, অর্থাৎ যেভাবে সবকিছু অস্তিত্বে আছে, ক্রিয়াশীল হয় এবং কাজ করে।

গভীরতম সত্য

প্রত্যেক বস্তুর সম্পর্কে সত্যটি গভীরতম স্তরের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। যদিও আমাদের কল্পনার অভিক্ষেপের কারণে বস্তুগুলি অসাধ্য উপায়ে উপস্থিত হতে পারে এবং অসাধ্য উপায়ে কাজ করতে পারে, তবুও যে অসম্ভব পদ্ধতির ভিত্তিতে সেগুলির উপস্থিতি দেখা যায় সেগুলি বাস্তবতার সাথে মিল খায় না।

আমাদের অভিক্ষেপের অনুরূপ হয় এমন কোনও সন্ধানযোগ্য সামগ্রিক অনুপস্থিতিকে বলা হয় শূন্যতা; প্রায়শই এটাকে রিক্ততা রূপে অনুবাদ করা হয়।

যদিও আমাদের অভ্যাসগত বিভ্রান্তির ফলে মন দ্বারা অভিক্ষিপ্ত অসম্ভব উপায়ে অস্তিমান সম্পর্কিত সূক্ষ্মতার অনেক স্তর আছে, তবে সবচেয়ে সাধারণ স্তরের সাথে কাজ করে আমরা সবচেয়ে গভীরতম স্তরে কাজ করা শুরু করতে পারি অর্থাৎ বস্তু অসম্ভব উপায়ে অস্তিত্বহীন। তারা কীভাবে পারে? বাস্তবতা হল আমাদের বিভ্রান্ত মনগুলি যা কিছু অসম্ভব অনর্থক জিনিস অভিক্ষিপ্ত করে তার অনুরূপ হয় এমন কিছুই অস্তিত্বে নেই। এটা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত এবং এরকম কোন বস্তু অস্তিত্বে থাকেও না।

একটা শাস্ত্রীয় উদাহরণ বিবেচনা করুনঃ একটা শিশু ভাবছে যে, বিছানার নিচে একটা দৈত্য আছে। প্রকৃতপক্ষে বিছানার নীচে আছে একটা বিড়াল কিন্তু শিশুটি বিড়ালের উপর অভিক্ষেপ করে আছে যে, ওটা একটা দৈত্য। তারপরে যেহেতু শিশুটি বিশ্বাস করে যে, সেখানে আসলে একটা দৈত্য রয়েছে, যদিও সেটা একটা অর্থহীন কথা তা সত্ত্বেও শিশুটি খুবই ভয়ভীত। সুতরাং এই অর্থহীন কথাটি শিশুর উপর প্রভাব ফেলছে কিন্তু এটা কোনও ভাবেই বিড়ালটিকে আসল দৈত্য হিসাবে পরিণত করে না কারণ দৈত্যের মতো কোন বৈশিষ্ট্য বিড়ালটির মধ্যে নেই। শূন্যতা হল এমন একটা আসল দৈত্যের পূর্ণ অনুপস্থিতি যা শিশুটির কল্পনার সাথে মিল খায়। বাস্তবে সেখানে কখনো দৈত্যের অস্তিত্ব ছিল না এবং কখনো থাকবেও না। এখানে অভিক্ষেপটি সরিয়ে দিন এবং সরিয়ে ফেলার পরে বিছানার নীচে একটা বিড়ালকেই দেখতে পাবেন। অতএব এখানে এর মানে এটা বোঝায় না যে সেখানে কিছুই নেই।

আমরা কল্পনা করি, অভ্যাসের কারণে বস্তু যেভাবে বাস্তবে আমাদের সামনে আবির্ভাব হয় সেভাবে সেটা বিদ্যমান থাকে না। আমাদের চোখের সামনে ঠিক কী আছে বা এই মুহুর্তে আমরা কী অনুভব করছি আমরা শুধু সেই সম্পর্কে সচেতন। উদাহরণস্বরূপ, আমি সম্ভবতঃ এখানে অখুশী বোধ করছি। মনে হচ্ছে এটা কোন কারণ ছাড়াই নিজের থেকে উত্থাপিত হয়েছে। আমি শুধু অখুশী। কেন আমি তা জানি না। আমি বিরক্ত বোধ করি; আমি অর্থহীন মনে করি; এবং আমি অখুশী হই আর আমি যা কিছু করছি আর যার সাথে রয়েছি এটা তার সাথে সম্পর্কিত বলে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ করেই আমি অর্থহীন বোধ করি; আমি দুঃখিত হয়ে পড়ি।

