জার্মানী রওনা হওয়ার আগে পরম পূজ্য দালাই লামার দর্শন
একটা লম্বা বক্তৃতার ভ্রমণ এবং মঙ্গোলিয়া তথা পাশ্চাত্য দেশে গভীর লেখালেখির কাজ করার পর ১৯৯৮ সালে আমি ভারতে অবস্থিত ধর্মশালার বাড়িতে ফিরেছিলাম। আমি ১৯৬৯ সাল থেকে হিমালয়ের তটদেশে জীবন-যাপন করতে-করতে নিজের অধ্যয়ন এবং পরম পূজ্য দালাই লামার আশে-পাশে একত্রিত তিব্বতী শরণার্থী সমুদয়ের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করছিলাম। এবার আমি নিজের জিনিস নিয়ে মিউনিখ, জার্মানী ফিরে যাওয়ার জন্য এসেছিলাম। সেখানে ফিরে আমি আরও বেশী দক্ষতার সাথে নিজের গ্রন্থ লিখতে পারতাম আর নিয়মিতভাবে বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা প্রদানের কাজ করতে পারতাম। আমি পরম পূজ্যকে নিজের নির্ণয়ের বিষয়ে বলতে চেয়েছিলাম এবং এই বিষয়ে তাঁর পরামর্শ চেয়েছিলাম। আমার আধ্যাত্মিক গুরু হিসাবে পরম পূজ্য পূর্বে আমাকে একবার নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, আমি যেন নিজের নির্ণয় নিজেই করি অন্যদের অর্থপূর্ণ অবদান দেওয়ার জন্য আমি নিজের সময় কীভাবে এবং কোথায় অতিবাহিত করব, এই কাজে অনুভব আমার সবথেকে বিশ্বস্ত পথপ্রদর্শক হবে বলে মনে হয়েছিল।
২৯ বছর পূর্বে যখন আমার সাথে পরম পূজ্যের প্রথম বার দেখা হয়েছিল, তখন আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদূর পূর্বের ভাষা আর সংস্কৃত এবং ভারতীয় অধ্যয়ন বিভাগের জন্য নিজের পি.এইচ.ডি. গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখার জন্য ফুলব্রাইট গবেষক রূপে ভারতে এসেছিলাম। তখনকার দিনে শিক্ষাগত ভাবে তিব্বতী বৌদ্ধধর্মকে মিশরের পুরাতত্ত্বের অধ্যয়নের মতোই মৃত বিষয় রূপে পড়ানো হতো। আমি এই পদ্ধতিটা মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই আমি কয়েক বছর ধরে চিন্তা-ভাবনা করেছিলাম যে, একজন হিসাবে কেমন করে জীবন-যাপন করা এবং চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। পরম পূজ্যের সাথে দেখা হওয়ার পরে আমি এই বিচার থেকে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম যে, এই প্রাচীন পরম্পরা এখনও জীবিত আছে। আমার পরম পূজ্যকে এমন একজন গুরু মনে হয়েছিল, যিনি এই পরম্পরার সবকিছু জানেন এবং সেটা মূর্ত রূপে আমাদের সামনে প্রস্তুত।
কয়েক মাস পরে আমি নিজেকে পরম পূজ্যের সম্মুখে প্রস্তুত করলাম এবং তাকে অনুরোধ করলাম যে, তিনি যেন আমাকে প্রকৃত শিক্ষাগুলি শেখার এবং সেগুলির প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত করার সুযোগ প্রদান করেন। আমি পরম পূজ্যের সেবা করতে চেয়েছিলাম এবং আমি জানতাম যে, প্রচন্ড পরিশ্রম করে আমি নিজেকে এর যোগ্য তৈরী করতে পারব। পরম পূজ্য সদয় ভাবে আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। ফলে আমার তাঁর অনিয়নিত অনুবাদকের মধ্যে একজন অনুবাদক হিসাবে কাজ করার এবং তাঁর পক্ষ হয়ে সারা বিশ্বে আধ্যাত্মিক গুরুদের তথা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে সহায়তা করার সু-অবসর প্রাপ্ত হয়েছিল।
আমার জায়গা বদলে ফেলে ইউরোপ যাওয়ার নির্ণয়টায় পরম পূজ্য খুশি হয়েছিলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি পরের গ্রন্থটি কোন বিষয়ের উপর লিখব। আমি বলেছিলাম যে, আমার ইচ্ছা একজন আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে সম্পর্কের বিষয়ে গ্রন্থটি লিখতে চাই। ধর্মশালায় পরম পূজ্যের সাথে পাশ্চাত্য বৌদ্ধ শিক্ষকদের নেটওয়ার্কের তিনটি বৈঠকে উপস্থিত থাকার কারণে আমি এই বিষয়ে পাশ্চাত্যের মানুষদের সমস্যার বিষয়ে পরম পূজ্যের দৃষ্টিকোণের সাথে ভালোভাবে পরিচিত হয়েছিলাম। পরম পূজ্য এই বিষয়ে কেবল এইটুকুই জুড়ে দিয়েছিলেন যে, সমস্যার মূল উৎস হ’ল যে, খুব কম শিক্ষকই বাস্তবে যোগ্য হন।
