বৌদ্ধ ধর্মকে পান্ডিত্যপূর্ণ ভাবে অধ্যয়ন করা আর বৌদ্ধ শিক্ষাগুলিকে দৈনিক জীবনে অন্তর্ভুক্ত করা দুটিই আলাদা জগৎ (আলাদা বিষয়)। এটা প্রায়শই বলা হয়েছে যে, বৌদ্ধধর্মকে কেবল বুদ্ধিমত্তার সাথে অধ্যয়ন করলে সত্যিই আপনার নিজের জীবন লাভবান হবে না। ডঃ আলেক্সান্ডার বরজিন, একজন বিদ্বান এবং অনুশীলনকারী (সাধক), শিক্ষাজগৎ এবং আধ্যাত্মিক জগৎ, উভয় ক্ষেত্রে তার উপস্থিতির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলবেন।

স্পুটনিক প্রজন্ম

১৯৪৪ সালে আমেরিকার একটি খুবই সাধারণ পরিবারে আমার জন্ম হয়েছিল। আমার পরিবারের কাছে অনেক টাকা-পয়সা ছিল না, তারা সাধারণ কাজের মানুষ ছিলেন এবং বেশী শিক্ষিতও ছিলেন না। কিন্তু তরুণ বয়স থেকেই আমার মধ্যে সহজাত ভাবেই এশিয় জিনিসের প্রতি একটা তীব্র আগ্রহ ছিল। এর জন্য আমার পরিবারের লোকজন আমাকে উৎসাহও দেয় নি, আবার নিরুৎসাহিতও করেননি। যাইহোক, সেই দিনগুলিতে এশিয়ার বিষয়ে খুব বেশী তথ্যও উপলব্ধ ছিল না। যখন আমার বয়স ১৩ বৎসর হল, তখন আমি একটি বন্ধুর সাথে যোগসাধনা শুরু করেছিলাম। ঐ সময় আমি বৌদ্ধধর্ম, ভারতীয় দর্শন, চীনা দর্শন ইত্যাদির বিষয়ে যা উপলব্ধ ছিল সব পড়ে ফেলেছিলাম।

আমি সেই প্রজন্মের অংশ যাকে আমেরিকায় “স্পুটনিক প্রজন্ম” বলা হয়। যখন স্পুটনিক রকেটটি অন্তরীক্ষে পাঠানো হয়েছিল, তখন আমেরিকা খুব মর্মাহত হয়ে গিয়েছিল, কারণ আমাদের মনে হতো যে, আমরা রাশিয়ার থেকে অনেক পিছিয়ে পড়লাম। স্কুলে পড়া সব ছেলে-মেয়েরা, যাদের মধ্যে আমিও ছিলাম, তাদের বিজ্ঞান পড়ার জন্য উৎসাহিত করা হতো যাতে আমরা রাশিয়াকে নাগাল পেতে পারি। এই জন্য আমি ১৬ বৎসর বয়সে রসায়ন বিজ্ঞান অধ্যয়ন করার জন্য রট্‌জার্স বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। রট্‌জার্স বিশ্ববিদ্যালয়টি নিউজার্সিতে অবস্থিত, যেখানে আমি বড় হয়েছি। সেখান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে গেশে ওয়াঙ্‌গ্যাল নামের একজন কাল্মিক মঙ্গোল বৌদ্ধ আচার্য থাকতেন, কিন্তু তার বসবাসের বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না।

আমার অধ্যয়নের অংশ হিসাবে আমি এশিয়ান বিদ্যা-এর একটা অতিরিক্ত বিষয় নিয়েছিলাম। সেখানে বলা হয়েছিল যে, বৌদ্ধধর্ম কীভাবে একটা সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতায় পৌঁছেছিল এবং কীভাবে প্রত্যেক সভ্যতা সেটাকে আলাদা-আলাদা ভাবে বুঝেছিল। যদিও সেই সময় আমার বয়স কেবল ১৭ বৎসরই ছিল, কিন্তু এটা আমার উপর একটা গভীর প্রভাব ফেলেছিল। আমি বলেছিলাম, “এটাই সেই কাজ যার সাথে আমি যুক্ত হতে চাই, বৌদ্ধধর্মের এক সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতায় যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে চাই।” এবং এই পথ থেকে বিচলিত না হয়ে, পরিবর্তন না করে আমি আমার অবশিষ্ট জীবনে এটাই অনুসরণ করেছি।

প্রিন্সটনঃ রসায়ন বিজ্ঞান থেকে চীনা ভাষা, চিন্তন এবং দর্শনের দিকে

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে এশিয়ান স্টাডিস বিভাগে ছাত্রদের আরও অধিক আকর্ষণ করার জন্য একটা নতুন পাঠক্রম শুরু হয়েছিল। সেই সময় সেখানে খুব কম সংখ্যক ছাত্র ছিল; এটা ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরুর দিনগুলি, আর সেই সময় কোনো এশিয় ভাষা জানা আমেরিকাবাসী খুব কম ছিল। আমি এই সুযোগটাকে নিয়ে খুব উৎসাহিত ছিলাম কারণ চীনা ভাষা অধ্যয়ন করার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল, তাই আমি আবেদন করেছিলাম এবং সেটা গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৮ বৎসর বয়সে আমি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা অধ্যয়ন করা শুরু করলাম এবং নিজের স্নাতক উপাধির শেষ দুটি বর্ষ সেখানেই শেষ করলাম।

আমি সবসময় এটাই জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম যে, যখন বৌদ্ধধর্ম চীনে পৌঁছেছিল তখন সেখানে সেই বিষয়টিকে চীনা দর্শন কীভাবে প্রভাবিত করেছিল, আর পরে বৌদ্ধধর্ম চীনা দর্শনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই জন্য আমি চীনা চিন্তন, দর্শন, ইতিহাস, বৌদ্ধধর্ম ইত্যাদির অধ্যয়ন করেছিলাম। গ্রীষ্ম কালে আমাকে প্রগাঢ় ভাষা বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল অর্থাৎ এক বছর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য, এক বছর শাস্ত্রীয় চীনা ভাষা শেখার জন্য স্টেনফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং স্নাতক উপাধি প্রাপ্ত করার পর গ্রীষ্ম কালে এক বছর তাইওয়ানে পাঠানো হয়েছিল। নিজের স্নাতক অধ্যয়নের জন্য আমি আবার হার্ভার্ডে ফিরেছিলাম। চীনা পাঠক্রমের অংশ হিসাবে আমি জাপানী ভাষারও অধ্যয়ন ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছিলাম এবং সুদূর প্রাচ্য ভাষাগুলিতে নিজের স্নাতকোত্তর উপাধি প্রাপ্ত করার আগেই আমি চীনা বিদ্যার বিস্তৃত অধ্যয়ন করে ফেলেছিলাম।

