মন-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্ব-রূপান্তর

38:55
আমরা যখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই এবং আমাদের জীবনে সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে না চলে, তখন আমরা যদি তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সক্ষম হই, তাহলে আমরা এই অভিজ্ঞতাগুলিকে এমন অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হব যা আমাদের আধ্যাত্মিক বিকাশকে আরও উন্নত করে তুলবে। তিব্বতী পরম্পরা ‘লো-জোঙ্‌’ অর্থাৎ মন-প্রশিক্ষণে (চিত্ত-সাধনা) বিভিন্ন ধরণের লাভদায়ক দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করা আছে যাকে বিকাশ করার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা আমাদের জীবনের চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও ভালোভাবে মুখোমুখি হতে সক্ষম হতে পারি।

“মন-প্রশিক্ষণ” বলতে এমন একটি পদ্ধতিকে বোঝায় যার মাধ্যমে আমরা কোন ব্যক্তি বা পরিস্থিতিকে বিবেচনা করার প্রক্রিয়াকে পরিবর্তন করতে পারি। তবে “মন-প্রশিক্ষণ” শব্দটি সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, কারণ এর থেকে এমন ধ্বনি নির্গত হয় যা দেখে মনে হয় এটা একাগ্রতা (সমাধি) এবং স্মৃতিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। বাস্তবে এখানে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে না। তিব্বতী ভাষায় মন-প্রশিক্ষণের (চিত্ত-সাধনা) জন্য ‘ব্লো-স্‌ব্যাঙ্‌= লোজোঙ্‌’ শব্দাবলীটি প্রয়োগ করা হয়। এখানে ‘ব্লো=লো’ শব্দের অর্থ কেবল মন বা চিত্তকে বোঝায় না। এই শব্দটি ‘মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি’-এর ক্ষেত্রে বেশী উপযুক্ত। ট্রেনিং (প্রশিক্ষণ), তিব্বতী ভাষায় ‘স্‌ব্যাঙ্‌= জোঙ্‌’ শব্দের দুটি অর্থ আছে, যথা- ‘পরিষ্কার করা’ অর্থাৎ আপনি নেতিবাচক মনোভাবকে পরিষ্কার করেন এবং ‘প্রশিক্ষণ দেওয়া’ অর্থাৎ আরও বেশী ইতিবাচকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া। অতএব, কখনো-কখনো ‘মন-প্রশিক্ষণ’ শব্দকে ‘মনোভাব-প্রশিক্ষণ’ হিসাবে বুঝলে এই শব্দের অর্থ বেশী স্পষ্ট হয়।

পরিষ্কার করণীয় প্রধান নেতিবাচক মনোভাব হল আমাদের স্ব-লালন মনোভাব। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে আত্মকেন্দ্রিকভাব এবং স্বার্থপরতা, কেবল নিজের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। অন্যদিকে ইতিবাচক প্রশিক্ষণ বলতে পর-লালন মনোভাবকে বোঝায় যার মধ্যে মূলতঃ মৈত্রী এবং করুণাসহ পরকল্যাণের চিন্তা-ভাবনা অন্তর্ভুক্ত থাকে। সমস্ত মন-প্রশিক্ষণের কৌশলগুলিতে ব্যবহৃত পদ্ধতিটি বুদ্ধের সাধারণ দৃষ্টিকোণের সাথে মিলে যায়, যা “চার আর্যসত্য” নামে পরিচিত।

চার আর্যসত্য

ভগবান বুদ্ধ খুবই ব্যবহারিক স্তরে আমাদের জীবনের সমস্যাগুলিকে কাটিয়ে উঠতে উপদেশ বা শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি যে শিক্ষা প্রদান করেছিলেন তার উদ্দেশ্য এর উপরেই কেন্দ্রীভূত ছিল। আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে বিভিন্ন স্তরের এবং বিভিন্ন ধরণের সমস্যা আছে তাদের মধ্যে কিছু স্থূল এবং কিছু অত্যন্ত পীড়াদায়ক; সেগুলি আমাদের শারীরিক, মানসিক অথবা উভয়রূপে অনেক কষ্ট দেয়। অন্য সমস্যাগুলি কিছুটা সূক্ষ্ম হয় তা হলেও হয় খুবই পীড়াদায়ক। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা জীবনে নানারকম জিনিস উপভোগ করি, তবুও আমরা হতাশ হই কারণ সেগুলি আমাদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করে না; সেগুলি চিরস্থায়ী হয় না বরং পরিবর্তন হতে থাকে। আমাদের জীবনে পরিস্থিতি কখনোই স্থির থাকে নাঃ সেগুলির উত্থান এবং পতন হতেই থাকে। কখনো-কখনো পরিস্থিতি সুচারু ভাবে চলতে থাকে আবার কখনো-কখনো সেটা ঠিকঠাক চলে না; পরিস্থিতির স্থিরতা আমাদের অনুভূতির উপর নির্ভর করে। কখনো-কখনো আমরা সুখী অনুভব করি; কখনো-কখনো দুঃখী; আবার কখনো-কখনো মনে হয় যেন আমরা কিছুই অনুভব করি না এবং পরবর্তী মুহূর্তে আমরা যে কী অনুভব করতে চলেছি সে বিষয়েও আমাদের কিছু জানা থাকে না। এমনকি আমরা যাদের সাথে আছি বা আমরা যা করছি সেটা কারও উপর নির্ভরশীল ব’লে মনে হয় না-ফলে হঠাৎ ক’রে আমাদের মেজাজ পরিবর্তন হয়ে যায়।

আমাদের সকলেরই আবেগগত সমস্যা আছে এবং সেগুলি জীবনে বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দেয়। যে বিষয়টা সত্যিই হতাশাজনক সেটা হল সেগুলি বারবার ঘটতে থাকে ব’লে মনে হয়। এমন মনে হয় যেন আমরা নিজেদের জন্য আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করি, যদিও মাঝে-মাঝে মনে হয় যেন সেগুলি অন্যদের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আমরা যদি আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে এবং আরও সততার সাথে পরীক্ষা করি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে আমাদের অনেক সমস্যার উৎস স্বয়ং আমরাই, আর বিশেষ ক’রে জীবনে যা কিছু ঘটে তার প্রতি আমাদের আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব।

ভগবান বুদ্ধ এই সবকিছুই দেখেছিলেন। তিনি এটাকে নিজের জীবনে উপলব্ধি করেছিলেনঃ তিনি এটাকে অন্যদের জীবনেও দেখেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে প্রত্যেকটি প্রাণী একই দুর্দশায় জর্জরিত। স্থূল স্তরে আমাদের সকলের জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলির মধ্যে অসুবিধা আছে- জন্ম নেওয়া, বড় হওয়া, অসুস্থ হওয়া, বৃদ্ধ হওয়া এবং মৃত্যু হওয়া- তার সাথে আমাদের অনুভূতিগুলির অনিয়ন্ত্রিতভাবে উত্থান এবং পতন হয়েই চলেছে। তিনি বলেছিলেন যে এমন নয় যে এই অসুবিধাগুলির কোন কারণ নেই। অবশ্যই এগুলি কোন না কোন কারণ থেকে উদ্ভূত হয়েছেঃ কারণগুলি অন্য কোথা থেকে আসে না। কোন বাহ্যিক মহাশক্তি আমাদের জন্য এই সমস্যাগুলি উৎপন্ন করছে না- তাতে আমরা ঐ বাহ্যিক শক্তিকে “ঈশ্বর” বলি অথবা আমরা এটাকে ব্যক্তি নিরপেক্ষ বানিয়ে নিয়তি বা ভাগ্য বলি। আসলে এটা আমাদের সমস্যার উৎস নয়।

আমাদের সমস্যার আসল উৎস আমাদের মধ্যেই রয়েছে আর আমরা যখন বলি এটা আমাদের মধ্যেই রয়েছে, এর অর্থ এই নয় যে আমরা স্বভাবগত ভাবে খারাপ বা দোষী। বুদ্ধ বলেননি যে, আমরা পাপী হিসাবে জন্ম নিয়েছি; বরং বুদ্ধ বলেছেন যে আমাদের সমস্যার উৎস হল বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের বিভ্রান্তি। এর অর্থ এই নয় যে আমরা মূর্খ, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায় বস্তু অসম্ভবরূপে অস্তিমান ব’লে মনে হয় যা বাস্তবের সাথে মোটেও মিল খায় না। এটা বিশেষ ক’রে ঐ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেখানে আমরা স্বয়ং নিজেদের এবং অন্যদের কেমনভাবে দেখি, অবশ্যই সেটাই আমাদের মনোভাবকে রূপ দেয়। আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা এবং স্ব-লালনের কারণে আমরা মনে করি যে, আমরা হলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আর সবকিছু আমাদের পছন্দ অনুযায়ী হওয়া উচিত। আর এর কারণে অন্যরা কী অনুভব করে বা না করে তাতে কিছু আসে যায় না। বিষয়টা এমন প্রতীয়মান হয় যে অন্যরা কেমন অনুভব করে সেটাকে গন্য মনে করা হয় না এবং এমনকি তার অস্তিত্বও থাকে না। আমার মনে হয় এটাকে এইভাবে জানা যেতে পারে যে আমরা যেটা অনুভব করি সেটা আমাদের অভিক্ষেপ এবং অবাস্তব প্রত্যাশার উপর ভিত্তি করে, প্রকৃতপক্ষে আমরা যে বাস্তব পরিস্থিতির মুখোমুখি হই তার উপর ভিত্তি করে না।

কিন্তু বুদ্ধ বলেছেন এই পরিস্থিতির অবসান ঘটানো সম্ভব, এই সমস্যাগুলি এমনভাবে উন্মূলন করা সম্ভব যে সেগুলির আর কখনো পুনরাবৃত্তি হবে না। এর অর্থ এই নয় যে আমরা চিরতরে এই সমস্যাগুলি ভোগ করার জন্য অভিশপ্ত। এটা এমনও নয় যে এর একমাত্র সমাধান হল মাদক দ্রব্য সেবন করা অথবা মাতাল হয়ে যাওয়া যাতে আমরা পীড়া সহ্য করা বন্ধ করতে পারি এবং অন্ততঃ এই মুহূর্তে অনুভব করতে পারি যে আমরা সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছি। আর এমনও নয় যে আমরা গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যাই যা আমাদের সমস্যার সমাধান করবে। এই ধরণের সমাধান কেবল সাময়িক এবং সেগুলি আমাদের সমস্যা থেকে মোটেও চিরতরে মুক্তি দেয় না। আমাদের যদি সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হয় তাহলে আমাদের নিজেদেরকে সেই সমস্যাগুলির কারণ থেকে মুক্তি পেতে হবে। আমাদের মুক্তি পেতে হবে আমাদের বিভ্রান্তি থেকে। সম্যক্‌ বোধগম্যতা দ্বারা আমাদের বিভ্রান্তিকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। আমরা সকলেই একই রকম যে সবাই সুখী হতে চায় এবং কেউ দুঃখী হতে চায় না। আর এরকম কেউ নেই যার সুখের উপর অধিকার অন্যদের থেকে বেশি আছে। এছাড়াও আমি হলাম একজন ব্যক্তি অন্যদের সংখ্যা অসংখ্য। আমরা যদি এই বাস্তবিকতাকে দেখি আর তদনুসারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করি তাহলে ধীরে-ধীরে আমাদের বোধগম্যতা যত গভীর হতে থাকবে আমাদের আবেগগত অবস্থাও তত পরিবর্তন হবে।

