চতুর্থ আর্যসত্যঃ মার্গসত্য

যে প্রকৃত পথ (মার্গসত্য) প্রকৃত দুঃখের প্রকৃত অবসান ঘটায় সেটা হল শূন্যতার নির্বিকল্পিত উপলব্ধি। আমরা, অন্যরা এবং সমস্ত ধর্ম কীভাবে অস্তিমান আছি তার সম্পর্কে আমরা মিথ্যাভাবে যে কল্পনা করি, তার অনুরূপ কোন কিছুর সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি হল শূন্যতা। শূন্যতার নির্বিকল্পিত জ্ঞানই হল মনের একটা প্রকৃত পথ আর সেই অর্থে এটা প্রকৃত নিরোধ অবস্থার দিকে পরিচালিত করার জন্য একটা পথ হিসাবে কাজ করে।

প্রথম তিন আর্যসত্য

বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছিলেন, আমরা সবাই যে প্রকৃত দুঃখের মুখোমুখি হই সেটা হল আমরা আমাদের অসুখীতা এবং অতৃপ্ত সুখের উত্থান এবং পতনের অনুভূতিকে স্থায়ী করি এবং তার সাথে বারবার একটা সীমিত শরীর এবং মন প্রাপ্ত করি, যার মাধ্যমে আমরা সেগুলি ভোগ করি। আমরা এবং এই অনুভূতিগুলি কীভাবে অস্তিমান রয়েছে তার সম্পর্কে আমাদের অসচেতনতা (অবিদ্যা) হল এর প্রকৃত কারণ। আমরা কল্পনা করি যে সেগুলি অসম্ভব উপায়ে অস্তিমান- উদাহরণ স্বরূপ, স্বয়ংসম্পূর্ণ নিটোল সত্তা হিসাবে- আর বিশ্বাস করি যে এই বিভ্রান্তমূলক উপায়ে যেভাবে সেগুলি আমাদের সামনে অস্তিমান আছে সেগুলি বাস্তবে যেভাবে অস্তিমান থাকা দরকার তার অনুরূপ রয়েছে। এই ভুল ধারণাটি অশান্তকারী আবেগকে সূত্রপাত করে। ফলস্বরূপ, আমরা যাকে “আমি” ব’লে কল্পনা করি সেটাকে জোরদার বা রক্ষা করার জন্য বাধ্যতামূলক কর্মের প্ররোচনা সৃষ্টি করে যা নিছকই কল্পনা মাত্র। এই ভুল ধারণা আমাদের মৃত্যুকালে একটা সীমিত শরীর এবং সীমিত মনের সাথে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক পুনর্জন্মের (সংসার) সূত্রপাত করে। তবে বুদ্ধ উপলব্ধি করেছিলেন এবং উপদেশ দিয়েছিলেন যে, এই প্রকৃত কারণগুলি এবং তার ফলে উদ্ভূত দুঃখগুলি পরিহার করা সম্ভব যাতে সেগুলি আর কখনো উৎপন্ন না হতে পারে। চতুর্থ আর্যসত্য প্রকৃত প্রতিষেধকের সাথে সম্পর্কিত যা এই ধরণের একটা প্রকৃত নিরোধ বা অবসান ঘটায়।

অবিদ্যাকে চিরতরে পরিহার করার প্রকৃত পথ হল সম্যক্‌ জ্ঞান

সাধারণতঃ, আমরা যখন কোন অসুখীতা, অতৃপ্ত সুখ অথবা কিছুই না- এর অনুভূতি অনুভব করি তখন আমরা এই কল্পনা ক’রে সেটা থেকে একটা অসাধারণ এবং নিটোল কিছু তৈরী করি যে, সেটা চিরকাল টিকে থাকবে। কিন্তু অবশ্যই আমরা যে অনুভূতি অনুভব করি সেখানে বিশেষ বলতে কিছুই থাকে না- সেগুলি সবই অস্থির এবং অস্থায়ী। সেগুলি যতক্ষণ টিকে থাকে ঐ সময় সেগুলি ক্রমাগতভাবে তীব্রতায় পরিবর্তন হতে থাকে আর অবশেষে সবই স্বাভাবিকভাবে সমাপ্ত হয়ে যায়। এই সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে এবং বিপরীতভাবে চিন্তাভাবনা ক’রে আমরা আমাদের মস্তিষ্কে ঐ আওয়াজের কারণে প্রতারিত হই, ফলে আমরা উচ্চস্বরে চিৎকার ক’রে ফেলি, “আমি এই সুখ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হতে চাই না; এটা খুবই চমৎকার” অথবা “আমি এই অসুখীতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই; এটা খুবই ভয়াবহ; আমি এটা সহ্য করতে পারছি না।” অথবা “আমি চাই এই অনুভূতি যেন কখনোই হ্রাস না হয়; এটা খুবই স্বস্তিকর।” “আমি”-এর উপর এই স্থিরকরণ এবং কিছু নিটোল সত্তার উপর “আমি”-এর স্ফীতি অশান্তকারী আবেগ এবং বাধ্যতামূলক আচরণকে সূত্রপাত করে, যা প্রকৃত দুঃখকে স্থায়ী ক’রে তোলে।

