সেরকোঙ্‌ রিনপোছের কাছে প্রশিক্ষণ

আমার সেরকোঙ্‌ রিনপোছের সাথে প্রথম দর্শন এবং তাঁর প্রাথমিক উপদেশ

১৯৭০ সালে আমি প্রথম সেরকোঙ্‌ রিনপোছেকে দেখি বুদ্ধগয়াতে। শারপা ও খামলুঙ্‌ রিনপোছে নামে দুজন তরুণ অবতারি লামা গেশে ওয়াঙ্‌গ্যাল-এর তত্ত্বাবধানে আমেরিকায় ইংরেজি শিখতেন। ওরা আমায় সেরকোঙ্‌ রিনপোছের নাম বলেছিলেন। তারা আরও বলেছিলেন যে, তিনি হলেন আমাকে গুহ্যসমাজ সাধনা শেখানোর জন্য সবচেয়ে যোগ্য গুরু। আমি পি.এইচ.ডি. করার জন্য এই জটিল তন্ত্রটিকে বেছে নিয়েছিলাম। স্নাতক স্তরে এর মূল গ্রন্থের একটি অংশের সংস্কৃত ও তিব্বতী ভাষায় রচনার তুলনামূলক বিচার করার সুযোগ ঘটে।

কিন্তু ওই রকম উচ্চতর অধ্যয়নের জন্য আমার ভাষা জ্ঞান যথেষ্ট ছিল না। সেরকোঙ্‌ রিনপোছে আমায় গুরুত্ব দিলেন। তিনি খেনজুর য়েশে দোনডুব-এর নাম বললেন. তিনি ছিলেন উচ্চতর তান্ত্রিক বিহার গ্যুতোর অবসরপ্রাপ্ত মঠাধ্যক্ষ। আমি এই রকম বিখ্যাত মানুষটিকে আমার জন্য বেছে নেওয়ায় সম্মানিত বোধ করলাম। বেশ কয়েকবছর পর তিনি গেলুগ পরম্পরার প্রধান হয়েছিলেন।

ডালহৌসীতে গেশে ঙাওয়াঙ্‌ ধারগ্যের কাছে অধ্যয়ন

এর কয়েক মাস পর ধর্মশালার কাছে ডালহৌসীর এক পাহাড়ী গ্রামে যেখানে গ্যুতো বিহার ছিল, সেখানে একটা মাটি ও ঘুটের কুড়ে ঘরে ঐ মঠাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করলাম। আমি সেখানেই রয়ে গেলাম। বৃদ্ধ ভিক্ষু সবেমাত্র পরপর দুটি তিন বছরের সাধনা পূর্ণ করেছেন। আমাকে শিক্ষাদান করতে প্রার্থনা করায় তিনি তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলেন। তিনি বললেন যে, আমি ঠিক সময়ে পৌঁছেছি। পরদিনই তিনি গুহ্যসমাজের উপর তিন বছরের নিবিড় সাধনা শুরু করতে যাচ্ছেন। আমি কী তার সঙ্গে যোগ দেব? আমাকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে, কিন্তু রিনপোছের কাছে অতুলনীয় বৌদ্ধ শিক্ষাও পেয়েছিলাম। পরিস্থিতিটি তিনি সৃষ্টি করলেন, আমি যেন নিজে সত্যটা বুঝতে পারি। এরকম অত্যন্ত উন্নত তন্ত্রের সাধনা করতে হলে আমাকে প্রাথমিক পাঠ থেকে শুরু করতে হবে।

