স্ব-পর সমতা এবং স্ব-পর পরিবর্তন

চেনশব সেরকোঙ্‌ রিনপোছে তাঁর মৃত্যুর দু-মাস আগে এই উপদেশটি ডঃ বরজিনের কাছে শুনিয়েছিলেন, তাকে এটা অক্ষরে অক্ষরে লিখতে বলেছিলেন এবং এটাকে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হিসাবে সংরক্ষণ করতে বলেছিলেন। এটি অসুখীতা ও সমস্যাগুলির সবচেয়ে বড় উৎস- আমাদের স্ব-লালন মনোভাব- একে কাটিয়ে ওঠার জন্য আর তার পরিবর্তে আন্তরিক ভাবে পর-লালন মনোভাব, যা হল সমস্ত সুখের উৎস, একে বিকাশ করার ধ্যানকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে।

সম্পূর্ণরূপে অন্যের প্রতি উৎসর্গীকৃত হৃদয় এবং যথাসম্ভব অপরের কল্যাণের উদ্দেশ্যে বোধিলাভের জন্য কীভাবে বোধিচিত্তকে বিকাশ করা যায় তারজন্য রয়েছে দুটি পরম্পরা- সপ্তাংশ কারণ ও ফলের পরম্পরা এবং স্ব-পর সমতা ও স্ব-পর পরিবর্তন মনোভাবের পরম্পরা। প্রাথমিক অংশ হিসাবে প্রত্যেকেরই আগে থেকে সমতা বিকাশে একটা আলাদা এবং স্বতন্ত্র পদ্ধতি আছে। যদিও প্রত্যেকের একই নাম আছে “সমতা” তবুও যে ধরণের সমতার বিকাশ করা হয় সেটা হল আলাদা।

  1. সপ্তাংশ কারণ এবং ফল সম্পর্কিত ধ্যানের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সত্ত্বকে আমাদের মা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে যে সমতাটি বিকশিত হয় তার মধ্যে বন্ধু-বান্ধব, শত্রু এবং অপরিচিত ব্যক্তির মনোনিবেশ অন্তর্ভুক্ত থাকে। আর এই সমতা যার মধ্যে আছে তার মধ্যে আসক্তি এবং বিদ্বেষের অনুভূতি জাগা বন্ধ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে, এর একটা নাম হল “সমতা-মাত্র যার কারণে আমরা বন্ধু-বান্ধব, শত্রু এবং অপরিচিত লোকজনদের প্রতি আসক্তি এবং ঘৃণা ত্যাগ করি।” এখানে “মাত্র” শব্দটি এই বোঝায় যে এর একটি দ্বিতীয় পদ্ধতিও আছে যার মধ্যে আরও কিছু অন্তর্ভুক্ত হয়ে রয়েছে।

    এই প্রথম ধরণের সমতার আর একটি নাম হল “সমতা-মাত্র অর্থাৎ শ্রাবক এবং প্রত্যেকবুদ্ধদের সাথে একযোগে সমতা বিকশিত হওয়ার উপায়।” শ্রাবক (শ্রোতাগণ) প্রত্যেকবুদ্ধ (স্ব-বিবর্তক) হলেন বুদ্ধের শিক্ষার হীনযানে অন্তর্ভুক্ত দুই-প্রকারের অনুশীলনকারী বা সাধক। এখানে “মাত্র” শব্দটির অর্থ হল যে এই ধরণের সমতা থাকলে আমরা না বোধিচিত্তের উৎসর্গীকৃত হৃদয় বিকাশ করতে পারি, না তার সাথে যুক্ত হতে পারি।
  1. আমাদের স্ব-পর সমতা এবং স্ব-পর পরিবর্তন মনোভাবের প্রাথমিক অংশ হিসাবে আমরা যে সমতার বিকাশ করি সেটা উপরে বর্ণিত সমতামাত্রকে বোঝায় না। এটা হল এমন এক ধরণের সমতা যেখানে সমস্ত সীমাবদ্ধ প্রাণীদের কল্যাণ করা এবং সহায়তা করা, আর তাদের সমস্যা দূর করার সাথে যুক্ত চিন্তা-ভাবনা বা ক্রিয়া-কলাপে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বা দূরত্বের অনুভূতি থাকে না। এটা হল বিশেষভাবে বিশিষ্ট, অসাধারণ মহাযান উপায়ে সমতা বিকাশের পদ্ধতি।

সমতামাত্র

আমরা যদি জিজ্ঞাসা করি যে, সপ্তাংশ কারণ এবং ফলের পদ্ধতির মাধ্যমে সকলকে নিজের মা-রূপে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে সমতা বিকাশের যে উপায়টি নির্ধারিত আছে সেটা কী, তাহলে এটা নিম্নলিখিত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিকাশ করা যাবেঃ

ত্রি-পুরুষের মনোনিবেশ

প্রথমতঃ আমরা ত্রি-পুরুষকে মনোনিবেশ করিঃ একজন সম্পূর্ণ ন্যাক্কারজনক এবং অপ্রীতিকর ব্যক্তি যাকে আমরা অপছন্দ করি অথবা যাকে আমরা আমাদের শত্রু হিসাবে বিবেচনা করি, একজন অত্যন্ত লালিত এবং প্রিয়জন অথবা বন্ধু, আর একজন অপরিচিত অথবা এমন একজন যার প্রতি আমাদের মধ্যে উভয় অনুভূতি থাকে না। আমরা এই ত্রি-পুরুষদের একসাথে মনোনিবেশ করি।

আমরা যখন এদের মধ্যে প্রত্যেকটির উপর এক এক করে মনোনিবেশ করি তখন সাধারণত কেমন ধরণের মনোভাব জাগে? আমরা যাকে অপছন্দ করি এমন পুরুষের প্রতি জাগে অপ্রিয়তা, অস্বচ্ছন্দতা এবং বিকর্ষণের অনুভূতি। অত্যন্ত লালিত বন্ধুর প্রতি জাগে আকর্ষণ এবং আসক্তির অনুভূতি। যে পুরুষ বা ব্যক্তি আমাদের শত্রু বা মিত্র কিছুই নয় তার প্রতি জাগে নিরপেক্ষতা, তার সহায়তা বা ক্ষতি করার অনুভূতি জাগে না, কারণ ঐ অপরিচিত ব্যক্তিকে আমরা আকর্ষণীয় বা বিকর্ষকরূপে পাই না।

আমাদের অপছন্দের ব্যক্তির প্রতি বিকর্ষণ ত্যাগ করা

আলোচনার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য, ধরুণ আমরা যে ত্রি-পুরুষকে মনোনিবেশ করি তারা হলেন স্ত্রী। প্রথমতঃ যে ব্যক্তি আমাদের অপছন্দের, যাকে আমরা আমাদের শত্রু মনে করতে পারি, তার উপর মনোনিবেশ করি।

১। আমরা তার প্রতি আমাদের অপ্রীতিকর এবং বিকর্ষণমূলক অনুভূতি জাগতে দিই। যখন এটা স্পষ্টভাবে জেগে যায়,

২। আমরা লক্ষ্য করি যে আরও একটি অনুভূতি জাগছে যথা- তার সাথে খারাপ কিছু ঘটলে অথবা এমন কিছু ঘটলে, যেটা সে আশা করেনি, তখন আমাদের ভালো লাগে।

