আমরা পুনর্জন্মকে কীভাবে বুঝতে পারি?
আমরা প্রামাণিকভাবে কী করে বুঝতে পারি যে কোন বিষয়টি সত্য? বৌদ্ধ শিক্ষা অনুসারে, বস্তুকে প্রামাণিকভাবে দুই প্রকারে জানা যেতে পারেঃ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের দ্বারা অথবা অনুমানের মাধ্যমে। কোনো গবেষণাগারে পরীক্ষা করে আমরা কোনো বস্তুর অস্তিত্বকে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সহায়তায় প্রমাণিত করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, কোনো অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আমরা কেবল আমাদের ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে এটা জানতে পারি যে কোনো হ্রদ-এর এক ফোঁটা জলে অনেক সূক্ষ্ম জীব থাকে।
কিন্তু কিছু জিনিস এমন হয়, যেগুলি প্রত্যক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে জানা যায় না। সেগুলিকে বোঝার জন্য আমাদের যুক্তি, কারণ এবং অনুমানের সাহায্য প্রয়োজন হয়, যেমন- চুম্বকত্বের অস্তিত্বের অনুমান কোনো চুম্বক এবং লোহার সূচের ব্যবহারের আধারে বোঝা যায়। পুনর্জন্মকেও প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়জ্ঞানের মাধ্যমে প্রমাণ করা খুবই কঠিন। তবে এমন অনেক মানুষের উদাহরণ পাওয়া যায়, যারা নিজের পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করে থাকে আর তারা পূর্বজন্মের নিজের জিনিসপত্র অথবা পুরোনো পরিচিতদের চিনতে পারে। আমরা এর আধারে পুনর্জন্মের অস্তিত্বকে অনুমান করতে পারি, কিন্তু হতে পারে যে কিছু মানুষ এই অনুমানকে সন্দেহের চোখে দেখে অথবা এটাকে কোনো কৌশল মনে করে।
এই পূর্বজন্মের ঐ স্মৃতিগুলিকে আলাদা রেখে, আমরা যুক্তির সহায়তায় পুনর্জন্মকে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। পরম পূজ্য দালাই লামা এই কথাটি বলেছেন যে, যদি কোনো কথা অথবা ধারণা বাস্তবতার সাথে মিল না খায়, তাহলে তিনি সেগুলিকে বৌদ্ধধর্ম থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন। এই কথাটা পুনর্জন্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আসলে, তিনি এই বক্তব্যটি মূলতঃ এই বিষয়েই দিয়েছিলেন। যদি বৈজ্ঞানিকগণ এটা প্রমাণ করতে পারে যে, পুনর্জন্ম নেই, তাহলে আমাদের এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু, যদি বৈজ্ঞানিকগণ এটাকে অসত্য প্রমাণ না করতে পারে, তাহলে যেহেতু বৈজ্ঞানিকগণ যুক্তি আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন, যেটা নতুন কিছু বোঝার জন্য মুক্ত, তাই তাদের খোঁজ করা উচিত যে, বাস্তবে পুনর্জন্ম কি নেই। পুনর্জন্ম না থাকাটা প্রমাণ করতে চাইলে বৈজ্ঞানিকগণকে তার অস্তিত্ব না থাকার সত্যকে খুঁজতে হবে। শুধু এটা বলে দিলেই পুনর্জন্মের অস্তিত্ব না থাকা প্রমাণ হয়ে যায় না, “পুনর্জন্ম নেই, কারণ সেটা আমি নিজের চোখে দেখতে পাই না।” চুম্বকত্ব এবং মাধ্যাকর্ষণের মতো এমন অনেক জিনিস অস্তিত্বমান আছে, যেগুলি আমরা নিজের চোখে দেখতে পাই না।
পুনর্জন্ম আছে কি নেই তার খোঁজ করার জন্য যুক্তি-কারণের উপায়
যদি বৈজ্ঞানিকগণ পুনর্জন্মের অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে তাদের এটা খোঁজ করা উচিত যে, বাস্তবে পুনর্জন্ম হয়। এটা করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হল, কিছু তথ্যের আধারে একটা সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হয় আর তারপর এটা পরীক্ষা করা হয় যে, এটা প্রমাণ করা যায় কি না। এজন্য আমরা তথ্যের দিকে নজর দিই। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দেখতে পাই, নবজাত শিশু খালি ক্যাসেটের মতো জন্ম নেয় না। তার মধ্যেও কিছু অভ্যাস এবং ব্যক্তিত্ব বিষয়ক বৈশিষ্ট্য থাকে যেগুলি তার কম বয়সেই দেখতে পাওয়া যায়। এগুলি কোথা থেকে আসে?
