সম্যক্‌ বচন, আচরণ (কর্ম) ও জীবিকা

পুনঃ মূল্যায়ন

নৈতিক শৃঙ্খলা (শীল), মনোযোগ (সমাধি) ও প্রভেদমূলক চেতনা (প্রজ্ঞা), এই তিনটি শিক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকলে আমাদের যে কোন সমস্যা ও দুঃখ-কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। এই তিনটি বিষয় আমাদের সবসময় সাহায্য করতে ও নজর রাখে প্রস্তুত থাকে। আমাদের অসুবিধাগুলির মূল কারণের চিহ্নিতকরণ এবং কারণগুলি দূর করার জন্য উক্ত তিনটি বিষয়ের প্রয়োগ করাটাই হল এর পদ্ধতি।

দৈনন্দিন জীবনে অন্যদের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে এই তিনটি প্রশিক্ষণের প্রয়োগ অত্যন্ত সহায়ক হয়। 

  • নৈতিক শৃঙ্খলাঃ- অন্যদের সঙ্গে আমরা কীভাবে কথা বলছি ও আচরণ করছি তা লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষতিকারক ও ধ্বংসাত্মক কর্ম থেকে দূরে থাকার জন্য প্রয়োজন হয় নৈতিক শৃঙ্খলা। 
  • মনোযোগঃ- অন্যদের সঙ্গে মত বিনিময়ের সময় আমাদের একাগ্র হওয়ার ক্ষমতা থাকা দরকার। এর ফলে আমরা তাদের কী হয়েছে, তারা কী চাইছেন সেটা বুঝতে পারি। এর পরিবর্তে মন যদি চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, মন যদি সারাক্ষণ পড়ে থাকে ফোনে, তাহলে অন্যদের সঙ্গে আলোচনায় বেশ সমস্যা সৃষ্টি করে।
  • প্রভেদকরণঃ- আমি যদি ভাল করে অন্যদের কথা শুনতাম তাহলে প্রভেদমূলক চেতনা বা প্রজ্ঞার প্রয়োগ করে উচিত প্রতিক্রিয়া দিতে পারতাম। এই বিষয়টি আবার অপরকে নিয়ে সঠিক চিন্তা, আচরণ ও কথা বলার জন্য চালিত করে। 

এই তিনটি প্রশিক্ষণ (শিক্ষা) একে-অপরের সঙ্গে চলে এবং একে-অপরকে সুসংহত করে। একইসঙ্গে তাদের প্রয়োগের কারণ হল, যখন এই তিনটি প্রশিক্ষণ অপরের জন্য প্রয়োগ না করা হয়, তখন এগুলি আমাদের নিজের জন্যেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

  • ওরা আমাদের আত্মনাশের কর্ম করতে বাধা দেয়।
  • মন থাকে একাগ্র, তাতে আমরা যা অর্জন করতে চাই তা করতে পারি।
  • কী যথাযথ বা যথাযথ নয়, তা নির্ণয়ে আমাদের মৌলিক বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পারি।

এইভাবে, ব্যক্তিগত পরিস্থিতি বা সামাজিক মত বিনিময়ের পরিসরে এই মৌলিক নীতিগুলি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারি।


অষ্টাঙ্গিক মার্গ

অষ্টাঙ্গিক মার্গ পালনের মাধ্যমে আমরা এই তিনটি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হই। এ হল আটটি সাধারণ নীতির অনুশীলন এবং এর ফলে এই তিনটির বিকাশ ঘটে।

নৈতিক শৃঙ্খলা (শীল) প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে তিনটি অনুশীলন, যথাঃ-

  • সম্যক্‌ বচন- আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম।
  • সম্যক্‌ কর্ম- আমরা কীভাবে আচরণ করব।
  • সম্যক্‌ জীবিকা- আমরা কীভাবে জীবিকা অর্জন করব।

মনোযোগ (সমাধি) বৃদ্ধি প্রশিক্ষণের জন্যও রয়েছে তিনটি বিষয়ঃ-

  • সম্যক্‌ উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা- আমাদের ধ্বংসাত্মক চিন্তা-ভাবনা দমন ক’রে মনকে ধ্যানের উপযুক্ত করে তোলা।
  • সম্যক্‌ স্মৃতি- আমাদের মনোনিবেশের বিষয় ও অনুপ্রেরণা থেকে বিচ্যুত না হওয়া।
  • সম্যক্‌ সমাধি- গঠনমূলক কোন বিষয়ে একাগ্র থাকা।

প্রভেদমূলক চেতনা বা প্রজ্ঞার প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে দুটি অনুশীলনঃ 

  • সম্যক্‌ দৃষ্টি- সঠিক-ভুল, ক্ষতিকর-উপকারী, এর পার্থক্য বিচার করে সত্যে উপনীত হওয়া।
  • সম্যক্‌ সংকল্প- সম্যক্‌ দৃষ্টি উৎপন্ন হলেই সম্যক্‌ সংকল্প উদয় হয়। এ হল মনের গঠনমূলক অবস্থা।

একটু বিস্তৃত ভাবে বলতে গেলে, আটটি অনুশীলনের মধ্যে প্রত্যেকটির প্রয়োগের ভুল ও সঠিক পদ্ধতি আছে। আমাদের যেটা করা উচিত সেটা হল- ভুলটিকে বর্জন করতে হবে এবং সঠিকটাকে গ্রহণ করতে হবে।