৩। তখন আমরা এই খারাপ অনুভূতিগুলি এবং কামনা জাগার কারণের উপর পরীক্ষা করি। সাধারণত আমরা বুঝতে পারি যে এর কারণ হল ঐ মহিলা আমাদের অথবা আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের আঘাত করেছিলেন, কোন ক্ষতি করেছিলেন অথবা এমন কিছু করেছিলেন বা ন্যাক্কারজনক কথা বলেছিলেন। সেই কারণেই আমরা চাই তারসাথে খারাপ কিছু ঘটুক অথবা সেটা প্রাপ্ত করুক যা তিনি চান না।

৪। এবার আমরা যে মহিলাকে অপছন্দ করি তারসাথে খারাপ কিছু ঘটার যে কামনা করি তার কারণ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি এবং খতিয়ে দেখি যে এটা সত্যিই কোন ভাল কারণ কি না। আমরা তার বিষয়ে নিম্নবৎ বিবেচনা করি।

  • এই তথাকথিত শত্রু পুর্বজন্মে অনেকবার আমাদের মাতা এবং পিতা ছিলেন, পাশাপাশি ছিলেন আমার আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুও। তিনি অসংখ্যবার আমাকে অনেক সহায়তা করেছেন।
  • এই জন্মে, কী ঘটবে সেটা নিশ্চিত নয়। এই জন্মে পরবর্তীকালে তিনি অত্যন্ত সহায়ক এবং একজন ভাল বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন। এরকম হওয়াও খুবই সম্ভব।
  • যাইহোক না কেন ভবিষ্যতে তার এবং আমার অসংখ্যবার জন্ম হবে এবং এটাও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত তিনি একসময় আমার মাতা বা পিতা হবেন। এই হিসাবে তিনি আমার প্রচুর সাহায্য করবেন এবং আমাকে আমার সমস্ত আশা তার উপর ছেড়ে দিতে হবে। যেহেতু অতীতে, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে তিনি একভাবে সহায়তা করেছিলেন, করছেন এবং করবেনও, অতএব তিনি অন্তত একজন ভাল বন্ধু। এটি নিশ্চিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই কারণে যদি তিনি এই জীবনে অল্প ক্ষতি করে থাকেন, তার কারণে আমি যদি তাকে শত্রু হিসাবে বিবেচনা করি আর তার অসুস্থতার কামনা করি তাহলে সেটা কোন মতেই উচিত হবে না।

৫। আমরা কয়েকটা উদাহরণ মনে করি। যেমন ধরুন, একজন ব্যাঙ্ক আধিকারিক অথবা একজন ধনী ব্যক্তি যার কাছে আমাকে অনেক টাকা দেওয়ার ক্ষমতা আছে এবং যার মধ্যে এই ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য ছিল আর অতীতে তিনি এরকম কম-বেশি কিছু করেও ছিলেন। ঐ ব্যক্তি একদিন তার মেজাজ হারিয়ে রাগ ক’রে আমাকে একটা থাপ্পড় মেরেছিলেন। সেই কারণে আমি যদি রাগ করে থাকি আর তার প্রতি রাগ পুষে রাখি, তাহলে হতে পারে তিনি আমাকে টাকা দেওয়ার উদ্দেশ্যটা পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন। এমনকি এরকম বিপদও হতে পারে যে তিনি তার মত পালটে টাকাটা অন্য কাউকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। পরিবর্তে, আমি যদি তার থাপ্পড়টি সহ্য করি, আমার নজর নিচের দিকে রাখি আর মুখ বন্ধ করে রাখি, তাহলে তিনি পরে আমার প্রতি আরও বেশি প্রসন্ন হবেন, এই উপলব্ধি ক’রে যে আমি দুঃখিত হইনি। এমনও হতে পারে তিনি আগে আমাকে যত টাকা দেওয়ার জন্য মনস্থির করেছিলেন তার চেয়ে বেশী দিতে চাইবেন। তবে আমি যদি ক্রুদ্ধ হয়ে একটা খারাপ দৃশ্য সৃষ্টি করি তাহলে এটা তিব্বতীদের প্রবাদ-প্রবচনের মতো হবে, “আপনি আপনার মুখে খাবার রেখেছেন এবং আপনার জিভ এটাকে বাইরে ঠেলে দিচ্ছে।”

৬। অতএব, আমি যে ব্যক্তিকে অপছন্দ করি সেই ব্যক্তির বিষয়ে আমার দীর্ঘ সময়ের সম্পর্কের বিষয়ে বিচার করতে হবে এবং একই জিনিস সমস্ত সীমাবদ্ধ প্রাণীদের ক্ষেত্রে সঠিক মনে করতে হবে। এটা একশ শতাংশ নিশ্চিত যে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাদের সহায়তা আমার প্রয়োজন হবে। সুতরাং, কেউ যদি আমার ছোটোখাটো বা তুচ্ছ ক্ষতি করে থাকে তার প্রতি আমার রাগ পুষে রাখাটা একেবারে অনুচিত হবে।

৭। এরপরে আমরা বিচার করি যে কীভাবে একটা বিছা, বন্য পশু অথবা ভূত সামান্য হাঁফ বা উস্কানিতে তারা তখনই পালটা আক্রমণ করে। তখন আমরা নিজেদের বিষয়ে বিচার করে দেখি এই ধরণের প্রাণীদের মতো আচরণ করা কতটা অনুচিত। এইভাবে আমরা আমাদের ক্রোধকে শান্ত করি। আমাদের ভাবতে হবে যে এই ব্যক্তিটি যতই আমার ক্ষতি করুক না কেন আমি আমার মেজাজ হারাবো না আর রাগ করব না, নাহলে একটা বন্য পশু অথবা একটা বিছা আর আমার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না।

৮। উপসংহারে, আমরা এই সম্পূর্ণ আলোচনাটি একটা যুক্তির আকারে প্রস্তুত করতে পারি। আমি অন্যের প্রতি এই কারণে রাগ করা বন্ধ করব যে তারা আমার কোন ক্ষতি করেছে, কারণঃ

  • পূর্বজন্মে তারা আমার মাতা-পিতা হয়েছেন।
  • এই জন্মের পরবর্তীকালে তারা যে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
  • ভবিষ্যতে তারা একসময় বা অন্যসময়ে আমার মাতা-পিতারূপে জন্ম নেবেন এবং আমার প্রচুর পরিমাণে সহযোগিতা করবেন, তাই ত্রি-কালে তারা আমার জন্য সহায়ক হয়ে উঠেছেন।
  • আমি যদি পালটা রাগ করি তাহলে একটা বন্য পশুর চেয়ে ভালো কিছু হব না। অতএব তারা এই জন্মে যদি আমার ছোটোখাটো ক্ষতি করেন তারজন্য আমি রাগ করা বন্ধ করব।

