আজ সন্ধ্যায় আমরা দৈনন্দিন জীবনে আমাদের সহায়তা করার জন্য বৌদ্ধ পদ্ধতিগুলি কীভাবে প্রয়োগ করতে পারি সেই বিষয়ে আলোচনা করব। আমরা যখন বৌদ্ধ পদ্ধতি অথবা বৌদ্ধ শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করি তখন সংস্কৃত ভাষায় এরজন্য যে শব্দটি ব্যবহার করা হয় সেটা হল “ধর্ম”। আমরা যদি দেখি “ধর্ম” শব্দটি বাস্তবে কী বোঝায় তাহলে এটা নির্দেশ করে “এমন কিছু যা আমাদের ধরে রাখে।” ধর্ম হল এমন কিছু যা আমাদের ধরে রাখে অথবা আমাদের দুঃখ এবং সমস্যা থেকে বিরত রাখে।
চার আর্যসত্য
বুদ্ধ সর্বপ্রথম যে বিষয়টির উপর উপদেশ দিয়েছিলেন সেটা হল “চার আর্যসত্য।” এর অর্থ হল, এমন চারটি তথ্য আছে যেটাকে অত্যন্ত উন্নীত সত্ত্ব এবং যিনি বাস্তবতাকে বোঝেন তিনি সেগুলিকে বুঝবেন। ঐ চারটি হলঃ
- সত্য সমস্যা যার আমরা সন্মুখীন হই।
- সেগুলির সত্য কারণ
- আমাদের সমস্যাগুলি যাতে আর না থাকে তারজন্য তাদের সত্যিকারের নিরোধ থাকলে কেমন হতো।
- বোধগম্যতার উপায়, কর্ম ইত্যাদি যা আমাদের সমস্যাগুলির নিরোধ ঘটাতে পারে।
আমাদের সত্য সমস্যা
বৌদ্ধধর্মে সমস্যা এবং সেগুলির মোকাবিলা করার বিষয়ে অনেক কিছু বলার আছে। প্রকৃতপক্ষে, বুদ্ধের সমস্ত শিক্ষা আমাদের জীবনের অসুবিধাগুলি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করার জন্য নির্ধারিত। পদ্ধতিটি আসলে খুবই যুক্তিসঙ্গত এবং ব্যবহারিক। এটা বলে যে আমাদের যত সমস্যা আছে সেসব কিছুই কোন না কোন কারণ থেকে উৎপন্ন হয়। অতএব, আমাদের নিজেদের ভিতরে খুবই সততার সাথে এবং গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে যে, আমরা কেমন সমস্যার সন্মুখীন হচ্ছি। আমাদের মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে এটা খুব একটা সহজ প্রক্রিয়া নয়। আমাদের জীবনের কঠিন ক্ষেত্রগুলি কেমন সেটা দেখতে আসলে বেশ বেদনাদায়ক। অনেকে এটা অস্বীকার করে। তারা আসলে এটা স্বীকার করতে ইচ্ছুক নয় যে তাদের মধ্যে সমস্যা আছে, যেমন- একটা অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কের ক্ষেত্রে, তবুও তারা অসুখীতা অনুভব করে। তবে আমরা এটাকে “আমি অসুখী”, এই স্তরে ছেড়ে দিতে পারি না। আমাদের গভীরভাবে দেখতে হবে যে সমস্যাটি আসলে কী।
আমাদের সমস্যার সত্য (প্রকৃত) কারণ
এরপর আমাদের খোঁজ করতে হবে যে আমাদের সমস্যার কারণগুলি কী। সমস্যাগুলি নিজেদের থেকে অস্তিমান হয়ে ওঠে না, আবার অকারণে উৎপন্ন হয় না। এর পিছনে কোন না কোন কারণ থাকতেই হয়। অবশ্যই কারণ অনেক স্তরের থাকে যা অসন্তোষজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে যুক্ত থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, যখন কোন সম্পর্কের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব থাকে সেখানে অর্থনীতি থেকে উদ্ভূত অতিরিক্ত জটিল কারণ হতে পারে, যেমন- পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ না থাকা ইত্যাদি। এছাড়াও সন্তানদের সাথে সমস্যা অথবা আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে সমস্যা। এমন সব ধরণের পরিস্থিতি থাকতে পারে যা সমস্যার সৃষ্টিতে অবদান রাখে। কিন্তু বুদ্ধ বলেছেন যে, আমাদের সমস্যাগুলির সবচেয়ে গভীরতম কারণ কী সেটা খুঁজে বের করতে আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। সেখানে গেলে আমরা বুঝতে পারব যে, আমাদের সমস্যাগুলির গভীরতম কারণ হল বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের বিভ্রান্তি।
আমাদের মধ্যে অসুখীতা আছে, আমাদের আছে কষ্ট এবং অবশ্যই সেটা কোন না কোন কারণ থেকে উৎপন্ন হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা অত্যন্ত অশান্তভাবে কাজকর্ম করতে পারি, যেমন- অনেক ক্রোধের সাথে। ক্রোধিত হয়ে কেউ সুখী হতে পারে না, পারে কী? অতএব, আমাদের বুঝতে হবে যে এখানে ক্রোধ আমাদের অসুখীতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং সেইজন্য আমাদের কোন না কোনভাবে ক্রোধ থেকে মুক্তি পেতে হবে।
আমাদের সমস্যা, যা আমাদের অসুখী করে তোলে, সেটা আমাদের মধ্যে সবসময় উদ্ভূত উদ্বিগ্নতাও হতে পারে। উদ্বিগ্নতা মনের একটি অত্যন্ত অপ্রীতিকর অবস্থা। উদ্বিগ্ন হলে তখন কেউ সুখী হতে পারে না, পারে কী? শান্তিদেব, একজন মহান ভারতীয় বৌদ্ধ আচার্য, তিনি বলেছেন আপনি যদি একটি কঠিন অবস্থায় থাকেন তখন যদি সেটাকে পরিবর্তন করার জন্য কিছু করতে পারেন তাহলে চিন্তিত হবেন কেন? সেরকম করলে তো কোন কাজ হবে না। তাই উদ্বেগের নিরর্থকতা সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকে আর সেইজন্য আমরা উদ্বিগ্ন হতে থাকি। মূল বিষয়টি হল উদ্বিগ্ন হলে কোন লাভ হয় না।
এরপর আমাদের আরও একটি স্তরের সমস্যা আছে এবং সেই সমস্যাটি হল কখনো সন্তুষ্ট না হওয়া। অবশ্যই আমরা সুখী হওয়ার সময়গুলি অনুভব করি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেগুলি চিরস্থায়ী হয় না। আর তাই আমরা সবসময় আরও চাই, আরও চাই। এটা কখনোই আমাদের সন্তুষ্ট করে না। আমরা আমাদের প্রিয় খাবার কেবল একবার খেয়েই সন্তুষ্ট হই না, হই কি? আমরা সেটা বার বার খেতে চাই। আর যদি আমরা একবারে খুব বেশি খেয়ে ফেলি তাহলে শুরুতে আমাদের মধ্যে যে সুখটা ছিল সেটা পেট ব্যথায় পরিণত হয়ে যায়। আর তাই আমরা এই ধরণের সুখ সম্পর্কেও বিভ্রান্ত। এটা যেমন থাকে সেইভাবে উপভোগ করার পরিবর্তে, এটা চিরস্থায়ী হবে না এবং কখনোই আমাদের সন্তুষ্ট করবে না, এই উপলব্ধি না ক’রে আমরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকি। ফলে আমরা যখন সেই সুখটা হারিয়ে ফেলি তখন খুব দুঃখ অনুভব করি।
এটা একটা প্রিয়বন্ধু বা প্রিয়জনের সাথে থাকার মতো, যে আমাদের সাথে থাকে এবং পরে আমাদের ছেড়ে চলে যায়। অবশ্যই তাকে কোন এক সময় চলে যেতে হবে এবং তাই সে যত সময় আমাদের সাথে থাকে সেই সময়টা আমাদের উপভোগ করতে হবে। একটা খুব সুন্দর ছবি আছে যেটাকে আমরা মাঝে মাঝে ব্যবহার করি। যখন আমাদের জীবনে এমন কেউ আসে যাকে আমরা খুব ভালবাসি; সে হল একটা বন্য পাখির মতো যে আমাদের জানালার উপর এসে বসে। পাখিটি যখন আমাদের জানালার উপর এসে বসে আমরা তখন ঐ পাখিটির সৌন্দর্যতা উপভোগ করতে পারি কিন্তু কিছুক্ষণ পর পাখিটি অবশ্যই উড়ে যাবে, কারণ সে স্বাধীন। আর আমরা যদি খুবই শান্ত স্বভাবের হই তাহলে হতে পারে পাখিটি পুনরায় ফিরে আসবে। কিন্তু আমরা যদি পাখিটিকে ধরে খাঁচায় রেখে দিই তাহলে পাখিটি দুঃখিত হবে এবং এমনও হতে পারে সেটা মারা যাবে। একইভাবে ঐ সুন্দর বন্য পাখির মতো এই সমস্ত লোকজন আমাদের জীবনে আসে আর তখন আমাদের সবচেয়ে ভালো বিষয়টা হল, তারা যতক্ষণ আমাদের সাথে থাকে সেই সময়টাকে উপভোগ করতে হবে। তারা যখন যেকোন কারণে দূরে চলে যায়, সেটা যেকোন সময়ের জন্যই হোক না কেন, তারা যেতেই পারে এবং সেটা স্বাভাবিক। আমরা যদি এর সম্পর্কে শিথিল এবং শান্ত থাকি আর কোন দাবী না করি, যেমন- “আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।”, তাহলে তারা পুনরায় ফিরে আসতেও পারে। যদি তারা না আসে, তাহলে তাদের প্রতি আমাদের আসক্তি এবং দাবী তাড়া করতে থাকলে তারা দূরেই থেকে যাবে।