চীনা, সংস্কৃত এবং তিব্বতীঃ তুলনামূলক অধ্যয়ন

আমি ভারতীয় পক্ষও ভালো ভাবে জানতে চেয়েছিলাম যেমন ভাবে আমি চীনা পক্ষটি জেনেছিলাম, যাতে আমি বুঝতে পারি যে, বৌদ্ধধর্মের বিকাশে কী প্রভাব পড়েছিল। এই জন্য আমি সংস্কৃত ভাষা অধ্যয়ন করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। আমি সংস্কৃত এবং ভারতীয় বিদ্যা (ইন্ডিয়ান স্টাডিস), আর সুদূর প্রাচ্য ভাষা বিভাগ থেকে সংযুক্ত ভাবে ডক্টরেট উপাধি প্রাপ্ত করেছিলাম। সংস্কৃত এবং ভারতীয় বিদ্যা আমাকে তিব্বতী ভাষা অবধি নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমি বৌদ্ধ দর্শন এবং ইতিহাসের অধ্যয়নের উপর জোর দিয়েছিলাম।

আপনারা জানেন যে, জ্ঞান অর্জন করার জন্য আমার তীব্র তৃষ্ণা আছে, আর এই জন্য আমি দর্শন এবং মনোবিজ্ঞানে অতিরিক্ত বিষয় নিয়েছিলাম এবং এই সবের মধ্যেও বিজ্ঞান নিয়ে নিজের কৌতূহল বজায় রেখেছিলাম। এইভাবে আমি আমার অধ্যয়ন শেষ করেছিলাম এবং অনুবাদের তুলনা করার সাধারণ বৌদ্ধ পদ্ধতিগুলি শিখেছিলাম। আমরা সংস্কৃত ভাষার বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করতাম আর দেখতাম যে, সেগুলি কীভাবে চীনা এবং তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। এর সাথে ধারণা বিকাশের ইতিহাসেরও অধ্যয়ন করতাম এবং এটা জানার চেষ্টা করতাম যে, এই সব কিছু সাধারণ ইতিহাসের সাথে কীভাবে পরস্পর যুক্ত হয়ে আছে। আমার এই পুরো কর্মজীবনে এই ধরণের প্রশিক্ষণ খুবই সহায়ক হয়েছে।

হার্ভার্ড থেকে ব্যবহারিক পরম্পরা পর্যন্ত সফর

এই সবের মধ্যেও আমার কৌতূহল এটা নিয়ে ছিল যে, এশিয়ার এই সব দর্শনগুলি এবং ধর্মগুলি, যেগুলির আমি অধ্যয়ন করেছি- বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দু ধর্মের, এবং তাওধর্ম ও কনফুসিয়াস ধর্মের বিভিন্ন স্বরূপগুলির বিষয়ে এরকমভাবে বিচার করলে কেমন হবে। কিন্তু এর জীবন্ত পরম্পরার সাথে যুক্ত হতে কোনো বাস্তব অবসর উপলব্ধও ছিল না; এমন মনে হতো যেন আমি প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের বিষয়ে অধ্যয়ন করছি। তবুও আমার কৌতুহল ছিল খুব উঁচু।

কিন্তু ১৯৬৭ সালে যখন আমি তিব্বতী ভাষা অধ্যয়ন করা শুরু করেছিলাম, তখন রবার্ট থুরমান হার্ভার্ড ফিরে এসেছিল এবং আমরা দুজনেই সহপাঠী ছিলাম। থুরমান গেশে ওয়াঙ্‌গ্যালের খুব ঘনিষ্ঠ শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিলেন, এবং তিনি কয়েক বছর তার সাথে থেকেছিলেন। তিনি এক বছর ভিক্ষু জীবনও কাটিয়েছিলেন এবং ধর্মশালায় অধ্যয়নের জন্য ভারতে গিয়েছিলেন। তিনিই আমাকে গেশে ওয়াঙ্‌গ্যালের বিষয়ে এবং ধর্মশালা গিয়ে অধ্যয়ন করার সম্ভাবনার বিষয়ে বলেছিলেন, যেখানে তিব্বতী মানুষজন এবং পরম পূজ্য দালাই লামা থাকতেন। আমি যখনই ছুটিতে বাড়ি যেতাম তখনই গেশে ওয়াঙ্‌গ্যালের সাথে দেখা করতে তার নিউজার্সিতে অবস্থিত মঠে যেতাম এবং আমি বৌদ্ধধর্মকে একটা জীবন্ত পরম্পরা রূপে বুঝতে পারলাম। যদিও আমি অনেকবার গেশে ওয়াঙ্‌গ্যালের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমার কখনও তার সাথে থাকা এবং অধ্যয়ন করার সৌভাগ্য হয়নি। তা সত্ত্বেও তিনি আমাকে ভারতে যাওয়ার এবং সেখানে নিজের শিক্ষা চালু রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এই জন্য আমি ফুলব্রাইট ফেলোশিপের জন্য আবেদন করেছিলাম যাতে আমি ভারতে তিব্বতীদের সাথে থেকে নিজের গবেষণামূলক প্রবন্ধের জন্য গবেষণা করতে পারি।

১৯৬৯ সালে আমি ভারতে পৌঁছেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল ২৪ বৎসর। ভারতে পৌঁছে আমি পরম পূজ্য দালাই লামার সাথে দেখা করলাম এবং সম্পূর্ণভাবে তিব্বতী সমাজের সাথে মিশে গেলাম। সেখানে পৌঁছে আমার মনে হ’ল, এখনও পর্যন্ত আমার পুরো জীবন এমনই ছিল যেন আমি কোনো পরিবাহক বলয়ে (কনভেয়ার বেল্ট) আছি, যা আমাকে নিউ জার্সির সাধারণ পরিবার থেকে সম্পূর্ণ পান্ডিত্যের জন্য প্রিন্সটন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং এখন দালাই লামা এবং তার আশপাশের মহান তিব্বতী আচার্য পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আমি দেখলাম যে, আমি তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের বিষয়ে যা কিছু পড়েছিলাম সেগুলি সব এখানে একদম জীবন্ত এবং এখানে এমন মানুষও আছে যারা বৌদ্ধ শিক্ষায় বর্ণিত সব শিক্ষারই অর্থের বাস্তব জ্ঞান আছে। সেই মহান আচার্যদের কাছ থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত করার এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল।

