তান্ত্রিক সাধকদের জন্য সেরকোঙ্‌ রিনপোছের পরামর্শ

“খন্ডকালীন” ঐকান্তিক তান্ত্রিক ধ্যান করা

যদিও দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত পূর্ণকালীন ঐকান্তিক ধ্যানটা লাভজনক, তবে বেশীর ভাগ মানুষের মধ্যে এগুলি গ্রহণ করার কোনও বিলাসিতা নেই। যে সমস্ত মানুষ মনে করে যে, যদি তাদের কাছে তিন মাস বা তার বেশী সময় থাকে তাহলে তারা কেবল এই ধরণের ঐকান্তিক ধ্যান করতে পারে, রিনপোছে এদের সংকীর্ণ মনের মানুষ ভাবেন।

ঐকান্তিক ধ্যান মানে অন্যদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার সময়কে বোঝায় না, বরং একটা অনুশীলনের সাথে আমাদের মনকে নমনীয় করে তোলার জন্য নিবিড় অনুশীলনের সময় কাল। প্রতিদিন সকালে একটা অধিবেশন করা এবং অন্যদিকে সারাদিন একটা সাধারণ জীবন-যাপন করাটা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য। রিনপোছে নিজেই নিজের অনেকগুলো ঐকান্তিক ধ্যান এইভাবে করেছিলেন, কেউ কখনও জানতেও পারেনি যে তিনি একটা ধ্যান করছেন।

সাধনার এই পদ্ধতি সম্পর্কে একমাত্র নিষেধাজ্ঞাগুলি হ’ল- একই শয্যায় ঘুমোনো এবং ঐকান্তিক ধ্যান চলাকালীন একই জায়গায় একই আসনে ধ্যান করা। অন্যথা আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করার গতি ভেঙ্গে যায়। এছাড়াও, প্রতিটি অধিবেশনে অন্ততঃ পক্ষে মন্ত্র জপ, প্রণাম বা কিছু অন্যান্য পুনরাবৃত্তি সাধনার নিম্নতম সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত থাকতে হয়। সুতরাং রিনপোছে প্রাথমিক অধিবেশন চলাকালীন নির্বাচিত সাধনার কেবল তিনবার পুনরাবৃত্তি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এইরকম করলে একটি গুরুতর অসুস্থতা, ঐকান্তিক সাধনার ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করা এবং প্রথম থেকেই আবার শুরু করার জন্য বাধ্য করে না।

যখন প্রয়োজনীয়তা ঐকান্তিক সাধনার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে

যাইহোক সব ধরণের বৌদ্ধ শৃঙ্খলার (শীল) মতো “প্রয়োজনীয়তা কখনও-কখনও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে”, তবে কেবল খুব বিশেষ পরিস্থিতিতে। একবার ধর্মশালায় ঐকান্তিক ধ্যানের মাঝামাঝি সময়, আমি একটা অভিষেক এবং প্রবচন অনুবাদ করার অনুরোধ পেয়েছিলাম। ঐ অভিষেক এবং প্রবচনটি পরম পূজ্য দালাই লামা ভারতের অন্য একটি হিমালয়ী শহর “মানালী”-তে দিচ্ছিলেন। এই বিষয়ে আমি রিনপোছের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম। রিনপোছে আমাকে কোনও নির্দ্বিধা বা নিঃসংশয়ে সেখানে যেতে বলেছিলেন। সম্ভবতঃ আমি যা কিছু করতে পারতাম তার চেয়ে বেশী উপকার হতো পরম পূজ্যকে সহযোগিতা করলে। আমি নূন্যতম সংখ্যার মন্ত্র জপ ক’রে এবং প্রতিদিন একটা ধ্যানের অধিবেশন না ক’রে আমার সাধনার গতিবেগ ভঙ্গ করতাম না। এটা করার জন্য আমি নির্ধারণ করে রেখেছিলাম আর এই পদ্ধতিটি অনুসরণও করেছিলাম। পরম পূজ্যের সাথে দশ দিন কাটানোর পর আমি ধর্মশালায় ফিরে এসে আমার ঐকান্তিক সাধনা সম্পন্ন করেছিলাম।

