আমাদের আধ্যাত্মিক শিক্ষক (গুরু)-এর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া
সেরকোঙ্ রিনপোছে সবসময় জোর দিতেন সকল লামাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার জন্য এবং তাদের সময় নষ্ট না করার জন্য। তিনি স্পিতির ধর্মপ্রাণ বা নৈষ্ঠিক মানুষের উদাহরণ এড়ানোর জন্য পরামর্শ দিতেন। তাঁকে আনুষ্ঠানিক ভাবে খাদাক (উত্তরীয়) অর্পণ করার সময় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত এবং তাঁর স্পিতির ভক্তরা প্রত্যেকে একই সময় প্রত্যক্ষ তাঁর সামনে গিয়ে প্রণাম না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকত। এই ধরণের প্রক্রিয়া প্রায়শই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় লেগে যেত। তাছাড়া লামাকে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে রিনপোছে কখনও একটা লম্বা গল্প বলে বা একটা প্রদর্শনী পরিবেশন করে, সেটা কখনও না করতে বলেছিলেন। এমনিতেও তিনি আমাকে এই ধরণের প্রশ্নের আক্ষরিক অনুবাদ না করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, শুধু পয়েন্টটা বলে দিলেই হতো।
এছাড়াও রিনপোছে চাননি যে দর্শনার্থীরা সর্বদা তাঁকে খাদাক (উত্তরীয়) এবং কুকিজের বাক্স অর্পণ করুক, যাকে তিনি “লাউসি (উকুন ভরা)” বাক্স হিসাবে উল্লেখ করতেন। তিনি বলেছিলেন যারা একজন লামাকে নৈবেদ্য অর্পণ করতে ইচ্ছুক, তাদেরকে সত্যিই এমন ভাল কিছু অর্পণ করা উচিত যা সেই ব্যক্তি ব্যবহার করতে পারে বা পছন্দ করে। তদুপরি কেউ যদি তাকে বার বার দর্শন করতে চাইত, যেমনকি আমি করতাম, তিনি তাকে জিনিস আনতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি কিছু চাইতেন না বা তাঁর প্রয়োজন ছিল না।
সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করা এবং যদি কিছু কোনও পরিকল্পনা না করে, তাহলে বিকল্প পরিকল্পনার জন্য প্রস্তুত থাকা
রিনপোছে সব সময় মানুষকে সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সুতরাং মানুষ তাঁকে জাগতিক বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যবাণীর কথা বললে তিনি পছন্দ করতেন না। ভবিষ্যবাণীর জন্য অনুরোধ করা একমাত্র পরিস্থিতিতে উপযুক্ত মনে করা হতো যখন সাধারণ উপায় কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারত না, বিশেষ করে আধ্যাত্মিক বিষয় সম্পর্কে। একবার আমার ভাড়া সম্পর্কে সমস্যা হয়েছিল এবং আমি কী করব সে সম্পর্কে ভবিষ্যবাণী চেয়েছিলাম। রিনপোছে আমাকে তাড়া ক’রে একজন আইনজীবীর সাথে দেখা করতে বলেছিলেন।
তাছাড়া যে কোনও ক্রিয়াকলাপের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে, রিনপোছে সর্বদা কমপক্ষে তিনটি কার্যক্রমের কোর্স প্রস্তুত রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। যদি কেউ কোনও পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয় তাহলে এই ধরণের কৌশল থেকে প্রাপ্ত নমনীয়তা অসহায় আতঙ্ককে প্রতিরোধ করে। বেশ কয়েকটি বিকল্প প্রস্তুত থাকলে আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে নিরাপত্তার অনুভূতি জোগায় যে, তাদের মধ্যে অন্ততঃ একটা তো কাজ করবে।
