মানব সভ্যতার কিছু প্রাচীনতম উপলব্ধময় সাহিত্যগুলি প্রাচীন মিশরীয় দেবী-দেবতাদের মন্ত্র জপ থেকে শুরু করে সুমেরীয় মন্দিরের স্তুতি গানগুলি প্রার্থনার সাথে সম্পর্কিত। খ্রিষ্টান, মুসলমান এবং ইহুদীরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, হিন্দুরা বিভিন্ন ধরণের দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করার জন্য পছন্দ করে নিতে পারে। বাহ্যিকভাবে বৌদ্ধধর্মকে এর থেকে অন্যরকম বলে মনে হয় না। প্রায় যেকোন দেশে অবস্থিত মন্দির বা মঠের দিকে তাকালে আপনি প্রচুর দর্শনার্থীদের দেখতে পাবেন যারা অঞ্জলীবদ্ধ হয়ে, বুদ্ধের মূর্তির সামনে শব্দ পাঠ করছেন। আর যারা তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের সাথে পরিচিত তাদের জন্য থাকে সেই উপাদানগুলি, যেগুলিকে ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে প্রার্থনা-পুঁতি, প্রার্থনা-চক্র এবং প্রার্থনা-পতাকা রূপে।
প্রার্থনা ক্রিয়ার তিনটি উপাদান আছেঃ যে ব্যক্তি প্রার্থনা করে, যে আধারকে প্রার্থনা করা হয় এবং যে বিষয়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়। সুতরাং বৌদ্ধধর্মে প্রার্থনার প্রশ্নটি বেশ জটিল। সর্বোপরি, একটি অ-তাত্ত্বিক ধর্মে, যেখানে সৃষ্টিকর্তার মান্যতা নেই, সেখানে বৌদ্ধরা কার কাছে প্রার্থনা করে এবং কিসের জন্য? যদি আমাদের আশীর্বাদ দেওয়ার মতো কেউ না থাকে তাহলে প্রার্থনা করে কী লাভ? বৌদ্ধদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল, “আমাদের দুঃখ এবং সমস্যাগুলি নিবারণ করাটা কি অন্য কারও পক্ষে সম্ভব?”
পরিবর্তনের জন্য শুধু প্রার্থনা করা যথেষ্ট নয়। কার্যকর করতে হবে- পরম পূজ্য চতুর্দশ দালাই লামা
বুদ্ধ বলেছিলেন যে, কেউ এমনকি বুদ্ধ নিজেও তাঁর সমস্ত জ্ঞান এবং ক্ষমতা দিয়ে আমাদের সব রকমের সমস্যা দূর করতে পারে না। এটা অসম্ভব। আমাদের নিজেদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা যদি সমস্যা ও দুঃখ ভোগ করতে না চাই তাহলে আমাদের তার কারণ ত্যাগ করতে হবে। আর আমরা যদি সুখ ভোগ করতে চাই তাহলে আমাদের নিজেদেরকেই সুখের কারণগুলি তৈরী করতে হবে। বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, আমরা শুদ্ধ শীল এবং নৈতিকতা পালন করে এটা অর্জন করতে পারি। আমরা যে ধরণের জীবন চাই সেটা তৈরী করার জন্য আমাদের আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা পুরোপুরি আমাদের উপর নির্ভর করে।
বৌদ্ধরা কার কাছে প্রার্থনা করে?