আমরা যখন আমাদের জীবনের সাধারণ সুখ এবং আনন্দের স্বভাব সম্পর্কে বিভ্রান্ত হই, অবশ্যই তখনই আমাদের মধ্যে সমস্যা দেখা দেয়। আমরা এমন ধরণের সুখী সময়গুলি উপভোগ করতে পারি না কারণ আমরা চিন্তিত এবং ভয়ভীত হয়ে থাকি যে আমরা সেগুলিকে হারিয়ে না ফেলি। আমরা হলাম একটা কুকুরের মতো যার সামনে রাখা আছে এক বাটি খাবার- কুকুরটি খাবার তো খায় অথচ চারপাশে তাকাতে থাকে এবং গর্জন করতে থাকে, এই নিশ্চিত করার জন্য যেন কেউ এসে সেটা কেড়ে না নেয়। কখনো-কখনো আমরা এরকমই হয়ে যাই, তাই না? আমাদের কাছে যা আছে সেটা উপভোগ করার পরিবর্তে এবং যা থাকে সেটা উপভোগ করা হয়ে গেলেও সেটাকে মেনে নেওয়ার পরিবর্তে আরও কিছু আশা করে। তবে অবশ্যই এটা শুনতে যতটা সহজ বলে মনে হয়, মেনে নেওয়া ততটা সহজ নয়। এরজন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, জীবনের বিষয়বস্তুগুলিকে দেখার একটা আলাদা উপায়ে অভ্যস্থ হওয়া প্রয়োজন।
আমাদের সমস্যার প্রকৃত অবসান
বুদ্ধ বলেছিলেন যে আমাদের সমস্যাগুলি চিরতরে অবসান ঘটানো সম্ভব। এটা করার উপায় হল সেগুলির কারণ থেকে মুক্ত হওয়া। এটি একটি খুবই যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি। যদি জ্বালানী না থাকে তাহলে আগুনও থাকবে না। আর বুদ্ধ বলেছিলেন এই সমস্যাগুলি থেকে এমন ভাবে মুক্ত হওয়া সম্ভব যাতে সেগুলি আর কখনো ফিরে না আসে।
আমরা এই সমস্যাগুলি থেকে সাময়িকভাবে মুক্তি পেয়ে সন্তুষ্ট হতে চাই না, তাই না? এটা হল ঘুমোতে যাওয়ার মতো- আপনারা যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখন আপনাদের মধ্যে অন্যের সাথে কঠিন সম্পর্কের কোন সমস্যা থাকে না। তবে এটা তো সঠিক সমাধান হল না, কারণ আপনারা যখন জেগে উঠবেন তখন সমস্যাগুলি পুনরায় প্রকট হয়ে উঠবে। এটা হল কোথাও ছুটিতে চলে যাওয়ার মতো। ছুটি শেষ হয়ে গেলে আপনাকে বাড়ি ফিরে আসতে হয়। আর যখন বাড়িতে ফিরে আসেন তখনও সমস্যাগুলি আগের মতোই যেমন ছিল তেমনই থাকে। তাই ছুটিতে চলে যাওয়া সর্বোত্তম সমাধান নয়, গভীরতম স্থায়ী সমাধান নয়।
আর বুদ্ধ এটাও বলেননি যে আপনারা চুপচাপ নিজেদের সমস্যাগুলি মেনে নিন আর সমস্যার সাথে জীবন-যাপন করুন, কারণ সেটাও খুব একটা ভালো সমাধান নয়, তাই না? এর কারণ হল তখন আমরা আরও অসহায় বোধ করি- আমাদের কাছে কিছুই করার থাকে না, আমরা হাল ছেড়ে দিই এবং পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার চেষ্টাও করি না। নিজেদের সমস্যাগুলি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আমরা যদি চেষ্টা ক’রে তাতে খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে না পারি, অন্ততপক্ষে আমরা অনুভব করতে পারি যে আমরা চেষ্টা তো করেছি।
সমস্যার প্রকৃত অবসান ঘটানোর উপায়
তবে, আমরা যদি সত্যিই আমাদের সমস্যাগুলির প্রকৃতভাবে অবসান ঘটাতে চাই, সেগুলির একটি সত্যিকারের সমাপ্তি চাই তাহলে এরজন্য বুদ্ধ একটা চতুর্থ সত্য সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছেন এবং সেটা হল বিভ্রান্তিরূপী আমাদের সমস্যাগুলির গভীরতম কারণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এক ধরণের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে এবং সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কিন্তু ভাল জ্ঞান অর্জন করাটাই যথেষ্ট নয় যদি আমরা সবসময় সেটা মনে রাখতে না পারি। অতএব, তারজন্য আমাদের একাগ্রতা বিকাশ করতে হবে। তবে মনে রাখার জন্য সক্ষম হতে প্রয়োজনীয় একাগ্রতা এবং ঐ জ্ঞানের উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করতে আমাদের আত্ম-শৃঙ্খলার প্রয়োজন। তাই আমাদের সমস্যাগুলির প্রতিরোধ করার জন্য আমরা যে সাধারণ বৌদ্ধ পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করি সেগুলি হল শৃঙ্খলা (শীল), একাগ্রতা (সমাধি) এবং জ্ঞান (প্রজ্ঞা)-কে অনুসরণ করা।
উপরন্তু আমাদের সমস্যাগুলির একটা বড় কারণ হল আমাদের স্বার্থপরতা। আমাদের স্বার্থপরতার অধিকাংশ ভাগ বাস্তবতা সম্পর্কে বিভ্রান্তির উপর ভিত্তি করে। কারণ কোন প্রকারে আমরা এরকম মনে করি যে এই পৃথিবীতে একমাত্র আমিই অস্তিমান। এমনকি যদি আমরা মেনে নিই যে অন্যেরও অস্তিত্ব আছে, তাহলেও আমরা ধরে নিই যে নিঃসন্দেহে আমরা জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, আমরাই সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু। এই ভুল ধারণার কারণে আমরা মনে করি, “আমাকে সবসময় আমার সুযোগ পেতে হবে। আমি যা চাইব সেটা আমাকে সবসময় পেতে হবে।” আর যদি আমি আমার সুযোগ না পাই তখন আমি দুঃখিত হয়ে পড়ি।
তবে বাস্তবতা সম্পর্কে এটি একটি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ সেই অর্থে আমি বলতে বিশেষ কিছু নেই। এক অর্থে আমরা সবাই সমান যে সবাই সুখী হতে চায়, কেউ দুঃখী হতে চায় না; সবাই চায় যে তারা যেন কাঙ্খিত বস্তু পেয়ে যায় এবং কেউ চায় না যে তারা যা চায় সেটা যেন না পায়। আর কোন না কোনভাবে আমাদের একসাথে থাকতে হবে, কারণ আমরা একসাথেই থাকি। তাই সমস্যাগুলি কাটিয়ে উঠতে অথবা সমস্যাগুলি প্রতিরোধ করার উপায়গুলিতে আমাদের মৈত্রী এবং করুণা, অন্যদের প্রতি বিবেচনা এবং পরকল্যাণের ভাবনা যুক্ত করতে হবে। আমরা যেমন চাই অন্যরা আমাদের সহযোগিতা করুক, তেমনই তারাও চায় আমরা যেন তাদের সহযোগিতা করি।
অশান্তকারী আবেগের সাথে মোকাবিলা করা
অবশ্যই সবাই সাধু বা বোধিসত্ত্ব নয়, এটা একেবারে সত্য। সবাই কোন না কোন স্তরে বিভ্রান্ত হয়ে আছে। বিভ্রান্ত হওয়ার কারণে আমরা অশান্তকারী আবেগের প্রভাবে কর্ম করি। উদাহরণ স্বরূপ, আমি যদি ভাবি আমিই হলাম সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু এবং আমিই হলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে যে অনুভূতিটি তার সাথে জড়িত থাকে সেটা হল নিরাপত্তাহীনতা, তাই না? আপনারা যখন বিভ্রান্ত হন তখন আপনারা অনিরাপদ হন এবং মনে করেন, “বেশ, আমাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত কিন্তু মানুষ সবসময় আমার সাথে সেরকম আচরণ করে না।” তাই সেখানে নিরাপত্তাহীনতা থাকে।
আমরা যখন অনিরাপদ থাকি তখন আমরা কোন কোন কৌশল প্রয়োগ করতে পারি- নিজেদেরকে আরও নিরাপদ বোধ করতে চেষ্টা করার কৌশল? সেগুলির মধ্যে একটা হলঃ “আমি যদি আমার চারপাশে পর্যাপ্ত জিনিসপত্র পেয়ে যাই তাহলে সেটা আমাকে কোন না কোনভাবে নিরাপদ বোধ করাবে। আমি যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ, পর্যাপ্ত মনোযোগ অথবা পর্যাপ্ত ভালোবাসা পেয়ে যাই তাহলে সেটা আমাকে সুখী ক’রে তুলবে।” কিন্তু তারপর, যেমন আমরা দেখেছি, এই ধরণের সুখের স্বভাব হল যে আমরা কখনোই পর্যাপ্ত পরিমান পাই না, আমরা কখনোই সন্তুষ্ট হই না এবং তাই আমরা সবসময় আরও চাই।
এই বিষয়ে ভাবুন। এর অর্থ আছে। আমরা কি সত্যিই চাই যে আমাদের প্রিয়জন কেবল একবার বলুক, “আমি তোমাকে ভালোবাসি?” সে যদি কেবল একবার বলে তাহলে সেটাই কি যথেষ্ট- তাকে কি আর কখনোই আমাদের বলতে হবে না? আমরা কখনোই নিরাপদ বোধ করি না। আমরা সবসময় বার বার শুনতে চাই, তাই নয় কি? আবার আমরা কখনোই সেই বিন্দুতে পৌঁছই না যেখানে আমরা বলতে পারি, “ঠিক আছে, তোমাকে আর সেটা বলতে হবে না। আমি সেটা জানি।” সুতরাং আমরা যখন লোভী হওয়ার বিষয়ে কথা বলি তখন এটা শুধু বস্তুগত জিনিস বা অর্থের প্রতি লোভী হওয়াকে বোঝায় না। আমরা ভালোবাসার জন্য লোভী হই আর আমাদের মধ্যে বেশির ভাগই বিশেষভাবে মনোযোগের জন্য লোভী। আমরা ছোট ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও সেটা দেখতে পাই। অতএব, এটি একটি প্রক্রিয়াঃ আমরা যদি আমাদের চারপাশে পর্যাপ্ত জিনিসপত্র দেখতে পাই তাহলে সেটা আমাদের নিরাপদ করে তুলবে। তবে এটা কখনোই কাজ করে না।
