পরম পূজ্য দালাই লামার জীবনে সম্ভাব্য বিপদ
সেরকোঙ্ রিনপোছের মৃত্যু তাঁর জীবনের চেয়েও আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে স্পিতিতে অবস্থিত তাবো মঠে, রিনপোছে পরম পূজ্য দালাই লামা দ্বারা কালচক্র অভিষেক প্রদানের আয়োজন করেছিলেন। এরপরে রিনপোছে কাছেন ড্রুবগ্যাল নামক একজন স্থানীয় বৃদ্ধ ভিক্ষুকে বলেছিলেন যে, তিব্বতী জ্যোতিষবিদ্যা অনুযায়ী এটা পরম পূজ্যর বিঘ্ন-বছর ছিল। পরম পূজ্যর জীবন বিপদে ছিল। এই বিঘ্নগুলি নিজের মধ্যে স্থানান্তর করলে ভাল হবে। তিনি বৃদ্ধ ভিক্ষুকে এই বিষয়ে কাউকে বলতে নিষেধ করেছিলেন।
এরপরে রিনপোছে তিন সপ্তাহের জন্য কঠোর ঐকান্তিক ধ্যানে প্রবেশ করেছিলেন। তারপর তিনি নিকটস্থ একটি সেনা শিবিরে সৈন্যদের বোধিচর্যাবতারের উপর উপদেশ দিতে গিয়েছিলেন। রিনপোছের বর্ধিত সময়ের মধ্যে পুরো গ্রন্থটি ধীরে-ধীরে অধ্যাপনা করার কথা ছিল, কিন্তু তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন। পরিকল্পিত সময়ের চেয়ে বেশ কিছু দিন আগে তিনি শিবির ছেড়ে চলে গিয়ে বলেছিলেন যে, তাঁর কোথাও যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন আছে। দিনটি ছিল ১৯৮৩ সালের ২৯শে আগষ্ট, পরম পূজ্য দালাই লামা সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থার অধ্যক্ষ ইয়াসার আরাফাতেরও সেখানে পৌঁছনোর সম্ভাবনা ছিল। পুলিশ কর্তৃপক্ষ আরাফাতের বিরুদ্ধে পরিচালিত সন্ত্রাসবাদের একটি সম্ভাব্য ঘটনা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিল। তারা সতর্ক করে দিয়েছিল যে, তারা পরম পূজ্যের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারবে না।
পরম পূজ্যের জীবনের বিঘ্নগুলি নিজের উপর নেওয়ার প্রস্তুতি
রিনপোছে এবং ঙাওয়াঙ্ একটা জিপগাড়িতে করে সেনা শিবির থেকে বেরিয়ে এসে তাবো মঠে অল্প সময়ের জন্য থামলেন। রিনপোছে কাছেন ড্রুবগ্যালকে তাদের সাথে যোগ দিতে বললেন। উত্তরে বৃদ্ধ ভিক্ষুটি বললেন যে, তিনি সবেমাত্র তার চীবর ধুয়েছেন। রিনপোছে বললেন তাতে কিছু আসে যায় না, সে তার অন্তরবাস বা পেটিকোট পরে গেলেও চলবে। রিনপোছে এও বললেন যে, সে তার চীবরগুলি শুকানোর জন্য জিপের উপরে বেঁধে রাখতে পারে। বৃদ্ধ ভিক্ষুটি তাই করেছিল। তাঁরা স্পিতি উপত্যকার গভীরে প্রবেশ করার সময় রিনপোছে ঙাওয়াঙ্কে বলেছিলেন যে, সে যেন সর্বদা করুণার মন্ত্র “ওঁ মণি পদ্মে হূঁ” জপ করতে থাকে। কিন্তু সে সেটাকে কখনও গুরুত্ব দিয়ে নেয়নি। এটা তাঁর বিচ্ছেদ উপদেশ ছিল।
