“বিশেষ কিছু নয়” এই মনোভাবটি কি জীবনে কার্যকর হতে পারে?

প্রশ্নঃ আমি প্রকৃতপক্ষে এই “বিশেষ কিছু নয়” ধারণাটি পছন্দ করি। আমি যে কারণে আশ্চর্য হই সেটা হল, যখন আপনি এই ধরণের মনোভাব নিয়ে বাইরের পৃথিবীর সাথে সাক্ষাৎ করবেন। উদাহরণ স্বরূপ, ধরুন, আপনি অন্য লোকজনদের সঙ্গে একটি প্রকল্পের উপর কাজ করছেন এবং কিছু ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যাওয়ার সময় আপনার মধ্যে এই ধরণের মনোভাব জাগে যে “ঠিক আছে, বিশেষ কিছু নয়! এরকম ঘটেই থাকে”। আমার সন্দেহ আছে, ঐরকম পরিস্থিতিতে, অন্য লোকজনরা ভাবতেও পারে যে, আপনি বিষয়গুলিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন না।

ডক্টর বরজিনঃ “বিশেষ কিছু নয়” মনোভাবটিকে ভুল বুঝবেন না। এটা কিছু না করার মতো তেমন কিছু নয়। আবার এটা অসতর্কতার মতো বেপরোয়া মনোভাব, যেমন, “যাই হোক না কেন” এর থেকে আলাদাও নয়। “বিশেষ কিছু নয়”-এর অর্থ হল, আমরা সুখী বা অসুখী যা কিছুই বোধ করি না কেন, তাতে বিচলিত হই না এবং সেগুলির মধ্যে কোনোটাকে অতিরঞ্জিত করে দেখি না। শুধু আমরা যেটা করছি সেটা হল সেগুলির সঙ্গে খুবই যুক্তিসংগতভাবে ও শান্তভাবে মোকাবিলা করি। আমরা শুধু বিচলিত না হয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে সেগুলিই করি।

কী হবে যদি অন্য লোকজনরা বিচলিত হয়ে পড়েন?

যদি তাঁরা বিচলিত হয়ে পড়েন, তাহলে আপনার শান্ত-ভাবনা তাদেরকে শান্ত করতে সহায়তা করতে পারে। একটা বিশুদ্ধ উদাহরণ স্বরূপ ধরুন, আমরা কম্পিউটারে একটি নথি লিখছি এবং ভুল বোতামটিতে চাপ পড়ে যাওয়ার কারণে সেটি মুছে যায়। এরকম তো ঘটেই থাকে।এর কারণে বিচলিত হলে কোন লাভ হয় না। যদি আমাদের পূর্বাবস্থায় ফেরার কোনো উপায় না থাকে এবং আমরা এটিকে সংশোধন করতে না পারি, তার মানে আমাদের দ্বারা কৃত কাজটি শেষ! সেটার জন্য কান্নাকাটি করলে তো আর ফিরে আসবে না সেটার সম্পর্কে বিচলিত ও অসুখী হলেও কোন লাভ হবে না। সেরকম করলে শুধু ব্যাঘাতই ঘটবে। আমরা শুধু “ঠিক আছে” বলি ও পুনরায় লেখা শুরু করি। কী লেখা ছিল সেটা স্মরণ করার জন্য যদি আমরা ভালোভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে থাকি তাহলে আমরা সেটা পুনরায় লিখে ফেলতে পারব এবং সম্ভবত সেটা দ্বিতীয়বার আরও ভালো হতে পারে। আমরা এই পুরো বিষয়টিকে ভালভাবে মোকাবিলা করি এবং পুরো বিষয়টিকে একটা নাটক হওয়া থেকে এড়িয়ে চলি যাকে বলা হয় “চমকপ্রদ রানী”। আমরা যদি কোনো দলের অংশ হয়ে থাকি এবং নথিটি সেই দলটির জন্য তৈরী হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের নীরবতা তাদেরকে শান্ত করতে সহায়তা করবে।  

আমরা কি কোনও পরিস্থিতির কারণে বা সাধারণ ভাবে সুখী বা অসুখী বোধ করার কথা বলছি?