পরবর্তী প্রক্রিয়াটি হল ক্রোধ এবং বিকর্ষণঃ “আমি যদি এমন কিছু নির্দিষ্ট জিনিস দূর করতে পারি যেটাকে আমি মনে করি আমাকে হুমকি দেয়, তাহলে সেটা আমাকে নিরাপদ বোধ করাবে।” তবে আমরা কখনোই নিরাপদ বোধ করি না; আমরা সবসময় হুমকি দেওয়া অনুভব করি; এবং আমরা সবসময় সতর্ক থাকি যে যদি কেউ আমাদের এমন কিছু করে যেটা আমরা পছন্দ করি না- আর তারপর আমরা ক্রোধিত হয়ে উঠি এবং তাদের দূর ক’রে দিই। কখনো-কখনো এটা খুবই আত্ম-পরাজয় হতে পারে। আমি এমন একটা সম্পর্কের উদাহরণের কথা ভাবছি যেখানে আমার মনে হয় অন্য ব্যক্তি আমার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেয় না, আমাকে যথেষ্ট সময় দেয় না, তাই আমি তাকে দেখে চিৎকার করি। আমি ক্রোধিত হয়ে উঠি এবং চিৎকার ক’রে বলি, “তোমাকে আমার প্রতি আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত! তোমাকে আমার সাথে আরও বেশি সময় কাটানো উচিত!” ইত্যাদি। এর পরিণামে কী হয়? সাধারণতঃ সে আরও অনেক দূরে চলে যায় অথবা সে আমার একটা বড় উপকার করে এবং কিছু সময়ের জন্য সে আমার সাথে থাকে, কিন্তু আপনি অনুভব করতে পারবেন যে সে এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। আমরা কীভাবে ভাবতে পারি যে কারও প্রতি ক্রোধিত হলে সেটা তাকে আমাদের মতো ক’রে তুলবে? সত্যিই এটা অযৌক্তিক, তাই নয় কী? এই প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে অনেকগুলি প্রক্রিয়া যেগুলিকে আমরা আমাদেরকে আরও নিরাপদ করার আশায় ব্যবহার করি, আসলে সেই জিনিসগুলি পরিস্থিতিকে আরও খারাপ ক’রে তোলে।
আরও একটি প্রক্রিয়া যেটাকে আমরা ব্যবহার করি সেটা হল দেওয়াল স্থাপন করা। এটা নির্বোধতার উপর ভিত্তি করে অর্থাৎ আমরা ভাবি যে আমরা যদি কোনভাবে সমস্যাটির মোকাবিলা না করি তাহলে হয় এর অস্তিত্ব থাকবে না অথবা সেটা নিজেই চলে যাবে। “আমি এটার সম্পর্কে আর শুনতে চাই না”- এই ধরণের মনোভাব তৈরী হয় এবং আপনারা দেওয়াল স্থাপন করেন। নির্বোধতার সেই অবস্থা অবশ্যই কাজ করে না। শুধু আমরা সমস্যার উপেক্ষা করলে বা স্বীকার না করলে, সেটা এমনিই সমাধান হয়ে যাবে না।
সুতরাং এই অশান্তকারী আবেগগুলির উপর ভিত্তি করলে যেটা ঘটে সেটা হল আমরা অনেকভাবে ধ্বংসাত্মক উপায়ে কর্ম করিঃ আমরা চিৎকার করি। এমনকি আমরা কাউকে আঘাতও করতে পারি। আপনারা যদি মনে করেন, “আমরা গরীব, আমাদের কিছু নেই”, তাহলে আপনারা চুরি করতে পারেন এই ভেবে এটা কোন প্রকারে আপনাদের সাহায্য করবে, অথবা আমি এই ধরণের একটা উদাহরণের কথা ভাবছি যখন আমি ভারতে বহু বছর বাস করেছিলাম। ভারত হল পোকামাকড়ের দেশ- এখানে প্রচুর এবং প্রচুর, অসংখ্য পোকামাকড় দেখতে পাওয়া যায়, সব ধরণের পোকামাকড় সেটা আপনারা কল্পনা করতে পারেন। আপনারা তাদের সবাইকে মেরে ফেলতে পারবেন না; এমন কোন উপায়ও নেই যে তাদের উপর বিজয় লাভ করতে পারবেন। এর একমাত্র সমাধান হল তাদের সাথে বসবাস করতে শেখা। আপনারা যদি আপনার ঘরে থাকা বিভিন্ন পোকামাকড়দের পছন্দ না করেন, তাহলে আপনারা একটা মশারীর মধ্যে ঘুমান- আপনার চারপাশে একটা মশারী থাকবে আর আপনি আপনার সুরক্ষিত স্থানে থাকবেন। এটাই হল একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান। এটা না ক’রে আপনি যদি শিকার অভিযানে গিয়ে আপনার ঘরের সমস্ত মশা শিকার করেন তাহলে আপনাকে সারারাত জাগতে হবে, কারণ সেখানে মেরে ফেলার জন্য আরও বেশি মশা অবশিষ্ট থেকে যায়। এর কারণ হল দরজার নিচে সবসময় ফাঁকা জায়গা থাকে অথবা জানালাগুলি সঠিকভাবে বন্ধ হয় না, ফলে সেখানে সংখ্যা আরও বেশি হতে থাকে। তাই ধ্বংসাত্মক আচরণের জন্য ঐ আবেগ বাধ্যতামূলকভাবে উদ্ভূত হয়; আমাকে তাদের থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে।
ধ্বংসাত্মক আচরণের বিভিন্ন রূপ আছে। মিথ্যা কথা বলা, কর্কশ ভাষা প্রয়োগ করা, ব্যভিচার, ধর্ষণ- এই সমস্ত আচরণ সেখানে আছে। আর আমরা যখন ধ্বংসাত্মকভাবে আচরণ করি, মূলতঃ এটা অসুখীতার জন্ম দেয়, তবে সেই অসুখীতা অন্যের জন্য নয়, বিশেষ ক’রে নিজেদের জন্য। আপনারা যদি এই সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে বৌদ্ধধর্ম অত্যন্ত জোরালোভাবে হত্যা না করার কথা বলে, তাই না? এখানে বিষয়টা হল, আপনি যাকে পছন্দ না করেন সেটাকে যদি হত্যা ক’রে ফেলার অভ্যাস তৈরী ক’রে ফেলেন, যেমন- মশা, তাহলে সেক্ষেত্রে সেটাই আপনার সহজ প্রতিক্রিয়া হবে, তাই না? আর এটা শুধু হত্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যদি এমন কিছু থাকে যাকে আমরা পছন্দ করি না তাহলে সেক্ষেত্রে শান্ত মনের সাথে সেটার মোকাবিলা করার পরিবর্তে আমরা হিংসাত্মকভাবে তুড়ি মেরে দিই- এটা মৌখিকভাবে হতে পারে, শারীরিকভাবে অথবা মানসিকভাবেও হতে পারে।
অবশ্যই কখনো-কখনো আপনাদের হত্যা করতে হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, এমন কীট-পতঙ্গ আছে যারা ফসল খেয়ে ফেলে; রোগ ছড়ানো পোকা-মাকড় থাকতে পারে ইত্যাদি। বৌদ্ধধর্ম ধর্মান্ধ হওয়ার কথা বলে না। তবে আপনারদের এর সম্পর্কে নির্বোধ হওয়া উচিত নয়। আপনারা ক্রোধ এবং বিদ্বেষ ব্যতীত সেটা করুন- “আমি এই ম্যালেরিয়া বাহক মশাকে ঘৃণা করি!” আর আপনাদের এর নেতিবাচক পরিণতি, যা এর কারণে ফলিভূত হয়, নির্বোধ হওয়া উচিত না। একটা ছোট্ট সাধারণ উদাহরণঃ আমরা যদি আমাদের শাকসবজি এবং ফলের ক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহার করি, আর সেটা খাইও তাহলে সেটা রোগের কারণ হতে পারে। অতএব, সেখানে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকে। এখানে আমাদের মূল বিষয়ে ফিরে আসা অর্থাৎ অশান্তকারী আবেগগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে মৈত্রী এবং করুণা সংযুক্ত শৃঙ্খলা (শীল), একাগ্রতা (সমাধি) এবং জ্ঞান (প্রজ্ঞা)কে প্রয়োগ করতে শেখার পদ্ধতি।
স্ব-শৃঙ্খলা
জীবনের সমস্যাগুলি এড়িয়ে যেতে আমরা কীভাবে এই প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থাগুলি প্রয়োগ করব? প্রথম স্তরে, আমরা যে জিনিসটা করি সেটা হল নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা প্রয়োগ করা যার মাধ্যমে ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করা থেকে এড়িয়ে যেতে হয়। অশান্তকারী আবেগের প্রভাবে কর্ম করার অর্থ হল ক্রোধ, লোভ, আসক্তি, ঈর্ষা, নির্বোধতা, অহংকার ইত্যাদির বশে কর্ম করা। এর অর্থ হল যে আমরা যখন ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করার মতো অনুভব করি তখন আমরা খুব স্পষ্টভাবে সিদ্ধান্ত নিই, “না, আমি আর সেভাবে কর্ম করতে চাই না।”
আমি যখন মনে করি যে আপনার কিছু ভুলের জন্য আপনার উপর চিৎকার করছি, তখন আমি বুঝতে পারি চিৎকার করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে আমার পক্ষ থেকে হয় আপনাকে সংশোধন করতে হবে অথবা ভুল যা কিছুই হয়ে থাকুক না কেন আমাকে সেটার সাথে মোকাবিলা করতে হবে। চিৎকার করলে কেবল পরিস্থিতিকে আরও খারাপ ক’রে তুলবে, তাই না? বিশেষ ক’রে, আপনাকে খারাপ নামে ডাকা এবং আপনাকে অভিশাপ দেওয়া, এটা অবশ্যই পরিস্থিতিকে ঠিক করতে সহায়তা করবে না। অতএব, নৈতিক স্ব-শৃঙ্খলা হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লক্ষ্য করা, এমনকি আমাদের দ্বারা ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করার আগে যে কর্ম আমরা ধ্বংসাত্মকভাবে এবং বাধ্যতামূলকভাবে করতে চলি সেটাকেও লক্ষ্য করা। সেখানে সেইভাবে কাজ করার প্ররোচনা থাকে আর আমরা অনুমান করিঃ “এটা মোটেও সহায়ক হবে না” আর তারপর আমরা আমাদের আবেগকে কার্যকর করা থেকে নিজেদেরকে প্রতিরোধ করি।
