আমরা সবাই জীবনের অর্থের খোঁজ করি। কিছু লোক এটির খোঁজ করে তাদের পেশায়, কিছু মানুষ নিজেদের সাম্প্রতিক ফ্যাশনের সঙ্গে বজায় রেখে করে, এবং অন্যরা সুদূর-প্রসারিত গন্তব্যস্থলগুলির ভ্রমণের মাধ্যমে করে। কিন্তু সর্বশেষে পেশার অন্ত হয় অবসর গ্রহণে, ফ্যাশন নিয়মিতভাবে পরিবর্তন হয়, এবং ছুটির দিনগুলি থাকে চোখের পলকের উপর। এদের মধ্যে কোনটাও আমাদের স্থায়ী সন্তুষ্টি বা সুখ প্রদান করে না। আধুনিক বিশ্বে উপলব্ধ অসংখ্য পছন্দের মধ্যেও- ভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক- জীবনে কী করা যায়, তা নিয়ে রয়েছে অনেক বিভ্রান্তি।
বৌদ্ধ ধর্মে ‘শরণ’ হল আমাদের জীবনে একটি সার্থক দিশা প্রদান করার বিষয়। ঐ দিশাটি হল আমাদের সমস্ত ভুলত্রুটিগুলিকে অতিক্রম ক’রে এবং আমাদের সমস্ত সুপ্তশক্তিগুলিকে বোধগম্যের মাধ্যমে আমাদের এবং অন্য সবার জন্য সর্বোত্তম সহায়ক হিসেবে কাজ করা। বৌদ্ধ শরণগমন অস্থায়ী বিষন্নতা, ক্ষুধা অথবা ধকল- এর থেকেও বেশীর জন্য আশ্রয়স্থল রুপে কাজ করে। এটা এমন কিছু নয় যা বাহ্যিক রুপে আমাদের কিছু পরিবর্তন করে, অর্থাৎ আমাদের কোন বিশেষ বস্ত্র পরার প্রয়োজন নেই বা আমাদের চুলের ঠাট পরিবর্তন করতে হবে। বৌদ্ধ ধর্মের শরণগমনের অর্থ হল মনের অবস্থাকে পরিবর্তন করা। এর মানে হল আমাদের বোধশক্তিকে গভীর করা যা জীবনের একটা উদ্দেশ্য জন্ম দিতে পারে, এবং যা এখন আর ভবিষ্যতে সুখ প্রদান করবে। সংক্ষেপে, বৌদ্ধ ‘শরণ’ আমাদের দুঃখ থেকে রক্ষা করে।
সাধারণত বৌদ্ধরা এই বাক্যটি ব্যবহার করে “শরণ গমন করি”, কেননা শরণ হল একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া। এটি একটি মৌলিক ধাপ যেখানে আমরা বৌদ্ধ মার্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। কিন্তু এসব আমরা করব কেন? যখন আমরা মানুষের স্বভাব বিষয়ে বোধগম্য হয়, যে আমরা সবাই সুখ এবং সন্তুষ্টির খোঁজ করছি, এবং আমাদের মধ্যে কেউ দুঃখ চায় না- আমাদের এমন একটা জিনিসের খোঁজ করা উচিৎ যা আমাদের সহযোগিতা করবে। অতএব বৌদ্ধ ধর্মে, আমরা ত্রিরত্নের শরণের দিকে অভিমুখ হই।
এই ত্রিরত্ন হল বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘ
আমরা বুদ্ধের শরণে যাই। তার কারণ হল যেহেতু তিনি একজন জ্ঞানদীপ্ত শাস্তা, সুতরাং তিনি কেবল নিরর্থক ভব (সংসার) থেকে মুক্তি হওয়ার জন্য নয়, বরং দুঃখ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে মুক্ত হওয়ার পথ প্রদর্শন করেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে চিত্ত মূলতঃ শুদ্ধ হয় এবং সেকারণে করুণা এবং জ্ঞান দ্বারা সমস্ত বিভ্রান্তি ও নেতিবাচক আবেগগুলি, যা আমাদের মধ্যে উৎপন্ন হয়, পূর্ণতঃ নিবারণ করা যায় যাতে সেগুলি আবার ফিরে না আসে। ধর্ম হল বুদ্ধের বাণী যা দিয়ে এটা প্রাপ্ত করা যায়। অতএব আমরা যখন শরণ-গমন