থেরবাদ দীক্ষা পরম্পরার ইতিহাস

বৌদ্ধধর্ম সর্বপ্রথম শ্রীলঙ্কায় পৌঁছেছিল ভারতীয় সম্রাট অশোকের পুত্র মহিন্দা (মহেন্দ্র)-এর মিশনের মাধ্যমে ২৪৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। ঐ সময় প্রথম শ্রীলঙ্কার ভিক্ষুরা দীক্ষিত হয়েছিলেন। যদিও থেরবাদ নামটা কোন্‌ তারিখ থেকে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে সরলতার উদ্দেশ্যে আমরা এই বৌদ্ধ পরম্পরাকে থেরবাদ বলে উল্লেখ করতে পারি। তারপর খ্রীষ্টপূর্ব ২৪০ সালে এই দ্বীপে সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রার আবির্ভাবের সাথে শ্রীলঙ্কায় থেরবাদ ভিক্ষুণী দীক্ষা পরম্পরা হস্তান্তরণ করা হয়েছিল। ১০৫০ সালে এই দীক্ষা পরম্পরা তামিল আক্রমণ এবং পরবর্তী চোল সাম্রাজ্যের অধীনে শ্রীলঙ্কার শাসনের কারণে সমাপ্ত হয়ে যায়।

মৌখিক পরম্পরা অনুযায়ী সম্রাট অশোক সোন এবং উত্তর নামক আরও দুজন দূত পাঠিয়েছিলেন সুবন্নফুমে (সং. সুবর্ণভূমি) রাজ্যে এবং তারা সেখানে বৌদ্ধধর্ম এবং ভিক্ষুদীক্ষা পরম্পরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অধিকাংশ বিদ্বানমন্ডলী মোন (তাইলাইং) জনজাতি এবং দক্ষিণ বর্মায় অবস্থিত থাটন নামক বন্দর নগরীর অভ্যুত্থানের সাথে এই রাজ্যকে সনাক্ত করেন। তবে এটা স্পষ্ট নয় যে ভিক্ষুণী দীক্ষা পরম্পরা এই সময় থেকে অথবা পরবর্তীতে প্রেষিত হয়েছিল।

যদিও থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম উত্তর বার্মার বিভিন্ন পিউ শহর রাজ্যে অন্ততঃ খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে বিদ্যমান ছিল, তবে সেটা মহাযান, হিন্দুধর্ম এবং স্থানীয় আরি ধর্মের সাথে মিশে গিয়েছিল, যা ভূত-প্রেতদের জন্য পশুবলীতে যুক্ত ছিল। খ্রীষ্টিয় একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রাজা অনাওয়ারাতা উত্তর বার্মাকে একীভূত করেন, থাটনে মোন রাজ্যের উপর জয়লাভ করেন, প্যাগানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন এবং মোন ভিক্ষু অরহন্তকে তাঁর রাজ্য জুড়ে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম এবং তাঁর দীক্ষা পরম্পরা প্রতিষ্ঠার জন্য আমন্ত্রণ করেন।