তাসত্ত্বেও কখনও-কখনও শিষ্যরা ভবিষ্যবাণীর উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠত। এর ফলে তারা নিজেদের জন্য চিন্তা-ভাবনা করতে অক্ষম হয়ে যেত। নিজেদের জীবনের জন্য দায়িত্ব এড়ানো এই ধরণের ব্যক্তিরা কাউকে চান যে তাদের সিদ্ধান্ত যেন তারা নেয়। যদিও বড় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আধ্যাত্মিক শিক্ষকের সাথে পরামর্শ করাটা প্রায়শই সহায়ক হয়, তবে এর সবচেয়ে স্থিতিশীল উপায় হ’ল তাঁর মূল্যকে অভ্যন্তরীণ করে তোলা। ফলে যদি লামা বা শিক্ষক কখনও অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে এই মূল্যগুলো সর্বদা বুদ্ধিমান কর্ম-ধারার নির্ধারণের জন্য সহায়তা করে।
রিনপোছে বিশেষ করে এক শ্রেণীর লোকেদের বিপরীত পরামর্শ দিয়েছিলেন যারা ভবিষ্যদ্বাণী লাভ না করা পর্যন্ত একই প্রশ্ন অনেক লামাদের করতে থাকত। কোন ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য অনুরোধ করা উক্ত লামার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসকে বোঝায়। এর অর্থ হচ্ছে সে ব্যক্তি অর্থাৎ গুরু যা কিছু পরামর্শ দেয় সেটা করতে হয়। এছাড়া লামার কাছে এসে এই ধরণের কথা বলার বিরুদ্ধে রিনপোছে সতর্ক করেছিলেন- “অমুক লামা এটা বা ওটা করতে বলেছেন। আপনি এই বিষয়ে কী মনে করেন? এটা কি আমার করা উচিত?” অন্য একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক ভুল বলার কারণে তাকে খারাপ অবস্থানে রেখে দেওয়াটা প্রশ্নকর্তার সংবেদনশীলতার অভাবকে প্রমাণ করে।
সঠিকভাবে প্রশ্ন করতে শেখা
আসলে বেশীরভাগ পাশ্চাত্য মানুষেরা লামাদের কাছে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে জানে না। তারা যখন রিনপোছের কাছে আসত আর মূর্খতার সাথে তাঁকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করত। রিনপোছে সাধারণতঃ সেগুলো সংশোধন করতেন। উদাহরণ স্বরূপ, যদি কেউ অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগদানের বিষয়টি না জানে, তাহলে এই বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হাস্যকর, “এই অভিষেকে অংশগ্রহণ করা কি ভাল?” এবং যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, “আমার অংশগ্রহণ করা উচিত কি না?”, এর তাৎপর্য হ’ল “আমি অংশগ্রহণ করতে বাধ্য কি না।” অভিষেকে কেউ অংশগ্রহণ করতে বাধ্য নয়। এই ধরণের বিষয় সম্পর্কে আধ্যাত্মিক শিক্ষকের পরামর্শ নেওয়ার পরিবর্তে জিজ্ঞাসা করা ভাল, “আপনি আমায় কী করার পরামর্শ দিচ্ছেন?”
তদুপরি, লামার কাছে গিয়ে, “আমি অভিষেক প্রাপ্ত করতে পারি কি না?”, এই বলে তাঁর কাছ থেকে অভিষেক প্রাপ্ত করার অনুমতি নেওয়া, যে অভিষেকটা তিনি প্রদান করতে চলেছেন, এটা হ’ল বোকামি। এই প্রশ্নটা বোঝায়, “আমি সক্ষম কি না”, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। জিজ্ঞাসা করার সঠিক পদ্ধতি হ’ল, “অনুগ্রহ করে আমি কি অভিষেক প্রাপ্ত করতে পারি?” বিদেশে থাকার জন্য ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর সময় কেবল একজন নির্বোধ ব্যক্তিই জিজ্ঞাসা করবে, “আমি আরও বেশী দিন থাকতে পারি কি না?” অনুরোধ করার পরিপক্ক উপায় হ’ল, “আপনার সদয় অনুমতি নিয়ে আমি আরও বেশ কিছু দিন থাকতে চাই।”
