দক্ষিন এবং দক্ষিনপূর্ব এশিয়ায় থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম
ভারত
সপ্তম শতাব্দী থেকে ভারতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কমতে থাকে। তারপর দ্বাদশ শতকে পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর হয় অন্তর্হিত। টিকে রইল শুধু উত্তরের হিমালয় অঞ্চলে। উনবিংশ শতকের অন্তিমে ভারতে বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থান ঘটল। ব্রিটিশ পণ্ডিতদের সহায়তায় শ্রীলঙ্কার অনাগরিক ধর্মপাল এই কর্মে নেতৃত্ব দিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন মহাবোধি সোসাইটি। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতে বৌদ্ধ তীর্থস্থান গুলির সংস্কার ও সংরক্ষণ। এই কাজে তারা যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেন। নির্মিত হয় বহু মন্দির এবং সেগুলি হয়ে উঠে ভিক্ষুদের আবাস।
১৯৫০ এর দশকে ভীমরাও আম্বেদকর দলিতদের মধ্যে নব বৌদ্ধ আন্দোলন শুরু করেন। এর ফলে জাতি ভেদের নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য লক্ষ-লক্ষ দলিত বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে ভারতের মোট জনসংখ্যার ২% হলেন বৌদ্ধ।
শ্রীলঙ্কা
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র কর্তৃক শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্মের প্রচারের সময় থেকে সে দেশ বৌদ্ধধর্ম চর্যার একটি কেন্দ্র হিসেবে পরিগনিত হয়। শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্মের একটি নিরবচ্ছিন্ন ও দীর্ঘকালীন ইতিহাস রয়েছে। এদেশেও যুদ্ধ এবং ষোড়শ শতক থেকে উপনিবেশিকতার সঙ্গে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারীদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরকরণের ফলে বৌদ্ধধর্মের নিরবচ্ছিন্ন ধারাটি হয়েছে ব্যাহত।
ইংরেজ বিদ্বজ্জন এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সহায়তায় ১৯ শতকে শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্মের জোরদার পুনর্জাগরণ ঘটল। পাণ্ডিত্যপূর্ণ অধ্যয়ন, গৃহস্থ উপাসকদের জন্য ভিক্ষুদের ধর্মোপদেশ দানের ব্যবস্থা সহ তাদের জন্য ধ্যান সাধনায় সহায়তা ইত্যাদি করলে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধধর্মকে অনেক সময় “Protestant Buddhism” নামে অভিহীত করা হয়। ১৯৪৮ সনে এই দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তদ্পশ্চাৎ এই দেশে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির উপর প্রবল আগ্রহ দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে ৭০% শ্রীলঙ্কার নাগরিক হলেন বৌদ্ধ। তাদের অধিকাংশ থেরবাদ পরম্পরা অনুসরণ করেন। ৩০ বৎসর কাল অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধের পর এখানে জাতীয়বাদী বৌদ্ধধর্মের উত্থান ঘটেছে। বুদু বাল সেনার মতো কিছু সংগঠন মুসলমান বিরোধী দাঙ্গা সংগঠিত করছে। উদারপন্থী বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ হয়ে উঠছেন তাদের আক্রমণের লক্ষ্য।
মায়ানমার (বার্মা)
ঐতিহাসিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বার্মায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস দুই হাজার বছরের থেকেও বেশী পুরনো। ৮৫% মানুষ নিজেকে বৌদ্ধ হিসেবে পরিচয় দান করেন। এ দেশে প্রব্রজিত ভিক্ষুদের মধ্যে অধ্যয়ন ও ধ্যান সাধনার একটি অপূর্ব মেলবন্ধনের ঐতিহ্য রয়েছে। গৃহস্থ উপাসক উপাসিকাদের মধ্যেও দেখা যায় গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধার প্রকাশ এবং তা একই রকম রয়েছে। এমনই একজন হলেন বিখ্যাত সত্য নারায়ণ গোয়েঙ্কাজী। তিনি বর্মা পরম্পরার একজন পূজনীয় সাধক।