ডালহৌসীতে তিব্বতী ভাষায় কথা বলা শেখা

যখন আমি ভারতে গিয়েছিলাম, তখন আমি তিব্বতী ভাষায় কথা বলতে জানতাম না। হার্ভার্ড-এ আমার শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর নাগাতোমী। সত্যি কথা বলতে, তিনি এই ভাষা উচ্চারণই করতে জানতেন না। তিনি ছিলেন জাপানী এবং আমরা তিব্বতী ভাষাকে জাপানী ব্যাকরণের মাধ্যমে শিখেছিলাম কারণ সেই সময় উপলব্ধ একমাত্র পাঠ্যপুস্তকে তিব্বতী ব্যাকরণের ব্যাখ্যা ল্যাটিন ভাষার তুলনায় করা হয়েছিল! ল্যাটিন এবং তিব্বতী ভাষার মধ্যে সাধারণ কোনো মিলই ছিল না, পক্ষান্তরে জাপানী ব্যাকরণ প্রকৃতপক্ষে তিব্বতী ভাষার কাছাকাছি ছিল।

আমাকে কথা বলা শিখতে হতো, কিন্তু সেই সময় কোন পাঠ্যপুস্তক অথবা সামগ্রী উপলব্ধ ছিল না। গেশে ওয়াঙ্‌গ্যালের সাথে আমার সম্পর্কের কারণে আমি শারপা এবং খামলুঙ্‌ নামক দুই টুলকু রিনপোছে (পুনর্জন্ম নেওয়া লামা)-এর সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করতে পেরেছিলাম, যারা কিছু বছর গেশে ওয়াঙ্‌গ্যালের মঠে ছিলেন এবং তারা ইংরেজীও ভালো জানতেন। তারা ডালহৌসীতে থাকতেন, যেখানে অনেক তিব্বতী শরণার্থী বসবাস করত। সেখানে তারা কৃপা করে আমার জন্য একটি পাহাড়ের উপর ছোট্ট বাড়িতে সোনম নোরবু নামক এক তিব্বতী ভিক্ষুর সাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি ইংরাজী বুঝতেন না আর আমি তিব্বতী ভাষা বলতে পারতাম না, কিন্তু এক সাথে থাকার ফলে যেভাবে হোক আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হতো। এখানেই আমার বৌদ্ধধর্ম-দর্শন ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ চালু হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হতো যে, আমি বোর্ণিয়া অথবা আফ্রিকাতে থাকা কোনও মানব বিজ্ঞানী, যে অন্য কোন ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে।

আমি যে এশিয়ান ভাষাগুলির অধ্যয়ন করেছিলাম, সেগুলি তিব্বতী ভাষার উচ্চারণগুলি শুনে বুঝতে এবং কিছুটা উন্নতি করতে সহায়তা করেছিল। যখন আমাকে সোনম-এর সাথে কোন কথা বলতে হতো তখন আমি তাকে লিখে দিতাম (কারণ আমি তিব্বতী ভাষা লিখতে জানতাম), এবং সে আমাকে শেখাত সেটার উচ্চারণ কীভাবে করতে হয়। আমরা এইভাবে কাজ করতাম, এবং এছাড়াও আমি একজন অন্য ব্যক্তির কাছ থেকেও ভাষা শিক্ষা প্রাপ্ত করেছিলাম। অবশেষে দুই যুবক রিনপোছে আমাকে তাদের শিক্ষক, গেশে ঙাওয়াঙ্‌ ধারগ্যে-এর কাছ থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত করতে বলেছিলেন।

গোশালায় লাম-রিমের (মার্গ-ক্রম) অধ্যয়ন

আমি নিজের গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখার জন্য ভারতে এসেছিলাম। যদিও আমার পরিকল্পনা ছিল গুহ্যসমাজ তন্ত্রের বিষয়ের উপর গবেষণা করা, কিন্তু যখন আমি এই বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য পরম পূজ্য দালাই লামার শিক্ষকদের মধ্যে একজন সেরকোঙ্‌ রিনপোছের সাথে দেখা করলাম, তখন তিনি আমাকে প্রণোদিত করেছিলেন যে, এটা করা একদম অর্থহীন হবে কারণ আমি এর জন্য একদমই তৈরী নয়। পরম পূজ্যের কনিষ্ঠ শিক্ষক ঠিজঙ্‌ রিনপোছে বলেছিলেন যে, এর পরিবর্তে প্রথমে আমি যেন মার্গের ক্রমিক স্তর অর্থাৎ লাম-রিমের অধ্যয়ন করি। সেই সময় পর্যন্ত এই বিষয়ের উপর কোনো প্রকারের অনুবাদ করা হয়নি, এইজন্য এই বিষয়টা আমার জন্য একদম নতুন ছিল। সেই সময় তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের ব্যাপারে কেবল আলেক্সান্ড্রা ডেভিড-নীল, ইভান্স-উন্টজ্‌, লামা গোবিন্দ আর কিছু অন্য লেখকের পুস্তকই উপলব্ধ ছিল। আমি ঙাওয়াঙ্‌ ধারগ্যের কাছে থেকে লাম-রিমের মৌখিক পরম্পরার শিক্ষা নিয়েছিলাম এবং তারপর সেটাকে আমার গবেষণামূলক প্রবন্ধের ভিত্তি করেছিলাম।

ডালহৌসীতে আমার জীবন-যাপন খুবই সাধারণ ছিল। আমার ঘরে জলের ব্যবস্থা ছিল না আর শৌচালয়ও ছিল না। কিন্তু ঙাওয়াঙ্‌ ধারগ্যে তার থেকেও সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। তিনি একটি চালার মধ্যে থাকতেন, যেখানে তিনি থাকার আগে একটি গরুকে রাখার কাজে ব্যবহার হতো। সেখানে তার একটি খাট রাখার মতোই জায়গা ছিল। তার খাটের সামনে অল্প জায়গা ছিল যেখানে তার তিনজন যুবক রিনপোছের শিষ্য এবং আমি মাটিতে বসে পড়তাম আর তিনি উপদেশ দিতেন। ঝাডো রিনপোছে ও শারপা এবং খামলুঙ্‌ রিনপোছেও আমার সাথে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি পরম পূজ্য দালাই লামার মঠ, নামগ্যাল মঠের মঠাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। মাছি এবং অন্য কীট-পতঙ্গে ভরা এই গোশালাতেই আমরা অধ্যয়ন করতাম।