তাঁরা তখন ক্যি মঠে থামেন। রিনপোছে সেখানে নৈবেদ্য অর্পণ করতে চেয়েছিলেন। ঙাওয়াঙ্ বলেছিল যে দেরী হয়ে গিয়েছে এবং তাঁরা সকালে যেতে পারে, কিন্তু রিনপোছে জিদ করেছিলেন। বেশিরভাগ সময় রিনপোছে আস্তে-আস্তে এবং কষ্ট সহকারে হাঁটাচলা করতেন। তবে উপলক্ষ্যে রিনপোছে দৌড়াতে যথেষ্ট সক্ষম ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, একবার একটা বিমানবন্দরে, যখন কোন বিমানের জন্য আমাদের প্রায় দেরী হয়ে যেত, তখন রিনপোছে এত দ্রুত বেগে ছুটে যেতেন, আমাদের মধ্যে কেউ তাঁর সমতালে চলতে পারতাম না। একই ভাবে, একবার বুদ্ধগয়াতে যখন পরম পূজ্য দালাই লামা তিব্বতী কংগ্যুরের (বুদ্ধবচন) একশত খন্ডের একটি গণ-পাঠে অংশগ্রহণ করছিলেন তখন রিনপোছে পরম পূজ্যর ডান দিকে বসেছিলেন এবং আমি তাঁর পিছনে। ইতিমধ্যে হাওয়া এসে পরম পূজ্যের আলগা পাতার গ্রন্থ থেকে একটা পৃষ্ঠা উড়িয়ে নিয়ে যায়। রিনপোছে তৎক্ষণাৎ মেঝে থেকে সেটাকে তুলে নেওয়ার জন্য তাঁর আসন থেকে কার্যত উড়ে এসেছিলেন। সাধারণতঃ উঠতে তাঁর সহায়তার প্রয়োজন হতো। কিন্তু ক্যি মঠের এই উপলক্ষ্যে রিনপোছেও খাড়া পাহাড়ের পথ ধরে দ্রুত, অসহযোগিতায় দৌড়ে গিয়েছিলেন।
রিনপোছে তাঁর নৈবেদ্য অর্পণ করার পর ক্যি মঠের ভিক্ষুরা তাঁকে রাতটুকু সেখানে কাটানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু রিনপোছে অস্বীকার করে বললেন যে, তাঁকে সেই রাত্রে ক্যিবার গ্রামে পৌঁছতে হবে। তারা যদি তাঁকে আবার দেখতে চায় তাহলে তাদের সেখানে যেতে হবে। তারপরে কী ঘটতে চলেছে সেই বিষয়ে পরোক্ষ বার্তাটি দিয়ে রিনপোছে শীঘ্রই চলে গেলেন।
রিনপোছে এবং তাঁর দল ক্যিবারের উঁচু গ্রামে পৌঁছনোর পর তারা তাঁর পরিচিত এক কৃষকের বাড়িতে গেলেন। লোকটি তখনও মাঠে ছিল এবং কোনও অতিথির প্রত্যাশা করেনি। রিনপোছে জিজ্ঞাসা করলেন পরের সপ্তাহে তিনি ব্যস্ত থাকবেন কিনা ইত্যাদি। কৃষকটি “না” বলে রিনপোছেকে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
ধ্যান অবস্থায় রিনপোছের মৃত্যু সন্ধ্যা
হাত-মুখ ধুয়ে এবং একটু দই গ্রহণ করে রিনপোছে তাঁর স্মৃতি থেকে চোংখাপা প্রণীত “নেয়ার্থনীতার্থবিভঙ্গশাস্ত্র-সুভাষিতসার” নামক গ্রন্থ পাঠ করেছিলেন, যার জন্য তাঁর দুই ঘন্টা সময় লেগেছিল। সেটা শেষ করার পর তিনি ঙাওয়াঙ্কে ডেকে বলেছিলেন যে তিনি ভাল বোধ করছেন না। তারপর তিনি তাঁর মাথা ঙাওয়াঙ্-এর কাঁধে রেখেছিলেন- এমন কিছু করছিলেন যা রিনপোছে সাধারণতঃ কখনও করেননি। অনুভূতিতে মনে হয়েছিল যে, তিনি বিদায় জানাচ্ছেন। এই সমস্ত কিছুর আগে তিনি ছোনজেলাকে শিমলা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কারণ ঘটনাক্রমে সাক্ষ্য দেওয়া নিঃসন্দেহে ছোনজেলার পক্ষে খুব কঠিন হয়ে উঠত। ছয় বছর বয়স থেকেই তিনি রিনপোছের সাথে ছিলেন এবং রিনপোছে তাকে তাঁর ছেলের মতো বড় করেছিলেন।
