সেরকোঙ্‌ রিনপোছের মহান আচার্য হওয়ার পদ্ধতি

আধ্যাত্মিক গুরুর প্রতি বিশ্বাস এবং পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতির বিকাশ

বৌদ্ধ সাধনার মধ্যে আধ্যাত্মিক গুরুর প্রতি পূর্ণ সমর্পণের ভাবনা একটি কঠিনতম এবং অপূর্ব বিষয়। এ যেন দৃঢ় হয় ও বজায় থাকে। সযত্ন ছাড়া তা হয় না। সুদৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে সেটা হয় অটল। আমার ও তাঁর মধ্যে বিষয়টি যেন এমনই হয়। তার জন্য সেরকোঙ্‌ রিনপোছে অশেষ কষ্ট করেছেন। এক সন্ধ্যায় মুন্ডগোডে, মহাপ্রার্থনা উৎসবের পর রিনপোছে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির জটিলতা নিয়ে আমাকে বলেছিলেন। যদিও তাঁর সেবকদের মতে তার দরকার ছিল না, কিন্তু রিনপোছে মনে করলেন এসব আমার জানা উচিত। পরে বিভিন্ন হিংসুটে লোকজনের কাছ থেকে আমি তাঁর বিষয়ে গুজব শুনেছিলাম। এই কারণে রিনপোছে চেয়েছিলেন আমার বিশুদ্ধ সমর্পণে এবং তাঁর স্নেহে যেন কোন দাগ না লাগে।

সম্ভাব্য গুরু-শিষ্য দীর্ঘদিন ধরে নানা ভাবে এবং বিস্তারিত ভাবে একে অপরকে পরখ করে। এইভাবে গড়ে ওঠে আধ্যাত্মিক গুরুর প্রতি শিষ্যের পূর্ণ সমর্পণের ভাবনা। যদিও ভাল করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আধ্যাত্মিক গুরুকে শিষ্য বুদ্ধ রূপে দেখবে, তাই কাম্য। কিন্তু তার মানে এই নয় যে গুরুর কোন ভুল হয় না, তিনি অভ্রান্ত। গুরু কী বলছেন সেটা শিষ্যকে অবশ্যই মিলিয়ে নিতে হবে, প্রয়োজনে বিনীত ভাবে নিবেদন করা যেতে পারে। তাদের লামা (গুরু) কী বলছেন বা করছেন তা না বুঝলে শ্রদ্ধার সঙ্গে সেটা শুধরে নিতে হয়, থাকতে হয় সজাগ।

একবার ফ্রান্সের নালন্দা মঠে রিনপোছে এই বিষয়টি পশ্চিমী ভিক্ষুদের দেখাতে চেয়েছিলেন। উপদেশ দানের সময় তিনি ইচ্ছা করে একটা সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য একেবারেই অবাস্তব বলেও ভিক্ষুরা তা সশ্রদ্ধায় তাদের খাতায় লিখে নিয়েছিল। পরবর্তী অধিবেশনে রিনপোছে তাদের ভর্ৎসনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, আগের প্রবচনে তিনি সম্পূর্ণ হাস্যকর ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু কেউ তাকে প্রশ্ন করেনি কেন? তিনি তাদের বলেছিলেন- বুদ্ধ স্বয়ং উপদেশ দিয়েছেন যে, একজন গুরু যা বলেন সেটা অন্ধভাবে নিঃসংশয়ে যেন গ্রহণ না করা হয়। মহান আচার্যদেরও কোন-কোন সময় ভুল হয়, অনুবাদকরা প্রায়ই ভুল করেন আর শিষ্যরাও সেরকম ভুল ও বিভ্রান্তকর টিপ্পনী লেখে। অস্বাভাবিক কিছু মনে হলে অবশ্যই তাদের প্রশ্ন করা উচিত এবং প্রতিটি বিষয় গ্রন্থের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা উচিত।