আমি আমাদের নিজেদের সাথে মোকাবিলা করার কথা বলছি। আমরা যদি সুখী বা অসুখী বোধ করি, তাহলে আমরা নিজেদের জীবনের ছন্দে চলতে থাকি এবং সেগুলির সাথে কোনোরকম মোকাবিলা করি না। তাহলে অন্য কেউ যদি সুখী, অসুখী বা বিচলিত বোধ করে তখন কী হবে? উদাহরণ স্বরূপ, একটা শিশু কাঁদছে। আমরা তার কাছ থেকে কী আশা করব? সে তো একটা শিশু। আমরা তাই নিয়ে বিচলিত হই না, “আরে, বাচ্চাটি কাঁদছে?” আমরা এটাকে খুব বড়ো কিছু মনে করি না, পরিবর্তে আমরা শুধু শিশুটির যত্ন নিই। শিশুটি কেন কাঁদছে? তার জন্য যা কিছু করার প্রয়োজন, আমরা সেটা করি। এটা সেইরকমই।

শান্তিদেব এটিকে খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, “মানুষ শিশুসুলভ”। সুতরাং তারা বিচলিত হয়। এটা শিশুদের কান্নার মতো। আমরা কী আশা করতে পারি? আমরা এটাকে খুব বড়ো কিছু মনে করি না, বরং আমরা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করি এবং জিনিসগুলিকে বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করি।

কোনকিছুর সম্পর্কে বিচলিত হওয়ার অর্থ হল সেটার অস্তিত্বকে স্ফীত করে দেওয়া আর সেটাকে একটি বড়ো মোকাবিলায় পরিণত করে দেওয়া। এটাই তো শূন্যতা। সেখানে এরকম কোন বড় মোকাবিলা নেই। মোকাবিলাগুলি কখনও বাস্তবতার সাথে মিল খায় না। ঘটনা ঘটে থাকে, ব্যস্‌। আমরা কেবল তাদের সাথে মোকাবিলা করি। আমাদের মধ্যে কি আবেগ আছে? অবশ্যই আছে, ইতিবাচক আবেগ যেমন- মৈত্রী, করুণা এবং ধৈর্য, এগুলি হল মহান আবেগ। তবে আমাদের রাগ, অধৈর্যতা এবং অসহিষ্ণুতার মতো নেতিবাচক আবেগের বশে কর্ম করা উচিত না, কারণ এগুলি মোটেই লাভদায়ক নয়।

আমার মনে হয় যদি আমরা এটাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই তাহলে এটা “মন-প্রশিক্ষণ”- শিক্ষার মতো হবে। গভীরতর অন্তর্দৃষ্টির প্রথম ধাপ অর্জন করার মাধ্যমে আমরা নিজেদের সমস্যাগুলি থেকে এটা শিখতে পারি।

সেটা ঠিক। 

আপনি কি মনে করেন যে মন-প্রশিক্ষণের এই পদ্ধতিটি অবাস্তব? আপনার কি মনে হয় মানুষের পক্ষে এই “বিশেষ কিছু নয়”, এটা কোন বড়ো ব্যাপার নয়?-এই পদ্ধতির উপর কাজ করা বেশী বাস্তবসম্মত হবে?

আমাদের মনোভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করার জন্য আমরা মন-প্রশিক্ষণের এই বুদ্ধি-শোধন পদ্ধতিটির সহায়তা নিতে পারি। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা নেতিবাচক পরিস্থিতিকে ইতিবাচক পরিস্থিতি হিসাবে দেখতে পারি। এটি একটি দুর্দান্ত পদ্ধতি; আমার মনে হয় এটি পরিবর্তনের পূর্বে, আমরা কী অনুভব করছি সেটা নিয়ে গর্ব করা বন্ধ করতে হবে এবং আসল পরিস্থিতি কী সেটা দেখতে হবে। আমরা যখন এটাকে অতিরঞ্জিত করে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাই তখন এটাকে পরিবর্তন করা খুবই কঠিন হয়ে ওঠে। “ওহ, এটা একটা বিপর্যয়! বাচ্চাটি আবার তার ডায়াপারটি নোংরা করে ফেলেছে”।  “প্রত্যেকের নোংরা ডায়াপার পালটানোর দায়িত্ব যেন আমার কাছে আসে! আমি প্রত্যেকের ডায়াপার পরিবর্তন করবো”, এই মনোভাবটি পরিবর্তন করার আগে আমাদের মধ্যে আরও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি জাগাতে হবে।

