ধর্মের অনুসরণ ও দুঃখ ত্যাগ

ধর্ম হল সংস্কৃত শব্দ। এর তিব্বতী প্রতিশব্দ হ’ল ছো/ছোস। এর অর্থ হচ্ছে ধারণ করা। তাহলে কী ধারণ করতে হবে বা পালন করতে হবে? সেটা হল দুঃখ ত্যাগ ও সুখের প্রাপ্তি। শুধুমাত্র আমাদের জন্য ধর্ম সেটা করে না বরং সেটা করে সমস্ত সত্ত্বদের জন্য।

দুঃখের সনাক্তকরণ

আমরা যে দুঃখ অনুভব করি সেটা মূলতঃ দুই ধরণের হয়ঃ প্রথমতঃ মানুষ হিসাবে আমরা যা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারি। অন্যটি অনুভব করতে হলে অতীন্দ্রিয় শক্তি ছাড়া সম্ভব হয় না। জন্মগ্রহণের সময় কষ্ট, সাময়িক অসুস্থতা জনিত কষ্টের অনুভব, বার্ধক্যজনিত দুঃখ-কষ্ট আর মৃত্যুর ভয়াবহতা, এগুলি প্রথমোক্ত দুঃখের অন্তর্গতে আসে।

মৃত্যুর পর যে দুঃখ হয় সেটা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। আমরা ভাবতে পারি যে, মৃত্যুর পর হয়তো আবার মানুষ হয়ে জন্ম নেব। তবে তা হবেই বলা কঠিন। এরকম বিবর্তন ঘটবেই সেটা অনুমান করার মতো আমাদের হাতে কোন যৌক্তিক কারণ নেই। আবার মৃত্যুর পর কোনরকম জন্ম নেব না এমনও নয়।

আমরা যে বিশেষ কোন পুনর্জন্ম নেব সেটা জানা খুবই কঠিন এবং সেটা আমাদের সীমিত জ্ঞানের বাইরে। এই জীবনে যদি আমরা ইতিবাচক কর্ম করি তাহলে আমরা স্বাভাবিকভাবে ভবিষ্যতে পুনর্জন্মের একটি সুখী ধরণ লাভ করব। অপরদিকে যদি নেতিবাচক কর্ম করি, তাহলে আমাদের পরবর্তী পুনর্জন্ম সুখী হবে না বরং দুর্গতির প্রাণী হয়ে অনেক দুঃখ ভোগ করব। এটা নিশ্চিত। এইভাবেই পুনর্জন্ম ঘটে। আমরা যদি গমের বীজ রোপন করি, তাহলে সেটা থেকে গমের চারাই তো জন্মাবে। ধানের বীজ রোপন করলে ধান গাছই জন্মাবে। তেমনইভাবে নেতিবাচক কর্ম করলে তিনটি দুর্গতির মধ্যে একটিতে জন্ম নেওয়ার বীজ রোপন করি, অর্থাৎ নরকের প্রাণী, প্রেত অথবা পশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করাবে।

নরক, যেখানে আনন্দ থাকে না, তারও চারটি দশা বা লোক আছে, উষ্ণ, শীত, প্রাদেশিক নরক এবং প্রত্যেক নরক। এগুলির আরও বিস্তারিত বিভাগ আছে। উষ্ণ নরকের রয়েছে আটটি বিভিন্ন ভাগ। এর প্রথমটিকে বলা হয় সঞ্জীব নরক। তুলনামূলকভাবে বললে এর কষ্ট একটু কম। উষ্ণ নরকের এই প্রথম ভাগে একজন সত্ত্ব অনুভব করে যে, অপরাপর ভাগে কী ভয়ানক কষ্টই না পেতে হয়। এই সঞ্জীব নরকের নীচস্থ প্রতিটি নরকের দুঃখ-কষ্টের মাত্রা উত্তরোত্তর তীব্র হয়।

যদিও নরকের প্রাণী বা প্রেতের দুঃখ-কষ্ট আমরা দেখতে পাই না কিন্তু প্রানীদের তো স্বচক্ষে দেখতে পাই। একবার যদি ভেবে দেখি যে, আমরা যদি পশু রূপে জন্ম নিতাম তাহলে আমাদের অবস্থা কেমন হতো! আমাদের চারিপাশের অবাঞ্ছিত পশু বা বাস্তবে পশুদের দিকে তাকালে তাদের দশাটি সহজেই অনুমেয়। এই দুর্গতিগুলির দুঃখ ভোগ করার হাত থেকে ধর্ম আমাদের দূরে রাখে, রক্ষা করে।