একজন বৌদ্ধ শিক্ষক হওয়ার জন্য সেরকোঙ্ রিনপোছের পরামর্শের উপর ভাবনা
সভাকক্ষ থেকে বাইরে বের হওয়ার সময় আমার মনে প্রথমে এই ধারণাটাই জেগেছিল যে, আমি কি সত্যিই বৌদ্ধধর্মের শিক্ষক হওয়ার যোগ্য। অনেক বছর পর্যন্ত আমার ভারতে নির্বাসিত থাকা, কিছু উৎকৃষ্ট তিব্বতী গুরুর কাছ থেকে প্রশিক্ষিত হওয়ার অসাধারণ সুযোগ প্রাপ্ত হয়েছিল। এর মধ্যে পরম পূজ্য দালাই লামা ছাড়াও তাঁর তিনজন প্রয়াত শিক্ষক আর তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের অন্য শাখাগুলির কয়েকজন প্রমুখ শিক্ষকরাও ছিলেন। তাঁদের তুলনায় আমার যোগ্যতা কিছুই ছিল না। কিন্তু তখন আমার নিজের মুখ্য শিক্ষক, চেনশব সেরকোঙ্ রিনপোছে, যিনি পরম পূজ্যের প্রধান শাস্ত্রার্থ সহযোগী ছিলেন, ১৯৮৩ সালে দেওয়া তাঁর একটি পরামর্শ স্মরণ করেছিলাম।
আমি রিনপোছের সাথে তাঁর অনুবাদক এবং সচিব হিসাবে তাঁর বিশ্ব ভ্রমণগুলিতে ভ্রমণ করছিলাম, আর সবেমাত্র কারাকাস, ভেনেজুয়েলা থেকে ভ্রমণ করে ফিরেছিলাম। রিনপোছের অনুপ্রেরণায় আমি সেখানে একটি নবগঠিত বৌদ্ধ সমূহকে অধ্যাপনা করার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা দেওয়া সম্পর্কে এটাই আমার প্রথম কর্ম ছিল। রিনপোছে কিছু দিন বিশ্রামের জন্য গেশে ওয়াঙ্গ্যালের নিউজার্সি স্থিত মঠে ছিলেন। গেশে ওয়াঙ্গ্যাল রাশিয়ার কাল্মিক মঙ্গোল বংশের ছিলেন, আর আমার তিব্বতী বৌদ্ধ পরম্পরার প্রথম শিক্ষক ছিলেন, যার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৬৭ সালে, যদিও আমি কখনও তাঁর সাথে গভীরভাবে অধ্যয়ন করার সুযোগ পাইনি।
ফিরে আসার পর রিনপোছে আমার কাছে অধ্যাপনা করার কাজের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি। আমি তাঁর এই শৈলীর সাথে পরিচিত ছিলাম আর এইজন্য আমি একটুও আশ্চর্য হইনি। কিন্তু এক সপ্তাহ পর লন্ডনে নৈশ ভোজনের পর রান্নাঘরের টেবিলে বসে, “ভবিষ্যতে যখন তুমি একজন বিখ্যাত শিক্ষক হয়ে যাবে, আর তোমার শিষ্যরা তোমাকে বুদ্ধ রূপে দেখবে, কিন্তু তুমি এটা জানবে যে তুমি বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত করতে পারোনি, তখনও এই বিশ্বাসটা হারিয়ো না যে, তোমার নিজস্ব শিক্ষকরা হলেন বুদ্ধ।” তিনি শুধু এটাই বলেছিলেন এবং তারপর আমরা দুজনেই চুপ করে বসেছিলাম। তাঁর এই শব্দগুলির গভীরতা আমার বুঝতে অনেক বছর লেগেছিল।
রিনপোছের “আসল জিনিসটি” হওয়ার সম্বন্ধে লামা জোপার প্রামাণিক সাক্ষ্য
পাশ্চাত্যের তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের বিখ্যাত শিক্ষক লামা জোপা রিনপোছে বলেছিলেন যে, যদি আপনি কোনো বিশ্বাসযোগ্য গুরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে চান, তাহলে চেনশব সেরকোঙ্ রিনপোছে এর সব থেকে ভালো উদাহরণ। লামা জোপা এখানে তিব্বতী শব্দের ‘লামা’ প্রয়োগ সামান্য অর্থে কেবল কোনো ভিক্ষু অথবা কোনো সাধক রূপে করেননি, যিনি তিন বছর গভীরভাবে সাধনা করেছেন। না তিনি এই শব্দের প্রয়োগ কেবল এক “পুনর্জন্ম নেওয়া লামা”- এর অর্থে করেছেন, যিনি নিজের পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া সঞ্চালিত করার ক্ষমতা রাখেন, আর “রিনপোছে” অর্থাৎ “রত্ন”-এর পদবী ধারণ করেন। তিনি বলতে চেয়েছিলেন “লামা” শব্দের মূল অর্থ, একজন পূর্ণ যোগ্যতা প্রাপ্ত আধ্যাত্মিক শিক্ষক হিসাবে। এইজন্য এমন শিক্ষকের শিষ্যত্বকে কীভাবে ধারণ করা যায়, সেরকোঙ্ রিনপোছের এক শিষ্য রূপে তাঁর সাথে আমার সম্পর্কের শাব্দিক চিত্র আঁকা উপযোগী হবে। তাঁর সমুচিত ছবিগুলি আর স্মৃতিগুলির মাধ্যমে আমি এটা করার চেষ্টা করব।