শান্ত হওয়ার জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর ধ্যান

শান্ত হওয়ার জন্য নিশ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোযোগ দেওয়া হল বৌদ্ধ পরম্পরায় একটি উপায়। বৌদ্ধ প্রশিক্ষণে অনেক রকম শ্বাস-প্রশ্বাসের উপায় আছে, সেই সাথে রয়েছে নানারকম নিশ্বাসের অনুশীলন। যেটা আমি জানি তাতে প্রায় সবগুলি নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার সাথে যুক্ত, মুখ দিয়ে নয়। আর শ্বাস-প্রশ্বাস হবে স্বাভাবিক, জোর ক’রে নয়।

এই উপায়গুলির কয়েকটিতে আমরা শ্বাস আটকে রাখি আর কয়েকটিতে রাখি না। কখনো-কখনো আমরা নিশ্বাস নেওয়ার সময় শ্বাস ধরে রাখি আবার কখনো-কখনো শ্বাস ছাড়ার সময় একটু বিরতি দিই। সবই নির্ভর করে অনুশীলনের উদ্দেশ্য কী তার উপর। এতেই শ্বাস-প্রশ্বাসের পদ্ধতি নির্ধারিত হয়।

শান্ত হওয়ার জন্য পরম্পরাগত পদ্ধতি হল নিঃশ্বাস নেওয়া ও ত্যাগ করার চক্রটিকে ব্যবহার করা। শ্বাস ত্যাগ করার সময় আমরা একটু বিরতি বা ধরে রাখতে পারি কারণ তারপর অনায়াসে আমরা আরও গভীর শ্বাস নিতে পারি এবং সেটা স্বাভাবিক ভাবেই হয়। শান্ত হওয়ার জন্য এই সরলতম উপায়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় আমরা শ্বাস ধরে রাখি না। যদিও অন্য উপায়ে সেটা আছে। এই চক্রটিকে ব্যবহার করার কারণ হল, আমি বুঝতে চেয়েছি যে এই শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার পদ্ধতি ব্যবহার করার অনেক কারণ আছে; কিন্তু এখানে এর প্রধান উদ্দেশ্য হল আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলিকে শান্ত করা। অধিকাংশ মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাসের চক্রকে যেভাবে কল্পনা করে এই ভাবে গণনা করা তার থেকে ভিন্ন। এই পদ্ধতিটিতে অনেক বেশী মনসংযোগ করতে হয়। যেহেতু, এরজন্য অনেকবেশী একাগ্র হয়ে মনসংযোগের প্রয়োজন হয়, তাই সেই সময় অন্য কিছু ভাবার মতো অবকাশ থাকে না। তাই, পদ্ধতিটি মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে।

এটা হল পরম্পরাগত পদ্ধতি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে পশ্চিমী লোকজন, বিশেষ ক’রে যারা উপদেশ শুনতে আসেন, তারা অত্যন্ত ক্লান্তিকর চাপের দিনেই আসেন। তারা অত্যন্ত চাপের মধ্যে কঠিন পরিশ্রমে কাজ শেষ করে। তারপর ট্রাফিকের ঝুক্কি সামলে সন্ধ্যাবেলায় উপদেশ শুনতে যান। যখন আমরা ভারত বা তিব্বতের বৌদ্ধ পরম্পরার কথা বলব তখন এই বিষয়টি হবে না। অথবা আমরা ঘুম থেকে উঠেই সকালে কিছু ধ্যান করতে বসে পড়লাম, তাও হবে না। সুতরাং, আপনি যদি পশ্চিমের কোন ক্লান্ত বিধ্বস্ত মানুষ হয়ে থাকেন, যিনি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানে এসেছেন, তাকে প্রথমেই শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোযোগ দিতে বলা হয়, তার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ম ভিন্ন হবে। এতে তাদের চাপ বাড়বে। বিভ্রান্তিই হবে এর কারণ।