এখন এখানে আমরা বলছি না যে আপনি ক্রোধকে ভিতরে রেখে দিন, যা আপনাকে ভিতরে ভিতরে শেষ ক’রে দেয়। আর আপনি এটাকে ধারণ ক’রে রাখুন যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি বিস্ফোরিত হন। এটা কোন পদ্ধতি নয়। আর আমরা যদি এটার মোকাবিলা করতে সক্ষম না হই আর ভিতরে ভিতরে তৈরী করতে থাকি তাহলে ঠিক আছে কিন্তু সেটা অন্য ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করব না। দেওয়ালে ঘুষি মারলে তো নিজের হাতেই আঘাত লাগে তাই সেটা হল বোকামী। অতএব, সেটাকে অন্যভাবে প্রয়োগ করুন, ঠিক আছে। একটা বালিশে ঘুষি মারুন অথবা আপনার ঘরের সম্পূর্ণ মেঝেটাকে পরিষ্কার ক’রে ফেলুন- এই ধরণের “মাতৃজ্ঞান” রূপী পদ্ধতি ক্রোধ এবং হতাশার মোকাবিলা করার জন্য আর প্রকৃতপক্ষে ঘরের কঠোর কাজ করা, দীর্ঘ সময়ের জন্য দৌড়ানো অথবা কঠোর শারীরিক ব্যয়াম করা আপনার ক্রোধ এবং হতাশার শক্তিকে নষ্ট করতে সহায়তা করে।
মননশীলতা (স্মৃতি) এবং একাগ্রতা (সমাধি)
আমরা যদি এই আচরণের সাথে আরও অভ্যস্থ হয়ে যাই এবং আমরা যখন কর্ম করতে চাই তখন যদি আমরা ধ্বংসাত্মক আচরণ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখি, সেই সময় আমরা যেটা প্রয়োগ করি সেটাকে বলা হয় প্রভেদমূলক সচেতনতা (প্রজ্ঞা)। এর দ্বারা আমাদের জন্য কোনটা সহায়ক আর কোনটা ক্ষতিকারক তার মধ্যে পার্থক্য করি আর তার ভিত্তিতে আমরা শান্ত থাকতে পারি এবং কেবল ক্রোধকে ভিতরে চেপে রাখি না। অতএব, আমরা এখানে যে প্রধান বিষয়টি উৎপন্ন করি সেটাকে সাধারণতঃ মননশীলতা (স্মৃতি) রূপে অনুবাদ করা হয়। এর অর্থ হল মনে রাখা। এটা হল মানসিক আঠার মতো শৃঙ্খলাকে ধারণ ক’রে রাখা- আমি কী করতে চাই, আমি জীবনে কী হতে চাই, আমি আমার জীবনে কীভাবে কাজ করতে চাই- এগুলিকে ধরে রাখা এবং ভুলে না যাওয়া। এটাই হল মননশীলতা। এর অর্থ হল “সক্রিয়ভাবে মনে রাখা”।
সুতরাং, আমরা যা কিছু করার চেষ্টা করি সেটা হল আরও জাগ্রত হওয়া। “বুদ্ধ” শব্দের আসল অর্থ হল “এমন কেউ যিনি পূর্ণরূপে জাগ্রত।” আমরা যে বিষয়ে জাগ্রত হওয়ার চেষ্টা করি সেটা হল আমরা যে আবেগগুলি অনুভব করি, আমাদের মনে বাধ্যতামূলকভাবে এইভাবে বা ঐভাবে আচরণ করার জন্য যে তাগিদগুলি জাগে আর আমরা সেই জিনিসগুলির দাস না হওয়ার চেষ্টা করি। তবে, আমরা বোধগম্যতার মাধ্যমে কীভাবে কাজ করব সেটা বেছে নিতে পারি। আমি যদি খারাপ মেজাজে থাকি তাহলে সেটাকে পরিবর্তন করা যেতে পারে; এটাকে পরিবর্তন করার জন্য আমি অবশ্যই কিছু করতে পারি।
কখনো-কখনো খারাপ মেজাজে থাকার সমাধানটি খুব সরল হয়। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতির মধ্যে একটি হল “বকাটে শিশুকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া।” আমরা এমন একটা শিশুর মতো অনুভব করি যে অনেকক্ষণ জেগে থাকে আর সারাক্ষণ “হুয়া হুয়া” ক’রে কাঁদতে থাকে ইত্যাদি। প্রায়শই যখন আমাদের মেজাজ খারাপ থাকে তখন আমরা ঐ রকমই হয়ে উঠি। তাই তখন আপনারা শুয়ে পড়বেন, ঘুমিয়ে পড়বেন। পরে আমরা যখন জেগে উঠব তখন সাধারণতঃ অনেকটা ভাল অনুভব হবে। অথবা আপনার যদি কারও সাথে মতৈক্য থাকে এবং সেটা যদি তীব্র অবস্থায় পৌঁছে যায় তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে যে এই পরিস্থিতিতে ঐ ব্যক্তি সত্যিই আপনার কথা শুনছে না এবং আপনিও তার কথা শুনছেন না। তাই আপনাদের কথোপকথনটি শেষ করাই ভাল- “ঠিক আছে, আমরা দুজনে শান্ত হয়ে গেলে এই বিষয়টিতে ফিরে আসব”- আর শান্ত হওয়ার জন্য হাঁটতে বেরিয়ে যান অথবা এরকম কিছু করুন।
এগুলি খুবই সহজ পদ্ধতি। বৌদ্ধধর্ম প্রকৃতপক্ষে এরচেয়ে অনেক গভীর পদ্ধতি শেখায়, তবে এটা একটা শুরু। আমাদের এমন পদ্ধতি দিয়ে শুরু করতে হবে যেটাকে বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব। তবে নীতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং নীতিটি হল সমস্যার কারণটা কী সেটাকে দেখা আর সমস্যাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য কিছু করা। শুধু সমস্যার স্বীকার হবেন না। এক অর্থে আপনার জীবনে যা কিছু ঘটছে তার উপর নিয়ন্ত্রণ করুন।
এখন, আমরা যদি আমাদের আচরণের মধ্যে কোনটা সহায়ক এবং কোনটা ক্ষতিকারক সেটার সম্পর্কে আমাদের বোধগম্যতাকে বজায় রাখার জন্য মননশীলতা বিকাশ করতে পারি, আমাদের সাথে যা কিছু ঘটছে সেদিকে মনোযোগ দিতে পারি এবং মনে রাখতে পারি যে আমরা কীভাবে কাজ করতে চাই আর আমরা সংশোধন করতে পারি যদি কি না আমরা সঠিকভাবে কাজ করতে পারি অর্থাৎ আমরা কীভাবে শারীরিকভাবে কাজ করছি এবং কথা বলছি। তাহলে সেগুলিতে আমাদের মানসিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে সক্ষম হওয়ার জন্য শক্তি বিকাশ করতে পারব।
তাই আমরা যখন উদ্বেগের এই চিন্তার ট্রেনটি অথবা দুশ্চিন্তার ট্রেনটি পরিচালনা করা শুরু করি তখন ভাবিঃ “বেচারা আমি! কেউ আমায় ভালোবাসে না ইত্যাদি।” আমরা তখন বলি, “ছাড় না! আমি এই আত্ম-করুণা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদির চক্রে ফাঁসতে চাই না। এমন করলে আমাকে অসুখী ক’রে তুলবে।” আর সেইজন্য আমরা আরও ইতিবাচক কিছুতে আমাদের মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে পারব। কেবল বসে থাকা এবং দুশ্চিন্তা করার পরিবর্তে, অনেক ইতিবাচক জিনিস আছে যা আমরা আমাদের শরীর, আমাদের মনের মাধ্যমে করতে পারি। যেমন, আমরা যখন দুশ্চিন্তা করি সবকিছু ভীষণ ভয়াবহ হতে পারত, এরকম ভাবার পরিবর্তে আমরা আরও অনেক ইতিবাচক বিষয় সম্পর্কে ভাবতে পারি। কারণ আপনারা দেখুন, আমরা এখানে যেটা বিকাশ করতে পারি সেটা হল একাগ্রতা, যাতে আমরা আমাদের মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে পারি যখন সেটা দূরে চলে যায়।
উদাহরণ স্বরূপ, যখন আমাদের মন ঘোরা-ফেরা করতে শুরু করে তখন সেটা নিয়ে চিন্তা করার কোন প্রয়োজন হয় না, কারণ এটা হতেই পারেঃ “তারা কখন কথা বলা বন্ধ করবে?” অথবা “আমি রাতের খাবারে কী খাব?” এটা যেকোন বিষয় হতে পারে আর আমরা অন্য ব্যক্তির প্রতি মনোযোগ দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারি অথবা আমরা মনে মনে মন্তব্য করা শুরু ক’রে দিতে পারি। তারা যা কিছু বলেছে সেটা হল বোকামী।” এইভাবে আমরা আমাদের মনোযোগ ফিরিয়ে আনি আর শুধু তাদের কথা শোনার প্রতি মনোনিবেশ করি।
একাগ্রতার ক্ষেত্রে এটা একটা খুবই ব্যবহারিক প্রয়োগ তবে এরজন্য প্রয়োজন শৃঙ্খলা; আর এরজন্য প্রথমতঃ আমরা শারীরিক এবং বাচসিক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে সেই শৃঙ্খলা বিকাশ করি। আপনি যখন এই কৌশল, আপনার মনোযোগ ফিরিয়ে আনার এই কৌশল ও কোন পথভ্রষ্টতা সংশোধন করার কৌশল বিকাশ করেন তখন আপনি সেটাকে সব ধরণের পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করতে পারেন। এটা সত্যিই খুব খুব সহায়ক হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি কীভাবে আপনার শরীরকে ধারণ ক’রে আছেন তার সম্পর্কে আপনি সচেতন হতে শুরু করেন। যদি আপনার কাঁধ টান-টান থাকে, যদি আপনি সচেতন হন এবং আপনি সেটা লক্ষ্য করেন তাহলে আপনি শুধু আপনার কাঁধগুলিকে নিচে রাখুন এবং সেগুলিকে শিথিল করুন।
