অহিংসাই পথ

দ্বন্দ্বের সমাধান এবং শান্তি অর্জনের বাস্তবিক উপায় হল অহিংসা। এটা বৈজ্ঞানিক নিষ্কর্ষেরও অনুরূপ যে, করুণা হল মানুষের মৌলিক স্বভাব। আমরা যদি বিগত শতাব্দীর দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাব যে হিংসা কেবল বেশি বিদ্বেষ এবং নেতিবাচক আবেগের জন্ম দিয়েছে। যদি হিংসার বিরুদ্ধে হিংসাকে ব্যবহার করা হয় তাহলে এর কোন ইতিবাচক পরিণাম ফলিভূত হয় না। ইউরোপের নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, হিংসা সঠিক কোন পদ্ধতি নয়। তারা উন্মুক্ত মনে চিন্তা-ভাবনা করেছিল এবং তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তারা ইউরোপীয় সংঘের স্থাপনা করেছিল। আমি প্রায়শই মানুষকে বলি যে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কীভাবে ফ্রান্স এবং জার্মানী একে অপরের শত্রু ছিল। আমার বন্ধু এবং কোয়ান্টাম পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক কার্ল ফ্রেডেরিক ভন ওয়েজসাকার, যখন তার বয়স নব্বই বছর ছিল, তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি যখন ছোট ছিলেন ঐ সময় জার্মানবাসীরা সমস্ত ফরাসীদের নিজের শত্রু মনে করত আর ফরাসীরা জার্মানীদের, কিন্তু এখন সেই মনোভাব পুরোপুরিভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে।

ক্রমশঃ মানুষ যখন গভীর অভিজ্ঞতা অর্জন করল তখন তারা বুঝতে পারল হিংসা পুরনো হয়ে গিয়েছে। হিংসা প্রবলভাবে নির্ভর করে “আমরা” এবং “তারা” এই ধারণার উপর। আর তারপর এর উপর ভিত্তি ক’রে শুরু হয় লড়াই-ঝগড়া। আর তাই সমস্ত প্রতিবেশীকে একটা সমুদয় মনে ক’রে তারা ইউরোপীয় সংঘের স্থাপনা করে। আমি সবসময় বলি ইউরোপীয় সংঘ শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে ঝগড়ার কোন আশঙ্কা দেখা দেয়নি যা ইউরোপে একটা যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। যদি ইউরোপীয় সংঘ স্থাপিত না হতো তাহলে সম্ভবত এখন পর্যন্ত কোন না কোন গুরুতর সমস্যা অবশ্যই দেখা দিত। কিন্তু মানুষ অহিংসক হয়ে তাদের মৌলিক মানব স্বভাবের সাথে তাল মিলিয়ে চলে।

বিংশ শতাব্দীর শুরু এবং শেষের মধ্যে মানুষের চিন্তা-ভাবনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তন হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, পোল্যান্ডের সংহতি আন্দোলনকে ধরুন, সেখানে আগে দু-লক্ষ রাশিয়ার সৈন্য ছিল কিন্তু সেখানকার মানুষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল যে তারা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অহিংসা পদ্ধতির সাথে লড়বে। এই ধরণের বিষয় একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে এই মহাদেশের লোকজন হিংসার পথে এত কষ্ট-যাতনা ভোগ ক’রে বুঝতে পেরেছে যে, অহিংসাই হল সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়।

আমি আশা করি রাশিয়া ইউরোপীয় সংঘে যোগ দেবে। আমি এটাও মনে করি যে এই একই চিন্তা-ভাবনার নিরিখে ইউরোপীয় সংঘের মতো লাতিন আমেরিকায় এবং আফ্রিকায় সংঘের স্থাপনা হওয়া উচিত। আফ্রিকায় অনেকগুলি ভিন্ন দেশ আছে। সেইজন্য সম্ভবতই এটাকে কেবল উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করা যেতে পারে আর তারপর সেটা মধ্য, পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। আর তারপর সম্পূর্ণ বিশ্ব! অবশেষে আমাদের লক্ষ্য এরকম হওয়া উচিত যে সম্পূর্ণ বিশ্ব যেন একটা সংঘে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আমার মনে হয় এটা সম্ভব, আর এটা আমার স্বপ্ন।