আমাদের পছন্দের কারও প্রতি আসক্তি ত্যাগ করা

  1. আমাদের শত্রু, বন্ধু এবং অপরিচিত ব্যক্তির গোষ্ঠীতে আমরা আমাদের বন্ধু বা প্রিয়জনের প্রতি মনোনিবেশ করি যাদের সম্পর্কে আমরা শুরুতে কল্পনা করেছিলাম।
  2. আমরা তার (মহিলা) প্রতি আকর্ষণ এবং আসক্তি জাগতে দিই।
  3. সেই ব্যক্তির সাথে থাকার জন্য আমরা আমাদের অনুভূতিকে আরও প্রবল হতে দিই এবং তারপর
  4. এই ধরণের মোহ এবং আসক্তি থাকার কারণগুলি পরীক্ষা করি। এরকারণ হল তিনি আমাকে এই জীবনে অল্প কিছু সহযোগিতা করেছিলেন, আমার জন্য ভালো কিছু করেছিলেন, এমন কিছু করেছিলেন যেটা আমার ভালো লেগেছিল অথবা এই ধরণের কিছু, আর তাই আমি তার প্রতি আকৃষ্ট এবং আসক্ত হয়েছি।
  5. এখন আমরা পরীক্ষা করে দেখি এই ধরণের অনুভূতি জাগানোটা সঠিক কিনা। এটাও একটা ভালো কারণ নয়, কারণঃ
  • নিঃসন্দেহে পূর্বজন্মে তিনি আমার শত্রু ছিলেন, আমাকে আঘাত করেছিলেন এবং এমনকি আমার মাংস ভক্ষণ করেছিলেন ও রক্ত পান করেছিলেন।
  • এই জন্মের পরবর্তীকালে তিনি যে আমার সবচেয়ে খারাপ শত্রু হয়ে উঠবেন না তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
  • এটা একেবারে নিশ্চিত যে অনাগত জীবনে তিনি আমাকে আঘাত করবেন অথবা কোন না কোন এক সময় সত্যিই ন্যাক্কারজনক কিছু করবেন।
  1. যদি এই জন্মে তার দ্বারা আমার জন্য কৃত কিছু ভাল, তবে তুচ্ছ কিছু করার কারণে আমি যদি তার প্রতি মোহিত এবং আসক্ত হয়ে উঠি তাহলে আমি সেই ধরণের মানুষের চেয়ে ভালো কিছু হব না যারা নরখাদক মহিলাদের গানে মোহিত হয়ে যায়। এই মোহিনী মহিলাগুলি সুন্দররূপ ধারণ ক’রে বিভিন্ন ছলে পুরুষদের প্রলুব্ধ করে এবং পরে তাদের গিলে খেয়ে নেয়।
  2. এইভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে তিনি যদি এইজন্মে আমাদের জন্য ছোটোখাটো ভালো কিছু করেও থাকেন তাহলেও আমরা কখনও তার প্রতি আসক্ত হব না।

কোন তটস্থ ব্যক্তির প্রতি নিরপেক্ষতা ত্যাগ করা

তৃতীয়তঃ আমরা সেই ব্যক্তির সাথে একই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করি, যিনি এর মাঝখানে থাকেন অর্থাৎ একজন অপরিচিত ব্যক্তি যিনি হলেন না আমাদের বন্ধু, না শত্রু।

  1. আমরা আমাদের কল্পনা থেকে এই ধরণের একজন ব্যক্তির উপর মনোনিবেশ করি।
  2. আমরা তার সম্পর্কে নির্বিচার ভাবনা জাগতে দিই অর্থাৎ না তার ক্ষতি করার ইচ্ছা নাই বা সহায়তা করা, না তার থেকে মুক্ত হওয়া, না তার সান্নিধ্যে থাকা।
  3. এবং পরে তাকে উপেক্ষা করার উদ্দেশ্যটি ভাবি।
  4. আমরা এইভাবে অনুভব করার কারণটি পরীক্ষা করি। এর কারণ হল তিনি আমার সহায়তা বা আঘাত করার জন্য এমন কিছুই করেননি এবং তাই তার সাথে আমার কোন সম্পর্কও নেই।
  5. আমরা যখন আরও পরীক্ষা করে দেখি যে এরকম অনুভব করাটা সঠিক কারণ কিনা তখন আমরা বুঝতে পারি তিনি অন্তত একজন অপরিচিত নন, কারণ অসংখ্য পুর্বজন্মে, এই জীবনের পরবর্তীকালে এবং অনাগত জন্মে তিনি আমার ঘনিষ্ঠ হবেন, তিনি হবেন একজন বন্ধু ইত্যাদি।

এইভাবে আমরা শত্রু, বন্ধু-বান্ধব এবং অপরিচিতদের প্রতি ক্রোধ, আসক্তি অথবা নিরপেক্ষতার সমস্ত অনুভূতি ত্যাগ করতে সক্ষম হয়ে উঠি। এটাই হল শ্রাবক এবং প্রত্যেকবুদ্ধগণদের সাথে সাদৃশ্যময় সমতামাত্র বিকাশের উপায়। বোধিচিত্তের প্রয়োজনীয় একটা উৎসর্গীকৃত হৃদয়ের বিকাশের জন্য নির্ধারিত সপ্তাংশ কারণ এবং ফলের বিধিতে বর্ণিত সমস্ত প্রাণীকে নিজের মায়ের মতো উপলব্ধি করার প্রারম্ভিক অংশ হিসাবে এটাকে বিকশিত করা হয়।

স্ব-পর সমতা এবং আমাদের মনোভাবের পরিবর্তনের প্রাথমিক অংশ হিসাবে অসাধারণ মহাযান সমতা

আমাদের মনোভাবকে স্ব এবং পরের সাথে সমান করা এবং পরিবর্তন করার প্রাথমিক অংশ হিসাবে অসাধারণ মহাযান সমতার বিকাশের পদ্ধতিকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়ঃ

  • আপেক্ষিক দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভরশীল সমতাকে বাস্তবায়িত করার উপায়।
  • গভীরতম দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভরশীল সমতাকে বাস্তবায়িত করার উপায়।

আপেক্ষিক দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভরশীল উপায়কে নিম্নবৎ রূপে ভাগ করা হয়ঃ

  • আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভরশীল সমতাকে বাস্তবায়িত করার উপায়।
  • অপরের দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভরশীল সমতাকে বাস্তবায়িত করার উপায়।

আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভরশীল সমতাকে বাস্তবায়িত করার উপায়

এরমধ্যে তিনটি বিষয় জড়িত থাকেঃ

  1. যেহেতু সমস্ত সীমিত ক্ষমতাযুক্ত প্রাণী অসংখ্য জন্মে আমাদের মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব ছিলেন, অতএব তাদের বিষয়ে এইরকম অনুভব করা অনুচিত হবে যে কেউ আমাদের ঘনিষ্ঠ এবং কেউ দূরের অর্থাৎ ইনি হলেন একজন বন্ধু এবং তিনি হলেন একজন শত্রু, কয়েকজনকে স্বাগত জানাতে হবে আর অন্যদের করতে হবে প্রত্যাখ্যান। আমাদের ভাবতে হবে, সর্বোপরি, আমি যদি দশ মিনিট, দশ বছর অথবা দশ জন্ম পর্যন্ত আমার মা-কে না দেখে থাকি তাহলেও তিনি কিন্তু এখনও আমার মা।
  2. তবে এটা সম্ভব যে এই প্রাণীগুলি যেমন আমার সহযোগিতা করেছেন তেমনই কখনো কখনো আমার ক্ষতিও করেছে। তারা যে কয়েকবার আমাকে সহযোগিতা করেছে এবং যে পরিমাণে করেছে তার তুলনায় তারা যে ক্ষতি করেছে সেটা হল তুচ্ছ। সুতরাং একজনকে ঘনিষ্ঠ ভেবে তাকে স্বাগত জানানো এবং অন্যজনকে দূরের মনে করে তাকে প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়।
  3. আমরা অবশ্যই মারা যাব কিন্তু আমাদের মৃত্যুর সময়টি পুরোপুরি অনিশ্চিত। উদাহরণ স্বরূপ, মনে করুন আমাদের মৃত্যুদন্ডের সময় আগামীকাল নির্ধারণ করা হয়েছে। সেইজন্য কারও প্রতি রেগে এবং তাকে আঘাত ক’রে আমাদের শেষ দিনটি কাটানোটা যুক্তিসঙ্গত হবে না। কোন তুচ্ছ কাজকে পছন্দ করে সময় কাটিয়ে আমরা আমাদের শেষ দিনে কিছু ইতিবাচক এবং অর্থবহ কিছু করার সুযোগ হারিয়ে ফেলব। উদাহরণ স্বরূপ, একসময় একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক ছিলেন। তিনি কারও প্রতি ক্রোধিত হয়েছিলেন এবং পরের দিন তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি সারাদিন এই বিষয়ে পরিকল্পনা করে কাটিয়েছিলেন। পরের দিন সকালে কিছু করার আগেই হঠাৎ তিনি মারা যান। ফলে তার ক্রোধটি পুরোপুরি অযৌক্তিক হয়ে উঠেছিল। একইভাবে যদি অন্য ব্যক্তিকেও পরের দিন মারা যাওয়ার জন্য নিন্দা করা হয় তাহলে সেখানেও একই কথা সত্য হবে। অতএব, তাকে আজ আঘাত করার বিষয়টা অর্থহীন হয়ে যাবে।