অথবা আপনি যখন খুব উত্তেজিত হতে শুরু করেন যেটা সম্পূর্ণভাবে পরিস্থিতির প্রতিকূল হয়, আর আপনি আরও জোরে এবং আক্রমণাত্মকভাবে কথা বলতে শুরু করেন তখন আপনি সেটাকে লক্ষ্য করেন এবং সেটাকে পরিবর্তন ক’রে ফেলেন। আপনি আপনার কাঁধকে পিছনে হেলিয়ে দেওয়ার মতো শান্ত হয়ে যান কিন্তু আপনি সেটা করেন একটা শক্তি স্তরে, আবেগগত স্তরে।
আপনি এই ধর্ম পদ্ধতিগুলিকে কীভাবে জীবনে প্রয়োগ করবেন, এটাই হল তার পূর্ব রহস্য। শুধু সেগুলিকে মনে রাখুন, সেগুলিকে কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট শৃঙ্খলা পালন করুন এবং শুধু এটা প্রয়োগ করুন। আর আপনি শুধু এই কারণে এটা করবেন না যে আপনি ভাল হতে চান, আপনি আপনার গুরুকে খুশী করতে চান অথবা এরকম অন্য কিছু। পরিবর্তে আপনি এটা করুন, কারণ আপনি সমস্যা অর্থাৎ অসুবিধাগুলি ত্যাগ করতে চান কারণ আপনি জানেন যে আপনি যদি এই বিষয়ে কিছু না করেন তাহলে আপনি কেবল নিজেকে দুঃখী ক’রে তুলবেন, এবং এটা হাসি-মজা নয়, তাই না? অতএব, আমাদের মানসিক দিকে একাগ্রতার ক্ষেত্রে আমাদের আত্ম-শৃঙ্খলা প্রয়োগ করতে হবে- এমনকি সেটা আমাদের অনুভূতির সাথে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রেও। অবশ্যই অনুভূতির সাথে মোকাবিলা করা আরও সূক্ষ্ম এবং অনেক বেশি কঠিন হয়। কিন্তু যেমন আমি বলেছি আপনি যদি অতিরিক্ত উত্তেজিত হন তাহলে আপনি নিজেকে সংযত করতে পারবেন।
সম্যক্ জ্ঞান
একবার যখন আপনি একাগ্রতার সরঞ্জাম বিকাশ ক’রে ফেলবেন, অন্ততপক্ষে কিছু স্তর পর্যন্ত, তখন আপনি সত্যিই যার উপর একাগ্র হওয়ার জন্য সক্ষম হতে চাইবেন সেটা হল যা কিছু ঘটে চলেছে সেগুলির বিষয়ে সম্যক্ জ্ঞান বা বোধগম্যতা। বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের মধ্যে অনেক ধরণের বিভ্রান্তি রয়েছে- আমরা কীভাবে অস্তিত্বে আছি, অন্যরা কীভাবে অস্তিত্বে আছে এবং জগতটা কীভাবে অস্তিত্বে আছে। আর এই বিভ্রান্তির কারণে আমাদের মধ্যে অনেক রকমের কল্পনা থাকে যেগুলি প্রকৃতপক্ষে অবাস্তব, তাই না? আমরা কল্পনা করতে পারিঃ “আমি ভাল নই। আমি একজন পরাজয়ী।” অথবা আমরা কল্পনা করতে পারিঃ “আমি হলাম এই জগতের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বস্তু।” আমরা কল্পনা করতে পারিঃ “আমি বেচারা। আমায় কেউ ভালবাসে না।” কিন্তু আমরা যদি সত্যিই আমাদের জীবনের প্রত্যেককে বিশ্লেষণ করি, তার অর্থ হল, আমার মা আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি, আমার কুকুর আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি, অর্থাৎ কেউ আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। এই ধরণের বিষয় খুব কমই হতে পারে।
তাই আমরা এই কল্পনাগুলিকে অভিক্ষেপ করি এবং বিশ্বাস করি যে সেগুলি সত্য। এটা ভয়াবহ বিষয়। আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা দেরিতে পৌঁছতে পারি অথবা সাক্ষাতের জন্য উপস্থিত নাও হতে পারি এবং তাতে কিছু আসে যায় নাঃ “আপনার মধ্যে কোন অনুভূতি নেই, তাই না?” আর তারপর আমরা অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠি। তবে প্রত্যেকের মধ্যে অনুভূতি থাকে, যেমন আমার মধ্যে আছে। কেউই উপেক্ষিত হতে চায় না। কেউ এটা পছন্দ করে না যে যদি তাদের কোন একটা সাক্ষাৎ থাকে, অন্য ব্যক্তি তাকে না ডাকে অথবা দেরি হলেও সাক্ষাৎ না দেয়। কেউ সেটা পছন্দ করে না। সুতরাং আমাদের যা করতে হবে সেটা হল এই কল্পনাগুলি উচ্ছেদ করার জন্য একাগ্রতা প্রয়োগ করতে হবে আর এই সমস্ত আজে-বাজে কথা প্রকাশ করা বন্ধ করতে হবে। যেমন আমাদের সহানুভূতিহীন আচরণ, যেটা অন্যদের ক্ষতি না করে, কারণ এটাই আমাদের সমস্যার গভীরতম কারণঃ “আমি এই জগতের কেন্দ্রবিন্দু। আমাকে সবসময় আমার সুযোগ সুবিধা পেতে হবে। আমি হলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।” নিঃসন্দেহে এটা কল্পনার একটা অভিক্ষেপ। জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ হয় না। তবে, আমাদের কল্পনাকে সত্য করার ভিত্তিতে আমরা স্বার্থপর হয়ে উঠি। তাই আমরা যদি স্বার্থপরতা কাটিয়ে উঠতে চাই তাহলে আমাদের ঐ কল্পনাকে বিনির্মাণ করতে হবে এবং অভিক্ষেপ করা বন্ধ করতে হবে। তাসত্ত্বেও যদি মনে হয় যেন আমিই জগতের কেন্দ্রবিন্দু এবং আমিই হলাম একমাত্র অস্তিমান ব্যক্তি (কারণ আমি যখন আমার চোখগুলি বন্ধ করি তখন আমার মাথায় এই স্বরটা গুঞ্জন করে এবং আমি অন্য কাউকে দেখতে পাই না আর তাই মনে হয় যেন আমিই হলাম একমাত্র অস্তিমান ব্যক্তি), তাহলে আমাদের মনে রাখতে হবে, এটা হল একটি মায়া আর সেটাকে বিশ্বাস করার চেষ্টা করবেন নাঃ “এটা এমন নয়। এটা শুধু সেরকম প্রতীয়মান হয়।”
বুদ্ধ বলেছেন যে, আমাদের সমস্যার প্রকৃত নিরোধ অবস্থা লাভের জন্য সবসময় এই জ্ঞানের সাথে যুক্ত থাকতে হবে যেটাকে সত্য পথ বলা হয়। যদি আমাদের মধ্যে সবসময় ঐ সম্যক্ জ্ঞান থাকত তাহলে আমাদের মধ্যে কখনো বিভ্রান্তি থাকত না। আর যদি আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি না থাকত আমাদের মধ্যে ক্রোধ থাকত না; আমাদের মধ্যে থাকত না আসক্তি, লোভ ইত্যাদি। আর যদি আমাদের মধ্যে এই অশান্তকারী আবেগের (ক্লেশ) একটাও না থাকত, আমরা ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করতাম না। আর যদি আমরা ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম না করতাম তাহলে আমরা অন্যদের এবং নিজেদের জন্য সবরকমের সমস্যা সৃষ্টি করতাম না। এটাই হল বৌদ্ধ পদ্ধতি যার ভিত্তিতে আমরা জীবনের সমস্যা মোকাবিলা করি।
আমরা যদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে মিষ্টতা বজায় রাখতে চাই তাহলে আমাদের বুঝতে হবেঃ
- আমি একজন মানুষ। আপনিও একজন মানুষ। আমাদের সকলের মধ্যে একই অনুভূতি আছে ইত্যাদি।
- প্রত্যেকের মধ্যেই শক্তিশালী দিক আছে। প্রত্যেকের মধ্যেই আছে দুর্বল দিকও। আমার মধ্যে সেগুলি আছে, তাই আছে আপনার মধ্যেও।
- আমাদের মধ্যে সাদা ঘোড়ায় আরোহিত কোন কমনীয় রাজকুমার বা রাজকুমারী নয়।
আপনার গল্পে সেই চিত্র আছে? আমরা সবসময় নিখুঁত অংশীদারের খোঁজ করি, যে সাদা ঘোড়ায় আরোহিত কিন্তু সেটা একটা রূপকথার গল্প। সেটা অস্তিত্বে নেই তাসত্ত্বেও আমরা তার অভিক্ষেপ করি। সেই রূপকথায় বিশ্বাস করার কারণে আমরা মনে করি যে এই ব্যক্তি রাজকুমার বা রাজকুমারী হতে চলেছে আর যখন সে সেরকম না হয় তখন আমরা তার উপর ক্রোধিত হই এবং কখনো-কখনো আমরা তাকে প্রত্যাখ্যানও করি। আর পরবর্তীতে আমরা অন্য সম্ভাব্য অংশীদারকে অভিক্ষেপ করি যার সাথে আমরা দেখা সাক্ষাৎ করি যে সে একজন রাজকুমার বা রাজকুমারী হবে। কিন্তু আমরা কখনোই রাজকুমার বা রাজকুমারীকে খুঁজে পাই না কারণ সেখানে এই ধরণের কিছু অস্তিত্বই নেই।
তাই আমরা যদি সুস্থ সম্পর্ক রাখতে চাই তাহলে আমাদের বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। বাস্তবতা হল, যেমন আমি বলেছি, প্রত্যেকের মধ্যে ভাল দিক আছে, প্রত্যেকের মধ্যে আছে খারাপ দিক। আর তাই আমাদের যেকোনভাবে একসাথে থাকা শিখতে হবে কারণ কেউই জগতের কেন্দ্রবিন্দু নয়। তারপরে আপনি যেকোন ধর্মে বা যেকোন মানবতাবাদী দর্শনে যে সাধারণ শিক্ষাগুলি পান সেটা হল সদয় হওয়া, বিবেকবান হওয়া, প্রেমময় হওয়া, ধৈর্যবান হওয়া, উদার হওয়া এবং ক্ষমাশীল হওয়া। প্রত্যেকটা ধর্ম এবং প্রত্যেক মানবতাবাদী দর্শন একই শিক্ষা দেয় আর বৌদ্ধধর্মও দেয় সেই শিক্ষা।