মন-প্রশিক্ষণ

যেহেতু আমরা আমাদের জীবনের অনেক ভাগ অভিক্ষেপের কল্পনার জগতে বাস করি, তাই আমাদের বিভ্রান্তি আমাদের অভিজ্ঞতার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি রূপরেখা প্রদান করে; স্ব-লালন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, আমাদের সাথে যা কিছু ঘটে আমরা সেটাকে স্ব-কেন্দ্রিক পদ্ধতিতে বিবেচনা করি, যা আমাদের সাথে-সাথে অন্যদের জন্য আরও বেশি দুঃখ এবং সমস্যা সৃষ্টি করে। তবে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সাথে-সাথে আমাদের জীবনের ঘটনাবলীর প্রতি আমাদের অভিজ্ঞতা নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়।

উদাহরণ স্বরূপ, বিমানবন্দরে আমাদের বিমান উড়তে বিলম্ব হলে আমরা সেটাকে ব্যক্তিগত দুর্যোগ হিসাবে বিবেচনা না ক’রে আমরা যদি এইরকম বিচার করি যে বাস্তবিকতাটা হল এখন আমরা এবং বিমানের অন্যান্য সমস্ত যাত্রীরা প্রতীক্ষালয়ে সময় কাটানোর অনেক সুযোগ পেয়েছে। তারপর আমরা ঐ পরিস্থিতির প্রতি আমাদের দৃষ্টি পরিবর্তন করতে পারি এবং সেটা করতে পারি এইভেবে যে অন্য যাত্রীরা এই পরিস্থিতির মোকাবিলা কীভাবে করছে। আমরা বিলম্ব হওয়ার এই সুযোগটাকে অন্য সহযাত্রীদের সাথে কথোপকথন শুরু করার সুযোগ হিসাবে দেখতে পারি। আর সেটা দুঃখী হওয়ার পরিবর্তে আনন্দিত হয়ে অন্যান্য ব্যক্তিদের শান্ত করা আর মন খারাপ না হওয়ার সহায়ক হতে পারি। ঠিক যেমন শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে আমরা আমাদের শরীরকে আরও শক্তিশালী এবং সহনশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে পারি একইভাবে ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে আমরা আমাদের মন ও মনোভাবকে আরও শক্তিশালী এবং ইতিবাচক হওয়ার সাথে-সাথে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত না হয়ে সম্ভাব্য অশান্তকারী পরিস্থিতির জন্য আরও ধৈর্যশীল হতে প্রশিক্ষণ দিতে পারি।

আবেগগত শক্তি অর্জন করা

কখনো-কখনো আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের সমস্যাটা কী। আমরা বুঝতে পারি যে আমরা এক ধরণের বিশেষ মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছি কারণ আমাদের মন হল কঠোর এবং সংকীর্ণ যা শুধুমাত্র নিজের সম্পর্কে চিন্তা করে। কিন্তু এটা আমাদের আবেগকে পরিবর্তন করে ব’লে মনে হয় না। আমরা মনে করি যে আমরা যেভাবে অনুভব করি আমাদের বোধগম্যতা সেটাকে সত্যিই প্রভাবিত করতে পারে না। কিন্তু এখানে সমস্যাটা হল বোধগম্যতাটি আসলে যথেষ্ট গভীর নয়। এটা কেবল যথেষ্ট গভীর নয় তা নয় বরং দীর্ঘকাল পর্যন্ত এটা বাস্তবকে আত্মসাৎ করেনি যার মাধ্যমে আমরা আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে পারি। আসুন, শারীরিক স্বাস্থ্যের উদাহরণ ব্যবহার ক’রে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুন, আমরা সবসময় শারীরিকভাবে দুর্বল, ক্লান্ত এবং ভারী অনুভব করি। সেইজন্য আমরা একটি ব্যায়ামশালা (জিম) বা ফিটনেস ক্লাবে যাওয়া শুরু করি। একবার যখন আমরা ব্যায়াম করা শুরু করে দিই সেটা তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের শারীরিক স্থিতিতে কোন পরিবর্তন দেখা যায় না, যেমন আমরা অনুভব করি। এরজন্য বেশ কিছু সময় লেগে যায়, সাধারণতঃ কয়েক মাস পরে আমাদের স্বাস্থ্যের দিকে পরিবর্তন অনুভব হয়। যাইহোক, আমরা যত লম্বা সময় পর্যন্ত ব্যায়াম করি আর এটা আমাদের জীবনের একটি নিয়মিত দৈনিক চর্চা হয়ে যায় তার কিছু সময় পর সত্যিই একটা পরিবর্তনের অনুভূতি জাগেঃ আমরা দুর্দান্ত অনুভব করতে শুরু করি। আমরা নিজের সম্পর্কে আরও ভাল অনুভব করি আর এটা আমাদের অন্যদের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হবে তার সম্পর্কে আরও ভাল অনুভব করতে সহায়তা করে।

কখনো-কখনো আমাদের মনের মধ্যে এই ধরণের অনুভূতি জাগে যখন আমরা অনুভব করি যে আমাদের মন, আবেগ এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু ঘটছে। যত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই বোধগম্যতাটি থাকে এবং যত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমরা সেটাকে স্মরণ করাতে থাকি আমাদের বোধগম্যতাও তত গভীর হতে থাকে। তারপর যদি আমাদের মধ্যে আবেগগত পরিবর্তন তাৎক্ষণিক ভাবে না ঘটে, তাহলেও আমরা আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করার সাথে-সাথে আমরা আরও আবেগগত ভারসাম্য ও শক্তি অর্জন করা শুরু করি।

আত্ম-সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রেরণার স্তর

ফিটনেস ক্লাবে যাওয়ার জন্য কেবল স্ব-শৃঙ্খলার প্রয়োজন হয় না, পাশাপাশি স্মৃত্যুপস্থান অর্থাৎ মননশীলতারও প্রয়োজন হয়, যার অর্থ হল সেখানে যাওয়ার কথা মনে রাখা এবং ভুলে না যাওয়া। এরমধ্যে যে অর্থ নিহিত আছে যাকে আমরা বলি “যত্নশীল মনোভাব”- আমরা নিজেদের বিষয়ে যত্নশীল হই, আমরা দেখতে কেমন লাগি তার যত্ন নিই, আমরা কেমন অনুভব করি সেই বিষয়ে চিন্তিত থাকি ইত্যাদি। আমরা নিজেদের জন্য গম্ভীর থাকি এবং নিজেদের সম্মান করি। এক অর্থে প্রায়শই আমরা ভাবি যে সুখী হওয়া এবং স্বস্তি অনুভব করা হল আমাদের “অধিকার”। এই বিষয়টা আত্ম-বোধগম্যতার ক্ষেত্রে এবং আমাদের আবেগগত জীবন কেমন কাটছে তার ক্ষেত্রেও সঠিক। এটাও এই বিষয়টার উপর নির্ভর করে যে আমরা নিজেদের প্রতি যত্নশীল এবং এই অনুভূতি “হ্যাঁ” আমাদের আরও ভাল মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকার আছে।

নিজেদের প্রতি এই যত্নশীল মনোভাবটি স্ব-লালন মনোভাব থেকে একেবারে আলাদা। স্ব-লালন মনোভাবের ক্ষেত্রে আমরা কেবল নিজেদের সম্পর্কে ভাবি এবং অন্যদের হিতকে উপেক্ষা করি। আমরা এই বিষয়ে চিন্তিত হই না যে আমাদের মনোভাব এবং আচরণ ঐ লোকজনদের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে যাদের সাথে আমরা সম্বন্ধ স্থাপন করি বা যাদের মুখোমুখি হই। অন্যদিকে যত্নশীল মনোভাবের ক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারি আমাদের জীবনের দুঃখ এবং সমস্যা যা আমাদের আত্ম-কেন্দ্রিকতা এবং স্বার্থপর মনোভাবের কারণে উৎপন্ন হয়, কারণ আমরা সুখী হতে চাই। আর আমরা নিজেদেরকে এই বিষয়ে যত্ন নিই এবং সেই পরিস্থিতির জন্য আমরা কিছু করতে চাই। আমাদের মনোভাব এবং আচরণ পরিবর্তন করার জন্য আমরা আত্ম-সংশোধন করি এবং সচেতন থাকি যে আমরা অনুশীলন ক’রে যা কিছু অর্জন করি সেটাকে ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করব।

এইভাবে, অবশ্যই আত্ম-সংশোধন করার জন্য প্রেরণার অনেক স্তর রয়েছে। প্রেরণার বিশ্লেষণ করার সময় আমরা দেখি যে আত্ম-সংশোধন করা আমাদের লক্ষ্যটি কী যার বিষয়ে আমরা আলোচনা করছি এবং সেই আবেগগত শক্তিটি কী যা আমাদের সেই লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়। বৌদ্ধধর্মের শিক্ষায় এই পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রেরণার বিভিন্ন প্রগতিশীল স্তরে রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা কেবল আমাদের জীবনের মান উন্নত করার জন্য কাজ করতে পারি, কারণ এটা এখন সন্তোষজনক নয়। আর আমরা কেবল এটাকে অসন্তোষজনক হওয়া অব্যাহত রাখতে চাই না বরং খুব ভাল হয় যদি এটা আরও নিকৃষ্ট না হয়ে যায়। বস্তুতঃ আরও দুর্দান্ত হবে যদি এটা আরও ভাল হয়ে যায়। আমরা সত্যিই অসন্তুষ্ট এবং এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে আমরা বিরক্ত বোধ করি এবং এই বিষয়ে কিছু করতে চাই।

আরও উন্নত স্তরে, আমরা কেবল এই জীবনকালের জন্য ভাবব না বরং অনাগত জীবনকালের জন্য ভাবব। আমরা চাই না যে অনাগত জীবনেও পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। আমরা একই আবেগগত শক্তি দ্বারা প্রেরিত হয়ে আছি যা আমাদের এই জীবনকালে উন্নতি করার জন্য প্রেরিত করে। পার্থক্য শুধু এইটুকুই যে আমরা দীর্ঘ সময়ের জন্য ভাবি। আমরা এই দুটি স্তরের মধ্যে একটি মধ্যবর্তী পদক্ষেপও নিতে পারি, যেখানে আমরা চাই যেসমস্ত বিভিন্ন সমস্যা আমাদের পরিবার সম্মুখীন হচ্ছে সেটা যেন আমাদের হবু প্রজন্ম পর্যন্ত না চলতে থাকে।