অপরের দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভরশীল সমতাকে বাস্তবায়িত করার উপায়


এটাকেও তিনটি বিষয়ে বিভক্ত করা হয়

  1. আমাদের বিচার করতে হবেঃ আমি যেমন নিজের জন্য কখনও এমনকি স্বপ্নেও দুঃখ-কষ্ট চাই না এবং আমি যতই সুখ অর্জন করি না কেন আমি সেটাকে যথেষ্ট বলে মনে করি না। ব্যাপারটা অন্য সকলের ক্ষেত্রেও সমান। একটা ছোট্ট ছারপোকা থেকে শুরু করে সমস্ত সীমাবদ্ধ প্রাণী সুখী হতে চায় এবং কখনও দুঃখী হতে চায় না অথবা কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে চায় না। সুতরাং কাউকে প্রত্যাখ্যান করা এবং অন্যকে স্বাগত জানানো উচিত নয়।
  2. মনে করুন, দশজন ভিখারী আমার দরজার সামনে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে কয়েকজনকে খাবার দেওয়া এবং বাকীদের না দেওয়াটা একেবারে ঠিক নয়। ক্ষুধার ক্ষেত্রে এবং খাদ্যের প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তারা সকলেই সমান। ঠিক তেমনই বিভ্রান্তিতে অমলিন সুখ কয়জনইবা অর্জন করে? তবে বিভ্রান্তিতে মলিন সুখের ক্ষেত্রেও সমস্ত প্রাণীর পর্যাপ্ত অভাব থাকে। এটা এমন একটা জিনিস যেটা অর্জন করার জন্য সকলে আগ্রহী থাকে। অতএব, কাউকে দূরের মনে করে তাকে প্রত্যাখ্যান করা এবং অন্যদের ঘনিষ্ঠ মনে করে তাদের স্বাগত জানানোটা অনুচিত।
  3. আরও একটা উদাহরণ হিসাবে, মনে করুন, দশজন অসুস্থ লোক ছিলেন। তারা সকলেই দুঃখজনক এবং করুণ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে সমান ছিলেন। এইরকম পরিস্থিতিতে কারও পক্ষ নিয়ে শুধু তাদের চিকিৎসা করা এবং অন্যদের ভুলে যাওয়াটা অন্যায়। তেমনই সমস্ত সীমাবদ্ধ প্রাণীরা তাদের নির্দিষ্ট এবং নিজস্ব অসুবিধার কারণে সমানভাবে জর্জরিত এবং অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত অস্তিত্ব বা সংসারের সাধারণ সমস্যার কারণে সমানভাবে পীড়িত। এই কারণেই কাউকে দূরের মনে করে প্রত্যাখ্যান করা আর অন্যদের ঘনিষ্ঠ মনে করে স্বাগত জানানোটা অন্যায় এবং অনুচিত।

গভীরতম দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভরশীল সমতাকে বাস্তবায়িত করার উপায়

এরমধ্যেও ভাবনার তিনটি দফা যুক্তঃ

  1. বিভ্রান্তির কারণে আমরা কীভাবে এমন একজনকে প্রকৃত বন্ধু হিসাবে আখ্যা দিই যে আমাদের সাহায্য করে অথবা আমাদের সাথে ভাল ব্যবহার করে আর যে আমাদের কষ্ট দেয় তাকে একজন প্রকৃত শত্রু হিসাবে আখ্যা দিই। যাইহোক, যেভাবে আমরা তাকে আখ্যা দিয়ে থাকি সে যদি সত্যতঃ অস্তিমান হতো তাহলে তথাগত বুদ্ধও তাকে সেইরূপে             দেখে থাকতেন কিন্তু তিনি কখনোই তাকে সেইরূপে দেখতে পাননি। দিগ্নাগ রচিত প্রমাণসমুচ্চয়ের টীকা “প্রমাণবার্তিকে” ধর্মকীর্তি উল্লেখ করেছেন, “বুদ্ধের দৃষ্টিতে তারা দুজনেই সমান যে তাঁর শরীরকে সুগন্ধিত জল দিয়ে লেপন করে এবং অন্য একজন যে সেটাকে তরোয়াল দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটে।”

    পক্ষপাতশূন্যতার আরও একটা উদাহরণ আমরা এই ঘটনায় দেখতে পাই যে বুদ্ধ তাঁর কাকাতো ভাই দেবদত্ত, যে তাঁর সাথে ঈর্ষাবশে সবসময় তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিল, তার সাথে কেমন আচরণ করেছিলেন। সুতরাং আমাদেরও পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া ত্যাগ করতে হবে এবং বিভ্রান্তিমূলকভাবে আমরা যেভাবে আখ্যা দিয়ে থাকি সেটা সত্যিকার অর্থে অস্তিমান হওয়ার চিন্তা-ভাবনার সাথে তাদের পক্ষ নেওয়ার ভাবনা ত্যাগ করতে হবে। বাস্তবে কেউ কিন্তু সেরকমভাবে অস্তিত্বে নেই। সত্যতঃ প্রতিষ্ঠিত অস্তিত্বের প্রতি আমাদের ধারণাকে ত্যাগ করার জন্য প্রচেষ্টারত হওয়া উচিত। এই ধারণাটি উদ্ভূত হয় আমাদের বিভ্রান্ত মন থেকে, যা বস্তুকে আমাদের সামনে আবির্ভূত করে, যেটা বাস্তবে অস্তিমান নয়।
  1. তদতিরিক্ত, যদি সীমাবদ্ধ প্রাণীরা সত্যিকার অর্থে বন্ধু এবং শত্রু রূপে অস্তিমান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে তারা সবসময় সেই ভাবেই উপস্থিত থাকত যেভাবে আমরা তাদের গ্রহণ করি। উদাহরণ স্বরূপ, একটা ঘড়ির সম্পর্কে বিবেচনা করুন যার বিষয়ে আমরা ভাবি যে এটা সর্বদা সঠিক সময় প্রদর্শন করে। যেমন এটা সম্ভব যে কখনও ঐ ঘড়িটির পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে পারে এবং কখনও ধীরে চলতে পারে ঠিক তেমনই অন্যের হাল সবসময় স্থির থাকে না বরং পরিবর্তনও হতে পারে।