কর্মক্ষেত্রে আমাদের সম্পর্কের জন্য একই নীতি প্রযোজ্য। আপনার কার্যালয়ে যেসমস্ত লোকজন আপনার সাথে কাজকর্ম করে আপনি যদি তাদের প্রতি সদয় হন (অথবা আপনি যদি অন্যদের নিযুক্ত করেন আর আপনি আপনার কর্মীদের প্রতি সদয় হন) তাহলে পুরো ব্যবসা আরও সহজভাবে চলে। আপনি যদি একটা দোকানে কাজ করেন আর আপনি আপনার গ্রাহকদের সাথে সদয় এবং সুখকর হন তাহলে পুরো পরিবেশটি আরও বেশি মনোরম হয়, তাই নয় কি? আর যদি কেউ নিজের লেনদেনের সাথে সৎ হয়- অন্যদের সাথে প্রতারণা না করে ইত্যাদি- তাহলে পরিস্থিতি আরও ভাল হয়ে যায়। এর অর্থ এই নয় যে আমরা লাভ অর্জন করতে এবং জীবিকা নির্বাহ করতে চেষ্টা করব না। এখানে মূল বিষয়টি হল এই বিষয়ে আমরা যেন লোভী না হই।
আর অন্যরা যখন আমাদের প্রতারণা করে- কারণ তাদের মনে হয় সবাই এইভাবে কাজকর্ম করবে না- ঠিক আছে, আপনি কী আশা করেন? কিন্তু বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী আমরা বলব না যে এরা খারাপ মানুষ; পরিবর্তে, আমরা শুধু বলব যে তারা বিভ্রান্ত। তারা বোঝে না যে এইভাবে কর্ম করলে সেটা তাদের জন্য আরও বেশি সমস্যা তৈরী করবেঃ কেউ তাদের পছন্দ করবে না। অতএব, বাস্তবে তারা হল ঘৃণার পাত্রের পরিবর্তে করুণার পাত্র। আমরা যদি তাদের করুণার পাত্র হিসাবে দেখি এবং তাদের প্রতি ধৈর্য ধরি, তাহলে যখন তারা আমাদের প্রতারণা করবে তখন আমরা আবেগগতভাবে কষ্ট পাব না। আর তারপর পরবর্তীদের সাথে আমরা আরও সতর্ক থাকার চেষ্টা করব যাতে আমরা আবার প্রতারিত না হই। কিন্তু আপনারা মানুষের কাছ থেকে কী আশাই বা করতে পারেন? অনেক মানুষই এরকম হয়। অতএব, এটাই বাস্তব। এখানে অভিক্ষেপটি হল এরা প্রত্যেকেই সৎ কিন্তু বাস্তবে প্রত্যেকেই সৎ হয় না। তবে, ভাল হতো যদি সবাই সৎ হতো। কিন্তু প্রত্যেকেই তা হয় না। তাই অন্তত আমরা সৎ হওয়ার চেষ্টা করতে পারি।
অবৌদ্ধরা কি এই পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করতে পারে?
এখন, এই পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করার জন্য আমাদের কি ধ্যান এবং আচার অনুষ্ঠানের একটা কঠোর বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করতে হবে? আমার মতে বাস্তবে না। এই সমস্ত জিনিস প্রয়োগ করার জন্য আমাদের একটা কঠোর এবং আদর্শ আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করতে হবে না। পরম পূজ্য দালাই লামা সবসময় ধর্ম নিরপেক্ষ নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে কথা বলেন- সদয় হওয়া, আরও বেশি মননশীল হওয়া, নির্বোধ হওয়া, কল্পনাপ্রসূত না হওয়া ইত্যাদি। এগুলি হল সাধারণ নির্দেশিকা যেটা যেকেউ অনুসরণ করতে পারেন।
আর আমরা যখন ধ্যান নিয়ে কথা বলি তখন আমরা এমন একটি পদ্ধতি সম্পর্কে কথা বলি যার মাধ্যমে বসে বসে চিন্তন করি আমাদের নিজেদের বিষয়ে পরিচিত হওয়ার জন্য এবং আমাদের মন যখন এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায় সেটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। বেশ, আপনি বুদ্ধকে অথবা আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোনিবেশ ক’রে ধ্যানে বসে সেটা করতে পারেন। এছাড়া আপনি যখন বই পড়েন, যখন রান্না করেন অথবা এরকম কিছু করেন তখনও কিন্তু সেটা করতে পারেন। আপনি যখন রান্না করেন তখন শুধু রান্নার উপরই মনোনিবেশ করুন এবং ঐ সময় আপনার মন যদি কোন উন্মাদ ভাবনায় চলে যায় তখন আপনার মনকে আবার রান্নায় ফিরিয়ে আনুন। এটাকে একটা আনুষ্ঠানিক বৌদ্ধধ্যান অনুশীলন হতে হবে না। কোন প্রকারের বৌদ্ধ আচার-অনুষ্ঠান অথবা আনুষ্ঠানিক বৌদ্ধ ধ্যান পদ্ধতি ব্যতীত এরকম অনেক উপায় আছে, যার মাধ্যমে আমরা আরও উপকারী চিন্তা-ভাবনা কর্ম করার পদ্ধতি ইত্যাদি দ্বারা আমাদের নিজেদের সাথে পরিচিত হতে পারি।
সমস্যাকে এড়াতে আমাদের সাহায্য করার জন্য এটাই হল ধর্মকে প্রয়োগ করার পদ্ধতি- প্রতিরোধক মূলক ব্যবস্থা। আপনার কী প্রশ্ন আছে?
প্রশ্নঃ
আভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিকভাবে যা ঘটছে সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া
সমস্যা এড়ানোর জন্য কি আমাদের সবসময় একাগ্র হতে হবে?
এক অর্থে, হ্যাঁ। তবে সেটা পূর্ণ চিত্র নয়। যেমন আমরা চিৎকার করা এবং কাউকে আঘাত করার ক্ষেত্রে খুব একাগ্র হতে পারি। তবে এটা তার সম্পূর্ণ চিত্র নয়। এই অর্থে আমাদেরও সতর্ক হওয়া দরকার যে আমাদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ ভাবে কী ঘটে চলেছে- আমাদের চিন্তা-ভাবনা, আমাদের অনুভূতি ইত্যাদি- আর একই সাথে আমাদের চারপাশে লোকজনদের সাথে যা কিছু ঘটে চলেছে সেই বিষয়ে সতর্ক এবং সাবধান থাকতে হবে। যখন কেউ বাড়িতে আসে- আমাদের পরিবারের একজন সদস্য, প্রিয়জন অথবা অন্য যে কেউ হোক না কেন- আপনি দেখতে পাবেন সে খুব খুব ক্লান্ত থাকে। সেই ব্যাপারে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। ঐ সময়টা তার সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময় নয় কারণ সে খুবই ক্লান্ত থাকে। অতএব, আপনাকে সবসময় সতর্ক, মনোযোগী এবং আপনার চারপাশে যা কিছু ঘটতে থাকে সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আপনাকে জানতে হবে অন্য লোকজনরা কেমন পরিস্থিতিতে আছে, আমি কেমন পরিস্থিতিতে আছি সেটা নয়।
অতএব, আমরা শুধুমাত্র নিজেদের সম্পর্কে সচেতন হওয়া আর অন্যদের সম্পর্কে সচেতন না হওয়ার চরম অবস্থায় যাওয়া থেকে এড়িয়ে চলি অথবা শুধু অন্যদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং নিজেদের প্রতি মনোযোগ না দেওয়া। এটাও একটি চরম অবস্থা যেটাকে এড়িয়ে চলতে হবে। এরকম অনেক লোকজন আছে যাদের মধ্যে “না” বলতে পারার এই লক্ষণটি থাকে। আর সেইজন্য তারা সবসময় অন্যদের জন্য, তাদের পরিবারের জন্য অথবা যে কেউ হোক না কেন তাদের জন্য কিছু করতেই থাকে। ফলে তারা এতটাই ক্লান্ত এবং অবসন্ন হয়ে পড়ে যে তারা অবশেষে ভেঙে পড়ে বা তারা বিরক্ত হয়ে ওঠে। তাই আমরা কেমন অনুভব করি এবং আমাদের নিজস্ব চাহিদার প্রতিও মনোযোগ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যখন বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন হয় তখন বিশ্রাম নিতে হয়। যখন আমাদের বলতে হবে, “না, আমি দুঃখিত; আমি এটা করতে পারব না, এটা বেশি হয়ে যাচ্ছে, আমি সক্ষম নই।” তখন বলুন “না।” আদর্শগতভাবে, আমরা যখন বলি “না” তখন আমাদের তাদের জন্য কিছু বিকল্প দিতে হবে, যদি আমরা পারি। আপনি কিছু পরামর্শ দিয়ে দিনঃ “তাহলে হয়তো ঐ অন্য ব্যক্তি আপনাকে সাহায্য করতে পারে।”
সংক্ষেপে, বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণভাবে যা কিছু ঘটতে থাকে তাদের প্রতি জাগ্রত থাকুন এবং তারপর সঠিক জ্ঞান, মৈত্রী এবং করুণা প্রয়োগ করুন।
ক্রোধের সাথে মোকাবিলা
আপনি মেঝে পরিষ্কার করাকে ক্রোধ বা অন্যান্য ধ্বংসাত্মক আবেগের সাথে মোকাবিলা করার একটি পদ্ধতি হিসাবে কথা বলেছেন। কিন্তু আপনি এটাও উল্লেখ করেছেন যে বৌদ্ধধর্মে এরজন্য অনেক গভীর পদ্ধতি রয়েছে। আপনি কি অনুগ্রহ ক’রে একটি ইঙ্গিত দিতে পারেন যেখানে এগুলি খোঁজ করা যেতে পারে?