করি, আমরা অভিমুখ হই আর আমাদের জীবনের সব সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন বৌদ্ধ উপায়গুলি গ্রহণ করি। সংঘ মানে হল ভিক্ষু, ভিক্ষুণী এবং আমাদের বৌদ্ধ সহচরগণ। তাঁদের মধ্যে যাঁরা বাস্তবে বুদ্ধের শিক্ষার অনুশীলন করেন, তাঁরা আদর্শ উদাহরণ হিসাবে কাজ করেন এবং বৌদ্ধ মার্গকে অনুসরণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করেন।
আমাদের প্রতিশ্রুতির অর্থ এটা নয় যে বন্ধু-বান্ধব বা সমাজ থেকে আমাদের নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে। আসলে আমরা যখন ত্রিরত্নের শরণে যাই, আমরা না কেবল একটা সার্থক জীবন নির্মাণ করি, বরং আমরা অন্যের জন্য নিজেদের খোলা রেখে দিই এবং দেখতে শুরু করি যে আমাদের চারিপাশে এবং সারা বিশ্বে যাঁরা আছেন তাদের জন্য আমরা কী যোগদান দিতে পারি।
আমরা যখন বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের শরণে যাই, তখন আমাদের আর বিভ্রান্তি বোধ করার প্রয়োজন হয় না। আমাদের আর চারিপাশে আধ্যাত্মিক ভাবে কেনাকাটার প্রয়োজন হয় না। অবশ্যই যদিও আমাদের এখনও কিছু স্তর পর্যন্ত আরাম এবং সম্পত্তির প্রয়োজন আছে, তবুও আমরা তার উপর নির্ভর হব না, এই ভেবে যে এই আমাদের সর্বদা সুখী রাখবে। বৌদ্ধ নীতির প্রতি আমরা যেভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, সেটা আসলে আমাদের চাপ থেকে মুক্ত করে এবং যেটা গুরুত্বপূর্ণ তার উপর কাজ করার অধিক সময় প্রদান করে, যা আমাদের আবেগপূর্ণভাবে বেশী সুখী এবং স্বাস্থ্যকর রাখে।
এই কারণেই শরণ হল এক চলমান বা সক্রিয় প্রক্রিয়া। এটা হল এই রকম যে আমাদের নিয়মিত ভাবে এর উপর কাজ করে যেতে হবে। এটা এই রকম নয় যে আমরা বুদ্ধকে এক ধরণের দেবতা মনে ক’রে তাঁর উপর কেবল বিশ্বাস করলাম এবং প্রার্থনা করলাম। এছাড়া এটা এরকমও নয় যে বৌদ্ধ বন্ধুগণ আমাদের জন্য কাজ করতে সক্ষম হবেন। এই কারণেই এটা বলা হয় সর্বোত্তম শরণ হল বুদ্ধের উপদেশ, অর্থাৎ ধর্ম। যদিও আমাদের মধ্যে বুদ্ধ এবং প্রচুর পণ্ডিত ও কারুণিক বৌদ্ধ বন্ধুদের প্রতি দৃঢ় শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা স্বয়ং ধর্মকে অনুসরণ না করব এবং ধর্মোপদেশগুলি পালন না করব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা শরণের ফল অর্জন করতে পারব না। যখন আসল প্রমুখ পরামর্শকে অনুসরণ করি যা হল অন্যের অপকার না করা, হিতকর কাজ-কর্মে অংশগ্রহণ করা এবং আমাদের মনকে দমন করা, আমাদের জীবনটা নিশ্চিতভাবে বেশী সার্থক হবে।
যদিও বৌদ্ধ মার্গে বিশেষ অনুষ্ঠান আছে যেখানে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের যাত্রা শুরু করতে পারি, কিন্তু আসল প্রতিশ্রুতিকে তো হৃদয় থেকে জাগাতে হয়। যখন আমরা স্বয়ং সত্যিই কাজ করতে শুরু করি, এর মানে দাঁড়াবে যে আমরা প্রকৃতপক্ষে শরণগমন করেছি।