একবার অনুজ্ঞা প্রদানের জন্য ষট্ভূজ মহাকাল নামক আধ্যাত্মিক রক্ষককে আহ্বান করতে টার্নার কয়েক মাস ধরে বারংবার রিনপোছেকে বিরক্ত করছিল। অবশেষে যখন রিনপোছে রাজী হয়ে গেলেন টার্নার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, প্রতিদিনের জপ প্রতিশ্রুতিটি কী হবে। রিনপোছে তাকে বাস্তবিক ভাবে মেরেছিলেন আর বকাবকি করে বলেছিলেন যে, প্রতিশ্রুতি হিসাবে যে কোনও জিনিস করতে ইচ্ছুক হওয়া উচিত।
তাদের তৈরীর আগে প্রতিশ্রুতি পরীক্ষা করা
রিনপোছে খুব অসন্তুষ্ট হতেন যখন পাশ্চাত্য লোকের কোনও অভিষেক সংক্রান্ত মন্ত্র-জপ-প্রতিশ্রুতি নিয়ে রফা করার চেষ্টা করত। সকলের কল্যাণের জন্য বোধি লাভ করতে এই অনুশীলনে নিযুক্ত হওয়ার আন্তরিক ইচ্ছা থাকার কারণে তিনি সর্বদা একটা নির্দিষ্ট বুদ্ধ-কায়ের জন্য অভিষেক প্রাপ্ত করার উপর জোর দিয়েছেন। শুধু রোমাঞ্চকর অনুভূতি অথবা অন্য সবাই অংশগ্রহণ করছে, এই ভেবে যোগ দেওয়াকে তিনি হাস্যকর মনে করতেন। সংক্ষিপ্ত পরিচিত ঐকান্তিক সাধনা করার পর ধ্যান অনুশীলনের বিষয়টি ভুলে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনাকেও তিনি অনুচিত মনে করতেন। একটা নির্দিষ্ট তান্ত্রিক সাধনার প্রতিশ্রুতি তো সম্পূর্ণ জীবনের জন্য।
রিনপোছে জোর দিতেন যে, সাধককে যে আধ্যাত্মিক অনুশীলনে যুক্ত হতে হয় সেই অনুশীলন এবং সম্পর্কিত শিক্ষকদের যেন সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এটা হয়ে যাওয়ার পর আর অপেক্ষা না করতে বলতেন। রিনপোছে পাশ্চাত্যদের মধ্যে এই প্রধান দোষটা দেখতেন। আমরা অকাল থেকেই জিনিসের প্রতি ছুটে যাওয়ার প্রবণতা দেখাই। রিনপোছে এই ধরণের পাগল মানুষের মতো না হতে সতর্ক করেছিলেন যে মানুষটা জমাট বাঁধা বরফের উপর দিয়ে দৌড়ায় এবং তারপরে পিছনে একটা লাঠি দিয়ে পরীক্ষা করে যে, বরফটি তার ওজন বহন করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী কিনা।
রিনপোছে বলেছিলেন যে, মানুষ যে কারও উপদেশ বা শিক্ষায় উপস্থিত থাকতে এবং ভদ্রতার সাথে, এমনকি গুরু বা শিক্ষকের চীবর বা তাঁর কক্ষে বিদ্যমান বুদ্ধ-চিত্রকে প্রণাম করতে পারে। তবে সেই শিক্ষকের শিষ্য হওয়া অবশ্য অন্য বিষয়। এমনকি তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, আমি যে কোন লামার জন্য অনুবাদ করতে পারি। তবে কারও জন্য কাজ করাটা সেই ব্যক্তিকে তার আধ্যাত্মিক শিক্ষক হিসাবে গড়ে তোলে না। এটা সত্য, তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, এমনকি আমি যদি একটা তান্ত্রিক অভিষেকও অনুবাদ করি না কেন যা গণ্য সেটা হ’ল শিক্ষকের প্রতি কারও মনোভাব।
অকালে ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী হওয়া থেকে এড়ানো