যথাযথভাবে আচার-বিধির পদ্ধতি অনুসরণ করা

রিনপোছে সর্বদা জোর দিয়েছিলেন যে, আচার-বিধির পদ্ধতিগুলি হ’ল উদ্দেশ্যমূলক এবং গভীর। সেগুলি সঠিকভাবে অনুসরণ করা প্রয়োজন। যেমন- ঐকান্তিক সাধনার জন্য নির্দিষ্ট মন্ত্রগুলি নির্দিষ্ট সময় বারবার জপ করা প্রয়োজন। সেটা শেষ হয়ে গেলে একটি “অগ্নি-পূজা (হোম)” সম্পন্ন করতে হয়। “অগ্নি-পূজা” একটি জটিল আচার-বিধি যা আগুনে বিশেষ দ্রব্য অর্পন করে করতে হয়। এই আচার-বিধির উদ্দেশ্য হ’ল- সাধনায় কোনও ত্রুটি থাকলে সেটা পূরণ করতে হয় এবং আমরা কোনও ভুল করলে সেটা শুদ্ধ করতে হয়।

কিছু নির্দিষ্ট ঐকান্তিক সাধনা বিশেষ করে কঠিন হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমি একবার ঐ ধরণের অনুশীলন করেছিলাম। তার জন্য এক মিলিয়ন বার একটা মন্ত্র জপ করতে হয়েছিল। তারপরে বিস্তৃত অগ্নি-পূজার সময় দশ হাজার জোড়া লম্বা ঘাসের নল অর্পন করতে হয়েছিল এবং প্রতিটি জোড়ার সাথে একটা মন্ত্র জপ করতে হয়েছিল। সমস্ত দশ হাজার জোড়া বিনা বিরতিতে এক আসনে আসীন হয়ে আগুনে নিক্ষেপ করতে হতো। কিন্তু ঐকান্তিক সাধনা সমাপ্ত হওয়ার পর আমি যখন আমার অগ্নি-পূজা সম্পাদন করি তখন ঘাসের নল প্রয়োজনীয় সংখ্যার চেয়ে কয়েকটা কম পড়ে যায়। বাকি আচার-বিধি শেষ করে আমি রিনপোছেকে খবর দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে কয়েকদিন পরে পুরো অগ্নি-পূজাটার পুনরাবৃত্তি করতে বলেছিলেন। তদনুসারে আবার আমি দশ হাজার জোড়া ঘাসের নল প্রস্তুতের জন্য নিশ্চিত করেছিলাম।

যেহেতু আচার-বিধি বিশেষজ্ঞরা সবসময় উপলব্ধ হয় না, সুতরাং রিনপোছে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর উন্নত পাশ্চাত্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন যে, তারা নিজেরা কীভাবে অগ্নি-পূজা করতে পারে। এর মধ্যে ছিল কীভাবে অগ্নিকুন্ড তৈরী করতে হতো এবং রঙিন চূর্ণ দিয়ে অগ্নিকুন্ডের মেঝেতে প্রয়োজনীয় মন্ডলের নক্সা আঁকতে হতো। এমনকি পাশ্চাত্যরা তাদের নিজস্ব ভাষায় উপলব্ধ না থাকলেও ঐ আচার-বিধি অন্য কারও দ্বারা পাঠ করাতে পারত। রিনপোছে একথাও ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ঐগুলি পাঠ করানোর পর তাদের বিভিন্ন দ্রব্যগুলি আগুনে নিজেদের অর্পন করতে হতো। দলবদ্ধ ঐকান্তিক সাধনা করার ক্ষেত্রেও এটা সঠিক ছিল।

যাইহোক পদ্ধতিগুলি সঠিকভাবে অনুসরণ করাটা কোনও ব্যবহারিক পদ্ধতির সাথে দ্বন্দ্ব করে না। উদাহরণস্বরূপ, তান্ত্রিক ঐকান্তিক সাধনা শুরু করা হয় বাড়ির বেদিতে বিশেষ নৈবেদ্যর ব্যবস্থা করে। তারপরে বিঘ্ন নিবৃত্ত করার জন্য প্রত্যেক পরবর্তী দিন তাদের উৎসর্গ করা হয়। বিঘ্নগুলো হস্তক্ষেপকারী ভূত-প্রেত রূপে দৃষ্টিগোচর করা হয় এবং নৈবেদ্যর অংশ গ্রহণের প্রতিদিন তাদের আমন্ত্রন জানানো হয়। রিনপোছে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, বাক্স বা কুকিজের বয়ামগুলি এই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত পারম্পারিক অলঙ্কৃত বলির (তোরমা) পরিবর্তে নিখুঁতভাবে গ্রহণযোগ্য।