পুনর্জন্মের সম্পূর্ণ চক্র, অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মের এই সংসারের প্রকৃতি দুঃখময়। সাংসারিক এই সকল দুঃখ-কষ্ট থেকে ধর্ম আমাদের রক্ষা করে। তা ছাড়াও মহাযান ধর্মের উপদেশাবলী শুধু আমাদের রক্ষা করে না, বরং সকল সত্ত্বকেও রক্ষা করে।

শরণ নেওয়ার নিরাপদ দিক

ত্রিরত্নের শরণ, যথা- বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘে শরণের অনেক কথা বৌদ্ধধর্মে শোনা যায়। এগুলির প্রথমটিতে রয়েছেন সকল পূর্ণবোধ প্রাপ্ত সত্ত্বাগণ, যারা আমাদের ধর্মদান করেন। শাক্যমুনি বুদ্ধ, যিনি বারাণসীতে চার আর্যসত্যের উপদেশ দান ক’রে প্রথম ধর্মচক্রপ্রবর্তন করলেন, তিনি আমাদের কাছে অতীব মহত্বম। এই চারটি সত্যের অন্তিমটি হল সম্যক্‌ মার্গ- তা হল মুক্তি লাভের জন্য ধর্ম অনুশীলন। এই হ’ল নিরাপদ দিক নির্দেশের শরণের বিষয়, একেই বলে ধর্মরত্ন।

ধর্ম অনুশীলন দুটি বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত; তা হল সাংসারিক দুঃখ-কষ্টের মূলকে চেনা এবং অপরটি হল এর মূলোচ্ছেদ। জন্ম-মৃত্যুর এই চক্রের মূল কী? এর কারণ হল অহং এবং সকল জাগতিক বিষয়াবলীকে আমার বলে আঁকড়ে ধরে থাকা। এই আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতা যা আমাদের সকল দুঃখ ডেকে আনে তাকে প্রতিরোধ করার মানসিকতা আমাদের মধ্যে বিকাশ করতে হবে। এই যে বেঁচে থাকা এবং তাকেই সত্যি বলে আঁকড়ে ধরা; একে ভাল করে বুঝে তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এর প্রতিষেধকের বোধগম্যতার বিকাশ করতে হবে। এই প্রতিষেধক হল নৈরাত্মতা বা নিঃস্বভাবতার জ্ঞান (প্রভেদমূলক সচেতনতা)। আর এই নৈরাত্মতার বোধগম্যতাই সঠিকার্থে অনুধাবনই দুঃখ থেকে আমাদের মুক্তির পথ দেখায়।

আমরা সংসারে যে দুঃখ ভোগ করি তা অকারণে ঘটে না। অশান্ত আবেগ এবং তদনুরূপ আচরণ ও মোহান্ধ কৃতকর্মের কারণে এগুলি ঘটে। অহংকে আঁকড়ে থাকাই (আত্মগ্রহ) হল সকল অশান্ত আবেগ, আচরণ তদনুরূপ কর্মের মূল। আমরা যখন সেটা বুঝতে পারি তখন এই অহংকে আঁকড়ে ধরার বদলে তাকে ত্যাগ করার জন্য প্রতিষেধক খুঁজি। আমাদের চিত্ত-সন্ততিতে এখনও কেন প্রতিষেধক এর বিকাশ করতে পারলাম না? কেন আমরা নৈরাত্মতাকে বুঝতে পারি না? এর একটি কারণ হল আমরা মৃত্যু ও অনিত্যতাকে ভাল করে বুঝতে পারি না।

মৃত্যু ও অনিত্যতা

জন্মের একমাত্র নিশ্চিত উপায় হল মৃত্যু। আমরা নিশ্চিতভাবেই মৃত্যুমুখে চলেছি। এমন কোন জীবন্ত প্রাণী নেই অন্তিমে যার মৃত্যু হয়নি। মৃত্যুকে ঠেকানোর জন্য মানুষ নানারকম উপায় খোঁজে, কিন্তু সেটা অসম্ভব। কোন ঔষধ মৃত্যু থেকে আরোগ্যলাভ করায় না।