মহান বৌদ্ধ আচার্যদের দ্বারা গ্রন্থের বিচার ও প্রশ্নের উত্থাপন

ব্যক্তিগত ভাবে রিনপোছে মান্যতা প্রাপ্ত বৌদ্ধ ব্যাখ্যাগুলিকেও প্রশ্ন করেন। এইভাবে তিনি আচার্য চোংখাপার উদাহরণ বহন করছেন। চতুর্দশ শতকের মহান আচার্য চোংখাপা লক্ষ্য করেছিলেন যে, তিব্বতী বা ভারতীয় আচার্যদের লিখিত অনেক শ্রদ্ধেয় গ্রন্থ পরস্পর বিরোধী এবং অযৌক্তিক মতে পরিপূর্ণ। আচার্য চোংখাপা এগুলি খুঁজে পরীক্ষা করলেন। অযৌক্তিক বিষয় বাদ দিয়ে তিনি দিলেন নতুন ব্যাখ্যা। বিভ্রান্তিমূলক লেখার উপর দিলেন গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা। এগুলি একসময় ব্যবহৃত হত। যেগুলির বিস্তৃত ধর্মগ্রন্থের জ্ঞানবাহী এবং গভীর সাধনা প্রসূত তা নব ভাবনায় পেল স্থান। সেরকোঙ্‌ রিনপোছে ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।

উদাহরণ স্বরূপ, তার দেহত্যাগের কিছুদিন আগে রিনপোছে আমায় ডাকেন এবং চোংখাপার সর্বাপেক্ষা কঠিন দার্শনিক গ্রন্থ “নেয়ার্থনীতার্থ-বিভঙ্গশাস্ত্র-সুভাষিতসার” থেকে একটি অংশ দেখালেন। নিত্যপূজার অঙ্গ হিসাবে রিনপোছে এই কয়েকশত পৃষ্ঠা সম্বলিত গ্রন্থটি প্রতিদিন স্মরণ করে পাঠ করতেন। গ্রন্থাংশের বিষয় ছিল মন থেকে সংশয় দূরীকরণের পদ্ধতি বর্ণনা, বিশেষ করে সংশয়ের “বীজ” সম্পর্কিত। মান্যতা প্রাপ্ত ব্যাখ্যাগুলি এই বীজগুলিকে পরিবর্তিত ধর্ম হিসাবে দেখেছে যা দৈহিক বস্তু যেমন নয়, আবার তাদের দ্বারা জানা যাবে বা জ্ঞাতব্য তাও নয়। “বীজ” শব্দটিকে বোঝানোর জন্য আমি অনুবাদ করেছিলাম “প্রবণতা”। যুক্তি দিয়ে, যুক্তি অনুভব এবং গ্রন্থের অন্য অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে রিনপোছে ব্যাখ্যা করলেন ধানের বীজও আসলে ধান। অতএব সংশয়ের বীজও হল সংশয়ের “ছাপ”। অবচেতনকে নিয়ে কাজ করা বা তাকে কীভাবে বোঝা যাবে এই বিষয়ে এই বৈপ্লবিক ব্যাখ্যার মূল অতি গভীর।

রিনপোছের সহজ-সরল জীবনযাত্রা

সেরকোঙ্‌ রিনপোছের মধ্যে অপূর্ব উদ্ভাবনী মেধা থাকলেও তিনি সবসময় বিনম্র ও দেখানোপনা ত্যাগের উপর জোর দিয়েছেন। মুন্ডগোড বিহারের সর্বোচ্চ লামা হয়েও তিনি নিজের জন্য সুদৃশ্য বিশাল বাড়ি বানাননি, করেছিলেন ছোট্ট কুড়ে ঘর। ধর্মশালায় তার বাড়িটিও তাই, অতি সাধারণ। চারজন মানুষের জন্য তিনটি কক্ষ, অতিথির আগমন লেগেই থাকত এবং তার সঙ্গে থাকত দুটো কুকুর আর একটি বেড়াল।

