যদিও তিব্বতে তিনটি অবসরে মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষু-দীক্ষা প্রবর্তিত বা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবে মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী-সংঘ কখনোই দৃঢ়ভাবে প্রবর্তিত হয় না। পরিণামস্বরূপ, মূলসর্বাস্তিবাদ বিনয় পরম্পরায় অন্তর্ভুক্ত যে সমস্ত তিব্বতী নারীরা তিব্বতী বৌদ্ধ পরম্পরা অনুসরণ করতেন এবং যারা দীক্ষিত হতে চাইতেন তারা শ্রামণেরিকা অথবা নবাগত ভিক্ষুণী হয়েছিলেন।
তিব্বতে প্রথমবার মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষু-দীক্ষা প্রবর্তিত হয়েছিল ভারতীয় আচার্য শান্তরক্ষিত এবং তাঁর ত্রিশ জন ভিক্ষু অনুগামীদের আগমনের সাথে এবং সেটি মধ্য তিব্বতে ৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দে সম্যে মঠের স্থাপনার সাথে। এই কাজটি তিব্বতী সম্রাট ঠ্রিস্রোঙ্ দেচেন-এর পৃষ্ঠপোষকতা সম্পন্ন হয়েছিল। তবে যেহেতু ঐ সময় না তো বারোজন মূলসর্বাস্তিবাদ পরম্পরার ভিক্ষুণী তিব্বতে গিয়েছিলেন, তার পরবর্তীকালে তিব্বতী নারীরা উচ্চতর দীক্ষা লাভ করার জন্য ভারত যাত্রা করেছিলেন, এই কারণে এই প্রথম অবধি পর্যন্ত তিব্বতে মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী দীক্ষার পরম্পরা প্রবর্তিত হয়নি।
তবে দুনহুয়াং নথিতে সংরক্ষিত একটি চিনা স্রোত অনুযায়ী সম্রাট ঠ্রিস্রোঙ্ দেচেনের উপ-স্ত্রীদের মধ্যে একজন রানী ড্রোজা জাঙ্ডোন আরও অন্য ত্রিশজন তিব্বতী নারী সম্যে মঠে ভিক্ষুণী দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তাদের দীক্ষা প্রদান করা হয়েছিল চীনা ভিক্ষু দ্বারা যাদের ৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে সম্যে মঠে অবস্থিত অনুবাদ দপ্তরে আমন্ত্রিত করা হয়েছিল। যেহেতু চীনের তাং সম্রাট শোঙ্-জোঙ ৭০৯ খ্রীষ্টাব্দে আদেশ জারি করেছিলেন যে চীনে শুধুমাত্র ধর্মগুপ্তক দীক্ষার পরম্পরা পালন হবে তাই তিব্বতে প্রবর্তিত ভিক্ষুণী দীক্ষা সম্ভবতঃ ধর্মগুপ্তক পরম্পরা অনুসারেই প্রবর্তিত হয়েছিল। সম্ভবতঃ উক্ত দীক্ষা একক সংঘ পদ্ধতি দ্বারা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু সম্যে মঠে (৭৯২-৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দ)-এ অনুষ্ঠিত শাস্ত্রার্থে চীনা পক্ষের পরাজয়ের পর আর তিব্বত থেকে তাকে নিষ্কাষনের পর উক্ত পরম্পরা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
তিব্বতী সম্রাট ঠ্রি-রালপাচেন (৮১৫-৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দ)-এর শাসনকালে সম্রাট আদেশ জারী করেছিলেন যে সর্বাস্তিবাদের হীনযান গ্রন্থগুলি ছাড়া অন্য কোন হীনযান গ্রন্থ তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করা যাবে না। এই রাজ আদেশের কারণে মূলসর্বাস্তিবাদ ছাড়া অন্য কোন দীক্ষা পরম্পরাকে তিব্বতে প্রবর্তিত করার সম্ভাবনা সীমিত থেকে যায়।
আচার্য শান্তরক্ষিত দ্বারা প্রবর্তিত সর্বাস্তিবাদ ভিক্ষু দীক্ষা পরম্পরা নবম শতাব্দীর শেষের দিক অথবা দশম শতাব্দীর প্রথম দিকে রাজা লাঙ্ দরমার দ্বারা বৌদ্ধধর্মের বিনাশের সাথে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। জীবিত থাকা তিনজন মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষু দুইজন চীনা ধর্মগুপ্তক ভিক্ষুদের সাহায্যে সাহায্যে পূর্ব তিব্বতে গোঙ্পা রাবসেলের দীক্ষার সাথে এই ভিক্ষু দীক্ষা পরম্পরা পুনর্জীবিত করা হয়। তবে ঐ সময় ধর্মগুপ্তক ভিক্ষুণীদের সাথে দ্বৈত সংঘে মিশ্রিত পরম্পরা দ্বারা মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী দীক্ষাকে প্রবর্তিত করার জন্য এই ধরণের কোন প্রক্রিয়াকে সংযুক্ত করা হয়নি।