এটাকে নাটকীয় হতে হয় না। এটি অসন্তুষ্টির একটি নিম্ন স্তরের অনুভূতি হতে পারে। সুতরাং এটা কীভাবে আবির্ভাব হয়? দেখে মনে হয় যেন কোনও কারণ নেই। কিন্তু এটা অসম্ভব। এটি বাস্তবের সাথে মিল খায় না। এটা গভীরতম সত্য।

এরপর সংবৃতি বা আপেক্ষিক সত্য- আমার অসুখীতা বা সুখ সহ সবকিছুই কারণ ও ফলের প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত হয়। যদিও এটাই বাস্তবতা কিন্তু আমার কাছে এমন আবির্ভাব হয় না। মনে হয় আমি যা অনুভব করি সেটা বিনা কারণে কোথাও থেকে উপস্থিত হয়। গভীরতম সত্যটি হ’ল- আমার কাছে এটা যেভাবে উপস্থিত হয় সেটা বাস্তবতার সাথে মিল খায় না অর্থাৎ এটা অসম্ভব কোনও কিছুর অভিক্ষেপ। আপনি যদি এটার বিষয়ে ভাবেন তাহলে সেটা সত্যিই খুব গভীর হয়ে যায়।

আরও একটা উদাহরণ দিই। আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে যে মাঝে-মাঝে আমাকে দেখে চিৎকার করে। আমাদের মধ্যে একটা দুর্দান্ত সম্পর্ক আছে। হঠাৎ করে আমার বন্ধুটা কোনও কারণে রেগে যায় এবং আমাকে দেখে চিৎকার করে। এটা আমার কাছে কীভাবে উপস্থিত হয়? আমার মনে হয়, “তুমি আমাকে আর ভালবাস না।” আমি মর্মাহত হয়ে পড়ি, কারণ আমার মনে যা কিছু উপস্থিত হয় সেটা হ’ল- আমার বন্ধু আমাকে দেখে চিৎকার করে এবং তখন আমি তাকে পুরোপুরি সনাক্ত করি কেবল ওটা দিয়ে এবং অন্য আরও কিছু দিয়ে। কিন্তু এর অভিক্ষেপটি বাস্তবতার সাথে মিল খায় না। আমাদের দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বের প্রেক্ষাপটে শুধু একটি ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে এই চিৎকারটি অকারণে উদ্ভূত হয়না। সম্ভবতঃ আপনার ক্ষেত্রেও এরকম ঘটেছে।

যা ঘটে সেটা হল আমাদের বন্ধুর সাথে আমাদের যে পূর্ণ সম্পর্ক আছে এবং অন্যান্য সময়ে আমরা যতবার সম্পর্ক গড়েছি তার সমস্ত মিথস্ক্রিয়াটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে ফেলে। তবে এটা একমাত্র জিনিস নয়, আমরা বৃহত্তর ছবির দৃষ্টিও হারিয়ে ফেলি। আমাদের বন্ধুর জীবনে শুধু আমরাই একমাত্র ব্যক্তি নই এবং আমাদের বন্ধুত্বই তার জীবনে ঘটে যাওয়া একমাত্র বিষয় নয়। আমরা ছাড়াও বন্ধুর পুরো জীবন রয়েছে এবং এটা সে কীভাবে অনুভব করে আর আচরণ করে সেটাকেও প্রভাবিত করে। সম্ভবতঃ তার কর্মক্ষেত্রে একটা কঠিন দিন ছিল অথবা তার পিতা-মাতার সাথে কিছু সমস্যা ছিল যা আমার বন্ধুর মেজাজ খারাপ করে দিয়েছিল। এইজন্য সে আমাকে দেখে চিৎকার করেছিল। এখানে গভীরতম সত্যটি হল আমি যা অভিক্ষেপ করেছিলাম সেটা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এটা বাস্তবতা নয় যে আমাকে দেখে তার চিৎকার করাটা সম্পূর্ণভাবে নিজের থেকেই অস্তিত্বে ছিল, আমার বন্ধুত্বের বাকী অংশ এবং তার জীবনে যা ঘটেছিল তার প্রেক্ষাপটে স্বাধীনভাবে। স্বাধীনভাবে বিদ্যমান ঘটনাগুলির উপস্থিতির সাথে সম্পর্কিত কোন প্রকৃত বাস্তবতা সম্ভবতঃ থাকতে পারে না, আসলে এরকম কোনকিছু নেইও। এমন অস্তিত্বের প্রণালীর পূর্ণ অনুপস্থিতিকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় “শূন্যতা” যা শূন্য শব্দের সমান শব্দ।