এই সময়টা খুবই উৎসাহিত করার মতো ছিল, কারণ সেই সময় অনেক নতুন জিনিস শুরু হয়েছিল। পরম পূজ্য দালাই লামা আমাদের কার্যকলাপ এবং শিক্ষার ব্যাপারে খোঁজ নিতেন এবং পরে তিনি আমাদের অনুবাদ করার জন্য ছোট-ছোট গ্রন্থ দেওয়াও শুরু করলেন। যখন পরম পূজ্য দালাই লামা ধর্মশালায় তিব্বতী গ্রন্থ এবং অভিলেখের জন্য পুস্তকালয় নির্মাণ করলেন, তখন তিনি গেশে ধারগ্যেকে সেখানে পাশ্চাত্য জগতের মানুষদের জন্য শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করলেন এবং আমার সহায়তা করা শারপা এবং খামলুঙ্‌ রিনপোছেকে অনুবাদক হিসাবে নিযুক্ত করলেন। যখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, আমি কি কোনো ভাবে সহায়তা করতে পারি, তখন তিনি বললেন যে, “হ্যাঁ, কিন্তু প্রথমে তুমি আমেরিকা ফিরে যাও, সেখানে তোমার গবেষণা-প্রবন্ধ জমা করো, ডিগ্রী প্রাপ্ত করো এবং তারপর ফিরে এসো।”

তিব্বতী সমাজের সাথে মানানসই হওয়াঃ অনুবাদক হওয়া

ভারতে আমার প্রারম্ভিক দিনগুলিতে তিব্বতী সমাজের সাথে মানানসই হওয়ার জন্য আমি সেই পারম্পারিক ভূমিকাটি গ্রহণ করার চেষ্টা করেছিলাম যাতে তারা সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারে; এইভাবে আমি অনুবাদক হয়েছিলাম। আমার তীব্র ইচ্ছা ছিল যে, আমি স্বয়ং নিজের বৌদ্ধ সাধনা শুরু করি এবং এই জন্য ১৯৭০ সালের শুরুতে আমি আনুষ্ঠানিক ভাবে বৌদ্ধ হলাম এবং ধ্যান-সাধনার অনুশীলন শুরু করলাম। তখন থেকে আমি প্রতিদিন ধ্যান-সাধনা করে চলেছি।

অনুবাদকের ভূমিকার জন্য কেবল ভাষার কৌশল জানা পর্যাপ্ত নয়, এছাড়াও বৌদ্ধধর্মের গভীর জ্ঞান থাকা দরকার, অর্থাৎ ধ্যান সাধনা করা এবং শিক্ষাগুলি বাস্তব জীবনে কার্যে পরিণত করা আবশ্যক। চিত্তের বিভিন্ন অবস্থাগুলি অথবা ধ্যান সাধনার আলাদা-আলাদা অনুভবগুলিকে ব্যক্ত করার পারিভাষিক শব্দগুলিকে স্বয়ং বাস্তবে অনুভব না করে সেটার অনুবাদ করার আর কোন উপায় নেই। অনুবাদের জন্য প্রয়োগে আনার শব্দাবলীর চয়ন মুখ্যতঃ সেই ধর্মপ্রচারকদের দ্বারা করা হয়েছিল, যারা মুখ্যতঃ বাইবেলের অনুবাদ তিব্বতী ভাষায় করতে চেয়েছিল, আর বৌদ্ধ ধর্মে এই শব্দগুলির বাস্তবিক অর্থের সাথে খুবই কম মিল ছিল। এই জন্য সেই প্রারম্ভিক সময় থেকেই আমি নিজের বৌদ্ধ সাধনাকে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে নিজের অধ্যয়নের সাথে জুড়ে দিয়েছিলাম।

আমি ১৯৭১ সালের শেষদিকে হার্ভার্ড ফিরে গিয়েছিলাম। কয়েক মাস পরে নিজের গবেষণা-প্রবন্ধ জমা করে দিয়েছিলাম এবং ১৯৭২ সালের বসন্তকালে নিজের ডক্টরেট উপাধি প্রাপ্ত করেছিলাম। যেহেতু আমার সবসময় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হওয়ার ইচ্ছা ছিল, এই জন্য আমার প্রফেসর অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জন্য শিক্ষকতার একটা খুব ভাল চাকরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি সেই প্রস্তাবটিকে অস্বীকার করেছিলাম। আমি নিজের শেষ জীবন এমন কিছু মানুষদের সাথে কাটাতে চাইনি যারা এটার শুধু অনুমান করে যে, বৌদ্ধধর্ম কী। পরিবর্তে আমি সেই মানুষদের মধ্যে থাকতে চেয়েছিলাম যারা ঠিক-ঠাক জানত যে, বৌদ্ধধর্ম কী, আর আমি প্রামাণিক পরম্পরার থেকে শিখতে চেয়েছিলাম এবং সাথে-সাথে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপারে নিজের অধ্যয়নের আধারের উপর নিজের দৃষ্টিকোণও রাখতে চেয়েছিলাম। স্বভাবতঃ আমার প্রফেসর মনে করেছিলেন যে, আমি পাগল হয়ে গিয়েছি, তবুও আমি ভারতে ফিরে এলাম। সেখানে থাকার খরচ খুব কম ছিল, তাই এটা করা সম্ভব হয়েছিল।

আমার নতুন ভারতীয় জীবন

আমি ধর্মশালা চলে গেলাম এবং সেখানে আমি ঙাওয়াঙ্‌ ধারগ্যে আর শারপা এবং খামলুঙ্‌ রিনপোছে, যারা আগে থেকেই লাইব্রেরীতে কাজ করছিলেন, তাদের সাথে কাজ করা শুরু করে দিলাম। আমি সেখানে ডালহৌসীর থেকেও একটা ছোট কুটিরে থাকতাম, যেখানে না ছিল জল আর না ছিল শৌচালয়ের ব্যবস্থা এবং এমনকি সেই ঘরে জানালায় কাঁচও ছিল না। সোনম নোরবু নামক তিব্বতী ভিক্ষু যার সাথে আমি আগে থাকতাম, তিনিও আমার সাথে থাকার জন্য চলে এলেন। ভারতের সেই সাধারণ কুটিতে আমি সব মিলিয়ে ২৯ বছর বাস করেছিলাম।

