রিয়েল থিং ধর্মের জন্য অনুপ্রেরণার তিনটি স্তর
মার্গক্রম (লাম-রিম) অনুপ্রেরণার তিনটি স্তর উপস্থাপন করে-
- প্রাথমিক স্তর- আমরা কেবল পরবর্তী জীবনকালেই নয়, ভবিষ্যতের সমস্ত জীবনকালে আমাদের আরও একটা ভাল পুনর্জন্মের বিষয়টা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিবেচনা করি।
- মধ্যবর্তী স্তর- আমাদের অনুপ্রেরণা হ’ল- অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ; আমরা মুক্ত হতে চাই।
- উন্নত স্তর- আমরা প্রত্যেকেই অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি লাভ করতে সহায়তা প্রাপ্ত করার জন্য একটা সম্বুদ্ধের অবস্থায় পৌঁছনোর লক্ষ্য নির্ধারণ করি।
এটা একেবারেই সুস্পষ্ট যে, প্রতিটি স্তরের পুনর্জন্ম অনুমানের উপর ভিত্তি করে। তবুও, যেমনটি আমরা আগে আলোচনা করেছি, এই তিনটি স্তরের উপাদানগুলিতে যে সমস্ত পদ্ধতি উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটি ধর্ম-লাইট স্তরেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই অনুপ্রেরণাগুলি এমন নয় যেগুলিকে আমাদের তুচ্ছ মনে করা উচিত। কারণ আমরা যদি আন্তরিকভাবে তাদের উন্নতি করতে পারি তাহলে সেগুলি সত্যিই যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে।
মূল্যবান মানব জীবনের প্রশংসা ক’রে নিজের জন্য দুঃখ অনুভব করা কাটিয়ে ওঠা
প্রাথমিক স্তরের অনুপ্রেরণার সাথে, আমাদের যে বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন সেটা হ’ল- আমরা যেটাকে “মূল্যবান মানব জীবন” বলি সেটাকে উপলব্ধি করা। এমনই ধর্ম-লাইট স্তরেও, এই “আমি বেচারা” এবং সেখান থেকে উদ্ভূত বিষন্ন অনুভূতিগুলি অভিভূত করাটা খুবই কার্যকর। আমরা যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে পারি সে সবগুলিই আমরা অনুধাবন করি এবং যেটা পরিস্থিতির মধ্যে নেই সেটা যে কী চমৎকার তার প্রশংসা করার চেষ্টা করি।
মানক উপস্থাপনায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিগুলির একটা বৃহৎ তালিকা রয়েছে, তবে এখানে তার বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনা করার দরকার নেই। তার বিষয়ে আমরা সাধারণভাবে বিবেচনা করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ভাবি যে, আমরা কত ভাগ্যবান, আমরা কোনও যুদ্ধক্ষেত্রে বসবাস করি না, আমরা দুর্ভিক্ষের মধ্যেও নেই, অনাহারে মারা যাচ্ছি না এবং আমাদের সন্তানদের জন্য ভোজন জোগাতে পারছিনা। আমরা সেই সৌভাগ্যের কথা ভাবি যে, আমরা একটা সীমাবদ্ধ সমাজে একনায়কতন্ত্রের অধীনেও বসবাস করি না। বয়স্ক ব্যক্তিদের পক্ষে এখানে রোমানিয়ার সাথে সম্বন্ধস্থাপন করাটা আরও সহজ হতে পারে। আমরা কত ভাগ্যবান যে, আমরা মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে বা আবেগগতভাবে গুরুতর প্রতিবন্ধী নই। স্পষ্টতই বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যে কত ভাগ্যবান সেটাও আমরা বিবেচনা করি যে, আমরা একটা আরশোলা তো নই যাকে যে কেউ শুধু পায়ে পিষে মেরে ফেলতে চায়।
এই ধরণের চিন্তা-ভাবনার অনেকগুলি সম্প্রসার আছে। আমরা যখন সত্যিই নিজেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে দেখি তখন আমরা নিজেদের সত্যিই অবিশ্বাস্যভাবে ভাগ্যবান মনে করি যে, আমাদের কাছে এই স্বাধীনতাগুলি রয়েছে। শুধু এই জিনিসগুলির স্বাধীনতা আছে তা নয়, বরং আমাদের বুঝতে হবে যে, আমরা যে কোনও সময় এটাকে হারাতে পারি, যেমন- অ্যালঝাইমার রোগ। বর্তমানে একটা ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। আমরা যে অবস্থায় রয়েছি সেটা বর্ণনা করতে ব্যবহৃত শব্দটা হ’ল “বিরাম”, যার অর্থ হ’ল- এটা সত্যিকারের খারাপ পরিস্থিতি থেকে বিরতি। এই বিরামটা যে কোনও সময় সমাপ্ত হতে পারে।
এই স্বাধীনতাগুলিকে একপাশে রেখে আমাদের বিভিন্ন বিষয়গুলির দিকে নজর দেওয়া দরকার যা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের বেশীরভাগ তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যকর। অবশ্যই আমাদের মধ্যে অনেকে অসুস্থ হতে পারে, তবে এই মুহুর্তে আমরা কাজ করতে সক্ষম। বুদ্ধ শিক্ষাদান করেছেন, শিক্ষাগুলি হস্তান্তরিত হয়েছে এবং এখন আমাদের কাছে উপলব্ধ আছে। আমাদের শেখার জন্য সেখানে অনেক শিক্ষক এবং গ্রন্থও রয়েছে। স্পষ্টতই আমাদের কাছে অনেক সুযোগ উপলব্ধ আছে। এই পরিস্থিতিতে, আমাদের যে স্বাধীনতা এবং সমৃদ্ধি রয়েছে সেটা চিনতে হবে আর আমরা কতটা ভাগ্যবান সেটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