এটা বলার কোনো অর্থই নেই যে, শিশুদের মধ্যে এই গুণগুলি তার মাতা-পিতার ভৌতিক তত্ত্ব, অর্থাৎ শুক্রাণু এবং ডিম্বের পূর্ব সন্ততি থেকে আসে। নিজেদের মধ্যে যুক্ত হওয়া প্রত্যেক শুক্রাণু আর ডিম্ব গর্ভাশয়ে রোপিত হয়ে ভ্রুণ রূপে বিকশিত হয় না। সেই দুটির শিশু রূপে বিকশিত হওয়া অথবা না হওয়ার মধ্যেকার পার্থক্য কী কারণে হয়? বাচ্চাদের বিভিন্ন প্রকারের অভ্যাস এবং সহজাত বুদ্ধি প্রকৃতপক্ষে কী কারণে বিকশিত হয়? আমরা বলতে পারি যে, এটা ডি.এন.এ আর জীনের প্রভাবের কারণে হয়। এটা তো হল দৈহিক পক্ষ। এই কথাটিতে কেউই অস্বীকার করে না যে এটা কোনো শিশুর অস্তিত্বে আসার প্রক্রিয়ার দৈহিক পক্ষ। কিন্তু এটার অনুভবিক পক্ষের বিষয়ে কী বলা হবে? চিত্তের ব্যাপারে আমরা কী স্পষ্টভাবে বলতে পারি?
ইংরেজী ভাষার “মাইন্ড” শব্দের অর্থ ঠিক একরকম নয় যা সংস্কৃত এবং তিব্বতী ভাষাগুলিতে প্রয়োগ করা হয় আর যা অনুবাদ করার সময় ব্যবহার করা হয়। মূল সংস্কৃত এবং তিব্বতী ভাষাগুলিতে “চিত্ত” শব্দের আশয় মানসিক কার্যকলাপ অথবা মানসিক ঘটনাগুলিকে বোঝায়; এটা এমন কিছুকে বোঝায় না যা এই কার্যকলাপকে সঞ্চালিত করে। কার্যকলাপ অথবা ঘটনা হল বিচার, দৃশ্য, ধ্বনি, মনোভাব, ভাবনা ইত্যাদির মতো কিছু জিনিসের জ্ঞানাত্মক উৎপত্তি আর সেটাকে দেখতে, শুনতে, বুঝতে অথবা না বোঝার মতো জ্ঞানাত্মক যুক্ত থাকা।
কোনো ব্যক্তির ভিতরে জ্ঞানাত্মক বস্তুগুলির উৎপত্তি এবং তার সাথে যুক্ত থাকার এই মানসিক ক্রিয়াকলাপের উৎপত্তি কোথা থেকে হয়? এখানে আমরা এটা বলছি না যে শরীর কোথা থেকে আসে, কারণ এটা স্পষ্ট যে, এটা তো মাতা-পিতা থেকে প্রাপ্ত হয়। আমরা এখানে বুদ্ধি ইত্যাদির বিষয়ে বলছি না, কারণ এর বিষয়ে যুক্তি প্রস্তুত করা যেতে পারে যে, এর একটা জন্ম সম্বন্ধীয় আধার আছে। কিন্তু এটা বলা কথাটিকে অনেক বেশী টানার মতো হয়ে যাবে যে, যদি কোনো ব্যক্তি চকোলেট আইসক্রিম পছন্দ করে তাহলে এটা তার জীনের প্রভাবের কারণে হয়।