শীঘ্রই আমি আমার গবেষণার শিরোনাম বদল করে অনেক সহজ বিষয় নিলাম- “লাম-রিম বা মার্গক্রমের মৌখিক পরম্পরা।” প্রাথমিক পড়াশোনার জন্য শারপা ও খামলুঙ্‌ রিনপোছের গুরু গেশে ঙাওয়াঙ্‌ ধারগ্যের কাছে অধ্যয়ন করার ব্যবস্থা হল। “গেশে” একটি ভিক্ষুসংঘের ডিগ্রী, যা পি.এইচ.ডি.-এর সমতুল্য। বিজ্ঞ শিক্ষক হিসাবে গেশের নৈপুণ্যের কারণে গেশে ধারগ্যে পাঁচজন কিশোর অবতারি লামার শিক্ষক হতে পেরেছেন। ঔ সময় গেশে ধারগ্যে একটি গোয়াল ঘরকে সারাই করে তাতেই থাকতেন। সেটাতে মাছি ভনভন করতো। ঘরটি এতই ছোট ছিল যে, যার মধ্যে কোনরকমে তার বিছানা পাতা যেত আর তিনজন গাদাগাদি করে মেঝেতে বসতে পারত। তিনি যেভাবে থাকতেন তাতে দুঃখ পেতাম, কিন্তু আমাকে পড়াশোনায় মন দিতেই হল। আধুনিক কথ্য তিব্বতী ভাষা জানার প্রয়োজন ছিল। হার্ভার্ডে আমি শুধু ধ্রুপদী লিখিত তিব্বতী ভাষা শিখেছিলাম।

সেই বছরেরই জুন মাসে আমি ধর্মশালায় সেরকোঙ্‌ রিনপোছের দর্শন করি। সেখানে তখন টাইফয়েড ও কলেরার ভয়ঙ্কর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। পরম পূজ্য দালাই লামা সেরকোঙ্‌ রিনপোছেকে ধর্মশালায় এসে হয়গ্রীব দীক্ষা দানের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। হয়গ্রীব, বুদ্ধেরই ভয়ানক রূপ, এতে এই ধরণের সংক্রমণ রোধে মানুষের উপকারে আসেন। মুষ্টিমেয় কিছু পাশ্চাত্যদের সঙ্গে আমিও অভিষেক প্রাপ্ত করেছিলাম। তবে রিনপোছের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে দেখা করার কোন সুযোগ ঘটেনি। অন্যত্রও তাঁকে এই অভিষেক প্রদান করার ছিল এবং তিনি দ্রুত ধর্মশালা ত্যাগ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ ত্যাগ করে ধর্মশালায় আগমন

পরবর্তী সময় আমাদের যখন দেখা হয়, তখন অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের শরৎকালে পরম পূজ্য দালাই লামা গেশে ধারগ্যেকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন নবনির্মিত লাইব্রেরী অফ টিবেটান ওয়ার্কস্‌ অ্যান্ড আর্কাইভস্‌-এ বিদেশীদের বৌদ্ধধর্মের পাঠ দান করেন। শারপা এবং খামলুং রিনপোছে তাঁর অনুবাদক হিসেবে যোগ দিলেন। আমিও প্রার্থনা জানালাম গ্রন্থাগারের কাজ বা অনুবাদে যোগদান করতে পারি কি না। এতে পরম পূজ্য সম্মত হলেন। তিনি বললেন প্রথমে গবেষণা শেষ করে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রী নিয়ে তারপর এসো। সেখান থেকে একশত কিলোমিটারেরও কম দূরে ভারত-পাক লড়াই শুরু হয়েছিল এবং তখন, আমি আর দেরী না করে চলে গেলাম। হার্ভার্ডে ফিরে দালাই লামার উপদেশ পালন করলাম। অধ্যাপকদের অবাক করে, অধ্যাপক পদকে ধন্যবাদ দিয়ে কয়েক মাস পর ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ধর্মশালায় ফিরে এলাম।

রিনপোছের শিষ্যত্ব গ্রহণ

সেরকোঙ্‌ রিনপোছে দুই বছরের জন্য নেপাল চলে গেলেন। সেখানে কিছু নবনির্মিত বিহারে অভিষেক ও প্রবচন দেওয়ার কথা ছিল। ১৯৭৪ সালের শরৎকালে তিনি যখন ধর্মশালা প্রত্যাবর্তন করলেন, ততদিনে আমি তাঁর সঙ্গে সরাসরি তিব্বতী ভাষায় কথাবার্তা বলার মতো উপযুক্ত হয়ে উঠেছিলাম। কর্মফল বশতঃ আমি রিনপোছের অনুবাদক হব, এই বিষয়টি সম্ভবতঃ তিনি জানতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন- এসো, বিশেষ করে নানা রকম লোকজন যখন আসতো তিনি আমায় পাশে বসতে বলতেন, এইভাবে উৎসাহ দিতেন। সাক্ষাৎকারের অবসরে রিনপোছে আমার সঙ্গে তিব্বতী শব্দ ভান্ডার নিয়ে আলোচনা করতেন। আমি ঠিকমত আলোচনাটি বুঝেছি কিনা সেটা তিনি এইভাবে যাচাই করে নিতেন।