রিনপোছে আরও অনুভব করেছিলেন যে, অনেক পাশ্চাত্য মানুষ খুব তাড়াহুড়ো করে ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী হয়ে যায়। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে না যে, এটা কি সত্যিই তাই যা তারা তাদের অবশিষ্ট জীবনের জন্য চায়। প্রায়শই তারা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয় যে তাদের ভিক্ষুত্ব (ভিক্ষু জীবন) তাদের মাতা-পিতাকে কতটা প্রভাবিত করবে বা তারা ভবিষ্যতে কীভাবে সমর্থন করবে। অবশ্যই কেউ যদি অতীতের মহান ত্যাগী সাধকের মতো হয়, তাহলে তাকে তার পরিবার অথবা অর্থ (টাকা-পয়সা)-এর মতো বিষয় নিয়ে ভাবার প্রয়োজন হয় না। তাহলেও আমরা নিজেকে তো চিনি যে, আমরা মিলারেপা কিনা।
এই প্রসঙ্গে রিনপোছে প্রায়শই ড্রুবকাং গেলেক গ্যাছোর দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করতেন। এই মহান তিব্বতী মাস্টার তাঁর যুবাবস্থায় ভিক্ষু হতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার পরিবার অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। সেই কারণে তিনি দুঃখিত হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি তার মাতা-পিতার জীবনকালে তাদের ভাল সেবা করেছিলেন। পরে তারা যখন মারা যায়, তিনি তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি উপযুক্ত উদ্দেশ্যে দান করে দিয়েছিলেন এবং তারপরেই তিনি ভিক্ষু হয়েছিলেন।
রিনপোছে সব সময় আমাদের পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সেবার প্রতি জোর দিতেন। পাশ্চাত্য বৌদ্ধ হিসাবে আমরা চটপটেভাবে প্রত্যেককে পূর্ব জন্মে আমাদের মাতা এবং পিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের ঋণ পরিশোধ করার কথা বলি। তাসত্ত্বেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে, আমাদের মধ্যে অনেকেই এই জীবনকালে মা-বাবার সাথে ভালভাবে আচরণ করতে পারি না। রিনপোছে উপদেশ দিয়েছিলেন, আমাদের মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা, সদয় আচরণ করা প্রকৃতপক্ষে একটা মহান বৌদ্ধ অনুশীলন।
কেউ যদি আগে থেকে সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক’রে একজন ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী হয়ে যায় অথবা কেউ যদি ইতিমধ্যে ভিক্ষুর দীক্ষা প্রাপ্ত করে থাকে, তাহলে রিনপোছে তাকে বাদুড়ের মতো এর মধ্যে অর্ধেক ব্যক্তি না হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। যখন কোন বাদুড় পাখির মধ্যে থাকে তখন পাখিরা যা করে তা সে অনুসরণ করতে চায় না। সে বলে, “ওহ, আমি এটা করতে পারি না। আমার দাঁত আছে।” অন্যদিকে যখন সে ইঁদুরের মধ্যে থাকে তখন সে বলে, “ওহ, আমি এটা করতে পারি না। আমার ডানা আছে।” এই উদাহরণটির মতো কাজ করা হ’ল সুবিধার্থে ভিক্ষুর চীবর ধারণ ও ব্যবহার করা। যখন এই ধরণের মানুষ নির্দিষ্ট কাজকর্ম পছন্দ করে না, যেমন- নিজেকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা, তখন তারা তাদের চীবরের অজুহাত দেখায়। অন্যদিকে, তারা যখন কোনও নির্দিষ্ট ভিক্ষুর কাজ বা নিয়ম পরোয়া করে না, যেমন- ধার্মিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা বা চীবর ধারণ করে ভ্রমণ করা, তখন তারা পাশ্চাত্য হওয়ার অজুহাত দেখায়। রিনপোছে যেমন বলতেন, “আপনি কাকে বোকা বানাচ্ছেন?”