যেহেতু, প্রশান্তি লাভই হল এই প্রথম পর্যায়ের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের উপর অনুশীলনের উদ্দেশ্য। তাই, একজন ক্লান্ত বিধ্বস্ত পশ্চিমী অনুশীলনকারীর কাছে যদি এই পারম্পরিক পদ্ধতি অর্থাৎ নিঃশ্বাস নেওয়া ও সাফল্য সময় ধরে রেখে শ্বাস ছাড়ার চক্রের বিষয়টি বিভ্রান্তিকর লাগে; তাহলে এটা তাদের আরও বেশী চাপে ফেলবে। এর উদ্দেশ্যটিই ব্যহত হবে। অতএব, এই প্রসঙ্গে উক্ত বিষয়ের উপর জোর দেওয়ার দরকার নেই। আমি যেটা বলব সেটা হল, যদি তারা পরম্পরাগত পদ্ধতিটি অনুশীলন করতে গিয়ে আরও চাপে পড়ে যান তাহলে তারা এই পদ্ধতি বা চক্রটিকে পশ্চিমী কায়দায় দেখতে পারেন। এটা হল শুধুমাত্র শ্বাস নেওয়া এবং ছাড়া, এই চক্রটি গণনা করা, কোনও রকম বিরাম বা শ্বাস ধরে রাখার প্রয়োজন নেই। তারপর, আমাদের মন যদি বেশী বিক্ষিপ্ত থাকে তাহলে শান্ত হওয়ার জন্য শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার চক্রটিতে মনযোগ দিয়ে অনুভব ক’রে গণনা করতে পারি। আর মন যদি ততটা বিক্ষিপ্ত না হয় অথবা অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকে তাহলে গণনা করার দরকার নেই।

অন্যভাবে বলতে গেলে, পরম্পরাগত ধর্মীয় পদ্ধতি অনুসরণ করতে হলে আমরা তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি। একজন ব্যক্তি কী পরিস্থিতিতে আছেন সেটা তাকে নিজেকেই বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়।সুতরাং,

  • আমরা যদি অত্যধিক চাপে থাকি, তাহলে আমরা সাধারণ পশ্চিমী পদ্ধতিতে শ্বাস নেওয়া এবং শ্বাস ত্যাগ করার একটি চক্র ধরে শুধু গণনা করব।
  • আমরা যদি ততটা চাপে না থাকি, আর আমাদের মন লক্ষ্যে স্থির নয়, তাহলে আমরা স্বাভাবিক ও পারম্পরিক পদ্ধতি যেটা হল শ্বাস ছেড়ে একটু বিরতি নিয়ে আবার নেওয়া, এর অনুশীলন করতে পারি।
  • আর আমাদের মন যদি অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকে, তাহলে আমাদের গণনা করার দরকার নেই। শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসে মনকে একাগ্র করলেই চলবে।

এই পদ্ধতিগুলি প্রয়োগের সময় আমরা দেখি যে আমরা নিজেদের প্রতি অনুভবপ্রবণ হয়ে উঠছি এবং উপযুক্ত পদ্ধতিটি প্রয়োগ করছি। বৌদ্ধ উপদেশাবলীর আশ্চর্য দিকটি হল যে তাদের পদ্ধতিসমূহ খুবই সমৃদ্ধশালী। যেকোন একটি লক্ষ্য পূরণের জন্য বহু পদ্ধতি বা উপায় রয়েছে। এটা অনুভূতির প্রশিক্ষণের পক্ষেও খুবই ভাল হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের মনের আবেগগুলির সঠিক অবস্থা কী সেটা বোঝার জন্য আমাদের নিজস্ব অনুভূতি বোঝার ক্ষমতার বিকাশ করতে হবে। এই কারণে আমরা কোন কিছুতে সম্পন্ন হওয়ার জন্য অনেক পদ্ধতি শিখতে পারি, তাহলে তার জন্য একটি উপযুক্ত পদ্ধতি বেছে নিয়ে তার প্রয়োগ করতে পারি। পদ্ধতিটি যদি কার্যকর না হয় তাহলে অন্য আর একটি পদ্ধতি চেষ্টা করতে পারি। অতএব, শান্ত হওয়ার জন্য এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে যে কোন একটির ব্যবহার ক’রে শ্বাস-প্রশ্বাসে মনোযোগ দেওয়া যাক।

[ ধ্যান ]