কিছুদিন পর রিনপোছে আমায় তিনি অসাধারণ থাঙ্কা দান করলেন। সেগুলি ছিল শ্বেত মঞ্জুশ্রী, সরস্বতী এবং শ্বেত তারা; সম্প্রতি স্পিতির অধিবাসীগণ এসব রিনপোছেকে উপহার দিয়েছিল। বুদ্ধের এই রূপগুলি ছিল তার আশৈশব সাধনা ও চিত্তের বিকাশের মূল উপাস্য। পরোপকারী মনের শুদ্ধতা, সৃষ্টিশীল ও গভীর প্রজ্ঞামূলক সাহিত্য রচনার ক্ষমতা অর্জন এবং একটা দীর্ঘ কর্মক্ষম জীবনের শক্তিরূপ হল বুদ্ধের এই তিনটি রূপ। সুগভীর তাৎপর্যবাহী এই উপহারগুলি আমাদের সম্পর্কটিকে নিশ্চয়তা দিয়েছে। আমি কি আপনার শিষ্য হতে পারি? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি আমার পাশ্চাত্য ধারার ভাব প্রকাশ দেখে স্মিত হাসলেন। মধুর সে হাসি।

একজন অনুবাদক ও শিক্ষক হওয়ার জন্য শিক্ষাদান

এরপর রিনপোছে আমাকে প্রথানুসারে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন, কিন্তু একবারের জন্যও মনে হয়নি যে তিনি শব্দাবলীর উপর অত্যাধিক মনোযোগ দিচ্ছেন। প্রথমতঃ তিনি আমার স্মৃতি নিয়ে শুরু করলেন। যখনই যেতাম রিনপোছে জিজ্ঞাসা করতেন একটু আগে আমি কোন শব্দটি বলেছি বলতো? একইভাবে জিজ্ঞাসা করতেন তুমি এখনই যা বলেছ সেটা আবার বল। ১৯৭৫ এর শরৎকাল থেকে আমি রিনপোছের অনুবাদক হিসেবে কাজ শুরু করি। তিনি কোন-কোন সময় বলতেন অনুদিত বিষয়টি আবার তিব্বতীতে অনুবাদ কর। এইভাবে তিনি দেখে নিতেন কোনও ভুলচুক, বাদ পড়ে যাওয়া বা অতি কথন হয়নি তো; সত্যি বলতে কি আমি আট বছর রিনপোছের অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছি। যখনই তিনি বলতেন পুনরায় তিব্বতী অনুবাদ কর, দেখা যেত আমি তাঁর কথা ভুল বুঝেছি। আমার ভুলগুলি তিনি বুঝে ফেলতেন। প্রতিটি প্রবচনের পর রিনপোছে পাঁচ মিনিটে তিনি তার বক্তব্যের সারাংশ বলতেন; এর পর আমায় বলতেন তোমার সারাংশ প্রস্তুত কর। এইভাবে তিনি শুধু দীর্ঘ প্রবচনের অনুবাদ করার জন্য প্রশিক্ষণ দিতেন না বরং শিক্ষাদানেরও সুযোগ করে দিতেন। কোনও সময় হতো কি, আমি সারাংশ প্রস্তুত করছি, তিনি তাঁর সেবকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন, এইভাবে তিনি আমার মনোযোগের পরীক্ষা নিতেন। একজন প্রকৃত গুরু বাইরের শোরগোলে অবিচলিত থাকেন; কোনও অবস্থাতেই অমনোযোগী হন না।