“আমি মরতে যাচ্ছি” শুধু এরকম ভাবনা মৃত্যুকে উপলব্ধি করার জন্য সঠিক পথ নয়। সবাই মৃত্যুমুখী একথা অবশ্যই সত্য, কিন্তু এই সত্যটিকে নিয়ে শুধু চিন্তা করলেই তা যথেষ্ট হবে না। এটা সঠিক পদ্ধতি নয়। একইভাবে, আমরা বিখন্ডিত হতে চলেছি, এবং অবক্ষয়িত হতে চলেছি; আমাদের দেহে পচন ধরতে চলেছে, এই সত্যের উপর শুধু চিন্তনও যথেষ্ট নয়। আমাদের যা ভাবতে হবে সেটা হল কী করে আমাদের পতন প্রতিরোধ করা যায়।

মৃত্যুর সময় যে ভয় আসে সেই ভয়কে কীভাবে দূর করা যায়, এই নিয়ে যদি চিন্তন-মনন করি, তাহলে মৃত্যুর উপর আমাদের সাধনা ফলপ্রসূ হবে। যে সকল মানুষ জীবনভর নেতিবাচক কর্মই বেশী করেছে, মৃত্যুর সময় তারা অতিমাত্রায় ভীত হয়। ওরা কাঁদে, চোখের জলে তাদের দুই গাল ভেসে যায়, মুখ বেঁকে যায়, পোশাকে মল-মূত্র ত্যাগ করে এবং তারা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মরণকালে এসব দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় তার দুঃখ-কষ্ট আর এসবের কারণ হল জীবনভর যে নেতিবাচক কর্ম বা দুষ্কর্ম করেছে তদ্‌জনিত ভয়।

এর বিপরীতে আমরা যদি জীবদ্দশায় অসৎ কর্ম থেকে দূরে থাকি, তাহলে আমরা সহজেই মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারি। অনেকটা যেন একটি শিশু তার মাতা পিতার সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাচ্ছে, এমনই আনন্দময় অভিজ্ঞতা। আমরা যদি নিজেকে বিশুদ্ধ করতে পারি আমরা সানন্দে মৃত্যুকে বরণ করতে পারব। দশটি নেতিবাচক কর্ম থেকে বিরত থেকে এবং তাদের বিপরীতে দশটি কুশল কর্ম বা গঠনমূলক কর্ম সম্পাদন করলে আমাদের মৃত্যু হবে সহজ। তারফলে দুঃখময় পরিস্থিতিতে আমাদের পুনর্জন্ম হবে না। আমাদের পরবর্তী জীবন হবে অনেক বেশী সৌভাগ্যপূর্ণ, এই বিষয়ে আশ্বস্ত হতে পারি। যেমন- ঔষধী বৃক্ষের বীজ বপন করলে আমরা ঔষধী শক্তি প্রাপ্ত করব, তেমনই বিষাক্ত গাছের বীজ বপন করলে আমরা শুধু বিষাক্ত ফল উৎপাদন করব। আমরা যদি আমাদের চেতনায় গঠনমূলক বা কুশল কর্মের বীজ বপন করি, তাহলে আমরা অনাগত পুনর্জন্মে সুখ ভোগ করব। আমরা মানসিক এবং শারীরিক উভয়ভাবে শুভ পরিস্থিতি লাভ করব। ধর্মের এই মৌলিক উপদেশ- ধ্বংসাত্মক (অকুশল) কর্ম ত্যাগ করা এবং গঠনমূলক (কুশল) কর্ম সম্পাদন করা- শুধুমাত্র বৌদ্ধধর্ম দেয়নি, খ্রিস্টান সহ অন্যান্য অনেক ধর্ম সমূহও দিয়েছে।

মৃত্যু ও অনিত্যতার প্রতি আমরা কীভাবে মনোনিবেশ করতে পারব? আগে যেমন বলা হয়েছে, “আমি মরতে চলেছি” এমন চিন্তা খুব একটা উপকারী হয় না। আমাদের এইভাবে চিন্তা করা দরকার, “আমি যদি দশটি ধ্বংসাত্মক কর্মের মধ্যে কোন একটি করে থাকি তাহলে মৃত্যুর সময় ভয়ানক কষ্ট ও ভয় পাবো এবং এরফলে আমার পরবর্তী জন্ম হবে ভয়ঙ্কর দুর্গতিতে পরিপূর্ণ। অন্যদিকে আমার জীবদ্দশায় যদি গঠনমূলক কর্ম (পুণ্য অর্জন) করে থাকি, মৃত্যুর সময় আমি নির্ভয়ে থাকব,আমার দুঃখ কষ্ট হবে না আর পরবর্তী সুগতিতে আমার পুনর্জন্ম হবে।” মৃত্যুর উপর মনোনিবেশ করার এটা হল সঠিক পথ।