বচন

যেভাবে আমরা অন্যদের সঙ্গে কথা বলি তার থেকেই আমাদের মানসিক অবস্থা বোঝা যায়। প্রত্যুত্তরে আমরা কীরকম ব্যবহার পাবো, তাদের অনুভব কী হবে তার নির্ধারণ হয়। অতএব, আমাদের জানা উচিত কীভাবে কথা বললে সেটা উপকারী হবে আর কিসেই বা হবে ক্ষতিকারক।

ভুল বচন

যে সকল বাক্য দুঃখ ও সমস্যা সৃষ্টি করে সেটা ভুল বা অ-কুশল বচন

  • মিথ্যা বলা- যে বচন অসত্য ও অন্যদের প্রতারনা করতে বলা হয় সেটাই মিথ্যা বচন। আমরা যদি একজন মিথ্যাবাদী, প্রতারক হিসেবে পরিচিত হই; কেউ আমাদের বিশ্বাস করবে না। অনাস্থা প্রকাশ করবে, এমনকি আমাদের কথাও শুনতে চাইবে না। একটি দুঃখদায়ী পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
  • বিভেদ সৃষ্টিকারী বচন- কারও বন্ধু বা সঙ্গীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি বা সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য অপরের নামে কু-কথা বলা হল এই ধরণের কথা বা বচন। এতে মানুষ অবাক হয়ে যায় যে, তাদের অনুপস্থিতিতে আমরা ওদের নিয়ে কীরকম আলোচনা করি। এতে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
  • কঠোরভাবে কথা বলা- নিষ্ঠুর কথা বলা অথবা অপরের সাথে চিৎকার করে কথা বলা বা তাদের খারাপ কথা বলা। যখন আমরা অন্যদের খারাপ কথা বলব, তখন তারাও আমাদের একইরকম খারাপ কথা বলা শুরু করে দেবে অথবা যদি সেই ব্যক্তি আত্ম-নিগ্রহ করে মজা নেওয়ার মানুষ না হন, তাহলে তিনি আমাদের মতো কোনও ব্যক্তিদের কাছে থাকতে চাইবে না যারা তার উপর চিৎকার করতে থাকে।
  • অনর্থক কথাবার্তা বলা- সমসময় আজে-বাজে কথা, অন্যদের থামিয়ে দেওয়া এবং অর্থহীন পরচর্চা-এর অন্তর্গত আসে। এর ফলে কেউ আমাদের গুরুত্ব দেয় না। লোকে ভাবে এদের সঙ্গে থাকা মানে যন্ত্রণা ভোগ করা। এইভাবে নিজের তো বটেই অন্যদেরও সময় নষ্ট করা হয়।

সম্যক্‌ বচন

উক্ত ধরণের মন্দ বা অ-কুশল কথা থেকে দূরে থাকাই হল গঠনমূলক বচন। যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমরা মিথ্যা বলছি, কারও উপর চিৎকার করছি, অনর্থক বকছি এবং বুঝতে পারছি এ হবে বিনাশী, দুঃখের কারণ, তখন আমরা সেরকমটি না করতে সচেষ্ট হই। এই হল প্রথম স্তরের অনুশীলন। 

বিষয়টি মোটেই সহজ নয়। কারণ কথাটি বলে ফেলার আগেই আমাকে ধরতে হবে যে, আমি যেটা বলতে যাচ্ছি এটা অনেকটা এক টুকরো কেক নেওয়ার মতো। অনেক সময় ইচ্ছা করলে আমরা দুটি কেকও নিতে পারি। তবু স্বতঃ প্রবৃত্ত হয়ে একটি নেওয়ার পরও ভাবতে পারি যে- “ঠিক আছে নিলাম, কিন্তু এখনই খাবার দরকার নেই। এই কেকটি আমি চাই না। এটি আমার ওজন বাড়াবে। আমার একটু হাল্কা হওয়া প্রয়োজন।” এই হল শৃঙ্খলা যা আমরা বলতে চাইছি।

আমরা যখন বুঝতে পারব যে এমন করতে যাচ্ছি, তখন প্রাচীন ভারতীয় আচার্য শান্তিদেবের উপদেশটি স্মরণ করতে পারি। তিনি বলেছেন- ‘এমতাবস্থায় কাষ্ঠখণ্ডের মতো হও।’ বুঝতে পারছি আমি চেঁচিয়ে উঠবো বা কিছু নোংরা কথা বলে ফেলব। তা আপনাকে করবে আহত, সেই জন্য বলব না। আমি হব একটুকরো কাঠের মতো, নির্বাক। নির্বোধের মতো মজা বা মূর্খের মতো ভুল মন্তব্য করছি বুঝতে পারলে ভাববো এসব অনর্থক কথা মাত্র। আমি বলবো না। বিষয়টি অনেকটা এইরকম। 

আপনি কোনও গঠনমূলক কর্ম করতে যান, তখন হিতকর বাক্য বলা শ্রেয়। এই হল দ্বিতীয় পর্যায়ের শৃঙ্খলা। এভাবে করলে তা নিয়ে আসবে সুখ আর ঐকতানের সুরটি হবে আরও ভাল। এরকম একটি উপলব্ধি থেকে আসে এর অনুপ্রেরণা। বিষয়টি ‘হেতু-ফল’-এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ভাবনায় থাকতে হবে।

সত্য, শোভন, বিনয়ী, যথাসময়ে যথোপযুক্ত এবং যথার্থ কথা বা সম্যক্‌ বচন বলার অনুশীলনের জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত সচেতন মন ও দৃঢ় সংকল্প।

