ধ্রুপদী বৌদ্ধ সাহিত্যে ঐতিহাসিক বুদ্ধের জীবনের বহু দিক উন্মোচিত করেছে। গোড়ার দিকের কথা কোন একটি গ্রন্থে সম্পূর্ণ পাওয়া যায় না বরং থেরবাদী পরম্পরায় সূত্র ও বিনয় পিটকের বিভিন্ন ঘটনার তথ্যসূত্র থেকে তার একটি সর্বাঙ্গীন রূপ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে এই আদি গ্রন্থগুলিতে তথ্য নিয়ে মহাসাংঘিক, সর্বাস্তিবাদী এবং মহাযান পরম্পরা একটি সুশোভিত কাঠামো সৃষ্টি করেছে, যা কোন কোন সময় অতিমানবিক কাহিনী গড়ে তুলেছে। তবে পালি সাহিত্যে যে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে একান্তই একজন মানুষ ব্যক্তিগত ও সাংঘিক দিক দিয়ে অসুরক্ষিত সময়ে কীভাবে সমস্যায় জর্জরিত হয়ে অসংখ্য কঠিন সমস্যায় জীবনধারণ করছেন। এখানে আমরা স্টিফেন ব্যাচেলর এর পান্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ Confession of a Buddhist Atheist নির্ভর ক’রে বুদ্ধের জীবনের গোড়ার দিকের একটি বৃত্তান্ত প্রস্তুত করছি। সমস্ত নাম পালি অনুযায়ী দেওয়া হবে।
৫৬৬ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে বুদ্ধ বর্তমান নেপাল রাষ্ট্রের দক্ষিণে লুম্বিনী উদ্যানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। স্থানটি শাক্যদের রাজধানী কপিলাবস্তুর অনতিদূরে অবস্থিত। যদিও তাঁর নাম ছিল সিদ্ধার্থ কিন্তু পালিতে তা খুব একটা দেখা যায় না, তবে আমরা এখানে সুবিধার্থে সেটা ব্যবহার করব। গৌতম বুদ্ধের অপর নাম যা প্রকৃতপক্ষে তার গোত্রও ছিল। সিদ্ধার্থের পিতা শুদ্ধোধন রাজা ছিলেন না, যদিও বৌদ্ধ সাহিত্যে তাঁকে রাজা হিসেবেই দেখানো হয়েছে, বরং তিনি ছিলেন গৌতম গোত্রের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, হয়তো তিনি শাক্যদের আঞ্চলিক শাসন কর্তা ছিলেন। পালি সাহিত্যে তাঁর মায়ের নামের উল্লেখ না থাকলেও সংস্কৃত সাহিত্যে মায়ের নাম মায়াদেবী রূপে উল্লেখিত হয়েছে। সিদ্ধার্থের জন্মের কিছুদিন পর মায়াদেবী দেহত্যাগ করেন এবং তিনি প্রজাপতি গৌতমী কর্তৃক পালিত হন।
শাক্য একটি প্রাচীন গণরাজ্য ছিল, যা সিদ্ধার্থের সময় ছিল শক্তিশালী রাজ্য কোশলের অংশ। কোশল রাজ্য বর্তমান বিহারে গঙ্গার উত্তর পার থেকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর রাজধানী ছিল সাবথি (শ্রাবস্তী)।
বুদ্ধের জীবনকে বুঝতে হলে তাঁর সমকালীন ভৌগোলিক অঞ্চলকে জানতে পারলে তাঁকে অনুসরণ করা অনেক সহজ হবে। কোশলের পূর্ব সীমান্তে ছিল শাক্য রাজ্য, যার দক্ষিণ-পূর্বে ছিল মল্লগণ। আবার মল্লদের পূর্বে ছিল বজ্জি গণরাজ্য, যার রাজধানী হল বৈশালী। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর একটি সংসদ দ্বারা বজ্জি গণরাজ্য শাসিত হতো এবং তাদের মধ্যে লিচ্ছবিগণ ছিল প্রধান। বজ্জি ও কোশলের দক্ষিণে গঙ্গার তট ধরে ছিল এক শক্তিশালী রাজত্ব ‘মগধ’, যার রাজধানী ছিল রাজগহ (রাজগৃহ)। কোশলের পশ্চিমে হল বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও গান্ধার। গান্ধার তখন পারস্য সম্রাট আকেমেনিড (Achaemenid) এর সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। অঞ্চলটির রাজধানী ছিল তক্কশীলা (তক্ষশীলা) এবং তৎকালীন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তক্কশীলা তখন সমাদৃত।