আমরা বলতে পারি যে, আমাদের কিছু রুচি আমাদের পারিবারিক পৃষ্ঠভূমি অথবা আমাদের আর্থিক এবং সামাজিক পরিস্থিতিগুলির কারণে প্রভাবিত হতে পারে। সত্যিই এই জিনিসগুলির প্রভাব আছে, কিন্তু আমরা যেভাবে প্রত্যেকটি কাজ করি তার ব্যাখ্যা করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, বাচ্চা বয়সে আমার মন কেন যোগ সাধনার প্রতি আগ্রহী ছিল? আমার আশে-পাশে আমার পরিবার অথবা সমাজের কোনো ব্যক্তি ছিল না। যেখানে আমি থাকতাম সেখানে এই বিষয়ের কিছু গ্রন্থই উপলব্ধ ছিল, এই জন্য আপনারা এটা বলতে পারেন যে, সমাজের কিছু প্রভাব ছিল, কিন্তু তবুও হঠযোগের বিষয়ের সেই গ্রন্থগুলির প্রতি আমার আগ্রহ কেন জেগেছিল? আমি ঐ পুস্তকগুলিই বা কেন বেছে নিয়েছিলাম? এটা একটা অন্য প্রশ্ন। এটা এমন যে সবকিছুই শুধু ভাগ্যক্রমেই হয় আর এইজন্য ভাগ্য খেলা খেলে, অথবা প্রত্যেকটা জিনিস কি ব্যাখ্যা করা যায়?
পৃথক্ মানসিক কার্যকলাপ কোথা থেকে আসে?
এই সব বিষয়কে একদিকে রেখে, আমাদের মুখ্য প্রশ্নে ফিরে আসিঃ জ্ঞানাত্মক বস্তুগুলি এবং এই বস্তুগুলির সাথে জ্ঞানাত্মক লিপ্ততা থাকার এই কার্যকলাপের উৎপত্তি কোথা থেকে হয়? বোধক্ষমতা কোথা থেকে উৎপন্ন হয়? জীবনের স্ফুলিঙ্গের মূল কী? শুক্রাণু এবং ডিম্বের এই সংযোজনে প্রাণবায়ু কে দেয়? তাকে মনুষ্য রূপ কে প্রদান করে? এমন কি আছে যার কারণে বিচারগুলি আর দৃশ্যগুলির উৎপত্তি আর তার সাথে জ্ঞানাত্মক লিপ্ততা নিহিত থাকে আর যা মস্তিষ্কের রাসায়নিক আর বৈদ্যুতিক কার্যকলাপের অনুভবিক পক্ষ হয়?