  • অন্যদের আলোচনায় ক্রমাগত বাধাদান, তুচ্ছ বিষয়, যেমন- সকালে খাওয়া-দাওয়া কী করা হল?, গালগল্প ইত্যাদি নিয়ে অন্যদের ফোন করা বা এস এম এস করা থেকে বিরত থাকার প্রয়াস করা উচিত। এই ধরণের নিরর্থক বার্তালাপ অন্যদের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
  • আমাদের সঙ্গে সহমত থাকলে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে স্বল্প কথায় একটি বিষয়ের উপর বিশ্বাস জাগানোর মতো কথাবার্তা বলাই হবে সদর্থক পদক্ষেপ। 

আমাদের অবশ্যই প্রভেদমূলক বিচার (ভাল-মন্দ বিচার) প্রয়োগ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, মনে করুন কেউ একটি বিশ্রী জামা বা পোশাক পরেছেন। সত্য বলতে গিয়ে আপনি যদি বলে দেন- ‘এটি সত্যিই কুৎসিত দেখাচ্ছে’, তাহলে তিনি কষ্ট পাবেন। এইজন্য, সময় বিশেষে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে, তাও ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে। আমার বোন একদিন আমার এখানে এল। আমরা বাইরে বেরিয়েছিলাম। সে লম্বা ঝুলযুক্ত বেমানান একটি ব্লাউজ পরেছিল। তাকে ভাল দেখাচ্ছিল না। ঐ সময় আমি তাকে বলতেই পারতাম যে, এটি সুন্দর দেখাচ্ছে না। কারণ সে আমার বোন। নিজের পরিবারের বাইরে এমন কথা বলা সহজ নয়। আমরা আমাদের নতুন বান্ধবীকে বলতে পারব না, ‘কি এক বেঢপ ব্লাউজ পরেছ! বদলে নাও।’ সত্য হলেও তা বলব না। 

সত্যি বলতে কি, সময় বিশেষে আমাদের হয়তো কঠিন কথা বলতে হতে পারে। আমাদের সন্তান যদি দেশলাই বা আগুন লাগাতে পারে এমন কিছু নিয়ে খেলা করে, তাহলে আমাদের কঠোর নির্দেশ দিতে হবে। সেক্ষেত্রে তা কর্কশ বাক্য বলে বিবেচিত হবে না। কারণ ক্রোধিত হওয়া আমাদের উদ্দেশ্য থাকে না। সুতরাং মনের ঐকান্তিক ইচ্ছাটিই বা অনুপ্রেরণা সর্বোত্তম। 

ভুল বাক্যের অন্য উদাহরণ

এ সকল বিনাশী বা ধ্বংসাত্মক কথাবার্তার গতি শুধুমাত্র অন্যের উপর নয়, আরও বড় আঙ্গিকে তা আমাদের উপরও আসে। আমরা এই অহিতকর বিনাশী বাক্যগুলিকে আরও বিস্তৃত ভাবেও দেখতে পারি।

মিথ্যা বলা শুধু অন্যকে মিথ্যা বলা নয়। অপরের প্রতি আমাদের মনোভাব ও উদ্দেশ্যও এর মধ্যে সামিল। হয়তো কোন ব্যক্তির প্রতি আমরা খুব ভাল ব্যবহার করি। ধরুন তাকে বলছি- ‘আমরা তোমায় ভালবাসি’। আচরণটি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আমরা নিজেকেও বোকা বানাচ্ছি। আমাদের আসল উদ্দেশ্য হয়তো তার অর্থ (টাকা-পয়সা) বা অন্যকিছু। একদিকে দেখলে তা হল প্রতারণা। আমরা তাকে সোজা বলিনা ‘আমি তোমাকে ভালবাসি না। আমি শুধু তোমার টাকা চাই’। এটা যথাযথ হবে না ঠিকই, কিন্তু উদ্দেশ্য ও অনুভবের প্রতি সত্য নিষ্ঠ কিনা তা আমাদের পরীক্ষা করা উচিত। 

বিভেদমূলক কথা এমন জঘন্য যে, আমাদের স্ব-জনরাও মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিছু মানুষ আছেন যারা সর্বদা অভিযোগ আর নেতিবাচক কথা বলে বেড়ায়। এই কারণে সবাই তাদের এড়িয়ে চলেন। আমরাও সে রকম হলে, কে আর আমাদের ছায়া মাড়াবে? আবার অন্যদের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজে অনাবরত বকে গেলে, লোকেরা আপনার কাছ থেকে পালাবে। আমরা জানি মানুষ সেটাই পছন্দ করে। ওই রকম মানুষের সঙ্গে প্রায়শঃ দেখা হোক তাও চাইব না। যথাসম্ভব সদর্থক ও অপরের বিষয়ে সুন্দর কথা বলাই তো শ্রেয়।

যে কথায় আমরা অপরকে অপদস্থ করার সঙ্গে নিজেকেও করি আহত, সেটাই তো কর্কশ বচন। যখন কাউকে বলি, ‘তুমি একটা আস্ত বোকা, হতাশাজনক ব্যক্তি’, এরকম কথা অবশ্যই নিষ্ঠুরতা। একইরকম ভাবে এই শব্দগুলি যখন নিজেকে বলি! অবশ্যই আমাদের আনন্দ দেয় না। অতএব, নিজের প্রতি আমাদের মনোভাব স্বাগতোক্তি এবং আচরণও সদর্থক থাকা খুবই মহত্বপূর্ণ।

আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, উদ্বেগ, আশঙ্কা ইত্যাদি অন্যের কাছে যথেচ্ছ বলা উচিত নয়। কারণ এগুলি তুচ্ছ বার্তালাপ। কিছু বিষয় থাকে যা অপরের কাছে বলা অনুচিত। যেমন, কেউ আপনাকে বললেন যে, তিনি সমকামী বা তাঁর ক্যানসার হয়েছে এবং তাঁর অনুরোধ বিষয়টি যেন আপনার মধ্যেই থাকে। আপনার তাই করা উচিত। অপরের বিশ্বাস ভঙ্গ করাটা এই তুচ্ছ বার্তালাপের অন্তর্গত আসে।

যথাযথ সময় অনুযায়ী এবং সঠিক পরিস্থিতিতে কথা বলাই হলো সম্যক্‌ বচন। সময় বিশেষে আমাদের প্রথা অনুযায়ী কথা বলতে হয়, আবার কখনও নয়। কথাবার্তা এমন ভাবে বলা উচিত যাতে মানুষ স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আমরা যখন কোনও শিশুকে কোনও বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা করি, আমাদের এটিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যে, সে যেন সেটা বুঝতে পারে; তবে এটি বয়স্ক এবং অন্য সংস্কৃতির মানুষের মধ্যেও যেন প্রসারিত হয়।

কর্মের সীমা (আচরণ)

অষ্টাঙ্গিক মার্গের দ্বিতীয় মার্গ হচ্ছে কর্মের সীমা বা কর্মান্ত। এটি একটি পরিভাষ্য। আমরা যখন সীমার কথা বলি, তার অর্থ হল একটি নির্দিষ্ট গণ্ডীকে নিয়ন্ত্রণ করা। যেমন ধরুন- আমি এই পর্যন্ত কাজ করব, এর বেশী নয়।

ভুল কর্ম (আচরণ)

সীমার বাইরে যাওয়ার মানে হল তিন ধরণের ধ্বংসাত্মক আচরণে যুক্ত হয়ে যাওয়া, যথা-

  • প্রাণীহত্যা- কোনও জীবিত প্রাণীর হত্যা করা।
  • অপ্রদত্ত বস্তু নেওয়া (অদত্তাদান)- যা আমাদের নয়, তা নিয়ে নেওয়া অর্থাৎ চুরি করা।
  • ব্যভিচারে রত হওয়া।

প্রাণীহত্যা

এক কথায় অপরের প্রাণ হরণ করাই হল হত্যাকাণ্ড। এশুধু নরহত্যা বোঝায় না। সমস্ত প্রাণ অর্থাৎ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, মাছ ইত্যাদি এর আওতায় পড়ে।

আমি মনে করি বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই শিকার ও মাছ ধরা ছেড়ে দেওয়া বেশ কঠিন। এখনও অনেকে আছেন যাদের পক্ষে কীট-পতঙ্গ হত্যা না করা আরও বেশী কঠিন। ধরুন, “এই মাছিটি আমার পূর্বজন্মের মা ছিলেন”- এমন পূর্বজন্ম বা অনাগতের কথা না ভেবেও এদের হত্যা না করার অনেক কারণ আছে। এমন অনেক কিছু আছে যা আমাদের বিরক্তির উদ্রেক করে। আমরা সহজাত প্রবণতা বশতঃ তাকে দেখা মাত্র মেরে ফেলব না, এই ভাবনার উপর জোর দিতে হবে। যাকে পছন্দ করি না তাকে ভয়ংকর ভাবে নিকেশ করব, এই প্রবৃত্তি পরিবর্তনের অভ্যাস গড়ে উঠবে। আপনার মুখের সামনে যে মাছিটি ভন-ভন করছে, এই বিষয়টি তার উপরও প্রযোজ্য। এই বিরক্তিকর কীট-পতঙ্গগুলিকে সামলানোর জন্য শান্তিপূর্ব উপায় আছে। ঘরের দেওয়ালে বসলে কাপড় বা কাগজ দিয়ে ধরে ঘরের বাইরে ছেড়ে দিতে পারি। অবাঞ্ছিত বহু পরিস্থিতি আমরা শান্তিপূর্ব ও অহিংস উপায়ে সমাধান করতে সক্ষম।

আপনি যদি ভারতে থাকেন, যেমন আমি পূর্বে ছিলাম, আপনি কীটপতঙ্গের সঙ্গে থাকা শিখে যাবেন। ভারতে পোকামাকড় থেকে মুক্তির কোনও উপায় নেই। ভ্রমণ সংস্থাগুলির জন্য একটি বিজ্ঞাপন মাথায় আসে- “আপনি কীট-পতঙ্গ ভালবাসলে ভারতবর্ষকেও ভালোবাসবেন।” ভারত যাত্রার সময় কীট-পতঙ্গ আমার কাছে ছিল অসহ্য। ভালোবাসতাম কল্পবিজ্ঞান। ভাবতাম সুদূরে কোন গ্রহে যদি যেতে পারতাম আর সেখানে জীবের রূপ হতো এরকম কীট-পতঙ্গ; তাহলে সেটা ভীতিপ্রদ হতো। আমি তাদের দেখলেই হয়তো মাড়িয়ে দিতাম। কিন্তু আপনি যদি নিজেকে পতঙ্গের জায়গায় দেখেন, আপনি দেখবেন যে, ওরা তো শুধু আপন কর্ম করে চলেছে। এর বেশী কিছু না। আর তখনই উপলব্ধি করবেন ওরাও প্রাণী। তাদেরও শ্রদ্ধা করতে শুরু করবেন।