    আমরা যদি এই বিষয়টির শিক্ষা বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করি যে এই সংসারের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পরিস্থিতির কোন নিশ্চয়তা নেই তাহলে আমাদের জন্য এটা এখানে সহায়ক হতে পারে, যেমন একটা পুত্র তার বাবাকে ভক্ষণ করছে, মাকে আঘাত করছে এবং শত্রুকে দোলাচ্ছে। এই উদাহরণটি দেখতে পাওয়া যায় “মার্গ-ক্রম” নামক গ্রন্থে মধ্যবর্তী স্তরে প্রেরণা বিকাশ সম্পর্কিত নির্দেশাবলীতে। একবার উচ্চ সিদ্ধি প্রাপক আর্য কাত্যায়ন একটা বাড়িতে এসেছিলেন। সেই বাড়ির পুকুরে তার বাবা মাছরূপে জন্ম নিয়েছিলেন এবং তার পুত্র তাঁকে খাচ্ছিল। ঐ সময় পুত্রটি একটা কুকুরকে আঘাত করছিল যে কুকুরটি পূর্বে তার মা ছিলেন। আর তার সন্তানকে কোলে নিয়ে যে দোল দিচ্ছিল সে ছিল তার শত্রু। সংসারে বিচরণ করা প্রাণীদের এই ধরণের পরিবর্তনের অযৌক্তিকতা দেখে কাত্যায়ন হেসে দিয়েছিলেন। সুতরাং আমাদের মধ্যে মানুষের অস্তিত্বকে বন্ধু এবং শত্রুদের শ্রেণীতে নিশ্চিত এবং শাশ্বতরূপে বিভাজন করে দেখার যে ধারণা রয়েছে তার প্রতি আসক্ত হয়ে এবং তার ভিত্তিতে কাউকে স্বাগত জানানো এবং অন্যদের প্রত্যাখ্যান করা বন্ধ করা উচিত।
  1. শিক্ষাসমুচ্চয়ে শান্তিদেব ব্যাখ্যা করেছেন যে কীভাবে স্ব এবং অন্যরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। দূরে এবং কাছে অবস্থিত পাহাড়-পর্বতের উদাহরণের মতো তারা পরস্পর নির্ভরশীল অথবা তাদের একে-অপরের মাঝখানের দূরত্ব আপেক্ষিক হয়ে থাকে। আমরা যখন কোন একটা পাহাড়ের কাছে থাকি তখন অন্য পাহাড়টি আমাদের অনেক দূরে অবস্থিত মনে হয় এবং এই পাহাড়টি কাছে। আমরা যখন অন্যদিকে চলে যাই তখন এই পাহাড়টি দূরে হয়ে যায় এবং ঐ পাহাড়টি হয়ে যায় কাছে। তেমনি ভাবে আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব “আমার” অস্তিত্বের উপর আধারিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় না, কারণ আমরা যখন অন্য কারও দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদেরকে দেখি তখন আমরা “অন্য” হয়ে যাই। একইভাবে বন্ধু এবং শত্রু-এর অস্তিত্ব নির্ভর করে ব্যক্তির আলাদা দৃষ্টিকোণের উপর অথবা তার সম্পর্কে বিচার করার বিভিন্ন পদ্ধতির উপর। যেমন একজন ব্যক্তি একজনের বন্ধু, আবার অন্যজনের শত্রু হতে পারে। যেমনকি কাছে এবং দূরে অবস্থিত পাহাড়ের অস্তিত্ব, এসব কিছুই আমাদের আপেক্ষিক দৃষ্টিকোণের উপর আধারিত।

পাঁচটি সিদ্ধান্ত

উপরে বর্ণিত বিষয়গুলির সম্পর্কে এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা করার পর আমাদের পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

আমি পক্ষপাতি হওয়া ত্যাগ করব

আমরা আপেক্ষিক দৃষ্টিকোণ থেকে হোক বা গভীরতম দৃষ্টিকোণ থেকে, যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি না কেন কিছু মানুষ বা প্রাণীকে ঘনিষ্ঠ অথবা অন্যদের দূরের ভেবে বিবেচনা করার কোন কারণ নেই। অতএব আমাদের দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবেঃ আমি পক্ষপাতি হওয়া ত্যাগ করব। আমি নিজেকে পক্ষপাতিত্বের অনুভূতি থেকে মুক্ত করব যার কারণে আমি কাউকে প্রত্যাখ্যান করি এবং অন্যদের স্বাগত জানাই। এর কারণ হল শত্রুতা এবং আসক্তি উভয়ই আমার ক্ষতি করে এই জন্মে এবং অনাগত জন্মে, সাময়িকভাবে এবং চূড়ান্তভাবে, অল্পকালীন এবং দীর্ঘকালীন সময় পর্যন্ত, এতে কোন লাভ নেই। এরা হল শত প্রকারের দুঃখ-কষ্টের জড়। এরা রক্ষীদের মতো আমাকে আমার অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত সমস্যার সংসার-কারাগারে পরিবেষ্টিত করে রাখে।

ঐ লোকজনদের বিষয়ে ভাবুন যারা ১৯৫৯ সালে অভ্যুত্থানের পর তিব্বতে থেকে গিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে তাদের মঠ, সম্পদ, সম্পত্তি, ঘর-বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদির প্রতি আসক্তি ছিল তারা তাদের পরিত্যাগ করে রেখে আসতে পারেনি। পরিণামস্বরূপ, আসক্তির কারণে ২০ বছর অথবা তার থেকেও বেশি বছর ধরে তাদের কারাগারে বা রাজনৈতিক বন্দী শিবিরে বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল। এই ধরণের পক্ষপাতিত্বের অনুভূতি হল কষাইদের মতো যারা আমাদের দুঃখের নরকের আগুনের দিকে নিয়ে যায়। তারা হল আমাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা এমন রাক্ষস যারা আমাদের রাত্রে ঘুমাতে বাধা দেয়। আমাদের যে ভাবেই হোক তাদেরকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে।

অন্যদিকে সকলের প্রতি সমান মনোভাবটি, যার মাধ্যমে আমরা কামনা করি যে সমস্ত সীমাবদ্ধ প্রাণী সুখী হোক এবং তাদের সমস্যা ও দুঃখ থেকে মুক্ত হোক, সাময়িকভাবে এবং চূড়ান্তভাবে উভয় দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। এটাই হল প্রধান মার্গ যে মার্গে সমস্ত বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বগণ তাদের অভীষ্টসিদ্ধিতে পৌঁছনোর জন্য ভ্রমণ করেছেন। এটাই সমস্ত ত্রিকালগত বুদ্ধগণের উদ্দেশ্য এবং অন্তরের ইচ্ছা। অতএব আমাদের ভাবতে হবে যেকোন সীমাবদ্ধ প্রাণী তার পক্ষ থেকে আমার ক্ষতি বা সহায়তা করুক না কেন, আমার পক্ষ থেকে তারজন্য কোন বিকল্প নেই। আমি ক্রোধিত হব না অথবা আসক্তও হব না। আমি কাউকে দূরের এবং অন্যকে ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচনা করব না। এটা ছাড়া পরিস্থিতিকে সামলানোর কোন উপায় বা পদ্ধতি থাকতে পারে না। আমি নিশ্চিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। যেহেতু প্রত্যেক প্রাণী সুখী হতে চায়, কখনও দুঃখী হতে চায় না তাই অন্যের বিষয়ে বিচার করার সময় এবং আচরণ করার সময় আমি তাদের প্রতি সমান মনোভাব রাখব। আমি যতটা সম্ভব এটাই করার প্রচেষ্টা করব। হে আধ্যাত্মিক গুরু, দয়া করে আমাকে এটা যথাসাধ্য করার জন্য উদ্বুদ্ধ করুন। এই অনুশীলনের সাথে যুক্ত গুরু-পূজা (লামা-ছোয়পা)-এর জন্য নির্ধারিত পাঁচটি কারিকার মধ্যে যখন আমরা প্রথমটি পাঠ করি তখন আমাদের এইভাবে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।