এটা বলা কঠিন যে, শিশুর মানসিক কার্যকলাপ তার নিজের মাতা-পিতা থেকে আসে, কারণ যদি এমন হয় তাহলে সেটা মাতা-পিতা থেকে শিশু পর্যন্ত কী করে পৌঁছায়? এটার কোনো না কোনো প্রক্রিয়া অথবা ব্যবস্থা থাকবে। জীবনের ঐ স্ফুলিঙ্গ, বস্তুর সচেতনতা দ্বারা চিহ্নিত, শুক্রাণু এবং ডিম্বানুর মতো মাতা-পিতা থেকে এটা কি সেই ভাবেই প্রাপ্ত হয়? এটা কি কামের চরম অবস্থা সহ আসে? ডিম্বস্ফোটনের সাথে? এটা কি শুক্রাণুর মধ্যে থাকে, না ডিম্বানুতে? যদি আমরা এই কথাটির কোনো যুক্তিসঙ্গত এবং বৈজ্ঞানিক নিষ্পত্তি না দিতে পারি যে এই স্ফুলিঙ্গ কখন মাতা-পিতার থেকে শিশু পর্যন্ত পৌঁছায়, তাহলে আমাদের এই প্রশ্নের কোনো আলাদা সমাধান খুঁজতে হবে।
যদি কেবল তার্কিক দৃষ্টিতে দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, সকল ক্রিয়াত্মক বস্তুগুলি তাদের নিজেরই সন্ততি, কোনো বস্তুর সমান জাতির পূর্বের মুহুর্ত থেকে উদ্ভূত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটা দৈহিক বস্তু, সেটা পদার্থ হোক অথবা শক্তি, সেই পদার্থ অথবা শক্তির কোনো পূর্ব মুহুর্ত থেকে উৎপন্ন হয়। এটা একটা সন্ততি।
উদাহরণস্বরূপ, ক্রোধ। যখন আমাদের মধ্যে ক্রোধ জাগে, তখন আমরা শারীরিক শক্তিকে অনুভব করি, এটা তো একটা কথা হল। তবে ক্রোধকে অনুভব করার মানসিক ক্রিয়ার বিষয়ে বিবেচনা করুন অর্থাৎ সেই আবেগ এবং এর সচেতন ও অসচেতন বোধগম্যতার উৎপত্তির অনুভূতির কথা বলি। কোনো ব্যক্তির ক্রোধের অনুভূতি হওয়ার পিছনে এই জন্মের পূর্ব সন্ততির নিজ মূহুর্ত থাকে। কিন্তু তার পূর্বে এই অনুভূতি কোথা থেকে এসেছিল? হয় এই অনুভূতি ব্যক্তির মাতা-পিতা থেকে আসতে হবে, কিন্তু এই প্রক্রিয়া কেমন করে ঘটে, এটা বর্ণনা করার কোনো পদ্ধতি দেখা যায় না, অথবা এটাকে কোনো সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের থেকে প্রাপ্ত হতে হবে। কিন্তু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কী করে এটা সৃষ্টি করে, এই বিষয়ে যুক্তির দৃষ্টিতে ব্যাখ্যায় অসঙ্গতি থাকার কারণে একটা সমস্যা তৈরী হয়। এই রকমের অসংগতির সমস্যাকে পরিহার করার বিকল্প হল, কোনো ব্যক্তির জীবনে ক্রোধের প্রথম মুহুর্ত তার নিজ সন্ততির পূর্ব মুহুর্তে থেকে আসে। পুনর্জন্মের সিদ্ধান্ত এই কথাটির ব্যাখ্যা করে।
একটি চলচিত্রের উপমা