তবে ক্ষতিকর মানুষের মতো অনিষ্টকারক কীটও নিশ্চয় আছে। সময় অনুসারে তাদের দমন করতে কঠোর পদ্ধতি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হোক বা বাড়িতে পিঁপড়ে কিংবা আরশোলার উৎপাত থেকে মুক্তির জন্য প্রথমে শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজতে হবে।

ধরুন ঘাস ফড়িংরা আপনার ফসল খেয়ে ফেলছে। এক্ষেত্রে ইচ্ছাটি খুবই মহত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে একটি উদাহরণ আছে- কোনও এক জন্মে বুদ্ধ জাহাজের নাবিক ছিলেন। নৌকায় যাত্রী ছিল অনেক। তাদের মধ্যে একজন সকলকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল। বুদ্ধ দেখলেন এই লোকটিকে হত্যা করা ব্যতীত, এই গণহত্যা রোধের অন্য কোন উপায় নেই। ক্রোধ বা ভয়ে নয় বরং বুদ্ধ লোকটিকে করুণা সহকারে হত্যা করলেন। প্রথমতঃ রক্ষা করলেন অনেকগুলি মানুষের প্রাণ। লোকটি এমন নরহত্যা করে অপরিমেয় অ-কুশল কর্মফলের ভাগীদার হতে যাচ্ছিল, তা থেকে করলেন রক্ষা। উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, বুদ্ধ স্বীকার করে নিলেন একজনকে হত্যা করে ধ্বংসাত্মক কর্ম করেছেন। স্থির করলেন, “এই কর্মফল গ্রহণ করতে আমি প্রস্তুত এবং সেটা অপরের পরিবর্তে আমার উপর তা আসুক।”

সুতরাং, শষ্য রক্ষার তাগিদে ঘাসফড়িং-এর ঝাঁক হত্যা করতে হলে সেটা যেন ক্রোধ, ভয় বা শষ্য বিক্রি করে অনেক মুনাফা করব এমন ভাবনার কারণে না হয়, বরং সেটা যেন করুণাবশে হয়। তাতে কর্মফল অনেক লঘু হবে, কিন্তু ক্রোধিত হয়ে হত্যা করলে কর্মফল হবে গুরুতর। যাই হোক, বুদ্ধ যেমন করেছিলেন- মনে রাখতে হবে এটিও একটি অ-কুশল কর্ম। এর ফল যাই হোক না কেন মেনে নিতে হবে।

চুরি

অধিকাংশ মানুষ তাদের নিজের জীবন ও বিষয় সম্পত্তির উপর অত্যন্ত আসক্ত থাকেন। আপনি কোন ব্যক্তির সম্পদ নিয়ে নিলে সম্পদের মালিক ও আপনি দুজনেই দুঃখী হবেন। চোর ভাববে- “আমি ধরা পড়ব না তো?” (আতঙ্কিত চোরের সুখ রইল কোথায়?)

আমরা যা করতে চাইছি তা হল বিপত্তি থেকে নিজেদের দূরে রাখা। আপনি কীট-পতঙ্গ বা মাছ মেরে ফেললে অবশ্যই তা ওদের পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপদ। এতে আমাদের সমস্যা হয়। কেননা পোকা মাকড়ের ভয়ে ভীত হলেও রাতে কিন্তু মশার আতঙ্কে ভাল করে ঘুমাতে পারব না। মাঝরাতে উঠে খুঁজব মশা কোথায়। এটা মনের একধরণের অস্থিরতা। এদের মোকাবিলায় শান্তিপূর্ণ উপায় গ্রহণ করলে আমাদের মন অনেক সহজ অবস্থায় থাকবে। 

চুরির ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। আপনি সতর্ক হবেন, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেন, ধরা পড়ব না তো? এর পিছনে জোরালো লিপ্সা থাকে। যখন আপনি অধৈর্য হয়ে যান এবং কিছু পেতে যা করণীয় তা করেন না, তখন কাম্য বস্তুটি অন্যদের কাছ থেকে শুধু চুরি করেন।

বিপরীত অনুপ্রেরণা সহ কৃত হত্যা ও চুরির উদাহরণ আছে।

  • সত্যিই যদি আপনি মাংস বা মাছ খেতে চান, সেই কারণে আসক্তি ও লোভ বশতঃ আপনি প্রাণী হত্যা করতে পারেন। অন্যান্য উপায় একেবারে না থাকলে তা করা যেতে পারে। কিন্তু বিকল্প থাকলে অন্য কথা।
  • কাউকে দুঃখ দেওয়ার জন্য ক্রোধ বশতঃ সেই ব্যক্তির কিছু জিনিসপত্র চুরি করলেন।

ব্যভিচার

যৌনতার পিছনে থাকে আকুল কামনা। এটি মানুষের শক্তিশালী চালিকাশক্তি। এই বিষয়টি আমাদের অনেকের কাছেই জটিল মনে হয়।

কী-কী এড়িয়ে যেতে হবে সে বিষয়ে বৌদ্ধধর্ম একটি দিক-নির্দেশ দান করে। সেটা হলঃ-

  • যৌন আচরণের দ্বারা অপরের ক্ষতিসাধন- ধর্ষণ ও যৌন অত্যাচার।
  • অপরকে চাপ দেওয়া, এমনকি নিজের অনিচ্ছুক সঙ্গী/সঙ্গিনীকেও তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিলনের জন্য চাপ দেওয়া।
  • অপরের সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন অথবা নিজ সঙ্গী/সঙ্গিনী থাকা সত্ত্বেও অন্যের সঙ্গে সহবাস। আমরা যতই সতর্ক থাকি না কেন এসব সম্পর্ক সব সময় সমস্যায় ফেলে। তাই না?