সেই সময় আমি লাইব্রেরীতে পরম পূজ্যের জন্য অনুবাদ দপ্তর স্থাপন করতে সহায়তা করেছিলাম এবং আমার অধ্যয়ন অব্যাহত রেখেছিলাম। আমি দেখলাম যে, আমার পটভূমি বৌদ্ধধর্মের বৌদ্ধ শিক্ষাগুলি আরও বেশি অধ্যয়ন করতে আমার সহায়ক হয়েছিল। আমি ইতিহাস জানতাম এবং বিভিন্ন গ্রন্থের নামের সাথেও পরিচিত ছিলাম, আর আমাকে প্রামাণিক বিষয়বস্তুর শিক্ষা দেওয়ার শিক্ষকও উপলব্ধ ছিল। এটাই কারণ ছিল যে, আমি জিনিসগুলিকে খুব সহজেই বুঝতে পারতাম। পরম পূজ্য দালাই লামা আমাকে চারটি তিব্বতী পরম্পরারই অধ্যয়ন করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন, যদিও আমি মুখ্যতঃ গেলুগ সম্প্রদায় সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছিলাম যাতে তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক বিষয়-ক্ষেত্রকে বুঝতে পারি। এটা খুব উদ্দীপক সময় ছিল কারণ সেই দিনগুলিতে মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না যে, তিব্বতী বৌদ্ধ শিক্ষাগুলিতে কোন-কোন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সেরকোঙ্‌ রিনপোছের কাছ থেকে স্মৃতি এবং বিনম্রতার শিক্ষা গ্রহণ করা

১৯৭৪ সালে পরম পূজ্য দালাই লামার শিক্ষকদের মধ্যে একজন, সেরকোঙ্‌ রিনপোছের কাছ থেকে আমি শিক্ষা গ্রহণ আরম্ভ করলাম। রিনপোছের সাথে আমার প্রথম দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। ধর্মশালায় আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার সময় উনি দেখেছিলেন, আমার এবং তার মধ্যে কার্মিক সম্বন্ধ আছে যে, আমি তার এবং পরবর্তীকালে পরম পূজ্য দালাই লামার অনুবাদক হব, এই জন্য তিনি আমায় এই কার্যের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। যদিও পুস্তকের অনুবাদ তো আমি আগে থেকেই করছিলাম, কিন্তু এই প্রশিক্ষণটা মৌখিক অনুবাদ করা এবং শিক্ষা দেওয়ার জন্য ছিল। তিনি আমাকে নিজের কাছে বসাতেন যাতে আমি দেখে বুঝতে পারি যে, তিনি আলাদা-আলাদা মানুষের সাথে কীভাবে ব্যবহার করতেন। তিনি আমাকে স্মৃতির প্রশিক্ষণও দিতেন। যেমন- আমি যখন সাথে থাকতাম, তখন হঠাৎ তিনি চুপ করে যেতেন এবং বলতেন, “আমি এখনই যা বললাম, অক্ষরে-অক্ষরে পুনরাবৃত্তি কর,” অথবা “তুমি এখনই যেটা বললে, সেটা অক্ষরে-অক্ষরে পুনরাবৃত্তি কর।”

দ্বিতীয় বছর থেকে আমি তাঁর জন্য অনুবাদ করা শুরু করেছিলাম, যখন তিনি পাশ্চাত্য জগতের মানুষদের শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি কখনও আমাকে একা শিক্ষা দিতেন না। আমার শিক্ষা সবসময় অন্য কারোর জন্য অনুবাদ করার সময়ই হতো- কালচক্রকে ছেড়ে। কালচক্রের শিক্ষা তিনি আমাকে গোপনীয়ভাবে দিতেন; তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর সাথে আমার কোনো গভীর সম্পর্ক আছে। শিক্ষা গ্রহণ করার সময় আমার কোনো কথা লিখে রাখার অনুমতি ছিল না, বরং আমাকে সবসময় সব কথা মনে রাখতে হতো, যেগুলি আমি পরে লিখে রাখতাম। কিছু দিন পরে তিনি আমাকে উপদেশ শেষ হওয়ার পরেও লেখার অবসর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে অন্য কোন কাজ দিয়ে দিতেন এবং পরে আমি গভীর রাতেই সবকিছু লিখে রাখার সময় পেতাম।

যেমন গেশে ওয়াঙ্‌গ্যাল নিজের ঘনিষ্ঠ শিষ্যদের সাথে করতেন, তেমনই সেরকোঙ্‌ রিনপোছেও আমাকে বারবার বকা দিতেন। আমার মনে আছে, একবার যখন আমি তার জন্য অনুবাদ করছিলাম, তখন আমি তার বলা একটি শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করেছিলাম কারণ আমি সেই শব্দটি বুঝতে পারছিলাম না। তিনি চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “আমি এই শব্দটির অর্থ তোমাকে সাত বছর আগে বুঝিয়েছিলাম।। তোমার কেন মনে নেই? আমার মনে আছে!”

আমার জন্য তার প্রিয় নাম ছিল “বুদ্ধু” এবং যখনই আমি বুদ্ধুর মতো কাজ করতাম তখনই তিনি এটার প্রয়োগ করতে ভুলতেন না, বিশেষ করে অন্যদের সামনে। এটা একটা খুব ভাল প্রশিক্ষণ ছিল। আমার মনে আছে, একবার আমি প্রায় ১০০০০ মানুষের সভায় পরম পূজ্য দালাই লামার জন্য অনুবাদ করছিলাম এবং পরম পূজ্য আমাকে মাঝখানেই থামতে বললেন, তিনি হেসে বললেন, “ইনি এখনই একটা ভুল করে ফেললেন।” প্রত্যেকবার বুদ্ধু বলা প্রশিক্ষণের কারণে আমি কম্বলের তলায় লুকানোর বদলে নিজের অনুবাদ কার্য করতে সক্ষম হয়েছিলাম। অনুবাদ করার জন্য অবিশ্বাস্য মনোযোগ এবং একটি অসাধারণ স্মৃতিশক্তি থাকা প্রয়োজন, তাই আমি খুবই ভাগ্যবান যে আমার বৌদ্ধ অধ্যয়নের অভ্যাসের সাথে-সাথে পারম্পরিক তিব্বতী শিক্ষাও প্রাপ্ত হয়েছিল।

আমি ৯ বছর সেরকোঙ্‌ রিনপোছের কাছ থেকে গভীর শিক্ষা প্রাপ্ত করেছিলাম। আমি তাঁর জন্য অনুবাদ করেছিলাম, তাঁর চিঠি এবং ভ্রমণেও সহায়তা করেছিলাম। এই সব কিছুর জন্য তিনি আমাকে কেবল দুই বার “ধন্যবাদ” বলেছিলেন। এটাও আমার জন্য খুব উপকারী হয়েছিল কারণ, যেমন তিনি বলতেন, আর আমি কী আশা করতে পারি? যে আমার মাথায় হাত বোলানো হবে এবং আমি কোনো কুকুরের মতো নিজের লেজ নাড়াবো? অনুবাদ করা ব্যক্তিকে অপরের কল্যাণ করার অনুপ্রেরণার সাথে অনুবাদ করা উচিত, “ধন্যবাদ”-এর রূপে প্রশংসা পাওয়ার জন্য নয়। নিঃসন্দেহে, কখনও ক্রোধিত হওয়া অথবা নিবৃত্ত না হয়ে এই পারম্পরিক শিক্ষার প্রক্রিয়াকে পুরো করার জন্য আমার পুরো বৌদ্ধ ধ্যান-সাধনা এবং প্রশিক্ষণ নিতান্ত আবশ্যক।