আমরা যখন মানুষকে মুর্তির সামনে প্রণাম করতে দেখি, মন্দিরে ধূপ অর্পন করতে দেখি এবং পূজাকক্ষে শ্লোক পাঠ করতে দেখি, ঐ সময় তারা কী যাচনা করে এবং কার কাছে প্রার্থনা করে? ঐ সময় মানুষ চিন্তা-ভাবনা করতে পারে, “হে শাক্যমুনি বুদ্ধ, আমি যেন একটি মার্সিডিস গাড়ি প্রাপ্ত করতে পারি!” অথবা “হে ভৈষজ্য বুদ্ধ, অনুগ্রহ করে আমার রোগের নিরাময় কর!” অধিকাংশ বৌদ্ধ শিক্ষকরা বলেন যে, সম্ভবতঃ এই ধরণের প্রার্থনা অত্যাল্প উপকার প্রদান করতে পারে।
পরিবর্তে, বৌদ্ধধর্মে আমরা নিজের উপর কাজ করতে অনুপ্রেরণা এবং শক্তি জোগানোর জন্য বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বদের কাছে প্রার্থনা করি, যাতে আমরা আমাদের নিজের সুখের কারণগুলি বিকাশ করতে পারি। এটা এমন নয় যে আমরা একটা জাদুই ছড়ি ঘুরিয়ে দিলাম, আর আকস্মিক ভাবে আমরা তার থেকে এটা করার জন্য কিছু বিশেষ ক্ষমতা লাভ করে নিলাম। তবে তাদের দৃষ্টান্তকে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে, কারণ তারা আমাদের অনুকরণীয় আদর্শ হিসাবে কাজ করে অর্থাৎ আমরা বিশ্বাসে পরিপূর্ণ হই, “আমি এটা করতে পারি।”
সূত্র-পাঠ, মন্ত্র-পাঠ এবং সেই সাথে দেবতাদের আলম্বনের মতো বৌদ্ধ প্রার্থনার ক্রিয়াকলাপগুলি আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার সাথে যুক্ত। এর উদ্দেশ্য হল করুণা, উদ্যম, ধৈর্য ইত্যাদির মতো গঠনমূলক আবেগের বিকাশ করা এবং অপরের সহায়তা করার জন্য গঠনমূলক কর্মে যুক্ত হওয়া।
সপ্তাঙ্গ প্রার্থনা
সপ্তাঙ্গ প্রার্থনা হল একটা সুপরিচিত অনুশীলন। এরমধ্যে সম্পূর্ণ বৌদ্ধ পথের সারাংশ অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। এর সাতটা অঙ্গ আছে। যার প্রত্যেকটির একটা নির্দিষ্ট ফল আছেঃ
- আমি সমস্ত বুদ্ধদের প্রণাম করি যারা ত্রিকালকে অনুগ্রহ করেছেন। আর জগতে বিদ্যমান সমস্ত পরমাণু সমতুল্য শরীর দ্বারা ধর্ম এবং উচ্চতম সংঘকে প্রণাম করি।
- যেভাবে মঞ্জুশ্রী এবং অন্যরা আপনি, ভগবানকে, পূজাদ্রব্য অর্পণ করেছেন ঠিক তেমনই ভাবে আমিও আপনি, তথাগত, এবং আপনার ধার্মিক সন্তানদের পূজাদ্রব্য অর্পণ করি।
- আমার ইহ এবং অন্যান্য জন্মসহ অনাদি সাংসারিক জন্ম জুড়ে আমি অজান্তে নেতিবাচক কর্ম করেছি অথবা অন্যদের দ্বারা করিয়েছি এবং এছাড়াও অজ্ঞতার কারণে বিভ্রান্ত হয়ে উক্ত কর্মের প্রতি আনন্দবোধ করেছি। আমি যা কিছুই করেছি সেগুলিকে আমি ভুল হিসাবে দেখি এবং আমি, আপনি রক্ষকের সন্মুখে, হৃদয়ের গভীরতা থেকে সেটাকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করি।
- অতএব সীমিত সত্ত্বকে আনন্দে স্থাপিত করতে বোধিচিত্ত বিকাশ করা এবং সীমিত সত্ত্বদের কল্যাণ করার জন্য কর্ম করার প্রতি আমি সহর্ষে ইতিবাচক শক্তির মহাসাগরে অনুমোদন করি।
- অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে আমি সমস্ত দিকের বুদ্ধদের অনুরোধ করিঃ সীমিত সংখ্যার দুঃখিত সত্ত্ব ও অন্ধকারে হাতড়ানো সত্ত্বদের জন্য ধর্ম-প্রদীপ প্রজ্বলন করুন।
- অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে আমি ভগবান আপনাকে, যিনি নির্বাণ লাভ করবেন, অনুরোধ করিঃ এই বিচরিত সত্ত্বদের অন্ধতায় ত্যাগ না করে আপনি অসংখ্য কল্প পর্যন্ত অবস্থান করুন।
- উক্ত কর্ম করে, সেটা যাই হোক না কেন, আমি যা কিছু ইতিবাচক শক্তি সঞ্চয় করেছি, এর পরিণামস্বরূপ আমি যেন সমস্ত সীমিত সত্ত্বের দুঃখ পরিহার করতে পারি!