আমার স্মৃতির প্রশিক্ষণ

রিনপোছে যখন একান্তে প্রশিক্ষণ দিতেন, তিনি আমায় নোট নিতে দিতেন না। আমাকে সবকিছু মনে রেখে পরে লিখতে হতো। তারপরই রিনপোছে আমায় লম্বা কাজ দিতেন আর সবশেষে রাতে আমার নোট লেখার সময় পেতাম। অবশেষে প্রবচনকালে যা আমি অনুবাদ করতাম, তিনি কখনও একটু থামতেন এবং ব্যক্তিগত ভাবে আমার সঙ্গে একেবারে ভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। তারপরে তাঁর কথাগুলির অনুধাবন করা বা লিখে রাখার জন্য এক মুহুর্তও সময় না দিয়ে তাঁর মূল প্রবচন পুনরায় আরম্ভ করে দিতেন।

আমি যদি পূর্বে আলোচিত কোন বিষয় নিয়ে রিনপোছেকে প্রশ্ন করতাম তিনি আমাকে আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তির জন্য তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করতেন। আমার মনে পড়ে একবার একটি পরিভাষার অর্থ জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রিনপোছে তৎক্ষণাৎ বলেছিলেনঃ “সাত বছর আগে এই শব্দটি তোমাকে ব্যাখ্যা করেছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে। তোমার মনে নেই কেন?” এমনকি তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, তাঁর বয়স যত বেড়েছে মন ততই স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে।

আরও নির্ভুল শব্দাবলীর সন্ধানে আমার সঙ্গে কাজ

সেরকোং রিনপোছে শুধুমাত্র আমার স্মরণশক্তির উন্নতির ব্যাপারেই নয় অনুবাদের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির বিষয়েও আগ্রহী ছিলেন। পাশ্চাত্যবাসীদের শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি অনুভব করেছিলেন যে, নির্দিষ্ট পারিভাষিক শব্দের ত্রুটিপূর্ণ অনুবাদের কারণে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ফলস্বরূপ তিনি আমার সঙ্গে ইংরেজি-ভাষায় নতুন পারিভাষিক শব্দাবলী তৈরির জন্য কাজ শুরু করেন। তিনি ধৈর্য সহকারে তিব্বতী সংজ্ঞার ব্যাখ্যা করে সেগুলির যথার্থ সম্ভাব্য ইংরেজি শব্দগুলি জানতে চান। এইভাবে তিনি উপযুক্ত অর্থ অনুসারে শব্দাবলীগুলি সাজানোর জন্য প্রয়াস করেছিলেন। তিনি আমাকে সর্বদা নতুন শব্দাবলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে উৎসাহিত করতেন। চিরাচরিত ব্যবহৃত শব্দের প্রয়োগ মেনে নেওয়া দাসত্বেরই সমান এবং সেইজন্য সেটাকে অস্বীকার করতে বলতেন। সংস্কৃত থেকে বৌদ্ধ গ্রন্থ অনুবাদ করার জন্য ব্যবহারযোগ্য তিব্বতী শব্দাবলী কয়েক শতাব্দী ধরে ধীরে-ধীরে বিকশিত হয়েছিল। পাশ্চাত্য ভাষায় অনুবাদ করার সময় একই সংশোধন প্রক্রিয়া ঘটবে এটাই স্বাভাবিক ছিল। 

