সংঘের উৎপত্তি
‘ধর্মচক্রপ্রবর্তনসূত্র’ ব্যাখ্যা করে যে বুদ্ধত্ব লাভ করার পর বুদ্ধ তাঁর পাঁচজন প্রাক্তন বন্ধু, যাদের সাথে তিনি কয়েক বছর ধরে তপশ্চর্যা করেছিলেন, চার আর্যসত্যের উপর তাঁর প্রথম উপদেশ বা শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। ঐ উপদেশের সময় ঐ পাঁচজন তপস্বীই তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে কৌন্ডিণ্য অর্হত অর্থাৎ মুক্ত সত্তার অবস্থা লাভ করেছিলেন। কিছুদিন পরে আত্ম-শূন্যতার উপর উপদেশ দেওয়ার সময় অথবা কীভাবে অসম্ভব উপায়ে আত্মার অস্তিত্ব থাকতে পারে না, তার উপর উপদেশ দেওয়ার সময় অন্য সব তপস্বীরাও অর্হত্ব লাভ করেছিলেন। এইভাবে এই পাঁচজন শিষ্যই সংঘের প্রথম সদস্য বা প্রথম বৌদ্ধ ভিক্ষু হন।
তারপর বুদ্ধ তাঁর অবশিষ্ট জীবন- মোট প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে- তিনি যে ধর্মের খোঁজ করেছিলেন, তার প্রচার করার জন্য উত্তর ভারতের সমতল জুড়ে গ্রাম ও শহরে ভ্রমণ করেছিলেন। শীঘ্রই, বুদ্ধ সামাজিক ধারা জুড়ে অনেক অনুযায়ীদের আকৃষ্ট করেছিলেনঃ অন্যান্য আধ্যাত্মিক গুরু, রাজা এবং রাণী, কৃষক এবং কষাই ইত্যাদি আরও অনেক। যদিও বেশিরভাগ শিষ্যরা পার্থিব বা সাংসারিক জীবন ত্যাগ করতে চাননি, তবুও যারা গৃহস্থ জীবন ত্যাগ ক’রে সংঘে যোগদান করতে চেয়েছিলেন তাদের স্বাগত জানানো হয়েছিল। সাধারণ গৃহস্থ শিষ্যগণ, যারা বৈবাহিক জীবনে যুক্ত থেকে কাজকর্ম চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তারা সংঘকে অন্ন এবং বস্ত্র দিয়ে সমর্থন করেছিলেন।
সময়ের সাথে-সাথে, যত বেশি সংখ্যক মানুষ আনুষ্ঠানিকভাবে বুদ্ধের সাথে যোগদান করলেন একটা সম্প্রীত আধ্যাত্মিক সমুদয় তৈরী করার উদ্দেশ্যে, শিষ্যদের মেনে চলার জন্য নিয়ম তৈরী করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। সংঘের মধ্যে ঘটিত অনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে যখন নিয়ম গঠন করার প্রয়োজন হয়েছিল তখন সেটাকে বিচার ও ত্রুটির মাধ্যমে প্রণয়ন করা হয়েছিল। বুদ্ধের জীবনের শেষ দিকে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের জন্য কয়েক শত নিয়ম নির্ধারিত ছিল।
স্ত্রীদের দীক্ষা
শুরুতে বুদ্ধ শুধুমাত্র পুরুষদের বৌদ্ধ সংঘে দীক্ষিত করেছিলেন। বৌদ্ধসংঘের প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর বুদ্ধের মাসি মহাপ্রজাপতি গৌতমী বুদ্ধকে অনুরোধ করেছিলেন তাকে ভিক্ষুণী হিসাবে দীক্ষিত করার জন্য, কিন্তু তিনি সেটা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তা সত্ত্বেও মহাপ্রজাপতি নির্ভীক হয়েছিলেন এবং পাঁচশজন অন্য স্ত্রীদের সাথে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারা তাদের মস্তক মুন্ডন করবেন এবং পীত বস্ত্র ধারণ ক’রে বুদ্ধকে অনুসরণ করবেন।
মহাপ্রজাপতি বুদ্ধের কাছে আরও দুটি অনুরোধ করেছিলেন এবং প্রত্যেক বারই বুদ্ধ তাদের দীক্ষিত করতে অস্বীকার করেছিলেন। চতুর্থবার বুদ্ধের কাকাতো ভাই আনন্দ প্রজাপতির হয়ে মধ্যস্থ করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে স্ত্রীদের মধ্যে আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে যাওয়া এবং জ্ঞানলাভের ক্ষমতা পুরুষদের সমান আছে কিনা। বুদ্ধ ইতিবাচকভাবে তার উত্তর দিয়েছিলেন। আনন্দ তখন পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তাহলে তো স্ত্রীদের ক্ষেত্রে ভীক্ষুণী হওয়া ভালো হবে। আর তাই বুদ্ধ পরে স্ত্রী শিষ্যদের দীক্ষিত হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।
