দুটি জীবনকালে আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে সম্পর্ক

একজন আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে একটা গভীর সম্পর্ক কারও জীবনকালে সর্বাধিক উৎসাহজনক এবং তাৎপর্যপূর্ণ বন্ধন হতে পারে। এটি আত্ম-প্রতারণা, ব্যথা এবং আধ্যাত্মিক হতাশারও উৎস হতে পারে। সবকিছুই সম্পর্কটাকে সক্রিয় ভাবে স্বাস্থ্যকর করার উপর নির্ভর করে। পরিবর্তে এটি আমাদের নিজস্ব এবং আমাদের গুরুর যোগ্যতা সম্পর্কে, বন্ধনের লক্ষ্য সম্পর্কে, গতিশীলতা এবং সীমা সম্পর্কে বাস্তববাদী মনোভাব রাখার উপর নির্ভর করে।

আমি দুটি বই লিখেছিলাম, যথা- আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে সম্পর্কঃ একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের নির্মাণ (Eng. Relating to a Spiritual Teacher: Building a Healthy Relationship) এবং জ্ঞানী গুরু, জ্ঞানী শিষ্যঃ একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্কে তিব্বতী দৃষ্টিকোণ (Eng. Wise Teacher, Wise Student: Tibetan Approaches to a Healthy Relationship)। এর কারণ হচ্ছে, মূলতঃ আমি আমার প্রধান গুরুদের সাথে আমার সম্পর্ক থেকে উল্লেখযোগ্য ভাবে উপকৃত হয়েছি। আমার প্রধান গুরুরা হলেন- চেনশব সেরকোঙ্‌ রিনপোছে, পরম পূজ্য দালাই লামা এবং গেশে ঙাওয়াং দারগ্যে। আর আমার দুঃখের কারণ হল যে, আমার বিশ্ব শিক্ষার ভ্রমণগুলিতে আমি তত আন্তরিক আধ্যাত্মিক অন্বেষীগণের সাথে কম সন্তোষজনক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। অনেকে যৌন, আর্থিক বা ক্ষমতার অপব্যবহারের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে নির্দোষ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। শুধুমাত্র অবমাননাকর শিক্ষকদের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে তারা সকল আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা এবং মাঝে মধ্যে এমনকি আধ্যাত্মিক পথ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। অন্যরা তাদের অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কের কথা অস্বীকার ক’রে জীবন-যাপন করেছে। তারা মনে করেছে যে, যথাযথ “গুরু-ভক্তি” শুধু ন্যায়সঙ্গতই নয়, এমনকি একজন শিক্ষকের কাছ থেকে সমস্ত আচরণকে পবিত্রও করেছে, এটি প্রচলিত মানদন্ডের আধারে যতই ক্ষতিকারক বলে মনে হোক না কেন। উভয় চূড়ান্তই শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক থেকে পূর্ণ সুবিধা পেতে বাধা দেয়।

যেখানে শিক্ষার্থীরা পাশ্চাত্য এবং সেখানে গুরু বা শিক্ষকরা তিব্বতী হওয়ার সমস্যার একটা মূল কারণ হ’ল সাংস্কৃতিক ভুল বোঝাবুঝি এবং এটা অবাস্তব প্রত্যাশায় মিশ্রিত যে, অন্য পক্ষ নিজস্ব সংস্কৃতিগত নিয়ম অনুযায়ী কাজ করবে। বিভ্রান্তির আরও উৎস হ’ল- শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক সম্পর্কের আদর্শ পাঠ্য উপস্থাপনাগুলি তাদের মূল প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলির বাইরে নিয়ে চলেছে। এসব করা হচ্ছে তাদের আক্ষরিক অনুবাদ ক’রে এবং শব্দাবলীর অর্থ ভুল করে, প্রায়শই বিভ্রান্তিকর অনুবাদগুলির কারণে।

উদাহরণ স্বরূপ “মার্গক্রম” গ্রন্থটি সম্পর্কটিকে “পথের মূল” হিসাবে উপস্থাপন করে এবং তাদের প্রথম প্রধান বিষয় হিসাবে এটা আলোচনা করে। রূপকের মূল বক্তব্য হ’ল যে, একটা বৃক্ষ তার পুষ্টিসাধন বা খাদ্যপ্রাপ্ত করে তার মূল থেকে, এর মানে এই নয় যে এর প্রারম্ভ মূল থেকেই হয়। একটা বৃক্ষের শুরু হয় একটা বীজ থেকে। চোংখাপা এই সম্পর্কটিকে “পথের বীজ” হিসাবে অভিহিত করেননি। সর্বোপরি আসল “মার্গক্রম” শ্রোতা কোনও শিক্ষানবিশ ছিল না। এতে থাকত ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীরা যারা সমবেত হতো তান্ত্রিক অভিষেক প্রাপ্ত করার জন্য। তাদের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি হিসাবে সূত্র-শিক্ষার পর্যালোচনা প্রয়োজন ছিল। এই ধরণের ব্যক্তিদের জন্য একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষকের সাথে সুস্থ সম্পর্কের মূল হ’ল- পূর্ববর্তী অধ্যয়ন ও অনুশীলন অনুযায়ী বৌদ্ধ পথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া। তার কাছ থেকে পূর্ণ বোধিপথ ধরে রাখতে অনুপ্রেরণা অর্জন করা যায়। পাশ্চাত্য ধর্মকেন্দ্রগুলিতে নবাগতদের পক্ষ থেকে আধ্যাত্মিক গুরুদের বুদ্ধ হিসাবে দেখে শুরু করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সেখানে কখনই ছিল না।

