যেকোন কর্মের ফলাফল তার সাথে যুক্ত অনুপ্রেরণার উপর নির্ভর করে। ঐ কর্মটি প্রেরিত করার জন্য বিরক্তিকর আবেগ অথবা ইতিবাচক আবেগ যাই হোক না কেন, তার ভিত্তিতে যেমন কর্ম করা হয় তার ফলাফলও তেমন ভাবেই আলাদা আলাদা হয়। এমনকি যখন করুণার মতো সাধারণ আবেগ কোন ক্রিয়াকে সম্পাদন করতে অনুপ্রাণিত করে, তখন সেই আবেগের সাথে যুক্ত মানসিক এবং আবেগপ্রবণ সমর্থন ফলাফলকে প্রভাবিত করে।
করুণার তিনটি ভাগ
উদাহরণ স্বরূপ করুণাকেই ধরুন, এর তিনটি ভাগ আছেঃ
- প্রথম প্রকারের করুণা আমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং প্রিয়জনের ক্ষেত্রে পরিচালিত হয়। তবে আসক্তির উপর আধারিত হওয়ার কারণে এর উদ্দেশ্য সীমিত থাকে। সামান্যতম পরিস্থিতিতে এই ধরণের করুণা খুব শীঘ্রই ক্রোধ এবং এমনকি বিদ্বেষও পরিণত হয়ে যেতে পারে।
- দ্বিতীয় প্রকারের করুণা দুঃখ-কষ্টে পীড়িত প্রাণীদের প্রতি দয়া ভাবের উপর আধারিত। এই ধরণের করুণার মাধ্যমে আমরা দুঃখে পীড়িত প্রাণীদের অভাগা মনে করি এবং নিজেদেরকে তাদের চেয়ে ভালো মনে করি। বিরক্তিকর আবেগের কারণে উক্ত দুই প্রকারের করুণার বিকাশ হয় আর এর কারণেই সেটা সমস্যার দিকে পরিচালিত করে অর্থাৎ সমস্যার জন্ম হয়।
- তৃতীয় প্রকারের করুণা হল নিরপেক্ষ। এটা বোধগম্যতা এবং সম্মানের উপর আধারিত। এর মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করি যে আমাদের মতো অন্যরাও সমান : আমাদের মতো তাদেরও সুখী হওয়ার এবং দুঃখ ভোগ না করার সমান অধিকার আছে। এই বোধগম্যতার কারণে তাদের প্রতি আমাদের মনে মৈত্রী, করুণা এবং স্নেহ জাগে। এই তৃতীয় প্রকারের করুণা হল স্থিতিশীল। প্রশিক্ষণ, শিক্ষা এবং যুক্তির কারণে এর বিকাশ হয়। করুণা যত স্থির হবে এটা তত লাভদায়ক হবে। এই তিন প্রকারের করুণা দুটি শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত। তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি হল আবেগ যা স্নায়বিক কোন কিছুর উপর অধারিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগে। তৃতীয় প্রকারের করুণাও হল একটি আবেগ যা যুক্তির ভিত্তিতে বিকশিত হয়।
নবজাত শিশুর প্রতি তার মায়ের সহজাত ঘনিষ্ঠতা এবং স্নেহ
যুক্তির উপর আধারিত করুণা এবং যেটা পক্ষপাতহীন সেটা প্রকৃতির বলে বিকশিত হয়। জন্মের সময় মানুষ হোক, কোন স্তন্যপায়ী প্রাণী অথবা পাখিই হোক না কেন – সামুদ্রিক কচ্ছপ এবং প্রজাপতি সম্পর্কে আমার জানা নেই- আমরা সকলেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে আমাদের মায়ের প্রতি নিরপেক্ষ ভালোবাসা অনুভব করি, যদিও তার সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা থাকে না। আমরা সকলেই তার প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ, ঘনিষ্ঠতা এবং স্নেহ অনুভব করি। পাশাপাশি মাও তার নবজাত শিশুর প্রতি স্বয়ংক্রিয় ভাবে একটা স্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা এবং স্নেহ অনুভব করে। সেই কারণে সে তার সন্তানের যত্ন নেয় এবং পালন-পোষণ করে। এই স্নেহসুলভ যত্ন হল শিশুর সুস্থ বিকাশের আধার।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, জৈবিক ভিত্তিক ঘনিষ্ঠতা এবং স্নেহ হল করুণার বীজ। এগুলি হল আমাদের সবচেয়ে বড় উপহার এবং এগুলি আমরা আমাদের মায়ের কাছ থেকে পাই। আমরা যখন যুক্তি এবং শিক্ষা দ্বারা এই বীজের লালন-পালন করি তখন সেটা আসল করুণারূপে বিকশিত হয়। এটা হল পক্ষপাতহীন এবং সকলের জন্য সমান ভাবে পরিচালিত। এই করুণাটি এই ধরণের বোধগম্যতার উপর অধারিত যে আমরা সকলেই সমান।
করুণার উপর আধারিত ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতা
কোন শিশুর ক্ষেত্রে স্নেহ ধর্ম, আইন অথবা পুলিশ শক্তির উপর অধারিত নয়। এটা স্বাভাবিক ভাবেই জাগে। সুতরাং, ধর্ম দ্বারা শেখানো করুণা ভাল, তবে আসল বীজ, করুণার আসল আধার হল জৈবিক। আমি যাকে “ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতা” বলি, এটা হল তার আধার। ধর্মের উচিত এই বীজকে আরও শক্তিশালী করা।