মৃত্যু এবং অনিত্যতা সম্পর্কে ভাবনা করা যাতে আমাদের মূল্যবান সুযোগগুলি নষ্ট না হয়ে যায়
প্রাথমিক ক্ষেত্রের পরবর্তী বিষয়টি সত্যিই বুঝতে হবে যে, আমাদের মূল্যবান জীবন চিরকালের জন্য স্থায়ী হচ্ছে না। এটা যে আমাদের জীবনকালেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় সেই ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, আসলে আমরা সকলেই মরে যাব। অতএব আমরা মৃত্যু সম্পর্কে প্রচুর ধ্যানের ব্যাখ্যা পাই। অনেক মানুষ, অনেক সমাজে মৃত্যুকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে যা প্রায়শই একটা নিষিদ্ধ বিষয়। আমরা বাস্তবে সত্যটা গ্রহণ করি না যে, এক পর্যায়ে আমরা মরতে চলেছি। এর মধ্যে রয়েছে আমাদের প্রিয়জন, প্রত্যেক ব্যক্তি যাদের আমরা জানি এবং আমরা নিজেরাই। এটাই বাস্তব।
আমরা সকলেই নিশ্চিতভাবে মরতে চলেছি, এই সত্যটিকে সমর্থন করার অনেক কারণ রয়েছে। যাঁরা একসময় জীবিত ছিলেন তাঁরা সকলেই মারা গেছেন। যদি তাই হয়, আমরা কেন বিশেষ বা তাদের থেকে আলাদা? মৃত্যুর চূড়ান্ত কারণটা হ’ল জন্ম নেওয়া। সুতরাং আমরা যদি জন্মগ্রহণ করে থাকি তাহলে আমরা অবশ্যই মরে যাব। বয়স বাড়ার সাথে-সাথে আমাদের শরীর বেশ দুর্বল হয়ে যায় এবং ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। আমরা প্রায়শই যেমনটা মনে করি এটা ততটা শক্তিশালী নয়, বরং খুব সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত ও আহত হতে পারে। আমাদের এটাকে যুক্তিযুক্তভাবে বুঝতে হবে যাতে এটা আস্তে-আস্তে সংবেদনশীল স্তরে ডুবে যায়।
আমরা অবশ্যই মরে যাচ্ছি, এই সত্যটা ছাড়াও দ্বিতীয় বিষয়টা হ’ল আমরা কখনই জানতে পারি না যে, সেটা কখন ঘটবে। মৃত্যুর জন্য আমাদের বৃদ্ধ বা অসুস্থ হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। বহু যুবা ও সুস্থ মানুষ বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষের অনেক আগে মারা যায়। সম্প্রতি একটি বড় বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু তারা যখন বিমানে উঠেছিল তখন তারা বিধ্বস্ত হবে ব’লে কেউ আশা করেনি। আমরা যে কোনও সময় একটা বাসের ধাক্কা খেতে পারি। আমার নিকটতম বন্ধু, যার বয়স ছিল ৫৪ বছর এবং ছিলেন পুরোপুরি সুস্থ, হঠাৎ দুই সপ্তাহ আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
এরকম অনেক কারণ আছে যা সমর্থন করে যে, মৃত্যু যে কোনও মুহুর্তে আসতে পারে। মৃত্যু আমাদের কাজ, খাবার-খাওয়া অথবা আমরা যা কিছু করছি সেটা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে না। আমরা মৃত্যুকে বলতে পারি না, “এক মিনিট অপেক্ষা করুন, আমাকে এটা শেষ করতে দিন।” মৃত্যু যখন আসে, সেটা তখন আসে এবং আমাদের জীবন শেষ হয়ে যায়। আমাদের সময় যখন শেষ হয়ে যায় তখন এটা বাড়ানোর জন্য আমরা কিছুই করতে পারি না। আপনি মৃত্যুকে ঘুষ দিতে পারেন না। আমরা একটা জীবনদায়ী যন্ত্রের দ্বারা আমাদের শরীরকে টিকিয়ে রাখতে পারি, কিন্তু শাক-সবজির মতো অবস্থায় থাকার কী দরকার কারণ তারপরেও আমাদের জীবন শেষ পর্যায়ে চলে যাবে।
মৃত্যুর তৃতীয় বিষয়টি হ’ল আমরা যখন মৃত্যুর মুখে পৌঁছে যাই তখন সেটা আমাদের জন্য কী সহায়ক হবে সেটা পরীক্ষা করা। মৃত্যুর সময় আমরা আমাদের সাথে কোনও অর্থ, বন্ধু বা পরিবার নিয়ে যেতে পারি না। এমনকি আমরা যদি একটা পিরামিডও তৈরী করি এবং মরে যাওয়ার সময় সেটাকে সাথে বিঁধিয়ে রাখি, তাহলে সেটাও আমাদের সাথে আসবে না। বৌদ্ধ দৃষ্টিকোনে আমরা বলি, আমাদের যখন মৃত্যু হয় তখন বাস্তবে যেটা আমাদের সহায়ক হয় সেটা হ’ল- আমাদের চিত্ত-সন্ততিতে যে ইতিবাচক অভ্যাসগুলি নির্মাণ করেছি শুধু সেইগুলি।
