বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণে অন্য ধর্মসমূহ

এই গ্রহে যেমন শত-শত কোটি মানুষ বাস করেন, তেমন রয়েছে শত-শত কোটি মত এবং পথও। বৌদ্ধ মতানুযায়ী এই বিপুল সংখ্যক মানুষের বিচিত্র চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন রকমের ধর্মের প্রয়োজন আছে। মানব কল্যাণই সকল ধর্মের মূল লক্ষ্য। একথা বৌদ্ধধর্ম স্বীকার করে। এই মূল আধারটিকে ভিত্তি করে পারম্পরিক সহযোগীতা ও শ্রদ্ধার আবহে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানগণ একে অপরকে বোঝা এবং শিক্ষার লক্ষ্যে কার্যক্রমের ব্যবস্থা করেছে।

যেহেতু সবার মধ্যে একই রকমের ঝোঁক ও আগ্রহ থাকে না, সুতরাং বিভিন্ন ধরণের মানুষের উপযোগী করে বুদ্ধ বিভিন্ন রকম উপদেশ দিয়েছেন। এই ভাবনাটি মনে রেখে পরম পূজ্য দালাই লামা বলেছেন যে, ‘এটি সত্যিই অপূর্ব, পৃথিবীতে এত রকমের ধর্ম আছে।’ যেমন বিশেষ একটি খাদ্য সকলের মনোরথ পূর্ণ করতে পারে না, ঠিক তেমনই একটা ধর্ম বা এক ঝাঁক বিশ্বাস প্রত্যেকের প্রয়োজন মেটাতে পারে না। এটি ঘটনা যে, নানা ধরণের ধর্ম রয়েছে এবং তা খুবই উপকারী। বিষয়টি আনন্দের এবং স্বাগত জানানোর যোগ্য।

ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বার্তালাপ

বর্তমানে বৌদ্ধ ধর্মগুরু এবং অন্যান্য ধর্মের আচার্যদের মধ্যে পারম্পরিক সৌহার্দের আবহে চলছে বার্তালাপ। এই প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। পরম পূজ্য দালাই লামা দ্বিতীয় পোপ জন পলের সঙ্গে বহুবার দেখা করেছেন। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ইটালির আসিসিতে বিশাল এক সভায় পোপ বিশ্বের সকল ধর্মের নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ১৫০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। পরম পূজ্য দালাই লামা বসেছিলেন পোপের পাশে। তাকেই প্রথমে বলার সম্মাণ দেওয়া হয়েছিল। সম্মেলনে আধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দ সর্বধর্মের ভাবনায় ঐক্য রয়েছে এমন বিষয় গুলি, যেমন- নৈতিকতা, মৈত্রী এবং করুণার মতো বিষয়ের উপর আলোচনা করেন। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে পারম্পরিক ঐক্য সৌহার্দ এবং শ্রদ্ধার পরাকাষ্ঠা দেখে জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।

নিশ্চয়ই প্রতিটি ধর্ম মতের মধ্যে পার্থক্য আছে। অধিবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্বে এর দিক থেকে দেখলে দেখা যায় যে, এই পার্থক্য মুছে দেওয়া যাবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এনিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে হবে। “তোমার থেকে আমার বিশ্বাস ভাল” এরকম মনোভাব কোন কাজের কথা নয়। তার থেকে বরং দেখা উচিত সর্ব ধর্মমতের মধ্যে কী কী বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে। এতে অনেক উপকার হবে। এই যেমন ওঁরা সকলেই চায় মানবিক অবস্থার উন্নতি হোক। নৈতিকতা, মৈত্রী, করুণা ও ক্ষমার পথ অবলম্বন করে সকলের জীবন হোক আরও ভাল। তারা সবাই মানুষকে বলে- জীবনের পদার্থগতের দিকে বেশী ঝুঁকে পড়ো না তোমরা, বরং আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং ভৌতিক জীবনের মধ্যে কিছুটা সমন্বয়ের চেষ্টা করো।

বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি করতে যদি সকল ধর্ম মত একযোগে কাজ করে তাতে এর চাইতে ভাল কিছু হতে পারে না। তা হবে অবিশ্বাস্য ভাবে উপকারী। ভৌতিক উন্নয়নের প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি আধ্যাত্মিক উন্নতির যে দরকার আছে তাও ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে। যখন আমরা শুধুমাত্র ভৌতিক জীবনের দিকে জোর দিই, তখন সকলকে নাশ করতে পারে এমন বোমা তৈরী করা লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে আমরা যদি মানবিক বা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে দেখি, তখন বুঝতে পারি এই বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের মজুত বয়ে আনছে অনেক সমস্যা। তবু ভৌতিক দিক উপেক্ষা ক’রে আমরা যদি শুধু আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা ভাবতে থাকি; তাহলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। তাও তো ভাল নয়। সুতরাং সামঞ্জস্যের দরকার আছে।