সেখানে গ্রীক, পারসিক ভাবনা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির একটি মিলিত রূপ বিকশিত হয়েছিল। বুদ্ধ যেখানে বেড়ে উঠেছিলেন, সেই কপিলাবস্তু তখন উত্তরাপথের একটি বিশিষ্ট বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। উত্তরাপথ তখন দক্ষিণে মগধ থেকে বজ্জি, মল্ল, শাক্য হয়ে কোশল থেকে উত্তরে গান্ধারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। যদিও পালি সাহিত্য বুদ্ধের জীবনের ২৯ বছর বয়সের পূর্ববর্তী বিবরণ খুব একটা দেয়নি। তবু এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তিনি বহুরকম সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। হয়তো তিনি তক্কশিলায় পড়াশোনাও করে থাকবেন, তবে সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ।
সিদ্ধার্থ ভদ্দকাচ্চনাকে বিয়ে করেন, যিনি সংস্কৃত সাহিত্যে যশোধরা নামে পরিচিতা। তিনি ছিলেন সিদ্ধার্থের তুতো বোন এবং দেবদত্তের ভগিনী। পরবর্তী সময়ে দেবদত্ত বুদ্ধের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। তাদের একটি পুত্র সন্তান হল, নাম রাহুল। পুত্রের জন্মের কিছুদিন পর ২৯ বছর বয়সে বুদ্ধ কপিলাবত্থু ত্যাগ করেন। তিনি পারমার্থিক সত্য সন্ধানে মগধের দিকে যাত্রা করেন। উত্তরাপথ ধরে গঙ্গা পার হয়ে এলেন রাজগহে। সে সময় মগধের শাসক ছিলেন রাজা বিম্বিসার এবং কোশলের রাজা ছিলেন পসেনদি (প্রসেনজিত)। এই দুই রাজা কৌশলগত কারণে একে অপরের ভগিনীকে বিবাহ করেছিলেন। রাজা পসেনদির বোনের নাম ছিল দেবি (দেবী)।
মগধে সিদ্ধার্থ আলার কালাম এবং উদ্দক রামপুত্ত (উদ্রক রামপুত্র) নামক দুজন ব্রাহ্মণ শিক্ষকের নিকট অধ্যয়ন করেন। তারা তাঁকে শূন্যতার ধ্যান সহ বস্তুর অস্তি-নাস্তি ভাবনা ত্যাগ ক’রে মোক্ষ মার্গের শিক্ষা দিলেন। এই প্রাপ্তিতেও সিদ্ধার্থ খুশি হলেন না। তাই তিনি ঐ শিক্ষকদের ত্যাগ করেন। তারপর তিনি ঘোর কৃচ্ছসাধনে ব্রতী হলেন। প্রায় কিছুই আহার করতেন না। তারপরও তিনি বুঝলেন এই সাধনা মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে না। তিনি উপবাস ভঙ্গ ক’রে বর্তমান বুদ্ধগয়ার নিকটে উরুবেলাতে গেলেন। সেখানে একটি বোধিবৃক্ষের নীচে ৩৫ বছর বয়সে বুদ্ধত্ব লাভ করলেন। মগধ আগমনের পর সেটা ছিল ষষ্ঠ বর্ষ।
জনৈক সম্ভ্রান্ত লিচ্ছবি মহালি তখন ছিলেন বৈশালীতে, তিনি বুদ্ধের কথা শুনে তাঁকে মগধে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য রাজা বিম্বিসারকে অনুরোধ করলেন। সেই অনুযায়ী বর্ষাশেষে বুদ্ধতার বর্ধনশীল সংঘকে নিয়ে মগধের রাজধানী রাজগহের পূর্বে উপস্থিত হলেন। বুদ্ধের উপদেশ শুনে প্রীত রাজা বিম্বিসার তাঁকে একটি রম্য উদ্যান দান করলেন। উদ্যানটি বেলুবন (বেনুবন) নামে পরিচিত ছিল। বর্ষাকালে বুদ্ধ সেখানেই তার সংঘকে নিয়ে বাস করতেন।
শীঘ্রই সারিপুত্ত (শারিপুত্র) এবং মোজ্ঞল্লনা (মৌদ্গল্যায়ন) স্থানীয় জনৈক গুরুর প্রধান শিষ্যদ্বয় বুদ্ধের সংঘে যোগ দিলেন। ক্রমবর্ধনশীল সংঘের জন্য শীলাদির ব্যবস্থা করার জন্য সারিপুত্ত বুদ্ধকে নিবেদন করলেন। রাজা বিম্বিসারও পরামর্শ দিলেন যে জৈনদের মতো অপর সন্ন্যাসী সম্প্রদায়েরও কিছু রীতিনীতি যেন গ্রহণ করা হয়। রাজা প্রস্তাব দিলেন তারা যেন সপ্তাহান্তে বুদ্ধের দেশনা নিয়ে আলোচনা করেন। তাতে বুদ্ধ সম্মত হলেন।