শান্ত হওয়ার এই প্রাথমিক পর্বে আমাদের চোখের কথাই ধরা যাক, আমরা চোখ খোলা রাখতে পারি, মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি অথবা চোখ বন্ধ করেও রাখতে পারি। উভয় পদ্ধতি সম্পর্কে বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছেন। বৌদ্ধ উপদেশের দুটি প্রধান ভাগ রয়েছে। থেরবাদী পরম্পরায় সাধারণতঃ আমরা চোখ বদ্ধ করে ধ্যান করি। মহাযান, অপর একটি প্রধান শাখা, এতে আমরা ধ্যান করি চোখ খোলা রেখে, নাকের ডগা বা মেঝেতে তাকানো হয়। নাকের ডগার দিকে তাকিয়ে সাধারণ দৃষ্টি থাকে, তীক্ষ্ণ ভাবে তাকানো নয়।

আবারও আমাদের নিজেদের উপর সংবেদনশীল হতে হয়, কিন্তু আমরা যদি অত্যধিক চাপে থাকি তাহলে চোখ বন্ধ করে ধ্যান করা সহজ হয়। আর যদি আমরা কিছুটা শান্ত থাকি তাহলে মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে চোখ খোলা রাখা উচিত, কারণ আমরা শুধু চোখ বন্ধ ক’রে বিশ্বের দরজা বন্ধ ক’রে শান্ত হতে চাই না। বরং আমরা চাই জগৎ এবং অন্যান্য সকলের সঙ্গে কাজকর্মে যুক্ত থেকেও শান্ত ও সহজ থাকতে। সুতরাং সেরকম হতে গেলে চোখ খোলা রেখে ধ্যান করাই কাম্য।

পরবর্তী পর্যায় হল মনের ঐকান্তিক ইচ্ছাটিকে পুনরায় সুদৃঢ় করা। কোন কোন সময় আমরা আমাদের আবেগ ও মানসিক অবস্থাকে বিশ্লেষণ ক’রে ভাবতে থাকি যে কেন আমরা এই অনুশীলন বা ধ্যান করতে আসি। আমি কেন করছি? অপরাধবোধের কারণ কি? আমরা কি অন্যান্যদের চাপে করছি? কোন সামাজিক অনুষ্ঠান, কোন দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় আমি কি একজন ধর্মের ধ্বজধারী বা কোন প্রভাবশালী চিত্তাকর্ষক গুরুর কাছ থেকে শক্তি লাভ করব, এরকম ইচ্ছায় ধ্যান করছি? নাকি গুরুকে আপনি ভালবাসেন তাই আসক্তিবশতঃ আসেন। এই সবকিছুই বৌদ্ধ ভাবনার বিপরীত। এটা হল অনেকটাই পশ্চিমী ভাবনা এবং অবশ্যই এটা কাজ দেয়।

কিন্তু পরম্পরাগত বৌদ্ধ রীতিতে আমরা বলি যে আমরা আমাদের ঐকান্তিক ইচ্ছাটিকে সুদৃঢ় করি। এর অর্থ হল উদ্দেশ্যের সুদৃঢ়করণ। বৌদ্ধ প্রেষণা হল এক ধরণের উদ্দেশ্যের রকমফের। অন্যভাবে বলতে গেলে- এখানে এসে আমরা কী করছি? আমাদের উদ্দেশ্য কী, কীই বা আমাদের লক্ষ্য? এখানে এসে আমরা যা লাভ করতে চাই সেই দৃষ্টিকোণে দেখলে তিনটি সম্ভাব্য লক্ষ্য নিয়ে সেটা আমরা ভাবতে পারি এবং সেটাই হবে যথাযথ। তারপরেও উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের বিষয়ে আমাদের হতে হবে নিজের প্রতি অনুভূতি সম্পন্ন ও সৎ। কারণ, যিনি নিজেকে বৌদ্ধ ভাবেন এমন কোন ব্যক্তির পক্ষে বলা সহজ যে- “আমি এসব সর্বসত্ত্বার মঙ্গলের জন্য বুদ্ধত্বলাভ করতে চাই।” এসবই কথার কথা।