ঙাওয়াঙ্ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, তাঁকে ডাক্তার দেখানো উচিত বা ওষুধ খাওয়া উচিত কিন্তু রিনপোছে “না” বলে দিয়েছিলেন। ঙাওয়াঙ্ জিজ্ঞাসা করেছিল যে তার আর অন্য কিছু করার আছে কিনা। উত্তরে রিনপোছে তাকে শৌচালয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে বলেছিলেন। সেটাও সে করেছিল। এরপর রিনপোছে ঙাওয়াঙ্কে তাঁর বিছানা তৈরী করতে বলেছিলেন যা সে করেছিল। সব সময় শোয়ার জন্য সাধারণ হলুদ চাদর ব্যবহার করতেন কিন্তু এবার রিনপোছে ঙাওয়াঙ্কে তার পরিবর্তে সাদা চাদর পেতে দিতে বললেন। তান্ত্রিক সাধনায়, অপরের সহায়তা করতে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে ধর্মানুষ্ঠানের জন্য হলুদ রঙের বস্ত্র ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে বিঘ্ন প্রশমণ করার জন্য সাদা বস্ত্র।
রিনপোছে তখন ঙাওয়াঙ্ এবং কাছেন ড্রুবগ্যালকে তাঁর শয়ন কক্ষে আসতে অনুরোধ করলেন যা তারা করেছিল। তারপরে রিনপোছে ভগবান বুদ্ধের শয়ন-মুদ্রায় তাঁর ডানদিকে শুয়ে পড়লেন। সাধারণতঃ রিনপোছে শয়নে যাওয়ার সময় তাঁর হাতটি বামদিকের প্রমিত অবস্থানে রাখেন এবং ডান হাতটি মুখমন্ডলের নীচে, কিন্তু এবার রিনপোছে তার পরিবর্তে তান্ত্রিক আলিঙ্গন মুদ্রায় হাত দুটিকে আড়াআড়ি করেন দিলেন। তারপরে তিনি গভীর শ্বাস নিতে শুরু করলেন আর “দান ও গ্রহণ (তোং-লেন)” নামক ধ্যান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সহজভাবে দেহত্যাগ করলেন। তখন তার বয়স ছিল ৬৯ বছর এবং স্বাস্থ্য ছিল নিখুঁত। আমি তাঁকে দুমাস আগে দিল্লিতে একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা-সংক্রান্ত পরীক্ষার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম।
ঠিক সেই মূহুর্তে, পরম পূজ্য দালাই লামা যখন জেনেভা যাওয়ার পথে বিমানে ছিলেন, অধ্যক্ষ আরাফাত হঠাৎ তার মন পরিবর্তন করেছিলেন অর্থাৎ তিনি তার সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এইভাবে বিমানবন্দরে সন্ত্রাসবাদের একটা ঘটনার আশঙ্কা এড়ানো হয়েছিল। যদিও পরম পূজ্যের জীবনের বিপদ কেটে গিয়েছিল তবুও বিমানবন্দর থেকে হোটেল যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত মোটর ক্যাড হারিয়ে গিয়েছিল। তবে পরম পূজ্যের কোনরকম ক্ষতি হয়নি। সেরকোঙ্ রিনপোছে সফল ভাবে পরম পূজ্যের জীবনের বাধা-বিঘ্ন নিজের উপর নিয়েছিলেন এবং পরিবর্তে তাঁর জীবন-শক্তি দিয়েছিলেন।
বিঘ্ন গ্রহণের জন্য রিনপোছে দ্বারা ব্যবহৃত দান এবং গ্রহণ ধ্যান