বেশ, একটু গভীরে গেলে, আমরা যখন কারও উপর ক্রোধিত হই তখন ক্রোধকে মোকাবিলা করার একটা স্তর হল ধৈর্য বিকাশ করা। এখন, প্রশ্নটা হল আমরা কীভাবে ধৈর্য বিকাশ করব? এরজন্য অনেকগুলি পদ্ধতি আছে। তাদের মধ্যে একটি পদ্ধতিকে, উদাহরণ স্বরূপ, “লক্ষ্য সাদৃশ্য ধৈর্য” বলা হয়ঃ “আমি যদি একটা লক্ষ্য নির্ধারণ না ক’রে রাখি তাহলে কেউ সেটাকে আঘাত করবে না।” যেমন- আমি আপনাকে আমার জন্য কিছু করতে বলি এবং সেটা আপনি ভুলভাবে করেন। এর পিছনে যে প্রবণতা থাকে সেটা হল আমার দিক থেকে আপনার উপর ক্রোধিত হওয়া অথবা আপনি সেই কাজটা একেবারেই করেন না। তাহলে দোষটা কার? প্রকৃতপক্ষে, এটা আমার দোষ কারণ আমি এটা করতে খুবই অলস ছিলাম এবং সেইজন্য আমি আপনাকে এটা করতে বলেছিলাম। অতএব, আমি কী আশা করতে পারি? আপনি যখন কাউকে কিছু করতে বলেন তখন আপনি তার কাছ থেকে কী আশা করেন? ধরুন, আপনি দু-বছর বয়সে একজন ছোট্ট কোন বাচ্চাকে আপনার জন্য এককাপ গরম চা আনতে বললেন এবং আনার সময় সে সেটা ফেলে দেয়। অবশ্যই সে ফেলেও দিতে পারে। তাই এক্ষেত্রেও বিষয়টা একই- আমরা যখন কাউকে আমাদের জন্য কিছু করতে বলি, তখন আমরা কী আশা করি?
তাই আমি তখন বুঝে যাই যে এটা ছিল আমার অলসতা, যেটা প্রকৃতপক্ষে সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। তাই আপনি অন্য ব্যক্তির উপর ক্রোধিত হবেন না। আর আমি সচেতন থাকি যে আমি যখন আপনাকে আমার জন্য কিছু করতে বলি তখন এর পিছনে যে কারণ থাকে সেটা হল হয় আমি খুব অলস, আমার কাছে সময় নেই অথবা এরকম কিছু সেটা যাইহোক না কেন। তবে, বিষয়টা হল আমি যদি অন্য কাউকে এটা করতে বলি তাহলে আমাকে আশা করা উচিত নয় যে সে নিখুঁতভাবে সেটা করবে অথবা আমি যেভাবে এটা করব সেটা শেষ পর্যন্ত সঠিক নাও হতে পারে। আমিও ভুল করি। আর যদি আমি নিজে এটা করি এবং করার সময় একটা ভুল করি তখন নিজের উপর ক্রোধিত হয়ে কোন লাভ হয় না। “আমি তো নিখুঁত নই- কেউ নিখুঁত নয়- তাই অবশ্যই আমি ভুল ক’রে থাকি।” তাই আপনি বাস্তবতাকে মেনে নিন। “আমি একজন মানুষ; মানুষ মাত্রই ভুল করেঃ তাই আমি ভুল করেছি।” আর আমি যদি সংশোধন করতে পারি তাহলে আমাকে সেটা করতে হবে। আমাকে নিজের উপর ক্রোধিত হলে হবে না। নিজের উপর ক্রোধিত হয়ে কোন লাভ নেই। শুধু সংশোধন করব যদি আমি সেটা পারি। যদি না পারি তাহলে কিছু করার নেই- সেটাকে ছেড়ে দেব এবং ভবিষ্যতে ভুলকে পুনরাবৃত্তি না করার চেষ্টা করব।
ক্রোধের সাথে মোকাবিলা করার আরও একটা গভীর স্তর হল নিজের বাস্তবতাকে বোঝা। এখন আমি একটা খুবই সাধারণ স্তরের কথা বলছি, তবে এই সাধারণ স্তরেও এটা সহায়ক। “আমি জগতের কেন্দ্রবিন্দু নই। আমি কেন সবসময় আমার সুযোগ-সুবিধা পাব? কেন? আমার মধ্যে এমন কী বৈশিষ্ট আছে যে আমাকে সবসময় সুযোগ পেতে হবে। আর অন্য কেউ পাবে না?” এই ধরণের চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে আপনি জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হিসাবে “আমি” সম্পর্কে এই মূর্ত দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণ করতে শুরু করেন। মূর্ত “আমি”। তারপর অবশ্যই আপনি আরও, আরও বেশি বিনির্মাণ করতে পারবেন। যখন আপনার মধ্যে মূর্ত বস্তু হিসাবে “আমি”-রূপী দৃষ্টিভঙ্গি থাকে এবং তার কারণে আমাকে সবসময় সুযোগ-সুবিধা পেতে হবে, যখন আপনি আপনার সুযোগটা না পাবেন, তখন অবশ্যই আপনি ক্রোধিত হবেন, তাই না?
আমরা কীভাবে অস্তিমান এবং কীভাবে প্রত্যেকে অস্তিত্বে রয়েছে তার সম্পর্কে বৌদ্ধধর্মে অনেক কিছু বলার আছে। আমরা অস্তিমান কিন্তু আমরা অসম্ভব উপায়ে অস্তিত্বে নেই যেভাবে আমরা কল্পনা ক’রে থাকি, যেমন একটা ছোট্ট “আমি” আমার মস্তিষ্কে বসে কথা বলছে এবং সেই হল আমার মস্তিষ্কে অবস্থিত কন্ঠ স্বরের লেখক। মন হয় যেন ভিতরে একটা ছোট্ট আমি কথা বলছে এবং অভিযোগ করছেঃ “আমার এখন কী করা উচিত? ওহ্ আমি সেটা করব।” আর তারপর আপনি আপনার শরীরকে এমনভাবে নাড়াতে শুরু করেন যেন শরীরটা একটা মেশিন। কিন্তু এটি একটি মায়া। আপনি আপনার ভিতরে কোন ছোট্ট “আমি”-কে খুঁজে পাবেন না, পাবেন কি? কিন্তু তবুও আমি অস্তিমান- আমি কথা বলি; আমি কাজকর্ম করি। সুতরাং, এই অভিক্ষেপগুলির প্রতি আমাদের বিশ্বাস থেকে দূরে সরে যেতে হবে কারণ মনে হয় যেন সেগুলি বাস্তবতার অনুরূপ। এমনটাই মনে হয়। সেখানে এই আওয়াজ গুঞ্জন করে, যার অর্থ হল নিশ্চয়ই ভিতরে কেউ আছে যে কথা বলে।
তাই এই বৌদ্ধধর্মে সম্পূর্ণ ক্ষেত্রের জন্য অনেক কিছু দেওয়ার আছে যাকে আমরা বলব “মনোবিজ্ঞান।”
আমাদের শরীর দ্বারা কাজকর্ম করা
আমার দুটি প্রশ্ন আছে। প্রথমটি হলঃ আপনি হয়তো আমাদের শরীর দ্বারা কাজকর্ম করার বিষয়ে আরও কিছু বলতে পারেন। আপনি উল্লেখ করেছেন যে আমাদের শরীরকে শিথিল করতে হবে কিন্তু এর সাথে আমাদের আরও কিছু করতে হতে পারে। আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলঃ এই সমস্ত অভিক্ষেপগুলির উৎস কী? উদাহরণ স্বরূপ, এই ব্যক্তি আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরে কথা বলছেন- এটা কেন জাগে?