অন্যদের এবং আমাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, এই ভেবে অন্যের সুখ এবং আনন্দ বৃদ্ধির জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করুন। কেউই লেশমাত্র দুঃখ চায় না, নাই বা সেই সুখে সন্তুষ্ট হয় সেটা সে অর্জন করে।

এইভাবে আমরা প্রথম কারিকার মাধ্যমে সমান মনোভাব বিকাশের জন্য প্রার্থনা করি যাতে সকলের জন্য সুখ বর্ধন করা এবং দুঃখ-কষ্টকে দূর করার ক্ষেত্রে আমাদের ভাবনা এবং আচরণে কোন রকমের দূরত্ব অথবা ঘনিষ্ঠতার অনুভূতি না থাকে। এই ধরণের সমতার মনোভাব সমতা অথবা সমান দৃষ্টিকোণের সংজ্ঞাকে পরিভাষিত করে সেটাকে আমরা এখানে বিকশিত করতে চাই। সেই মনোভাবটি বিকাশ করা এবং অর্জনের জন্য আমরা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিই, যেমনকি আমরা যখন কোন দোকানে একটা আশ্চর্যজনক জিনিস দেখতে পাই এবং সেটাকে ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিই।

আমি নিজেকে স্ব-লালন ভাবনা থেকে মুক্ত করব

এরপরে, আমরা স্ব-লালিত মনোভাবের দোষ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি। স্বার্থপরতার উপর কেন্দ্রিভূত স্ব-লালিত মনোভাবের কারণে আমরা ধ্বংসাত্মক ভাবে কর্ম করি অর্থাৎ দশটি ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া করি। ফলস্বরূপ, আমাদের নারকীয় পুনর্জন্মের অংশীদার হতে হয়। সেই অবস্থা থেকে অর্হত্‌ (মুক্ত সত্ত্বা)-এর অবস্থা লাভ না করা পর্যন্ত এই স্বার্থপরায়ণ ভাবনা সমস্ত সুখ এবং শান্তিকে নষ্ট করে দেয়। যদিও বোধিসত্ত্বগণ বোধিলাভের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তবে তাদের মধ্যে কিছু অন্যের চেয়ে আরও কাছে পৌঁছে যায়। তাদের মধ্যে এখনও বিদ্যমান স্ব-লালিত মনোভাবের পরিমাণের কারণে ঐ দূরত্বটা তৈরী হয়। দেশের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক থেকে শুরু করে আধ্যাত্মিক গুরু এবং শিষ্যদের মধ্যে মতবিরোধ পরিবার অথবা বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে মতভেদ সবকিছুই এই স্ব-লালিত মনোভাবের কারণে সৃষ্টি হয়। অতএব, আমাদের ভাবতে হবে যে আমরা যদি আমাদের ভিতরে বিদ্যমান স্বার্থপরতা এবং স্ব-লালনের পচা জঞ্জাল থেকে মুক্ত না হই, তাহলে আমার পক্ষে সুখ ভোগ করার কোন উপায় থাকবে না। অতএব, আমি নিজেকে কখনই স্ব-লালিত মনোভাবের নিয়ন্ত্রণে আসতে দেব না। উনি আধ্যাত্মিক গুরু, আমাকে সমস্ত স্বার্থ-পরায়ণ ভাবনা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করুন। এই ভাবনাগুলি দ্বিতীয় কারিকার সঙ্গে যুক্ত থাকে।

আমাদের উদ্বুদ্ধ করুন যাতে আমরা দেখতে পাই যে এই স্ব-লালনের দীর্ঘস্থায়ী রোগটাই হল আমাদের অপ্রার্থিত দুঃখের কারণ এবং সেইজন্য স্বার্থপরতার বিকট রাক্ষসকে ধ্বংস করার জন্য এটাকে দোষারোপ করতে পারি।

অতএব, দ্বিতীয় কারিকার মাধ্যমে স্বার্থপরতার স্ব-লালন মনোভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য আমরা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিই।

আমি পর-লালনকে আমার প্রধান অনুশীলন বানাব

এরপর, পর-লালন অনুশীলন করার ফলে যে লাভ এবং ভালো গুণ সঞ্চয় হয় আমরা তার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করব। এই জন্মে সমস্ত সুখ এবং সব কিছু ঠিকঠাক চলা; অনাগত জীবনে মানুষ এবং দেবতারূপে জন্ম লাভ করা; এবং সাধারণ ভাবে বোধিলাভ পর্যন্ত সমস্ত সুখ পর-লালন থেকে প্রাপ্ত হয়। আমরা অনেক উদাহরণের মাধ্যমে এর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। যেমন একজন সর্বপ্রিয় আধিকারিকের জনপ্রিয়তা এই কারণে হয় যে তিনি অন্যদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এবং তাদের জন্য সবসময় উদ্বিগ্ন থাকেন। জীবহত্যা বা অদত্তাদান (চুরি করা) থেকে বিরত থাকার মতো নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা আমাদের পর-লালন ভাবনা থেকে উদ্ভূত হয় এবং এটাই হল তাই যা আমাদের মনুষ্যরূপে পুনর্জন্ম প্রদান করতে পারে।

উদাহরণ স্বরূপ, পরম পূজ্য দালাই লামা সবসময় এবং সর্বত্র সকলের কল্যাণের কথা ভাবেন। তার সমস্ত ভালো গুণাবলী পর-লালন ভাবনা থেকে উদ্ভূত হয়। একদা কামদেব যখন বোধিসত্ত্ব থোগমে জাংপোর সাধনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে এসেছিলেন তখন তিনি তার কোন ক্ষতি করতে পারেননি। এই মহান তিব্বতী সাধক এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন যখন কোন একটি কীট-পতঙ্গকে অগ্নিশিখায় উড়ে পড়তে দেখতেন। তিনি আন্তরিকভাবে অন্য সকলের জন্য উদ্বিগ্ন থাকতেন। সেইজন্য ভূত এবং এই ধরণের বিঘ্ন সৃষ্টিকারীরা কখনও তার কোন ক্ষতি করতে পারত না। এর কারণ এটাই ছিল যেমনকি স্বয়ং ভূত-প্রেতরাই বলত, যে তাঁর মন কেবল তাদের উপকার ও লালন করার ভাবনায় মগ্ন থাকত।