ভবিষ্যতের জীবনের বাইরে চিন্তা-ভাবনা করার ফলে আমরা এইভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারি যে পুনর্জন্মের সম্পূর্ণ অসন্তুষ্টি এবং হতাশাজনক চক্র থেকে আমরা যেন পুরোপুরি মুক্তি পেয়ে যাই। অথবা করুণার কারণে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা সকলের সহায়তা করার বিষয়ে ভাবি যে তারা যেন এই সমস্ত সমস্যার স্তরগুলিকে কাটিয়ে উঠুক। আমরা যদি সেরকম করতে পারি তাহলে আমরা বাস্তবে বুদ্ধ হওয়ার জন্য কাজ করি।

এই ধরণের উন্নত স্তরের প্রেরণার গুণ সম্পন্ন একজন ব্যক্তি হওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। তা সত্ত্বেও, আমরা যে স্তরেই থাকি না কেন, বুদ্ধের শিক্ষায় আমরা এই ধরণের অনেক পদ্ধতি খুঁজে পাই, যা আমাদের জন্য সহায়ক হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি এমনকি শুধু এই জীবনকালের পরিপ্রেক্ষিতেও চিন্তা-ভাবনা করি, তাহলেও কিন্তু আমরা শুধু আমাদের নিজেদের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা এবং নিজেদের সমস্যাগুলি কাটিয়ে ওঠার জন্য ভাবব না, বরং করুণা এবং পরকল্যাণের জন্য অনুপ্রাণিত হব। অন্যকথায় আমরা শুধু আমাদের নিজেদের সমস্যাগুলি কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্য এইজন্য স্থাপন করি না সে কারণ সেগুলির কারণে আমাদের কষ্ট এবং পীড়া হয়, বরং এর সাথে সেগুলি আমাদের সর্বোত্তম ভাবে পরকল্যাণের পথে বাধা সৃষ্টি করে। মন-প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে আত্ম-সংশোধন বলতে এটাকেই বোঝায়।

উদাহরণ স্বরূপ, আমরা একজন মদ্যপ। একটি দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, মদ্যপানের উপর আমাদের নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা অনুপ্রাণিত হতে পারি, কারণ আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে এবং সাধারণ ভাবে সবকিছুর পক্ষে এটা ক্ষতিকর। পরের দিন সকালে যখন আমাদের মধ্যে নেশার প্রভাব থেকে যায় তখনও আমরা স্বস্তিবোধ করি না। তবে আমরা যদি আমাদের পরিবারের কথা ভাবি তাহলে আমরা আরও প্রবল ভাবে প্রেরিত হতে পারি। আমরা বুঝতে পারি যে এই মদ্যপানের অভ্যাসটি কীভাবে আমাদের একজন ভালো অভিভাবক হতে বাধা সৃষ্টি করে। উদাহরণ স্বরূপ, প্রায়শই নেশাগ্রস্ত হওয়ার কারণে আমরা কীভাবে মাতাল হয়ে পরিবারের সাথে খারাপ আচরণ করি। এটা সত্যিই আমাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধবের ইত্যাদিদের সাথে আমাদের সম্বন্ধ নষ্ট ক’রে দেয়। আমাদের মধ্যে যখন এই বোধগম্যতা জাগে যে আমাদের পরিবারকে আমার কত প্রয়োজন আর এই মদ্যপানের নেশার সমস্যা কীভাবে সেখানে ঐ আবশ্যকতা পূরণ করতে বাধা সৃষ্টি করছে তখন মদ্যপানের সেই নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রচেষ্টারত হতে আমাদের শক্তি জোগায়।

এইভাবে আমরা যদি এই বৌদ্ধ পদ্ধতিগুলি অনুশীলন ক’রে থাকি আর সেটা যদি এই জীবনকালকে উন্নত করতে চেষ্টা করার পরিপ্রেক্ষিতে নাও করা হয়, তাহলেও অন্যদের প্রতি মৈত্রী এবং করুণার প্রেরণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মন-প্রশিক্ষণ সাধনায় পর-লালনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে; যদিও আমরা পদ্ধতিগুলির মধ্যে অনেকগুলি পদ্ধতির প্রয়োগ নিজের ভালো অনুভূতির জন্য করতে পারি, তবে অবশ্যই এই পদ্ধতিগুলির প্রয়োগ এইভাবে করলে ভাল হবে যার কারণে আমরা অন্যদের আরও ভালোভাবে সহায়তা করতে পারি।

জীবনের আটটি অনিত্য বস্তু (অষ্ট লৌকিকধর্ম)

আমাদের জীবনে আমরা বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। এই অর্থে সেগুলি কঠিন হতে পারে কারণ সেগুলি বেদনাদায়ক। এটা আবশ্যক নয় যে সেগুলিকে শারীরিক ভাবে বেদনাদায়ক হতে হবে; সেগুলি মানসিক ভাবেও হতে পারে। আমরা এই কঠিন পরিস্থিতিগুলি বুঝতে পারি, উদাহরণ স্বরূপ, এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া যা আমাদের অশান্তকারী আবেগের (ক্লেশ) জন্ম দেয়। এই অশান্তকারী আবেগ একদিকে ক্রোধও হতে পারে। আবার অন্যদিকে সেগুলি প্রবল আসক্তিও হতে পারে। আমরা সকলেই জানি যে আমাদের মন যখন ক্রোধ বা শত্রুতা ভাবনায় অথবা যখন তীব্র আসক্তি এবং লালসায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় আমরা তখন কতটা অস্বস্তিবোধ করি।

কিছু পরিস্থিতি বিশেষভাবে কঠিন হয়, যেগুলির উল্লেখ বৌদ্ধধর্মের তালিকায় তথাকথিত জীবনের আটটি অনিত্য বস্তুরূপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কখনো-কখনো সেগুলিকে “অষ্ট লৌকিক ধর্ম” রূপেও অনুবাদ করা হয়। তবে এর অভিপ্রায় হল যে আমাদের জীবনে এগুলির আগমন ঘটে অস্থায়ীরূপে; এগুলি স্থিতিশীল হয় না, অতিক্রম ক’রেই চলে। এগুলি চারটি জোড়ায় অন্তর্ভুক্তঃ

  • প্রশংসা বা সমালোচনা গ্রহণ করা- আমরা যদি প্রশংসা লাভ করি তাহলে আমরা গর্বিত হই এবং এর প্রতি আসক্ত হয়ে উঠি; আর যখন আমাদের সমালোচনা করা হয় তখন আমরা বিচলিত এবং ক্রোধিত হই।
  • সু-সংবাদ বা দুঃ-সংবাদ প্রাপ্ত করা- আমরা যখন সু-সংবাদ পাই তখন আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠি এবং অবশ্যই তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি। আমরা চাই সেটা যেন স্থায়ী হয়ে থাকে কিন্তু যেটা কখনও সম্ভব হয় না। অন্যদিকে আমরা যখন দুঃ-সংবাদ পাই আমরা খুবই বিচলিত হয়ে উঠি আর প্রায়শই বিষন্ন এবং ক্রোধিত হই।
  • লাভ বা ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া- আমরা যখন কিছু লাভ করি, উদাহরণ স্বরূপ, কেউ আমাদের কিছু দিলে আমরা আনন্দিত এবং উত্তেজিত হই, আর মনে করি, “ওহ্‌ কী চমৎকার!” তারপর আমরা যখন কিছু হারিয়ে ফেলি অথবা লোকজনরা আমাদের কাছ থেকে সেগুলি কেড়ে নেয় বা ভেঙে ফেলে তখন আমরা দুঃখী হয়ে পড়ি। লাভ অথবা ক্ষতি ব্যক্তিরূপেও হতে পারে, যারা আমাদের জীবনে আসে। আমরা একজন বন্ধু পাই অথবা আমরা আমাদের প্রিয়জনকে হারাই বা এটা আর্থিক দৃষ্টিতেও হতে পারে।
  • ভালোভাবে (সুখ) এবং খারাপভাবে (দুঃখ) চলা- আমরা সকলেই উত্তেজিত হই এবং আসক্ত হয়ে যাই অথবা আমরা হতাশ এবং ক্রোধিত হই।

এই আটটি অনিত্য ঘটনার কারণে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি, কারণ এগুলি আত্মকেন্দ্রিক ভাবনার সাথে যুক্ত থাকে। আমরা কেবল নিজেদের সম্পর্কে এবং আমাদের সাথে যা কিছু ঘটে আর আমরা যা কিছু অনুভব করি “আমি কত চমৎকার অথবা আমি বেচারা” তার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করি।

অস্থায়ী প্রতিপক্ষ বল প্রয়োগ করা

জীবনের এই আটটি অনিত্য বিষয়ের পরিণাম স্বরূপ উদ্ভূত অশান্তকারী আবেগকে কাটিয়ে ওঠার জন্য ভগবান বুদ্ধ বিভিন্ন পদ্ধতির বিষয়ে উপদেশ দিয়েছিলেন। এগুলির মধ্যে প্রত্যেকটি আমাদের এইরকম অনুশীলন করতে শিক্ষা দেয়, যার মাধ্যমে আমরা পর-লালনের জন্য হিতকারী মনোভাব জাগাতে পারি। এগুলির মধ্যে একটি পদ্ধতি হল অস্থায়ী প্রতিপক্ষ বলরূপী লেন্সের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে দেখা। এটা আমাদের চিরতরে অশান্তকারী আবেগ থেকে মুক্ত করতে পারে না। যদিও এই পদ্ধতিটি বেশি গভীরভাবে কাজে লাগে না, তবুও এটি খুবই উপকারী।

ক্রোধের প্রতিপক্ষরূপে মৈত্রী

ধরা যাক, উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের সাথে পরিস্থিতি ঠিকঠাক চলছে না। আমাদের জীবনে এমন কেউ আছে যে আমাদের সাথে খুবই খারাপ এবং অপ্রীতিকর আচরণ করছে আর আমরা সবসময় সেই ব্যক্তির উপর ক্রোধিত হই। শুধুমাত্র নিজেদের কথা ভাবার কারণে আমাদের কানে একই স্বর গুঞ্জন হতে থাকে “তিনি আমার সাথে যে আচরণ করছেন সেটা আমি একেবারেই পছন্দ করি না।” ক্রোধের জন্য অস্থায়ী প্রতিপক্ষ হিসাবে আমরা এখানে যা প্রয়োগ করব সেটা হল মৈত্রী বা প্রেম। এখন, এখানে আমরা একেবারে সরলভাবে বলব না, “আচ্ছা, এই ব্যক্তির উপর ক্রোধিত হবেন না, তাকে ভালোবাসুন। এটা স্পষ্ট যে আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে এই ভাবে পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। তবে পর-লালন ভাবনা বিকাশ করার ভিত্তিতে নিজেদের মানসিক অবস্থা এবং মনোভাব পরিবর্তন করতে সক্ষম হওয়ার ক্ষেত্রে নিজের বোধগম্যতা প্রয়োগ করার জ্জন্য এটা একটা ভাল উদাহরণ। এই ব্যক্তিটি আমার সাথে ভয়াবহভাবে আচরণ করছেন, কিন্তু তিনি এরকম আচরণ করছেন কেন? নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যা তাকে বিরক্ত করছে। আমি নিশ্চিত যে আপনাদের জীবনে এরকম মানুষ আছে যারা সর্বক্ষণ অভিযোগ করতে থাকে। যখনই তারা আপনার সাথে থাকে তারা তাদের কথোপকথনে নিয়মিত ভাবে এই বিষয় অথবা ঐ বিষয় নিয়ে অভিযোগ করতেই থাকে। তারা সবসময় নিজেদের সম্পর্কে আলোচনা করে আর সেইজন্য তাদের সাথে থাকাটা পূর্ণতঃ “অবসাদকারী” অভিজ্ঞতার অনুভূতি হয়। আমরা যদি এই বিষয়টির বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে এই ব্যক্তিটি স্পষ্টতই এরকম আচরণ করছে কারণ সে অত্যন্ত দুঃখী। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার জন্য একটি উৎপাদনশীল উপায় হল আমাদের ভাবতে হবেঃ “যদি এই ব্যক্তিটি সুখী হতো তাহলে সে সবসময় অভিযোগ করত না আর আমার জন্য সমস্যা তৈরী করত না।” মানুষের পক্ষে এই ভাবে পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। তবে পর-লালন ভাবনা বিকাশ করার ভিত্তিতে নিজেদের মানসিক অবস্থা এবং মনোভাব পরিবর্তন করা সক্ষম হওয়ার ক্ষেত্রে নিজের বোধগম্যতা প্রয়োগ করার জন্য এটা একটা ভাল উদাহরণ।