হতে পারে আমরা প্রচুর ইতিবাচক কাজ করেছি এবং অন্যকে সাহায্য করেছি অথবা আমাদের ক্রোধ, স্বার্থপরতা ইত্যাদি হ্রাস করার ক্ষেত্রে আমরা আধ্যাত্মিক পথে অনেক উন্নতি করেছি। এটা আমাদের চিত্ত-সন্ততিতে গভীর প্রভাব ফেলে। “ধর্ম-লাইট” দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, ঐ রকম ইতিবাচক কাজ করলে মৃত্যুর সময় আমরা অনুশোচনা ছাড়াই মৃত্যুকে বরণ করতে পারি এবং অনুভব করতে পারি যে, আমরা একটা সার্থক এবং ইতিবাচক জীবন-যাপন করেছি, বিশেষ করে আমরা যদি প্রিয়জনদের যত্ন নিয়ে থাকি বা বৃহত্তর রূপে সমাজে কিছুটা অবদান রেখে থাকি। আমাদের সেই মানসিক শান্তি, অনুভূতি এবং চিন্তা-ভাবনা থাকবে, “আমি একটা ভাল, সার্থক জীবন-যাপন করেছি”।
“রিয়েল থিং ধর্মের” ক্ষেত্রে, আমরা কিছুটা আত্মবিশ্বাসের সাথে মরে যেতে পারি যে, আমাদের চিত্ত-সন্ততিতে সঞ্চিত এই ইতিবাচক অভ্যাস, প্রবণতা এবং প্রবৃত্তি অপর জন্মে বা ভবিষ্যতের জীবনে অবিরত থাকবে। আমরা এই অনুভূতির সাথে মরে যাব, “অপর জন্মে আমি একটা বহুমূল্য মানব জীবন বজায় রাখতে পারব। আমি অত্যন্ত ইতিবাচক প্রবৃত্তি সহ একটা শিশু রূপে জন্মগ্রহণ করব।” আমরা নিজেরাই এই সবকিছু শিশুদের মধ্যে দেখতে পাই। যেমন, কিছু ছেলে-মেয়ে আছে যারা খুব অল্প বয়সেই সব সময় কাঁদতে থাকে এবং ক্রোধিত হয়, আবার অন্যরা শান্ত স্বভাবের হয় এবং অন্যের প্রতি সদয় থাকে। এসব কিছুই ইতিবাচক অভ্যাসের পরিণাম যা তারা পূর্ব জন্মে গড়ে তুলেছিল। মৃত্যুকালে আমাদের মন যদি শান্ত অবস্থায় থাকে তাহলে এটা খুবই সহায়ক হয়। ব্যাঙ্কে আমাদের নামে যে পরিমান অর্থ রয়েছে সেটা আমাদের কোনওভাবেই স্বস্তি প্রদান করে না, কারণ মৃত্যুর সময় এটা শুধু কম্পিউটারের স্ক্রিনের নম্বর হয়ে থাকবে।
মৃত্যুর উপর ধ্যান
উপরে বর্ণিত কারণের ভিত্তিতে আমাদের কাছে অনুশীলন করার জন্য যেটা আছে সেটা হ’ল “মৃত্যুর উপর ধ্যান।” সেখানে আমরা কল্পনা করতে পারি যে, আজ আমাদের শেষ দিন। আমরা নিজেরাই জিজ্ঞাসা করি, আমরা কি যেকোনও সময় মরতে প্রস্তুত? আমি যদি আজ মরে যাই তাহলে কি আমি আমার জীবন-যাপন প্রণালীর জন্য অনুশোচনা করব যেভাবে আমি এটাকে পরিচালনা করেছি? এর মূল বক্তব্য অবশ্যই হতাশাগ্রস্ত হওয়ার জন্য নয়, বরং আমাদের এই মূল্যবান মানব জীবন এবং এখন যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে সেগুলিকে কাজে লাগাতে উৎসাহ প্রদান করা। সেটাই ধ্যানের পুরো লক্ষ্য। এটার অর্থ এই নয় যে আমি প্রত্যেকদিন ক্রমাগত বয়স্ক হয়ে চলেছি, বরং আমি ক্রমাগত মৃত্যুর কাছাকাছি যাচ্ছি। প্রতিটা দিন শেষ হওয়ার সাথে আমাদের জীবিত থাকার একদিন কমে যায়। সময় ফুরোতে থাকে এবং আমাদের ধারণাই নেই যে আর কতটুকু সময় আমরা অবশিষ্ট রেখেছি। অতএব অকারণে সময় নষ্ট না করে আমরা সত্যিই আমাদের জীবনটাকে সর্বোত্তম ব্যবহার করতে চাই। মনের এমন একটি অবস্থার সাথে মরে যাওয়াটা, যেখানে আমরা বুঝতে পারি যে, আমরা সত্যিই আমাদের জীবনকে নষ্ট করেছি এবং আমরা আরও কিছু অর্জন করতে পারতাম, একান্ত ভয়ঙ্কর অবস্থা।
“আমি আমার সুযোগ নষ্ট করছি না,” মনের এই অবস্থাটাকে ভারসাম্যভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই ধর্মান্ধ হয়ে ওঠা উচিত না এবং ভয়ে থাকা অবস্থায় কাজ করা বা ধ্যান করা থেকে বিরত থাকা উচিত। আমাদের যদি সত্যিই প্রয়োজন হয় তাহলে আমাদের শিথিল হওয়া এবং বিরতি নেওয়া দরকার যাতে আমরা সেটাকে ক্রমাগত চালিয়ে যেতে শক্তি পাই। আমার প্রিয় জেন কোয়ান (ধাঁধা) হ’লঃ “মৃত্যু যে কোনও সময় আসতে পারে। আরাম করুন।” আপনি যদি এই সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন, তাহলে বাস্তবে অনেক অর্থ বোঝাবে। হ্যাঁ, আমরা যে কোনও সময় মরে যেতে পারি, কিন্তু এই বিষয়ে বিচলিত এবং ধর্মান্ধ হওয়া হ’ল নিজেকে পরাজিত করা।
মূল বার্তাটি হ’ল আমাদের আশ্চর্যরূপে বহুমূল্য মানব জীবনে যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে সেগুলিকে কাজে লাগানো, তবে এগুলিকে করতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে। যখন প্রয়োজন হবে আমরা তখন শিথিল হতে পারি এবং আমরা যখন সত্যিই ক্লান্ত না হই; অলস হয়ে পড়ি তখন নিজের সাথে সৎ হতে পারি। আমাদের অনুপ্রেরণা আমাদের মাথায় রাখার চেষ্টা করা উচিত।