আমাকে সামাজিক কুশলতা এবং নম্রতার শিক্ষাদান

প্রাথমিকভাবে আমি যখন রিনপোছেকে আমাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলাম ঐ সময় আমি তাঁকে উপায় কুশলের উপর শিক্ষাদান করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। অর্থাৎ কীভাবে করুণা এবং বুদ্ধির সাথে অপরের সহায়তা করা যায়। একটি অভিজাত শৈক্ষিক পরিবার থেকে আসার ফলে যদিও সেখানে আমি সবসময় শ্রেষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছিলাম, তাসত্ত্বেও আমার ব্যক্তিত্বের বিকাশ একতরফা ঘটেছিল। অতএব আমার সামাজিক কুশলতা এবং নম্রতার বিষয়টা শেখার প্রয়োজন ছিল। এই কারণে রিনপোছে আমাকে একটা মাত্র নামে ডাকতে লাগলেন- ‘পুতুল’, পাশাপাশি অব্যর্থভাবে আমার বোকামি এবং ত্রুটিপূর্ণ কাজ যেগুলো আমি করতাম সেগুলি ধরিয়ে দিতে লাগলেন। উদাহরণস্বরূপ, অনুবাদের কাজ করার সময় রিনপোছে জোর দিতেন যাতে আমি বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারি। যখনই কাজে ত্রুটি হতো তিনি আমাকে বোকা বলতে থামতেন না তাতে যত সময়ই লাগুক না কেন বা আমি বিব্রত হয়ে যেতাম না কেন। আমি কোন শব্দের অর্থ সঠিক ভাবে না বুঝলে এবং সঠিক অনুবাদ না করলে তিনি কখনই বাদ দিয়ে এগোতে দিতেন না। যদিও নিম্ন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের পক্ষে এই ধরণের শিক্ষা পদ্ধতি উপযুক্ত নয়। তবু তাঁর এই আপোসহীন পদ্ধতি আমার পক্ষে পুরোপুরি ভাবে উপযুক্ত ছিল। 

একবার রিনপোছে ফ্রান্সের ল্যভরে একটা জটিল গ্রন্থের ভাষ্যের উপর উপদেশ দিয়েছিলেন। আমি যখন সেটাকে অনুবাদ করতে বসেছিলাম তখন রিনপোছে আমাকে ঐ ভাষ্যের কয়েকটি সংস্করণের মধ্যে তুলনা করে গ্রন্থটি সম্পাদনা করতে বলেছিলেন। আমার কাছে কোনও কলম ছিল না। ঐ সময় ঠিক আমার মুখোমুখি একজন উজ্জ্বল লাল রঙের চুলযুক্ত মহিলা বসেছিলেন। তিনি চিত্তাকর্ষক লাল লিপস্টিক ব্যবহার করেছিলেন এবং পুরো শিক্ষাদানের সময় দাঁতে লাল গোলাপ ধারণ করেছিলেন। আমি জানতে চেয়েছিলাম কারও কাছে একটা অতিরিক্ত কলম আছে কিনা, তাহলে সেটা আমি ধার করতে পারি। সেই মহিলা তার কলমটি দিয়েছিলেন। অধিবেশনের কাজ শেষ হওয়ার পর আমি সম্পূর্ণভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর যখনই উঠে দাঁড়ালাম সেই মহিলা কোনও কথাবার্তা না বলে তাঁর হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি নিজেকে নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিলাম যে, ভেবেছিলাম ভাল কাজ করার জন্য তিনি আমার সাথে করমর্দন করে আমাকে অভিনন্দন জানাতে চাইছিলেন। প্রত্যুত্তরে আমিও যখন হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম, রিনপোছে চিৎকার করে উঠেছিলেন, “পুতুল, তার কলম ফিরিয়ে দাও।”

প্রশংসা লাভের কোনও আকাঙ্ক্ষা ছাড়া শুধু অপরের সহায়তা করার বিষয়ে শিক্ষাদান

আমার আত্মকেন্দ্রিকতাকে প্ররোচিত করার জন্য রিনপোছে আমাকে শুধু অপরের জন্য কর্ম করতে শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমি আমার জন্য ব্যক্তিগত শিক্ষা বা অভিষেক প্রদানের জন্য অনুরোধ করলেও তিনি তাতে রাজি না হয়ে এ সব করতেন। অন্য কেউ অনুরোধ করলে তিনি সম্মতি দিতেন এবং আমাকে সেখানে অনুবাদক হতে হতো। যে বিষয়গুলি আমার শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন রিনপোছে সেগুলি পৃথকভাবে শিখিয়েছেন।  