আমাদের ধাপে-ধাপে এগোতে হবেঃ প্রথমে, শিশুটি নিজেকে নোংরা করে ফেলেছে। তাতে কী হয়েছে? সে তো একটা শিশু। আমরা ডায়াপারটি পালটে দেব। তবে ডায়াপার পালটানোর সময়, আমরা হয়তো মনোরম স্পর্শের অনুভূতি লাভ করতে পারব না, কারণ তাতে দুর্গন্ধ থাকে। এইরকম পরিস্থিতিতে আমরা বুদ্ধি-শোধন (লোজঙ্) অনুশীলন প্রয়োগ করতে পারি যেমন, “বাচ্চাটি পরিষ্কার করার মতো, আমি যেন প্রত্যেকের দাগ এবং সমস্ত ময়লা পরিষ্কার করতে সক্ষম হতে পারি। এটা করার ফলে, এটা যেন সকলকে শুদ্ধ করতে সক্ষম হওয়ার কারণ হিসাবে কাজ করতে পারে”। তবে প্রথমে আমাদের এটাকে বিপর্যয়ের ধারণা থেকে আলাদা করতে হবে। আমাদের এই পদক্ষেপটির দিকে ধাপে-ধাপে এগোতে হবে।

আমি তো সকলের ডায়াপার পালটানোর কথা চিন্তা করছি। এটা কি নোংরা কাজ!

একদম ঠিক, যদি আমাদের পৃথিবীর সমস্ত নোংরা নিজের উপর নিতে হয়, তাহলে কেউই বৌদ্ধ হতে চাইবে না। একটা সাধারণ নীতি হিসাবে, আমরা যদি জীবনে সাধারণ উদাহরণগুলি ব্যবহার করার পরিবর্তে রসিক উদাহরণগুলি ব্যবহার করি তাহলে তার প্রভাব বেশী পড়ে, তাই না?

আমি কেবল ভাবছিলাম যে, আমরা যখন কোনো ধ্বংসাত্মক সম্পর্ক বা অপ্রীতিকর কোনো কিছু উপভোগ করি, তখন আমরা সেটাকে কীভাবে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্ত করব?

যদি আমরা একটা ধ্বংসাত্মক সম্পর্কের মধ্যে থাকি এবং পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যায়, তখন আমরা বলি না যে, “তাতে কী হয়েছে, এটাই তো সংসার”। তখন আমরা যেটা প্রয়োগ করতে চাই সেটা হল প্রভেদমূলক সচেতনতা, যেটিকে পরমপূজ্য দালাই লামা “বিস্ময়কর মানবীয় বুদ্ধি” বলে সম্বোধন করেন। কোন পরিস্থিতি লাভদায়ক বা ক্ষতিকারক, আমাদের সেটাকে প্রভেদ করতে সক্ষম হতে হবে। পরিস্থিতিটা আমাদের পক্ষে লাভদায়ক কিনা এবং অন্য ব্যক্তির পক্ষে এই সম্পর্কে থাকা লাভদায়ক কিনা? যদি এটা লাভদায়ক না হয়, যদি এটা উভয়পক্ষের জন্যই ক্ষতিকারক হয়, তাহলে আমরা এটাকে সমাপ্ত করে দেব। মূল বিষয়টি হল যা ঘটছে সেটা বাস্তবের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটার সম্পর্কে অতিরঞ্জিত করণ বা অনুমানের ভিত্তিতে চিন্তা-ভাবনা না করে, তার সম্পর্কে স্পষ্টভাবে চিন্তা করতে সক্ষম হতে হবে। কখনও কখনও অবশ্যই তার থেকে আলাদা হয়ে গেলেই ভাল হয়। তবে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত এবং সুস্পষ্ট বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সেই সিদ্ধান্তটা নেওয়া উচিত।

আমাদের অসচেতন অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার চেষ্টা করা এবং তাদের সততার সাথে প্রকাশ করার চেষ্টা করা কি ইতিবাচক বিষয় হতে পারে?