অনুচিত যৌন আচরণের আরও নানা দিক রয়েছে। সমস্ত ভাবনার মূল হল যে, আমরা পশুদের মত আচরণ করব না। পশুরা তাদের চাহিদামত যে কোন সময় মিলনে রত হয়। কে তাদের নিকটে আছে সেটা তাদের কোনও বিষয় নয়। ওরা তাদের জৈবিক প্রবৃত্তির বশীভূত। এই বিষয়টি আমরা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে চাই।

আমরা যা করতে চাইব তা হল আমাদের যৌন আচরণ একটি সীমায় সীমিত রাখব। মিলনের বার, আচরণের ধরণ, মূদ্রা যে কোন বিষয় এই সীমার বিষয় হতে পারে। আমাদের যৌন-জীবন কীভাবে অতিবাহিত করব তার একটি নির্দেশাবলী প্রস্তুত করাটাই হল এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মনে এল তাই পশুর মতো যে কোন স্থানে, সময়ে বা যে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে তা করব না। আত্মসংযমের জন্য এই ভাবনা অত্যন্ত মহত্ত্বপূর্ণ। এই আত্মসংযম বা শৃঙ্খলা সীমা লঙ্ঘন করতে বাধা দেয়। কারণ আমরা বুঝতে পারি এর বাইরে যাওয়া মানেই হল লালসা। আর লালসা অসংখ্য সমস্যার জন্মদাতা।

মাদক দ্রব্য সেবন

মাদক দ্রব্য এই ধ্বংসাত্মক কর্মগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় না। কিন্তু আমাদের উন্নতির জন্য এসব বর্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

আমরা চাই আরও একাগ্র হবো, বৃদ্ধি হোক শৃঙ্খলা, অতি উত্তম, কিন্তু মাতাল হয়ে গেলে সব শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলি। তাই না? অলিক মায়াজাল সৃষ্টিকারী, উত্তেজক মাদক, মারিজুয়ানা ইত্যাদি সেবন করি। আর হারিয়ে ফেলি মানসিক ভারসাম্য ও একাগ্রতা। মন উড়ে বেড়ায় কল্পনার জগতে। উন্নতির লক্ষ্যে আমরা কী পেতে চাই আর তার সঙ্গে মাদক বা মদ্যপানের তুলনা একেবারেই বিপরীত, দ্বন্দ্বমূলক। এটা বিঘ্ন সৃষ্টি কর্তা। মাদকাসক্ত অবস্থায় শুধু নয়, পরেও তার প্রভাব অনেকক্ষণ থাকে। ব্যবহারিক ভাবে কিছু নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই ভাল। একেবারেই ছেড়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই।

সম্যক্‌ কর্ম বা কর্মান্ত (সদাচরণ)

ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে দূরে থাকা হল আত্মশৃঙ্খলা বা সংযমের একটি দিক। অপরটি হল গঠনমূলক কর্ম, আর তাই হল সম্যক্‌ কর্ম বা সদাচার।

এইভাবে, অপরের প্রাণহরণ নয়, একটি জীবন রক্ষায় সক্রিয় হোন আপনি। ব্যাপকার্থে এর প্রয়োগ হতে পারে পরিবেশ রক্ষায়, ধ্বংসে নয়। তবেই জীবজন্তু ও মাছ স্বাধীনভাবে বাঁচবে। আপনার যদি শুকরছানা থাকে, তাদের খাদ্য দিন। এভাবে নয় যে খাইয়ে ওদের মোটা করে মাংস খাব। বরং তাদের খাদ্য চাই, আর আপনি তাদের বাঁচিয়ে রাখছেন, এই ভাবনা থাকুক। আপনার কুকুরটিকে আহার দেওয়াও জীবন রক্ষার একটি উপায়। অসুস্থ, আহতদের সেবা শুশ্রুষা ও একইরকম জীব সেবা। 

ভাবুন একটি মৌমাছি আপনার কক্ষে উড়ে বেড়াচ্ছে। ওঁর কিন্তু আপনার কক্ষ্যে আটকে থাকার কথা নয়। বরং বেরিয়ে যেতে চায়, কিন্তু বুঝতে পারছে না কীভাবে যাবে। ভুল করে ও আপনার কক্ষে ঢুকে পড়ল আর আপনি তাকে মেরে ফেললেন। এটা কি খুব একটা ভাল কাজ হল? আপনি তাকে সাহায্য করতে পারেন। খুলে দিন জানালা আর বলুন- যাও! এই হল প্রাণ রক্ষা। মৌমাছিটিও বাঁচতে চায়। একটি পাখি যদি ভুল করে আপনার ঘরে ঢুকে পড়ে, আপনি কি তাকে গুলি করার জন্য বন্দুক বার করবেন? মনে হয় না। দৃশ্যতঃ মৌমাছি ও পাখির মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হল তাদের আকার আর ওদের ডাক বা শব্দ। আপনি আপনার ঘরে মাছি ঢোকা পছন্দ করেন না। ঠিক আছে; জানালা খুলবেন না বা পরদা লাগিয়ে দিন। ব্যাস হয়ে গেল। 

চুরি যেন না করতে হয়, তার জন্য রক্ষা করুন অন্যদের সম্পদ। কেউ যদি আপনাকে কিছু ধার দেয় চেষ্টা করবেন এর যেন কোনও ক্ষতি না হয়। সুন্দর জিনিস পেতে মানুষকে সাহায্য করুন।