নিজের মহত্ত্বতার প্রদর্শন রিনপোছে কখনও করেননি। তেমনই শিষ্যদেরও মানা করেছেন- আমার সম্বন্ধে অতিকথন কোরো না। এমন অনেক ধ্যান সাধনা আছে যেখানে গুরুকেই কেন্দ্র করে মানস দর্শনের সাধনা করতে হয়; যেমন গুরুযোগ সাধনা। এতে গুরুর সংস্কৃত নাম সম্বিলিত মন্ত্র পাঠ করতে হয় কয়েকবার। সেইক্ষেত্রে রিনপোছে সবসময় শিষ্যদের বলেন- তোমরা পরম পূজ্য দালাই লামাকে মানস নেত্রে দর্শন কর। তাঁর নিজের নাম সম্বলিত নামের জন্য প্রার্থনা করলে, তিনি তাঁর পিতার নাম বলতেন। রিনপোছের পিতা সেরকোঙ্‌ দোর্জে ছাঙ্‌ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের মহান সাধকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। সেই সময় তিনি ছিলেন কালচক্র কুলের ধারক। তার মানে হল তিনি ছিলেন কালচক্রের জ্ঞান ও সাধনা পরবর্তী প্রজন্মে প্রদান করতে সক্ষম এমন একজন স্বীকৃত গুরু।

অত্যাধিক্য ত্যাগের জন্য মহাত্মা গান্ধীর অনুসরণ

রিনপোছের অতিসাধারণ জীবনযাত্রা বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছে। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি যখন ভ্রমণ করতেন মহাত্মা গান্ধীকে অনুসরণ করতেন। বিশেষ কোন কারণ না থাকলে তিনি ভারতীয় রেলের থ্রি-টায়ার শ্রেণীতে যাত্রা করতে চাইতেন। আমাদের দুজনের প্রথম পাশ্চাত্য ভ্রমণের সময় তাই হয়েছে। ধর্মশালা থেকে দিল্লি আসার পথে দুর্গন্ধযুক্ত শৌচালয়ের পাশেই ঘুমোতে হয়েছে। রিনপোছে বলেছিলেন এইরকম সাধারণ যাত্রা খুবই ভাল, এতে করুণার বিকাশে সহায়ক হয়। তিন শ্রেণীর যাত্রীরা তো একই সময়ে গন্তব্যে পৌঁছয়, অনর্থক অর্থ নষ্ট করে কী লাভ? মানুষ তার জন্য প্রথম শ্রেণীর টিকিট কেটে দিচ্ছে বা নিয়ে যাচ্ছে দামী রেঁস্তোরায়, যা রিনপোছে পছন্দ করতেন না।

একবার রিনপোছে স্পিতি থেকে ধর্মশালায় ফিরছিলেন। আমি সহ অনেক শিষ্যরা বাজারে তাকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিলাম। অনেক বাস ও গাড়ি চলে গেল, রিনপোছের দেখা নেই। অবশেষে একটি নোংড়া পুরোনো লরি এসে থামল বাজারে। তার উপরে লোক ভর্তি, এরমধ্যে হাতে মালা নিয়ে বসে আছেন রিনপোছে। এইভাবে তিনদিন ধরে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা এসেছিলেন। আরাম বা দেখতে কেমন লাগবে এর পরোয়া করেননি।