একদিন কোশলের রাজধানী সাবত্থির ধন্যাঢ্য ব্যক্তি অনাথপিন্ডক রাজগহেতে ব্যবসায়ের জন্য এলেন। বুদ্ধের দেশনায় প্রাভাবিত হয়ে তিনি রাজা পসেনদির রাজধানী সাবত্থিতে বর্ষাবাস করার জন্য একখন্ড জমি দান করলেন। এর কিছুদিন পর বুদ্ধ সংঘ সহ কোশল যাত্রা করলেন। এই ঘটনা অনাথপিন্ডক কর্তৃক বুদ্ধকে উপযুক্ত স্থান দান করার অনেক আগের কাহিনী।
এর মধ্যে বুদ্ধ তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে এলেন কপিলাবত্থু। পিতা শুদ্ধোদন শীঘ্রই তার অনুগামী হলেন, সেই সঙ্গে আট বছরের পুত্র রাহুল ভিক্ষু সংঘে শ্রমণ হিসেবে যোগ দিলেন। এরপর অনেক শাক্যবংশীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিও সংঘে যোগ দিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন খুড়তুতো ভাই আনন্দ, অনিরুদ্ধ (অনুরুদ্ধ), দেবদত্ত, বৈমাত্রেয় ভাই নন্দ, তিনি সুন্দরনন্দ নামেও পরিচিত ছিলেন।
বুদ্ধের বিমাতা তথা মাসি প্রজাপতি সংঘে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করায়, বুদ্ধ প্রথমে অস্বীকার করলেন। বিন্দুমাত্র নিরুৎসাহী না হয়ে প্রজাপতি অন্য বহু নারী সহ মস্তক মুন্ডন ক’রে হলুদ বর্ণ চীবর ধারণ ক’রে বুদ্ধের অনুসরণ করতে লাগলেন। দীক্ষা দানের জন্য প্রজাপতির একাধিক অনুরোধ বুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অবশেষে তথাগতের মহাপরিনির্বাণের কয়েকবছর আগে আনন্দ এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলেন। তিনি বুদ্ধকে প্রজাপতির হয়ে অনুরোধ করলেন। অবশেষে বুদ্ধ ভিক্ষুণী হিসেবে দীক্ষা দিতে সম্মত হলেন। সেটা বজ্জি গণরাজ্যের বৈশালীতে হয়েছিল।
এইভাবে বৌদ্ধধর্মে ভিক্ষুণী সংঘের প্রতিষ্ঠা হল। দানবীর হিসাবে অনাথপিন্ডক খ্যাত ছিলেন। কোশলে বুদ্ধের প্রত্যাবর্তনের কয়েক বছর পর তিনি বিপুল স্বর্ণের বিনিময়ে একখন্ড উদ্যান ক্রয় ক’রে বুদ্ধকে দান করলেন, সেটা জেতবন নামে পরিচিত। সেখানে তিনি বুদ্ধ ও সংঘের বর্ষাবাসের জন্য একটি রম্য নিবাস তৈরী করলেন। ঘটনাক্রমে সেটা ঘটল বুদ্ধের নির্বাণ লাভের ২০ বছর পর। বুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাবাসের প্রথা চালু করেছিলেন। বর্ষাকালের তিন মাসে ভিক্ষুগণ একস্থানে বসবাস করবেন এবং কোথাও যাতায়াত করবেন না, যেমনটি ওঁরা আগে করতেন। বুদ্ধ স্বয়ং ১৯ টি বর্ষাবাস জেতবনে অতিবাহিত করেন এবং সেখানে ৮৪৪টি দেশনা দান করেন। বৌদ্ধ সংঘের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অনাথপিন্ডক আজীবন দান করলেও জীবনের শেষ দিকে তিনি নিঃস্ব হয়ে যান।
বুদ্ধের চল্লিশ বছর বয়সে, জেতবনে কোশল নরেশ পসেনদি প্রথমবার বুদ্ধের দর্শন করেন। বুদ্ধ দর্শনে পসেনদি অভিভূত হয়ে যান এবং তিনিও একজন অনুগামী ও পৃষ্ঠপোষক হলেন। পসেনদি ও বুদ্ধের মধ্যে সম্পর্ক ছিল খুবই আন্তরিক শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ। অধ্যয়নের বিষয়ে কোশল নরেশ একজন বিচক্ষণ পৃষ্ঠপোষক হলেও তিনি নানা বিষয়ে আসক্ত এমনকি নিষ্ঠুরও ছিলেন। তিনি সন্দেহবশে, মল্লবংশীয় বন্ধু তথা সেনাপতি বন্ধুলাকে হত্যা করেন। তারপর অনুতপ্ত হয়ে বন্ধুলার ভাগ্নে করয়নকে সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত করেন। এর বহু বছর পর মামাকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে করয়ন পসেনদিকে সিংহাসনচ্যুত করেন। রাজার দুর্দশা ও ভাগ্য বিপর্যয়েও বুদ্ধ চুপ ছিলেন, কারণ তাঁর ভিক্ষু সংঘের জন্য চোর-ডাকাত এবং বন্য জীবজন্তুর হাত থেকে নিরাপত্তার সঙ্গে ধনাঢ্য ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতারও প্রয়োজন ছিল।
রাজবংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে রাজা পসেনদি একটি পুত্র সন্তান চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর প্রথম স্ত্রী মগধ রাজ বিম্বিসারের বোন ছিলেন নিঃসন্তান। তারপর রাজা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। যিনি ছিলেন নীচু জাতির বৌদ্ধানুগামী মল্লিকা। রাজার ব্রাহ্মণ মন্ত্রীগণ নীচু জাতির কারণে তাকে গালমন্দ করত। মল্লিকা রাজা পসেনদিকে একটি কন্যা জন্ম দিলেন, তার নাম রাখা হল বজিরি (বজ্রী)।
রাজা ভাবলেন পুত্র সন্তান পেতে হলে তাকে তৃতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে হবে। তাই তিনি বুদ্ধের খুড়তুতো ভাই মহানামের কন্যা বাসভাকে বিবাহ করলেন। মহানাম বুদ্ধের পিতার মৃত্যুর পর শাক্যদের শাসক হয়েছিলেন। বুদ্ধের একান্ত অনুগত শিষ্য আনন্দ ও অনুরুদ্ধের ভাই ছিলেন মহানাম। মহানাম বাসভাকে সম্ভ্রান্ত নারীর মতো লালন-পালন করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন মহানামের ঔরসজাত একজন কৃতদাসীর কন্যা। তিনি একটি পুত্রের জন্ম দিলেন নাম তার বিদদভ। বিদদভ কোশল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হলেও তার মায়ের বংশ পরিচয়ের জন্য সেটা সহজ ছিল না। বাসভার সঙ্গে বুদ্ধের আত্মীয়তা থাকার বিষয়টি বুদ্ধকেও স্বস্তি দিল না।
তার অযোগ্যতা সম্বন্ধে অজ্ঞাত বিদদভ প্রথমবার মাতামহ মহানামকে দেখতে শাক্য রাজ্যে গেলেন। তখন তার বয়স ছিল ষোল। সেই সময় পসেনদির সেনাপতি করয়ন বিদদভের মায়ের আসল পরিচয় জানতে পারলেন। সেনাপতি রাজাকে খবর দিল যে তার পুত্র একজন কৃতদাসী মহিলার পৌত্র। রাজা তৎক্ষণাৎ শাক্যদের উপর ক্ষিপ্ত হলেন এবং তিনি স্ত্রী ও পুত্রের রাজকীয় সম্মান কেড়ে নিয়ে দাস হিসাবে বিক্রয় ক’রে দিলেন। তখন শেষ পর্যন্ত বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করায় রাজা তাদের পুনঃবহাল করেন।
এরপর কোশলে বুদ্ধের অবস্থান কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় তিনি দীর্ঘদিন পর মগধের রাজধানী রাজগহেতে এলেন, তখন তাঁর বয়স প্রায় সত্তর বছর। সেখানে তিনি রাজপ্রদত্ত বেনুবনে না থেকে তাজ বৈদ্য জীবকের আম্রকাননে বসবাস করতে লাগলেন। হয়তো তিনি তখন অসুস্থ ছিলেন বিষয়টি সেরকমই ইঙ্গিত দেয়।
বুদ্ধের বয়স যখন ৭২ বছর, তখন তাঁর প্রথম পৃষ্ঠপোষক মগধের রাজা বিম্বিসারকে পুত্র অজাতশত্রু সিংহাসনচ্যুত করলেন। অজাতশত্রু পিতা বিম্বিসারকে কারাগারে বন্দী ক’রে অনাহারে রেখে হত্যা করলেন। বিম্বিসারের পত্নী রাজা পসেনদির বোন দেবী শোকে দেহত্যাগ করলেন। তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজা পসেনদি ভাগ্নে অজাতশত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। বারাণসীর নিকটিবর্তী যে গ্রামগুলি রাজা বিম্বিসারকে যৌতুক দেওয়া হয়েছিল সেটা তিনি ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। যুদ্ধে কোন ফয়সালা হল না, বরং শান্তি রক্ষায় পসেনদি নিজ কন্যা বজিরির সঙ্গে অজাতশত্রুর বিয়ে দিতে বাধ্য হলেন।