আমরা পুনর্জন্মের বিষয়কে কোনো চলচিত্রের উপমার সাথে তুলনা করে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। যেমন একটা চলচিত্র চলচিত্রের অনেকগুলি ফ্রেমের ধারাবাহিকতার পরিণামে হয়, ঠিক তেমনই আমাদের চিত্ত-সন্ততি বা মনের ধারাবাহিকতা হল সর্বদা পরিবর্তনশীল এক জীবনের বা এক জীবন থেকে অপর জীবনের ঘটমান বিষয়ের সচেতনতার মুহুর্ত। “আমি” অথবা “আমার চিত্ত”-এর মতো দৃঢ়, আবিষ্কার যোগ্য কোনো তত্ত্ব নেই যার পুনর্জন্ম হয়। পুনর্জন্ম কোনো একজন পরিবাহকের বেল্ট-এ উপবিষ্ট কোনো ছোট একটি প্রতিমার উপমার মতো নয়, যা এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে চলে যাচ্ছে, বরং এটা একটা চলচিত্রের মতো যা নিয়মিত ভাবে পরিবর্তন হয়ে চলেছে। এর প্রতিটি ফ্রেম আলাদা, কিন্তু তার মধ্যে একটি ধারাবাহিকতা আছে। প্রতিটা ফ্রেম পরের ফ্রেমের সাথে যুক্ত। তাছাড়া সেখানে ঘটমান বিষয় (ফেনোমেনা) সম্পর্কিত সচেতনতার নিয়মিতভাবে পরিবর্তন হয়ে চলা মুহুর্তের সন্ততি বা ধারাবাহিকতা আছে, যদিও তার মধ্যে কিছু মূহুর্ত অসচেতনশীল হয়। তদতিরিক্ত, যেভাবে সব চলচিত্রগুলি চলচিত্র হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেকটি চলচিত্র এক নয়, তেমনই সব মানসিক সন্ততি অথবা “চিত্ত” কোন একটি চিত্ত নয়। সেখানে ঘটমান বিষয় সম্পর্কিত সচেতনতার সন্ততির অসংখ্য পৃথক্ প্রবাহ আছে এবং প্রত্যেক প্রবাহকে তার নিজের পরিপ্রেক্ষিতে একটা “আমি”-এর সংজ্ঞা দেওয়া যায়।
এগুলি হল কারণ-রেখা যা আমরা পুনর্জন্মের প্রশ্ন সম্পর্কে পরীক্ষা করতে শুরু করি বা প্রয়োগ করি। যদি কোনো সিদ্ধান্ত যুক্তির দৃষ্টিতে অর্থপূর্ণ বলে মনে হয়, তাহলে আমরা গভীরভাবে এই বিষয়ের উপর বিচার করতে পারি যে, এমনও লোক আছে যারা পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করে। এইভাবে আমরা যুক্তির পদ্ধতিতে পুনর্জন্মের অস্তিত্বকে পরীক্ষা করি।
কী পুনর্জন্ম নেয়?
বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে পুনর্জন্মের উপমা এমন নয় যে, কোনো পরিবাহক বলয়ে রাখা কোনো একটা ছোট মূর্ত প্রতিমা অথবা ব্যক্তি এক জন্ম থেকে পরজন্মে ভ্রমণ করে। সেই সাদৃশ্যে পরিবাহক বলয় সময়কে সূচীত করে এবং তার প্রতিমা বোঝায়, কোনো মূর্ত বস্তুকে, অর্থাৎ কোনো নিশ্চিত ব্যক্তিত্ব অথবা আত্মা যাকে “আমি” বলে সম্বোধিত করা হয় যা সময়ের সাথে এগিয়ে যায়ঃ “এখন আমি যুবক, এখন আমি বৃদ্ধ; এখন আমি এই জন্মে রয়েছি, এখন আমি ওই জন্মে আছি।” পুনর্জন্ম সম্পর্কে এটা বৌদ্ধ অবধারণা নয়। বরং এই উপমাটি একটা চলচিত্রের মতো। চলচিত্রে একটা ধারাবাহিকতা থাকে, চলচিত্রের ফ্রেম ওই ধারাবাহিকতাটি নির্মাণ করে।
নাই বা বৌদ্ধধর্ম এটা বলে যে আমি তুমি হয়ে যাই, অথবা আমরা সবাই এক। যদি আমরা সবাই এক হই, আর আমি হই তুমি, তাহলে যদি আমাদের দুই জনেরই খিদে লাগে, তখন আপনি গাড়িতে বসে প্রতিক্ষা করতে পারেন আর আমি খাবার খেতে চলে যাই। এটা এমন নয়। আমাদের প্রত্যেকের নিজের-নিজের আলাদা আলাদা সন্ততির প্রবাহ আছে। আমার চলচিত্রের ঘটনাচক্র আপনার চলচিত্রের ঘটনাচক্র হতে পারে না, কিন্তু আমার জীবন এই অর্থে চলচিত্রের মতো এগিয়ে চলে যে সেটা মূর্ত আর স্থির নয়। জীবন এক ফ্রেম থেকে অন্য ফ্রেমের দিকে এগিয়ে চলে। কর্মগতি অনুসারে তার একটা ক্রমকে অনুসরণ করে, আর এই ভাবে জীবন একটি সন্ততি নির্মাণ করে।