আরও, রিনপোছে আমার সামনে কখনও প্রশংসা করেননি তবে সবসময় তিরস্কার করতেন। আমি যাতে সমালোচনা এবং চাপের মুখে অবিচলিত থাকতে পারি, সেইজন্য এই কাজটি তিনি বিশেষভাবে অন্যের সামনে করতেন। সত্যি কথা বলতে গেলে, আমার মনে পড়ে রিনপোছে একবারই আমাকে একত্রে পশ্চিমা সফর শেষ করবার শেষে আমার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন। এইভাবে আবেগপূর্ণ শক্তিশালী উপায়ে রিনপোছে আমাকে শুধু অন্যের হিতার্থে উদ্বুদ্ধ হতে শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেটি প্রশংসা পাওয়া বা শিক্ষককে তুষ্ট করার জন্য নয়। আমি লক্ষ্য করলাম তাঁর ধন্যবাদ পাওয়ার আশা, পোষ্য কুকুর যেমন তার মাথায় প্রভুর হাতের স্পর্শ পাওয়ার আশা করে থাকে। অতএব আমি দ্রুত কোন অনুমতির আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করলাম। অতএব তাসত্ত্বেও তিনি যদি আমার প্রশংসাও করতেন আমার লেজ নাড়ানো ছাড়া কী বা করার ছিল। 

আমাকে মহান তিব্বতী গ্রন্থ অধ্যয়ন করবার জন্য অনুপ্রাণিত করা

রিনপোছে সর্বদা মানুষকে মহান শাস্ত্রগুলি নিজে পড়তে শেখার জন্য উৎসাহ দিতেন। কারও মনে দ্বিধা বা প্রশ্ন থাকলে রিনপোছে সেই ব্যক্তিকে সেগুলি দেখানো এবং সংশোধনের জন্য থাকতেন। তিনি ব্যাখ্যা করতেন শিক্ষাগুলি তিনি নিজে তৈরি করেননি কিন্তু সেগুলি উপযুক্ত উৎস থেকেই এসেছে। রিনপোছে এটাও বলেছিলেন যে, কেউ যেন আশা না করে একজন লামা তাকে সব শিক্ষা দেবে। তদুপরি, তিনি পাশ্চাত্য দেশীয়দের পরম পূজ্যজীর বিবৃতিটি বারংবার বলতেন যে পরবর্তী দুই-শত বছর বুদ্ধের সম্পূর্ণ শিক্ষা কেবল তিব্বতী ভাষাতেই উপলব্ধ হবে। সেই কারণে তিনি পাশ্চাত্যদেশীয় শিষ্যদের তিব্বতী শিখতে জোরালোভাবে উৎসাহ দিতেন। তিনি বলেছেন প্রতিটি তিব্বতী বর্ণ অর্থপূর্ণ। সেই কারণে শিক্ষা প্রদানের সময় প্রায়ই রিনপোছে তিব্বতী শব্দাবলী ব্যাখায়িত করতেন। 

এই পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রিনপোছে আমাকে গ্রন্থগুলি পড়তে বলতেন এবং কোন প্রশ্ন থাকলে সেটি করার অনুমতিও দিতেন। তিনি বলেছিলেন এইভাবে অগ্রসর হলে শিষ্যরা বৌদ্ধ সাহিত্যের সর্বত্র বিচরণ করতে পারবে; সমুদ্রে সাঁতার কাঁটার মতো বা আকাশ পথে বিচরণকরার মতো, তিনি তাদের কী শিক্ষা নিতে হবে বা পড়তে হবে তাঁর নির্দেশ দিতেন। তারপর তিনি শিষ্যদের বাসস্থান থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে পথ চলার জন্য মুক্ত ক’রে দিতেন। 

তাঁর উপর নির্ভরশীল না হয়ে পড়ার শিক্ষা

তাঁর উপর কোনও ভাবেই যাতে নির্ভরশীল না হয়ে পড়ি আমাকে সেই শিক্ষা দেওয়ার জন্য রিনপোছে অনেকগুলি পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- যদিও রিনপোছে এবং আমার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল, তবুও সব পরিস্থিতিতে আমাকে সাহায্য করতে সক্ষম হওয়ার ভান করেননি। একবার আমি বেশ অসুস্থ ছিলাম এবং যে ওষুধগুলি গ্রহণ করছিলাম সেগুলি কাজ করছিল না। আমি যখন রিনপোছের কাছে ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা জানতে চেয়েছিলাম- পাশ্চাত্য দেশীয় চিকিৎসা, তিব্বতী বা ভারতীয় কোনটি গ্রহণযোগ্য এবং কোন চিকিৎসকের উপর নির্ভর করা ভাল তখন তিনি বলেছিলেন এই মুহুর্তে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অস্পষ্ট। পরিবর্তে তিনি এক মহান লামার কাছে পাঠালেন যিনি আমাকে উপযুক্ত চিকিৎসা দ্বারা সাহায্য করলেন। আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলাম।