বুদ্ধ তাঁর এক পূর্বজন্মে যখন তিনি দেবতাদের রাজা ইন্দ্ররূপে জন্ম নিয়েছিলেন ঐ সময় দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে অসুররা জিতে যাচ্ছিল এবং সেইজন্য ইন্দ্র তাঁর রথে চেপে সেখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় তিনি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিলেন যেখানে অনেক পায়রা একত্রিত হয়েছিল। পায়রাগুলি ভয়ভীত হয়েছিল যে তিনি তাদের কয়েকটির উপর দিয়ে রথ চালিয়ে না দেন। সেইজন্য তিনি তাঁর রথ থামিয়ে দিয়েছিলেন। এই দেখে অসুররা ভাবল যে ইন্দ্র তাদের উপর আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে তাঁর রথ থামিয়ে ঘুরিয়ে নিয়েছেন। এই ভেবে তারা সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আমরা যদি এই ঘটনাটি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব তাদের পলায়ন করার ঘটনাটা ঘটেছিল ইন্দ্রের মধ্যে পর-লালনের মনোভাবের কারণে। এইভাবে আমাদের এই উদাহরণটির মতো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে পর-লালন ভাবনা জাগানোর লাভ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। যখন কোন একজন জেলাশাসক ও কোন আধিকারিক পরিচ্ছন্ন ভাবে তাঁর দপ্তরে বসেন তখন তাঁর পদ এবং তাঁর সাথে যুক্ত সব কিছুর গৌরব সেখানে উপস্থিত অন্যের অস্তিত্বের কারণে হয়। এই উদাহরণে অন্যের সদয়তা শুধুমাত্র তাদের উপস্থিতিতেই থাকে। যদি সেখানে তিনি ছাড়া অন্য কেউ না থাকত তাহলে তিনি জেলাশাসক হতে পারতেন না। তাঁর কাছে করণীয় কিছুই থাকত না। তদুপরি, সেখানে লোকজন থাকা সত্ত্বেও যদি তাঁর কাছে কেউ না আসত তাহলে ঐ জেলাশাসক শুধু বসে থাকত আর কিছুই করত না। অন্যদিকে যদি অনেক লোকজন তাঁর কাছে আসত এবং তাদের সমস্যাগুলির সমাধান করার জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত তাহলে তিনি তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে সুন্দরভাবে বসতেন এবং তাদের সেবা করতেন। একজন লামার ক্ষেত্রেও একই জিনিস প্রযোজ্য। অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে তিনি বসেন এবং সুন্দর ভাবে শিক্ষা প্রদান করেন। তাঁর সম্পূর্ণ অবস্থানটি এই বিষয়টির উপর নির্ভর করে যে সেখানে উপস্থিত সকলকে তিনি সহায়তা করতে পারেন। তিনি তাদেরকে সহায়তা করার জন্য ধর্মোপদেশ দেন এবং এইভাবে তাঁর সহায়তা করাটা অন্যের উপর নির্ভর করে, যেমন তাদের কৃতজ্ঞতাকে স্মরণ করার মাধ্যমে এটা ঘটে।

তেমনইভাবে মৈত্রী এবং করুণার মাধ্যমে পর-লালন ভাবনা দ্বারা আমরা দ্রুত বোধিলাভ করতে পারি। উদাহরণ স্বরূপ, যদি কোন শত্রু আমাদের ক্ষতি করে আর আমরা ধৈর্য বিকাশ করি আর তার পরিণাম স্বরূপ, আমরা বোধিলাভের কাছে পৌঁছে যাই, তাহলে এটা সম্ভব হয়ে ওঠে আমাদের পর-লালন ভাবনার কারণে। সুতরাং, যেহেতু সীমাবদ্ধ প্রাণীরা হল সমস্ত সুখ ও কল্যাণের আধার এবং মূল আর এটা কোন কিছুকেই বাদ দেয় না, সেইজন্য আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন যে তারা যাই-ই করুক না কেন অথবা যেকোন ভাবে আমার ক্ষতি করুক না কেন আমি সবসময় পর-লালন ভাবনা বজায় রাখব। অন্য প্রাণীরা হল আমার আধ্যাত্মিক গুরু বুদ্ধ অথবা মূল্যবান রত্নের মতো এবং সেইজন্য আমি তাদের প্রতি সেইরূপে পর-লালন ভাব বিকশিত করব। যদি তাদের কোন রকমের ক্ষতি হয়েও যায় তাহলে সেটা আমি নিজের ক্ষতি মনে করব আর যে ভাবেই হোক আমি তাদের প্রত্যাখ্যান করব না। আমি তাদের প্রতি সর্বদা সদয় এবং উষ্ণ ভাব বজায় রাখব। হে আমার আধ্যাত্মিক গুরু, দয়া করে আমাকে অনুপ্রাণিত করুন, যাতে আমি এক মুহূর্তের জন্যেও আমি আমার হৃদয় এবং অনুভূতি থেকে অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ি। এটাই হল তৃতীয় কারিকার অর্থঃ

আমাকে প্রেরিত করুন যাতে আমি দেখতে পারি; যে চিত্ত আমাদের মায়েদের লালন করে এবং পরম সুখের সাথে নিরাপদে রাখে, সেটাই হল অসীম পুণ্য অর্জনের সিংহদ্বার আর সেই জন্য আমি যেন এই বিচরণকারী প্রাণীদের আমার জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যে লালন করতে পারি, এমনকি তারা যদি আমাদের শত্রু হয়েও ঘোরাঘুরি করে।

এইভাবে আমরা পর-লালন ভাবনার অনুশীলনকে আমাদের ধ্যান সাধনার কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

আমি অবশ্যই স্ব এবং অপরের সম্পর্কে আমার মনোভাব পরিবর্তন করতে সক্ষম

স্ব-লালন ভাবনার অনেক দোষ এবং পর-লালনের অনেক গুণাবলীর কথা চিন্তা-ভাবনা করার প্রবেশদ্বারের উপর নির্ভর ক’রে যখন আমরা ভাবি যে, আমরা স্ব-পর লালন ভাবনার মূল্যবোধগুলি অবশ্যই পরিবর্তন করতে পারি কি না, তখন আমাদের নিশ্চিত হতে হবে আমরা অবশ্যই পারি। আমরা আমাদের মনোভাবকে পরিবর্তন করতে পারি, কারণ বুদ্ধত্ব লাভ করার আগে বুদ্ধ ঠিক আমাদের মতোই ছিলেন। তিনিও আমাদের মতোই এই অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত সাংসারিক পরিস্থিতি এবং সমস্যায় জর্জরিত হয়ে একজন্ম থেকে অন্য জন্মে বিচরণ করেছিলেন। যাইহোক, মুনি বুদ্ধ তাদের প্রতি তাঁর মনোভাব পরিবর্তন করেছিলেন যাদের তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। পর-লালনের ভাবনাকে দৃঢ়-ভাবে ধারণ করে তিনি নিজের এবং অন্যের লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হওয়ার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন।

এর বিপরীতে, আমরা কেবল নিজেদেরকে যত্ন নিয়ে চলেছি এবং অন্য সকলকে উপেক্ষা করে চলেছি। পরকল্যাণের জন্য কোন কিছু করাকে একপাশে রেখে আমরা নিজেদের জন্য লেশমাত্র কল্যাণ করতে পারিনি। স্ব-লালন ভাবনা এবং অন্যদের উপেক্ষা করার প্রবৃত্তিটি আমাদের সম্পূর্ণভাবে অসহায় করে তুলেছে এবং বাস্তবে কিছু অর্জন করতে অক্ষম করে তুলেছে। আমরা আমাদের সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাস্তবিক বৈরাগ্য অথবা সংকল্প বিকাশ করতে পারি না। এমনকি আমরা নিজেদেরকে পুনর্জন্মের নিকৃষ্টতম অবস্থায় পতন হওয়ার হাত থেকে প্রতিরোধ করতে পারি না। এইভাবে আমরা স্ব-লালন ভাবনার দোষ এবং পর-লালন ভাবনার লাভ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি। যদি স্বয়ং বুদ্ধ তাঁর মনোভাব পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়ে থাকেন আর এরজন্য তিনি আমাদের মতোই শুরু করেছিলেন তাহলেও আমরা আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে পারি।