অপরের কাছ থেকে বিঘ্ন গ্রহণ করা এবং তাদের সুখ প্রদান করার জন্য দান করা এবং গ্রহণ করা হ’ল- বোধিসত্ত্বদের একটি উন্নত কৌশল। রিনপোছে যখনই এই সাধনাটার উপর উপদেশ দিতেন, তিনি বলতেন যে, আমাদের অন্যের দুঃখ নিজের উপর নেওয়ার জন্য ইচ্ছুক হতে হবে, এর জন্য আমাদের আত্মত্যাগের বিষয়টিকেও যদি বোঝায়। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি সর্বদা উল্লেখ করতেন যে, খুনু লামা রিনপোছে তার নিজের জেলার একজন ব্যক্তিকে জীবন-শক্তি দান করেছিলেন। তার মাথায় আঘাত লেগেছিল এবং তাকে জীবনশক্তি দেওয়ার ফলে রিনপোছের মৃত্যু হয়। আমরা যখন রিনপোছেকে জিজ্ঞাসা করতাম, এই কাজটি করলে কি জীবনের অপচয় হবে না? রিনপোছে উত্তর দিতেন “না”। তিনি ব্যাখ্যা করে বলতেন, এটা একজন মহাকাশচারীর মতো হবে যে বিশ্বের অগ্রগতির জন্য নিজে জীবন উৎসর্গ করে দেয়। যেমন একজন বীর মহাকাশ্চারী তার দৃষ্টান্ত এবং খ্যাতি তার পরিবারকে যথেষ্ট সরকারী পেনশনের আশ্বাস দেয়, তেমনি গুরুর ত্যাগের বীরত্বপূর্ণ দৃষ্টান্তও তাঁর শিষ্যদের আধ্যাত্মিক পুষ্টি জোগায়।
তিন দিনের জন্য মৃত্যু-সন্ধিক্ষণ ধ্যানে অবস্থান
রিনপোছে তিন দিনের জন্য প্রভাস্বরী মৃত্যু-সন্ধিক্ষণ ধ্যানে অবস্থান করেছিলেন। যারা তাদের পুনর্জন্মকে নির্দেশ করার ক্ষমতা রাখেন তারা সাধারণত পুনর্জন্মিত গুরুদের বংশ-পরম্পরাকে তৈরী করা বা বজায় রাখার প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে এই ধ্যানটিতে প্রবেশ করেন। ধ্যান চলাকালীন তাদের হৃদয় উষ্ণ থাকে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও তাদের দেহগুলিতে পচন শুরু হয় না। সাধারণত মহান লামাগণ (গুরু) বেশ কয়েকদিন ধরে এই অবস্থায় থাকেন। তারপর তাঁদের মাথা অতিমন্দা হয়ে যায় এবং রক্ত নাসিকা ত্যাগ করে দেয় যা বোঝায় যে তাদের চেতনা তাঁদের দেহ ছেড়ে চলে গিয়েছে।
যখন এই লক্ষণগুলি সেরকোঙ্ রিনপোছের মধ্যে দেখা দিয়েছিল আকাশে রামধনু ঝলমলে হয়ে উঠেছিল এবং শবদাহের জন্য নির্বাচিত অনুর্বর পাহাড় চূড়ায় বিস্ময়কর আলো বিকিরণ হয়েছিল। যদিও লোকেরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার জন্য ধর্মশালায় অবস্থিত পরম পূজ্যের নামগ্যাল মঠের ভিক্ষুদের বার্তা পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু যথাসময়ে উক্ত ভিক্ষুদল সেখানে পৌঁছতে পারেনি। স্পিতির ভিক্ষুরা রিনপোছের ইচ্ছা মতো বিনয়ীভাবে অনুষ্ঠানটি সম্পাদন করেছিল। শীঘ্রই অন্ত্যেষ্টির স্থান নিরাময় ক্ষমতা সম্পন্ন একটা নতুন জলের ঝর্ণা উৎসারিত হয়েছিল। এটি এখনও সেখানে প্রবাহিত হয়ে চলেছে আর একটা তীর্থস্থলে পরিণত হয়েছে। ঠিক নয় মাস পর ১৯৮৪ সালের ২৯শে মে, রিনপোছে আবার স্পিতিতে এক বিনম্র পরিবারে পুনর্জন্ম নিয়েছিলেন।
তাঁর পুনর্জন্ম পরিচালনা