১০৭০ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীলঙ্কায় চোলদের পরাজয়ের সাথে এবং পোলোনারুয়াতে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে প্যাগান থেকে আমন্ত্রিত ভিক্ষুদের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় থেরবাদ ভিক্ষু দীক্ষা পরম্পরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্যই রাজা অনাওয়ারাতা মোন ভিক্ষুণী পরম্পরার বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং ফলস্বরূপ, তিনি ভিক্ষুণী পাঠাননি। এই কারণে ঐসময় শ্রীলঙ্কায় ভিক্ষুণীদের থেরবাদ দীক্ষা পরম্পরা পুনর্জীবিত হয়নি। বর্মায় ভিক্ষুণী মঠের অভ্যুত্থানের শেষ শিলালিপির প্রমাণ হল সন্‌ ১২৮৭ খ্রীষ্টাব্দ যখন প্যাগান মঙ্গোল আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিল। সন্‌ ১২১৫ থেকে ১২৩৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কলিঙ্গের (আধুনিক উড়িষ্যা, পূর্বভারত) রাজা মাঘ দ্বারা শ্রীলঙ্কার উপর আক্রমণ করা হয়েছিল এবং এর অধিকাংশ অংশের উপর শাসন করেছিলেন। ঐ সময় শ্রীলঙ্কার ভিক্ষুসংঘ মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। রাজা মাঘের পরাজয়ের সাথে সাথে কাঞ্চীপুরম থেকে থেরবাদ ভিক্ষুদের, দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত বর্তমান তামিলনাড়ুর দুর্বল চোল রাজ্যের একটা বৌদ্ধ কেন্দ্র, ভিক্ষু সংঘের পরম্পরাকে পুনর্জীবিত করার জন্য ১২৩৬ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীলঙ্কায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে কোন তামিল ভিক্ষুণীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এবং সেটা এই তথ্য থেকে বোঝা যায় যে ঐ সময় থেরবাদ ভিক্ষুণী সংঘ দক্ষিণ ভারতে উপস্থিত ছিল না। বাংলা সহ উত্তর ভারতে ভিক্ষুণী সংঘের শেষ শাস্ত্রীয় প্রমাণ হল খ্রীষ্টিয় ১২ শতাব্দীর শেষের দিক। ভিক্ষুণী সংবর (ব্রত) কোন পরম্পরার ভিক্ষুণীরা পালন করতেন সেটা স্পষ্ট নয়।

থাইল্যান্ডের সুখোথাই রাজ্যের রাজা রামখামহেং খ্রীষ্টিয় ১৩ শতাব্দীর শেষের দিকে শ্রীলঙ্কা থেকে থাইল্যান্ডে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু, সেই সময় শ্রীলঙ্কায় কোন ভিক্ষুণী সংঘ উপলব্ধ ছিল না তাই থেরবাদ ভিক্ষুণী সংঘ থাইল্যান্ডে পৌঁছায়নি। সেখানে কেবল ভিক্ষু পরম্পরার আগমন ঘটেছে। যেহেতু চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে থাইল্যান্ড থেকে কম্বোডিয়ায় থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তার কিছু সময় পরে কম্বোডিয়া থেকে লাউসে পৌঁছায়, তাই থেরবাদ ভিক্ষুণী দীক্ষা পরম্পরা এই দেশগুলিতে পৌঁছায়নি।

থেরবাদ দেশগুলির মধ্যে কেবল শ্রীলঙ্কা আনুষ্ঠানিকভাবে থেরবাদ দীক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে এবং এর সময়টা ছিল ১৯৯৮ সাল। ততদিন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় স্ত্রীদের শুধুমাত্র দশশীল মাতা “দশ-শিক্ষা অনুশীলনকারী” হওয়ার অনুমতি ছিল, ভিক্ষুণী হওয়ার জন্য নয়। যদিও এই ধরণের গৃহস্থ স্ত্রীরা চীবর ধারণ করেন এবং ব্রহ্মচর্য পালন করেন কিন্তু তারা ভিক্ষুণী সংঘের সদস্য হিসাবে বিবেচিত হয় না। বর্মা এবং কম্বোডিয়ায় স্ত্রীদের শুধুমাত্র “অষ্ট-শিক্ষা অনুশীলনকারী” হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, যারা বর্মায় “শীলাসিন” এবং কম্বোডিয়ায় ‘দোনচি’ অথবা ‘ইয়াচি’ নামে পরিচিত ছিল। বর্মায় কিছু-কিছু স্ত্রীরা দশটি শিক্ষাও গ্রহণ করেন। থাইল্যান্ডে তারা অষ্ট-শিক্ষা অনুশীলনকারী হয়ে উঠতে পারেনি যা ‘মায়েচি (মাইজি)’ নামে পরিচিত। সন্‌ ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে উপকূলীয় বর্মার আরাকান জেলা থেকে চট্টগ্রাম জেলা এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের পুনর্জীবিত হওয়ার পর থেকে সেখানে স্ত্রীরা ‘অষ্ট-শিক্ষা অনুশীলনকারী’ হয়ে উঠেছে।

Top