নিজেকে একবার জিজ্ঞাসা করুন, আপনি কেন মনে করেন যে আপনি “আমি” নামক একপ্রকারের নিটোল সত্তা হিসাবে অস্তিমান আছেন, যা স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা শরীর ও মন থেকে স্বাধীন এবং আপনার মস্তিষ্কের আওয়াজের লেখক? আপনি যদি বলেন, “এটা এমন মনে হয় এবং সেইজন্য আমি তেমন মনে করি”, তাহলে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, “কারণ আমি মনে করি” এই ধারণাটা কি কোন কিছুকে বিশ্বাস করার একটা উপযুক্ত কারণ? আমরা যখন কল্পনার কোন অভিক্ষেপে বিশ্বাস করি, বিশেষ ক’রে নিজেদের সম্পর্কে, “কারণ আমি তাই মনে করি” শুধুমাত্র এর উপর ভিত্তি ক’রে, তাহলে আমরা কেন এটা সম্পর্কে অনিরাপদ বোধ করি? এর কারণ হল আমাদের কাছে ভুল বিশ্বাসকে সমর্থন করার কিছু নেই; এটা তথ্য বা কারণ দ্বারা সমর্থিত নয়।

আসল বিষয়টা হল কোন কিছু দেখা, শ্রবণ করা, গন্ধ শোকা, স্বাদ গ্রহণ করা, শারীরিকভাবে অনুধাবন করা অথবা চিন্তন করার সময় আমরা সুখ, দুঃখ অথবা সুখ-দুঃখ ব্যতীত কিছু না কিছু অনুভব ক’রে থাকি কিন্তু সেই অনুভূতিতে বিশেষ বলতে কিছুই থাকে না। সেগুলির মধ্যে কোনটাকে আঁকড়ে ধরার মতো কিছুই থাকে না। সেগুলিকে আঁকড়ে ধরা হল একটা মেঘকে আঁকড়ে ধরার মতো- একেবারে নিরর্থক কিছু। আর “আমি” এবং যেকোন মুহূর্তে ‘আমি’ যা অনুভব করি সেগুলি সম্পর্কিত বিশেষ বলতে কিছু থাকে না। আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে কথা বলে এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ নিটোল সত্তারূপে আমাদের কোন অস্তিত্ব নেই, যার সর্বক্ষণ নিজের স্থান পাওয়ার প্রয়োজন হয়। আমরা অস্তিমান কিন্তু অসম্ভব উপায়ে নয় যার প্রতি আমরা ভুল ধারণা করি এবং বিশ্বাস করি, কেবল এই কারণেই সেরকম মনে হয় এবং “আমি তাই মনে করি”।