প্রায়শই, যদি পাশ্চাত্য অভিব্যক্তি প্রয়োগ করা হয়, আমরা অসচেতনভাবে আবেগগুলি অনুভব করি। প্রশ্নটি হল, কিছু পরিস্থিতিতে এটাকে কি আরও সুস্পষ্টতার সাথে প্রকট করা ভাল? আমার মনে হয়, আমাদের দুটি ভিন্ন ক্ষেত্রে পরীক্ষা করতে হবে, একটা হল ধ্বংসাত্মক আবেগ এবং অন্যটি হল গঠনমূলক। উদাহরণ স্বরূপ, ক্রোধ এবং মৈত্রী বা প্রেমের পরীক্ষা করা যাক। যদি অচেতন স্তরে কারও সাথে আমাদের শত্রুতা থাকে, তাহলে আমরা অবশ্যই এটির সম্পর্কে সচেতন হতে চাইব। এটির সম্পর্কে সচেতন হওয়ার অর্থ এই নয় যে অগত্যা কারও প্রতি আমাদের শত্রুতা প্রকাশ করা। পুনরায়, আমাদের মধ্যে যা কিছু ঘটে চলেছে তার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ ও পার্থক্য করতে হবে।

উদাহরণ স্বরূপ, ধরুন, আমার বন্ধু আছে এবং যখন আমি তাদের সাথে কথাবার্তা বলি, তখন আমি সবসময় তাদের জিজ্ঞেস করি, “আপনি কেমন আছেন? আপনার জীবন কেমন কাটছে?”যদিও তারা আমাকে কখনও জিজ্ঞেস করে না যে, আমি কেমন আছি এবং আমার জীবন কেমন কাটছে। যেহেতু তারা কখনই আমাকে জিজ্ঞাসা করে না, তাই এটা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর মনে হয় যে তারা খুবই স্বার্থপর এবং তারা আমাকে আমার বিষয়ে জিজ্ঞেস করার কথা ভাবেও না। এখন, এখানে একটি পার্থক্য আছে। ঐ বিষয়ে আমার মধ্যে কি কোন অচেতন শত্রুতা আছে? হয়তো থাকতেও পারে; কিন্তু সেটা প্রকাশ করলে এবং তাদের সাথে রাগারাগি করলে ঐ পরিস্থিতি শুধরাবে না। আমি যদি বলি, “আপনি সত্যিই স্বার্থপর! আপনি ভয়ঙ্কর,” তাহলে সেটা আমাদের বাধ্যতামূলক ভাবে একটি ধ্বংসাত্মক উপায়ে আচরণ করতে এবং তাদের প্রতি চিৎকার করার দিকে পরিচালিত করবে। এটা পরিস্থিতিকে কোন ভাবেই শুধরাবে না। “আপনি আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করেন না যে আমি কেমন আছি? আপনার কী সমস্যা আছে?” এই ধরণের আচরণ কোন ভাবেই কাজে লাগে না। আমরা যদি লক্ষ্য করি যে এরকম কিছু সম্পর্কে আমাদের মধ্যে শত্রুতা রয়েছে, তাহলে আমাদের সত্যিই দেখা উচিত যে এটি যেন প্রকাশ না পায়, কারণ যদি এটা প্রকাশ পায় তাহলে আমরা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলব এবং ধ্বংসাত্মক ভাবে কাজ করতে লাগব।

তবে, আমি যখন এই ধরণের শত্রুতা লক্ষ্য করি, তখন আমি রাগ না করে পরিস্থিতিটাকে সংশোধনের চেষ্টা করতে পারি। সাধারণত এটি আমি একটি হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে করি। আমি লক্ষ্য করেছি যে, পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার জন্য ব্যঙ্গকৌতুক বা হাসি-ঠাট্টা একটি উপকারী মাধ্যম। যখন আমার বন্ধু তার সম্পূর্ণ ঘটনা শুনিয়ে দেয় যে, সে কেমন আছে আর সে যখন আমার সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করার আগে নতুন বিষয় শুরু করার জন্য তৈরী হয়, তখন আমি বলে উঠি, “তুমি কেমন আছো আলেক্স? আরে, ধন্যবাদ জিজ্ঞেস করার জন্য”। এগুলি ভীষণ রসিকতা হয়ে যায় এবং ব্যক্তিটি বুঝতে পারে তাকেও বিনিময়ে কিছু করা উচিত এবং তাকেও জিজ্ঞাসা করা উচিত যে আমি কেমন আছি। এইভাবে এর মধ্যে কোনো শত্রুতা থাকে না।