অবশ্যই অনেক নিয়ম-শৃঙ্খলা নির্ধারিত আছে, যেগুলি আমরা শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি। উদাহরণ স্বরূপ, বৌদ্ধ ওষুধ যা আপনি তিব্বতী পরম্পরায় দেখতে পাবেন। এটা শরীরের শক্তির ভারসাম্যকে বজায় রাখার জন্য অনেক কিছু করে। আমাদের শক্তি এবং আমাদের সাধারণ স্বাস্থ্য, খুব বেশি প্রভাবিত হয় আমাদের আহার এবং আচরণের কারণে। আচরণ বলতে যেমন আপনি ঠান্ডায় বাইরে যান এবং যথেষ্ট গরম পোশাক পরেন না যার কারণে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমরা ঐ ধরণের আচরণের কথা বলছি। অথবা অতিরিক্ত কাজকর্ম করা- এই ধরণের আচরণ আপনাকে অসুস্থ ক’রে তোলে।
আমরা আমাদের শরীরের অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা বজায় রাখার চেষ্টা করি। আপনি আভ্যন্তরীণভাবে যত বেশি নীরব হয়ে থাকবেন আপনি ততবেশি সতর্ক থাকবেন। আর এটা শুধু আপনার মনের পরিস্থিতি বিষয়ে নয়, বরং আপনার শরীরের শক্তির পরিস্থিতি বিষয়েও। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি যখন অনুভব করবেন আপনার শক্তি ভীষণভাবে ভীতিগ্রস্ত তখন আপনি অনুভব করতে পারবেন স্পন্দন খুব দ্রুতবেগে চলছে ইত্যাদি। এরজন্য এমনকিছু মৌলিক জিনিস আছে যেটা আপনি করতে পারেন, এমনকি আপনি আপনার আহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, যেমন- আপনি কফি এবং শক্তিশালী চা পান করা বন্ধ করতে পারেন এবং ভারী খাবার গ্রহণ করতে পারেন যেটা আমাদের শক্তিকে কমিয়ে দেয়, যেমন- চর্বীযুক্ত খাবার- পনীর এবং এই ধরণের অন্য কিছু। আর তার সাথে উষ্ণ থাকবেন; বাতাস যুক্ত অথবা যেখানে খসড়ায় ভরা থাকে সেখানে থাকবেন না; উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন যুক্ত যানে যাতায়াত করবেন নাঃ যেমন ঘরর-ঘরর শব্দ, এটা আপনার শক্তিকে আরও বেশী বিরক্ত ক’রে তুলবে। শান্ত অবস্থায় থাকুন। অতএব, এটাই হবে উক্ত অনুশীলনের স্তর।
তিব্বতী পরম্পরা স্বয়ং শারীরিক ব্যায়াম অথবা শরীর দ্বারা করণীয় এই ধরণের কাজের উপর জোর দেয় না, যেভাবে আপনি করতে পারেন। যেমন- ধরা যাক, চীনা অথবা জাপানী বৌদ্ধ পরম্পরায় প্রবর্তিত মার্শাল আর্ট বা যুদ্ধকলা। তবে অবশ্যই সেটা হল আলাদা ধরণের মার্শাল আর্ট- তাইজি, কিগং, এই ধরণের কলাগুলি খুবই সহায়ক হতে পারে। এগুলি আপনার গতিবিধি সম্পর্কিত মননশীলতার মাধ্যমে একাগ্রতা বিকাশের পদ্ধতিও। তিব্বতীরা যে শারীরিক ব্যায়ামগুলি করে সেগুলি অনেক সূক্ষ্ম যা শক্তি ব্যবস্থার সাথে অন্যভাবে কাজ করার মাধ্যমে করতে হয়, মার্শাল আর্ট পদ্ধতিতে নয়। এটা একটা আলাদা উপায়, এটা আরও বেশি যোগ অনুশীলনের অনুরূপ। অতএব, এটাই হল সেই পদ্ধতি যেটা আপনি শরীর দ্বারা করতে পারেন।
আমাদের মস্তিষ্কের কন্ঠস্বরের উৎস
আমাদের মস্তিষ্কের কন্ঠস্বরের উৎস সম্পর্কে বলতে গেলে এটা মনের স্বভাবের সাথে যুক্ত এবং এটা কিছুটা জটিল হয়ে যায়। বৌদ্ধধর্মে, আমরা যখন মন সম্পর্কে কথা বলি তখন আমরা কোন ধরণের বিষয় নিয়ে কথা বলি না। আমরা কথা বলি মানসিক কার্যকলাপ সম্পর্কে এবং ঐ মানসিক কার্যকলাপই চিন্তন, দর্শন এবং আবেগের অনুভূতির সাথে জড়িত। এটা অত্যন্ত বিস্তৃত। ঐ কার্যকলাপের সাথে যা ঘটে সেটা হল সেখানে এক ধরণের মানসিক হলোগ্রাম উৎপন্ন হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন কিছু দেখি, আলো রেটিনাকে আঘাত করে, নিউরনে বৈদ্যুতিক আবেগ এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু করে এবং এরফলে যেটা যেমন দেখায় তার এক ধরণের হলোগ্রাম তৈরী হয়। কিন্তু সেটা আসলে একটা মানসিক হলোগ্রাম। এটা ঐ সমস্ত রাসায়নিক এবং বৈদ্যুতিক আবেগ থেকে উদ্ভূত হয়।
কিন্তু হলোগ্রাম দৃষ্টিলব্ধ নয়। এই মানসিক হলোগ্রামগুলি শব্দের মতো স্বরও হতে পারে। আমরা এক মুহূর্তের মধ্যে একটা সম্পূর্ণ বাক্য শুনতে পাই না- আপনি এক মুহূর্তে তার ছোট ছোট অংশ শুনতে পান- তাহলেও সেখানে সেই সম্পূর্ণ বাক্যের এই মানসিক হলোগ্রাম থাকে এবং আপনি বুঝতে পারেন যে এর অর্থ কী। একইভাবে সেখানে আবেগের আকারে মানসিক হলোগ্রাম থাকে, চিন্তার আকারে থাকে মানসিক হলোগ্রাম। আর থাকে মৌখিকতার আকারে মানসিক হলোগ্রাম অর্থাৎ এই কন্ঠস্বর। এই বিষয়গুলি শুধু উৎপন্ন হয়। এইগুলি হল কিছু জ্ঞান যা সেগুলির সাথে জড়িত থাকে। সুতরাং এটাই হল তাই যা দেখা যায়, চিন্তা করা হয় অথবা অনুভূত হয়। এটাই হল তাই। আর এই মানসিক কার্যকলাপ “আমি”-এর অস্তিত্ব ব্যতীত চলতেই থাকে এবং এটা তার থেকে আলাদা যে নিরীক্ষণ করছে অথবা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এটা ঘটাচ্ছে। এটা শুধু ঘটতেই থাকে। সুতরাং এই মানসিক হলোগ্রামের অংশ হল “আমি”- “এই কন্ঠস্বরটি হল আমি।” কে চিন্তা-ভাবনা করছে? আমি চিন্তা-ভাবনা করছি। এটা কি আপনি নন যে চিন্তা-ভাবনা করছেন- আমি চিন্তা-ভাবনা করছি। তবে এটা এই হলোগ্রামের পুরো প্রক্রিয়ার অংশ।
আমার মস্তিষ্কের এই স্বরের উৎস কী? এটা মানসিক কার্যকলাপের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটা। এরজন্য সমস্ত মানসিক কার্যকলাপ কীভাবে ঘটতে থাকে সেটা অগত্যা প্রয়োজন নয়। স্বরটি সবসময় গুঞ্জন হতে থাকে না। আর আমার সন্দেহ আছে যে, একটা কেঁচোও কোন স্বরের সাথে চিন্তা-ভাবনা করে। তবুও কেঁচোর অবশ্যই একটা মস্তিষ্ক আছে, একটা মন আছে, বস্তু দেখে এবং কাজকর্ম করে।
আসলে আমরা যখন এর সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি তখন এটা খুব আকর্ষণীয় হতে শুরু করে। কন্ঠস্বরের একটা হলোগ্রাম হল যোগাযোগ স্থাপনের কোন রূপ, তাই নয় কি? এটা এক ধরণের কল্পনা, যা শব্দের মানসিক স্বরের আকারে একটি চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করে অথবা যোগাযোগ স্থাপন করে। মজার প্রশ্নটি হলঃ একজন ব্যক্তি যিনি জন্ম থেকে বধির ও বোবা এবং স্বর সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই- তার মস্তিষ্কে কি একটা কন্ঠস্বর থাকে, নাকি তিনি সাংকেতিক ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা-ভাবনা করেন? এটা একটা খুবই আকর্ষণীয় প্রশ্ন। আমি এর উত্তর কখনো খুঁজে পাই না।
সুতরাং এটা একটা স্বর হোক অথবা এটি একটি সাংকেতিক ভাষা, যাইহোক না কেন- বা কীটরা কেমনভাবে চিন্তা-ভাবনা করে- এখানে মায়া হল, এই সমস্তের পিছনে একটা আলাদা “আমি” আছে যে কথা বলছে, কন্ট্রোল বোর্ডে বসে আছে, চোখ থেকে তথ্য পর্দায় চলে আসছে এবং তার কাছে এই মাইক্রোফোন আছে, সে কথা বলছে আর সে হাত এবং পা নড়াচড়া করানোর জন্য বোতাম টিপছে। এটি একটি সম্পূর্ণ মায়া। তবে, কন্ট্রোল বোর্ডে বসে থাকা এই ধরণের “আমি”-এর উদ্দেশ্য হল “ওহ্, লোকেরা আমাকে নিয়ে কী ভাববে? এবং “আমার এখন কী করা উচিত?” আমরা এই বিষয়ে চিন্তিত, এই “আমি” রয়েছে কন্ট্রোল বোর্ডে।
আমরা যখন উপলব্ধি করি যে এই “আমি” একটি মায়ার মতো, তাহলে সেখানে চিন্তিত হওয়ার কিছু থাকে না। আমরা কথা বলি, আমরা কাজ-কর্ম করি। অবশ্যই এটা হলাম আমিঃ আমি কথা বলছি, আমি কাজকর্ম করছি। আর মানুষ যদি এটা পছন্দ না করে, তারা পছন্দ করবে না। তাতে কী হয়েছে? বুদ্ধ তো সকলকে খুশী করেননি। বুদ্ধকে সবাই পছন্দ করেনি, তাই আমি আমার জন্য কী আশা করব? আমরা শুধু বোধগম্যতা, মৈত্রী এবং করুণা ব্যবহার ক’রে কাজকর্ম করতে পারি। ব্যস্ এইটুকু। আর এই নিয়ে কোন চিন্তা করবেন নাঃ “তারা আমার সম্পর্কে কী ভাববে?” এটা যেমন শোনা যায় ততটা সহজ নয়।
অন্যরা যখন ক্রোধিত হয় তখন নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করা
যখন অন্য কোন ব্যক্তি আমাদের উপর ক্রোধিত হয় তখন আমরা কীভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করব?
মূলতঃ আমরা দেখতে পাই যে তারা একটা ছোট্ট শিশুর মতো। যখন একটা দুই বছর বয়সী শিশু আমাদের উপর ক্রোধিত হয়, যখন আমরা তাকে বলি, “এখন ঘুমোতে যাওয়ার সময়।” তখন সে বলে, “আমি তোমাকে ঘৃণা করি। তুমি ভয়ঙ্কর।” আর তারপর সে যখন উত্তেজিত হয়ে ঝগড়া করে আমরা কি ক্রোধিত হই? ঠিক আছে, কিছু লোক আছে যারা ক্রোধিত হয়; কিন্তু সে তো মাত্র দু-বৎসর বয়সী, আপনি তার কাছ থেকে কী বা আশা করবেন? আপনি শিশুটিকে শান্ত করার চেষ্টা করুন। এখন আপনি ভদ্র হন, যেমন আপনি দুই বছর বয়সী শিশুর সাথে করবেন। এটার সম্পর্কে ভাবুনঃ আপনি কীভাবে এর মতো একটা দু-বছর বয়সী শিশুর সাথে মোকাবিলা করবেন? সাধারণতঃ যখন একটা দু-বছর বয়সী শিশু ভয়ঙ্করভাবে আচরণ ক’রে তখন আপনি যদি তাকে তুলে ধরেন এবং স্নেহ করেন সে শান্ত হয়ে যায়, তাই নয় কি? পরিবর্তে, তাদের প্রতি চিৎকার করলে তাদের আরও বেশি কাঁদায়। তাই মানুষও তেমন- বড় শিশু।