এই ব্যক্তিটি আমার সাথে ভয়াবহভাবে আচরণ করছে, কিন্তু তিনি এরকম আচরণ করছেন কেন? নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যা তাকে বিরক্ত করছে। আমি নিশ্চিত যে আপনাদের জীবনে এরকম মানুষ আছে যারা সর্বক্ষণ অভিযোগ করতেই থাকে। যখনই তারা আপনার সাথে থাকে তারা তাদের কথোপকথনে নিয়মিত ভাবে এই বিষয় অথবা ঐ বিষয় নিয়ে অভিযোগ করতেই থাকে। তারা সবসময় নিজেদের সম্পর্কে আলোচনা করে আর সেইজন্য তাদের সাথে থাকাটা পূর্ণতঃ “অবসাদকারী” অভিজ্ঞতার অনুভূতি হয়। আমরা যদি এই বিষয়টির বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, এই ব্যক্তিটি স্পষ্টতই এরকম আচরণ করছে কারণ সে অত্যন্ত দুঃখী। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার একটি উৎপাদনশীল উপায় হল আমাদের ভাবতে হবেঃ “যদি এই ব্যক্তিটি সুখী হতো তাহলে নিশ্চয়ই সে সবসময় অভিযোগ করত না, আর আমার জন্য সমস্যা তৈরী করত না।” বৌদ্ধধর্মে মৈত্রীর সংজ্ঞা এইভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে- অন্য ব্যক্তি যেন সুখ এবং সুখের কারণে যুক্ত হয়, এই কামনা। অতএব, ঐ ব্যক্তিটি অন্য কোথাও চলে যাক আর আমাকে যেন বিরক্ত না করে, এই কামনা করার পরিবর্তে আমাদের এই ধরণের কামনা বিকাশ করতে হবে সে যেন সুখী হয়, আর যা কিছু তাকে বিরক্ত করছে তার যেন অবসান ঘটে। এরকম করলে আমরা কম বিরক্ত হব। ধ্যান সাধনায় এই ধরণের মনোভাব পরিবর্তন করার জন্য প্রযোজ্য অনুশীলন হল “মন-প্রশিক্ষণ।”

তীব্র যৌন আকর্ষণ হ্রাস হওয়া

একইভাবে আমরা যদি কারও প্রতি খুবই আকর্ষিত হই, তাহলে আমরা এই ধরণের অনিত্য প্রতিপক্ষ ভাবনাকে প্রয়োগ ক’রে নিজেদের কল্পনাকে কাজে লাগাতে পারি। আত্মকেন্দ্রিক হওয়া এবং কেবল ঐ ব্যক্তির বাহ্যিক চেহারার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার পরিবর্তে আমরা কল্পনা করতে পারি যে তার শরীরের আভ্যন্তরীণ চেহারাটা কেমন, যেমন- তার পেট, অন্ত্র, মস্তিষ্ক ইত্যাদি, কারণ আমরা ভাবি ঐ চেহারা যুক্ত ব্যক্তিটিই হল আমার সুখ ভোগ করার বস্তু। এটা বিশেষ ক’রে সহায়ক হয় যখন আমরা তার চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করি আর কল্পনা করি যে তার মাথার খুলির কঙ্কালের গঠনটি কেমন হতে পারে। অবশ্যই আমরা যেটা কল্পনা করি সেটা সত্য, কারণ ঐ ব্যক্তির ত্বকের ভিতরে ঐসব কিছুই তো আছে।

আর একটি কার্যকর পদ্ধতি হল ঐ ব্যক্তিকে একটি শিশু হিসাবে কল্পনা করা এবং তারপর কল্পনা করা যে সে যখন খুব বয়স্ক হয়ে যাবে তখন সে কেমন দেখতে লাগবে। এইভাবে আমরা আমাদের আসক্তিকে হ্রাস করতে পারি। বিশেষ ক’রে এটা যদি যৌন আকর্ষণ হয় তাহলে তখন আমাদের ভাবতে হবে আমরা যা দেখছি সেটা কেবল তার বাহ্যিক রঙ্‌-রূপ। আর অবশ্যই সেটা স্থায়ী হয়ে থাকবে না। অথবা সে যদি কোন ভয়াবহ চর্মরোগে আক্রান্ত হয় বা তার শরীর ভারী ব্রণে ভরে যায় তাহলেও কি আমরা তাকে এত আকর্ষণীয় মনে করব? আমরা যত বেশী এই বিষয়টাকে বুঝব যে, আসলে এই ব্যক্তির ভিতরে আছে অন্ত্র এবং একটি কঙ্কাল, আমাদের মন ততই পরিবর্তন হতে থাকবে। আর আমাদের আবেগগত বিপর্যয় শান্ত হতে থাকবে। ফলে আমরা আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠব।

তারপর আমরা তার প্রতি একটা যত্নশীল মনোভাব গড়ে তোলার পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারি। এই ব্যক্তি, যার প্রতি আমার মধ্যে এত তীব্র যৌন আকর্ষণ জাগে তার বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি কোনও ব্যক্তির প্রতি এই ধরণের তীব্র আসক্তি এবং আকর্ষণ সাধারণতঃ তার শরীরের উপর কেন্দ্রিভূত হয়। আমরা এই তথ্য সম্পর্কিত আমাদের দৃষ্টিকোণ হারিয়ে ফেলি যে, সে একজন মানুষ এবং সে সুখী হতে চায়, দুঃখী নয়। আর সে চায় না যে তাকে একটি উপভোগ্য বস্তু হিসাবে গণ্য করা হোক। ঐ ব্যক্তিরও নিজস্ব নিরাপত্তাহীনতা, নিজস্ব মানসিক সমস্যা, নিজস্ব আবেগগত সমস্যা এবং নিজস্ব পারিবারিক সমস্যা আছে। অতএব, তার এই দিকগুলি সম্পর্কে ভাবলে তখন তাকে উপভোগ্য বস্তুরূপে দেখাটা তার বিপরীত হয়ে যাবে। আমরা বাস্তবে তাকে একজন মানুষ হিসাবে দেখতে পারি এবং তার সুখ ও কল্যাণের জন্য আন্তরিক উদ্বেগ বিকাশ করা শুরু করতে পারি।

ভিখারী বা প্রতিবন্ধীদের প্রতি বিতৃষ্ণা বা উদাসীনতা ত্যাগ

আমরা যখন একজন কুৎসিত বা ঘৃণিত ব্যক্তিকে দেখি তখন অস্থায়ী প্রতিপক্ষকে প্রয়োগ করাও অত্যন্ত কার্যকর হয়ে ওঠে। আমরা যখন ভিখারী বা খুবই গরীব মানুষের মুখোমুখি হই, এগুলি অন্যান্য দেশের তুলনায় মেক্সিকো বা ভারতের মতো দেশে দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে এই ধরণের নিম্ন শ্রেণীর লোকজন বাস করে। আমরা এর প্রয়োগ প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রেও করতে পারি। যারা অন্ধ, বধির অথবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয় এবং যাদের সাথে আমরা থাকতে প্রায়শই খুবই অসহ্য এবং অস্বস্তি বোধ করি।

আমার মনে আছে, বার্লিনে একবার প্রতিবন্ধীদের নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। ঐ প্রদর্শনীর একটা ভাগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিয়ে ভিডিও সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপছিল, তাদের মুখ ছিল বাঁকা আর কথা ছিল অস্পষ্ট। তারা তাদের যৌন জীবন সম্পর্কে কথা বলছিল। তারা বলছিল তাদের হৃদয়েও ঠিক ঐ ধরণের মনোভাব জাগে, তাদের মনেও ঐ ধরণের যৌন চাহিদা আছে আর অন্যদের মতো তারাও যৌন সম্পর্ক করার কামনা করে। তারপর সেই বিষয় সম্পর্কে বর্ণনা করেছিল যে, তারা কেমন ধরণের প্রেমের সম্পর্কে জড়িত ছিল। শহরের সমস্ত স্কুলের ছেলে-মেয়েদের এই প্রদর্শনীতে যাওয়া অনিবার্য ছিল। আমার মতে এটা একটা অসাধারণ পদক্ষেপ ছিল, কারণ এই প্রদর্শনীটা দেখিয়েছিল যে অন্যান্য মানুষের মতো তারাও ছিল প্রকৃত মানুষ। আমাদের আত্মকেন্দ্রিক বিতৃষ্ণা, উদাসীনতা অথবা এই ধরণের মানুষের সাথে থাকার অস্বস্তিভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য এটা খুবই সহায়ক।

আর একটি পদ্ধতি হল আপনি যখন একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখবেন তখন কল্পনা করবেন যে “আমার মা” অথবা “আমার বাবা”- সেখানে গৃহহীন হয়ে ভিক্ষা করছে অথবা আপনি যদি দেখেন যে একজন তরুণ পলাতক রাস্তায় ভিক্ষা করছে, তখন কল্পনা করবেন যে “আমার পুত্র” অথবা “আমার কন্যা” এই অবস্থায় যদি থাকে তাহলে আপনার কেমন মনে হবে। মনোভাবে এই ধরণের পরিবর্তন, আমরা কীভাবে ব্যক্তিকে বিবেচনা করি, সেটা সম্পূর্ণরূপে আমাদের আবেগগত প্রতিক্রিয়াকে পরিবর্তন করে দেয়। আমি স্বীকার করি যে আমি এই রকম কখনো করিনি কিন্তু আমি নিউইয়র্কের একজন ওয়ের্স্টার্ন জেন শিক্ষককে চিনি, যদি তিনি চান তাহলে তার ছাত্ররা টাকা-পয়সা, ক্রেডিট কার্ড অথবা ডেবিড কার্ড ছাড়া রাস্তায় বেরিয়ে যাবে আর গৃহহীন অবস্থায় এক সপ্তাহ ধরে ভিক্ষা করতে থাকবে। তারা এটা করে এই অনুভব করার জন্য যে ঐ অবস্থায় তাদের মধ্যে কেমন অনুভূতি জাগে।