সেই সময় দেবদত্ত, যিনি অজাতশত্রুর গুরু হয়েছিলেন, তিনি বুদ্ধের ভিক্ষুসংঘ দখল করতে সচেষ্ট হলেন। দেবদত্ত বুদ্ধের ভিক্ষু সংঘের পালনীয় বিনয় নিয়মাবলীতে আরও কিছু নিয়ম যুক্ত করার জন্য বুদ্ধকে বোঝাতে লাগলেন, যেমন- বনে বসবাস করা, একমাত্র বৃক্ষতলে শয়ন করা, সাধারণ মানুষের গৃহে প্রবেশ নিষেধ, শুধুমাত্র বল্কল ধারণ, কাপড় গ্রহণ না করা, বিশুদ্ধ নিরামিষ আহার গ্রহণ করা ইত্যাদি। বুদ্ধ সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বুঝলেন এতে ভিক্ষু সংঘ সাধনাতেই বেশী মগ্ন থাকবেন এবং সমাজের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। দেবদত্ত বুদ্ধের কতৃত্বকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ঠেলে দিয়ে অনেক তরুণ ভিক্ষুকে নিজের দলে টেনে আনতে সক্ষম হলেন এবং নিজেই পৃথক ভিক্ষু সংঘ সৃষ্টি করেন। প্রকৃতপক্ষে দেবদত্ত বুদ্ধকে হত্যা করার জন্য বহুবার চেষ্টা করলেও সফল হননি। তবে শেষ পর্যন্ত সারিপুত্ত এবং মোগ্গল্লনা বুদ্ধের শিষ্যদের ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তবে মনে হয় দেবদত্ত তার কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন, তবে বুদ্ধের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করার আগেই তিনি দেহত্যাগ করেন। যাইহোক না কেন তার প্রতি বুদ্ধের কোন বিরাগ বা বিদ্বেষ ছিল না। রাজা অজাতশত্রুও বুদ্ধের নিকট পিতাকে হত্যা করার জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছিলেন। এতে অবশ্য রাজবৈদ্য জীবকের উপদেশও ছিল। এর বছর খানেক পর বুদ্ধ আর একবার মাতৃভূমি শাক্য দর্শনে গেলেন। ইতিমধ্যে রাজা পসেনদি বুদ্ধকে দর্শন ও শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে গেলে সেনাপতি করয়ন বিদ্রোহ ক’রে রাজকুমার বিদদভ-কে কোশলের সিংহাসনে বসিয়ে দিল। পসেনদির ফেরার জায়গা রইল না এবং তিনি পালিয়ে মগধ এসে অজাতশত্তুর কাছে চাইলেন নিরাপত্তা, অজাতশত্তু (অজাতশত্রু) তাকে রাজগহে নগরে প্রবেশ করতে দিলেন না এবং পরদিন রাজা পসেনদিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল।
এদিকে নতুন কোশল রাজ বিদদভ তার জন্মবৃত্তান্ত মাতামহ মহানাম গোপন করার জন্য প্রতিশোধ নিতে শাক্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। মহানাম বুদ্ধের খুড়তুতো ভাই এবং তখন শাক্যদের শাসক ছিলেন। বুদ্ধ তিনবার রাজাকে বুঝিয়ে যুদ্ধ থামালেও অবশেষে ব্যর্থ হলেন। শাক্য রাজধানী কপিলাবতথুর সকল অধিবাসীদের হত্যা করার জন্য কোশল সেনাবাহিনীকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং তাই ঘটল। এই গণ-হত্যা রুখতে ব্যর্থ হয়ে বুদ্ধ মগধে এসে রাজা অজাতশত্রুর শরণে এলেন। রাজা পসেনদিও তার সামনে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
মগধে যাওয়ার পথে বজ্জি গণরাজ্য হয়ে যেতো। সেখানে রাজধানী বৈশালীতে বুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিষ্য সারিপুত্ত তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেখানে বুদ্ধের পুর্বতন সেবক সুনক্কত্ত (সুনক্ষত্র) ছিলেন। তিনি চীবর ত্যাগ ক’রে তখন বৈশালীর একজন মান্য ব্যক্তি ছিলেন এবং বৈশালীর সংসদে তিনি বুদ্ধের নিন্দা ক’রে বললেন যে বুদ্ধ কোন অলৌকিক শক্তির অধিকারী নন। এমনকি তিনি সর্বজ্ঞতা প্রাপ্তির জন্য কোন উপায়ও দেখাতে অসমর্থ। বুদ্ধ শুধু যুক্তি দিয়ে লোভ ইত্যাদি দমনের পরামর্শ দিতে পারেন। তখন বুদ্ধ সেটাকেই প্রশংসা হিসাবে গ্রহণ করলেন।