ভারত এর জন্য একটা ভাল উদাহরণ। ভারত উত্তর, মধ্য, পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণের একটা সংঘ। সব রাজ্যই তাদের নিজস্ব ভাষা এবং লিপির ভিত্তিতে ভিন্ন-ভিন্ন দেশের মতো। তা সত্ত্বেও তারা একটি সংঘ গঠন করেছে। আমার স্বপ্ন- হতে পারে একটা শূন্য স্বপ্ন- হল যে ভারত, চীন এবং জাপান একদিন একটা একক সংঘ গঠন করবে। সংঘের ধারণা অহিংসার ধারণার উপর ভিত্তি করে।

এই শতাব্দী একটা সংলাপী শতাব্দী হওয়া উচিত। যখন মানুষের মধ্যে ভিন্ন স্বার্থ থাকে তখন সংলাপ হওয়া উচিত, অস্ত্র নয়। এটা সম্ভব। সর্বপ্রথম পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ করা উচিত। এটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। লোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের সম্মেলন উপলক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, যেহেতু সেখানকার সরকারের অসুবিধা হচ্ছিল তাই সেটাকে রোমে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সেখানে আমরা আলোচনা করেছিলাম যে কীভাবে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ করা যায়। ঐ সময় আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, আমাদের এরজন্য একটি সময়সূচী নির্ধারণ করা উচিত। আর এরজন্য পারমাণবিক শক্তিগুলিকে দায়িত্ব প্রদান করা উচিত। কিন্তু সেরকম কিছুই করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। “পরমাণু-নিরস্ত্রীকরণ”- এটা শুনতে খুব ভাল লাগে। কিন্তু এর জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়-সারনী নির্ধারণ না করলে সেটা কার্যকর নাও হতে পারে। তারপর যদি এটা একটা বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের রূপ ধারণ ক’রে নেয়, তাহলে সম্ভবতঃ সেটা কার্যকর হতে পারে। এরপর আমাদের সমস্ত ক্ষতিকর অস্ত্র থেকে মুক্ত হতে হবে এবং তারপর হতে হবে প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র থেকে। একটা শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য আমাদের ধাপে-ধাপে নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে।

বাহ্যিক শান্তি অর্জনের জন্য প্রথমে আমাদের আভ্যন্তরীণ স্তরে এর ব্যবস্থা করতে হবে। বাহ্যিক স্তরে খুব বেশি ক্রোধ, ঈর্ষা এবং লোভ ছড়িয়ে আছে। সুতরাং আমাদের বাহ্যিক নিরস্ত্রীকরণ এবং আভ্যন্তরীণ নিরস্ত্রীকরণ উভয়ই একসাথে প্রয়োজন। আভ্যন্তরীণ নিরস্ত্রীকরণ জাগে শিক্ষার মাধ্যমে। অধিক করুণাময় মনের কারণে আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।

এর সাথে যেটা প্রয়োজন সেটা হল হাসিটাও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ হাসি দেখতে ভালোবাসে, ভ্রুকুটি অথবা কোন গম্ভীর মুখমন্ডল দেখতে ভালোবাসে না। বাচ্চারা এমনকি কুকুরও হাসি পছন্দ করে। আপনি যখন কুকুরের দিকে তাকিয়ে হাসেন তখন কুকুরও তার লেজটা নাড়ায়। আপনি যদি গম্ভীর ভাবের সাথে কুকুরকে খাওয়ান তাহলে কুকুরটি খাবার খাবে, তারপর চলে যাবে।

সামাজিক প্রাণীদের মধ্যে সামাজিক উদ্বেগ থাকে। কারণ তাদের জীবিত থাকা সমাজের বাকীদের উপর নির্ভর করে। মানুষ হল সামাজিক প্রাণী। আর সম্পূর্ণ বিশ্ব হল আমাদের সমাজ বা সম্প্রদায়। এই চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে আমরা অন্যদের প্রতি সম্মান বিকাশ করি। তারপর সেখানে ভিন্ন মতামত, ভিন্ন স্বার্থ থাকলেও আমরা একটি সম্মতির ভিত্তিতে এগোতে পারি।