কঠিন পরিস্থিতিতে অন্যদের প্রতি আমাদের উদাসীনতা কাটিয়ে ওঠার জন্য এগুলি অত্যন্ত প্রভাবশালী “ওষুধ”। আমি শুধু ভাবছি প্রায়শই আমরা যখন এই ধরণের মানুষের মুখোমুখি হই আমরা তখন তাদের দিকে তাকাতেও চাই না। এটা আমাদের অস্বস্তি বোধ করায়। কল্পনা করুন, তাদের জায়গায় যদি আমরা হতাম! আপনি ঐ অবস্থায় রয়েছেন, সংঘর্ষ করছেন আর কেউ আপনার দিকে তাকাতেও চায় না, আপনার অস্তিত্বকে কেউ মানতেও চায় না অথবা এই ভেবে তারা আপনাকে তাড়িয়ে দেয় যে, আপনি যেন একটা মশা। যাইহোক, প্রতিপক্ষ শক্তিকে প্রয়োগ করার জন্য এটি একটি পদ্ধতি কিন্তু এগুলি অস্থায়ী আর এগুলি সমস্যার মূলে যেতে পারে না।

গভীরতম প্রভাবী প্রতিপক্ষ বলের প্রয়োগ

দ্বিতীয় মন-প্রশিক্ষণ পদ্ধতি হল এমন একটি প্রতিপক্ষ বলকে প্রয়োগ করা যা নিছক একটি অস্থায়ী প্রতিকার নয় বরং সেটা সমস্যার মূলে যায় এবং সেটার উন্মুলন ক’রে দেয়। এর অভিপ্রায় হল এমন একটি চিত্তের অবস্থাকে প্রয়োগ করা যা পারস্পরিক একচেটিয়া বিভ্রান্ত এবং ভুল মানসিক অবস্থার বিপরীত। মনের এই অবস্থা বলতে শূন্যতার বোধগম্যতাকে বোঝায়, যেমন- একজন ব্যক্তি বা একটি পরিস্থিতি যেভাবে অস্তিমান তার সম্পর্কে যে ভুল ধারণা থাকে তার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। অন্য কথায়, মূলতঃ আমাদের আসক্তি অথবা ক্রোধের অন্তর্নিহিত বস্তুগুলি যেভাবে অস্তিমান তাদের সম্পর্কে আমাদের বিভ্রান্তি।

শূন্যতার উপর গভীর আলোচনা করার এটা সঠিক অবসর নয়। অতএব, আসুন, আমরা কেবল এর মৌলিক স্তর নিয়ে আলোচনা করি। উদাহরণ স্বরূপ, ধরুন, আপনি আপনার অসুস্থ ঠাকুরদাদা এবং ঠাকুরমা অথবা বয়স্ক মাতা-পিতার সাথে দেখা করতে কোন বৃদ্ধ নার্সিংহোমে যান। আপনি যখন গলিপথ হয়ে তাদের কক্ষে প্রবেশ করেন, তখন আপনি এমন একজন বৃদ্ধা মহিলার পাশ দিয়ে যান যিনি একটি হুইল চেয়ারে কুচকে পড়েছিলেন, একা-একা বিড়বিড় করছিলেন আর তার মুখ থেকে লালা বেরিয়ে তার কোলের উপর রাখা তোয়ালের উপর পড়ছিল। এরকম কাউকে দেখে আপনি খুবই অস্বস্তি বোধ করেন। আপনি মনে করেন যে তিনি সবসময় এরকম অবস্থায় থাকেন। আর আপনি যদি তার পাশ দিয়ে যাতায়াত করেন তখন যদি তিনি তার হাতটি বের ক’রে আপনার হাতটি ধরার চেষ্টা করেন অথবা আপনাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেন তখন আপনি ঘাবড়ে যান, কারণ আপনি শুধু আপনার কথাই ভাবতে থাকেন।

অবশ্যই আমরা এখানে অস্থায়ী প্রতিপক্ষ বলকে প্রয়োগ করতে পারি এবং মনে করতে পারি যে তিনি একজন মানুষ। তার একটা জীবন ছিল, ছিল একটা পরিবার, একটি পেশা এবং একসময় তিনি তরুণও ছিলেন; তিনি সবসময় এরকম দেখতে ছিলেন না। তিনি কেবল নিজের হাত বাড়াচ্ছিলেন কারণ তিনি চাইছেন একটু মানবীয় সংস্পর্শ। এটা কার্যকর হতে পারে কিন্তু এখানে আমরা একটা গভীর পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারি। আমাদের বিষয়টাকে বুঝতে হবে যে আমরা তার বিষয়ে যেভাবে কল্পনা করছি সেটা সেইরূপে করছি যেরূপে আজ আমরা তাকে আমাদের সামনে দেখতে পাচ্ছি অর্থাৎ একজন বৃদ্ধা এবং ক্ষয়প্রাপ্ত ব্যক্তিরূপে, এর বাইরে আর কিছুই নয়, এটা অসম্ভব। সম্ভবতঃ কেউ এইরূপে অস্তিমান হতে পারে না। এটা যেন একটি স্থির ছবিতে একসময় অবধি হিমায়িত চিত্র। তারপর আমরা আমাদের ধ্যান একাগ্র করতে পারি, “এরকম কিছু হয় না, এটা অসম্ভব।” আমাদের ভুল ধারণা বন্ধ করার এটি একটি কঠোর পদ্ধতি যাতে আমরা ঐ বৃদ্ধার প্রতি আরও বাস্তববাদী এবং করুণাময় মনোভাব জাগাতে পারি।

অন্তর্নিহিত গভীর সচেতনতা প্রকাশ করতে অশান্তকারী আবেগকে শিথিল করা

আর একটি পদ্ধতি হল “মহামূদ্রা”-নামক একটি উন্নত মানের ধ্যানে ব্যবহৃত পদ্ধতি, যথা- “অন্তর্নিহিত গভীর সচেতনতার দর্শন যার মধ্যে অশান্তকারী আবেগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলীন হয়ে যায়। এই পদ্ধতিতে ঐ মৌলিক প্রক্রিয়াগুলিকে ব্যবহার করা হয় যার মাধ্যমে আমাদের মন বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে- এটিকে সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা হবে, “আমাদের মনের কার্য সঞ্চালন বিধি।”

আসুন আমরা একটা উদাহরণকে দেখি। ধরুন, আমাদের মধ্যে কারও প্রতি তীব্র আকর্ষণ এবং লালসা আছে। আমরা যদি ঐ আবেগগত অবস্থার উত্তেজনাকে শিথিল করতে পারি তাহলে আমরা তার গভীরে যা খুঁজে পাব সেটাকে বলা হয় “গভীর সচেতনতার ব্যক্তিগতকরন।” অন্যকথায়, এই ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়ার পদ্ধতি অনুযায়ী যেটা ঘটে চলেছে সেটা হল আমরা এই ব্যক্তিকে অন্য একজন ব্যক্তির বিপরীতে আলাদা একজন ব্যক্তি হিসাবে নির্দিষ্ট করছি। মোট কথা, মনের মৌলিক পরিকাঠামোর নিরিখে এটাই ঘটতে থাকে। তারপর আমরা ঐ বস্তুর উপর অভিক্ষেপ করি, “এই ব্যক্তিটি সত্যিই বিশেষ।” আমরা কিছু নির্দিষ্ট গুণকে অতিরঞ্জিত করি এবং তারপর আকর্ষণ এবং লালসা অথবা আসক্তি উৎপন্ন করি।

লালসা জিনিসটা তখনই জাগে যখন আপনার কাছে সেই বস্তুটা না থাকে; আপনি সেটাকে পেতে চান। অন্যদিকে, আসক্তি হল এমন একটা জিনিস যা আপনার কাছে থাকে কিন্তু আপনি সেটাকে হারাতে চান না। এটা স্পষ্ট যে, আপনি উভয় পরিস্থিতিতেই পুরোপুরিভাবে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকেন। আপনি যদি মনের এই অবস্থায় অতিরঞ্জিত করা এবং প্রবল শক্তিকে শিথিল করেন তাহলে যেটা অবশিষ্ট থাকবে সেটা হল, মনের মূল রূপ যা সেটাকে নির্দিষ্ট করে। ব্যস্‌ এখানেই শেষ।

এটি একটি বেশ উন্নত, তবে অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতি, যদি কিনা আপনি এর প্রয়োগ করতে পারেন কিন্তু এর জন্য একটু পরিপক্কতার প্রয়োজন হয়, যাতে আবেগে ভেসে না যান। আপনার মধ্যে এই সামর্থ্য থাকতে হবে যাতে আপনি দেখতে পারেন, যখন আপনি এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করছেন তখন আপনার আবেগের নীচে কী ঘটছে এবং তারপর আপনাকে ঠান্ডা হতে হবে। আমরা যত অন্তর্নিহিত মৌলিক জ্ঞানের কাঠামোকে দেখতে থাকব আমাদের আবেগ ততই স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্মোচন হতে থাকবে।

নেতিবাচক পরিস্থিতিগুলিকে ইতিবাচকরূপে পরিবর্তন করাঃ অন্যদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিকোণ

পরবর্তী পদ্ধতিটি হল সাধনা করার জন্য আপনি যে পরিস্থিতিকে অনুকূল না মনে করেন সেটাকে অনুকূল তৈরী করা। এটি হল সেই প্রধান পদ্ধতি যেটাকে পরম্পরাগত মন-প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষ ক’রে লাংরি থাংপা- রচিত “চিত্ত-শোধন অষ্ট কারিকা (লো-জোঙ্‌ ছিগ্‌-গেমা)” নামক গ্রন্থে। মহান ভারতীয় আচার্য শান্তিদেব রচিত ‘বোধিচর্যাবতার’ নামক গ্রন্থের একটি শ্লোকে উল্লেখ করেছেনঃ

যদি এর প্রতিকার করা যায় তাহলে সেটাকে অপছন্দ কেন করবেন? যদি এর প্রতিকার করা না যায় তাহলে সেটাকে অপছন্দ করেই বা লাভ কী (৬.১০)