মুন্ডগোড-এ মহাপ্রার্থনার শেষে ধর্মশালা ফিরে আসার সময় রিনপোছে, তাঁর সেবকবৃন্দ এবং আমাকে পুনের রেল স্টেশনে সারাদিন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। একজন তিব্বতী সোয়েটার বিক্রেতা তৃতীয় শ্রেণীর একটি হোটেলের কামরা আমাদের ব্যবহার করতে দিয়েছিল। গরম, হৈ-হট্টগোল উপেক্ষা করে রিনপোছে সেখানে আরামে রইলেন। সত্যি বলতে কি রিনপোছে ভারতে ভ্রমণ করার সময় রাত্রি-বাস ব্যবহার করতে বলতেন, যেটা সহজে পাওয়া যায় আর সস্তা। জনাকীর্ণ বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে তিনি বিব্রত হতেন না। তিনি বলতেন এরকম অবস্থায় নিজেকে শান্ত রাখার মত অনেক ধ্যান আছে, তাতেই হয়ে যায়। চারদিকের হৈচৈ, দুর্গন্ধ কোন কিছুই তার একাগ্রতা ভঙ্গ করতে পারত না।

তিনি এক জায়গায় দীর্ঘদিন থাকতেন না, সবসময় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি বলতেন আসক্তি দূর করার জন্য এটা ভাল উপায়। এই কারণে এইভাবে যখনই আমরা ভ্রমণ করতাম একটি বাড়িতে কোথাও বেশী দিন থাকতাম না। স্বাগতিকের বোঝা যেন না হতে হয়, এই ছিল এর উদ্দেশ্য। কোন বৌদ্ধ বিহার বা কেন্দ্র যেখানে প্রবীণ ভিক্ষু রয়েছেন, যিনি সেখানকার শিক্ষক তেমন জায়গায় প্রবীণ ভিক্ষুর সঙ্গে রিনপোছে পরম মিত্রের মতো ব্যবহার করতেন। তাঁর হৃদয় উৎসারিত সম্পর্ক কখনও কোন এক ব্যক্তির উপর সীমাবদ্ধ রাখেননি।

নিরন্তর অকপট সাধনা, অবস্থানুযায়ী ব্যবস্থা নীতি

রিনপোছে কোথায় গেলেন সেটা বড় কথা নয়, তিনি সারাদিন সাধনায় থাকতেন। রাতে তিনি প্রায় ঘুমোতেন না। সাক্ষাৎকারের অবসরে হোক বা বিদেশীদের সঙ্গে বার্তালাপের সময় হোক বা আমার অনুবাদের পর্ব, তিনি ওই সময়েও মন্ত্র পাঠ বা তান্ত্রিক দর্শনের সাধনা করে যেতেন। গাড়ি, রেলগাড়ি বা বিমান যাই হোক না কেন, যে কোন বাহ্যিক পরিস্থিতিতে তাঁর সাধনায় কখনও ছেদ পড়েনি। তিনি প্রতিদিনের দৃঢ় সাধনার উপর জোর দিতেন আর বলতেন যেখানেই আমরা যাই না কেন বা যে কোন কাজ করি, তাতে একধরণের নিরন্তরতা দান করে। তাতে আমরা পাই স্থিতিশীলতা, আত্মবিশ্বাস এর স্থিরতা।

তিনি তাঁর সাধনা কখনও প্রদর্শন করেননি। আহারের পূর্বে প্রার্থনা হোক বা প্রবচনের প্রারম্ভের পাঠ তিনি সেটাকে একান্তে করতে বলতেন। অন্যদের সঙ্গে ভোজনের সময় দীর্ঘ মন্ত্র পাঠ করলে ওরা হয়তো অস্বস্তি বোধ করবেন বা ভাবতে পারেন তাদের লজ্জা দেওয়া হচ্ছে বা তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে। এছাড়াও তিনি কখনও কারও উপর কোন সাধনা বা রীতি চাপিয়ে দেননি। যে কেন্দ্রে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাত তিনি তাদের ওখানকার রীতি অনুসরণ করে প্রবচনের আগে বা পরে করতেন প্রার্থনা।