আমাকে প্রস্তুত করা হচ্ছিল পরম পূজ্য দালাই লামার অনুবাদ করবার জন্য

বেশ কয়েক বছর পর আমি বুঝতে পারি পরম পূজ্যের জন্য অনুবাদ করার জন্য রিনপোছে আমাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। এমনকি কখনও মনে হত, তাঁর সামনে উপহার দেওয়ার জন্য রিনপোছে আমাকে প্রস্তুত করছিলেন। ভালোভাবে সেবা করার জন্য আমাকে কখনও তাঁর সঙ্গে আবদ্ধ বা তাঁর উপর নির্ভর করতে হয়নি। বরং তাঁর বহু গল্‌ফ ক্লাবগুলির মধ্যে একটির মতো হয়ে উঠতে হয়েছিল এবং পরম পুজ্যজী তাঁর অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে নির্বাচিত করেছিলেন। আমাকে প্রচণ্ড চাপের মুখোমুখি হতে হয়েছিল এবং নিজের অহংকারকে কাটিয়ে উঠতে হয়েছিল। 

এইভাবেই একজন দালাই লামাকে যথাযথভাবে পরিবেশন করার সময় কেমনভাবে সঠিক আচরণ করতে হয় সেটা রিনপোছে আমাকে শিখিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, পরম পূজ্যের অনুবাদকগণ কখনোই তাদের হাত নৃত্যের মতো নাড়াবে না; চিড়িয়াখানায় যেমন ভাবে দৃষ্টিক্ষেপ করা হয়। তাঁর দিকে সেভাবে তাকাবে না। পরিবর্তে নতমস্তকে, একাগ্রচিত্তে থাকবে এবং নিজ ব্যক্তিত্বের কোন কিছুই যুক্ত করবে না। তারা পরম পূজ্যের নির্দেশ অনুসারে মানুষের তালিকা তৈরি করবে, কোনরকম পরিবর্তন করবে না, অথবা পরম পূজ্যের কোন বক্তব্য অর্থহীন বা উদ্দেশ্যহীন বলে মনে করবে না।

যেমন পরম পূজ্যের ব্যবহার করে থাকেন লামার উপাধির অনুবাদ সর্বদা সঠিক করা উচিত এবং বিদেশিরা যেমন প্রায় সব লামাকেই পরম পূজ্য বলে থাকেন তেমন নয়। এই লামাদের সম্মানিত করার পরিবর্তে পাশ্চাত্য প্রথা দালাই লামার সম্মান হ্রাস করেছে। প্রকৃতপক্ষে এই লামারা যদি জানতেন যে বিদেশিরা দালাই লামার সঙ্গে এক আসনে উল্লেখ করছে তাহলে তারা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠতেন। ক্যাথলিক চার্চে এবং কূটনৈতিক সৈন্যদলের মতো তিব্বতী মুসাবিদা এবং এর শ্রেণিবদ্ধ ব্যবহার কঠোর অনুশাসন মেনে চলে। 

আমি যখন পরম পূজ্যের জন্য অনুবাদ কার্য করতাম প্রায় সেরকোং রিনপোছে আমার বিপরীতে বসে থাকতেন। তাঁকে এইভাবে দেখা তাঁর প্রশিক্ষণের বিষয়টি স্মরণে রাখতে সাহায্য করত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একবার ধর্মশালায় অনুবাদকার্য চলাকালীন প্রায় একশত পাশ্চাত্য দেশীয় দর্শক এবং কয়েক হাজার তিব্বতী দর্শকের সামনে পরম পুজ্যজীর আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন এবং সহাস্যে গর্জন ক’রে উঠেছিলেন, “সে একটা ভুল করেছে।” পরমপূজ্য ইংরেজি ভালোভাবে বুঝতেন। তবুও পিপীলিকার মতো গালিচার নীচে লুকিয়ে থাকতে চাইতেন, রিনপোছে আমার দৃষ্টির ক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে নির্বোধকে তাঁর অনুবাদক হিসেবে সাহায্য করতেন।