আধ্যাত্মিক অনুশীলনে যুক্ত হওয়ার বিষয়টা চাকরী না পাওয়ার কোনও অজুহাত নয়
রিনপোছে বোঝাতেন, এর অর্থ এই নয় যে বৌদ্ধ সাধক বা অনুশীলনকারীদের কাজকর্ম করা উচিত না। গৃহস্থ বা প্রব্রজিত, যেই হোক না কেন, প্রত্যেককেই ব্যবহারিক হতে হবে এবং মাটিতে বাস করতে হবে। রিনপোছে শিখিয়েছিলেন যে, কীভাবে আমরা আমাদের শরীরকে দখলে রাখি। তার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ কীভাবে আমরা আমাদের মন এবং বাক্ (বাণী)-কে দখলে রাখি। অতএব তিনি নিবিড় সাধকদের ভৃত্যের কাজের জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন যারা নিজেদের সাহায্যের প্রয়োজন মনে করতেন। কাজ-কর্ম করার সময় আমরা মন্ত্রগুলি জপ করতে পারি এবং উষ্ণ অনুভূতি ও সদয় চিন্তা-ভাবনা প্রসারিত করতে পারি। যদি কাজের সময় শিক্ষাগুলো এবং আমরা যে তান্ত্রিক অভিষেক প্রাপ্ত করেছি, সেগুলো বিচার করা কঠিন হয়, তাহলে আমরা কমপক্ষে নিজেদের স্ব-চিত্র বা স্ব-মূর্তিগুলো রূপান্তর করতে পারি। সারাদিন জুড়ে আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য আমরা নিজেদেরকে বুদ্ধ-কায় হিসাবে এবং আমাদের পরিবেশকে শুদ্ধ ভূমি হিসাবে কল্পনা করতে পারি। তারপরে খুব সকালে এবং রাত্রে, আমরা সাধনাগুলোর বিস্তৃত আলম্বনগুলো অনুশীলন করতে পারি। রিনপোছে জীবন থেকে বৌদ্ধধর্মকে আলাদা কিছু না করার জন্য সর্বদা জোর দিয়েছিলেন।
বহু বছর ধরে টার্নার ইংল্যান্ডে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের সাথে বসবাস করত। ঐ সময় সে বেকার ছিল এবং সমাজ-কল্যাণ করত। সে প্রায় তার পুরো সময় ঐকান্তিক সাধনা করে কাটিয়েছিল। সে অনুভব করেছিল যে, সে যখন শিক্ষাগুলো অনুশীলন করতে পারে তখন কাজ ক’রে কেন সময় নষ্ট করবে? এর আগে সে রিনপোছের কাছ থেকে শ্বেত মহাকাল নামক একজন অর্থ-সম্পর্কিত রক্ষকের অনুজ্ঞা অনুষ্ঠান প্রাপ্ত করেছিল এবং তার আর্থিক সমস্যার সমাধান হওয়ার জন্য প্রতিদিন প্রার্থনা করত। তাতে রিনপোছে মোটেও সন্তুষ্ট হননি। তিনি বলেছিলেন এটি এমন যেন একজন অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার জন্য ভেষজ বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করছে কিন্তু সে কখনও কোনও ওষুধ সেবন করে না। তিনি টার্নারকে একটি চাকরী পেতে এবং তার নিবিড় অনুশীলনগুলো খুব সকালে আর রাত্রে খুব অল্প সময়ের জন্য করতে বলেছিলেন। তারপর শ্বেত মহাকালকে আবাহন করলে তার কাজকে আর্থিক সাফল্যে পরিণত করতে সহায়তা করবে।
সর্বদা ব্যবহারিক এবং দক্ষ হওয়া
রিনপোছে মানুষকে ব্যবহারিক এবং দক্ষ হতে পছন্দ করতেন, বাক্যহীন হওয়া নয়। অতএব তিনি সব সময় সাধনা এবং দ্রুত জপ করতে পছন্দ করতেন। একবার ইতালির মিলানে অবস্থিত গেফেল-লিং সেন্টারের শিক্ষার্থীরা রিনপোছেকে সেখানে তাঁর মার্গক্রম (লাম-রিম) এবং অবলোকিতেশ্বরের পাঠক্রম শেষ করার জন্য একটি ধ্যানের অধিবেশন পরিচালনা করতে বলেছিল। রিনপোছে একমত হয়ে তাদের ছয়টি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের অবলোকিতেশ্বর হিসাবে রূপান্তরিত করার এবং তারপরে মার্গক্রমের কয়েক ডজন পয়েন্টের উপর ধ্যান করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি এসব কিছু দুমিনিটের জন্য করতে বলেছিলেন। শিক্ষার্থীরা এই