দুটি সত্যের ক্ষেত্রে যখন বিষয়গুলি একে অপরের অস্তিত্ব থেকে বঞ্চিত থাকে এবং স্বতন্ত্রভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে তখন হেতু এবং ফল কাজ করে। কারণ হেতু এবং ফল কেবল একে অপরের সাথে আপেক্ষিকভাবে এবং নির্ভরশীল হয়ে ক্রিয়াশীল হয়। কোন হেতু থেকে এর সম্ভাব্য ফল না থাকলে সেটা হেতু রূপে উপস্থিত থাকতে পারে না। যদি কোন কিছু ফল উৎপাদন না করতে পারে তাহলে কীভাবে সেটা কোনকিছুর হেতুরূপে উপস্থিত থাকতে পারে? তখন বস্তুর আপেক্ষিক সত্য হেতুর কার্যকারণ সম্পর্ক কেবলমাত্র প্রত্যেকটা বস্তু সম্পর্কে গভীর সত্যের কারণেই কাজ করতে পারে। অন্য কিছু থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে অসম্ভব উপায়ে কোন কিছুই বিদ্যমান থাকে না।

বিষয়টি হল এই দুটি যে একে অপরকে সমর্থন করে সেটা হল যেমন শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে “আধার, যেখানে সমস্ত কিছুই অবস্থান করে”। এখানে আধার শব্দটি নির্দেশ করে যে পরবর্তী লাইনে যা আসে এটা তারও আধার। এটা বাস্তবতাকে দেখার ভিত্তিতে যেমন দুটি সত্য আছে, এর উপর ভিত্তি করে বুদ্ধ চারটি সত্যকে জেনেছিলেন।

প্রশ্ন

সত্য বাস্তবতার অভিজ্ঞতা

আপনার যেখানে কোন মিথ্যা ধারণা থাকে না, সেখানে সরাসরি সত্য বাস্তবতা কি অনুভব করা সম্ভব? না কি এটা অসম্ভব কিছু?

না, না, এটা সম্ভব। যদিও আমাদের মানসিক কার্যকলাপ সমস্ত কিছুকে অসম্ভব উপায়ে উপস্থিত করে তোলে, তবুও যেহেতু এগুলি বাস্তবের সাথে মিল খায় না, তাই যে কারণ এই বিকৃতিটা ঘটায় তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এর কারণ হ’ল, বাস্তবতার মতো একটা বিষয় এবং বিকৃত হওয়া বাস্তবতাটি মানসিক ক্রিয়াকলাপের মৌলিক প্রকৃতির অংশ নয়। কোনও অভিক্ষেপ বা বিকৃতি ছাড়াই মানসিক ক্রিয়াকলাপের পক্ষে কাজ করা সম্ভব।