ব্যবহারিক সংঘ এবং আর্য সংঘ
সাধারণতঃ, সংঘ শব্দটি ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীদের এই দুটি সমুদয়, যারা বুদ্ধের শিক্ষা অনুসরণ করে, তাদের বোঝানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ভিক্ষু শব্দের প্রকৃত অর্থ হল “ভিক্ষুক বা ভিখারী” এবং এটা এই কারণে ব্যবহার করতে হয়েছিল যে, দীক্ষিত সমুদয়কে অধিকাংশ বস্তুগত ত্যাগ ক’রে আহারের জন্য অন্যের উপর নির্ভর ক’রে জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হতো। একটা সংঘ গঠনের জন্য নুন্যতম চারজন পূর্ণ ভিক্ষু অথবা শ্রামণের বা শ্রামণেরিকা থাকার প্রয়োজন হতো, তাতে তাদের উপলব্ধির সচেতনতার স্তর যাই হোক না কেন। এছাড়াও একটা আর্য সংঘ আছে, যা ব্যক্তি দীক্ষিত অথবা অদীক্ষিত উভয়কে বোঝায় কিন্তু তাদের প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় পথের কিছু উপলব্ধি অর্জন করতে হতো।
ব্যবহারিক বা প্রচলিত সংঘ এবং আর্য সংঘের মধ্যে পার্থক্য করা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সংঘের মধ্যে অনেক উৎকৃষ্ট সর্বজনীন ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণী আছেন, তবে এমনও হতে পারে তাদের মধ্যে কিছু এমন আছেন আমাদের মতোই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং তাই এটা আমাদের মধ্যে প্রশ্ন জাগাতে পারে যে আমরা কেন তাদের শরণে যাব। বস্তুতঃ তারা এমনই একজন যারা আমাদের সঠিক পথে যেতে সহযোগিতা করে।
সংঘের গুণাবলী
তাহলে, সংঘের মধ্যে কী ধরণের গুণ থাকে যা আমরা নিজেদের মধ্যে বিকাশ করতে চাই?
১। তাঁরা যখন শিক্ষা দান করেন তখন তাঁরা গ্রন্থ থেকে যা শিখেছেন তার পুনরাবৃত্তি করেন না। তাঁরা তাদের নিজস্ব বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলেন এবং এটা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক।
২। তাঁদের একমাত্র ইচ্ছা অন্যদের সহযোগিতা করা আর তাঁরা যে বিষয়ে শিক্ষা দান করেন তাঁরা তার অনুশীলনও করেন। একজন ধূমপায়ীর পক্ষ থেকে ধূমপানের বিপদ সম্পর্কে আমাদের তিরষ্কার করার কথা ভাবুন, আমরা সত্যিই ভাবব আমাদেরকে কেন তার পরামর্শ অনুসরণ করা উচিত, তাই না? এই কারণে, সংঘ সবসময় তাঁরা যা করেন সেই বিষয়ে তাঁরা আন্তরিক থাকেন, তাই আমরা সত্যিই তাদের বিশ্বাস করতে পারি।
৩। আমরা যখন খারাপ সঙ্গের সাথে সময় কাটাই আমরা বুঝতেই পারি না তাদের কতটা খারাপ গুণ নিজেরা গ্রহণ করে ফেলি। একইভাবে আমরা যদি ভাল বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডায় যুক্ত হয়ে যাই, এমনকি খুব বেশি পরিশ্রম না ক’রেও, আমরা শীঘ্রই ভাল গুণগুলি অর্জন ক’রে ফেলি। অতএব, আমাদের ধর্ম-চর্চার উন্নতির জন্য সংঘের দিক থেকে আমাদের উপর খুব ভাল প্রভাব ফেলে।
সংঘের গুরুত্ব