আপনি যদি কোন পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার জন্য কিছু করতে পারেন তাহলে এটা নিয়ে মন খারাপ কেন করবেন? শুধু এটা পরিবর্তন ক’রে ফেলুন। আর যদি এটার জন্য আপনি কিছু না করতে পারেন তাহলে মন খারাপ করেই বা লাভ কী? এতে আপনার তো কোন লাভ হবে না। সুতরাং আমরা যদি এমন কোন পরিস্থিতির মধ্যে থাকি যেটা আমাদের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক, খুবই কঠিন, সমালোচনামূলক অথবা সেটা আমাদের কোন কাজে লাগে না আর আমরা বাস্তবে সেটা পরিবর্তন করতে পারি না, তাহলে মন খারাপ ক’রে কী লাভ হবে? কেবল সেটার প্রতি যা করণীয় সেটা হল নিজের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূল পরিস্থিতিতে পরিবর্তন করার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। নিজের মনোভাব পরিবর্তন করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক পদ্ধতি এই বিষয়ের উপর নির্ভর করে যে, আমরা অন্যদের কেমন আলাদা দৃষ্টিতে দেখি যখন তারা আমাদের জন্য সমস্যা তৈরী করে। আর এই পদ্ধতিগুলি সেই পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত যে এই পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদেরকে কেমনভাবে দেখি। আসুন, সর্বপ্রথম আমরা সেই পদ্ধতিগুলির দিকে নজর দিই, যার সম্পর্কে অন্যদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে।

কষ্টকর মানুষদের চিন্তামণি-রত্নের মতো বিবেচনা করা

কষ্টকর মানুষের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের একটা উপায় হল তাদের “একটা চিন্তামণি রত্নের মতো” বিবেচনা করা। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা ভাবতে পারি, “এখানে কেউ আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে; সে আমাকে বড় হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে যে আমি কতদূর উন্নতি করেছি তার পরীক্ষা করার জন্য। এটা একটা চমৎকার সুযোগ।” অথবা, “ইনিই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আমাকে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই শ্রেণীর মানুষ সবসময় অভিযোগ করতে থাকেন এবং আমাকে সম্পূর্ণভাবে হতাশ করেন, তবে এটা একটা ভাল সুযোগ! অসাধারণ! এই ব্যক্তি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, কারণ এখন আমি সত্যিই ধৈর্য এবং বোধগম্যতা অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছি।” সুতরাং এই শ্রেণীর মানুষ হল চিন্তামণির মতো। “আমার প্রতিবেশী আমাকে কত সুন্দর ক’রে একটা শিশুর সাথে বসতে বলেছেন যার বিষয়ে আমি জানি যে, সে সারারাত কাঁদবে এবং চিৎকার করবে। এটা অসাধারণ!”

আচার্য শান্তিদেব খুব সুন্দরভাবে বলেছেন-

অতএব আমি অত্যন্ত আনন্দিত হব এরকম একজন শত্রুর সম্পর্কে যে হঠাৎ ক’রে আমার ঘরে একটা সম্পদের মতো উত্থিত হয়েছে, যাকে আমি ক্লান্তি সহ্য না করেই লাভ করেছি। কেননা তিনি বোধিসত্ত্বচর্যার জন্য আমার সহায়ক হয়েছিলেন।

একজন বোধিসত্ত্বের ক্ষেত্রে যা সবচেয়ে বেশি পরম আনন্দের বিষয় সেটা হল যখন কেউ তাকে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করেন; যে পর-কল্যাণের জন্য বোধিলাভ হেতু নিজেকে সমর্পিত করেন। যদি কেউ তাকে সহযোগিতা করতে না বলেন তাহলে সেই বোধিসত্ত্ব অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করে, তিনি নিজেকে অনর্থক মনে করেন। আমার একটি ওয়েবসাইট আছে যেখানে আমি প্রচুর পরিমাণে ই-মেইল পাই, আমাকে প্রশ্ন করা হয় অথবা সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এইরকম পরিস্থিতিতে ঐ ই-মেইল এবং অনুরোধের সংখ্যা দেখে অতি সহজেই বিরক্ত হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক কিন্তু আমি যদি সত্যিকারেই ঐ ধরণের চর্যার অনুশীলন করি তাহলে আমি আনন্দিত হব। যত বেশি অনুরোধ এবং ই-মেইল আসবে আমি তাদের তত বেশি সহযোগিতা করার সুযোগ পাব। আমরা যদি বৌদ্ধ পদ্ধতিতে প্রার্থনা করি, “আমি যেন সমস্ত প্রাণীর উপকারে আসি!” এবং যদি আরও বেশি সংখ্যক প্রাণী আমার কাছে আসে আর সহযোগিতার জন্য অনুরোধ করে তাহলে কী আমার প্রার্থনা সত্য প্রমাণিত হবে না? শান্তিদেব বলেছেনঃ

যদিও মানুষ সুখ লাভ করার উদ্দেশ্যে কর্ম করে তাসত্ত্বেও এটা নিশ্চিত নয় যে সে সুখী হবে কিনা। কিন্তু (বোধিসত্ত্বের) কর্ম প্রকৃতপক্ষে সুখবর হয়, কারণ এই রকম কর্ম না ক’রে সে কীভাবে সুখী হতে পারবে? 

কষ্টকর লোকজনদের আমাদের অসুস্থ শিশুর মতো বিবেচনা করা

আমাদের মনোভাবের আর একটি পরিবর্তন হল এক শ্রেণীর অপ্রিয় এবং কষ্টকর লোকজনদের আমাদের অসুস্থ শিশুর মতো বিবেচনা করা। যখন আমাদের শিশু অসুস্থ হয় এবং বিরক্ত হয়ে কাঁদতে থাকে তখন আমাদের সেই সময়টা অনেক কষ্টে ভরা থাকে। কিন্তু মূলতঃ আমাদের অন্তরে তাদের প্রতি মমতা ভাব থাকে, কারণ আমরা বুঝতে পারি যে তারা অসুস্থ। সম্ভবতঃ ঐ সময় তাদের বিছানার উপর শুইয়ে দেওয়া অথবা সেই ধরণের কিছু করার প্রয়োজন হয়। এরকম পরিস্থিতিতে আমাদের ক্লান্ত শিশু যদি ব’লে ওঠে, “আমি তোমাকে ঘৃণা করি এবং আমি বিছানায় শুতে চাই না” তখন আমরা তার কথাটাকে গম্ভীর ভাবে নিই না, কারণ সে তখন অসুস্থ থাকে। ঠিক একইভাবে ঐ ব্যক্তির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা উচিত যে ব্যক্তি আমাদের প্রতি অপ্রীতিকর। তাকে একটি বিরক্তিকর কীট-পতঙ্গের মতো না মনে ক’রে একটি অসুস্থ শিশুর মতো মনে করা উচিত। এইভাবে আমরা আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার পরিবর্তে তাদের প্রতি উদ্বিগ্ন হতে পারি।

কষ্টকর লোকজনদের নিজেদের গুরুর মতো বিবেচনা করা

তৃতীয় পদ্ধতিটি হল তাদেরকে আমাদের গুরু হিসাবে বিবেচনা করা। একটা জনপ্রিয় গল্প আছে, যখন অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে গিয়েছিলেন তখন তিনি তাঁর সাথে একজন রাঁধুনী নিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতীয় রাঁধুনীটি কখনোই তাঁর কথা শুনত না আর সবসময় তর্ক-বিতর্ক করতে থাকত। তিব্বতবাসীরা অতীশকে বলেছিল, “আপনি তাকে ভারতে কেন ফেরত পাঠাচ্ছেন না? আমরা আপনার জন্য রান্না করতে পারব” উত্তরে অতীশ বলেছিলেন, “না, না! তিনি কেবল আমার রাঁধুনী নন; বরং তিনি আমার ধৈর্যের গুরু।” অতএব আমাদের জীবনে যদি কোন বিরক্তিকর আত্মীয়-স্বজন থাকে এবং যে ভাবেই হোক আমাদের তার সংসর্গে থাকতে হয় তাহলে তখন তাকে আমাদের ধৈর্যের গুরু হিসাবে বিবেচনা করাটা খুবই সহায়ক হয়।

বাস্তবে মানুষ আমাদের অনেক কিছু শেখাতে পারে, যেমন- নিজেরা খারাপ আচরণ ক’রে, তারা আমাদের খারাপ আচরণ না করতে শেখাতে পারে ইত্যাদি। এমনকি আমাদের কুকুরও আমাদের গুরু হতে পারে। আপনি কি কখনো লক্ষ্য করেছেন যে, আপনি যখন দিনের বেলায় আপনার কুকুরকে আপনার সাথে নিয়ে বাইরে হাটতে যান তখন কুকুরটি যেকোন জায়গায় মাটিতে শুয়ে বিশ্রাম ক’রে নেয়, এমনকি ঘুমিয়েও পড়ে। অন্যদিকে, আমাদের বা মানুষের ক্ষেত্রে অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়, “ওহ্‌, বিছানাটা বিশেষ হতে হবে, চাদরটি বিশেষ হতে হবে এবং সেটা নরম হতে হবে” বা “এটাকে শক্ত হতে হবে” অথবা এটা, সেটা ইত্যাদি, ইত্যাদি। কুকুর কখনও এই বিষয়ে অভিযোগ করে না। সে যেকোন জায়গায় শুয়ে থাকতে পারে। এটি একটি মহান শিক্ষা। এটি হল অন্যদের আলাদাভাবে দেখার একটি পদ্ধতি, যখন তারা আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে অর্থাৎ তাদের চিন্তামণি-রত্ন হিসাবে বিবেচনা করা অথবা নিজেদেরকে অসুস্থ শিশু হিসাবে বা একজন গুরু হিসাবে বিবেচনা করা।

নেতিবাচক পরিস্থিতিকে ইতিবাচকরূপে পরিবর্তন করাঃ আমরা নিজেদের কীভাবে বিবেচনা করি।

অন্যদের বিজয় প্রদান

এইরকম পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে নিজেদের আলাদাভাবে বিবেচনা করতে পারি এবং নিজেদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারি। প্রথমটি হল “অন্যদের বিজয় প্রদান করা এবং নিজেরা পরাজয় স্বীকার করা।” অন্যকথায় স্ব-লালন মনোভাবের সাথে আমরা সবসময় এরকম চিন্তা-ভাবনা করতে থাকি, “আমাকে যেতেই হবে; আমি যা বলি সেটা যেন কার্যকর হয় এবং অন্যরা যেন আমার সামনে নত হয়” অন্যদিকে আমরা যদি নিজের পরাজয় স্বীকার করে নিই তাহলে তো কোন তর্ক-বিতর্কই থাকে না। উদাহরণ স্বরূপ, একটা সহজ উদাহরণ, আপনি আপনার বন্ধু বা সঙ্গীর সাথে আছেন এবং আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আপনারা কোন রেঁস্তোরায় যাবেন। যদি আপনার বন্ধু কোন নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে চায় আর আপনি তার পরিবর্তে অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য আগ্রহ করেন, তাহলে তো তর্কের উপরে তর্ক চলতেই থাকবে। অবশেষে কী লাভ হবে? এর পরিবর্তে আপনি যদি তার কথায় রাজী হয়ে যান এবং বলেন, “ঠিক আছে, তুমি যে রেঁস্তোরা পছন্দ করেছ সেখানে যাওয়া যাক,” তাহলে তো গল্পই শেষ, কোন তর্ক-বিতর্কই থাকবে না। অন্যকথায়, তর্ক-বিতর্কটি তখনই শেষ হয়ে যাবে যখন আপনি অন্য ব্যক্তিকে নিজের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন এবং তাকে বিজয় প্রদান করবেন।