নিজেদের সম্পর্কে এই ধরণের ভ্রান্ত ধারণা এবং বিভ্রান্তিকর বিশ্বাস থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে আমাদের এমন এক প্রতিপক্ষের প্রয়োজন হয় যে সেগুলিকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আমাদের মনকে শান্ত করা এবং এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা করা বন্ধ করলে সেটা সাময়িকভাবে আমাদের বিভ্রান্তিকে দমন করতে পারে, কিন্তু সেগুলি এটাকে পুনরায় উৎপন্ন হতে প্রতিরোধ করে। আমাদের প্রকৃত সমস্যার এই প্রকৃত কারণের প্রকৃত নিরোধ অবস্থা লাভের জন্য মনের প্রকৃত পথের প্রয়োজন হয়। এরজন্য এমন একটি মনের অবস্থার প্রয়োজন যেটা হল আমাদের অসচেতনতার বা অজ্ঞতার পারম্পরিক অনন্য বিপরীত। তাহলে আমাদের কেমন সচেতনতার প্রয়োজন? বেশ, আমরা একধরণের স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তারূপে অস্তিমান। এর সম্পর্কে যে ভুল ধারণা আছে যা সেটাকে নিশ্চিহ্ন করে সেটা হল নির্বিকল্পিত জ্ঞান। এই জ্ঞান বলতে শূন্যতাকে উপলব্ধি করার নির্বিকল্পিত জ্ঞান। আর এটা কোন একটি ধারণার মাধ্যমে শূন্যতার উপর মনোনিবেশ করাকে বোঝায় না। এই জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তাকে অনস্তিমানরূপে উপলব্ধি করতে পারি। কারণ এবং নির্বিকল্পিত অভিজ্ঞতার উপর আধারিত জ্ঞান যা আমরা ভুলবশতঃ বিশ্বাস ক’রে থাকি, সেটা বাস্তবতার সাথে মিল খায় না। সেটা মিথ্যা বিশ্বাসকে নিশ্চিহ্ন ক’রে দেয়, যে ভুল বিশ্বাসের ভিত্তিতে আমরা বিশ্বাস করি যেটা বাস্তবতার সাথে মিল খায়, কারণ এটা ভিত্তি করে “কারণ আমি সেরকম মনে করি” আর এই অসচেতনতাই হল মিথ্যা। যেহেতু অসচেতনতার প্রবণতা এবং অভ্যাসগুলি গভীরভাবে অন্তর্নিবদ্ধ হয়ে থাকে, তাই সেগুলির বিলুপ্তি ধীরে-ধীরে, আংশিকভাবে এবং পর্যায়ক্রমে ঘটে।

একটা প্রকৃত পথের (মার্গসত্য) চারটি বৈশিষ্ট্য

বুদ্ধ ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, প্রকৃত পথটি প্রভেদমূলক সচেতনতা (জ্ঞান) এর পরিপ্রেক্ষিতে উপলব্ধি করা যেতে পারে যা শূন্যতার নির্বিকল্পিত জ্ঞানের সাথে সংযুক্ত। এই চেতসিক বা চৈত্ত পার্থক্য করে যে কোনটা মিথ্যা এবং কোনটা সত্য।

  • প্রথমত, এই প্রভেদমূলক সচেতনতা হল মনের একটা পথ যা ক্রমাগতভাবে অজ্ঞানতার বিভিন্ন স্তরের বিলুপ্তি এবং সম্পূর্ণ অবসানের দিকে যায়। প্রাথমিকভাবে, এটা আমাদের চিরতরে অজ্ঞানতা এবং বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দেয় যা উৎপন্ন হয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের একটি ভিন্ন ব্যবস্থা শেখা এবং গ্রহণ করার উপর ভিত্তি ক’রে। যেমন- আমাদের মাতা-পিতা এবং সমাজ আমাদের মধ্যে সেগুলিকে অন্তর্নিবদ্ধ ক’রে রেখেছে। এটা বানিজ্যিক বিজ্ঞাপন এবং সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত বিষয়গুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করে।

    আপনি যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখেন যে, সেখানে লোকজনদের সেলফিগুলি ভাল দেখাচ্ছে এবং তারা তাদের সময়টাকে ভালভাবে উপভোগ করছে তখন সেটা কীভাবে আপনার ধারণাকে প্রভাবিত করে; আপনি মনে করেন আপনার দেখতে কেমন হওয়া উচিত এবং আপনার জীবনটা কেমন হওয়া উচিত? এটা কি আপনার নিজের সম্পর্কে ভাল বা খারাপ অনুভব করায়? এই পোষ্টগুলি কোনভাবেই বাস্তব জীবনকে প্রতিফলিত করে না, এমন মিথ্যা বিশ্বাস থেকে চিরতরে নিজেকে মুক্ত করার পথ হল প্রভেদমূলক সচেতনতা। পরিণামস্বরূপ, এই সচেতনতা আমাদের ঐ ধরণের অসুখীতা এবং হতাশা থেকে চিরতরে মুক্তি দেয়। আমরা যখন নিজেদেরকে তাদের সাথে তুলনা করি এবং সেরকম হতে চাই তখন সেটা আমাদের মধ্যে এই ধরণের ভুল বিশ্বাস তৈরী করে।