গোঙ্পা রাবসেলের মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষু দীক্ষা পরম্পরাকে মধ্য তিব্বতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল এবং সেটি “নিম্ন তিব্বত বিনয়” (মে-দুল) পরম্পরা নামে পরিচিত হয়। তবে পশ্চিমী তিব্বতে দশম শতাব্দীর শেষের দিকে রাজা য়েশে হোদ্ (জ্ঞানপ্রভা) নিজের রাজ্যে মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষু দীক্ষা প্রবর্তিত করা অথবা সম্ভবতঃ পুনরায় প্রবর্তিত করার জন্য ভারতের সহযোগিতা নিয়েছিলেন। এইভাবে দ্বিতীয় মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষু পরম্পরাকে প্রবর্তিত করার জন্য তিনি পূর্ব ভারতের পন্ডিত ধর্মপাল এবং তাঁর কয়েকজন শিষ্যদের পশ্চিমী তিব্বতের গুগে প্রান্তে আমন্ত্রিত করেছিলেন। এই পরম্পরাটি “উচ্চ তিব্বত বিনয়” (তোদ্-দুল) নামে পরিচিত হয়।
গুগে ক্রনিকল (গুগে কালানুক্রমিক বিবরণ) অনুসারে ঠিক ঐ সময় গুগে প্রান্তে একটি মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী সংঘও প্রবর্তিত হয়েছিল। আর রাজা য়েশে হোদ্-এর কন্যা ল্হায়ি মেতোগ ঐ সংঘে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট নয় যে ঐ দীক্ষা থেকে তিনি ভিক্ষুণী হয়েছিলেন, না শ্রামনেরিকা। পরিস্থিতি যাই-ই হোক না কেন বিষয়টি আরও অস্পষ্ট যে মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণীদের দীক্ষা প্রদান করার জন্য তাকে গুগে প্রান্তে আমন্ত্রিত করা হয়েছিল আর এমন কোন প্রমাণও নেই যে যা প্রমাণিত করে মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী সংঘ পশ্চিমী তিব্বতে ঐ সময় দৃঢ়ভাবে প্রবর্তিত হয়েছিল।
১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে তিব্বতী অনুবাদক ঠ্রো লোচাবা জাম্পা পেল নালন্দা মহাবিহারে পীঠাধীশ (আসন ধর) ভারতীয় আচার্য শাক্যশ্রী ভদ্রকে তিব্বতে প্রস্থান করার জন্য আমন্ত্রিত করেছিলেন যাতে তিনি তুর্কীর ঘুরীদ রাজবংশের আক্রমণকারী গুজ তুর্কীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। তিব্বতে থাকাকালীন শাক্যশ্রী ভদ্র এবং তার সাথে প্রস্থানকারী ভারতীয় ভিক্ষুগণ শাক্য পরম্পরা অনুযায়ী প্রার্থীদের মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষু দীক্ষা প্রদান করেন আর সেই থেকে তিব্বতে তৃতীয় দীক্ষা পরম্পরা শুরু হয়। এর দুটি উপ-পরম্পরা আছেঃ একটি হল শাক্যশ্রী ভদ্র দ্বারা সাক্য পন্ডিত কুঙ্গা গ্যালছেনকে প্রদত্ত দীক্ষা এবং অন্যটি হল তাঁর দ্বারা ভিক্ষু সংঘকে প্রদত্ত দীক্ষা যাদের তিনি পরবর্তীকালে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং কালান্তরে চার সাক্য মঠীয় সংঘে বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল। যদিও এর প্রমাণ আছে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত উত্তর ভারতে ভিক্ষুণী ছিল, কিন্তু শাক্যশ্রী ভদ্রের সাথে কোন মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী তিব্বতে প্রস্থান করেননি। অতএব মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী দীক্ষা পরম্পরাকে কখনোই উক্ত তিন মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষু দীক্ষা পরম্পরার মধ্যে কোনো একটার সাথে সংযুক্ত ক’রে তিব্বতে নিয়ে যাওয়া হয়নি।
শাক্যশ্রী ভদ্রের তিব্বত যাত্রার পর শতাব্দী জুড়ে তিব্বতে মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী দীক্ষা প্রবর্তিত করার জন্য কমপক্ষে একবার প্রয়াস করা হয়েছিল, কিন্তু সেটা অসফল হয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে সাক্য পরম্পরার বিদ্বান শাক্য ছোগদেন তাঁর মাতার জন্য বিশেষ রূপে একাকী সংঘ মূলসর্বাস্তিবাদ ভিক্ষুণী দীক্ষা আয়োজন করেছিলেন। তবে অন্য একজন সমকালীন সাক্য পরম্পরার বিদ্বান গোরাম্পা (গোরাম্পা সোনম সেঙ্গে) উক্ত দীক্ষার বৈধতা নিয়ে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন এবং সেই কারণে পরবর্তীকালে এটাকে সমাপ্ত করে দেওয়া হয়েছিল।