স্পষ্টতই, “ধর্ম-লাইট” এবং “রিয়েল থিং ধর্ম” উভয় ক্ষেত্রে মৃত্যু সচেতনতার ধ্যানকে প্রয়োগ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি এমন কিছু জিনিস থাকে যেগুলি আমরা না করে পূর্বাবস্থায় ফেলে রেখেছি, যেমন- আমি কাউকে ভালবাসি এবং তাঁরা যা কিছু করেছে তাঁর প্রশংসা করা, ক্ষমা চাওয়া এবং কারও সাথে মিলিত হওয়া, তাহলে আমাদের তার জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়। এর কারণ হ’ল- সেই ব্যক্তিটি আগামী দিনে আমাদের আশেপাশে নাও থাকতে পারে এবং আমরাও হয়তো আগামী দিনে তার আশেপাশে নাও থাকতে পারি। এটাই ধর্ম-লাইট পাঠ যা আমরা মৃত্যু-সচেতনতা থেকে অর্জন করতে পারি। এটা যেকোনও স্তরে খুব উপকারী এবং সহায়ক। অতএব মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করা উচিত নয়, বরং সর্বদা এর জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। আমরা আমাদের নিজের মৃত্যু এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াগুলিকে দৃষ্টিপাত করতে পারি, যা আমাদের কাছে আরও কিছুটা বাস্তবিক হতে সহায়ক হতে পারে। শুধু নিশ্চিত হতে হবে যে, আমরা যেন কেবল এটার উপর নির্ভর না করি এবং যেন রোগব্যাধি বা হতাশায় পরিণত না হয়ে পড়ি।
আমাদের মৃত্যুকে অনুসরণ করতে পারে এমন পুনর্জন্মের সবচেয়ে খারাপ অবস্থাগুলির অভিজ্ঞতায় ভয়ের বিকাশ
এরপরে, আমাদের মৃত্যুর পর কী ঘটে তার পরীক্ষার সাথে এগিয়ে চলি। এখানে খারাপ পুনর্জন্মের একটা উপস্থাপনা রয়েছে যা আমাদের বোঝায় যে, আমরা সম্ভাব্য অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি এবং কীভাবে এটাকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া দরকার। আবার এটা মোটেও সহজ নয় কারণ বৌদ্ধধর্মের উপস্থাপনায় কেবলমাত্র পশুর পুনর্জন্মগুলিই অন্তর্ভুক্ত নয় যা আমাদের বর্তমান জন্মের চেয়েও খারাপ, কিন্তু এমন রূপও আছে যা আমরা আসলে দেখতে পাই না।
আমরা যখন পশুর পুনর্জন্ম নিয়ে বিবেচনা করি তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এতে সমস্ত রকমের পোকামাকড়, মাছ এবং প্রতিটি প্রজাতি ও শ্রেণী উপলব্ধ আছে। পশুর জগতে পুনর্জন্ম হওয়াটা যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তার অনেক উদাহরণ আছে। তারা সব রকমের ভয় ও দুঃখ সহ্য করে। আমরা যখন প্রাণীর পুনর্জন্মের কথা ভাবি, তখন আমরা অট্টালিকায় থাকা নেইল পালিশ ব্যবহৃত কোনও পোডল (ক্ষুদ্র পোষা কুকুর)-এর জীবন সম্পর্কে কল্পনা করি না। বরং আমরা আরশোলা এবং ইঁদুরের কথাও ভাবি যা বেশিরভাগ মানুষ ঘৃণা করে; ছোট পোকামাকড় এবং মাছ যাদের বৃহত্তর প্রাণীরা জীবিত খেয়ে ফেলে; এবং অবশ্যই সেই প্রাণীগুলি যাদের শিল্পগতভাবে বড় করে তোলা হয় এবং পরে জবাই করা হয়।
ভবিষ্যতে এমন সম্ভাবনা সম্পর্কে এখানে যে আবেগ তৈরী হয়েছে তা প্রায়শই “ভয়” হিসাবে অনুবাদ করা হয়, তবে আমি নিশ্চিত নই যে এটাই সেরা শব্দ কিনা। এর কারণ হ’ল এটা হতাশাকে বোঝায়, যদিও এ সম্পর্কে আমরা কিছুই করতে পারি না। যাইহোক, এটাকে এড়ানোর জন্য আমরা কিছু একটা করতে পারি। তাই জন্য আমি “ভয়” শব্দটা পছন্দ করি যা আমরা সত্যিই দৃঢ়ভাবে চাই না যে এটা ঘটুক।
উদাহরণস্বরূপ, ধরুন একটা সত্যিই বিরক্তিকর সভার আয়োজন করা হয়েছে যাতে আমাদের যোগ দিতে হবে। আমরা সভাটিতে যেতে ভয় পাচ্ছি। বাস্তবে, যদিও সভাটি বিরক্তিকর এবং ভয়ানক হতে চলেছে, তাহলেও আমাদের ভয় পেলে চলবে না। এটা হ’ল আবেগ যা আমাদের জাগানো উচিত। আমাদের কাছে এই মূল্যবান জীবনটা আছে যা যে কোনও মুহুর্তে হারিয়ে যেতে পারে। অতএব আমরা আমাদের পরবর্তী জীবনে যেন একটা আরশোলা না হই সেটা নিশ্চিত করতে আমরা এর সুযোগটা নিতে চাই। একটা আরশোলা হওয়া খুবই ভয়ঙ্কর হবে এবং আমরা সত্যিই চাই না যে সেটা হোক। অতএব এটাকে এড়ানোর জন্য আমাকে কিছু একটা করতে হবে।
