আমাদের জীবনে বৌদ্ধ অনুশীলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করা-
আমাকে দৈনন্দিন জীবনে শরণ-গমনের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমার স্মরণে এলো ভারতের মহান আচার্য অতীশ (দীপঙ্কর)-এর কথা, যিনি দশম শতাব্দীর শেষে তিব্বত গিয়েছিলেন। তিনি একজন মহান আচার্য ছিলেন, আর তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের পুনরুত্থানে সহায়তা করেছিলেন। এই বৌদ্ধ ধর্ম ভারতবর্ষ থেকে তিব্বতে প্রারম্ভিক প্রবর্তন হওয়ার পর পতন হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় তিব্বতে প্রচুর ভুল ধারণা ছিল, বিশেষ করে তন্ত্র এবং আরও উন্নত শিক্ষাগুলি সম্পর্কে। যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকই ছিল না সেখানে। প্রকৃতপক্ষে, এমন কোনও শিক্ষকই ছিল না, যিনি সত্যিই আরও স্পষ্টভাবে বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করতে পারতেন। যদিও এমন অনেক গ্রন্থ ছিল যা অনুবাদ করা হয়েছিল, কিন্তু অনেক লোক সেটা পড়তেও পারত না এবং যথেষ্ট পরিমাণ অনুলিপিও ছিল না। যদিও তারা পড়তে পারত, কিন্তু যা কিছু পড়ছিল তার সম্পর্কে কোনও ব্যাখ্যা পাওয়াও খুব কঠিন ছিল।
এই পরিস্থিতিতে সহায়তা করার জন্য, পশ্চিম তিব্বতের একজন রাজা কিছু অতি সাহসী ছাত্রকে ভারতবর্ষে প্রেরণ করেছিলেন, যাতে তারা একজন মহান বৌদ্ধ আচার্যকে তাদের সাথে তিব্বতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতে পারেন। তাদের পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করতে হয়েছিল, ভাষা শিখতে হয়েছিল এবং জলবায়ুর সাথে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। যাত্রার সময়ই অথবা ভারতবর্ষে পৌঁছনোর পর অনেকে মারাও গিয়েছিলেন। তবে যাই হোক না কেন, তারা ভারত থেকে এই মহান আচার্য অতীশকে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানাতে পেরেছিলেন। তিনি তিব্বতে গিয়ে সেখানে অনেক বছর ছিলেন। মূলতঃ তিনি শরণ-গমন এবং কর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই কারণে, তিনি “শরণ-গমন এবং কর্ম লামা (কর্ম গুরু)” নামে পরিচিত হয়েছিলেন অর্থাৎ তিব্বতীরা তাকে এই নাম দিয়েছিলেন।
অতীশের উদাহরণ বর্তমানে বেশ প্রাসঙ্গিক। বর্তমানেও বৌদ্ধধর্ম এবং দৈনিক স্তরের অনুশীলনের অর্থ কী তা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। আবার, তন্ত্র এবং অন্যান্য উন্নত শিক্ষাগুলি সম্পর্কে প্রচুর ভুল ধারণাও রয়েছে। মৌলিক বৌদ্ধ শিক্ষার খুব কম ভিত্তিমূলক জ্ঞান অথবা কোনও ভিত্তি ছাড়াই লোকেরা এই অনুশীলন-গুলিতে লাফ মারে। তাদের ধারণা যে, কিছু ঐন্দ্রজালিক কর্ম-কান্ড অনুষ্ঠান করাই হল বৌদ্ধ সাধনা। শরণ-গমনের প্রাসঙ্গিকতা এবং আমাদের দৈনিক জীবনে তার গুরুত্বকে তুচ্ছ ক’রে এই মানুষগুলি আসল বিন্দুটিই হারিয়ে ফেলছেন।
আমাদের জীবনের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, বৌদ্ধ অনুশীলনটি হল নিজের উপর কাজ করার জন্য অর্থাৎ একজন উত্তম ব্যক্তি হওয়ার জন্য নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করা। এটা এমন একটা জিনিস নয় যা আমরা কেবল শখ বা খেলাধুলার মতো পার্শ্ব কাজ হিসাবে করি, সম্ভবতঃ প্রতিদিন আধা ঘণ্টার জন্য অথবা আমরা যখন খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন সপ্তাহে একবার একটি সংক্ষিপ্ত সেশনের জন্য করি। বরং এটি এক ধরণের ব্যবহারিক জিনিস যা আমরা করার চেষ্টা করি। সর্বদা নিজের উপর কাজ করা। এর অর্থ হ’ল আমাদের ত্রুটিগুলি এবং ভাল গুণগুলি, উভয়কেই সনাক্ত করা। তারপর নিজের ত্রুটিগুলির শক্তি দুর্বল করা এবং ভালো গুণগুলিকে শক্তিশালী করার পদ্ধতিগুলি শেখা। শেষপর্যন্ত, উদ্দেশ্যটি হ’ল সমস্ত ত্রুটি থেকে নিজেকে মুক্ত করা এবং সমস্ত ভালো গুণকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা। এটি কেবল আমাদের নিজের লাভের জন্য নয়, যদিও আমরা অবশ্যই জীবনে সুখী হওয়ার জন্য এটির থেকে উপকৃত হব। এটি অন্যকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে আরও কার্যকর করার জন্য এবং অন্যের উপকারের জন্যও নির্ধারিত। এটাই হল বৌদ্ধ অনুশীলনের উদ্দেশ্য। যা এটিকে স্পষ্টতঃ বৌদ্ধ করে তোলে তা হ’ল- এই লক্ষ্যগুলি অর্জনে সক্ষম হওয়ার জন্য সম্পর্কিত পদ্ধতিগুলি এবং শরণ-গমনের অর্থ আমরা সেই পদ্ধতিগুলির দিকে অগ্রসর হই এবং সেগুলি আমাদের জীবনে গ্রহণ করি।
শরণ-গমন কোনো নিষ্ক্রিয় সাধনা নয়
ত্রিরত্ন- বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘ-এর শরণে যাওয়াটা, সমস্ত বৌদ্ধ শিক্ষার কেন্দ্রস্থল। বাস্তবে শরণ-গমন করাটাই বৌদ্ধ হওয়া অথবা না হওয়ার মধ্যে বিভাজন রেখা তৈরী করে। সংক্ষেপে বলা যায়, ধর্ম আমাদের নিজের উপর কাজ করার পদ্ধতি এবং আমরা সকলে সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারি; বৌদ্ধরা হলেন- যারা এই পদ্ধতিগুলি শিখিয়েছেন এবং সেই লক্ষ্যটি পুরোপুরি অর্জন করেছেন। সংঘ বলতে বোঝায়, যারা সেই লক্ষ্যের কিছু অংশ অর্জন করেছেন। বস্তুতