একজন আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে অধ্যয়ন করা

আধ্যাত্মিক শিষ্য এবং গুরুর অনেকগুলি স্তর আছে। যখন সম্ভাব্য শিষ্যরা কল্পনা করে যে তারা এবং তাদের শিক্ষকরা তাদের যোগ্যতা থেকে উচ্চতর স্তরে আছেন বা যখন তারা গুরুকে একজন চিকিৎসক হিসেবে বিবেচনা করেন তখন অনেক বিভ্রান্তি দেখা দেয়।

আধ্যাত্মিক গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক বিষয়ে পরীক্ষামূলক তথ্য

আধ্যাত্মিক গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মধ্যে বিভ্রান্তি এড়াতে আমাদের কিছু পরীক্ষামূলক তথ্যকে স্বীকার করতে হবেঃ

  1. প্রায় সকল আধ্যাত্মিক অন্বেষী আধ্যাত্মিক পথ ধরে পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হয়।
  2. বেশিরভাগ অনুশীলনকারীরা তাদের জীবনকালে বেশ কয়েকজন গুরুর সাথে অধ্যয়ন করে এবং প্রত্যেকের সাথে আলাদা-আলাদা সম্পর্ক গড়ে তোলে।
  3. প্রত্যেক আধ্যাত্মিক গুরু সিদ্ধির একই স্তরে পৌঁছননি।
  4. একজন নির্দিষ্ট অন্বেষী এবং একজন নির্দিষ্ট গুরুর মধ্যে সম্পর্কের ধরণটি প্রত্যেকের আধ্যাত্বিক স্তরের উপর নির্ভর করে।
  5. আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হওয়ার সাথে-সাথে মানুষ সাধারণতঃ তাদের গুরুর সাথে ধীরে-ধীরে গভীর ভাবে সম্পর্কে যুক্ত হন।
  6. যেহেতু একজন শিক্ষক প্রতিটি অন্বেষীর আধ্যাত্মিক জীবনে ভিন্ন-ভিন্ন ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই শিক্ষকের সাথে প্রতিটি অন্বেষীর সবচেয়ে উপযুক্ত সম্পর্ক ভিন্ন হতে পারে।

আধ্যাত্মিক গুরু ও আধ্যাত্মিক অন্বেষীদের স্তর

এইভাবে, আধ্যাত্মিক গুরু এবং আধ্যাত্মিক অন্বেষীদের অনেক স্তর আছে সেখানে আছেনঃ

  • বৌদ্ধ ধর্মের অধ্যাপকগণ, যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্য প্রদান করার জন্য।
  • কীভাবে ধর্মকে জীবনে প্রয়োগ করতে হয় সেটা দেখানোর জন্য ধার্মিক প্রশিক্ষক।
  • ধ্যান প্রশিক্ষকগণ তাই-চি বা যোগ শেখানোর মতো পদ্ধতি শেখানোর জন্য।
  • আধ্যাত্মিক গুরুরা শিষ্যকে তার স্তর অনুসারে আলাদা ক’রে সম্বর প্রদান করেন: গৃহস্থ (উপাসক) অথবা ভিক্ষু সম্বর, বোধিসত্ত্ব সম্বর অথবা তান্ত্রিক সম্বর।

তদনুরূপভাবে সেখানে আছেনঃ

  • বৌদ্ধ ধর্মের শিষ্যগণ যারা তথ্য লাভ করতে ইচ্ছুক।
  • ধর্মের শিষ্যগণ যারা শিখতে চায় যে ধর্মকে কীভাবে জীবনে প্রয়োগ করতে হয়।
  • ধ্যান প্রশিক্ষণার্থীগণ যারা চিত্তকে স্থির করা অথবা প্রশিক্ষণের পদ্ধতি শিখতে ইচ্ছুক।
  • শিষ্যগণ ভবিষ্যৎ জীবন উন্নত করতে, মুক্তি লাভ করতে অথবা বোধিলাভ করতে ইচ্ছুক এবং এই লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করার জন্য কিছু স্তরের সম্বর গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে। এমনকি যদি শিষ্যরা এই জীবনকে উন্নত করতে চায়, তাহলে তারা এটাকে মুক্তি এবং বোধিলাভের পথের একটি ধাপ হিসাবে দেখে।

প্রতিটি স্তরের নিজস্ব যোগ্যতা রয়েছে এবং একজন আধ্যাত্মিক অন্বেষী হিসেবে আমাদেরকে নিজস্ব এবং গুরুর পটভূমি বিবেচনা করতে হবে- এশীয় না পাশ্চাত্য, ভিক্ষু, ভিক্ষুণী অথবা গৃহস্থ, শিক্ষার স্তর, আবেগপূর্ণ এবং নৈতিক স্তরের পরিপক্কতা, প্রতিশ্রুতির স্তর ইত্যাদি। অতএব, ধীরে-ধীরে এবং সাবধানে এগিয়ে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।

একজন সম্ভাব্য শিষ্য এবং একজন সম্ভাব্য আধ্যাত্মিক গুরুর যোগ্যতা

একজন সম্ভাব্য শিষ্য হিসেবে, আমাদের নিজস্ব বিকাশের স্তর পরীক্ষা করা দরকার, যাতে আমরা এমন একটি সম্পর্কে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হই যার জন্য আমরা প্রস্তুত নই। একজন শিষ্যের যে প্রধান গুণাবলী প্রয়োজন সেগুলি হলঃ

  1. তার নিজস্ব পূর্ব ধারণা এবং মতামতের সাথে আসক্ত শূন্য উদার মানসিকতা।
  2. কোনটি সঠিক এবং কোনটি সঠিক নয়, তার মধ্যে পার্থক্য করার জন্য সাধারণ জ্ঞান।
  3. ধর্ম এবং সুযোগ্য গুরুর খোঁজ করার জন্য দৃঢ় আগ্রহ।
  4. ধর্ম এবং সুযোগ্য গুরুর প্রতি সমাদর এবং সম্মান।
  5. মনোযোগী চিত্ত।
  6. মানসিক পরিপক্কতা এবং স্থিতিশীলতার মৌলিক স্তর।
  7. নৈতিক দায়িত্বের মৌলিক স্তর।

গুরুর স্তরের উপর নির্ভর ক’রে, তার মধ্যে আরও ক্রমবর্ধমান যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। সাধারণতঃ প্রধান গুলি হল-

  1. তার নিজের আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে একটি সুস্থ সম্পর্ক।
  2. নিজের শিষ্যের চেয়ে ধর্মের অধিক জ্ঞান।
  3. ধ্যান-সাধনায় এবং দৈনন্দিন জীবনে পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করার অভিজ্ঞতা এবং সাফল্যের কিছু স্তর।
  4. জীবনে ধর্মকে প্রয়োগের উপকারী ফলাফলের প্রেরণামূলক উদাহরণ স্থাপন করার ক্ষমতা। এর অর্থ হলঃ
  5. নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা থাকা।
  6. স্থূল মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তির উপর ভিত্তি ক’রে মানসিক পরিপক্কতা ও স্থিতিশীলতা।
  7. শিক্ষা প্রদান করার প্রাথমিক অনুপ্রেরণা হিসাবে শিষ্যদের উপকার করার জন্য আন্তরিকভাবে চিন্তিত হওয়া।
  8. শিক্ষাদানের সময় ধৈর্য।
  9. ভান না করা (তার মধ্যে যে গুণাবলী নেই সেই বিষয়ে ভান না করা) এবং ভন্ডামী না করা (জ্ঞান অথবা অভিজ্ঞতার অভাবের মতো ত্রুটিগুলি না লুকানো)।

আমাদের পরিস্থিতির বাস্তবতার সাথে মানানসই হতে হবে- আমাদের শহরে উপলব্ধ শিক্ষকদের যোগ্যতার স্তর কতটা, আমরা কতটা সময় এবং প্রতিশ্রুতি দিতে পারব, আমাদের আধ্যাত্মিক লক্ষ্য কী (বাস্তবসম্মত ভাবে, শুধু “সকল সত্ত্বের উপকার করার জন্য” আদর্শগতভাবে নয়) ইত্যাদি। আমরা নিজেদেরকে কোন আধ্যাত্মিক সম্পর্কে অঙ্গীকার করার পূর্বে যদি একজন সম্ভাব্য গুরুর যোগ্যতা যাচাই করি তাহলে আমরা নিজের গুরুকে দেবতা অথবা শয়তানে পরিণত করার চরমপন্থী ভাবনা এড়াতে পারি। আমরা যখন আধ্যাত্মিক গুরুকে ঈশ্বরে পরিণত করি তখন আমাদের সাধাসিধে ভাব সম্ভাব্য অপব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। যদি আমরা তাকে শয়তানে পরিণত করি তাহলে আমাদের মানসিক বৈকল্যতা আমাদের উপকার করতে বাধা দেয়।

একজন আধ্যাত্মিক গুরুর শিষ্য হওয়া এবং কোন চিকিৎসকের মক্কেল হওয়ার মধ্যে পার্থক্য

আধ্যাত্মিক গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মধ্যে বিভ্রান্তি উৎপন্ন হওয়ার একটা প্রধান কারণ হল আধ্যাত্মিক গুরুকে কোন চিকিৎসকরূপে দেখার ইচ্ছা। উদাহরণস্বরূপ, এমন একজনের কথা মনে করুন যিনি তার বাকি জীবনের জন্য মানসিক সুখ ও ভালো সম্পর্কের কামনা করেন। এই লক্ষ্য অর্জন করার জন্য কোন আধ্যাত্মিক গুরুর শিষ্য হওয়া হল একই উদ্দেশ্যের জন্য কোন চিকিৎসকের মক্কেল হওয়ার অনুরূপ।

বৌদ্ধ ধর্ম এবং চিকিৎসাবিধান উভয়ঃ

  1. আমাদের জীবনে দুঃখকে উপলব্ধি করা এবং স্বীকার করা আর সেটাকে উপশম করার কামনা থেকে উৎপন্ন হয়।
  2. আমাদের সমস্যা এবং তার কারণগুলিকে উপলব্ধি করা ও বোঝার জন্য কারোর সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করার সাথে সম্পর্কিত। আসলে অনেক প্রকারের চিকিৎসাতে বৌদ্ধ ধর্মেরই মতো মনে করা হয় যে, বোঝাপড়াই হল আত্মপরিবর্তনের চাবিকাঠি।
  3. চিন্তাধারার ব্যবস্থাকে অঙ্গীকার করে যা আমাদের সমস্যার কারণগুলিকে গভীরভাবে বোঝার উপর জোর দেয়, পরম্পরা যা এই কারণগুলিকে অতিক্রম করার কন্য বাস্তবসম্মত পদ্ধতিতে কাজ করে এবং ব্যবস্থা যা দুটি পদ্ধতির সুষম সমন্বয়ের সুপারিশ করে।
  4. নিজের উন্নয়নের প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে পরামর্শদাতা অথবা চিকিৎসকের সাথে একটা সুস্থ মানসিক সম্পর্ক স্থাপিত করতে সুপারিশ করে।
  5. যদিও অধিকাংশ পারম্পরিক চিকিৎসা পদ্ধতি মক্কেলের আচরণ এবং তাদের চিন্তা-ভাবনার পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য নৈতিক নির্দেশিকা ব্যবহার করতে চায় না, কিন্তু কিছু উত্তর-শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে বৌদ্ধ ধর্মের অনুরূপ নৈতিক সিদ্ধান্তের সমর্থন করে। এই সিদ্ধান্ত গুলির মধ্যে কোন ভেঙে যাওয়া পরিবারের সকল সদস্যের সাথে একই রকম ভালো আচরণ করা এবং ক্রোধের মতো নিজের ধ্বংসাত্মক আবেগ থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে।

মিল থাকা সত্ত্বেও একজন বৌদ্ধ পরামর্শদাতার শিষ্য হওয়া এবং একজন চিকিৎসকের মক্কেল হওয়ার মধ্যে অন্তত পাঁচটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান আছেঃ

১) মনোবৈজ্ঞানিক স্তরে যা সম্পর্ক স্থাপন করে সম্ভাব্য মক্কেলরা সাধারণতঃ মানসিকভাবে বিরক্ত হলে একজন চিকিৎসকের কাছে যান। এরমধ্যে অনেকে মানসিক রোগীও হতে পারে যাদের চিকিৎসার অংশ হিসেবে ধ্যান-সাধনার প্রয়োজন হতে পারে। অন্যদিকে, সম্ভাব্য শিষ্যরা আধ্যাত্মিক মার্গে নিজের প্রথম পদক্ষেপের সময় কোন পরামর্শদাতার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না। এর পূর্বে, তারা বুদ্ধের শিক্ষাগুলির অধ্যয়ন ক’রে থাকে এবং তারা সেটাকে নিজের উপর প্রয়োগ করতে শুরু ক’রে থাকে। পরিণামস্বরূপ, তারা মানসিকভাবে পরিপক্ক এবং স্থিরতার একটি পর্যাপ্ত স্তরে পৌঁছে যায়, যাতে তাদের মধ্যে স্থাপিত গুরু-শিষ্য সম্পর্কটি বৌদ্ধ দৃষ্টিতে গঠনমূলক হয়। অন্য কথায়, বৌদ্ধ শিষ্যদের ইতিমধ্যে মানসিক রোগের প্রবৃত্তি এবং আচরণ থেকে তুলনামূলকভাবে মুক্ত হতে হয়।

২) সম্পর্কের মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়ার আশা করে। সম্ভাব্য মক্কেলগণের বেশিরভাগই এই বিষয়ে আগ্রহী থাকে যে কেউ তাদের কথা শুনুক। এই জন্য দল বা গ্রুপ থেরাপির মধ্যেও তারা আশা করে যে চিকিৎসক তাদের ব্যক্তিগত সমস্যার দিকেও যেন মনোনিবেশ করেন। অন্যদিকে, শিষ্যরা সাধারণতঃ তাদের পরামর্শদাতার সাথে ব্যক্তিগত সমস্যা গুলি শেয়ার করেন না এবং তারা প্রত্যাশা করে না অথবা ব্যক্তিগত মনোযোগের জন্য দাবী করে। যদিও তারা পরামর্শদাতার সাথে ব্যক্তিগত পরামর্শ করে কিন্তু সেটা নিয়মিত ভাবে নয়। শুধু শিক্ষা গ্রহণ করার উপরই তাদের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। বৌদ্ধ শিষ্যগণ প্রাথমিকভাবে তাদের পরামর্শদাতার কাছ থেকে সাধারণ সমস্যা গুলি কাটিয়ে ওঠার পদ্ধতি শেখে যে সমস্যাগুলির মুখোমুখি তারা সকলেই হয়। তারপর, তারা তাদের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করার জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করে।

৩) সম্পর্ক থেকে প্রত্যাশিত ফলাফল। চিকিৎসার লক্ষ্য হল আমাদের জীবনের সমস্যাগুলিকে মেনে নেওয়া এবং সেগুলিকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে শেখা, অথবা সেগুলিকে কম করা যাতে সেগুলি সহনীয় হয়ে ওঠে। আমরা যদি এই জীবনকালের মানসিক মঙ্গলের লক্ষ্যের সাথে কোন বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতার কাছে যাই, তাহলে আমরা আমাদের সমস্যাগুলি কম করারও আশা করতে পারি। জীবন কঠিন হওয়া সত্ত্বেও- জীবনের প্রথম সত্য (আর্য সত্য) যার উপর বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছিলেন- আমরা জীবনের সমস্যাগুলি কম করতে পারি।

যাইহোক, আবেগগতভাবে আমাদের জীবনকে কম কঠিন করা হল পারম্পরিক বৌদ্ধমার্গে যাওয়ার একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতার শিষ্যরা অন্ততপক্ষে অনুকূল পুনর্জন্ম, মুক্তি এবং বোধিলাভের মতো বৃহত্তর লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয়। এছাড়াও, বৌদ্ধ ধর্মে ব্যাখ্যা করা পুনর্জন্ম সম্পর্কে বৌদ্ধ শিষ্যগণের একটা বৌদ্ধিক উপলব্ধি হয় এবং তারা পুনর্জন্মের অস্তিত্বকে অন্ততপক্ষে অস্থায়ীভাবে স্বীকৃতি দেয়। চিকিৎসকের মক্কেলদের পুনর্জন্ম অথবা তাদের তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির উন্নতি ব্যতীত লক্ষ্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন হয় না।

৪) আত্ম-রূপান্তর প্রতিশ্রুতি স্তর। চিকিৎসকের মক্কেলরা ঘন্টা হিসেবে চিকিৎসককে পারিশ্রমিক প্রদান করে, কিন্তু তারা আজীবন মনোভাব এবং আচরণ পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় না। অন্যদিকে, বৌদ্ধ শিষ্যরা শিক্ষার জন্য পারিশ্রমিক দিতেও পারে অথবা নাও দিতে পারে; তবুও তারা আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের জীবনের দিক পরিবর্তন করে। শরণ-গমন করার সময়, শিষ্যরা আত্ম-বিকাশের মার্গে চলার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, যেটা বুদ্ধগণ সম্পূর্ণভাবে অতিক্রম করেছেন এবং তারপর সেটার সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করেছেন আর উচ্চসিদ্ধি প্রাপ্ত আধ্যাত্মিক সংঘ যেটাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে।

এছাড়াও, বৌদ্ধ শিষ্যগণ জীবনে কর্ম করা, কথা বলা এবং চিন্তা করার মাধ্যমে নৈতিক, গঠনমূলক মার্গে চলার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে। তারা অশান্তকারী আবেগ থেকে দূরে থাকার জন্য এবং গঠনমূলক আবেগের সাথে যুক্ত থাকার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করে। যখন শিষ্যরা অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে, তখন তারা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহস্থ (উপাসক) অথবা ভিক্ষু সম্বর গ্রহণ ক’রে আরও গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। আত্ম-বিকাশের এই পর্যায়ে শিষ্যরা প্রতিজ্ঞা করে যে তারা আজীবন এই আচরণ গুলি থেকে দূরে থাকবেন যা স্বাভাবিকভাবে ধ্বংসাত্মক, অথবা যার বিষয়ে বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছিলেন যে, কিছু নিশ্চিত মানুষের নির্দিষ্ট কারণ থেকে দূরে থাকা উচিত। বুদ্ধের দ্বারা নির্দিষ্ট ক’রে দেওয়া আচরণের মধ্যে একটি উদাহরণ হল যে, ভিক্ষুদের আসক্তি কম করার জন্য নিজের গৃহস্থ বেশভূষা পরিত্যাগ ক’রে চীবর পরিধান করা। এমনকি পূর্ণ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বিকাশের পূর্বে, শিষ্যরা প্রায়শই গৃহস্থ বা ভিক্ষু সম্বর গ্রহণ করে।

অন্যদিকে, চিকিৎসকের মক্কেলরা চিকিৎসা বিদ্যাগত চুক্তির অংশ হিসেবে কিছু নিয়ম মেনে চলেন, যেমন- সাক্ষাতের জন্য পঞ্চাশ মিনিট সময় দেওয়া। তবে এই নিয়মগুলি শুধুমাত্র চিকিৎসার সময়েই প্রযোজ্য। সেগুলি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাইরের পরিস্থিতিতে প্রয়োগ হয় না। এর জন্য স্বাভাবিক রূপে ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত থাকার শর্ত প্রযুক্ত থাকে না, আর এটা আজীবন প্রযুক্ত থাকে না।