“রিয়েল থিং ধর্মে”, আমরা কেবল পশু এবং পোকামাকড়ের জন্মের কথা বলি না, বরং ভূত এবং নরক জগতের পুনর্জন্মের কথাও বলে থাকি। এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে আমাদের বিব্রত হওয়া উচিত নয়। বৌদ্ধধর্মের পক্ষে এই বিবরণগুলি শুধু আলমারিতে লুকিয়ে রাখাটা ঠিক নয়। এর পরিবর্তে আমরা খোলা মনের হতে পারি এবং বলতে পারি, “আমি সত্যিই এটা বুঝতে পারছি না।”
অমানবিক পুনর্জন্মের অবস্থাগুলি কীভাবে বোঝা যায়
আমরা মানসিক ক্রিয়াকলাপের সাথে বা অন্য কথায়, কিছু অনুভবে প্রতিটি মুহুর্তের সাথে এটার সম্বন্ধ স্থাপিত করতে পারি। প্রতিটি মুহুর্তের সাথে আমাদের মধ্যে একটা মানসিক হলোগ্রাম উত্থিত হয়, যা হ’ল বা যার অর্থ হচ্ছে কিছু দেখা, জানা বা চিন্তা করা ইত্যাদি। প্রতিটি মুহুর্তের অভিজ্ঞতার সাথে একরকম সুখ বা দুঃখের অনুভূতি থাকে। এটা প্রকৃতপক্ষে আমাদের কম্পিউটার থেকে আলাদা করে বলে মনে হয়। কম্পিউটারের মধ্যে এমন একটি তথ্য রয়েছে যা এক অর্থে এটা যোগাযোগ করে এবং এক অর্থে এটা বোঝে। তবে কম্পিউটার খুশি বা অখুশি বোধ করে না, এবং এটা বাস্তবে তথ্য অনুভব করে না। আমাদের মধ্যে যে খুশি এবং অখুশির অনুভূতি আছে সেগুলি আমাদের অভিজ্ঞতাকে সংজ্ঞায়িত করে। সুখ ও দুঃখের বর্ণালীটি অত্যন্ত বিশাল। আমরা বর্ণালীর যে পরিমাণটা অনুভব করতে সক্ষম সেটা আমাদের হার্ডওয়ারের উপর নির্ভরশীল; অন্য কথায়, আমাদের কাছে দেহের যে ধরণটি আছে।
এটা কেবল সুখ এবং দুঃখ নয়, বরং বিভিন্ন জিনিস আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বোঝা যায়। কিছু লোকজন অন্যের চেয়ে বেশী দূরে দেখতে পারে, কিছু লোক অন্যের চেয়ে ভাল শুনতে পারে এবং কিছু লোক অন্যের চেয়ে তাপ এবং ঠান্ডা বেশী সহ্য করতে পারে। পশুর ক্ষেত্রে, কুকুর মানুষের চেয়ে অনেক বেশী উচ্চতর স্পন্দনের সাথে শুনতে পায়, কারণ এর আছে ভিন্ন ধরণের দেহ এবং সেইভাবে ভিন্ন ধরণের হার্ডওয়্যারও আছে। একটি ঈগল তার ঈগলী চোখ দিয়ে বেশী দূরের বস্তু দেখতে পারে যা আমরা আমাদের মানবীয় চোখ দিয়ে সেটা পারি না। যদি বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের ক্ষেত্রে এরকম হয় তাহলে কেন সুখী এবং দুঃখী বোধ করার বর্ণালীতে এটা সত্য হতে পারে না।
আমরা এই আলোচনায় আনন্দ এবং বেদনাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, যদিও তারা একইরকম নয়। সুখ এবং দুঃখ মানসিকভাবে অনুভব করি। অন্যদিকে আনন্দ এবং বেদনা, কমপক্ষে ইংরেজী ভাষায় আমাদের কাছে যে শব্দ রয়েছে তার ভিত্তিতে, বেশীরভাগ শারীরিকভাবে অনুভব করি। আমাদের মানবিক হার্ডওয়্যার সম্পর্কে বলতে গেলে, যখন শারীরিক দুঃখ প্রবল হয় তখন আমরা অজ্ঞান হয়ে পড়ি, আমরা মানসিক ব্যথা সহ ধাক্কা অনুভব করি এবং আমাদের শরীর কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
অন্যদিকে, আনন্দ হ’ল মজাদার। আপনি যদি চুলকানির বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখবেন এটা তীব্র আনন্দ দেয়। এটা মোটেও বেদনাদায়ক নয়। বাস্তবে এটা খুব আনন্দদায়ক এবং তাই আমরা সহজাতভাবে এটাকে আঁচড়িয়ে শেষ করে দিই। তীব্র চুলকানি দ্বারা দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের ব্যধিগুলির সাথে মোকাবিলা করার একটা উপায় যা চুলকানিকে আনন্দ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এটাকে চেষ্টা, আরাম এবং উপভোগ করাটা খুবই উন্নত এবং খুবই কঠিন, বিশেষ করে যদিও চুলকানি ক্ষতি করে। তাহলেও এটা সম্ভব। যাইহোক, আমরা যদি যৌন সুখের বিষয়টা বিবেচনা করি, সেই ক্ষেত্রে এটা যত তীব্র হয় আমরা তত তাড়াতাড়ি এটাকে ধ্বংস করার জন্য প্রচন্ড উত্তেজনা এবং শিখরে পৌঁছে যেতে চাই।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের কাছে থাকা এই হার্ডওয়্যারটি কেবলমাত্র সুখ এবং দুঃখ, আনন্দ এবং বেদনার বর্ণনার একটা নির্দিষ্ট অংশ অনুভব করতে সক্ষম। আমরা এটাও প্রতিষ্ঠিত করেছি যে প্রাণীরা বিভিন্ন সংবেদনশীল বর্ণালী, যেমন- দর্শন এবং শব্দের উপর আরও বেশী অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। সুতরাং এটা যৌক্তিকভাবে সম্ভব যে অন্যান্য ধরণের হার্ডওয়্যারও থাকতে পারে যা ব্যথা, আনন্দ, সুখ এবং দুঃখের বর্ণনায় আরও বেশী অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম। কেন হবে না?