ব্যভিচারের বিষয় শুধুমাত্র অপরের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক নয়, নিজের সাথে যৌন সম্পর্কও এর অন্তর্গত। কুকুরের মত প্রবৃত্তির নিবৃত্তি নয়, যৌন আচরণেও আমাদের হতে হবে সহৃদয় এবং স্বস্তিদায়ক।

সঠিক ভুল কর্মের কয়েকটি উদাহরণ

আমরা যদি আলোচনাটিকে একটু বাড়িয়ে দেখি, তাহলে দেখব যে এই তিনটি কর্মের অন্তর্গত আরও অনেক বিষয় রয়েছে। 

উদাহরণস্বরূপ, হত্যা না করার বিষয়টিকে বিশদে দেখলে দেখব যে কোন ব্যক্তিকে কঠিন শারীরিক যাতনা দেওয়াও ঠিক নয়। শুধু দৈহিক নির্যাতনই নয়, কাজ করানোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত খাটান যাতে তাদের দৈহিক ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা তাও এর অন্তর্গত। আমরাও এর বাইরে নই। অতিরিক্ত পরিশ্রম করে আমাদের দেহেরও ক্ষতি করা অনুচিত। স্বল্প নিদ্রা, স্বল্পাহার করা উচিত নয়। অন্যদের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করছি তা যেমন দেখা উচিত, তেমনই দেখা উচিত নিজেকে। 

অপরের জিনিস নিয়ে নেওয়াই শুধু চুরি নয়। অন্যকে না জানিয়ে তাদের জিনিস ব্যবহার করাও একই বিষয়। যেমন ধরুন, মালিককে না বলে কারও ফোন থেকে ব্যয়বহুল ফোন করা, ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে খেয়ে ফেলা বা টিকিট না কেটে সিনেমায় ঢুকে পড়া, সরকারকে দেয় কর ফাঁকি দেওয়া, এসবই চুরির মধ্যে সামিল। আপনি যুক্তি দিতে পারেন যে যুদ্ধ আর সমরাস্ত্র কেনার জন্য আমি কর দেব না। কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে যে এই করের টাকাতেই রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি গড়ে উঠছে। এসব আপনি চাইলে কিছু কর তো আপনাকে দিতেই হবে।

অনধিকারী বা অননুমোদিত সফ্‌টওয়্যার ও ভিডিও ডাউনলোড করাকে কি চুরি বলবেন? আমার মনে হয় হ্যাঁ। বিশেষ করে যেখানে বলা থাকে যে বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে না, সেখানে তো অবশ্যই। এটা চুরি নয় বলার কোন উপায় নেই। যাই হোক একটি সীমারেখা টানাই নৈতিকতার মূল। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন কর্মটি করব না এর মধ্যে সুস্পষ্ট চিন্তার সীমারেখা থাকা বিধেয়। চুরির কথাই ধরা যাক। বলতেই পারেন আমি তো ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে যাচ্ছি না, না চুরি করছি দোকানে। মূল্য না দিয়ে ডাউনলোড করা? তা এখনই ত্যাগ করতে পারছি না। এতে কিছুটা সীমা টানা হলেও দাম না চুকিয়ে ডাউনলোড করাও চুরি। ডাউনলোড করে মূল্য দেওয়ার মতো টাকা আছে অথচ দিলেন না। আবার টাকা না থাকার মধ্যে পার্থক্য আছে। টাকা থাকা সত্ত্বেও দিলেন না, এটা গুরুতর নোংরামি। এটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

চুরির পরিপ্রেক্ষিতে বললে, আমাদের নিজেদের দিকেও দেখা উচিত। তুচ্ছ বিষয়ে অর্থ ব্যয় বন্ধ করতে পারি, যেমন- জুয়া। কারণ এতে আমাদের ধন-সম্পত্তির অপব্যবহার হয়। অন্যদিকে সামর্থ্য থাকলে কৃপণ হওয়াও ঠিক নয়। অর্থ থাকলে সুখাদ্য নিশ্চয়ই কিনবেন। কৃপণ হলে তো কিনবেন সস্তা খারাপ খাবার। এটাতো নিজের কাছ থেকেই চুরি করা হয়ে যায়! 

ব্যভিচারের বিষয়টি শুধুমাত্র অন্য কেহ বা তাদের সঙ্গী/সঙ্গিনীদের প্রতি ধাবিত হওয়া নয়। সম্ভাব্য যৌন সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত আমাদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি রোধও এর অন্তর্গত। মনে করুন, কোনও ব্যক্তির সঙ্গে আপনার পরিচয় হল। আপনি তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লেন। আপনি চাইছেন যৌন মিলন হোক। কিন্তু সমস্যাটি হল অপর পক্ষেরও নানা রকম আবেগজনিত এবং অন্যান্য সমস্যা রয়েছে। আপনি বুঝতে পারলেন যে, তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে ভবিষ্যতে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হবে। এই আপন হিতের জন্যই এতে জড়িয়ে পড়বেন না। সুদর্শন/সুদর্শনা কাউকে দেখলেই কামনা তাড়িত হওয়া উচিত নয়! 