আমাদের মধ্যে যদি এই ধরণের অন্তর্নিহিত শত্রুতা থেকে থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে সচেতন হওয়া খুবই লাভদায়ক হয়। যদি এটা আমাকে বিরক্ত না করে, তাহলে কী হবে? আমার কোনো কিছু যায় আসে না ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো কিনা যে আমি কেমন আছি; এটা অপ্রাসঙ্গিক। আমি কী করছি, কেমন আছি সেটা কি আমাকে তাদের বলতেই হবে? অবশ্যই নয়। আমাকে যদি সত্যিই বলতে হয়, তাহলে আমি তাকে আমার বিষয়ে বলে দেব। এটা এমনই, যেমন- আপনার পূর্ণবয়স্ক সন্তান বা নাতি-নাতনিরা যদি আপনাকে ফোন না করে, আপনার যদি তাদের কথা শুনতে ইচ্ছা হয়, তাহলে আপনি নিজে থেকেই তাদের ফোন করুন। কিন্তু এটি করুন কোনরকম শত্রুতা ছাড়াই এবং তাদের অপরাধবোধ না করিয়ে যে তারা কেন আপনাকে ফোন করে না।

একটি গঠনমূলক আবেগ কী? এক্ষেত্রে আমাদের এর সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা শুরু করতে হবে। আমাকে এর সম্পর্কে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই কারণ আমি সত্যিই আগে কখনও এর উপর বিশ্লেষণ করিনি। সম্ভবতঃ আমাদের মধ্যে অপ্রকাশিত প্রেম রয়েছে? এর মানে কী? আমরা এখানে কারও প্রতি কোনো প্রচ্ছন্ন বা গুপ্ত কাম-বাসনা এবং যৌন আকর্ষণের ধ্বংসাত্মক আবেগ সম্পর্কে কথা বলছি না। এর অর্থ “আমি তোমার সাথে শুতে চাই” বা সেরকম কিছু নয়। এখন আমাদের এমন আবেগ সম্পর্কে কথা বলতে হবে যেটা সত্যিই ইতিবাচক। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা আমাদের সন্তানকে ভালোবাসি, ঠিক? আমরা আমাদের সন্তানকে ভালোবাসি, কিন্তু আমরা কতবার সেই ভালোবাসাকে প্রকাশ করি? আমরা কি এটাকে আরও প্রকাশিত স্তরে নিয়ে যেতে চাই? হ্যাঁ, এটা সহায়ক হতে পারে।

তারপর আমাদের প্রভেদমূলক সচেতনতা ব্যবহার করতে হবে, কারণ আমরা বাচ্চাটির শ্বাসরোধ করতে চাই না। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের একটা কিশোর সন্তান আছে এবং সে নিজের বন্ধুদের সাথে আছে আর আমরা যদি মা হিসাবে তার কাছে গিয়ে তাকে বলি “ওহ, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি” এবং তাই বলে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাই, তাহলে তার বন্ধুদের সামনে তাকে বিব্রত করে ফেলব এবং যেটা একেবারে অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে। আরেকটা উদাহরণ হতে পারে যে, যখন তারা বাইরে থাকে তাদের অবিরত ভাবে ফোন করা এবং বার্তা পাঠানো। “উফ্ফ, মা আবার ফোন করেছেন আমি ঠিক আছি কিনা জানার জন্য?”