অযোগ্য অবস্থায় উন্নত সাধনাগুলি অনুশীলনের চেষ্টা করা এড়ানো

যখন মানুষ অযোগ্য অবস্থায় উন্নত সাধনাগুলি অনুশীলন করার চেষ্টা করত রিনপোছে তাতে সন্তুষ্ট হতেন না। যেমন- কিছু মানুষ অনিচ্ছুক বা লম্বা সাধনা করতে অনাগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও তারা নিষ্পন্নক্রম সাধনা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা এতে আয়ত্ত করতে বিফল হয়ে যায়। অনুত্তরযোগ-তন্ত্র হ’ল তন্ত্রের সর্বোচ্চ শ্রেণীর তন্ত্র। এর অনুশীলনের দুটি ক্রম আছে, যথা- উৎপত্তিক্রম এবং নিষ্পন্নক্রম। পূর্ব ক্রমটির সাধনার মাধ্যমে কল্পনা এবং সমাধি বলের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরবর্তী ক্রমটি আসল স্ব-রূপান্তর ঘটাতে শরীরের সূক্ষ্ম শক্তি ব্যবস্থার সাথে কাজ করার জন্য চিত্তের বিকশিত বল প্রয়োগ করা হয়। সাধনা অনুশীলনের মাধ্যমে প্রাপ্ত দক্ষতা ছাড়াই চক্র, নাড়ি এবং সূক্ষ্ম বায়ু-শক্তি ব্যবস্থার সাথে কাজ করাটা একটা হাস্যকর অভিনয় হয়ে দাঁড়ায়।

রিনপোছে সাবধান করেছিলেন যে, উন্নত তন্ত্র-সাধনা যদি কোনও অযোগ্য ব্যক্তি দ্বারা ভুলভাবে অনুশীলন করা হয়, তাহলে সেটা খুবই ক্ষতিকারক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, চেতনা-সংক্রমণ (ফোআ)-এর সাধনার ক্ষেত্রে নিজের চেতনাকে মৃত্যুর প্রত্যাশায় মাথার শীর্ষ স্থান দিয়ে অভিক্ষেপ করার কল্পনা করা হয়। সাধনা যথাযথ না হলে এটা সাধকের আয়ু কমিয়ে দিতে পারে। রসাদান বড়ি গ্রহণ করে একজন ব্যক্তি কয়েক সপ্তাহ ধরে উপবাস থাকে এবং পবিত্র রসাদান বড়িও উপর জীবিত থাকে। এটা যদি বিশেষ করে কোনও গোষ্ঠীতে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে ঐ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। এছাড়াও, এই ধরণের সাধক আহার এবং জলের অভাবে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, এমনকি মারাও যেতে পারে।

তান্ত্রিক ঐকান্তিক সাধনা স্বয়ংই একটি উন্নতমানের সাধনা। রিনপোছে অনুশীলনকারীদের অপরিপক্ক অবস্থায় প্রবেশের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, কখনও-কখনও অনুশীলনকারীরা এক লক্ষ মন্ত্র পাঠ করার জন্য একটা ঐকান্তিক সাধনায় অংশ নেয় কিন্তু সেই সাধনার বিষয়ে তারা একেবারেই অপরিচিত। তারা মনে করে যে, ঐকান্তিক সাধনার সময় তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। যদিও অধ্যয়নে একটা নিবিড় সময় ব্যয় করা এবং কোনও একটা সাধনায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া লাভজনক, কিন্তু আনুষ্ঠানিক তান্ত্রিক ঐকান্তিক সাধনা করার সময় এই কাজটা করলে হয় না। যেমন- যে ব্যক্তি সাঁতার কাটতে জানে না সে প্রতিদিন বারো ঘন্টা পুলে অনুশীলন করে প্রশিক্ষণ শুরু করে না। এই ধরণের নির্বোধতা শুধু বাধা এবং ক্লান্তির দিকে নিয়ে যায়। একজন শীর্ষ ক্রীড়াবিদ হওয়ার জন্য অভিজ্ঞ সাঁতারুদের ক্ষেত্রে নিবিড় প্রশিক্ষণ সীমাবদ্ধ থাকে। তান্ত্রিক ঐকান্তিক ধ্যানের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম।