আমার নিজের ক্ষেত্রে, একজন আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে আমার যে গভীরতম সম্পর্ক রয়েছে সেই সম্পর্কটি উক্ত গুরুর দুটি জীবনকাল জুড়ে আছে। আমি চেনশব সেরকোঙ্‌ রিনপোছের শিষ্য, অনুবাদক, ইংরেজি সচিব এবং বিদেশ ভ্রমণ ব্যাবস্থাপক হিসাবে নয় বছর কাটিয়েছিলাম। প্রয়াত রিনপোছে ছিলেন পরম পূজ্য দালাই লামার শাস্ত্রার্থ সঙ্গী এবং সহায়ক শিক্ষক। ১৯৮৩ সালে রিনপোছে দেহ ত্যাগ করেন এবং ঠিক নয় মাস পরে তাঁর পুনর্জন্ম হয়। যথারীতি তাকে চিহ্নিত করা হয় এবং চার বৎসর বয়সে তিনি ধর্মশালায় ফিরে আসেন। কয়েক মাস পরে যে মূহুর্তে আমাদের সাক্ষাৎ হয় তিনি এবং আমি উভয়ই আমাদের গভীর বন্ধনটি পুনরায় নিশ্চিত করি। যখন একজন পরিচারকের মাধ্যমে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, তিনি আমাকে চেনেন কিনা, তরুণ টুল্‌কু উত্তর দেন, “বোকার মত কর না। অবশ্যই আমি জানি তিনি কে।” যেহেতু রিনপোছে আমাকে তাঁর আধ্যাত্মিক পরিবারের একজন ঘনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে দেখতেন, অতএব এমন একটি বিষয় সামনে এসেছিল যার ভিত্তিতে একটা চার বছরের ছেলে নকল হতে পারত না। এর ফলে আমার গভীর সংযোগ সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ থাকল না।

২০০১ সালের গ্রীষ্মে, আমি রিনপোছের সাথে এক মাস দক্ষিণ ভারতে তাঁর মঠে কাটিয়েছিলাম। তাঁর মঠের নাম গাদেন জংচে। সেখানে তিনি সতেরো বৎসর বয়সে বিদ্বানদের শ্রেণীতে সরকারী প্রবেশ চিহ্নিত করার জন্য এক অনুষ্ঠানে সমবেত ভিক্ষুদের উপস্থিতিতে শাস্ত্রার্থ করেছিলেন। ঠিক ঐ মাসে, আমি তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত করেছিলাম যে শিক্ষা তিনি গেশে প্রশিক্ষণের জন্য অধ্যয়ন করেছিলেন। পাশাপাশি একটা গ্রন্থের আগম এবং ব্যাখ্যার অনুবাদ করেছিলাম যা তিনি তাঁর পূর্বসুরীর একজন ঘনিষ্ঠ পাশ্চাত্য শিষ্যকে প্রদান করেছিলেন। আমি যখন রিনপোছেকে তাঁর জন্য আরও একবার অনুবাদ করাটা কত বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করলাম, তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “অবশ্যই, এটাই তোমার কর্ম।” আমিও তাঁকে বহু ছোট-ছোট উপদেশ এবং লৌকিক পরামর্শ ফিরিয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াটি চালিয়ে গেলাম যা তিনি আমাকে তাঁর পূর্ব জন্মে প্রদান করেছিলেন।

দুটি জীবনকালেরও বেশী সময় ধরে সেরকোঙ্‌ রিনপোছের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমাকে একা অধ্যয়ন ও ধ্যান করার চেয়ে ধর্ম এবং পুনর্জন্মের প্রতি আরও বেশী আত্মবিশ্বাস প্রদান করেছে। এটা সত্যিই পথে চলমান অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি বা আমি কেউই আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একে-অপরের প্রতি আমাদের ভূমিকা সম্পর্কে নিজেকে ঠকাইনি। আমরা ঐ সময় যারা ছিলাম তার থেকে সম্পূর্ণ এক নই অথবা সম্পূর্ণ আলাদা নই। আমাদের প্রত্যেকেই ধারাবাহিক। একে-অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার সাথে, এখনকার জীবনে আমাদের বিভিন্ন ধাপগুলি সম্পর্কে বাস্তববাদী মনোভাবের উপর ভিত্তি করে, আমরা প্রত্যেকে এখন একে-অপরের কাছ থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে শিক্ষা প্রদান করি ও শিখি।

স্টার ট্রেকের অনুরাগী হিসাবে, আমি অভিজ্ঞতাটি দর্শন করেছি যে, আমি যেন মূল সিরিজ এবং পরবর্তী প্রজন্মের (জেনারেশন) উভয় দলের অংশ হয়ে উঠেছি, যেখানে ক্যাপ্টেন কির্কের অধীনে এবং এখন ক্যাপ্টেন পিকার্ড রূপে তার পুনর্জন্মের অধীনে এখনও একজন তরুণ ক্যাডেট (সামরিক শিক্ষানবিশ) হিসাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আমি যে প্রধান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি সেটা হ’ল- ভবিষ্যতের সমস্ত অভিযানগুলির দলের সেবা করার জন্য নিয়মিতভাবে কর্ম নির্মাণ করা।

Top