“আমি মরতে যাচ্ছি এবং এতে আমার কিছু করণীয় নেই”, এরকম বিষন্ন বা হতাশ হওয়ার মতো এই সাধনা নয়। বরং মৃত্যুর সময় আমাদের কী হবে, এই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন আছে।

“মৃত্যুর পর আমি কোথায় যাব? আমি কী ধরণের কারণ বা হেতু সঞ্চয় করেছি? আমি কি আমার মৃত্যুকে আনন্দময় করতে পারি? কীভাবে? পরবর্তী জীবনই বা কেমন করে করব আনন্দময়? কীভাবে? পরজন্ম নিয়ে যখন ভাবব তখন মনে রাখতে হবে যে, সংসারের কোন স্থান নির্ভরযোগ্য নয়। আমরা কী দেহ পেলাম সেটা কোন বিষয় নয়, সময় এলে তাকেও যেতে হবে। ইতিহাসে আমরা পড়ি যে, কেউ কেউ শতায়ু এমনকী হাজার বছর পর্যন্ত জীবিত ছিল। তবুও, এই কাহিনীগুলি যতই মনোরঞ্জক হোক না কেন, এমন কোন নজির নেই যে তাকে শেষ পর্যন্ত দেহত্যাগ করতে হয়নি। আমরা সংসারে যে ধরণেরই দেহ লাভ করি না কেন তাকে মরতেই হবে।

মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারব এমন কোন স্থানও নেই। আমরা যেখানেই থাকি না কেন, যখন সময় আসবে, আমাদের মরতে হবে। তখন কোন ওষুধ, মন্ত্র বা সাধনা কাজ দেবে না। শল্য-চিকিৎসার মাধ্যমে আমাদের দেহের দুরারোগ্য রোগ দূর করতে পারে, কিন্তু মৃত্যুকে নয়।

পরবর্তী জন্মে যে দেহই আমরা পাবো না কেন তারও মৃত্যু নিশ্চিত। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। আমাদের সকল কর্মের দীর্ঘমেয়াদী ফল এবং জন্ম, জীবন, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের পরিণতিকে ভাল করে দেখলে তা আমাদের কুশল কর্ম করতে সহায়ক হবে।

যদিও কোন-কোন সময় আমরা পরিকল্পনা করি যে, আমরা ধর্ম অনুশীলন করব, কিন্তু আমরা ভাবি সেটা আগামীকাল বা পরশু থেকে শুরু করব। যাইহোক আমরা কেউ বলতে পারব না কখন আমাদের মৃত্যু হবে। আমরা যদি এমন নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি পেতাম যে আরও একশত বছর আয়ু পড়ে আছে, তখন না হয় ধর্ম সাধনার অনুশীলন সুযোগ-সুবিধা অনুসারে করা যাবে। কিন্তু কখন আমাদের মৃত্যু হবে তার কণামাত্র নিশ্চয়তা নেই। তাই সাধনা ফেলে রাখা অত্যন্ত বোকামী হবে। কোন-কোন মানুষ তো জন্মের আগেই গর্ভতে মারা যায়। কেউ আবার যখন দু-এক পা হাঁটা-চলা শেখার আগেই চলে যায়। আমরা দীর্ঘজীবি হবো এমন কোন নিয়ম নির্ধারিত নেই।

আমাদের দেহ অত্যন্ত কোমল। এগুলি পাথর বা লোহার হলে হয়তো কিছুটা কাঠিন্যের অনুভব হতো, কিন্তু আমরা যদি তদন্ত ক’রে দেখি, দেখব যে মানুষের দেহ খুবই দুর্বল। খুব সহজেই বিগড়ে যায়। এ যেন অসংখ্য ভঙ্গুর যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরী সুদৃশ্য হাত ঘড়ির মতো। এর উপর কোন ভরসা নেই। এমন বহু কারণ আছে যাতে আমাদের মৃত্যু হতে পারেঃ যেমন খাদ্যে বিষক্রিয়া, ক্ষুদ্র একরত্তি পোকার কামড়, এমনকি বিষাক্ত কাঁটা ফুটলেও সেটা ঘটতে পারে। এরকম সাধারণ ঘটনাও আমাদের মেরে ফেলতে পারে। যে খাদ্য ও পানীয় আমাদের জীবন দীর্ঘায়িত করার জন্য গ্রহণ করি তাও আমাদের নাশের কারণ হতে পারে। তাই কোন্‌ অবস্থায় এবং কখন আমাদের মৃত্যু হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