একে অপরের কাছ থেকে শেখা

বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলির মধ্যে আদান-প্রদানের একটি বিষয় হ’ল যে, ওঁরা তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য একে অপরের সঙ্গে বিনিময় করছে। উদাহরণ স্বরূপ, বহু খ্রিষ্টান চিন্তাবিদ বৌদ্ধধর্ম থেকে মনোযোগ বৃদ্ধি এবং ধ্যান শেখার আগ্রহ দেখাচ্ছে। ভারতের ধর্মশালায় এই উদ্দেশ্যে অসংখ্য ক্যাথলিক সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনী, পাদ্রী, যাজক এসেছেন। এই সব শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন ক’রে তাদের পরম্পরায় তা নিয়ে গেছেন। ক্যাথলিক মিশন গুলিতে বহু বৌদ্ধ তা শিখিয়েছেন। কীভাবে একাগ্রতা বর্ধিত হয়; কীভাবে মৈত্রী বিকাশ করা যায়, এসব শেখানোর জন্য আমাকেও কখনও-কখনও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সবাইকে ভালবাসতে বলে খ্রিষ্টধর্ম, কিন্তু কীভাবে ভালবাসতে হবে তা বিস্তারিত ভাবে বলে না। অপরদিকে মৈত্রী কী করে আরও বাড়ানো যায় তার জন্য বৌদ্ধধর্মে অত্যন্ত উন্নত পদ্ধতি রয়েছে। বৌদ্ধধর্ম থেকে এই উপায় গুলি শেখার জন্য খ্রিষ্টধর্মের সর্বোচ্চ স্তর খুবই উদার। তার অর্থ এই নয় যে, ওরা সবাই বৌদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, এখানে কেউ কাউকে ধর্মান্তরিত করছে না। এর মানে হল এই যে, তারা এই উপায় গুলি তাদের নিজেদের ধর্মের মধ্যে থেকেই আরও উন্নত একজন খ্রিষ্টান হওয়ার জন্য গ্রহণ করতে পারে।

তেমনই বহু বৌদ্ধ খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে সমাজসেবা শিখতে আগ্রহী। অধিকাংশ খ্রিষ্টান পরম্পরা এবং সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী শিক্ষকতা, হাসপাতালে সেবা, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অনাথদের সেবাযত্ন ইত্যাদিতে যুক্ত থাকেন। কিছু বৌদ্ধ দেশ এই ধরণের সমাজ-কল্যাণ মূলক কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করেছে। তবে ভৌগোলিক ও নানা রকম সামাজিকতার জন্য সকলে এখনও করে উঠতে পারেনি। সমাজসেবার বিষয়ে বৌদ্ধরা খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। এই বিষয়ে পরম পূজ্য দালাই লামা একেবারে মুক্তকন্ঠ। উভয়পক্ষ একে অপরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও অভিজ্ঞতা শিখতে পারে, এটি সত্যিই অসাধারণ বিষয়। এইভাবে পারম্পরিক সম্মান নির্ভর করে বিশ্বের অগ্রণী ধর্মগুলির মধ্যে একটি মুক্ত মঞ্চ গড়ে উঠতে পারে।

সারাংশ

ধর্মীয় আদান-প্রদান বা বার্তালাপ এখনও পর্যন্ত ঘটেছে সর্বোচ্চ স্তরের ধর্মীয় নেতৃবর্গের মধ্যে, যেখানে মানুষ অনেক উদার এবং ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের মাত্রা অনেক কম মনে হয়। নিম্নস্তরে, মানুষ অনেক বেশী অসুরক্ষিত হয়ে উঠেছে এবং ফুটবল দলের মানসিকতা তৈরী করছে। যেখানে লড়াই ও প্রতিযোগীতা একমাত্র মাপকাঠি। অন্য ধর্মে হোক বা বৌদ্ধ পরম্পরার মধ্যে, এই ধরণের মানসিকতা পোষণ করা দুঃখজনক। বুদ্ধ বহু বৈচিত্রপূর্ণ উপায় শিক্ষা দিয়েছেন। সে সকল শিক্ষা বৈচিত্রময় মানব সমাজের কল্যাণে একই সুরে ধ্বনিত হয়। অতএব বৌদ্ধধর্মের অন্তর্গত বা জগতের আর ধর্ম সমূহ, সকল পরম্পরাকে সম্মান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আলেক্সান্ডার বরজিন এবং থুবতেন ছোড্রোন কর্তৃক রচিত গ্লিম্পস্‌ অফ রিয়েলিটি (বাস্তবতার ঝলক), সিঙ্গাপুর, অমিতাভ বৌদ্ধ কেন্দ্র, ১৯৯৯ থেকে সংশোধিত সারাংশ সংগৃহীত। বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন, সঞ্জীব কুমার দাস, রামকৃষ্ণ দাস (কর্মা জ্ঞানবজ্র) এবং দেবজিৎ চ্যাটার্জী।

Top