এখন আমরা এখানে সত্যিই কোন কঠোর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছি না, যেখানে অন্য কোন ব্যক্তি একটা ভীষণ নেতিবাচক এবং ধ্বংসাত্মক বিষয় সম্পর্কে পরামর্শ দেয়। তবে যেখানে প্রকৃতপক্ষে খুব বেশী পার্থক্য থাকে না, তখন অন্যদের বিজয় প্রদান করা উচিত। অবশ্যই এই কৌশল নিয়ে কারও-কারও আপত্তি থাকতে পারে, যদি আপনি সবসময় পরাজয় স্বীকার করেন এবং অন্যরা আপনার সুবিধা নেয়। অতএব এটা স্পষ্ট যে, আপনাকে এই বিষয়ে সংবেদনশীল হতে হবে যে এই পদ্ধতিটিকে কোন্‌ পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা উচিত। তাহলেও এরকম অনেক পরিস্থিতি আছে, যেখানে কোন সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য এটাই হল সর্বোত্তম পদ্ধতি।

আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদের একটা উদাহরণ দেব। আমি বার্লিনের একটি প্রধান রেঁস্তোরা-জেলার একটি ব্যস্ত কোণায় অবস্থিত সেখানে একটা জায়গায় বসবাস করি। আমি থাকি একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের নিচের তলায়। সেখানে একটি খুব শান্ত সরাইখানা ছিল কিন্তু পরে তার পরিবর্তে একটা নতুন রেঁস্তোরা খুলল। এটি একটি খুবই জনপ্রিয় স্প্যানিস রেঁস্তোরা। এই রেঁস্তোরাটি সপ্তাহের সাত দিনই সকাল সাতটা থেকে পরের দিন ভোর তিনটে পর্যন্ত খোলা থাকে। যখন আবহাওয়া উষ্ণ থাকে তখন আমার ভবনের দুপাশে বাইরে তাদের টেবিল সাজানো থাকে। লোকজন বাইরে বসে বিয়ার বা মদ্যপান করে। আর ভোর তিনটে পর্যন্ত জোরে-জোরে কথা বলে এবং হাসি-ঠাট্টা করতে থাকে। যখন তারা প্রথমবার রেঁস্তোরাটি খুলল তখন তারা আমার শয়নকক্ষের জানালার ঠিক নীচে টেবিল রাখতে শুরু করেছিল। আমি রাত্রে শুয়ে পড়তাম কিন্তু হই-হুল্লোড়ের কারণে ঘুমাতে পারতাম না। আমি হতাশ এবং বিরক্ত হতাম আর কেবল নিজের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকতাম। তারা যে আনন্দে সময়টা কাটাতো সেই বিষয়ে একেবারেই ভাবতাম না। আমার মনে নানারকম কল্পনা জাগত। আমি কল্পনা করতাম যে, আমি কোন মধ্যযুগীয় দূর্গে আছি আর আমার পাশে ফুটন্ত আলকাতরায় ভরা একটা বড় জালা রয়েছে, যেটাকে আমি উলটে দিয়ে ঐ লোকজনদের উপরে ঢালছি। তবে আমি এমন ধরণের একজন ভূতুড়ে বুড়ো হয়ে উঠতে পারিনি যে সবসময় চিৎকার ক’রে বলতে থাকে, “লোকজনদের চুপ ক’রে থাকতে বলো না হলে আমি পুলিশ ডাকব।”

সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় ছিল তাদের বিজয় প্রদান করা এবং নিজের পরাজয় স্বীকার ক’রে নেওয়া। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় তাদের উপভোগ করার শৈলীটা আমার শয়নকক্ষে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে সক্ষম হওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার বাড়ির একমাত্র কক্ষ যেটা রাস্তার মুখোমুখি ছিল না, সেটা হল রান্নাঘর। আমার রান্নাঘরটা খুব বড়। এখানে সকালের ব্রেকফাস্ট করার জায়গায় একটা উঁচু প্লাটফর্ম তৈরী করা আছে, সেখানে পর্যাপ্ত খালি জায়গাও আছে। অতএব, আমি গরমের সময় সেখানে ঘুমোই। দিনের বেলা আমি গদিটাকে পাঁচিলের দিকে হেলান দিয়ে রেখে দিই আর রাত্রিবেলা সেটাকে মেঝেতে পেতে তার উপর ঘুমিয়ে পড়ি। বাড়িতে যতগুলো ঘর আছে তার মধ্যে সবথেকে শান্ত এবং শীতল ঘর হল এটি।

আমি রান্নাঘরে ঘুমিয়ে আনন্দ অনুভব করি। আমি তাদের বিজয় প্রদান করেছি আর এইজন্য তারা যতই জোরে চিৎকার করুক না কেন তাতে আমার কিছু আসে যায় না, নববর্ষের প্রাক্‌ দিনগুলিতেও আমার খুব ভালো লাগে, কারণ জার্মানবাসীরা বাজি ফাটাতে খুব ভালোবাসে। রাস্তার দিক থেকে আওয়াজটা খুব জোরে শোনা যায়। কিন্তু আমি যদি আমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করি তাহলে কোন সমস্যাই থাকে না।

আমার সাথে ঘটিত নেতিবাচক ঘটনাগুলি আমার নেতিবাচক কর্মকে পুড়িয়ে দেয়

দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হল, আমার সাথে যে নেতিবাচক ঘটনা ঘটে চলেছে সেই বিষয়গুলিকে “নেতিবাচক কর্মকে পুড়িয়ে দেওয়া” হিসাবে দেখা। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা এটিকে শাস্তি হিসাবে মেনে নেব, বরং আমরা মনে করব, যে কঠিন বিষয়গুলি ঘটে চলেছে সেটা আমাদের কিছু নেতিবাচক কর্মকে একটা ছোট্ট আকারে পুড়িয়ে দিচ্ছে এবং এরফলে ভবিষ্যতে যাতে এই নেতিবাচক কর্ম পরিপক্ক হয়ে আমার জন্য ভয়াবহ বিপত্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। একটা সহজ উদাহরণ স্বরূপ, আপনি একটা যান-বাহনের ভিড়ে আটকে পড়েছেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে চলাফেরা করতে পারছেন না। সুতরাং, আপনি মনে করুন, “চমৎকার! এটা আমার কর্মফলকে পঙ্গু করার জন্য পুড়িয়ে দিচ্ছে, যার কারণে আমি সত্যিই নড়াচড়া করতে পারতাম না, উদাহরণ স্বরূপ, আমি পরজন্মে স্ট্রোকে ভুগতাম।” এইভাবে আমরা এই বিষয়টাকে নিয়ে সত্যিই আনন্দিত হই যে এই নেতিবাচক ঘটনাগুলি ঘটছে কারণ এটা ভবিষ্যতে আমাদের চলার পথ পরিষ্কার ক’রে দিচ্ছে।

পরম্পরাগত বৌদ্ধরা ক্ষতিকর প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করে। আমরা যদি তার অস্তিত্বকে স্বীকার করি তাহলে আমরা ঐ মনোভাবকে পরিবর্তন ক’রে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে পারি এবং ক্ষতিকর প্রেতাত্মাদের অনুরোধ করতে পারি, “আমার আরও ক্ষতি কর। আরও কর।” সম্প্রতিকালে আমার একটা খুব ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছিল। জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু ক’রে দুই মাস ধরে সবকিছু আমার প্রতিকূল ঘটে চলছিল; সবকিছু এলোমেলো হচ্ছিল। আমি সংক্রমিত হয়েছিলাম। এর কারণে আমার পিঠে বিচিত্র কিছু ফুলে উঠেছিল। ফলে আমি দু-মাস ধরে ফিটনেস ক্লাবে যেতে পারিনি, কারণ পরে অবশেষে আমাকে ঐ সংক্রমণটাকে পরিষ্কার করতে হয়েছিল। আমার পিঠে যেটা ফুলে উঠেছিল সেটাকে কেটে ফেলতে হয়েছিল। এরপর আমার কম্পিউটারে একটি ভয়ঙ্কর ভাইরাস ঢুকে গিয়েছিল। এটা আমার হার্ড ডিস্ককে নষ্ট করে দিয়েছিল। আমার কাছে একমাস ধরে নিয়মিতভাবে কোন কম্পিউটার ছিল না। এরপর আমার প্রিন্টারটাও ভেঙে গিয়েছিল; আর আমার কাছে যে দুটো ভিডিও প্লেয়ার ছিল সে দুটোও ভেঙে গিয়েছিল। আমি জ্যোতিষশাস্ত্রের একজন দারুন ভক্ত। কিছু অব্যক্ত কারণে আমি যে সমস্ত লোকজনদের রাশিফল সংগ্রহ করেছিলাম সে সবের ডাটাবেস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই তথ্যগুলিকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না। তারপর আমার প্রিয় কাপটিও ভেঙে গিয়েছিল, যে কাপে আমি সবসময় চা-জলপান করতাম। এর মাঝখানে আমি পরম পূজ্য দালাই লামার উপদেশ শ্রবণ করার জন্য ফ্রান্স গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানকার বিমান-সংস্থা আমার জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলেছিল।

এটাই ছিল শেষ ঘটনা। যখন আমার জিনিসপত্র হারিয়ে গিয়েছিল আমি তখন শুধু হেসে দিয়েছিলাম। সম্পূর্ণ বিষয়টা অত্যন্ত হাস্যকর ছিল। তারপর আমি ভাবতে শুরু করলাম, “আরও নিয়ে যাও, ও ক্ষতিকারক প্রেতাত্মাগুলি! আর কী ক্ষতি করা অবশিষ্ট রয়ে গেছে?” এই ভাবনাটি আমাকে অনেক ভালো অনুভব করিয়েছে। বিঘ্ন নিরস্ত্র করার জন্য আবেগপ্রবণ দেওয়াল স্থাপন করার পরিবর্তে আমি সেগুলিকে খোলাখুলিভাবে গ্রহণ করেছি, এমনকি স্বাগতও জানিয়েছি।

কয়েক বছর আগে, আমার চোয়ালের একটি হাড়ের দাঁতের নিচের অংশে সংক্রমণ হয়েছিল, যেটার আগে আমি রুট ক্যানেল করিয়েছিলাম এবং চোয়ালের হাড়ের একটি অংশ কেটে দাঁতের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল। ফ্রান্স যাত্রার কিছুক্ষণ পরে আমি সেই দন্ত্য চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে একটা আনন্দের খবর দিয়েছিলেন যে ক্ষতকোষে আবার সংক্রমণ হয়ে গিয়েছে। এর কারণে আমাকে দ্বিতীয়বার দন্ত্যের অস্ত্রোপ্রচার করতে হয়েছিল যাতে হাড়ের ঐ অংশটাকে আবার বেশি ক’রে কেটে ফেলা যায়। আমি এই খবরটাকে কিছু ইতিবাচক মনোভাবে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলাম, “দারুণ! এটি আমার ওয়েবসাইটে পরবর্তী ভাষা-বিভাগ গুলি স্থাপনের ক্ষেত্রে আগত বাধা দূর করছে।”