আমাদের ইতিবাচক আবেগ কখন এবং কীভাবে প্রকাশ করতে হবে সেটা নির্ধারণ করতে আমাদের প্রভেদমূলক সচেতনতা ব্যবহার করতে হবে। আমাদের দুই বছর বয়সী সন্তানের ক্ষেত্রে প্রকাশ করার পদ্ধতিটি আমাদের পনেরো বছর বয়সী সন্তানের ক্ষেত্রে প্রকাশ করার পদ্ধতি থেকে একেবারে আলাদা। ইতিবাচক আবেগ প্রকাশ করা ভালো; তবে আবার, এরজন্য তাকে নাটকের রানী হলে হবে না আর এটাকে সত্যিকারের একটি নাটকীয় অনুষ্ঠান বানালে হবে না। আরও স্পষ্ট স্তরে প্রকাশ করাই ভালো।

আবেগের মুদ্রা

এটি অন্য একটি বিষয় সম্পর্কিত, যেটাকে আমরা খুবই কার্যকর মনে করি। আমার একজন বন্ধু আছে যিনি হলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, যিনি অর্থনৈতিক শব্দাবলী ব্যবহার ক’রে এই বিষয়টির উল্লেখ করেছিলেন। আমাদের এটা মেনে নিতে শিখতে হবে যে প্রতিটি মানুষই ভিন্ন মুদ্রার অধিকারী এবং তারা সেই মুদ্রা দিয়ে সকলকে ভুগতান করে। আমাদের তাদের মুদ্রা গ্রহণ করা শিখতে হবে।উদাহরণ স্বরূপ, কিছু মানুষ আলিঙ্গন এবং চুম্বন ক’রে শারীরিক ভাবে তাদের স্নেহ প্রদর্শন করে। আবার অন্য মানুষেরা আমাদের যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে তাদের প্রেম ও উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা শারীরিক ভাবে স্নেহময় হয় না, তবে তারা যত্নশীল এবং প্রতিরক্ষামূলক প্রকৃতির হয়।

একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ পুরোনো প্রজন্মের হতে পারে যেখানে পিতা সাধারণত সন্তানদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল হতেন না। তবে, সেই পিতা তার সন্তানদের প্রতি ভালবাসা এই ভাবে প্রকাশ করতেনঃ তিনি বাইরে চলে যেতেন, কাজ করতেন, সমস্ত অর্থ উপার্জন করতেন এবং নিজের সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করতেন। এটাই হল সেই মুদ্রা যেটা সেই পিতা ভুগতান করতেন। শিশু হিসাবে বা এমনকি পরবর্তীকালে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে আমাদের এটা উপলব্ধি করতে হবে। “আমার বাবা আমাকে ভালোবাসতেন এবং নিজের উদ্বেগ ও যত্ন প্রকাশ করতেন। তিনি হয়তো তাঁর মুদ্রার মাধ্যমে সেটা ভুগতান করেননি যেটা আমি বেশি পছন্দ করতাম, যেমন আলিঙ্গন করা অথবা আমাকে বলা যে উনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন, কিন্তু তিনি স্নেহপ্রকাশ করেছেন”। আমাদের বিভিন্ন মুদ্রাকে গ্রহণ করা শিখতে হবে। এটি এখানে ডেনমার্কে ক্রোনায-এ ভুগতান করার মতো হবে, ইউরো দ্বারা নয়। টাকা তো টাকাই থাকে, বিভিন্ন লোক বিভিন্ন ভাবে তাদের স্নেহকে প্রকাশ করে।

আপনি আপনার গল্পে আপনার বন্ধুদের সম্পর্কে বলেছিলেন যারা জিজ্ঞেস করে না যে আপনি কেমন আছেন, যদি আপনি রেগে না যান, তাহলে কী হবে; তবে আপনার মনে তাদের প্রতি একটি আসক্তি আছে অথবা আপনি চান যে ওরা আপনাকে নিয়ে ভাবুক এবং আপনি কেমন আছেন সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করুক। তার অর্থ এই নয় যে আপনি রাগ করেছেন, আপনি চিৎকার করতে চান না, আপনি শুধু দুঃখ পান এবং কম ভালোবাসা বোধ করেন। আপনি কিন্তু তখনও এটা বলতে পারেন। তবে তারা যদি তাদের আচরণ পরিবর্তন না করে এবং আপনার সামান্য বিনীত পরামর্শটি গ্রহণ না করে, তাহলে আপনি কীভাবে এই দুঃখকে মোকাবিলা করবেন? এইসব কি নিজের আসক্তিকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা ক’রে ঐ দুঃখের মোকাবিলা করবেন? 