কারণ, বুদ্ধত্ব লাভের প্রকৃত অর্থ কী সেটা না জেনে জগতের প্রতিটি পোকামাকড় পর্যন্ত অনিয়ন্ত্রিতভাবে অসংখ্যবার জন্ম নিচ্ছে, তাদের মুক্ত করার সদ্‌ভাবনা না থাকলে “আমি সকল সত্ত্বার হিতের জন্য বুদ্ধত্ব লাভ করতে চাই” এটা বলা নিরর্থক। আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য কী, এ বিষয়ে বাস্তবসম্মত ও সদ্‌ চিন্তা থাকলে সেটা অনেক বেশী কার্যকর হয়। তাই, এতে তিনটি উপযুক্ত লক্ষ্য রয়েছে। একটি হয়তো হতে পারে যে আমরা শুধুমাত্র এই জীবনে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখতে সচেষ্ট। তাই আমরা এখানে অনুশীলন করতে এসেছি। এই বৌদ্ধ পদ্ধতিকে একটি থেরাপির মতো ধরে নিয়েছে।

অথবা একজন তথাকথিত ধার্মিকের দৃষ্টিকোণেও অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। তাও হবে, “আমি এই জীবনে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করতে এটা করছি। তার সঙ্গে দেখছি যে এটা আমাকে মুক্তি ও বুদ্ধত্বের দিকে নিয়ে যাওয়ার সিঁড়ি হতে পারে।” আবার একজন প্রকৃত ধার্মিক দৃষ্টিতেও দেখা যেতে পারে। তা হবে, “আমি প্রকৃতার্থে যুক্তি ও বুদ্ধত্ব লাভের জন্য পদক্ষেপ হিসেবে এর প্রশিক্ষণ নিচ্ছি।” তাই, আমাদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাই হোক না কেন আমরা নিজেকে পুনরায় সংগঠিত ও আশ্বস্ত করি। আমরা যদি লক্ষ্যে সৎ থাকি, মনে-প্রাণে এই ধ্যান করা সহজ হয়ে যায়। নতুবা লক্ষ্যে সৎ না হলে যা করছি সেটা খেলা হয়ে দাঁড়ায়।

তারপর, আমরা একাগ্রতার সাথে শোনার জন্য সচেতন হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। যদি আমাদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়, আমরা তাকে ফিরিয়ে আনি; ঘুম পেলে জেগে থাকার চেষ্টা করি। বসার ভঙ্গী মনোযোগে সহায়ক হলে সেটা ঠিক করি অর্থাৎ সোজা হয়ে বসি, কিন্তু শক্ত হয়ে নয়। যদি দেহে শক্তি একটু কম থাকে তাহলে দুই ভ্রু-এর মাঝে মনকে কেন্দ্রীভূত করি। সেইজন্য মাথা সোজা রেখে দুই চোখের দৃষ্টি ঐ বিন্দুতে স্থির করি। যদি একটু উত্তেজিত বা স্নায়বিক দুর্বলতা অনুভব করি; সেক্ষেত্রে শক্তির সমতা ফিরিয়ে আনতে আমরা মাথা সোজা রেখে দৃষ্টি নীচের দিকে এনে নাভির দিকে লক্ষ্য করি। শ্বাস স্বাভাবিকভাবে নিয়ে ছাড়তেই হবে এমন অবস্থা পর্যন্ত নিঃশ্বাস ধরে রাখি।

কীভাবে একাগ্র চিত্ত হওয়া যায় তার উপদেশ মৈত্রেয়-এর উপদেশে পাওয়া যায়। এর দ্বারা সচেতন হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং একাগ্র হওয়ার ইচ্ছা জাগানো যায়। শক্তির ভারসাম্য আনয়ন যা ভ্রু-এর মাঝখানে এবং নাভিতে দৃষ্টি স্থির ক’রে করা হয়, সেটা কালচক্র-উপদেশ থেকে এসেছে। এইভাবে যদিও বৌদ্ধ পরম্পরায় প্রাথমিক অনুশীলনের জন্য সবগুলি মিলিয়ে একটি সুচী বা সংগ্রহ নিই, তবুও সেটা সবই বৌদ্ধ উপদেশ। কিন্তু আমি এগুলিকে প্রাথমিক আকারে সাজিয়েছি। আমি দেখেছি যে পশ্চিমীরা যখন উপদেশ শুনতে আসেন, তখন তারা খুবই চাপের মধ্যে থাকেন। এই ধরণের কার্যক্রম বা উপদেশের ক্রমটি তাদের সাহায্য করে। আমাদের অত্যধিক চাপের জীবনের সঙ্গে মানানসই একটি প্রাথমিক অনুশীলনের সংগ্রহ থাকার প্রয়োজন আছে।

Top