নিয়ে তাদের অবিশ্বাস প্রকাশ করেছিল। এই সমস্ত কিছুর জন্য তিনি যতটা সময় দিয়েছিলেন তা নিয়ে তারা প্রতিবাদ করেছিল। রিনপোছে তখন বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “ঠিক আছে, এটা তিন মিনিটের জন্য করুন।” তারপরে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, একজন ভাল সাধক বা অনুশীলনকারী সম্পূর্ণ “মার্গক্রম” একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারে, যে সময়টুকু ঘোড়ার পিঠে চড়ার সময় তার জিনের (স্যাডল) উপর পা রাখতে লাগে। মৃত্যু যখন আসে তখন ভালভাবে বসার এবং ধীরে-ধীরে ও ক্রমপর্যায়ে একটা দৃষ্টিগোচর নির্ধারণ করার সময় থাকে না।
আমাদের বৌদ্ধ অনুশীলনে বাস্তববাদী হওয়া
রিনপোছে বৌদ্ধ অনুশীলনের সমস্ত ক্ষেত্রে বাস্তববাদী হওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন। এটা বিশেষ করে গুরুতর হয়ে ওঠে যদি আমরা বোধিসত্ত্ব হয়ে পরকল্যাণ করার চেষ্টা করি। যদিও আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের সর্বদা সহায়তা করতে ইচ্ছুক হওয়া দরকার, কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, আমাদের সহায়তায় অন্যেরও অকপটতার প্রয়োজন। সর্বশেষে আমাদের প্রচেষ্টার সাফল্য তাদের কর্মের উপর নির্ভর করে অর্থাৎ পূর্বের ধরণ যা তাদের মনকে যোগ্য করে তুলেছে। সুতরাং রিনপোছে এমন বিষয়গুলিতে সহায়তা প্রদান করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন সেগুলি যখন আমাদের জন্য উদ্বেগজনক নয় বা যখন অন্যরা আমাদের সহায়তা গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। ঐ পরিস্থিতিতে আমাদের হস্তক্ষেপ কেবল বিরক্তি সৃষ্টি করবে। আর যদি আমাদের সহায়তা ব্যর্থ হয় তাহলে আমরাই সমস্ত দোষের ভাগিদারী হব।
আমরা যা করতে পারি তার চেয়ে বেশী প্রতিশ্রুতি না দেওয়া
সবসময় নিম্ন পরিলেখ রাখাটাই সর্বোত্তম। আমরা অপরকে জানাতে পারি যে আমরা সহায়তা করতে ইচ্ছুক। প্রত্যুত্তরে যদি তারা জিজ্ঞাসা করে তাহলে আমরা অবশ্যই তাদের বিষয়গুলির সাথে জড়িত হতে পারি। তবে আমাদের নিজেদেরকে “ভাড়ার বোধিসত্ত্ব” রূপে প্রচার করা থেকে এড়িয়ে চলতে হবে। আমাদের প্রতিদিনের ধ্যানের অনুশীলনগুলো করা এবং বিনম্রভাবে জীবন-যাপন করাটাই সর্বোত্তম। রিনপোছে বলেছিলেন যে, আমরা ভবিষ্যতে কোন কাজটা সম্পাদন করতে পারব অথবা কোন কাজটা করার দায়িত্ব গ্রহণ করব বা সম্পন্ন করব তার প্রচার করতে পারি। তার চেয়ে বেশী কিছু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলাম। কারণ এটা শুধু বেশী বাধা সৃষ্টি করে। আমরা যে ঘোষণা করেছিলাম সেটা যদি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত না হয় তাহলে আমরা নিজেদের বোকা বানাই এবং সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলি।