এই পরিস্থিতিতে দুই রকমের দু:খ উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রথমটা হল আত্ম-লালনের দু:খঃ, “আমি দুঃখিত কারণ তারা আমার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। আমি এতে রাগ করি না, তবে আমি আশা করি তারা যেন আমার দিকে মনোযোগ দেয়”। এটা “আমি, আমি, আমি” চিন্তা-ভাবনার উপর ভিত্তি করে জাগে। এটি এক প্রকারের অসুখীতা। তবে আমরা এই কারণেও দু:খ পেতে পারি যে, তারা এত আত্ম-কেন্দ্রিত, কিন্তু আমরা এটাকে একেবারে ব্যাক্তিগত ভাবে গ্রহণ করি না। এক্ষেত্রে আমরা দুঃখিত হই যে তাদের মধ্যে এই সমস্যাটি রয়েছে। এটা আমাদের তাদের প্রতি করুণা বিকাশের পথে পরিচালিত করে। এরপর আমরা তাদের সাহায্য করার চেষ্টা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি।

যদি আমাদের দু:খ কেবলমাত্র নিজের সম্পর্কে উদ্বেগের ভিত্তিতে তৈরি হয়, “আমি দুঃখিত যে মানুষ আমার প্রতি মনোযোগ দেয় না,” তাহলে আমাদের সত্যিই সেটাকে মোকাবিলা করার জন্য কাজ করতে হবে। এমনকি মানুষ যদি আমাদের প্রতি মনোযোগ দিয়েও থাকত, তাহলে তাদের কাছে আমাদের কী প্রত্যাশাই বা ছিল? আমরা কি চাই যে পাপারাজ্জি সাংবাদিকরা সারাক্ষণ আমার চারপাশে থেকে আমাদের ছবি তুলুক? আমরা কি চাই আমাদের প্রতি খুব বেশী মনোযোগ দেওয়া হোক? আমার এই কথাটি বলার অর্থ হল, অবশ্যই সেটা আমাদের সন্তুষ্ট করবে না। এমনকি অন্যরা যদি আমাদের প্রতি ততটাই যত্ন নেয় যতটা আমরা আশা করি, তবুও সেটা একটা সাধারণ সুখ হবে এবং বেশিদিন স্থায়ী হবে না। অন্যদিকে একজন অতিরিক্ত যত্নশীল অভিভাবকের উদাহরণ স্বরূপ, যারা অনাবশ্যক কারণে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর তার সন্তানের লক্ষ্য রাখে, “তুমি কেমন আছো? তুমি ঠিকঠাক বোধ করছো তো? অথবা সব ঠিক আছে তো?” তাহলে কী হবে?

আমি হয়তো মনে করি আমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা ঠিক হতেও পারে, কিন্তু অপর ব্যক্তির ক্ষেত্রে সেটা ঠিক নাও হতে পারে। আমাদের মুদ্রা সম্পর্কে কথা বলা উচিত, “আমি এই রকম এবং তুমি ঐ রকম”। আমরা একে অপরের সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি। আমরা একে অপরের পছন্দ ও অপছন্দের উপর কাজ করতে পারি এবং শিখতে পারি। এর সম্পর্কে কথা বলা, যোগাযোগ রাখা এবং তার সম্পর্কে সচেতন থাকা ভালো।