    এই প্রথম ধাপের বাইরে আমরা যখন আরও পরিচিতি সহ একজন ‘আর্য’ বা উচ্চ উপলব্ধিকৃত সত্তা হয়ে উঠি তখন এই প্রভেদমূলক সচেতনতা আমাদের পর্যায়ক্রমে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভূত অজ্ঞানতা থেকে চিরতরে মুক্তি দেয়, উদাহরণ স্বরূপ, কল্পনার উপর আধারিত আমাদের মস্তিষ্কে প্রায় নিয়মিতভাবে উপস্থিত আওয়াজের পিছনে আছে একটা অনুসন্ধান যোগ্য “আমি” নামক নিটোল সত্তা। আমরা মুক্তি লাভ করি এবং অবশেষে লাভ করি বোধি। আমরা যখন বুঝতে পারি যে শূন্যতার প্রভেদমূলক সচেতনতা প্রকৃত দুঃখের এই প্রকৃত কারণগুলি থেকে চিরতরে মুক্তি দেয় তখন সেটা আমাদের মিথ্যা ধারণা দূর ক’রে দেয়, যে মিথ্যা ধারণা আমাদের বিভ্রান্ত করে যে সেগুলি থেকে মুক্তি লাভ করার কোন উপায় নেই।
  • দ্বিতীয়ত, প্রভেদমূলক সচেতনতা এই পথ প্রদর্শন করে যে “আমি” নামক স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং নিটোল সত্তা ব’লে কিছু নেই। এই প্রভেদমূলক সচেতনতা হল এমন একটা জিনিস যা অসচেতনতা এবং ভুল বিশ্বাসকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার উপযুক্ত উপায়। এর কারণ হল এটা পারস্পরিকভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত। আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না যে একই সময়ে কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকে আবার থাকে না, বিশ্বাস করতে পারবেন কি? এই বিন্দুটি ঐ ভুল ধারণা দূর করে যে এই প্রভেদমূলক সচেতনতা হল প্রকৃত নিরোধ অবস্থা লাভ করার একটা অনুপযুক্ত উপায়।
  • তৃতীয়ত, শূন্যতার প্রভেদমূলক সচেতনতা হল পর্যায়ক্রমে একজন আর্য হওয়া, একজন মুক্ত সত্তা হওয়া এবং বোধিপ্রাপ্ত বুদ্ধ হওয়ার বাস্তবিক উপায়। এই সচেতনতাটি এই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে প্রতিহত করে যে, সমাধির গভীর অবস্থার মধ্যে যেকোন একটি অবস্থা হল ঐ প্রাপ্তিগুলিকে বাস্তবায়িত করার উপায়।
  • সর্বশেষে, মুক্তি এবং বোধিলাভ অর্থাৎ নিঃশ্রেয়স্‌ লাভ করতে বাধা সৃষ্টিকারী অশান্তকারী আবেগ এবং সেগুলির প্রবণতা ও অভ্যাসগুলিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার উপায় হল এই প্রভেদমূলক সচেতনতা। এই সচেতনতাটি এই ভুল ধারণাকে প্রতিহত করে যে এগুলি হল আমাদের মনের স্বভাবের অংশ এবং সেগুলিকে কখনোই পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করা যায় না।

সারাংশ

প্রভেদমূলক সচেতনতা দ্বারা নিশ্চিহ্ন করা শূন্যতার নির্বিকল্পিত জ্ঞানসম্পন্ন মনের প্রকৃত পথ হল আমাদের প্রকৃত দুঃখের প্রকৃত কারণগুলির বিলুপ্তকারী প্রতিপক্ষ। একবার এই মনের সত্য পথটা অর্জন হয়ে গেলে এটা আমাদের পর্যায়ক্রমে, চিরতরে অজ্ঞানতা এবং ভুল বিশ্বাসগুলি থেকে মুক্তি দেয়, যে অজ্ঞানতা এবং ভুল বিশ্বাস আমাদের জন্য জন্ম-জন্মান্তর পর্যন্ত প্রকৃত দুঃখের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্তিকে স্থায়ী ক’রে তোলে। তাই এই ধরণের মনের প্রাপ্তিই কি একটা সবচেয়ে সার্থক জিনিস নয় যার জন্য আমরা চেষ্টা করতে পারি?

Top