সেই ভিত্তিতে আমরা বুঝতে পারি যে, যখন আমাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপ বাস্তবতাকে বিকৃত করে তোলে, তখন সেটা আমাদের সমস্যা, দুঃখ এবং অসুখীতায় জর্জরিত করে তোলে। তবে যেহেতু আমাদের মনকে ঐ বিকৃতিটিকে অভিক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখা সম্ভব, তাই আমরা আর নিজের জন্য সমস্যা তৈরী করি না ও অনুভব করি না। একবার যখন আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের মন এই লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম, তখন আমরা দুঃখ এড়াতে এবং প্রতিরোধ করতে আমাদের নিরাপদ দিক অর্জন করে ফেলেছি। এই নিরাপদ দিকটি হল আমাদের তথাকথিত “শরণ”। তবে আমরা কেবল তখনই লক্ষ্যটা সন্ধান করতে পারি যখন আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই যে, আসলে এটা অর্জন করা সম্ভব। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এই বিষয়টার সম্পর্কে বোধগম্য হওয়ার পর জাগে। সেসব কিছু সম্পর্কে আমি উল্লেখ করেছি অর্থাৎ বাস্তবতা এবং সেটা উপলব্ধি করা আমাদের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে জাগে।

তবে নিজেকে বাস্তবের সাথে পরিচিত করার জন্য একটা দীর্ঘ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন যাতে মানসিক অবরুদ্ধতাগুলি উচ্ছেদ করা যায়। এখানে থেকেই উদয় হয় ধ্যান। ধ্যানের অর্থ হ’ল, এই প্রসঙ্গে বাস্তবকে একটা উপকারী অভ্যাস হিসাবে দেখিয়ে নিজেকে বাস্তবতার সাথে পরিচিত করার একটা প্রশিক্ষণ। যদি আপনি এই অভ্যাসটা তৈরী করেন তাহলে আপনি যখনই কারও সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করবেন, শুধুমাত্র সেগুলি আপনার চোখের সামনে সেইভাবে উপস্থিত হবে না কারণ আপনি সেগুলিকে দেখার জন্য নিজেকে অভ্যস্থ করে ফেলেছেন। আপনি পুরোপুরি অবগত যে তারা একসময় শিশু ছিল, তাদের শৈশব এবং একটা প্রাপ্ত বয়স্ক জীবন ছিল। সুতরাং অনেক কিছুই তাদের জীবন জুড়ে প্রভাবিত করেছে। এখন তারা সম্ভবতঃ আরও বয়স্ক হয়ে উঠবে এবং আরও বেশিকিছুর কারণে প্রভাবিত হবে। এইভাবে আপনি ব্যক্তির জীবনের পুরো প্রসঙ্গে বাস্তবতাকে দেখতে পান। এবার দেখুন যে, ঐ সময় যা কিছু ঘটেছিল সেগুলি একে-অপরের সাথে সম্পর্কিত। ব্যক্তির বাস্তবতার এই দৃশ্য আপনাকে আপনার চোখের সামনে অবস্থিত ফটোগ্রাফির মতো কেবল সংক্ষিপ্তভাবে দেখার চেয়ে অনেক বেশি উপকারী এবং বাস্তববাদী ভাবে মিথস্ক্রিয়া করতে দেয়।

তবে এটা করার জন্য স্বয়ং আপনাকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। নিঃসন্দেহে আপনি তাদের জীবনের সমস্ত বিবরণ এবং এর প্রভাবগুলি জানেন না, তবে এতে কিছু আসে যায় না। এই ব্যক্তির অনেক প্রভাবসহ অতীতের ইতিহাস আছে এবং সম্ভবতঃ ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও রয়েছে। সেই সম্পর্কে সচেতন হয়েই আপনি ব্যক্তির বাস্তবতার কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করে তোলেন। সুতরাং, উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি কোন শিশুকে দেখতে পান তাহলে আপনি শুধু শিশুটাকে শিশু হিসাবেই দেখবেন না বরং এখানে একটা সম্ভাব্য প্রাপ্তবয়স্ক এবং আমি এখন যা কিছু করছি যেটা এই শিশুটাকে কীভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হতে প্রভাবিত করে তাও দেখবেন। আপনি পুরো ছবিটির দিকে তাকান। আপনি বাস্তবতার সংস্পর্শে আছেন।

Top