আমার মূর্খ আচরণ সংশোধন করার জন্য কঠিন পদ্ধতির ব্যবহার 

কখনো-কখনো জোরালো ভাবে আমার পাঠ মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রথম দিকে আমি একবার পরম পূজ্যের উপদেশের জন্য অনুবাদ কার্য করছিলাম। তিনি বৌদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষের নীচে দশ হাজার মানুষের সামনে শিক্ষাদান করেছিলেন। আমার মাইক্রোফোনটি কাজ করছিল না, পরম পুজ্যজী আমাকে কার্যতঃ স্তোত্র পাঠকের কোলে চাপতে বাধ্য করেছিলেন, যাতে তাঁর মাইক্রোফোনটি ব্যবহার করতে পারি। এটাও কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। পরম পূজ্যজী তাঁর সিংহাসন এবং প্রথম সারিতে বসা রিনপোছের মধ্যবর্তী স্থানে আমাকে ভূমির উপর বসিয়ে দিলেন। আমার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমি দুই হাত ব্যবহার ক’রে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক কাজ করার পরিবর্তে এক হাত ব্যবহার ক’রে মাইক্রোফোনটি নিয়েছিলাম এবং ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর এইভাবে বানরের কলা গ্রহণ করার মতো করে মাইক্রোফোন নেওয়ার কারণে রিনপোছে আমাকে কার্যত প্রহার করেছিলেন।

শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পরমপূজ্য দালাই লামার যথাযথ শিষ্টাচার

পাশ্চাত্যদেশীয়রা যাতে নিজের আলোকে পরম পুজ্যের সম্মুখে উপস্থাপিত হতে পারে সে ব্যাপারে রিনপোছে যত্নবান ছিলেন। পরম পুজ্যের জন-শিক্ষাদানে তাদের আচরণ প্রায় তাঁকে প্রভাবিত করত। তিনি বলতেন যে ‘পরম পূজ্য’ কে সেটা উপলব্ধি করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কোন সাধারণ লামার ‘পুনর্জন্ম’ নন। তাঁর উপস্থিতি বিশেষ সম্মান এবং বিনয় প্রদর্শনের অপেক্ষা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, কোন অভিষেক বা ধর্মোপদেশের বিরতি পর্বে পরম পূজ্যের দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর উপস্থিতিকে উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে এবং গল্প করার মধ্যে চরম অভদ্রতা রয়েছে। যে কোন আলাপচারিতার জন্য বাইরে যাওয়াই হল যথাযথ শিষ্টাচার।

একবার পাশ্চাত্য দেশীয় এক বৌদ্ধ সংস্থার অর্থ আনুকূল্যে ধর্মশালায় পরমপূজ্যের একটি ধর্মোপদেশ অনুবাদ কার্যে আমি নিযুক্ত ছিলাম। পরম পূজ্য লিখিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। প্রতিটি অধিবেশনের পরে রিনপোছে আমাকে পরবর্তী দিনের জন্য জমা দেওয়া প্রশ্নগুলি পড়তে বলতেন এবং বোকা অথবা তুচ্ছ প্রশ্নগুলি বাতিল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন। রিনপোছে প্রায়শই প্রশ্নগুলি পুনরায় লিখতে বা সংশোধন করতে বলতেন, যাতে তারা আরও গভীরতর হয়ে উঠতে পারে। তাদের পক্ষ থেকে পরম পূজ্যের সময় নষ্ট করা উচিত নয় বা তাঁর উত্তর থেকে অনেক মানুষের লাভ প্রাপ্ত করার সুযোগ নষ্ট করা উচিত নয়। পরম পূজ্য প্রায়শই প্রশ্নগুলি কতটা অসাধারণ এবং গভীর সেই নিয়ে মন্তব্য করতেন। আমি যখনই পরম পূজ্যের সঙ্গে ভ্রমণ করেছি তখনই পরম পূজ্যের কাছ থেকে এই সম্পাদন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে শিখেছি। 

Top