এটাই হ’ল সেই মানসিক ক্রিয়াকলাপ যা আমরা জীবন থেকে জীবনে ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে আলোচনা করি। মারাত্মক দুঃখ এবং বেদনা থেকে অতি তীব্র আনন্দ এবং সুখ পর্যন্ত পুরো বর্ণালীটি অনুভব করতে সক্ষম না হওয়ার কোনও কারণ নেই। আমাদের প্রতিটি জীবদ্দশায় যে হার্ডওয়্যার থাকে সেটা কেবলমাত্র একটা বিষয়। এটা চেষ্টা করার একটা যুক্তিসঙ্গত উপায় এবং বৌদ্ধধর্মে বর্ণিত অন্যান্য জীবনগুলির, যাদের আমরা দেখতে পারি না, তাদের সম্পর্কে বিবেচনা করার জন্য কমপক্ষে খোলামেলা মন থাকা দরকার। আমরা অ্যামিবা (জীবানু বিশেষ) দেখতে পাই না, কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বৈজ্ঞানিক বিকাশের মাধ্যমে আমরা তাদের জীবনরূপে দেখতে পারি এবং স্বীকার করতে পারি। একইভাবে আমরা ভূতও দেখতে সক্ষম হই না, তবে মনের বিকাশের মাধ্যমে, সম্ভবতঃ এটা দেখা সম্ভব।
“ধর্ম-লাইট” সংস্করণ অন্যান্য সমস্ত জগতের সমস্ত রকমের মানুষের অভিজ্ঞতাকে হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ, হতে পারে কেউ মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপর্যস্ত যাদের দেখে মনে হয় তারা নরকে বাস করছে। এটা তাদের প্রতি সহানুভূতি জাগাতে সহায়তা করে এবং ভবিষ্যতে সে রকম না হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে। “ধর্ম-লাইট” স্তরের একটা ক্রিয়াকলাপ হিসাবে এটা ঠিক আছে। তবে “রিয়েল-থিং ধর্ম” শুধুমাত্র মানুষের অভিজ্ঞতার কথা বলে না, বরং মানসিক ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে আমরা এবং অন্য সবাই যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি তার সম্পর্কে কথা বলে। এই মানসিক ক্রিয়াকলাপের সাথে খুশী থেকে অখুশী, আনন্দ থেকে বেদনার বর্ণালীতে যে কোনও কিছুই থাকতে পারে। আমরা অবশ্যই এমন কিছু আধার রাখতে চাই না যা হ’ল সীমিত এবং ভবিষ্যতে কেবলমাত্র ভয়াবহ বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা সমর্থন করতে পারে। এটা পরিষ্কার।
ওটাকে এড়ানোর কোনও উপায় আছে কি? এটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রথমতঃ আমাদের জীবনে একটা নির্দিষ্ট ইতিবাচক দিক রাখতে হবে, যা আমাদের উক্ত অপেক্ষারত খারাপ পুনর্জন্মগুলিকে এড়াতে সক্ষম করে তুলবে। আসলে, এটা শুধু এই করবে না, বরং আমাদের মোক্ষ ও বোধিলাভের দিকেও নিয়ে যাবে।
আমাদের জীবনে নিরাপদ দিকনির্দেশনা প্রদান করাঃ শরণ-গমন
আমি “শরণ” শব্দটির প্রতি এতটা আগ্রহী নই যা খুব অসাড় ধ্বণিত হওয়ার মাধ্যমে কিছুটা বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়, যদিও আমরা ত্রাণকর্তা হিসাবে বুদ্ধের কাছে যাই, “ওহে বুদ্ধ, আমাকে রক্ষা কর!” এমনটি নয় যে, আমরা পশু যারা বন্যজীবনের শরণ নেয়। আমরা খুবই সক্রিয় কিছুর সম্পর্কে কথা বলছি, নিষ্ক্রিয় কিছুর সম্পর্কে একেবারে নয়। আমি এটাকে আমাদের জীবনে, “নিরাপদ দিকনির্দেশনা” হিসাবে বর্ণন করি। আমরা যদি এই দিকে যাই তাহলে আমরা আরও খারাপ পুনর্জন্মের অভিজ্ঞতা ও সম্পূর্ণরূপে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুনরায় পুনরুত্থান থেকে নিজেকে রক্ষা করি; পাশাপাশি অপরকে যতটা সম্ভব কার্যকরভাবে অক্ষম হওয়া থেকে রক্ষা করি।
“ধর্ম” শব্দটি যাকে সাধারণতঃ বুদ্ধের শিক্ষা (বুদ্ধবচন) হিসাবে অনুবাদ করা হয়, সেটাকে আসলে একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাকে বোঝায়। এটা এমন কিছু যা আমরা নিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করি যাতে ভবিষ্যতে সমস্যা বা দুঃখ রোধ করা যায় বা এড়ানো যায়। আমরা আমাদের জীবনে এই ব্যবস্থাগুলির বিকাশ করি যাতে আমরা খারাপ পুনর্জন্ম, অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্তি পুনর্জন্ম এবং অপরকে পুরোপুরি সহায়তা করতে অক্ষমতা, এই তিনটি সমস্যা এড়াতে পারি।
বুদ্ধ দ্বারা নির্দেশিত এই দিকটা কী? দিকটা বুদ্ধ নিজেই অর্জন করেছিলেন যেখানে সমস্ত বাধা, ত্রুটি, বিভ্রান্তি এবং বিরক্তিকর আবেগগুলি সম্পূর্ণভাবে নিরোধ হয়ে যায়। একই সাথে, মনের যে ইতিবাচক সম্ভাবনা রয়েছে বুদ্ধ সেই সমস্ত গুলির উপলব্ধি করেছেন। এটাই হ’ল সেই দিক যার বিষয়ে আমরা কথা বলছি। আমরা যখন বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের মূল্যবান এবং দুর্লভ বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘ রত্নের নিরাপদ দিকের কথা বলি তখন এটাই আসলে আমার অর্থ। ধর্ম হ’ল বুদ্ধ আসলে যা সম্পাদন করেছেন এবং তাঁর একই শিক্ষাগুলি আমরা সকলে লাভ করতে পারি। বুদ্ধ কাউকে ইঙ্গিত করেছেন যিনি সম্পূর্ণরূপে এটা অর্জন করেছেন। সংঘ বলতে শুধু বিহার বা বৌদ্ধ কেন্দ্রের মানুষদের বোঝায় না, বরং ভিক্ষুসংঘকে বোঝায়। বাস্তবে, এটাও আমাদের নিরাপদ দিক নয়। ত্রিরত্নের অংশ রূপে সংঘ বলতে উচ্চ উপলব্ধি প্রাপ্ত করা প্রাণীদের বোঝায় যারা কোনও বুদ্ধ দ্বারা সম্পূর্ণভাবে অর্জিত কিছু অংশ অর্জন করেছেন।