কেউ কেউ মনে করেন যে নৈতিক আচার অবশ্যই ধর্মীয় বিশ্বাসভিত্তিক হওয়া উচিত। আবার কেউ-কেউ মনে করেন নৈতিকতার বোধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিকাশ করা যায়। কেউ কেউ মনে করেন "ধর্মনিরপেক্ষ" হওয়ার অর্থ হল ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করা। অন্যরা মনে করেন যে "ধর্মনিরপেক্ষ" বলতে বোঝায় যে ভারতের সংবিধানে উপস্থাপিত ব্যবস্থার মতো পক্ষপাতহীনতার সাথে অবিশ্বাসীদের প্রতি সম্মান সহ সব ধর্মের প্রতি সম্মান থাকা। এই পরের ধরণের নৈতিকতা এবং বিশেষত করুণা ভিত্তিক নৈতিকতা সহজ প্রবৃত্তি থেকে জাগে। মা এবং নবজাত শিশুর ক্ষেত্রে জীবিত থাকার প্রয়োজনীয়তার কারণে এগুলি স্বয়ংক্রিয় ভাবে উত্থিত হয়। এই জৈবিক ভিত্তির কারণে এগুলি আরও স্থিতিশীল হয়।
আমরা যখন বেশি করুণাময় হয়ে যাই, তখন আমাদের মন ও হৃদয় আরও উন্মুক্ত হয় এবং আমরা আরও সহজে আদান প্রদান করি।
যখন বাচ্চারা একে অপরের সাথে খেলাধুলা করে তখন তারা একে অপরের ধর্ম, বর্ণ, রাজনীতি বা পারিবারিক পটভূমির কথা ভাবে না। তারা তাদের খেলার সঙ্গী-সাথীদের প্রশংসা করে আর তার সঙ্গী-সাথীদের পরিচয় যাই হোক না কেন প্রতিক্রিয়াতে তারা তাদের জন্য ভালো। তাদের মন এবং হৃদয় উন্মুক্ত থাকে। অন্যদিকে, প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত জাতিগত এবং রাজনৈতিক মতভেদ ইত্যাদির মতো অন্যান্য কারণ গুলির ওপর জোর দেয়। এই কারণে তাদের মন ও হৃদয় বেশি সংকীর্ণ হয়।
আপনারা এই দুজনের মধ্যে পার্থক্যটা দেখুন। আমরা যখন বেশি করুণাময় হয়ে উঠি তখন আমাদের মন এবং হৃদয়ও বেশি উন্মুক্ত হয়ে ওঠে আর আমরা আরও বেশি সহজে আদান-প্রদান করি। অন্যদিকে আমরা যখন স্বার্থকেন্দ্রিত হই তখন আমাদের মন এবং হৃদয় বন্ধ হয়ে যায় আর অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে। ক্রোধ আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে, পরিবর্তে করুণা এবং সদয় হৃদয় আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে। মনে ক্রোধ এবং ভয় থাকলে আমরা ঘুমোতে পারি না আর যদি ঘুমিয়েও পড়ি আমরা দুঃস্বপ্ন দেখি। আমাদের মন যদি শান্ত থাকে তাহলে আমরা ভালো ভাবে ঘুমাই। এর জন্য আমাদের ঘুমের ওষুধের প্রয়োজন হয় না, আমাদের শক্তি ভারসাম্যপূর্ণ থাকে। উত্তেজনার কারণে আমাদের শক্তি চারিপাশে ছুটতে থাকে আর আমরা বিচলিত হয়ে উঠি।
করুণা একটা শান্ত ও উন্মুক্ত মন বিকাশ করে।
করুণাজনিত শান্ত এবং মুক্ত মন স্পষ্টভাবে দেখতে এবং বুঝতে আমাদের একটা শান্ত মনের প্রয়োজন। আমরা যদি উত্তেজিত হই তাহলে আমরা বাস্তবিকতাকে দেখতে পারি না। সুতরাং অধিকাংশ সমস্যা, এমনকি বিশ্বব্যাপী সমস্যাগুলি হল মানব নির্মিত। সেগুলির সৃষ্টি হয়, কারণ আমরা বাস্তবিকতা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ হওয়ার ফলে আমরা পরিস্থিতিকে খারাপ ভাবে পরিচালনা করি। আমাদের কর্ম, ভয়, ক্রোধ এবং উত্তেজনার উপর ভিত্তি করে। সেখানে আমরা খুব চাপের মধ্যে থাকি। আমাদের মন বিভ্রান্ত হওয়ার কারণে আমাদের মধ্যে সঠিক উদ্দেশ্যের সঞ্চার হয় না। এই নেতিবাচক আবেগগুলি আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতার দিকে পরিচালিত করে এবং এটা সমস্যার সৃষ্টি করে যা কখনোই সন্তোষজনক ফল প্রদান করে না।
অন্যদিকে করুণা একটি উন্মুক্ত এবং শান্ত মন বিকাশ করে। এর মাধ্যমে আমরা বাস্তবিকতাকে দেখি আর বুঝতে পারি কোন্ পরিস্থিতিকে কে না চায় আর সেটাকে কী করে কাটিয়ে ওঠা যায় এবং সকলেই যেটা চায় তার ব্যবস্থা কী করে করা যায়। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং যুক্তির পর আধারিত করুণার লাভ। সুতরাং জীববিজ্ঞানের উপর আধারিত এবং যুক্তি দ্বারা সমর্থিত মানবিক মূল্যবোধের প্রচারের জন্য মা এবং সন্তানের মধ্যে সহজাত ভালোবাসা এবং স্নেহ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।