বেশ কয়েক বছর আগে, রিনপোছে ছেরিং ছোডাগ এবং কুনসং ছোডোন নামে এক স্বামী-স্ত্রীর সাথে দেখা করেছিলেন। তারা দুজনেই রিনপোছেকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিলেন। অত্যন্ত কঠোর ধর্ম-অনুশীলনকারী, তারা রিনপোছেকে বলেছিলেন যে, তাদের গভীর ইচ্ছা ছিল যে তারা ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণী হয়ে যাবে। কিন্তু গ্রামের প্রধান এর বিপরীতে অনুমোদন করেছিল, কারণ অল্প বয়সী পরিবারের সাথে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে ভিক্ষুত্ব জীবনে যোগদান করা অনেক সমস্যা দেখা দেবে। তাদের অবশ্যই প্রথমে তাদের সন্তানদের লালন-পালন করা উচিত। রিনপোছে গ্রাম প্রধানের পরামর্শকে সমর্থন করেছিলেন। এঁরাই হলেন সেই মা-বাবা যাদের চতুর্থ সন্তান রূপে রিনপোছে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
শিষ্যরা মৃত্যু-সন্ধি ধ্যানের উপর দক্ষতা অর্জনকারী একজন মহান লামার পুনর্জন্ম সনাক্ত করতে অনেক উপায় ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিগুলির মধ্যে পরামর্শমূলক দৈববাণী এবং সর্বাধিক উপলব্ধি করা মাস্টারদের স্বপ্ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তারপরে চূড়ান্ত প্রার্থীকে অনেক অনুরূপ প্রকরণের মধ্যে থেকে মৃত লামার বেশ কয়েকটি সম্পত্তি সঠিকভাবে সনাক্ত করতে হয়। তবে পরম পূজ্য দালাই লামা অবশ্য সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, শুধু ঐ ধরণের উপায়ের উপর যেন নির্ভর না হয়। গম্ভীর প্রার্থী হিসাবে বিবেচনা করার আগে ঐ সন্তানের পক্ষ থেকে আরও স্পষ্ট লক্ষণ প্রদর্শন করা প্রয়োজন।
রিনপোছের পুনর্জন্ম সনাক্তকরণ
স্পিতির মানুষ সেরকোং রিনপোছেকে একজন সাধু রূপে শ্রদ্ধা করে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই তাঁর ছবি থাকে। ছোট সেরকোঙ্ রিনপোছে যখন কথা বলতে লাগলেন তিনি তাদের বাড়ির দেওয়ালে লাগানো রিনপোছের ছবির দিকে আঙ্গুল দিয়ে তাঁর বাবা-মাকে বললেন, “এটাই আমি!” পরে যখন ঙাওয়াঙ্ বাচ্চাটিকে পরীক্ষা করার জন্য ঐ বাড়িতে গিয়েছিল, ছেলেটি তৎক্ষণাৎ তার কোলে ছুটে এসেছিল। তিনি তার সাথে তাঁর মঠে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন।
তিনি কে সে সম্পর্কে কারও সন্দেহ ছিল না। সর্বোপরি, কয়েক বছর আগে স্পিতির একদল বিশিষ্ট মহিলা পরের বার তাদের উপত্যকায় জন্ম নেওয়ার জন্য রিনপোছেকে অনুরোধ করেছিলেন। ভারত সরকারের কাছ থেকে তাদের প্রত্যন্ত সীমান্ত জেলা পরিদর্শন করার অনুমতি নেওয়া বরাবরই একটা সমস্যা ছিল। তবে এই ধরণের পুনর্জন্ম সবকিছুকে সহজ করে তুলত। তাঁর বাবা-মা গভীরভাবে সম্মানিত হয়ে তাদের সম্মতি দিয়েছিলেন। তারপরে চার বছরের ছোট্ট রিনপোছে ধর্মশালায় চলে যান। যদিও তাঁর বাবা-মা সময়ে-সময়ে দেখা করে, কিন্তু ছেলেটা কখনও তাদের জন্য জিজ্ঞাসা করেনি অথবা এমনকি তাদের অভাবও বোধ করেনি। শুরু থেকে তিনি তাঁর পুরনো বাড়ির সদস্যদের সাথে পুরোপুরি নিজের বাড়ির মতো অনুভব করেছিলেন।
তরুণ পুনর্জন্ম আমাদের প্রথম সাক্ষাতে আমাকে চিনতে পারা