- উক্ত প্রার্থনার প্রথম অংশ হল প্রণাম। আমরা আদর বা শ্রদ্ধার প্রতীক রূপে বুদ্ধদের প্রণাম করি। কারণ বুদ্ধরা করুণা, মৈত্রী এবং জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রণামকালে আমরা আমাদের শরীরের সবথেকে উচ্চতম অংশ অর্থাৎ মস্তককে যখন ভূমিতে ঠেকাই সেটাও আমাদের অহংকারকে পরিহার করতে এবং নম্রতা বিকাশ করতে সহায়তা করে।
- এরপর আমরা পূজাদ্রব্য অর্পন করি। অনেক বৌদ্ধরা জলপাত্র অর্পন ক’রে কিন্তু তারমধ্যে যে বস্তুটি বিদ্যমান থাকে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল দানের অনুপ্রেরণা অর্থাৎ আমাদের সময়, প্রচেষ্টা, শক্তি এবং এর পাশাপাশি আমাদের সম্পদও। এটা আমাদের আসক্তিকে পরিহার করতে সহায়তা করে।
- তৃতীয়তঃ আমরা আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলি স্বীকার করি। সম্ভবতঃ কখনো-কখনো আমরা অলস বা স্বার্থপর হয়ে উঠি, আবার কখনো আমরা কাজ করি খুবই ধ্বংসাত্মকভাবে। আমরা এগুলি স্বীকার করি, তারজন্য অনুশোচনা করি এবং একই ভুল আবার না করার জন্য দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাই। এই অংশটি হল নেতিবাচক কর্মের আবেগের প্রভাবের অধীনে না থাকাটা কাটিয়ে ওঠা।
- এরপর আমরা অনুমোদন করি বা আনন্দিত হই। আমরা যে সমস্ত ভালো কর্ম নিজেরা করে থাকি সেগুলির বিষয়ে ভাবি আর ভাবি অন্যদের দ্বারা কৃত অবিশ্বাস্য গঠনমূলক কর্ম বিষয়ে। আমরা বুদ্ধদের দ্বারা কৃত মহান কৃতিগুলির দিকেও অবলোকন করি। এটা ঈর্ষাকে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করে।
- এরপরে সেই শিক্ষাগুলির জন্য আমরা অনুরোধ করি যা আমাদের মধ্যে মনের একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থা বিকাশ করে। আমরা বলি, “আমরা শিখতে চাই, আমরা নিজেদের এবং অন্যদের জন্য সুখ বিকাশ করতে চাই।”
- আমরা শিক্ষকদের না চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। পূর্ববর্তী অংশে, আমরা শিক্ষার জন্য উন্মুক্ত হয়ে থাকি এবং এখন আমরা চাই যে শিক্ষকরা যেন আমাদের ছেড়ে চলে না যায় বরং আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণবোধি লাভ না করতে পারি ততক্ষণ পর্যন্ত তারা যেন আমাদের শিক্ষা দান করতে থাকেন।
- সর্বশেষে আমাদের কাছে থাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ সেটা হল পরিণামনা বা উৎসর্গ। আমরা যা কিছু ইতিবাচক শক্তি বিকাশ করি সেগুলিকে উৎসর্গ করি যাতে সেটা আমরা নিজেরা এবং অন্যান্য সত্ত্বরা লাভবান হতে পারে।
যেমনকি আমরা এই প্রার্থনায় দেখতে পাই যে বৌদ্ধধর্মের লক্ষ্য কোন বাহ্য সত্ত্ব নয় যে নিচে নেমে আসবে এবং আমাদের সমস্ত অসুবিধা থেকে রক্ষা করবে। কথায় আছে “আপনি একটা ঘোড়াকে জলের কাছে নিয়ে যেতে পারেন কিন্তু পান করাতে পারবেন না।” অন্য কথায়, বুদ্ধ শুধু আমাদের পথ দেখান কিন্তু কাম এবং অসচেতনতাকে পরিহার করা আর আমাদের মধ্যে বিদ্যমান অসীম গঠনমূলক সম্ভাব্য-এর বিকাশ করতে হলে চেষ্টা স্বয়ং আমাদেরকেই করতে হবে।
উপসংহার
বাহ্যিক ভাবে, বৌদ্ধধর্মে প্রার্থনার ফাঁদ এবং অনুষ্ঠান আছে। তবে এর অর্থ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সহায়তার জন্য কোনও বাহ্যিক সত্ত্বের কাছে আবেদন করা নয়। বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বরা হলেন নিখুঁত অনুসরণীয় আদর্শ। তাঁরা আমাদের পথ-প্রদর্শন করেন, আমাদের বর্তমান অবস্থা থেকে পূর্ণ বোধিলাভ পর্যন্ত। বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বদের কাছে প্রার্থনা করে আমরা তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করি এবং আমাদের আভ্যন্তরীণ ক্ষমতা জাগ্রত করি অর্থাৎ অসীম করুণা, মৈত্রী এবং জ্ঞান যা আমাদের সকলের মধ্যে সম্ভাব্য রূপে বিদ্যমান আছে।