প্রত্যেক সন্ততি হ’ল কোনো ব্যক্তি যাকে “আমি” বলা যায়; এমন নয় যে, প্রত্যেক সন্ততি কোনো ব্যক্তিই নয়। কিন্তু যেভাবে কোনো চলচিত্রের শীর্ষক ওই পুরো চলচিত্র আর তার প্রত্যেক ফ্রেমকে বোঝায় কিন্তু সেটা চলচিত্রের মূর্ত রূপে প্রত্যেক ফ্রেমে পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনই “আমি” বলতে কোনো ব্যক্তির চিত্ত-সন্ততি আর তার প্রত্যেক মুহুর্তকে বোঝায়, কিন্তু তাকে মূর্ত রূপে কোনো মুহুর্তে পাওয়া যায় না। যাইহোক একটা সাংবৃতিক বা প্রচলিত ‘আমি’, একটা ‘আত্মা’ আছে। বৌদ্ধধর্ম কোনো উচ্ছেদবাদ ব্যবস্থা নয়।
মানুষ কি প্রত্যেকবার মানুষরূপে পুনর্জন্ম গ্রহণ করে?
আমরা এখানে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি সেটা হল মানসিক ক্রিয়াকলাপ এবং যে সাধারণ উপাদানগুলি মানসিক ক্রিয়াকলাপের চরিত্র বর্ণন করে। যে উপাদানটি মানুষের মানসিক ক্রিয়াকলাপের চরিত্র বর্ণন করে সেটা হল বুদ্ধি। আমরা জানি যে, ঐ বুদ্ধির তাৎপর্য পুরো মাপ হিসাবে “খুবই বুদ্ধিমান নয়” থেকে “খুব বুদ্ধিমান” পর্যন্ত হতে পারে। তবে এছাড়া অন্যান্য উপাদানও আছে এবং সেগুলিও মানসিক ক্রিয়াকলাপের অংশ। উদাহরণস্বরূপ, ক্রোধ, লোভ, আসক্তি, বিক্ষেপতা এবং বাধ্যতামূলক আচরণ, যেগুলি এই চেতসিকের (চৈত্ত) কারণে উৎপন্ন হয়। কিছু মানুষের মধ্যে এই উপাদানগুলি তাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপকে আধিপত্য করে যাতে তারা তাদের মানবীয় বুদ্ধি ব্যবহার না করতে পারে। পরিবর্তে, তারা বেশীর ভাগ লোভ অথবা বিদ্বেষ ইত্যাদির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, কিছু মানুষের মধ্যে কামেচ্ছা অত্যন্ত প্রবল হয়, তারা মদ্যশালায় ঘোরাফেরা করে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং প্রায় সকলের সাথে যৌন সম্বন্ধ তৈরী করে যাদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। আপনার কি মনে হয় না ঐ মানুষটা কুকুরের মতো আচরণ করে? একটা কুকুর তো যেকোনো অন্য কুকুরের উপর চড়ে বসবে যার সাথে তার সাক্ষাৎ হবে, যেকোন সময়; এটা তার নিজের উপর কোন প্রকারের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ রাখবে না। যদি একটা মানুষ ঐভাবে আচরণ করে, তাহলে সে একটা পশুর মানসিকতার অভ্যাস গড়ে তোলে। অতএব এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমরা যদি পুনর্জন্মের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা-ভাবনা করি, তাহলে ঐ ব্যক্তির কামুকতার মানসিকতা তার ভবিষ্যতের জন্মে তার মানসিক ক্রিয়াকলাপের উপর প্রভাব ফেলবে। ফলে তার পুনর্জন্ম এমন একটি শরীরে হবে যা উপযুক্ত হবে সেই ধরণের মানসিক ক্রিয়াকলাপের ভিত্তি; সেটাই হল একটা পশুর পুনর্জন্ম।