রিনপোছে যখন প্রথম ধর্মশালায় পৌঁছেছিলেন তখন আমি একটা বক্তৃতা-ভ্রমণের জন্য বাইরে ছিলাম। কয়েক মাস পরে আমার ফিরে আসার পর, আমি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। ঐ সময় অধিক প্রত্যাশিত বা অতিরিক্ত অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটেনি। আমি যখনই রিনপোছের ঘরে ঢুকলাম, ঙাওয়াঙ্ ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, আমি কে সেটা তিনি জানেন কিনা। ছেলেটা উত্তর দিল, “বোকার মতো কোরো না। অবশ্যই আমি জানি তিনি কে!” যেহেতু পুরনো সেরকোঙ্ রিনপোছে এবং পরম পূজ্য পোপের মধ্যে ভ্যাটিকানে বৈঠকের জন্য আমার অনুবাদ করা কালীন একটা ছবি তাঁর বসার ঘরের দেওয়ালে বিশেষভাবে টানানো ছিল, আমি ভেবেছিলাম তিনি আমাকে সেখান থেকে চিনে ফেলেছিলেন।
তবুও আমাদের সাক্ষাৎ হওয়ার মুহুর্ত থেকে ছোট্ট রিনপোছে তাঁর পরিবারের সদস্যের মতো আমার সাথে সম্পূর্ণ পরিচিত এবং স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে আচরণ করছিলেন। একটা চার বছরের বাচ্চা নিশ্চয়ই এরকম কিছু নকল করতে পারে না। এটা যেকোনো কিছুর চেয়েও বেশী, সে কে সেটা আমাকে বোঝায়।
১৯৯৮ সালে চোদ্দ বছর বয়সী রিনপোছে
এখন ১৯৯৮ সালে, নতুন সেরকোঙ্ রিনপোছের বয়স চোদ্দ বছর হয়েছে। তিনি বেশীরভাগ সময় মুন্ডগোড অবস্থিত তাঁর মঠে থাকেন এবং অধ্যয়ন করেন আর বছরে একবার বা দুবার ধর্মশালায় আসেন, যখন পরম পূজ্য প্রমুখ শিক্ষা প্রদান করেন। ছোনজেলা এবং রিনপোছের পুরনো রাঁধুনী মারা গিয়েছে আর ঙাওয়াঙ্ ভিক্ষুত্ব ত্যাগ করে বিবাহ করেছে। এখন সে নেপালে বসবাস করছে। রিনপোছের দেখাশোনা করার জন্য তাঁর ভিক্ষুদের একটা নতুন পরিবার রয়েছে। তাদের প্রত্যেককেই তিনি তাঁর পূর্বজন্মে সযত্নে বাছাই করেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, তাঁর পরিবারে যোগ দিতে এবং জীবনের শেষ কয়েক মাস তাঁর সাথে থাকতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে স্পিতি এবং কিন্নোর থেকে দুটো দশ বছর বয়সী ছেলে বেছে নিয়েছিলেন।
যদিও তাঁর পুর্বসূরীর মতো তাঁর মধ্যে একই রকমের হাস্যরস রয়েছে এবং ব্যবহারিক ভাবে মাটির মানুষের মতো সেটাকে শেয়ার করেন কিন্তু তরুণ সেরকোঙ্ রিনপোছের নিজের একটা ব্যক্তিত্ব আছে। এক জীবন থেকে পরবর্তী জীবনে যা অব্যাহত থাকে সেটা হ’ল- প্রতিভা, প্রবণতা এবং কার্মিক সংযোগ। তাঁর সাথে আমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে, আমি কিছুটা ক্যাপটেন কির্কের (কার্ক) মূল “স্টার ট্রেক”-এর দলের সদস্যের মতো বোধ করি যারা এখন যোগ দিয়েছে “স্টার ট্রেকঃ দা নেক্সট জেনারেশন”-এর ক্যাপটেন পিকার্ডে।
রিনপোছের লালন-পালনের ক্ষেত্রে পিছনের আসনের ভূমিকা গ্রহণ