নির্দিষ্ট সীমাটি অতিক্রম করে ফেললে কী করব

কোন-কোন সময় আমাদের স্বতপ্রণোদিত লক্ষণরেখা লঙ্ঘিত হয়। তা হয়েই থাকে। সেরকম পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বৌদ্ধধর্ম কতগুলি বিপরীত-ধর্মী উপদেশ বা শিক্ষা দান করে-

  • যা করেছেন তা স্বীকার করে নিন, নিজের কাছে সৎ থাকুন।
  • কৃত-কর্মের জন্য দুঃখিত হোন। ভাবুন যা ঘটেছে তা নাহলেই ভাল হতো। এটা দোষী হওয়া থেকে ভিন্ন। দোষী ব্যক্তি তো নিজেকে ভয়ংকর ভাবে এবং তা থেকে মুক্ত হতে পারে না।
  • সংকল্প নিন, পুনরাবৃত্তি রোধ করুন।
  • মনের ঐকান্তিক ইচ্ছাটিকে করুন পুনঃশক্তিশালী। ভাবুন যে, সীমা অতিক্রম করলে তা শুধু সমস্যা ও দুঃখই দেয়।
  • বিপরীত প্রয়োগ- কখনও যদি কাউকে ভৎর্সনা করে থাকেন, তার কাছে বিনীত ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। বলুন যে, সে সময় তার মানসিক অবস্থা ভাল ছিল না ইত্যাদি।

জীবিকা

এই বিষয়টি আমাদের জীবনধারণের উপায়ের সঙ্গে যুক্ত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নৈতিক মূল্যবৃদ্ধি।

মিথ্যা বা ভুল জীবিকা

নিজের এবং অপরের পক্ষ্যে ক্ষতিকারক এমন কর্ম বা শিল্প থেকে অর্থ উপার্জন করা হল ভুল জীবিকা। এর কয়েকটি উদাহরণ হল-

  • অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবসায়
  • কসাইখানা, মাছ ও পশুশিকার ও কীটনাশক/নাশের কর্ম।
  • মদ্য বা মাদকের উৎপাদন, বিক্রয় ও পরিবেশন।
  • জুয়াখানা পরিচালনা
  • যৌন উত্তেজক ছবির প্রকাশন ও বিতরণ

এই ধরণের জীবিকা অপরের ক্ষতির কারণ হয়। পর্ণগ্রাফি লালসা ও দৈহিক চাহিদা বৃদ্ধি করে। এমনকি আমরা যদি গতানুগতিক কর্মেও নিযুক্ত থাকি অসৎ উপায় বর্জন করে সৎ পথে থেকে করাটা খুবই মহত্বপূর্ণ।

  • মক্কেলদের কাছ থেকে যথাসম্ভব অর্থ নিংড়ে নেওয়া, অতিরিক্ত অর্থ আদায়।
  • আত্মসাৎ- ব্যবসা থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে নিজের জন্য ব্যয় করা।
  • অর্থ আদায়ের জন্য অন্যদের উপর অবৈধ জুলুম, ভীতি প্রদর্শন।
  • উৎকোচ দান (ঘুষ)।
  • অন্যদের শোষণ
  • মিথ্যা বিজ্ঞাপন।
  • অধিক উপার্জনের জন্য খাদ্য বা পণ্যে ভেজাল দেওয়া।

জীবিকা ধারণের জন্য এমন বহু অসৎ উপায় রয়েছে। এই ধরণের জীবিকা পরিত্যাগ করার জন্য আমাদের আত্মসংযম ও নৈতিক আদর্শের প্রয়োজন।

সম্যক্‌ জীবিকা

সৎ এবং সমাজের উপকার হতে পারে এরকম জীবিকা অর্জন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। যেমন-

  • ঔষধপত্র
  • সমাজ সেবা
  • আইনানুগ ব্যবসায়
  • মানুষের উপকার হবে এমন পণ্যের উৎপাদন ও সেবা ইত্যাদি।

সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা ও অপরের কল্যাণের জন্য যে কোনও ধরণের অবদান অতুলনীয়। তাছাড়া আমাদের এই নীতি মেনে চলা উচিতঃ

  • কাউকে প্রতারণা নয়, বেশীমূল্য ধার্য্য করা নয়।
  • সঠিক মূল্য ধার্যকরণ, এতে গ্রহণযোগ্য লাভও থাকবে।
  • আমাদের কর্মচারীদের শোষণ নয়, বরং তাদের যোগ্য প্রাপ্য দেওয়া উচিত।

কোন-কোন সময় আমাদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। একসময় অস্ট্রেলিয়ায় একজন তিব্বতী গুরুজীর অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছিলাম। এক ভদ্রলোক আমায় বললেনঃ “আমি যে শহরে থাকি সেখানে একটি মাত্র কাজ পাওয়া যায়, তা হল ভেড়া পালন। তা থেকে পাওয়া যায় উল ও মাংস। আমার কী করা উচিত? আমি অন্য শহরে গিয়ে নতুন চাকুরি খুঁজতে যেতে পারছি না।” গুরুজী বললেনঃ “মূল বক্তব্য হল আপনি আপনার পেশায় সৎ থাকুন। অন্যদের প্রতাড়িত করবেন না। ভেড়াগুলিকেও কষ্ট দেবেন না বরং তাদের প্রতি সদয় থাকবেন। ভালো খাবার দেবেন। যত্ন করবেন তাদের।” সম্পূর্ণ বিষয়ের সারমর্ম হল- সদয় ও সৎ হওয়া। 

সারাংশ

অষ্টাঙ্গিক মার্গ থেকে প্রাপ্ত উপদেশগুলি দেখলে মনে হয়- এগুলি কিছু নিয়ম বা বিধান যা আমাদের বেঁধে রেখেছে। বিষয়টি তা নয়, বরং এগুলি আমাদের নেতিবাচক কর্ম থেকে মুক্ত করে আর ঐ ধরণের কর্ম নিজের সাথে-সাথে অপরেরও অমঙ্গল করে।

Top