আমরা যতটা সম্পাদন করতে পারি তার চেয়ে বেশী কিছু করার প্রতিশ্রুতি না দেওয়ার বিষয়টি আমাদের আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। রিনপোছে সব সময় অশ্বঘোষ রচিত “গুরুপঞ্চশিকঃ”-এর নির্দেশিকা অনুসরণ করতে বলেছিলেন। এটা তিনি তাঁর ধ্যানের অংশ হিসাবে প্রতিদিন পাঠ করতেন। যদি আমাদের গুরু বা শিক্ষকরা আমাদের কোন কিছু করার জন্য দায়িত্ব নিতে বলেন, যেটা আমরা কোনও কারণে করতে পারি না, তাহলে সেটা আমাদের বিনম্রভাবে ও শিষ্টাচারের সাথে ব্যাখ্যা করতে হবে যে আমরা কেন সেটা করতে অসক্ষম। রিনপোছে জোর দিয়েছিলেন যে, একজন আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতার আন্তরিকভাবে প্রতিশ্রুতির বিষয়টি তাঁর গুলাম হওয়া বা একটা রোবট হওয়া নয়, বরং নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখা; নিজের জন্য চিন্তা-ভাবনা করা; এবং আলোকিত হয়ে ওঠার জন্য। আমরা যদি আমাদের শিক্ষকদের পরামর্শ মতো করতে সক্ষম না হই তাহলে আমরা আমাদের পরামর্শদাতাদের হতাশ করে তুলি এবং তার জন্য আমরা খারাপ শিষ্য বলে দোষী হওয়া অনুভব করি। এটা একেবারেই ভাবা উচিত না। একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক একজন অযৌক্তিক অত্যাচারী নয়।
আমরা যদি কারও জন্য, আমাদের শিক্ষকদের জন্য বা অন্য কারও জন্য কিছু করতে রাজি হই, এই বিষয়ে রিনপোছে শুরু থেকেই সবকিছু পরিষ্কার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমরা যদি কোনও নির্দোষ ব্যক্তির মতো ভাল কাজ করার জন্য একমত হই আর কাজটি সম্পাদন করার পরে বা এটি শেষ করার পরে শুধু ঘোষণা করি, তাহলে এর বিনিময়ে আমরা কিছু প্রত্যাশা করি। রিনপোছে শিখিয়েছিলেন, আমরা যদি ব্যবহারিক এবং বাস্তববাদী হই এবং বিষয়গুলি আগে থেকেই চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে লৌকিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় বিষয় ভালভাবে চলতে পারে। আমরা যদি অব্যবহারিক এবং অবাস্তব আর নির্বোধভাবে বিষয়ের দিকে ছুটে যাই তাহলে কেউ সফল হবে না।
বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলির জন্য পরামর্শ
রিনপোছে পশ্চিমী বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলিকে একই পদ্ধতির পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি কেন্দ্রগুলিকে অনেক বড় করা থেকে এড়ানোর জন্য বলেছিলেন। কারণ এর ফলে ঋণী হয়ে নিজেরাই তখন বোঝা হয়ে যাবে আর তারা সম্ভবত প্রতিশ্রুতি দেওয়া প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন বা সম্পূর্ণ করতে পারবে না। তিনি ছোট এবং নজিরবিহীনভাবে শুরু করতে ও প্রত্যন্ত দেশের অঞ্চলে সনাক্ত করার প্রলোভন প্রতিরোধ করার জন্য বলেছিলেন। বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলি নগরবাসীদের ক্ষেত্রে পৌঁছনোর এবং আশপাশে কাজ খুঁজে পেতে সুবিধাজনক হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি গোষ্ঠীটি সব সময় কেন্দ্রটি বিক্রয় করতে পারে এবং প্রয়োজনে আরও বড় একটা কিনতে পারে তবে সঠিক সময়ে।
বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলির উদ্দেশ্য কোনও সার্কাসের মতো ভন্ড বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচুর ভিড় আকর্ষণ করা নয়। রিনপোছে সব সময় আন্তরিক শিক্ষার্থীদের ছোট দলকে পছন্দ করতেন। উপরন্তু আধ্যাত্মিক গুরু বা শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে মূল বিষয়টি এই নয় যে সেই ব্যক্তিটি কীভাবে বিনোদন করেন অথবা তিনি যে গল্পগুলি বলেন সেগুলি কতটা মজাদার। আমরা যদি হাসতে চাই বা কোন চমকপ্রদ কিছু দেখতে চাই, তাহলে আমরা সার্কাসের জোকারগুলো দেখতে যেতে পারি বা উপ-প্রদর্শনীতে যেতে পারি।