সংস্কৃতিগুলির মধ্যে সেতু বন্ধনে সহায়ক ভূমিকা

১৯৮৩ সালে সেরকোঙ্‌ রিনপোছে পরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। তারপরে আমাকে সারা বিশ্বে ভ্রমণ করে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হচ্ছিল, কারণ আমি আগে রিনপোছের অনুবাদক রূপে এর মধ্যে কিছু স্থানে ভ্রমণ করেছিলাম। তখন পর্যন্ত আমি কখনও-কখনও পরম পূজ্য দালাই লামার জন্য অনুবাদ করাও শুরু করেছিলাম। কিন্তু অনুবাদ বলতে শুধুমাত্র শব্দের অনুবাদ করা নয়, বরং তার মধ্যেকার ভাব এবং বিচারগুলির ব্যাখ্যা এবং অনুবাদ করাটাও বটে। পাশ্চাত্য জগতের মনোবৈজ্ঞানিক, বৈজ্ঞানিক এবং ধার্মিকগুরুদের সাথে পরম পূজ্যের সেই প্রথম দিকের বৈঠকগুলিতে আমার কাজ ছিল মূলতঃ তাদের ধারণাগুলির ব্যাখ্যা করা, তাদের শব্দগুলির অনুবাদ করা নয় (কারণ তিব্বতী ভাষায় অধিকাংশ শব্দ উপলব্ধ ছিল না), আর আমি সংস্কৃতিগুলির মধ্যে সেতু নির্মাণের কাজ করতাম। আর এটাই সেই কাজ ছিল যাতে আমি খুব ছোট বয়স থেকেই উৎসাহী ছিলাম যে, আমি বৌদ্ধ শিক্ষাগুলির দৃষ্টিতে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সেতু রূপে কাজ করব। এমন সেতু হওয়ার জন্য এটা আবশ্যক যে, আপনাকে দুটি সংস্কৃতিরই ভাল জ্ঞান থাকতে হবে, মানুষের ধারণা এবং তাদের জীবনশৈলী সম্পর্কেও জানতে হবে। আর আমার তিব্বতীদের সাথে দীর্ঘ সময় কাটানো বিশেষ সুবিধা এবং সৌভাগ্য প্রাপ্ত হয়েছিল। সেখানে আমি তাদের ধারণা, জীবন-পদ্ধতি ইত্যাদিকে গভীরভাবে দেখেছিলাম এবং বুঝেছিলাম। বৌদ্ধধর্মের প্রসারের জন্য এই পরিচিতিটা অত্যন্ত আবশ্যক ছিল।

আমি পরম পূজ্য দালাই লামার পক্ষ থেকে কয়েকটি আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা শুরু করেছিলাম এবং কয়েকটি পরিকল্পনা শুরু করার জন্য আমাকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে প্রধান কার্য ছিল সারা বিশ্বে পরম পূজ্য এবং তিব্বতীদের জন্য ভ্রমণ করার পথ সুগম করার জন্য প্রয়াস করা। তাদের কাছে নিজের পাসপোর্ট ছিল না, শুধু শরণার্থীর কাগজ পত্র ছিল। এই জন্য তারা কোনো দেশ ভ্রমণ করার জন্য ভিসা পেত না, যতক্ষণ না তাদের সেখানে আমন্ত্রণ করা হতো। কিন্তু তাদের যোগাযোগ অল্প কিছু স্থানের সঙ্গেই ছিল। এখানে আমার হার্ভার্ডের পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি খুব সাহায্য করেছিল, কারণ আমাকে বিদ্যালয়গুলিতে অতিথি রূপে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সারা বিশ্ব থেকে আমন্ত্রণ করতে পারত। এইভাবে আমি সম্পর্ক তৈরী করেছিলাম যাতে ভবিষ্যতে তিব্বতীদের এবং পরবর্তীকালে পরম পূজ্যকে বিদেশে আমন্ত্রণ করার উপায় প্রশস্ত হয়েছিল। এর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পরম পূজ্যের কার্যালয়ের স্থাপনা করতে সহায়ক হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে আমি সমস্ত পূর্ব সাম্যবাদী দেশগুলিতে, দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সব দেশে, আর আফ্রিকার অনেক জায়গায় যাওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। তারপর বৌদ্ধ এবং মুসলিমদের মধ্যে কথোপকথন শুরু করার জন্য আমি মধ্য-পূর্বের দেশগুলিতেও যাওয়া শুরু করেছিলাম।

এই সবের মধ্যে আমি পরম পূজ্যকে সব দেশের যাত্রা বৃত্তান্ত পাঠানোতে নিজের ধ্যানকেন্দ্রিত করে রেখেছিলাম, যাতে যেখানে-যেখানে আমি যেতাম, সেই দেশগুলির সংস্কৃতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা পরিচিত হতে থাকে। এখানেও আমি নিজের হার্ভার্ডের পটভূমিকার জন্য এই দেশগুলির বিভিন্ন ধর্মগুরুদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারতাম, আর তাদের থেকে তাদের ধর্ম সম্পর্কে শিখতে পারতাম যাতে যখন পরম পূজ্য সেই দেশে ভ্রমণ করবেন, তখন তার ঐ দেশের মানুষদের বিশ্বাস সম্পর্কে একটা ধারণা থাকে। আমি যে বৌদ্ধ এবং বৈজ্ঞানিক শিক্ষা অর্জন করেছিলাম, সেটা থেকে আমি বুঝতে সক্ষম হতাম যে, কোন্‌-কোন্‌ জিনিস দরকারী, যেটা আমি সংঘবদ্ধ করতে পারি এবং এমনভাবে প্রস্তুত করতে পারি যে, সেটা উপযোগী হবে।

আমি অনেকগুলি পরিকল্পনার সাথে যুক্ত ছিলাম। তার মধ্যে সব থেকে উপযোগী এবং আকর্ষকপূর্ণ ছিল চেরনোবিলের ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করার জন্য তিব্বতী চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ, যেটা সোভিয়েত ইউনিয়ানের স্বাস্থ্য মন্ত্রালয়ের দ্বারা আয়োজিত করা হয়েছিল। যদিও তিব্বতী চিকিৎসা পদ্ধতি সেখানে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়েছিল, কিন্তু যখন সোভিয়েত ইউনিয়ান ভেঙে গেল তখন রাশিয়া, বেলারুশ এবং ইউক্রেন এই পরিকল্পনায় সহযোগিতা করতে অস্বীকার করল এবং তারা এটার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করল যে, আমরা তিনটি আলাদা-আলাদা পরিকল্পনা শুরু করি, কিন্তু সেটা শারীরিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে করা সম্ভবই ছিল না। এই কারণে সেই পরিকল্পনার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।