৫) গুরু অথবা চিকিৎসকের প্রতি মনোভাব। শিষ্যরা তাদের আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতাদের জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে দেখেন যা তারা অর্জন করার জন্য প্রচেষ্টা করেন। তারা পরামর্শদাতাদের ভাল গুণাবলীর সঠিক স্বীকৃতির ভিত্তিতে তাদের এইভাবে বিবেচনা করে এবং তারা বোধিলাভের জন্য তাদের ক্রমিক মার্গের পুরো সময় জুড়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখে এবং সেটাকে সুদৃঢ় করে। এর বিপরীতে, মক্কেলরা তাদের চিকিৎসকের মানসিক স্বাস্থ্যকে আদর্শ হিসাবে দেখে, কিন্তু তাদের চিকিৎসকের ভাল গুণাবলী সম্পর্কে সঠিক সচেতনতার প্রয়োজন হয় না। এই সম্পর্কের উদ্দেশ্য চিকিৎসকের মতো হওয়া নয়। চিকিৎসা চলাকালীন চিকিৎসকরা তাদের মক্কেলদের আদর্শের অভিক্ষেপের বাইরে নিয়ে যায়।

“শিষ্য” শব্দটির অনুপযুক্ত ব্যবহার

কখনো-কখনো মানুষ নিজেদেরকে আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতার শিষ্য বলে অভিহিত করে, যদিও তারা শিক্ষক বা উভয়েই শব্দগুলির সঠিক অর্থ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। তাদের অজ্ঞানতার কারণে তারা প্রায়শই অবাস্তব প্রত্যাশা, ভ্রম, আঘাত-অনুভূতি এবং এমনকি দুর্ব্যবহারের শিকার হয়। এই প্রেক্ষাপটে অপব্যবহারের বস্তু হয়ে ওঠার অর্থ হল যৌন, মানসিক বা আর্থিকভাবে শোষিত হওয়া, অথবা শক্তি প্রদর্শনে কারোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া। এবার আমরা পশ্চিমী জগতে উপলব্ধ তিন প্রকারের সাধারণ ছদ্ম-শিষ্যের বিষয়ে পরীক্ষা করি, যারা আধ্যাত্মিক গুরুর সমস্যায় আক্রান্ত।

১) কিছু মানুষ তাদের কল্পনার পরিপূর্ণতার জন্য ধর্ম কেন্দ্রে আসেন। তারা কোথাও “রহস্যময় প্রাচ্য” অথবা সুপারস্টার গুরুদের সম্বন্ধে কিছু পড়েছে বা শুনেছে এবং তারা একজন বিদেশী অথবা আধ্যাত্মিক গুরুর রহস্যময় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজের নিরস জীবনকে রোমাঞ্চকর বানাতে চায়। তারা কোন আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে এবং অবিলম্বে নিজেদেরকে সেই গুরুর শিষ্য বলে ঘোষণা করে, বিশেষ ক’রে যদি সেই গুরু প্রাচ্যবাসী হন এবং চীবরধারী হন, অথবা উভয়ই। প্রাচ্য উপনাম অথবা নাম ধারক পশ্চিমী শিক্ষকদের সাথেও অনুরূপ আচরণের প্রবণতা থাকে তাতে সেই ব্যক্তি চীবর ধারণ করুক অথবা না করুক। তন্ত্রবিদ্যার অনুসন্ধানকারী প্রায়শই গুরুর সাথে সাধকদের সম্পর্ককে অস্থির ক’রে দেয়। যদিও তারা নিজেদেরকে যোগ্য গুরুর শিষ্য বলে ঘোষণা করে, তবে এমন শিষ্যরা প্রায়ই এই গুরুদের ছেড়ে চলে যায় যখন তারা বুঝতে পারে যে তাদের কল্পনা ছাড়া বাস্তব জীবনে তাদের সাথে কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটছে না। এছাড়াও, “তাৎক্ষণিক শিষ্যদের” অবাস্তব মনোভাব এবং উচ্চ প্রত্যাশা গুলি প্রায়শই তাদের সমালোচনামূলক জ্ঞানকে ধোঁয়াশা ক’রে দেয়। এই ধরণের ব্যক্তিরা বিশেষ ক’রে চালাক আধ্যাত্মিক ভন্ডদের দ্বারা প্রতারিত হয় যারা ভাল কাজকর্ম করতে উন্মুক্ত থাকে।