এমনকি আমরা যদি অনুভবও করতে পারি যে, একশত বছর বাঁচব ইতিমধ্যে ওই আয়ুষ্কালের অনেকটাই চলে গেছে, কিন্তু আমরা বিশেষ কিছু করতে পারিনি। এ যেন রেলের কামরায় ঘুমন্ত এক যাত্রী, একটু-একটু করে গন্তব্যের দিকে চলেছে, তেমনই আমরা অনবরত চলেছি মৃত্যুর দিকে। তবু পদ্ধতিটি সম্বন্ধে আমরা অজ্ঞ। এই পদ্ধতিটি প্রতিরোধের জন্য আমরা বিশেষ কিছু করতে পারি না। আমরা ক্রমান্বয়ে শুধু মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলি।

আমাদের জীবদ্দশায় কী পরিমাণ টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি, ঘর-বাড়ি অথবা কাপড়-চোপড় সঞ্চয় করলাম সেটা মৃত্যুকালে কোন পার্থক্য গড়ে তোলে না। মৃত্যুকালে আমাদের খালি হাতেই যেতে হবে। কণামাত্র বস্তু আমরা সঙ্গে নিয়ে যেতে অসমর্থ হই। এই দেহটিকেও ফেলে যেতেই হয়। এই দেহ এবং চিত্ত বিচ্ছেদ হয়ে যায়, আর চিত্ত-সন্ততি অনবরত চলতে থাকে। আমাদের সম্পত্তির এক কণা তো দূরের কথা, আমাদের দেহটিকেও তো নিয়ে যেতে পারি না।

কর্ম

মৃত্যুর পর চেতনার সঙ্গী কে হন? যদি আমাদের দেহ, বন্ধু-বান্ধব এবং আমাদের সকল ধনসম্পদকে ত্যাগ করে যেতেই হয়, তাহলে অনাগত জীবনে আমাদের চেতনাকে সাহায্য করার মতো কিছু আছে বা তার সঙ্গী কি কেউ হতে পারে?

কিছু একটা আছে যা মৃত্যুর পরও চেতনাকে অনুসরণ করেঃ সেটা হল এই জন্মে যে সমস্ত কার্মিক বীজ বা কার্মিক ঋণ সঞ্চয় ক’রে রেখেছি সেগুলি। এই জন্মে যদি দশটি অকুশল কর্মের কোন একটি সম্পাদন করে থাকি তাহলে এর ফলে আমাদের পরজন্মে চিত্ত সন্ততির সময় নেতিবাচক কর্মফল চিত্ত বহন করবে। প্রাণীহত্যা, অপরের ধনসম্পদ চুরি বা ব্যাভিচারের মতো এই দেহকৃত ধ্বংসাত্মক কর্মের নেতিবাচক কার্মিক বীজ চিত্ত-সন্ততিতে স্থাপিত হয়ে যায়। মিথ্যা ব’লে, অন্যদের মধ্যে কুৎসা ক’রে বা বিচ্ছেদ তৈরী ক’রে, অনর্থক কথা বলে অথবা কটু বাক্য বলে ক্ষতি করে কথার মাধ্যমে যে অকুশল কর্ম করা হয় তার নেতিবাচক কার্মিক বীজ মৃত্যুর সময় আমাদের অনুসরণ করবে। অপরের প্রতি অসূয়া, অপরের ধনসম্পত্তিতে লোভ, লোলুপতা, অপরের ক্ষতি কামনা করা অথবা “কোন পূর্বজন্ম বা পরজন্ম নেই”, “কার্য-কারণ সম্পর্ক বলে কিছু হয় না”, “শরণ গমনের সঠিক দিশা বলে কিছু নেই”, যদি এমন মিথ্যাদৃষ্টি পোষণ করি; তাহলে মনের এরকম ধ্বংসাত্মক ভাবনামূলক কর্মের ফলে সঞ্চিত নেতিবাচক কার্মিক বীজ আমাদের ভবিষ্যৎ জন্মেও যাবে এবং নিয়ন্ত্রণ করবে।