এখন পর্যন্ত আমি সেরকোঙ্ রিনপোছের লালন-পালনের ক্ষেত্রে পিছনের আসনের ভূমিকা পালন করেছি। আমি অনুভব করেছি যে, পুরনো রিনপোছে মূলতঃ তার নিজের লোকদের সেবা করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। অনেক বড়-বড় লামারা স্বয়ং তিব্বতীদের ক্ষতির জন্য পাশ্চাত্য দেশে বা এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের পারম্পারিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের বাইরে শিক্ষা প্রদান করার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। যদি বৌদ্ধধর্মের তিব্বতী রূপটা সম্পূর্ণ রূপে টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে ভাবী তিব্বতী প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দেওয়া আবশ্যক। এর কারণ হ’ল- বর্তমানে পূর্ণ বৌদ্ধ শিক্ষা শুধু তিব্বতী ভাষায় উপলব্ধ। রিনপোছে আমার প্রশিক্ষণ এবং আত্ম-বিকাশের জন্য কল্পনাযোগ্য সর্বোত্তম পরিস্থিতির ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা পরিশোধ করার জন্য আমিও তাঁর জন্য একইরকম করে চলেছি।
সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব রোধ করার চেষ্টা করার জন্য আমি রিনপোছের আধুনিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ করিনি। আসলে আমি জেনে-শুনে তাঁর সাথে খুব বেশী যোগাযোগ করা এড়িয়ে চলেছি, যদিও আমরা যখনই দেখা-সাক্ষাৎ করি আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ট বন্ধন সুস্পষ্ট হয়। পরিবর্তে আমি ভারতে অবস্থিত তিব্বতী বিদ্যালয়গুলির একই পাঠক্রম অনুসরণ করে তাঁকে ইংরেজি, বিজ্ঞান, সামাজিক অধ্যয়নের উপর শিক্ষা অর্জন করার জন্য স্থানীয় তিব্বতী প্রশিক্ষকদের ব্যবস্থা করতে সহযোগিতা করেছি। ফলস্বরূপ, রিনপোছে সম্পূর্ণভাবে তাঁর নিজের লোকের সাথে সম্পর্ক রাখতে পেরেছে। আমি তাঁকে পাশ্চাত্য দেশেও নিয়ে যাইনি, কম্পিউটার বা ভিডিও প্লেয়ারও কিনে দিইনি এবং অপরকে এই সমস্ত জিনিস দিতে নিরুৎসাহিত করেছি। প্রচুর তরুণ পুনর্জন্মিত লামারা কম্পিউটার গেম এবং অ্যাকশন ভিডিও রাখে যা তাদের পারম্পারিক ভিক্ষুত্ব অধ্যয়নের চেয়েও বেশী আকর্ষিত করে।
আরও একবার তাঁর শিষ্য হওয়ার প্রার্থনা
আমি জানি না আমার দিকটি কতটা অবদান রেখেছে, তবে রিনপোছে নিরাপত্তার গভীর উপলব্ধি প্রদর্শন করেন এবং তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতির বিষয়ে পুরোপুরি স্বস্তিপূর্ণ। এটি কেবল তাঁর এবং ভবিষ্যতে যার সাথে সাক্ষাৎ হবে তার পক্ষে উপকারী হতে পারে। তিনি যখন পরিপক্কতায় পৌঁছচ্ছেন তখন তিনি পাশ্চাত্য সম্পর্কে প্রথম থেকেই শিখতে পারেন। আমি প্রার্থনা করি যে, আমি যেন আমার পরবর্তী জীবনে আরও একবার তাঁর শিষ্য হয়ে উঠতে পারি।