যদি এটা একটা চলমান সম্পর্ক হয় এবং অপর ব্যক্তিটি সেটা গ্রহণ করতে সক্ষম হন, তাহলে আমরা এর সম্পর্কে কথা বলতেই পারি। “আমি এইভাবে প্রদর্শিত স্নেহ পছন্দ করি”। অপর ব্যক্তিটি বলতে পারেন তিনি সেইভাবে প্রদর্শিত স্নেহ পছন্দ করেন। এইরকম অংশীদারিত্ব সম্পর্কের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে; কিন্তু এই পদ্ধতিটা একটা শিশু এবং মাতা-পিতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশি ভালো ভাবে কাজ করে না। যদি ইতিমধ্যেই বাবা-মা মারা গিয়ে থাকেন এবং আমরা আমাদের শৈশবের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে আমরা এটা আলোচনা করতে একদমই প্রস্তুত হই না। এখানে একটা জিনিস দেখা গুরুত্বপূর্ণ যে, কোন সম্পর্কে জড়িত দুজন ব্যক্তি মূলতঃ সমান স্তরের কিনা। তারা কি নিজেদের পরিবর্তন করে যোগাযোগ করতে পারে? হতে পারে কর্মকর্তা কখনোই কর্মক্ষেত্রে বা দপ্তরে কাউকে জিজ্ঞেস করেন না যে, সে কেমন আছে। আমরা এই ধরণের সমস্যা নিয়ে কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করিও না। একজন কর্মকর্তার সাথে আমাদের শুধুমাত্র কাজ সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা উচিত, যেমন, “আপনি আমাকে খুব বেশী কাজ দিচ্ছেন, যার জন্য আমি খুব একটা খুশি নই”। আপনাকে পরিস্থিতিটা দেখা উচিত এবং প্রভেদমূলক সচেতনতার সাথে এই বিষয়ে ভাবা উচিত।

ধরুন, আমরা শূন্যতার সম্পর্কে সচেতনতার স্তর উপলব্ধি করতে পারিনি, আমরা এখনও মনে করি আমাদের মধ্যে রাগ করার কোনো বাস্তব কারণ রয়েছে, যেটা কোন অতিরঞ্জিত কারণ নয়। আমরা সেটা এড়িয়ে চলি এবং আমাদের ক্রোধ প্রকাশ করি না। আমরা এটাকে কোন বড় ব্যাপার হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করি না, তবে এমন কোন ব্যবস্থা আছে যেটা মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে অস্বাস্থ্যকর হতে পারে?

এর ভিত্তিতে এখানে মনোভাবের নিগ্রহের বিষয়টি সামনে আসে। আমরা যখন শূন্যতা উপলব্ধির কোনও স্তর উপলব্ধি করতে বা অর্জন করতে পারিনি এবং আমরা কেবল শত্রুতা দমন করতে পারি, তখন অবশ্যই এটা ভিতরে-ভিতরে আমাদের নিজের দিকে ঘুরে যাবে। এটা তখন বিভিন্ন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তখন আমরা কী করব? যদি আমরা আমাদের ক্রোধ বা দুঃখ প্রকাশ করতে চাই এবং যদি সেটার প্রকাশ আবশ্যক হয়, তাহলে উপযুক্ত সময় বেছে নিতে আবার প্রভেদমূলক সচেতনতা ব্যবহার করতে হবে। যখন অন্য ব্যক্তি সত্যিই ক্রোধিত বা বিচলিত থাকে বা খুব ব্যস্ত থাকে তখন ক্রোধ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সেটা সঠিক সময় নয়। এটা প্রকাশের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় কখন হবে সেটা বোঝার জন্য বুদ্ধি ব্যবহার করতে হবে। যখন ক্রোধ খুবই প্রবল অবস্থায় থাকে তখন ক্রোধ প্রকাশ করবেন না, কারণ সেটা তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

সব মিলিয়ে কথা-বার্তা বা আচরণ আমাদের সাধারন জ্ঞান ও বুদ্ধি ব্যবহারের মাধ্যমে করা উচিত। কখন এটা সহায়ক হতে পারে? এর উপযুক্ত সময়টি কখন? যদি অন্য কোন ব্যক্তি সত্যিই ক্লান্ত হয়ে থাকেন এবং ঘুমোতে চান অথবা অর্ধনিদ্রায় থাকেন তাহলে তার সংবেদনশীলতা নিয়ে গভীর এবং অর্থপূর্ণ কথোপকথন করার ক্ষেত্রে সেটা সঠিক সময় নয়। যদি তিনি সত্যিই কোন কাজে ভীষণ ভাবে ব্যস্ত হয়ে থাকেন তাহলে সেক্ষেত্রেও এটা একইভাবে প্রযোজ্য। সেটা কোন সঠিক সময় নয়। ঠিক আছে?

Top