ইংরেজদের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর সামরিক ও গণতান্ত্রিক শাসকগণ থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। সামরিক শাসনে বৌদ্ধধর্ম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বিরুদ্ধ মতবাদীদের মন্দির থেকে নিয়মিত বিতাড়ন করে ধ্বংস করা হয়েছে। ১৯৮৮ এবং ২০০৭ সালের নৈতিক বিপ্লবের মতো ভিক্ষুদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে সামনের সারিতে দেখা গেছে।
বিগত এক দশকে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে, যারা ইসলামের বিরোধীতার সঙ্গে চেষ্টা করছে বৌদ্ধধর্মের পূনঃজাগরণ করার জন্য। ১৯৬৯ গোষ্ঠীর ভিক্ষুনেতা অশিন বিরাথু, স্ব-ঘোষিত “বার্মিজ বিন লাদেন” মুসলমান দোকান বয়কটের ডাক দিয়েছেন। বৌদ্ধধর্ম রক্ষার নামে মসজিদ ও মুসলমানদের বাড়িঘর আক্রমণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ ঘটনা। মুসলমানদের প্রত্যাঘাত আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করছে।
বাংলাদেশ
একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী। বর্তমানে এই দেশে মোট জনসংখ্যা ১% এরও কম হলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা বার্মা সংলগ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করেন। রাজধানী ঢাকায় রয়েছে চারটি বৌদ্ধ মন্দির এবং পূর্বাঞ্চলের গ্রাম গুলিতেও অনেক মন্দির আছে। বার্মার তুলনায় এই দেশে বৌদ্ধ সাধনা ও চর্চার স্তর কিছুটা অনুন্নত বলা যেতে পারে।
থাইল্যান্ড
দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার এই সাম্রাজ্যে বৌদ্ধধর্ম আসে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে। লোকায়ত ধর্ম ও হিন্দুধর্ম প্রভাবিত হলেও এখানে থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে মহাযান পরম্পরা। একটি বিষয়ে এই দেশ শ্রীলঙ্কা ও বার্মার বিপরীত। এখানে কখনো ভিক্ষুণী সঙ্ঘ স্থাপিত হয়নি। এই দেশের জনসংখ্যার ৯৫% শতাংশ হলেন বৌদ্ধ। থাই ভিক্ষু সঙ্ঘ রাজতন্ত্রের অনুরূপ। সেই অনুরূপ পরম্পরার শুদ্ধতার রক্ষায় রয়েছে প্রধান স্থবিরদের নিয়ে গঠিত পরিষদ, যার নেতৃত্বে রয়েছে মহাস্থবির। এখানে গ্রামবাসী ও অরণ্যবাসী ভিক্ষু রয়েছে। তারা সকলেই গৃহস্থ উপাসক উপাসিকাদের পরম শ্রদ্ধা ভাজন।
অরণ্যবাসী ভিক্ষুগণ কঠোর সাধনায় নিমগ্ন থাকেন। গ্রাম্য ভিক্ষুগণ সূত্রপাঠ এবং গ্রামবাসীর পূজা পাঠনে সহায়তা করেন। থাই সংস্কৃতি অশরীরী শক্তি বিশ্বাস করেন। এই ভিক্ষুগণ গ্রামবাসীদের রক্ষাকবচ দান করেন। ভিক্ষুদের জন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেও মুখ্যতঃ ভিক্ষুদের প্রশিক্ষণ ও পালি থেকে আধুনিক থাই ভাষায় অনুবাদের কর্ম সম্পাদিত হয়।
লাওস
লাওসে সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম পৌঁছোয়। সেখানে বর্তমানে ৯৫% জনগণ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তবে এর মধ্যে সর্বপ্রাণবাদীদেরও প্রভাব রয়েছে। সাম্যবাদী জমানায় প্রথম দিকে তারা বৌদ্ধধর্মকে দমন করেনি, বরং তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভিক্ষুসঙ্ঘকে কাজে লাগিয়েছে। কালক্রমে সেখানে বৌদ্ধধর্মের ওপর নেমে আসে চরম উৎপীড়ন। ১৯৯০ থেকে চাপ মুক্ত হয়ে বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণ হয় শুরু। শ্রদ্ধাবান লাওসবাসী পুরুষগণের অধিকাংশ জীবনে অন্ততঃ একবার কিছুদিনের জন্য হলেও ভিক্ষু জীবন পালন করে। অধিকাংশ পরিবার ভিক্ষুদের ভোজন দান করে এবং পূর্ণিমার দিন মন্দির দর্শন করতে যায়।
কম্বোডিয়া
ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম এই দেশের রাষ্ট্র ধর্ম। এখনও এই দেশে ৯৫% জনগণ বৌদ্ধ। ১৯৭০-এর দশকে খেমের রুজ বৌদ্ধধর্মকে নিশ্চিহ্ন করতে প্রায় সফল হয়েছিল। ১৯৭৯ তে প্রায় সকল বৌদ্ধ ভিক্ষু হয় নিহত হয়েছিলেন, নয়তো বিদেশে বিতাড়িত হয়েছিলেন। সমস্ত মন্দির ও গ্রন্থাগার ধ্বংস হল। রাজকুমার সিহান্ধক রাজা হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণ ধীরে-ধীরে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ফিরে এলো বৌদ্ধধর্মের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি যা লুক্কায়িত ছিল। কম্বোজবাসীরা হলেন ভবিষ্যৎবক্তা, জ্যোতিষচর্চা এবং অশরীরী লোক সম্বন্ধে গভীর বিশ্বাসী। ভিক্ষুগণ কখনও-কখনও এসকল বিষয় নিরাময়ে কাজ করেন। সমাজে সকল স্তরে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রীতি-নীতিতে এবং আচার-অনুষ্ঠানে ভিক্ষুগণ অংশগ্রহণ করেন।
ভিয়েতনাম
দুই হাজার বছর আগে ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম ভিয়েতনাম পৌঁছোয়। পরে তা এসেছিল চীন থেকে। তবে পঞ্চদশ শতাব্দীতে শাসকগোষ্ঠীর আনুকূল্য হারানোয় এর অগ্রগতি থমকে যায়। বিংশ শতকের গোঁড়ার দিকে বৌদ্ধধর্মে পুনর্জাগরণ ঘটে। তবে প্রজাতান্ত্রিক শাসনকালে ক্যাথলিক খ্রিস্টানপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বৌদ্ধরা কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বর্তমানে ১৬% জনগণ ঘোষিত বৌদ্ধ হলেও তা সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ধর্ম।
বর্তমানে সরকার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ শিথিল করলেও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোন মন্দির কাজ করতে পারে না।
ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া
ভারত থেকে বানিজ্যপথ ধরে এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে আনুমানিক দ্বিতীয় শতাব্দীতে। পনেরো শতকে ইন্দোনেশিয়ার সর্বশেষ সম্রাট মাজাপহিত পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় পরম্পরায় বিশ্বাসী ছিলেন। সুতরাং বৌদ্ধধর্মের আগমন কাল থেকে পনেরো শতক পর্যন্ত এ দেশে ইতিহাসে বৌদ্ধধর্ম নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পালিত হয়েছে। ১৭ শতকের গোড়ায় হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মকে সরিয়ে দিয়ে ইসলাম হয়ে ওঠে প্রধান ধর্ম।
ইন্দোনেশিয়ার সরকারী পঞ্চশীল নীতি অনুযায়ী সরকারী ধর্ম হতে হবে ঈশ্বর বিশ্বাসী। ভগবান একজন ব্যক্তিসত্ত্বা এরকম বৌদ্ধধর্ম স্বীকার করে না। কিন্তু হাজার বছর আগে বিকশিত কালচক্রযানে বর্ণিত আদি বুদ্ধকে স্বীকার করে। আদি বুদ্ধ অর্থাৎ প্রথম বুদ্ধ তিনি একটি প্রতীকি শক্তি কোনো ব্যক্তি সত্ত্বা নয়। তিনি সময়াতীত বা অনন্ত এই দৃশ্যমান জগতের সৃষ্টিকর্তা এবং সর্বজ্ঞ। প্রভাস্বর রুপী চিত্ত রূপে আদি বুদ্ধ সকলের মধ্যে রয়েছে। এর ভিত্তিতে ইসলামের সঙ্গে হিন্দু, খ্রিস্টান, কনফুশিয়ানিজম সহ বৌদ্ধধর্মকেও গ্রহণ করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার বালি ও তৎসন্নিহীত অঞ্চলে শ্রীলঙ্কার ভিক্ষুগণ থেরবাদী পরম্পরার প্রচার করছেন। তবে তা অত্যন্ত সীমিত স্তরেই রয়েছে। বালির এই বুদ্ধান্ধগামীগণ হলেন সেখানকার হিন্দু, বৌদ্ধ ও স্থানীয় লোকায়ত ধর্মানুরাগীদের এক মিশ্রণ। ইন্দোনেশিয়ার অবশিষ্ট অংশে জনসংখ্যার ৫% হল বৌদ্ধ। এই ইন্দোনেশীয়গণ মূলতঃ চীনা বংশোদ্ভূত। এছাড়াও কিছু ইন্দোনেশিয়া সম্প্রদায় রয়েছেন যারা থেরবাদ, চীনা ও তিব্বতী পরম্পরার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে।
মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার ২০% হল বৌদ্ধ। মূলতঃ ওরা হলেন বহিরাগত চীনা সমাজ। পঞ্চাশ বছর আগে সেখানে বৌদ্ধধর্মের প্রতি দেখা দেয় অনাগ্রহ। সেই কারণে ১৯৬১ সনে বৌদ্ধধর্ম বিস্তারের লক্ষ্যে গড়ে উঠে বৌদ্ধ মিশনারি সোসাইটি। বিগত দশক থেকে বৌদ্ধ সাধনার উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এমনকি যুবকরাও তাতে আকৃষ্ট হচ্ছেন। বর্তমানে সেখানে বহু থেরবাদী, মহাযান-বজ্রযান কেন্দ্র রয়েছে এবং সেগুলি পাচ্ছে আর্থিক ও নৈতিক সমর্থনও।