আমাদের সাধনা সম্পর্কে অহংকার ত্যাগ করা

তদুপরি তান্ত্রিক সাধনা ব্যক্তিগত থাকা প্রয়োজন, অন্যথা অনেক হস্তক্ষেপ দেখা দিতে পারে। রিনপোছে দেখেছিলেন যে, অনেক পাশ্চাত্য লোকজন তাদের সাধনা এবং কৃতিত্ব কেবল নিজের কাছে ধরে রাখেনি বরং তারা সেটা নিয়ে গর্বও করেছিল। তিনি বলেছিলেন যে, নির্দিষ্ট বুদ্ধ-কায়ের একজন মহান যোগী-সাধক হওয়ার বিষয়ে অহংকার করা একেবারে অযৌক্তিক। কারণ প্রত্যেকেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রগুলি কয়েক লাখ বার পাঠ করে সংক্ষিপ্ত ঐকান্তিক সাধনা করছে বা করেছে। যখন নির্ধারিত দীর্ঘ সাধনা প্রতিদিন অনুশীলন না করা হয় তখন আরও ভন্ডামি ও অহংকারী হওয়াটা হ’ল বেশী করুণ। রিনপোছে সবসময় ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, দীর্ঘ সাধনা প্রাথমিক সাধকদের জন্য। এই সাধনাগুলিতে প্রায়শই শতাধিক পৃষ্ঠা থাকে এবং দৃশ্যায়নগুলি হয় লম্বা গীতিনাট্যের লিপির মতো। ক্ষুদ্র এবং সংক্ষিপ্ত সাধনাগুলি উন্নত সাধকদের জন্য নির্ধারিত যারা সম্পূর্ণ সাধনার সাথে এতটাই পরিচিত যে কেবল কয়েকটা শব্দ পাঠ করার সময় তারা সমস্ত দৃশ্যায়ন এবং পদ্ধতি পূরণ করতে পারে।

রিনপোছে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, পাশ্চাত্যদের শুরু থেকেই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা সমস্ত শিক্ষা এবং নির্দেশনা গ্রহণ করার প্রবণতা রোধ করা দরকার, বিশেষ করে তন্ত্র সম্পর্কিত শিক্ষা। মহান ভারতীয় এবং তিব্বতী আচার্যগণ স্পষ্ট ভাবে গ্রন্থ প্রণয়ন করার জন্য পুরোপুরি সক্ষম ছিলেন। তবুও তারা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে অস্পষ্ট পদ্ধতিতে রচনা করেছিলেন। তান্ত্রিক উপাদানকে খুব পরিষ্কার এবং সুলভ করাটা সহজেই হস্তক্ষেপ এবং সাধনার অধঃপতনের কারণ হতে পারে। যেমন- মানুষ শিক্ষাগুলি মর্যাদাপূর্ণ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু তার জন্য গম্ভীর প্রচেষ্টা নাও করতে পারে।

বৌদ্ধ শিক্ষাগত কৌশলটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হ’ল অপরকে প্রশ্নের অর্থ বোঝানো। যদি শিক্ষার্থীরা সত্যিই আগ্রহী হয় তাহলে তারা আরও স্পষ্ট করার জন্য অনুরোধ করবে। যারা “আধ্যাত্মিক পর্যটক” এবং যারা আলোকিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কঠোর পরিশ্রম করতে আগ্রহী না এটি স্বয়ংক্রিয় ভাবে তাদের নিড়িয়ে দেয়। তবে তন্ত্রগুলির উদ্দেশ্য যদি মানুষের বিকৃত এবং নেতিবাচক প্রভাব দূর করা হয়, তাহলে পরম পূজ্য দালাই লামা এর স্পষ্ট ব্যাখ্যার সমর্থন করেছেন। এগুলি কেবল তত্ত্বের জন্য সম্পর্কিত হতে পারে কিন্তু বিশিষ্ট বুদ্ধকায়ের নির্দিষ্ট সাধনার জন্য নয়। একটা স্পষ্ট “কীভাবে এটা করা যায়” নামক সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ কোনও গুরুর রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই উন্নতমানের সাধনা করার মানুষ উৎসাহিত করতে পারে, কিন্তু সেটা খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

ধর্ম-রক্ষকদের হালকাভাবে না নেওয়া

রিনপোছে সাবধান করেছিলেন যে, সবচেয়ে বিপজ্জনক হ’ল- ধর্ম-রক্ষকদের হালকাভাবে নেওয়া। বাস্তবে ধর্ম-রক্ষকরা হ’ল- ক্ষমতাশালী শক্তি; প্রায়শই এরা ভূত-প্রেত, যাদের মহান আচার্যরা দমন করে রেখেছেন। তারা সাধারণতঃ বুদ্ধের শিক্ষা (ধর্ম) এবং আন্তরিক সাধকদের এই হিংস্র প্রাণীদের ক্ষতি এবং বাধা-বিঘ্ন থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ক’রে রেখেছে। শুধুমাত্র মহান যোগীরাই তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।