যাইহোক এই কুৎসা এবং সম্ভবতঃ ভিক্ষুণী সংঘ স্থাপনের কারণে বজ্জি গণরাজ্যে বুদ্ধ কিছুটা সম্মান ও পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ, বুদ্ধ গঙ্গা অতিক্রম ক’রে রাজগহেতে এসে গিজঝকুট (গৃদ্ধকূট) পর্বতের একটি গুহায় বাস করতে থাকেন।
রাজা অজাতশত্তুর প্রধানমন্ত্রী বস্সাকারা বুদ্ধকে দর্শন করতে এলেন। তিনি রাজা অজাতশত্তুর রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা এবং বজ্জি গণরাজ্য আক্রমণের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। তবে বুদ্ধ তাকে বলেন যে বজ্জিদের সামরিক শক্তিতে পরাস্ত করা যাবে না। ওরা তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে সম্মান ক’রে আঁকড়ে থাকবে। কোশলদের শাক্য আক্রমণ যেমন থামাতে পারেনি এবারেও যুদ্ধ থামাতে অসমর্থ হলেন। এইসময় বুদ্ধের ধর্ম সেনাপতিদ্বয় সারিপুত্ত এবং মোগ্গল্লনাকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ডাকাতরা প্রহার ক’রে হত্যা করল।
মগধে কোনরকম সহানুভূতি এবং সমর্থন না পেয়ে বুদ্ধ পুনরায় উত্তরে যাত্রা করতে করতে মনঃস্থির করলেন। সম্ভবতঃ নিজভূমি শাক্যতে গিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন কোশল আক্রমণের পর কিছু অবশিষ্ট রয়েছে কি না। বেরিয়ে পড়ার আগে বুদ্ধ আনন্দকে বলেন তিনি যেন সকল ভিক্ষুদের গৃধকূট পর্বতশীর্ষে জমায়েত হতে বলেন। তিনি সেখানে ভিক্ষুদের অন্তিম উপদেশ দেবেন। তিনি সেখানে বজ্জিদের গণতান্ত্রিক সংসদের অনুকরণে ভিক্ষুসংঘ সৃষ্টির জন্য নির্দেশ দিলেন। ওরা যেন নিয়মিত সভা করেন, ঐক্যবদ্ধ ও সৌভাতৃত্বের সঙ্গে বাস করেন, ভিক্ষা ভাগ ক’রে নেন এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করেন।
অতঃপর বুদ্ধ গৃধকূট পর্বত এবং মগধ ত্যাগ ক’রে বজ্জি গণরাজ্যের বৈশালীতে উপস্থিত হয়ে বর্ষাবাসের জন্য অবস্থান করলেন। তিনি দেখলেন যুদ্ধের আবহে সেখানে বৌদ্ধ সমাজের অধঃপতন হয়েছে। বজ্জি সংসদের সমর্থন ও সাহায্য না পেয়ে বুদ্ধ একা বর্ষাবাস করলেন এবং অনুগামীদের উপদেশ দিলেন ওরা যেন বন্ধুবান্ধব এবং উপাসকদের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
এই বর্ষাবাস কালে বুদ্ধের বয়স তখন আশি এবং তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে মরণাপন্ন হলেন। আনন্দ তাঁকে নিবেদন করলেন- আপনি আমাদের অন্তিম উপদেশ দান করুন। বুদ্ধ তাদের বলেছিলেন যে- তিনি যা জানেন তা সবই বলা হয়েছে এবং তার উপদেশই হবে তাদের শরণ এবং পথ প্রদর্শক। দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে হলে এই উপদেশগুলিকে জীবনে স্বার্থক করে তুলতেই হবে এবং তাদের রক্ষা করার জন্য অপর নেতা বা সম্প্রদায়ের প্রয়োজন হবে না। তখন বুদ্ধ তাঁর আসন্ন মৃত্যুর কথা ঘোষনা করলেন।