তদনুসারে, আমাদের প্রথমেই এটা করা দরকার। আমাদের আন্তরিকভাবে আমাদের জীবনে একটা নিরাপদ দিক বজায় রাখতে হবে অর্থাৎ আমরা কোন দিকে কাজ করছি। বুদ্ধ যা অর্জন করেছেন আমরাও সেটা অর্জন করার জন্য কাজ করি। যেভাবে একজন বুদ্ধ পুরোদমে করেছেন এবং যেভাবে সংঘ আংশিক করেছেন সেটা অর্জন করার জন্য আমরা কাজ করি। আমাদের জীবনে এই দিকটি স্থাপন করাটা প্রতিটি স্তরে একটা অবিশ্বাস্যভাবে পার্থক্য তৈরী করে, কারণ এখন আমাদের জীবনে সত্যিই একটা অর্থ এবং দিক আছে। আমরা আমাদের ত্রুটিগুলি থেকে মুক্ত হতে এবং আমাদের সম্ভাব্যতাকে উপলব্ধি করার জন্য নিজের উপর কাজ করছি। আমরা যদি এরকম করি তাহলে সাধারণতঃ আমরা আবেগগতভাবে আরও সুখী হব। কারণ আমরা ভাবব না, “আমি জানি না জীবন কী। আমি জানি না যে আমি এখানে কী করছি; আমার জীবনটা অর্থহীন।” ওটা মনের একটা ভয়াবহ অবস্থা। যখন মানুষের মধ্যে এটা থাকে তখন এটা প্রায়শই বোঝায় যে, তাদের জীবন অর্থের চারিপাশে ঘোরে। ক্লিচে (গতানুগতিক) মতো সত্যিটা হ’ল, “ধন-সম্পত্তি আমাদের সুখ কিনতে পারে না।”
ধ্বংসাত্মক আচরণ ত্যাগ করা
এখন আমরা আমাদের জীবনে এই নিরাপদ দিকটি পেয়েছি। এর আধারে, খারাপ পুনর্জন্ম এড়ানোর উপায় কী? এর পদ্ধতি হ’ল- শারীরিক, বাচনিক এবং মানসিকভাবে ধ্বংসাত্মক উপায়ে কাজকর্ম করা থেকে এড়ানো। এর অর্থ হ’ল- আমরা রাগ, লোভ, আসক্তি, মূর্খতা, ঈর্ষা, অহংকার এবং অন্যদের দীর্ঘ তালিকার মতো বিরক্তিকর আবেগের প্রভাবের অধীনস্থ এই তিনটির যে কোনও একটি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। প্রাথমিক স্তরে এখনই এই বহুমূল্য মানব জীবন থেকে সুযোগ গ্রহণের সর্বোত্তম উপায় হ’ল ধ্বংসাত্মক উপায়ে কর্ম করা, কথা বলা এবং চিন্তা-ভাবনা করাকে ত্যাগ করা।
তবে এটা আমাদের করতে হবে বৌদ্ধ পরিকাঠামোর মধ্যে। সাধারণতঃ সব ধর্মই প্রাণী হত্যা ও চুরির মতো ধ্বংসাত্মক আচরণ না করতে শেখায় কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে বৌদ্ধ আধারটি কোনও বিধি নয়। এমন কোনও বিধি নেই যা ঐশ্বরিক সত্ত্বা, আইনসভা বা সরকার কর্তৃক দ্বারা তৈরী হয়েছে। বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্র আইনের আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়নি, যেমন, “আইন মেনে চলুন, নাহলে শাস্তি পাবেন।” নাগরিক আইন সম্পর্কে যদি বলা হয়, আমরা কাউকে ঘুষ দিতে পারি বা শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য একজন ভাল আইনজীবী নিয়োগ করতে পারি। এছাড়াও, এটা এমনও নয় যে আমরা যখন আইন মেনে চলি আমরা ভাল হয়ে যাই এবং আর যদি সেটা না করি তাহলে আমরা খারাপ বা অপরাধী হয়ে যাই। আনুগত্য বা বাধ্যতা বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্রের আধার নয়।
গঠনমূলক আচরণে নিযুক্ত হওয়া
বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী, গঠনমূলক আচরণ বলতে কী বোঝায়, সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটা করতে পারি ধ্বংসাত্মক আচরণকে দেখে। উদাহরণস্বরূপ, জীবহত্যা বা প্রাণাতিপাতের একটা উপায় হ’ল শিকার করা। তবে আমরা যদি কখনও শিকার না করতাম এবং শিকারে আগ্রহী না হয়ে থাকতাম তাহলে আমরা যে শিকার করি না সেটা আসলে গঠনমূলক আচরণ হিসাবে গণ্য হত না, যদিও এটা একটা ভাল জিনিস। গঠনমূলক আচরণ বলতে বোঝায় যে আমরা যখন একটা মশা মারার জন্য থাপ্পড় মারি তখন সেই কর্মটা করতে আমরা আমাদের অনুভূতির উপর নির্ভর করি না। আমরা বুঝতে পারি না যে, আমরা যদি এই কর্মটা সম্পাদন করি, তাহলে সেটা করে থাকি ক্রোধের বশে, শুধু এই ভেবে “আমাকে, আমাকে কামড় দিয়েছে।” তদতিরিক্ত আমরা জানি যে, আমরা যদি মশাটি মারি তাহলে এটা একটা কঠিন অভ্যাস তৈরী করবে। ফলে আমাদের পছন্দ মতো কিছু না থাকলে আমরা সেটার হত্যা করে মোকাবিলা করার চেষ্টা করব। সুতরাং মশাকে থাপ্পড় মারার পরিবর্তে এটার সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে আচরণ করার একটা উপায় আছে, যেমন- এটাকে একটা কাপে করে ধরে বাইরে নিয়ে যাওয়া। অতএব গঠনমূলক পদক্ষেপটা হ’ল- আমরা যখন সত্যিই এটার হত্যা করতে চাই তখন নিজের বিচারে পরিবর্তন করে অপরের হত্যা থেকে বিরত থাকা। আমরা বিরত থাকি কারণ আমরা হেতু এবং ফলকে বুঝি। এই ধরণের গঠনমূলক কর্ম দৃঢ় ইতিবাচক সম্ভাবনা নির্মাণ করে।
গঠনমূলক কর্মের আরও শক্তিশালী স্তর রয়েছে, যা কেবল মশাকে হত্যা করায় না, বরং আহার দান করা শেখায়। আমরা এটাকে রক্তের স্বাদ গ্রহণ করাতে পারি। সর্বোপরি, আমাদের অনেক কিছু আছে। আমার সাথে প্রকৃতপক্ষে বেশ কয়েকজন লোকের সাক্ষাৎ হয়েছে যারা এটা করতে সক্ষম। আমরা যে জিনিসটা শিকার করি না সেটা বাস্তবে ইতিবাচক কর্ম নয় যেটা আমরা ভেবে থাকি।
বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্রের আধার আচরণগত হেতু এবং ফলকে বোঝা
তৎকালীন বৌদ্ধধর্মের নীতিশাস্ত্রের পুরো আধারটি হ’ল- নির্দিষ্ট উপায়ে কর্ম করলে নির্দিষ্ট ধরণের ফল প্রদান করবে সেটাকে বোঝা এবং কোনটা ক্ষতিকারক ও কোনটা উপকারী তার পার্থক্য করা। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করি তাহলে এটা আমাদের নিজের জন্য একটা অসুখী বা বিরক্তিকর মনের অবস্থা তৈরী করবে। আমাদের মৌলিক বিভ্রান্তির কারণে আমরা এই ধরণের কর্ম করি। প্রথমতঃ, আমরা নাও জানতে পারি যে, ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করাটা আসলে নিজের ধ্বংস করা হয়। যেমন, আমরা যখন মাদক বা মদ্য পানে আসক্ত হয়ে যাই, তখন তার কারণে নিজেরই ক্ষতি হয়। অতিরিক্তভাবে, আমরা একটা বিপরীত ভাবে ভাবতে পারি যে, আমরা যদি সারাক্ষণ অত্যন্ত নেশাগ্রস্থ হই বা মাতাল হয়ে থাকি তাহলে আমরা আমাদের সমস্যাগুলি এড়াতে সক্ষম হব।
সুতরাং নৈতিক আচরণের আধারটি বোঝার সাথে আমরা বুঝতে পারি যে, আমরা যখন ধ্বংসাত্মকভাবে আচরণ করি এর মানে এটা হয় না আমরা খারাপ বরং কারণটা এই হয় যে, আমরা বিভ্রান্ত। তেমনভাবে যখন অন্যরা ধ্বংসাত্মকভাবে আচরণ করে, তার অর্থ এই নয় যে তারা খারাপ এবং শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, বরং এর কারণ হ’ল- তারা বিভ্রান্ত এবং বিরক্ত। তাঁরা করুণার পাত্র হয়ে যায় যেখানে আমরা বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে তাদের সহায়তা করতে চাই, তারা যদি অন্য লোকের ক্ষতি করতে থাকে আর এমন সম্ভাবনাও থাকে তাহলে আমাদের সেগুলি বন্ধ করার দরকার পড়ে, তবে এটা করা উচিত অন্যরকম মানসিকতার সাথে। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের শাস্তি বা আঘাত দেওয়ার দরকার নেই, বরং তার পরিবর্তে এক অর্থে সাহায্য করার চেষ্টা করা উচিত। তাদের একটা চিত্ত-সন্ততি আছে যেটা চিরকাল অব্যাহত থাকবে। অতএব আমরা যদি এখনই পুনর্বাসনের চেষ্টা না করি, তাহলে তারা ভবিষ্যতে কেবল ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করতে থাকবে।
তবে এই প্রাথমিক স্তরে, আমরা মূলতঃ নিজের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখি এবং ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে চাই। আমরা এটা করি “ধর্ম-লাইট” পদ্ধতির জন্য এই জীবনে অথবা “রিয়েল থিং ধর্ম” পদ্ধতির জন্য ভবিষ্যতের জীবনে। এই স্তরে, এটাই হ’ল তাই যে, আমরা একটা নিরাপদ দিক খুঁজে এইভাবেই এই মূল্যবান মানব জীবনকে ব্যবহার করি। আমরা এই জীবনকে মূল্য দিই কারণ আমরা জানি যে, আমরা এটা হারাতে চলেছি এবং আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে, আমরা ভবিষ্যতেও আমাদের মূল্যবান মানব জীবন অব্যাহত রাখতে চাই। আমাদের এই মানব জীবন প্রয়োজন কারণ এটা মোক্ষ ও বোধিলাভের লক্ষ্যে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় নিতে চলেছে। “ধর্ম-লাইট” যেমন “রিয়েল থিং ধর্ম”-এর জন্য একটা ধাপের পাথর, ঠিক তেমনই, আমরা প্রাথমিক স্তরে যে স্তরটি দেখেছি সেটা মধ্যবর্তী এবং উন্নত স্তরের ধাপের পাথর।
সারাংশ
প্রাথমিক অনুপ্রেরণাটি শুরু হয় এই অবিশ্বাস্যভাবে মূল্যবান মানব জীবনের প্রশংসা দিয়ে যা আমাদের আছে। আমাদের কাছে এই শরীর আছে, আমাদের আছে সুযোগ এবং সর্বোপরি আমাদের আছে মানবিক বুদ্ধি। অতএব আমাদের মন যদি এতে মনোনিবেশ করে তাহলে আমরা অর্জন করতে পারব না, এমন কিছুই নেই।
আমরা যে আশ্চর্যজনক পরিস্থিতিতে আছি সেটা চিরকাল স্থায়ী হবে না, বাস্তবে কিছুই স্থায়ী হয় না। আমরা যতই ধনী বা যতই বিখ্যাত হই না কেন, আমাদের যতই বন্ধু-বান্ধব থাকুক না কেন, আমাদের শরীর যতই শক্তিশালী হোক না কেন, মরতে আমাদের হবেই। এটাকে থামানোর এমন কিছুই নেই এবং আমাদের সময় কখন আসবে সেটাকে জানারও কোন উপায় নেই। এরকম বলা হয়েছে যে, আমরা যদি সত্যিই মৃত্যুকে উপলব্ধি করি, তাহলে আমাদের পক্ষে একটা সাধারণ জীবন-যাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আমরা যখন দেখি এই জীবনটা ভঙ্গুর এবং যে কোনও মুহুর্তে শেষ হতে পারে তখন আমরা মৃত্যুর বাইরে কী রয়েছে সেটা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। কারণ এমন অনেক সম্ভাব্য অবস্থা আছে যার মধ্যে অনেকগুলি ভীতিজনক যেখানে আমরা পুনর্জন্ম লাভ করতে পারি। এইজন্য আমরা আমাদের জীবনে একটা নিরাপদ দিক রাখি।
এই নিরাপদ দিকনির্দেশ আমাদের ধ্বংসাত্মক কর্ম থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানায়। এই কর্মগুলি হ’ল ভবিষ্যতের দুঃখের কারণ। ঐ দিকনির্দেশ আমাদের গঠনমূলক কর্মে লিপ্ত হতে অনুরোধ জানায়, যে কর্মগুলি হ’ল আমাদের ভবিষ্যতের সুখের কারণ। এইভাবে, আমরা আরও ভাল অবস্থায় আমাদের নিজেদের ভবিষ্যতের পুনর্জন্ম নিশ্চিত করি।