এর বিপরীত দিকও সত্য। আমরা যদি ইতিবাচক (কুশল) কর্ম করি এবং অকুশল কর্ম সম্পাদনে বিরত থাকি তারফলে উদ্ভূত ইতিবাচক শক্তি (কুশল কার্মিক বীজ) আমাদের চিত্ত সন্ততিতে সঙ্গী হবে এবং অনাগত জন্মে আরও ভাল পরিস্থিতি উৎপাদন করবে।

আমরা যখন সত্যিই আমাদের বর্তমান অবস্থাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি তখন যেভাবেই হোক কুশল কর্ম করতে সচেষ্ট হই আর বিপরীত কর্ম ত্যাগ করি। নেতিবাচক বিষয়গুলি যতবেশী সম্ভব পরিত্যাগ ক’রে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আমাদের চেষ্টা করা প্রয়োজন। ভবিষ্যত জন্মে পরিশোধ করতে হতে পারে এমন কার্মিক ঋণ যেন এক কণাও অবশিষ্ট না থাকে।

কারণ ও ফলের তত্ত্ব অনুযায়ী কী ধরণের প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা আমাদের দেখতে হবে। একজন ব্যক্তির একটি কাহিনী আছে। লোকটির অনেকগুণ থাকলেও তার কথা-বার্তা ছিল কর্কশ বা কঠোর। সে অন্যদের নীচু দেখানোর জন্য বলত, “তুমি কুকুরের মতো কথা বলছ”। তার ফলে তাকে পাঁচশত বার কুকুরের জন্ম গ্রহণ করতে হয়েছিল। দেখতে সামান্য হলেও ক্ষুদ্র কর্মও বিশালাকার ফল দিতে সক্ষম হয়ে ওঠে।

একইভাবে একরত্তি ভাল কাজও বিশালাকার ফল দিতে পারে। এক শিশুর একটি কাহিনী আছে। শিশুটি একবার বুদ্ধকে সামান্য একটি অর্ঘ্য দান করেছিল। তার ফলে শিশুটি জন্মান্তরে হলেন সম্রাট অশোক। অশোক হাজার-হাজার বৌদ্ধ সৌধ স্থাপন সহ অসংখ্য কুশলকর্ম সম্পাদন করেছিলেন।

পরিত্যাগ এবং করুণা

গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, আমরা যে সমস্ত ধ্বংসাত্মক কর্ম করেছি তার ফল আমাদের সুখ ও কল্যাণের নিশ্চয়তার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। যদি আমাদের দুঃখ কষ্টের বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে আমরা দেখব যে এটা তো আমাদেরই নেতিবাচক কর্মের ফল। যারফলে এসব ভোগ করছি। আর যেন এরকম দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে না হয় এই মনোভাব আমাদের মধ্যে জাগে। নেতিবাচক কর্মের পরিত্যাগের মনোভাব জাগরণকেই বলা হয় “পরিত্যাগ”।

এই ধরণের ভাবনায় আমাদের নিয়োজিত করাও এক প্রকারের ধ্যান। প্রথমতঃ আমাদের নিজের দুঃখ-কষ্টের উপর একাগ্র হতে হবে। তারপর মনের একাগ্র অবস্থাকে আরও বিস্তৃত করে জগতের সকল জীবকে দেখতে হবে। দেখতে হবে কোন ভাবে, কোনও প্রাণীই দুঃখের কামনা করে না অথচ তারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুঃখ-কষ্টের জালে আবদ্ধ হয়ে আছে। এই ধরণের চিন্তা আমাদের করুণার দিকে নিয়ে যায়। আমরা নিজেদের দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা যদি না জাগাতে পারি, তাহলে অন্য প্রাণীদের দুঃখ থেকে মুক্ত করার ইচ্ছা কীভাবে জাগরিত করব? আমরা আমাদের সকল দুঃখ-কষ্টের সমাপন করতে পারি তবুও সেটা শেষ পর্যন্ত মঙ্গলদায়ক হয় না। আমাদের এই কামনাকে সকল জীবের জন্য প্রসারিত করতে হবে, কারণ তারাও সুখাভিলাসী। আমরা আমাদের মনকে প্রশিক্ষিত করতে পারি, সকলে দুঃখ থেকে চিরতরে মুক্ত হোক এই কামনার বিকাশ ঘটাতে পারি। এই চিন্তা অনেক বিস্তৃত এবং মহা উপকারী।