বর্ষা শেষে শিষ্য আনন্দ ও অনুরুদধকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধ বেরিয়ে পড়লেন। শাক্য যাওয়ার পথে মল্লদের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পাবাতে তিনি থামলেন সেখানে চুন্দ নামক একজন লৌহ কর্মকার তাদের বিষাক্ত শুকরের মাংস পরিবেশন করল। তিনি বুঝতে পেরে শিষ্য তথা ভাইদের বললেন- তোমরা এসব খেয়ো না। আমি আহার করার পর অবশিষ্ট অংশ মাটিতে পুতে দিও। মল্ল ছিল সেনাপতি করয়নের বাসভূমি, যিনি শাক্যদের গণহত্যা করিয়েছিলেন। সম্ভবতঃ ওই বিষাক্ত খাবারের লক্ষ ছিল আনন্দ, যিনি ছিলেন বুদ্ধের সমস্ত উপদেশের ধারক। আনন্দ নিহত হলে বুদ্ধের সকল উপদেশ হারিয়ে যেত আর সংঘের কোন অস্তিত্বও থাকত না।
রক্ত আমাশয়ে বুদ্ধ গুরুতর অসুস্থ, তখন তিনি আনন্দকে বলেন তাকে কুশিনারাতে নিয়ে যাবার জন্য। সেখানে দুটি শাল গাছের মধ্যবর্তী স্থানে শায়িত হয়ে যে কয়জন অনুগামী তখনও তাঁর সঙ্গে ছিল তাদের কোন প্রশ্ন বা সংশয় রয়েছে কী না জিজ্ঞাসা করলেন, শোকাতুর আনন্দ এবং অপর ভিক্ষুগণ নীরব রইলেন। তারপর বুদ্ধ খ্রীষ্টপূর্ব ৪৮৫ অব্দে ৮০ বছর বয়সে মহাপরিনির্বাণ লাভ করলেন।
বুদ্ধের নশ্বর দেহের অন্তিম সংস্কারের কিছু আগে একদল ভিক্ষু পাবা থেকে এসে উপস্থিত হল। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মগধের মহাকাশ্যপ। তিনি পূর্বে ব্রাহ্মণ ছিলেন, তিনি পৌঢ় বয়সে ভিক্ষু হন এবং বুদ্ধ তাকে নিদের জীর্ণ উত্তরীয় দান করেছিলেন এবং মহাকাশ্যপের নতুন উত্তরীয় গ্রহণ করেছিলেন। এই ঘটনা কুলপতি হিসাবে কর্তৃত্ব হস্তান্তরের প্রতীক হিসাবে বৌদ্ধধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেছে। মহাকাশ্যপ এসে অন্তিম সংস্কার পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন, যাতে ওরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারেন।
যাইহোক, বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের বহুবার বিভিন্ন উপলক্ষ্যে পরিষ্কার ভাবে বলেছেন যে তাঁর পরিনির্বাণের পর ধর্মই তাদের গুরু হবে। তিনি চেয়েছিলেন বজ্জিদের সংসদের মতো ভিক্ষু সংঘ সেরকম আদর্শে এগিয়ে চলবে। কোন একজন ভিক্ষু সংঘের প্রধান হবেন বা কোশল ও মগধের রাজাদের মতো সংঘ পরিচালনা করতে, তেমনটি তিনি চাননি।
যাইহোক না কেন, বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর ভিক্ষু আনন্দ ও মহাকাশ্যপের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিল। অন্য কথায় বলতে গেলে সেটা ছিল প্রাচীন ভারতীয় একনায়কতন্ত্রী কতৃত্বের মতো গুরু-শিষ্য পরম্পরার সঙ্গে ভিক্ষু সন্ন্যাসীদের একটি ছোট্ট গোষ্ঠী যেখানে ছিল গণতান্ত্রিক এবং বহুতর উদারবাদীদের নীতি ও আদর্শের লড়াই। মহাকাশ্যপ জয়ী হলেন।
বুদ্ধের অন্তিম সংস্কার ও অস্থিধাতু সমূহ বিতরণের পর ভিক্ষুরা মহাকাশ্যপের প্রস্তাব মতো পরবর্তী বর্ষাবাসের সময় রাজগহেতে একটি সভার আয়োজন করতে সম্মত হল। তাতে বুদ্ধের উপদেশগুলির সংগ্রহ, লিপিবদ্ধ করণ এবং যাচাই করা ছিল ওই পরিষদীয় সভার উদ্দেশ্য। বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে কারা অংশ নিতে পারবে না সেটা মহাকাশ্যপ ঠিক করলেন । তিনি শুধুমাত্র অর্হৎদের আবাহন করলেন, ওঁরা সংখ্যায় ছিল ৪৯৯ জন। প্রথমে মহাকাশ্যপ আনন্দকে এই যুক্তিতে পরিষদের স্থান দিলেন না, কেননা তিনি তখনও অর্হত্ব অর্জন করেননি। বুদ্ধবানীর স্মৃতিধর হলেও মহাকাশ্যপ আনন্দকে বাদ দিলেন। এছাড়াও আনন্দ বুদ্ধ কথিত আদর্শ, যেখানে সংঘে কোন দলপতি থাকবে না এই মতের প্রবল সমর্থক ছিলেন। আনন্দকে অপছন্দ করার আরও একটি কারণ থাকতে পারে, সেটা হল আনন্দের আগ্রহতেই ভগবান বুদ্ধ ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব হয়তো রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরম্পরা উদ্ভূত মহাকাশ্যপের বিরাগের হেতু ছিল। তবে আনন্দের বহিষ্কারে অর্হৎগণ প্রতিবাদ করায় মহাকাশ্যপ তাকে পরিষদে আমন্ত্রণ জানাতে বাধ্য হন। থেরবাদী পরম্পরা মতে পরিষদের সভার পূর্বরাত্রিতে আনন্দ অর্হত্ব লাভ করেছিলেন।