২) অন্যরা হয়তো মানসিক বা শারীরিক পীড়া কাটিয়ে উঠতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্যের জন্য মরিয়া হয়ে ধর্ম কেন্দ্রে আসেন। তারা হয়তো বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। তখন তারা কোন জাদুকর/ চিকিৎসকের এর কাছ থেকে কোন অলৌকিক ঘটনার আশা করে। তারা নিজেদেরকে এমন কোন ব্যক্তির শিষ্য বলে ঘোষণা করে যারা তাদের আশীর্বাদ স্বরূপ কোন ওষুধের বড়ি দিতে পারে, পাঠ করার জন্য কোন বিশেষ প্রার্থনা বা মন্ত্র উল্লেখ করতে পারে অথবা কোন প্রভাবশালী সাধনা, যেমন- এক লক্ষ বার সাটাঙ্গ প্রণাম করার সাধনার পরামর্শ দিতে পারে- যার দ্বারা তার সমস্যাগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাধান হয়ে যাবে। তারা বিশেষভাবে এমন ধরণের গুরুর কাছে যান যারা গুহ্যবিদ্যার সন্ধানে থাকা মানুষদের আকর্ষণ করে। যখন যোগ্য গুরুর পরামর্শ অনুসরণ করলে অলৌকিকভাবে নিরাময় হয় না, তখন জাদুর সন্ধানে সাধকের “ঠিক করার” মানসিকতা তাদের জন্য নিরাশা বা হতাশার কারণ হয়। “ঠিক করা”-এর মানসিকতা আধ্যাত্মিক হাতুড়ে ডাক্তারের হাতে ঠকে যাওয়ার কারণ হয়।

৩) কিছু অন্য মানুষ, বিশেষ ক’রে বিরক্ত, বেকার যুবকরা, যারা অস্তিত্ব সম্বন্ধীয় অভিষেক পাওয়ার আশায় বিশেষ উপাসনা পদ্ধতির ধর্ম কেন্দ্রে আসে। সহজাত দক্ষতা সম্পন্ন অহংকারোন্মোধী “আধ্যাত্মিক ফ্যাসিবাদ”-এর উপায় ব্যবহার ক’রে তাদের আকর্ষিত করে। তারা নিজেদের পরম্পরার নিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের তথাকথিত শিষ্য সংখ্যার দ্বারা আশ্বস্ত করে। তারা শিষ্যদের প্রচণ্ড ক্রোধী রক্ষকের বিষয়ে নাটকীয় বর্ণনা দিয়ে আকৃষ্ট করে যে, এই রক্ষকরা তাদের শত্রু, বিশেষভাবে গৌণ ও অশুদ্ধ বৌদ্ধ পরম্পরার অনুগামীদের ধ্বংস ক’রে দেবে। তাদের আন্দোলনের সংস্থাপকদের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে বিশাল গল্পের সাহায্যে তারা শিষ্যদের এমন শক্তিশালী মার্গদর্শকের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করে যিনি তাঁর অনুগামীদের আধ্যাত্মিক অবস্থায় নিয়ে যাবে। এমন প্রতিশ্রুতিতে প্রভাবিত হয়ে এইসব ব্যক্তি দ্রুত নিজেকে তাঁর শিষ্য বলে ঘোষণা করে এবং অন্ধভাবে নিজের সত্তাবাদী গুরুর নির্দেশ বা আদেশের পালন করতে থাকে। এর পরিণতি সাধারণত দুঃখকর হয়।

সারাংশ

সংক্ষেপে, যেমন ভাবে কোন বৌদ্ধ কেন্দ্রে শিক্ষা প্রদান করা প্রত্যেক ব্যক্তি একজন খাঁটি আধ্যাত্মিক গুরু হন না তেমনি কোন কেন্দ্রে পঠরত প্রত্যেক ব্যক্তি একজন খাঁটি শিষ্য হয় না। আমাদের গুরু এবং শিষ্য শব্দগুলির যথাযথ প্রয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য প্রয়োজন আধ্যাত্মিক সততা এবং ভান করা থেকে বিরত থাকা।

Top