সর্বপ্রথম আমাদেরকে, অন্যদের এবং আমাদের ভাই-বোনদের অধিকারকে সম্মান দিতে হবে। আমরা এটা পছন্দ করি বা না করি, আমাদের সবাইকে এই গ্রহে একসাথে বসবাস করতে হবে। ইউরোপীয় সংঘ পূর্ব এবং পশ্চিম আর উত্তর এবং দক্ষিণ একে-অপরের উপর নির্ভর করে। বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য, জাতীয় সীমানা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

বৈশ্বিক উষ্ণতা একটি গম্ভীর সমস্যা। এটা যদি চলতে থাকে তাহলে পরবর্তী শতাব্দীতে বিশ্বে মারাত্মক অসুবিধা দেখা দেবে। আমি একজন ভিক্ষু, আমার কোন সন্তান নেই। কিন্তু আপনারা যারা মাতা-পিতা এবং ঠাকুরদাদা এবং ঠাকুমা, আপনাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনীদের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। অতএব দয়া ক’রে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে গম্ভীরভাবে বিবেচনা করুন।

এছাড়াও মানুষের জনসংখ্যার বৃদ্ধি হচ্ছে। আমি যখন ভারতে এসেছিলাম তখন এর সংখ্যা ছিল ছয় বিলিয়ন, এখন সেটার বৃদ্ধি হয়ে সাত বিলিয়ন হয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিকরা বলছেন যে শতাব্দীর শেষের দিকে সেটা হবে দশ বিলিয়ন। সুতরাং পরিবেশ ও সমাজের সাথে-সাথে সকলের কল্যাণের কথা ভাবুন।

সমস্যার মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় হল অহিংসা। ভারতে আমি অহিংসা এবং অসাম্প্রদায়িক নৈতিকতার প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছি। ভারত হল অহিংসার আবাসস্থল। ৩০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি রয়েছে। আমি পরামর্শ দিয়েছি যে ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষ থেকে অবশ্যই আফগানিস্থান, সিরিয়া এবং অন্যত্র বসবাসকারী সুন্নি ও সিয়া বন্ধুদের সহায়তা করতে হবে। ভারতে সুন্নি ও সিয়াদের মধ্যে কোন সমস্যা নেই। ভারতেও হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, পারসি ইত্যাদি একসাথে বসবাস করে। একইভাবে আমি ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রচারের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছি।

বর্তমানে বস্তুগত বিষয়ের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়। ভারতে আধুনিক বস্তুগত শিক্ষাকে অহিংসা, নৈতিক দায়িত্ব এবং আবেগগত জ্ঞানের প্রাচীন পরম্পরার সাথে সংযুক্ত করা সহজ। ভারতের প্রাচীন আবেগগত পরম্পরাকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহযোগিতা করার জন্য আমি সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চীনেরও নিজের পরম্পরা বা ঐতিহ্য আছে। এখন সেখানে ৪০০ মিলিয়ন বৌদ্ধ আছে। আপনি যদি ভারত ও চীনকে সংযুক্ত করেন তাহলে এটি একটি বিশাল জনসংখ্যা হবে।

ধাপে-ধাপে বিভিন্ন পেশার মাধ্যমে আমরা একটা শান্তিপূর্ণ এবং করুণাময় বিশ্ব গড়ে তুলতে পারি। এটা সম্ভব, আর এইভাবে একবিংশ শতাব্দীর উত্তরার্ধ আরও শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠবে। আমার বয়স এবং ৮৪ বছর। সুতরাং, আর দশ বা কুড়ি বছরের মধ্যে আমার ‘বিদায়, বিদায়’ বলার সময় হয়ে যাবে। কিন্তু দূরদর্শিতা এবং ব্যবহারিক পদ্ধতির মাধ্যমে আমাদের এখনই শুরু করতে হবে। এখানেই শেষ করলাম। ধন্যবাদ!

Top