যদিও তিনি পরম পূজ্যকে প্রচুর দান করতেন এবং তেমনই করতেন তিব্বতী বা পশ্চিমের বিহারগুলিতে। কিন্তু এনিয়ে কখনও উচ্চবাচ্য করতেন না। তা না করার শিক্ষা দিতেন তিনি। একবার ইটালিতে ভিলোরবাতে একজন সৌম্য পৌঢ় রিনপোছের দর্শন করতে এসেছিলেন। তিনি কক্ষ ছেড়ে চলে যাবার সময় নীরবে একটি টেবিলে তার খামবন্ধ শ্রদ্ধার দান রেখে চলে যান। সর্বসমক্ষেও রাখেননি, একপাশে রেখেছিলেন। পরে রিনপোছে মন্তব্য করেন এইভাবেই একজন লামাকে দান করতে হয়।

রিনপোছে জোর দিতেন যে আমাদের শিষ্টাচার যেন হয় খাঁটি, ভান নয়। যারা বিনম্র হওয়ার ভান করে তাদের তিনি পছন্দ করতেন না, কারণ ওরা আসলে গর্বিত, উদ্ধত হয় এবং ভাবে যে ওরা মহান যোগী। তিনি প্রায়ই যাযাবর মানুষদের মধ্যে বড় হয়েছেন এমন একজন গর্বোদ্ধত যোগীর গল্প শোনাতেন, যে একবার একজন মহান লামার কাছে গিয়েছিল। তার ভাব-ভঙ্গিমা এমন যেন সে সভ্যতা কখনও দেখেনি। লামাজীকে জিজ্ঞাসা করল টেবিলের উপর রাখা পূজোর উপকরণগুলি কী? তারপর লামাজীর বেড়ালটি দেখিয়ে বলল এই আশ্চর্য জীবটিই বা কী? লামাজী তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন।

তাঁর ব্যক্তিগত সাধনা গোপন থাকত

মানুষ তাদের বিষয়ে বড়-বড় কথা বলছে, রিনপোছে তা একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন আমরা যদি মনস্থ করি যে, কোন সাধনা করব বা যদি সমাপ্তও করি তা অন্যদের কাছে বলা উচিত নয়। গোপন রাখা সর্বোত্তম, কেউ যেন জানতে না পারে আমি কী করছি। নইলে আমাদের নিয়ে লোকে আলোচনা করবে আর অনেক বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। ঈর্ষা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব জাগবে। তন্ত্র সাধনায় আচার্য চোংখাপার ইষ্টদেবতা কে ছিলেন কেউ জানত না। দেহত্যাগের আগে আচার্যের শিষ্য খেডুব-জে দেখলেন তিনি অন্তর-অর্ঘ্য পাত্র থেকে বাষট্টিটি অর্ঘ্য দান করছেন। তাতে তিনি বুঝতে পারলেন আচার্যের ইষ্টদেবতা চক্রসংবর; বুদ্ধের অন্তরের সুখের রূপ। একই ভাবে সেরকোঙ্‌ রিনপোছের ব্যক্তিগত সাধনা কী ছিল তাও কেউ জানে না, যদিও তিনি কালচক্র যানের একজন স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

তিনি প্রায়ই কদমপা পরম্পরার গেশেদের কথা বলতেন। ওঁরা তাদের সাধনা এমনভাবে করতেন যে কেউ বুঝতেও পারত না। দেহত্যাগের পর হয়তো দেখা যেত চীবরের এক ভাঁজে রয়েছে ছোট্ট বজ্র এবং ঘন্টা। তখন বোঝা যেত ওরা কী সাধনা করে থাকবেন। এই রকম ভাবে রিনপোছে জীবন-যাপন করেছেন। তাঁর নিবাসে সকলের নিদ্রা যাওয়ার আধ ঘন্টা আগে তিনি ঘুমোতে যেতেন, তেমনই উঠতেন সবার পরে। আমি ও তাঁর সেবক লক্ষ্য করতাম অন্যরা যখন ঘুমোচ্ছে তাঁর ঘরে আলো জ্বলছে। তেমনই অন্যরা জেগে থাকলেও তার ঘরের আলো নিভে যেত।