শুধু তাই নয়, পর্যাপ্ত অভ্যাস করে নেওয়ার পর অন্যের শরীরকে লালন করাটা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে যেমন আমরা নিজেদের শরীরের যত্ন নিই। সর্বোপরি, অন্যের শরীর অর্থাৎ আমাদের মাতা-পিতার শরীর থেকে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু গ্রহণ করেছি এবং সেইজন্য এখন আমরা সেটাকে নিজেদের শরীর হিসাবে লালন করি। মূলতঃ, সেগুলি আমাদের ছিল না। অতএব, আমাদের ভাবতে হবে যে আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করাটা অসম্ভব নয়। আমি নিজের এবং অন্যের প্রতি যে মনোভাব রাখি সেটাকে আমি পরিবর্তন করতে পারি। সুতরাং, এই নিয়ে ভাবনা সত্ত্বেও, যদি আমি মনোভাবটি পরিবর্তন না করি, যে মনোভাবটি আমি নিজের বা অন্যের প্রতি রাখি, তাহলে তাতে কোন কাজ হবে না। এটা এমন কিছু যা আমি করতে পারি, এমন কিছু নয় যেটা আমি করতে পারি না। সুতরাং, হে আমার আধ্যাত্মিক গুরু, আমাকে এটা করতে অনুপ্রাণিত করুন। চতুর্থ কারিকাতে এর উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

সংক্ষেপে, আমাদেরকে এমন চিত্তের বিকাশের জন্য অনুপ্রাণিত করুণ, যে চিত্তটি কেবল স্বার্থপরতার কারণে শিশুসুলভ প্রাণীদের মতো দাসত্বে পরিণত হয়ে যায় এবং মুনীন্দ্রের মতো পরকল্যাণ মাত্রের জন্য কর্ম করার গুণাবলীর পার্থক্য বুঝতে সক্ষম হয়, যাতে আমরা নিজের এবং  অন্যের লালন সম্পর্কে আমাদের মনোভাবকে সমান এবং পরিবর্তন করতে সক্ষম হতে পারি।

সুতরাং, আমরা এখানে যে সিদ্ধান্ত নিই সেটা হল আমরা স্ব এবং পর-লালন সম্পর্কিত মনোভাব অবশ্যই পরিবর্তন করতে পারি।

আমি স্ব এবং পর সম্পর্কিত মনোভাব অবশ্যই পরিবর্তন (বিনিময়) করব 

পুনরায় আমরা স্ব-লালনের দোষ এবং পর-লালনের গুণাবলী সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি। তবে এবার আমরা এই দুটি ভাবনাকে মিলিয়ে একটি বিকল্পের প্রণালীতে এটা করি। অন্য কথায় আমরা দশটি ধ্বংসাত্মক এবং দশটি গঠনমূলক কর্মের মাধ্যমে গমন করি, প্রতিটি তালিকা থেকে একের পর এক কর্মের পরীক্ষা করি এবং দেখি তাদের স্ব-লালন এবং পর-লালনের ফলাফল। উদাহরণ স্বরূপ, আমি যদি স্ব-লালন ভাবনার উপর জোর দিই তাহলে অন্যের প্রাণ নিতে একেবারে দ্বিধা করব না। এরফলে, আমি আনন্দহীন অর্থাৎ দুঃখময় নরকলোকে জন্ম নেব। এমনকি পরে যদি মনুষ্যরূপে জন্ম হয়েও থাকে, তাহলে আমি অসুস্থতায় পরিপূর্ণ একটা আল্পায়ু জীবন লাভ করব। অন্যদিকে, আমি যদি পর-লালন ভাবনা বিকশিত করি তাহলে আমি অন্যের জীবন নেওয়া থেকে বিরত থাকব। এরফলে, আমি একটা ভাল অবস্থায় পুনর্জন্ম গ্রহণ করব, যেখানে আমার দীর্ঘায়ু হবে ইত্যাদি। তারপরে চুরি করা থেকে বিরত থাকা, অনুপযুক্ত যৌন আচরণে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা এবং এই ধরণের অন্য কর্মের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়াকে পুনরাবৃত্তি করব। সংক্ষেপে, যেমনকি পঞ্চম কারিকায় উল্লেখ করা আছেঃ

যেহেতু স্ব-লালন ভাবনা হল সমস্ত পীড়া-যন্ত্রণার প্রবেশদ্বার, অন্যদিকে আমাদের মায়ের প্রতি লালন ভাবনা হল সমস্ত ভাল জিনিসের আধার অতএব আমাদের অনুপ্রাণিত করুন যাতে আমরা  স্ব-পর পরিবর্তনের যোগকে আমাদের মূল অনুশীলন বানাতে পারি।

এরপর পঞ্চম সিদ্ধান্ত হল যে আমি অবশ্যই স্ব-পর পরিবর্তনের মনোভাব বিকাশ করব। অবশ্যই এর অর্থ এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া নয় যে এখন আমি হলাম আপনি এবং আপনি হলেন আমি, বরং এর অর্থ হল আমরা যার প্রতি লালন ভাবনা রাখি তার প্রতি আমাদের দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন করতে হবে। স্ব-লালনের মনোভাব এবং অন্যদের উপেক্ষা করার পরিবর্তে এখন আমরা আমাদের স্বার্থপর ভাবনাকে উপেক্ষা করি এবং সকলের প্রতি স্ব-লালন ভাবনা বিকাশ করি। আমরা যদি এটা করতে ব্যর্থ হয়ে যাই তাহলে আমাদের পক্ষে অর্জন করার কিছুই থাকবে না। তবে আমরা যদি আমাদের মনোভাবের সাথে এই বিনিময়টা করি তাহলে তার ভিত্তিতে আমরা নিজেদের সুখ অপরকে সমর্পণ করা এবং তাদের দুঃখ নিজের উপর গ্রহণ করার মনোনিবেশের প্রশিক্ষণের জন্য অগ্রসর হতে পারব, আন্তরিক যত্নশীল মৈত্রী এবং করুণামূলক সহানুভূতির বিকাশের উপায় হিসাবে। তার ভিত্তিতে আমরা প্রত্যেকের সমস্যা ও দুঃখ লাঘব করা এবং সুখ প্রদান করতে অসাধারণ সংকল্প বিকাশ করতে সক্ষম হব। যারফলে, আমরা বোধিচিত্তের উৎসর্গীকৃত হৃদয় বিকাশ করতে সক্ষম হব। এর দ্বারা আমরা বোধিলাভ করার প্রচেষ্টা করব যাতে যতদূর সম্ভব উপরোক্ত কর্ম করতে সক্ষম হতে পারি।

সারাংশ

আচার্য শান্তিদেব রচিত “বোধিচর্যাবতার” নামক গ্রন্থ, কদম্ব আচার্যদের শিক্ষা এবং চতুর্থ পানছেন লামা রচিত “গুরু পূজা অনুষ্ঠানটি” হল এই শিক্ষাগুলির উৎস। পরম পূজ্য দালাই লামার কনিষ্ঠ গৃহশিক্ষক স্বর্গীয় শ্রদ্ধেয় ঠ্রি-জাং দোর্জেছাং-এর বচন সংগ্রহে কয়েকটি অধ্যায়ে উক্ত শিক্ষাগুলি উপলব্ধ রয়েছে। তবে এর রূপরেখা এবং তার সংখ্যার প্রতি খুব আগ্রহী হওয়ার অর্থ হল আমাদের সামনে একটা প্লেটে সাতটা মোমো সাজিয়ে রাখার মতো যেগুলি আমরা না খেয়ে তার সংখ্যা, তার উৎস এবং তার আকার কেমন ইত্যাদিকে প্রমাণ করার জন্য কাউকে প্রয়োজন বোধ করা। এসব বাদ দিয়ে বসে পড়ুন এবং খান।

Top