প্রায় দু-হাজার পাঁচশ বছর আগে বুদ্ধ পরলোক গমণ করেছেন আর আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর ধর্মরূপী শিক্ষার অনুশীলন এবং এটাই হল সেই বৌদ্ধধর্ম। কিন্তু সেটাকে ভালোভাবে অনুশীলন করার জন্য আমাদের প্রয়োজন হয় নির্ভরযোগ্য দৃষ্টান্তের, যারা আমাদের সহযোগিতা এবং পথ প্রদর্শন করতে পারেন অর্থাৎ যারা প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধের শিক্ষাগুলি শিখেছেন, অধ্যয়ন করেছেন এবং অনুশীলন করেছেন আর এর কোন লক্ষ্য অর্জন করেছেন। এমন ধরণের লোকজনের সমুদয়কে বলা হয় সংঘ। এটা সম্পূর্ণরূপে সংঘের কৃতজ্ঞতা বা অবদান যেটা আজ আমাদের কাছে শিক্ষা রয়েছে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে এসেছে। সংঘ আমাদের অনুপ্রেরিত ক’রে আমাদের তাৎক্ষণিক সমস্যা ব্যতীত সমস্যাগুলি সম্পর্কে ভাবতে এবং আমাদের ভাবায় যে এমন একটা পথ আছে যা আমাদের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ক’রে দেয়। তারা শুধু আমাদের অনুপ্রাণিত করে তা নয়, এছাড়াও তারা আমাদের পথের প্রতিটি পদক্ষেপে মার্গ দর্শন করেন, উৎসাহিত করেন এবং সমর্থন করেন। এই কারণেই কখনো-কখনো বলা হয় সংঘ ছাড়া কোন বৌদ্ধধর্ম নেই।
আজকাল আমরা প্রায়ই আমাদের রোল মডেল হিসাবে তারকাদের অর্থাৎ অভিনেতা, অভিনেত্রী, শিল্পী, গায়ক এবং ক্রীড়াবিদদের দিকে অভিমুখ করি। কিন্তু এই মানুষদেরও তাদের নিজস্ব সমস্যা আছে, তাই না? আমরা জানি যে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তারা প্রায়ই বিশৃঙ্খলার মধ্যে যুক্ত থাকে। শুধু তাই নয় আমরা যখন তারকা এবং তাদের জীবন নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি তখন এটা সাধারণতঃ আমাদের বন্ধুদের সাথে গালগপ্পো করতে এবং বস্তুগত আসক্তির প্রতি স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি আঁকড়ে ধরতে প্রেরিত করে। এই ক্রিয়াকলাপগুলি সত্যিই আমাদের বা অন্যদের কোন প্রকৃত লাভ বা সুখ প্রদান করে না। অন্যদিকে সংঘ হল এমন মানুষের সমুদয় যারা ইতিমধ্যে তাদের সমস্যার কিছু স্তর থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে, এটা কি দুর্দান্ত নয়? আর সেইসাথে তারা অবশিষ্ট সমস্যাগুলি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টারত আছেন। আমরাও যদি আমাদের নিজস্ব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই তাহলে কি তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার কোন মানে হয় না?
সারাংশ
আমরা কীভাবে জীবনে একটা ভাল প্রেরণার স্রোত বেছে নিতে পারি? যদিও আমাদের সাথে সংঘের একজন প্রকৃত সদস্যের প্রকৃত অবস্থা প্রাপ্ত একজন আর্য সংঘ-এর সাথে সাক্ষাৎ না হয়, তবুও আমরা এমন লোকজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারি, যারা ধর্ম সম্পর্কে আরও বেশি অভিজ্ঞ এবং তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারি। তাদের দৃষ্টান্ত দেখে, তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করতে উৎসাহিত হই।
বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীদের নিয়ে গঠিত ব্যবহারিক সংঘের উৎসর্গের কারণে ধর্ম সারা বিশ্বে প্রচারিত হতে পেরেছে। ঠিক যেমন বুদ্ধকে চিকিৎসকের সাথে এবং ধর্মকে ঔষধের সাথে তুলনা করা হয়, তেমনই সংঘরা হল নার্সদের (সেবিকা) মতো যারা আমাদের পথে অবতরিত হতে উৎসাহিত এবং মার্গদর্শন করেন, কারণ আমরা আমাদের সমস্ত সমস্যা থেকে চিরতরে মুক্তির জন্য প্রচেষ্টারত থাকি।