রিনপোছে প্রায় একজন রক্ষকের গল্প শোনাতেন। ঐ রক্ষকটি নিবেদিত মঠের অনুশীলন রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। নির্ধারিত মঠে শাস্ত্রার্থ চলাকালীন যদি কেউ তন্ত্র সাধনা করার চেষ্টা করত, তাহলে তার জন্য তাকে অসুস্থতা এবং দুর্ঘটনার মতো বাধা-বিঘ্ন ঘটাতে হতো। শুধু মাত্র যে সমস্ত ভিক্ষুরা তাদের ন্যায়শাস্ত্রসম্মত প্রশিক্ষণ শেষ করেছিলেন এবং তারপরে দুটি তান্ত্রিক কলেজের একটিতে আরও অধ্যয়ন করেছিলেন তাদের তন্ত্র সাধনা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তবে সেটা মঠের চার দেওয়ালের মধ্যে নয়।

ঐ সময় একজন গেশে শিক্ষার্থী থাকাকালীন মঠের মাঠে তন্ত্র সম্পর্কিত দগ্ধ-নৈবেদ্য অর্পন করতেন। তিনি নৈবেদ্যটা পাইন গাছের পাতা পুড়িয়ে ব্যবস্থা করতেন। তিনি নিয়মিতভাবে বাধা-বিঘ্ন জর্জরিত থাকতেন। পরে তিনি একটি তান্ত্রিক কলেজে প্রবেশ করেছিলেন। স্নাতক শেষ হওয়ার পর পুনরায় ঐ নৈবেদ্য অর্পন করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি সেটা করেছিলেন মঠের বাইরে অবস্থিত একটা পর্বতের পাশে। কয়েক বছর পর ঐ গেশে যখন শূন্যতা প্রত্যক্ষ নির্বিকল্প জ্ঞান লাভ করেছিলেন, তখন উক্ত রক্ষক একটা দর্শনে তার সামনে উপস্থিত হয়েছিল। উগ্র আকৃতির আত্মাটা ক্ষমা চেয়ে বলেছিল, “আমি দুঃখিত! এর আগে আমাকে আপনার ক্ষতি করতে হয়েছিল। তবে এটা ছিল আপনার মঠের প্রতিষ্ঠাতার কাছে আমার প্রতিশ্রুতির অঙ্গ। এখন যেহেতু আপনি শূন্যতার নগ্ন জ্ঞান লাভ করেছেন, অতএব আমি চাইলেও আপনার কোনও ক্ষতি করতে পারব না।”

রিনপোছে এই উদাহরণটার গুরুত্বকে জোর দিতেন। নিয়ন্ত্রণের জন্য সামর্থ্যের বাইরে গায়ের জোরে বোকামি করলে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তিনি প্রায়শই পরম পূজ্য দালাই লামার উদ্ধরণ প্রস্তুত করতেন। তিনি সব সময় বলতেন যে, ধর্ম-রক্ষকরা হ’ল- ইষ্টদেব বা বুদ্ধকায়ের দাস। যারা অনুত্তরযোগ তন্ত্রের উৎপত্তিক্রমে পূর্ণ রূপে পারদর্শিতা লাভ করেছেন এবং বুদ্ধরূপে আদেশ করার ক্ষমতা রাখেন শুধু তাদের এর সাথে নিযুক্ত হওয়া উচিত। অন্যথা অপরিপক্ক অবস্থায় নিযুক্ত হওয়ার মানে হ’ল- একটা ছোট শিশুর মতো তার নিরাপত্তার জন্য বিশাল বড় সিংহকে ডাকা। সিংহ তো সহজেই শিশুটিকে গ্রাস করে ফেলতে পারে। পরম পূজ্য পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, কর্ম দ্বারা সৃষ্ট কর্মফলই আমাদের সেরা রক্ষক। তদুপরি বুদ্ধ, ধর্ম এবং সর্বোচ্চ উপলব্ধি করা আধ্যাত্মিক সংঘ রূপী ত্রিরত্নের শরণে যাওয়ার ফলে আমরা নিজেদের অকুশল কর্ম করা থেকে রক্ষা করে থাকি।

Top