অতএব আমরা আমাদের আচরণকে পরীক্ষা করা খুবই উপকারীঃ “আমি কি এই ধরণের বা ঐ ধরণের পশুর মতো আচরণ করছি?” একটি মাছির পরিপ্রেক্ষিতে ভাবুন। একটি মাছির মানসিকতা পুরোপুরি মানসিক বিচরণে যুক্ত। একটি মাছি কয়েক মুহুর্তের বেশী এক জায়গায় থাকতে পারে না; এটা সবসময় উড়ে বেড়ায় এবং প্রতিনিয়ত বিক্ষিপ্ত থাকে। মাছির মনের মতোই কি আমাদের মন? যদি তাই হয়, তাহলে পরবর্তী জীবনকালে আমরা কী আশা করতে পারি? আমরা কি আশা করতে পারি যে, আমরা বুদ্ধিমান হব এবং ভাল একাগ্রচিত্ত থাকবে?
এগুলি এমন কিছু চিন্তাধারা যা আমাদের বুঝতে সহায়তা করে যে, মানুষের জন্ম অগত্যা মানুষ রূপে হয় না। আমরা বিভিন্ন রূপে পুনর্জন্ম নিতে পারি; এর উত্থান-পতন হতে থাকে। একজন মানুষ হিসাবে আমরা যদি অনেক ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলে থাকি, তাহলে আমরা যদি পশু রূপে পুনর্জন্ম লাভ করেও থাকি, তবুও যখন আমাদের পূর্বের পাশবিক আচরণ সমাপ্ত হয়ে যায়, তখন আমাদের পূর্ববর্তী ইতিবাচক শক্তি প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে আমরা পুনরায় মানুষ রূপে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারি। চিরকাল নিম্ন যোনিতে (দুর্গতি) জন্ম হওয়ার জন্য আমাদের নিন্দা করা হয় না।
এখানে বোঝার বিষয়টা হল যে, মানসিক ক্রিয়াকলাপে কোনো কিছু সহজাত থাকে না, যা মানবীয় মানসিক ক্রিয়াকলাপ তৈরী করে বা যা পুরুষ অথবা স্ত্রীর মানসিক ক্রিয়াকলাপ তৈরী করে অথবা এমন অন্যকিছু। এটা হল শুধুমাত্র মানসিক ক্রিয়াকলাপ। আর এইজন্য যে ধরণের পুনর্জন্ম লাভ করি সেটা আমাদের কর্মের উপর নির্ভর করে অর্থাৎ আমাদের বিভিন্ন অভ্যাস যা আমাদের বাধ্যতামূলক আচরণ গড়ে তোলে। ভবিষ্যতের জন্মে আমরা এমন শরীর ধারণ করব যা সেই অভ্যাসগুলি সম্পাদন করার জন্য উপযুক্ত আধার হিসাবে কাজ করবে।
সারাংশ
আমরা যখন পুনর্জন্মের বৌদ্ধ উপস্থাপনাকে যুক্তি দ্বারা পরীক্ষা করি, তখন আমাদের সেই কার্যকারণ প্রক্রিয়াটি পরীক্ষা করতে হবে যা ব্যক্তিগত চিত্ত-সন্ততিকে স্থায়ী করে তোলেঃ মানসিক ক্রিয়াকলাপের ব্যক্তিগত স্বতন্ত্র ধারাবাহিকতা যা কখনও হ্রাস হয় না। অনাদি পুনর্জন্ম হল আমাদের পৌঁছনোর উপসংহার, এর আগে নির্মিত তার নিজস্ব আচরণগত অভ্যাসগুলি প্রতিটি জীবনকালকে রূপ দেয়।