একবার জার্মানীর জাগেনডর্ফ-এ রিনপোছের প্রবীণ সেবক ছোনজেলা রিনপোছের শয়ন কক্ষে থাকতেন। ছোনজেলা দেখতেন রিনপোছে মধ্যরাতে উঠে নারোপার ষড্‌যোগের কঠিন মুদ্রাগুলি অনুশীলন করছেন। অথচ দিনের বেলা ওঠাবসা বা চলাফেরা করতে তার সাহায্যের প্রয়োজন হতো। তা সত্ত্বেও ওইরকম কঠিন যোগ-সাধনা করার মত শক্তি ও নমনীয়তা রিনপোছের মধ্যে ছিল।

ভাল গুণাবলী গোপন থাকত

রিনপোছে সবসময় তাঁর গুণাবলী গোপন রাখার চেষ্টা করতেন। এমনকি তিনি আগন্তুকদের কাছে নিজের পরিচয়ও প্রকাশ করতে পছন্দ করতেন না। একবার ইন্দোনেশীয় এক বৌদ্ধ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দম্পতি প্যারিস থেকে আমস্টারডাম যেতে তাদের গাড়িতে যাবার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন। আমস্টারডাম পৌঁছনোর পর সেই দম্পতি ভোজনের জন্য রিনপোছেকে আমন্ত্রণ করলেন। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় বৌদ্ধ মন্দির থেকে দম্পতির কাছে ফোন এলো যে, ওরা যেন রিনপোছের প্রবচন শুনতে আসেন। তখন ওরা বুঝতে পারেন তাদের অতিথি কে ছিলেন। ওরা ভেবেছিলেন তিনি একজন সাধারণ বন্ধু বৎসল ভিক্ষু হবেন।

এই রকম হৃদয় নিয়েই তিনি শিশুদের সঙ্গে দাবা খেলতেন, যখন তিনি বিদেশ যেতেন। কোন-কোন সময় কনিষ্ঠ সেবক ঙাওয়াঙ্‌কে বলতেন শিশুদের সঙ্গে খেলার জন্য এবং তিনি দুপক্ষকেই উৎসাহ দিতেন। শিশুরা ভাবত তিনি একজন স্নেহময় দাদুর মতো। একবার বড়দিনের সময় জার্মানির মিউনিখে তিনি পথে হেঁটে যাচ্ছিলেন। শিশুরা তার পিছু নিল। তার লাল চীবর দেখে ওরা তাঁকে সান্তাক্লস ভেবে বসল।

রিনপোছে যে কিছুটা ইংরেজি জানতেন, তাও গোপন করেছিলেন। তাঁর দেহ ত্যাগের একমাস আগে, স্পিতিতে কালচক্রের দীক্ষাদানের পর তাকে তাবো মঠে রেখে আমি ছুটি নিয়ে ধর্মশালা চলে গিয়েছিলাম। পাশ্চাত্যের একদলের জন্য আমি একটি বাস ভাড়া করেছিলাম এবং আমাকে যেতেই হতো। একজন বিদেশী শেষ মুহুর্তে গিয়েছিল ২০ মাইল দূরে ক্যি গোনপা দর্শনে এবং সে ঠিক সময়ে আসতে পারল না। ভদ্রমহিলাকে খুঁজতে আমি গিয়েছিলাম ক্যি গোনপায়। এদিকে একজন ইতালিয়ান শিষ্য দোভাষী ছাড়া গিয়েছিল রিনপোছেকে দর্শন করতে। রিনপোছে কোন বিদেশীর সঙ্গে একবর্ণও ইংরেজি কখনও বলেননি। কিন্তু তিনি সেই ইতালিয় ভদ্রলোককে পরিষ্কার ইংরেজীতে জিজ্ঞাসা করলেন, “আলেক্স কোথায় গেছে?” লোকটি অবাক হয়ে গেল, “রিনপোছে আপনি তো ইংরেজি বলেন না!” রিনপোছে শুধু হাসলেন।

Top