আর একটি আকর্ষণীয় পরিকল্পনা ছিল যে, মঙ্গোলিয়ায় বৌদ্ধধর্মের পুনর্জীবিত করা। এটা করার জন্য বকুলা রিনপোছে দ্বারা লিখিত পুস্তকগুলিকে আধুনিক মঙ্গোলিয়ান ভাষায় অনুবাদ এবং প্রকাশনের ব্যবস্থা করার সঙ্গে সম্বন্ধিত। বকুলা রিনপোছে তখন মঙ্গোলিয়ায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

পশ্চিমী জগতে ফিরে যাওয়া

সব মিলিয়ে আমি বিশ্বের মোটামুটি ৭০টি দেশে ভ্রমণ করেছিলাম এবং সেখানে শিক্ষা প্রদান করেছিলাম। এই সব করার সময় আমি নিজের দৈনিক ধ্যান-অনুশীলনও করে গিয়েছিলাম, যা আমাকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনেক সাহায্য করেছিল। আমার অনেক নতুন-নতুন জায়গা থেকে শিক্ষা প্রদান এবং বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ আসতে থাকল। এই বক্তৃতা-ভ্রমণ অনেক বড় হতে থাকল- সবচেয়ে বড় ভ্রমণ ছিল পনেরো মাসের- যেখানে আমি প্রতি সপ্তাহে দুই-তিনটি শহরে যেতাম, আর ভ্রমণ চলতেই থাকল। এতবেশী ভ্রমণ করার সাথে-সাথে এই সব কাজ করার স্থায়িত্ব আমার বৌদ্ধ ধ্যান-অনুশীলন থেকে প্রাপ্ত হয়েছিল, বিশেষ করে এই জন্য যে, আমি সবসময় একাই ভ্রমণ করতাম।

এই বছরগুলিতে আমি কিছু বই লিখেছিলাম, আর একটা সময়ের পর আমার মনে হয়েছিল যে, এই সব করা সহজ ছিল না, ভারতে থেকে প্রকাশক ‘স্নো লায়নের’ সাথে কাজ করা সহজ ছিল না। এছাড়াও আমি ইন্টারনেটের দিকে ঘুরতে চেয়েছিলাম এবং ভারতে থেকে এটা করা খুবই কঠিন ছিল। এই জন্য ১৯৯৮ সালে আমি ভারত থেকে পশ্চিমের দিকে চলে এলাম। এক বছর পর্যন্ত যে জায়গাগুলিতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তারমধ্যে কিছু স্থানে থাকার চেষ্টা করার পর আমি বার্লিন, জার্মানীতে থাকতে স্থির করলাম। আমি জার্মান ভাষা তো আগে থেকেই জানতাম, তাই এটার জন্য কোনো সমস্যা হয়নি, আর এখানে আমাকে সবথেকে বেশী স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। আমার জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল; আমি কোনো সংগঠনের সাথে আবদ্ধ অবস্থায় থাকতে চাইনি। আমি পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে, রাশিয়া এবং পূর্ববর্তী সোভিয়েত ইউনিয়ান, যেখানে আমি বারবার শিক্ষা প্রদান করতাম আর এই দেশগুলিতে ভ্রমণ করার জন্যও বার্লিন একটা খুব সুবিধাজনক স্থান ছিল। তার জন্য এই স্থানটিকে যোগাযোগের দিক থেকে নিকটতম অনুভব করতাম।

আমি নিজের সাথে অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির ৩০০০০ পৃষ্ঠা নিয়ে পশ্চিমী জগতে এসেছিলাম- এতে আমার লেখা শেষ না হওয়া কিছু পুস্তক ছিল, তার পড়ার জন্য কিছু নোটস্‌ ছিল, আমার পড়া গ্রন্থের অনুবাদ ছিল, আর আমার কিছু বক্তৃতার প্রতিলিপি এবং আমার শিক্ষকদের দ্বারা দেওয়া বক্তৃতার অনুবাদও ছিল। এছাড়াও পরম পূজ্য দ্বারা দেওয়া উপদেশ, তার তিনটি প্রমূখ শিক্ষকের, আর গেশে ধারগ্যে দ্বারা দেওয়া শিক্ষাগুলির থেকে লেখা আমার প্রচুর পরিমাণের নোট ছিল। এটা নিয়ে আমার খুব চিন্তা ছিল যে, আমার মৃত্যুর পর এই সব নোটস্‌গুলি আবর্জনা ফেলার জায়গায় না ফেলে দেওয়া হয়।

বরজিন আর্কাইভস্‌

আমার শেষ প্রজন্মের মহান লামাদের মধ্যে মহানতম লামাদের থেকে এত লম্বা সময় পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করার অবিশ্বাস্য সৌভাগ্য প্রাপ্ত হয়েছিল। সেখানে আমি যা কিছু শিখেছিলাম এবং কলমবদ্ধ করেছিলাম সেগুলি এত বহুমূল্য ছিল যে, সেগুলি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া আবশ্যক ছিল। যদিও গ্রন্থকে হাতে ধরতে খুব ভালো লাগে, আর দেখতেও ভালো লাগে, কিন্তু যদি আপনি খুব ভাল গ্রন্থ না লেখেন তাহলে সেটা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছায় না, আর আমার কোনো গ্রন্থ এই শ্রেণীর মধ্যে পড়ে না। সাধারণতঃ, গ্রন্থ ছাপাও ব্যয়বহুল, আবার কেনার ক্ষেত্রেও মূল্যবান। এটার প্রকাশনে অনেক সময় লেগে যায়, আর পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত আপনি সেটা সংশোধন করতে পারেন না।

যদিও আমি ইতিহাস পড়ার খুব বড় ভক্ত, তবে আমি ভবিষ্যতের জিনিসেরও বড় ভক্ত, আর ভবিষ্যত হল ইন্টারনেটের। আসলে বর্তমান সময়ও ইন্টারনেটের। এই কথাটিকে মনে রেখে, আমি আমার সব সামগ্রীকে একটি ওয়েবসাইটে প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আর এর জন্য আমি নভেম্বর, ২০০১ সালে berzinarchives.com শুরু করেছিলাম।