বৌদ্ধ শিক্ষা অনুযায়ী আপনি যতবেশি ইতিবাচক কিছু অর্জন করার চেষ্টা করবেন সেখানে ততবেশি বাধা-বিঘ্ন আপনাকে অর্জন করা থেকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করবে। সুতরাং, আমি এই সমস্ত ঘটনাগুলিকে একটি আশ্চর্যজনক পরিস্থিতি হিসাবে দেখেছিলাম যা আমার বাধা-বিঘ্নকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল। আর তাই আমি ক্ষতিকারক প্রেতাত্মাদের অনুরোধ করেছিলাম, “আরও বেশি বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করুন; সেগুলি আমার উপর চাপিয়ে দিন!” এটা করতে গিয়ে আমি একেবারেই দুঃখী হইনি, কারণ এটা করার সময় সবকিছু এলোমেলো এবং ভুল হচ্ছিল। সুতরাং, আপনি যদি বাস্তবে মন-প্রশিক্ষণের পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন তাহলে সেটা সত্যিই লাভদায়ক হয়। একটি পরিস্থিতিকে কঠিন, ভয়াবহ এবং হতাশাজনক হিসাবে দেখার পরিবর্তে, আপনি আপনার মনোভাব পরিবর্তন করুন এবং সেটাকে কিছু আশ্চর্যজনক হিসাবে দেখুন।

অন্যদের সুখ প্রদান ক’রে তাদের দুঃখ বরণ ক’রে নেওয়া

যে শেষ পদ্ধতিটি আমি উল্লেখ করতে চাই সম্ভবতঃ সেটা হল সবচেয়ে উন্নত এবং কঠিন পদ্ধতি। এটা হল তোঙ্‌-লেন (আদান-প্রদান) অনুশীলন বা সাধনা। আপনি যখন কোন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যেমন ধরুন, দাঁতের ব্যথা, তখন আপনি এই পদ্ধতিটিকে মনে করুন, “সকলের দাঁতের ব্যথা যেন দূর হয়ে যায় এবং সেটা যেন আমার উপর পরিপক্ক হয়! সকলের দাঁতের ব্যথা আমার উপর গ্রহণ করার ফলে, কেউ যেন কখনও পুনরায় দাঁতের ব্যথা ভোগ না করে!” সকলের জন্য আমাদের মন এবং হৃদয়কে উন্মুক্ত ক’রে এবং স্বেচ্ছায় তাদের দুঃখ-কষ্ট গ্রহণ ক’রে আমরা নিজেদের “আমি বেচারা” মনে করার নিবীড়তা, ভয় এবং দুঃখকে কাটিয়ে উঠি। তোন্‌-লেন সাধনার মাধ্যমে আমরা এর চেয়ে আরও উচ্চস্তরে গিয়ে ভাবি, “আমি তাদের সমস্ত ব্যথা এবং দুঃখ-কষ্ট দ্রবীভূত করব, আর তারপর আমার মনের মৌলিক সুখে প্রবেশ ক’রে আমি সেই সুখ তাদের সকলকে প্রদান করব।”

এখন, এখানে আপনাকে খুব সাবধান থাকতে হবে যে আপনি আবার শহীদ হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন না ক’রে ফেলেন, “আমি আপনার জন্য কষ্ট ভোগ করব,” যা এক অর্থে অহং-এর বিস্তার করে। আমাকে স্বীকার করতে হবে যে আমি এই পদ্ধতিতে একেবারেই নিপুণ নই। এটাকে আন্তরিক ভাবে করার জন্য অত্যধিক পরিমাণে সাহসের প্রয়োজন হয়, তবে সম্প্রতিকালে আমি এটাকে পরীক্ষা করে দেখেছি।

আমি যেমন বলেছি যে, আমাকে আমার চোয়ালের দ্বিতীয় অস্ত্রোপ্রচার করতে হয়েছিল। অস্ত্রোপ্রচারের পুরো সময় আপনাকে জেগে থাকতে হয়। এটা বেশ আনন্দদায়ক! তারা আপনার মুখের একপাশের পুরো মাড়ি চিরে খুলে ফেলে এবং নীচের দিকে মুড়িয়ে রাখে। তারপর তারা একটি বৈদ্যুতিক করাতের মতো কোন যন্ত্র ভিতরে ঢুকিয়ে মাড়ির এক টুকরো হাড়, দাঁতের গোড়ার সামান্য অগ্রভাগ এবং তার আশপাশের একটু মাংস কেটে ফেলে। তাদের কাজের পদ্ধতিটি সত্যিই মধ্যযুগীয় পদ্ধতির মতো। আমি যখন প্রথমবার এটা করেছিলাম তখন এটা মজাদার মনে হয়েছিল। আসলে এটা ততটা বেদনাদায়ক ছিল না, কারণ এনেস্থিসিয়া (অসাড়করণ ওষুধটা) খুব ভাল ছিল, যদিও মাঝখানে আমার আরও একটু বেশি নিতে হয়েছিল। কিন্তু যখন দ্বিতীয় বারের জন্য আমাকে এটা করতে হয়েছিল সংক্রমণ অনেক বেশী হয়েছিল। আর যখন এই ধরণের রোগের সংক্রমণ হয়, তখন নোবোকেন সেই জায়গায় বেশী কাজ করে না। সুতরাং এটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ছিল।

আমি সেই পদ্ধতিটি প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলাম যা মহামুদ্রায়ও ব্যবহৃত হয়- এটা একটা সংবেদন মাত্র, কোন বড় বিষয় নয়। আপনি আপনার হাড়ে সুড়সুড়ি দিন, চিমটি কাটুন, আঁচড় দিন অথবা কেটে দিন, এটা কেবল একটা শারীরিক সংবেদন হবে, এর চেয়ে বেশী কিছু নয়। সেইজন্য এটাকে বেশী গুরুত্ব দেবেন না। এটা একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত কাজে লেগেছিল, কিন্তু তখনই তোঙ্‌-লেন (আদান-প্রদান)-এর কথা মনে পড়ে গেল। এটা ছিল ঐ সময়ের কথা যখন তিব্বতে বিশেষ ক’রে তিব্বতবাসীদের উপর নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন চলছিল। আমি সেই অবিশ্বাস্য কষ্টের কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম যা সেখানকার লোকজনরা ভোগ করছিল, আর আমি ভাবছিলাম যে তারা যে কষ্ট ভোগ করছে তার তুলনায় আমি যা ভোগ করছিলাম সেটা কিছুই ছিল না- এটা ছিল গৌণ। এটা তো মাত্র দুই মিনিটের কথা এবং তারপর সবকিছু সমাপ্ত হয়ে যাবে।

অতএব, “আমি বেচারা কত দুঃখ ভোগ করছি”, এরকম চিন্তা-ভাবনা করার পরিবর্তে আমি তিব্বতের এই সমস্ত লোকজনদের সম্পর্কে ভাবার জন্য আমার মনোভাবকে প্রসারিত করেছিলাম এবং তিব্বতের লোকজনদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে লেগেছিলাম, “তারা যে পরিমাণে কষ্ট ভোগ করছে সেটা আমার এই সামান্য কষ্টের চেয়ে অনেক বেশী” আর সেইজন্য এখানে আমার দুঃখ থেকে একটা আলাদা দৃষ্টিকোণ তৈরী হয়েছে। তারপর আমি ভাবলাম, “তাদের সমস্ত দুঃখ এবং ব্যথা যেন আমার এই চোয়ালের ব্যথায় বিলীন হয়ে যায় আর আমি যেন শান্ত ও সুখী থাকি, আর আমি যেন আমার মনের শান্তি তাদের উৎসর্গ করতে সক্ষম হই।”

যদিও আমি অবশ্যই ১০০% সঠিকভাবে করিনি, তবে এটা ঐ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে খুব, খুব সহায়তা করেছে। আপনি যদি এটা সঠিকভাবে করেন, তাহলে এর অর্থ এই হবে যে আপনি সত্যিই তাদের পীড়া অনুভব করতে চান আর আপনার নিজের পীড়াকে আরও খারাপ করে তুলতে চান। সততার সাথে বলতে গেলে, এটাকে আন্তরিকভাবে করা সত্যিই একটা উন্নত স্তর। আপনি এটাকে শব্দে প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু বাস্তবে এর কোন অর্থ হয় না। বাস্তবে এরকম ঘটানোর কামনা করতে পারাটা একেবারে আলাদা বিষয়। তবে কমপক্ষে তাদের দুঃখের অনুভূতি এবং তাদের পীড়া নিজের পীড়া সমান মনে ক’রে সেটাকে নিজের স্তরে কম করা সম্ভব।

ভ্রমবশতঃ এটাকে আসলে বস্তু মনে করা উচিত নয়। আসল বস্তু অনেক বেশি মৌলবাদী হয়, কারণ আপনি এখানে যে মনের অবস্থা বিকাশ করেছেন, যেটাকে আপনি এখানে প্রয়োগ করছেন, সেটা পীড়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে আপনি সেটাকে এই আত্মবিশ্বাসের সাথে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করছেন যে আপনি এটার মোকাবিলা করতে পারবেন। আপনি যদি এটাকে সকলের দুঃখের বিস্তৃত স্তরে করতে পারেন, তাহলে অবশ্যই আপনার মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস আছে যে আপনি আপনার পীড়া গ্রহণ করতে এবং মোকাবিলা করতে পারবেন, এর সাথে লড়াই করবেন না এবং এতে ভয়ভীত হবেন না। সুতরাং, এটা কোন জাদুকরী পদ্ধতি নয়; আপনি যদি এটার বিশ্লেষণ করেন যে এটার সাথে কী ঘটছে, তাহলে একটা দুর্দান্ত অনুভূতি অর্জন হবে।

সারাংশ

এগুলি হল কয়েকটি পদ্ধতি যা স্ব-লালন ভাবনা ত্যাগ ক’রে প্রাথমিকভাবে অপরের জন্য উদ্বেগ থাকতে মন-প্রশিক্ষণ, লো-জোঙ্‌, সাধনায় ব্যবহৃত হয়। আমাদের প্রেরণার স্তর যাই হোক না কেন, মনোভাবের এই ধরণের পরিবর্তন খুবই সহায়ক। এই থেকে যে স্ব-রূপান্তর ঘটে সেটা হল এই চিন্তা-ভাবনা এবং আন্তরিকভাবে অনুভব করার ক্ষমতা, “কঠিন পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল এবং কঠিন হোক না কেন, আমি কখনোই নিজেকে “আমি বেচারা” ব’লে নিজের ক্ষতি হতে দেব না। আমি এর কারণে নিজেকে হতাশ হতে দেব না।” পরিবর্তে, আমি জীবনে সাধারণ মনোভাব গড়ে তুলব, যাতে, “যাই ঘটুক না কেন, আমি সেটাকে রূপান্তর করতে পারব। আমি এটাকে অপরের জন্য উদ্বেগ বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারব। এটা কোন বাধা সৃষ্টি করবে না।” এই ধরণের মনোভাব আপনাকে জীবনে অপার সাহস জোগায়।

Top