আমরা কেন অন্য প্রাণীদের জন্য ভাবিত হব? আমরা তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু পাই, এই হল তার কারণ। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যে দুধ পান করি সেটা গরু বা মহিষের থেকে, শীত বা হাওয়ার দাপট থেকে শরীর গরম রাখার জন্য বস্ত্র পরিধান করি, তারজন্য ভেড়া এবং ছাগল থেকে পশম সংগ্রহ করি ইত্যাদি। তাদের দুঃখ দূর করার জন্য উপায় অন্বেষনের এই হল দুই একটি দৃষ্টান্ত মাত্র।

মন্ত্রজপ বা ধ্যান, আমরা কী ধরণের সাধনা করি সেটা বড় কথা নয়। আমাদের সর্বক্ষণ মনে রাখতে হবে “এই সাধনায় সর্বসত্ত্বের মঙ্গল হোক!”। এতে আমাদেরও মঙ্গল নিয়ে আসবে। এরজন্য আমাদের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনেও সেটা উপলব্ধি করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ, যদি কেউ স্বার্থপর হন এবং সবসময় নিজের লাভের জন্য কাজ করেন, তাকে অন্য লোকেরা খুব পছন্দ করেন না। অন্যদিকে, কেউ যদি দয়ালু হন এবং অন্যদের সাহায্যের কথা ভাবেন, তাকে সাধারণতঃ সকলেই ভালবাসে।

“সবাই সুখী হোক এবং কেউ যেন দুঃখ না পায়” এই ভাবনা আমাদের চিত্ত সন্ততিতে স্থাপন করতে হবে। বারংবার স্মরণ করে এই ভাবনা আমাদের চিন্তার সঙ্গে ওতপ্রোত করার জন্য চেষ্টা করতে হবে, এবং খুবই উপকারী হতে পারে। যে সকল সত্ত্ব অতীতে সেটা করতে পেরেছেন আজ তারা হয়েছেন মহান বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব বা সন্ত। বিশ্বের সত্যিকারের মহান নরনারীগণ প্রত্যেকেই এর উপর নির্ভর করেছেন। আমাদের মধ্যে এই ভাবনা জাগরিত করতে পারলে তা কী চমৎকার বা আনন্দের হবে!

আমাদের প্রিয়জনদের রক্ষা করার জন্য অন্যদের ক্ষতিসাধন কর্ম

কেউ যখন আমাদের ক্ষতি করতে উদ্ধত হয় তখন কি আত্মরক্ষা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে?

প্রশ্নটির পরিসর অত্যন্ত বিস্তৃত। কেউ যদি আপনার মাথায় গদা বা লাঠি দিয়ে আঘাত করে, তখন আপনি এই ভেবে ধ্যান করুন যে আপনার পূর্বজন্মের অকুশল কর্মের জন্য ভুগতে হল। ভাবুন, এই লোকটি সেই নির্দিষ্ট কর্মফলটি পরিপক্ক হওয়ার সুযোগ এখন দিয়েছে, ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখেনি। আপনার চিত্ত-সন্ততি থেকে ওই কর্মফলটি লোকটি চিরতরে দূর করে দিল, এমনটি ভেবে তার প্রতি কৃতজ্ঞ হোন।

কেউ যদি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের আক্রমণ করে, যারা আমার উপর নির্ভরশীল; সেক্ষেত্রে আমি কি তাদের রক্ষা করব না? সেটা করলে কি কর্মটি নেতিবাচক বা অকুশল কর্ম হবে?

আপনার স্ত্রী ও সন্তানটিকে রক্ষা করা যেহেতু আপনার কর্তব্য ও দায়িত্ব, আপনার তাই করা উচিত। কিন্তু সেটা যেন যতদূর সম্ভব সুকৌশলে সম্পাদিত হয়। আপনাকে চতুর হতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় আক্রমণকারীকে আঘাত না করে তাদের রক্ষা করা। অন্য কথায় বলতে গেলে আপনি কোন ক্ষতি করলেন না অথচ তাদের রক্ষাও করলেন, এমন একটি উপায় খুঁজতে হবে।

সে আমার সন্তানকে আঘাত করতে পারবে, কিন্তু আমি করতে পারব না? নিষ্ঠুর, বর্বরতা থেকে সন্তানদের রক্ষা করা কি আমাদের কর্তব্য নয়? আমাদের জীবন এমনিতেই দিয়ে দেব?