আমি সবসময় এই মুখ্য সিদ্ধান্তটি অনুসরণ করেছি যে, ওয়েবসাইটটিতে যেন সব সামগ্রী নিঃশুল্কভাবে পাওয়া যায়, কোনো রকম বিজ্ঞাপন থাকবে না এবং কোন রকমের জিনিস বিক্রি হবে না। ওয়েবসাইটটিতে দেওয়া সামগ্রীতে তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের চারটি পরম্পরার সব দিকের ব্যাপারে দেওয়া আছে, যদিও গেলুগ পরম্পরার সম্বন্ধে বেশী ভালো ভাবে দেওয়া আছে। অনেকগুলি তুলনামূলক উপকরণও উপলব্ধ আছে। এই উপকরণগুলি তিব্বতী চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, বৌদ্ধ ইতিহাস, এশিয়ার ইতিহাস, তিব্বতী ইতিহাস, আর বৌদ্ধধর্ম এবং ইসলামের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে। আমি এই উপকরণগুলিকে আরও কিছু ভাষায় অনুদিত করার জন্যও দৃঢ়বিশ্বাসী।

আমি জানি যে, মুসলিম অধ্যায় সম্বন্ধিত কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর পরম পূজ্য দালাই লামাও এই কাজটির জন্য সুদৃঢ় ভাবে সমর্থন করেছেন। ইসলামিক জগতে আমার ভ্রমণগুলি এবং সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নিজের বক্তৃতা দেওয়ার সময় এটা স্পষ্ট বুঝেছিলাম যে, সেখানকার মানুষ বাকি বিশ্বের ব্যাপারে জানতে ভীষণ উৎসুক। বিশ্ব সমন্বয়ের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে তাদের আলাদা না করে তিব্বতী শিক্ষাগুলি তাদেরকেও দেওয়া হোক, কিন্তু এটা করার সময় এমন যেন না মনে হয় যে, তাদেরকে তাদের ধর্ম থেকে বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত করার প্রয়াস করা হচ্ছে।

উপসংহার

২০১৫ সাল পর্যন্ত, বরজিন আর্কাইভস্‌ ওয়েবসাইটের জিনিসগুলি ২১টি ভাষায় উপলব্ধ করা হয়েছিল। আর প্রতিবছর মোটামুটি ২০ লক্ষ মানুষ সেই ওয়েবসাইটটি দেখতো। এগুলি সবই ১০০ এর বেশী বেতনভোগী কর্মচারী এবং সেচ্ছাসেবকের কাজের পরিণামস্বরূপই সম্ভব হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পরম পূজ্য দালাই লামা বার-বার ২১তম শতকের বৌদ্ধধর্মের উপর জোর দিয়েছেন। এর থেকে প্রেরণা পেয়ে আমি ২১ শতকের কিছু এমন যুবককে ভর্তি করতে চেয়েছিলাম যারা আমার ওয়েবসাইটটিকে ভবিষ্যতের পাঠকের রুচি অনুযায়ী নতুন রূপ প্রদান করবে। এই প্রয়াসের পরিণামস্বরূপ studybuddhism.com এর জন্ম।

এই নতুন ওয়েবসাইটটি পুরোপুরি প্রতিক্রিয়াশীল; এটা কম্পিউটার এবং অন্য হ্যান্ডহেল্ড যন্ত্রগুলিতেও জিনিসগুলি ভালোভাবে দেখা যায়। এটা ব্যবহারকারীর পরীক্ষণ এবং বিশ্লেষণের আধারের উপর আমরা এমন একটি ওয়েবসাইট তৈরী করেছি যার নকশা ব্যবহারকারীদের চাহিদা অনুযায়ী বটে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও আমরা নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়েছি এবং সমৃদ্ধ অডিও এবং ভিডিও গুলিও যোগ করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য হল- আমরা প্রারম্ভিক স্তর থেকে উন্নত স্তর পর্যন্ত সহজে বোঝার তথ্য উপলব্ধ করার জন্য একটি সেন্ট্রাল হাব তৈরী করা। আমরা চাই যে, আমরা ব্যবহারকারীর এমন একটা সমূহ তৈরী করি যেখানে তারা একসাথে অধ্যয়ন করতে পারে, আর আমরা তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষার সামগ্রীর একটা খোলা মঞ্চ উপলব্ধ করাতে পারি।

এখন আমরা স্বল্প কয়েকটি ভাষায় আগের জিনিসগুলিই সীমিত মাত্রায় উপলব্ধ করাচ্ছি। প্রারম্ভিক পাঠকদের জন্য নির্দিষ্ট অনেক নতুন প্রবন্ধ যোগ করা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত পুরোনো ওয়েবসাইটের সব জিনিস নতুন সংস্করণে উপলব্ধ না করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত পুরোনো ওয়েবসাইটটি নতুন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে উপলব্ধ থাকবে।

সমাপ্তি

সংক্ষেপে এটাই হল আমার কথা। এই সবের মধ্যেও আমি নিজের দৃঢ় বৌদ্ধ অনুশীলন জারি রেখেছি। উদাহরণস্বরূপ, এই বর্ষগুলির মধ্যে আমি প্রতিদিন দুই ঘন্টা করে ধ্যান-অনুশীলন করেছি। আমি অনেকগুলি লম্বা ঐকান্তিক সাধনা করেছি। এখন আমি নিজের ধ্যান-অনুশীলনের সময় কিছুটা কমিয়ে দিয়েছি, কিন্তু তাও আমি প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ধ্যান-অনুশীলন করি। আর আমি শিক্ষাগুলির মধ্যে করুণা, সঠিক অনুপ্রেরণা, অহংকারকে নিয়ন্ত্রিত করা ইত্যাদি যা হল শিক্ষাগুলির প্রমুখ দিক, আমি যেগুলিকে বেশী গুরুত্ব দিই। গেশে ওয়াঙ্‌গ্যাল যিনি পরম পূজ্য দালাই লামা পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তা দেখিয়েছিলেন, সেখান থেকে দালাই লামার শিক্ষকদের পর্যন্ত আমার গুরুজনদের প্রেরণা দ্বারা আমি একটা সার্থক জীবন-যাপন করতে সামর্থ্য হয়েছি। আশা করি বৌদ্ধ অনুশীলন এবং বৌদ্ধ দর্শনের অধ্যয়ন, বৌদ্ধধর্মের অনুভবিক এবং বস্তুগত অনুভবগুলি একসাথে প্রস্তুত করার দৃষ্টিতে আমার জীবন অন্যদের জন্য সার্থক হয়েছে। হতে পারে আমার জীবন কথা আপনাদের মধ্যে কয়েকজনকে এমনই কিছু করার জন্য প্রেরিত করবে।

Top