পরিষদের সভার প্রতীক্ষার সময় আনন্দ অজাতশত্তুর প্রধানমন্ত্রী বস্সকার (বর্ষকার)-এর সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি তার কাছে জানতে পারলেন যে মগধ বাহিনী শুধু বজ্জিদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে না ওরা অবন্তির রাজা পজ্জোতার (প্রদ্যোত) সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যও প্রস্তুত হচ্ছে। এর রাজত্ব ছিল মগধের পশ্চিম সীমানায়। এইভাবে সংঘকে পিতৃতন্ত্রের মতো কেউ একজন নেতৃত্ব দেবে এটা বুদ্ধের ইচ্ছা ছিল না। তবুও মহাকাশ্যপের নেতৃত্ব নিঃসন্দেহে বুদ্ধবানীর স্থায়ীত্ব ও একটি অনিশ্চিত অশান্ত সময়ে ভিক্ষু সংঘের টিকে যাওয়ার পিছনে বিরাট অবদান রেখেছে।
রাজগহের সত্তিপন্নি গুহায় (সপ্তপর্ণী) প্রথম বৌদ্ধ পরিষদের সভায় ৫০০ জন অর্হত অংশ গ্রহণ করেছিলেন। মহাকাশ্যপের সভাপতিত্বে আনন্দ স্মৃতি থেকে অধিকাংশ বুদ্ধবাণী বা সূত্র বললেন, বিনয় পিটক শোনালেন উপালি। থেরবাদী পরম্পরা মতে এই পরিষদে বিশেষ বিষয়াদির অভিধম্ম বলা হয়নি। যদিও সর্বাস্তিবাদীদের মতে বৈভাষিকা তর্জমায় দেখা যায় যে অভিধর্মের কিছু সূত্র মহাকাশ্যপ আবৃত্তি করেছেন। কিন্তু সৌত্রান্তিকদের মতে এই অভিধম্ম সূত্রগুলি বুদ্ধের বাণী নয় এবং তা সাতজন অর্হৎ কর্তৃক রচিত।
তিব্বতী পরম্পরা মতে মহাকাশ্যপ থেকে সাতজন কুলপতির একটি বংশ শুরু হয়েছে। চিনের চান পরম্পরা, তা থেকে কোরিয় পুত্র এবং জাপানী জেন পরম্পরা হয়ে ভারতে ২৮ জন কূলপতির খোঁজ পাওয়া যায় এবং বোধিধর্ম হলেন ২৮ তম। ভারতীয় আচার্য বোধিধর্ম চীনে চান উপদেশাবলী নিয়ে যান। পূর্ব এশিয়ায় চান পরম্পরায় তিনি হলেন প্রথম কুলপতি।
সারাংশে, থেরবাদী পরম্পরার পালি সাহিত্য বুদ্ধকে একজন অনন্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী একজন ধর্মগুরু রূপে যেমন দেখিয়েছে; ঠিক তেমনই কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্রমবর্ধমান ভিক্ষু সংঘকে তিনি সুরক্ষা দিতে লড়াই করেছেন একজন দুঃখী যোদ্ধার মতো, তাও দেখিয়েছে। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, বহুযুদ্ধ, তাঁর বংশের গণহত্যা, সরকারের সামনে তাঁর ব্যক্তিগত কুৎসা, শিষ্যদের মধ্যেই তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন, প্রিয় শিষ্যের হত্যা এবং অবশেষে বিষ প্রয়োগে মৃত্যু এ সবকিছুই তিনি মোকাবিলা করেছেন। এত কিছুতেও বুদ্ধ মনের প্রশান্তি হারাননি এবং নিরুৎসাহ হননি। বুদ্ধত্বলাভের পরবর্তী ছেচল্লিশ (৪৬) বছর ধরে তিনি পৃথিবীকে দুঃখ থেকে মুক্তি এবং নির্বাণের পথ দেখাতে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি নিয়ে অবিচল অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।
বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন রামকৃষ্ণ দাস, সম্পাদন করেছেন সঞ্জীব কুমার দাস, প্রুফ রিডিং করেছেন সম্পা দাস এবং টাইপিং করেছেন দেবজিৎ চ্যাটার্জী।