যথোপযুক্ত ভাবে এই ধরণের অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য আপনার যথেষ্ট সাহস থাকতে হবে। এই বিষয়ে বুদ্ধের পূর্ববর্তী জীবনের (জাতকের) একটি কাহিনী রয়েছে। সেই জীবনে তিনি ছিলেন একজন নাবিক এবং প্রোথিত ধনরত্নের খোঁজে যাচ্ছেন, এমন পাঁচশত মানুষকে নিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন। এই দলে একজন অত্যন্ত লোভী মানুষ ছিল। তিনি সবাইকে হত্যা করে ধনসম্পদ একাই লুট করার ফন্দি আঁটলেন। বোধিসত্ত্ব (শাক্যমুনি বুদ্ধের পূর্ববর্তী জীবন) বিষয়টি বুঝতে পারলেন। ভাবলেন যা হতে যাচ্ছে তা খুবই খারাপ, লোকটি পাঁচশত মানুষ হত্যা করতে যাচ্ছে। তাই, তিনি পাঁচশত প্রাণ রক্ষার্থে অসীম সাহসে লোকটিকে হত্যা করলেন। তিনি এই হত্যাকান্ডের দায় নিলেন স্বেচ্ছায়। অপরকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজে নরকে জন্ম নিতে রাজী থাকলে সেটা হবে আপনার অসীম সাহসের পরিচায়ক। তবে আপনি এ কাজে এগিয়ে যেতে পারেন, যেমনটি বুদ্ধ করেছিলেন।

সেরকম অবস্থায় হত্যাকেও কি অকুশল কর্ম বলে ধরা হবে?

 “সুহৃল্লেখ” নামক গ্রন্থে নাগার্জুন লিখেছেন যে, যদি কেউ তার পিতা-মাতা, সন্তান, বৌদ্ধধর্ম অথবা ত্রিরত্নে শরণ রক্ষায় অকুশল কর্ম করেন, তাকে তার ফল ভোগ করতে হবে। তিনি তার ফল সম্পর্কে পূর্ণতঃ সচেতন আছেন কিনা এবং নিঃস্বার্থ হয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষায় যা করলেন তা নিজের উপর নেবেন স্বেচ্ছায়, এই হল পার্থক্য। আপনি যদি শত্রুকে আঘাত করেন তাহলে আপনি দুঃখময় পরজন্ম গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। যাই হোক, আপনাকে এরকম চিন্তা করে তার সম্মুখীন হতে হবে- “আমি দুঃখ কষ্ট ভোগ করব স্বেচ্ছায়, তাতে আমার পত্নী ও সন্তান কষ্ট পাবে না।”

তাহলে বৌদ্ধধর্মানুযায়ী তাতেও অকুশল কর্ম হবে?

স্ত্রী ও সন্তানকে রক্ষা করা সদর্থক ও কুশল কর্ম কিন্তু শত্রুকে আঘাত করা অকুশল এবং ধ্বংসাত্মক কর্ম। উভয় কর্মেরই ফল গ্রহণ করার জন্য ইচ্ছুক হতে হবে অর্থাৎ ফল ভোগ করার জন্য আপনাকে তৈরী থাকতে হবে।

আপনি বলেছেন যে, যদি কেউ অকুশল কর্ম করে, তাহলে ভবিষ্যতে তাকে দুঃখ ভোগ করতে হবে, কিন্তু যদি সে কুশল, শুভ কর্ম করে তাহলে সুখ তাকে অনুসরণ করবে। এই শুভ কর্মসমূহ কি পুনর্জন্ম ব্যতিরেকে নির্বাণগামী করতে পারে?

আপনি যদি নির্বাণ লাভ করতে চান আপনাকে উপদেশগুলি পরিপূর্ণ এবং সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি যদি খ্রিষ্টান পন্থা অনুসরণ করেন, আপনাকে খ্রিষ্টের উপদেশাবলী নিখুঁতভাবে পালন করতেই হবে। তাহলে খ্রিষ্টীয় মুক্তি সম্ভব হবে। যিশু একা আমাদের পাপমুক্ত করতে পারবেন না, আমাদেরও করণীয় কিছু আছে। নইলে যিশু কেন বলেছেন- পাপ করো না। আমরা যদি যিশু যা বলেছেন তা সঠিকার্থে পালন করি, আমার বিশ্বাস খ্রিষ্টীয় পন্থানুযায়ী মুক্তি সম্ভব। আর যদি বুদ্ধের উপদেশাবলী সঠিকভাবে পালন করি, তাহলে বৌদ্ধ পন্থানুযায়ী “মুক্তি”- নির্বাণ সম্ভব

Top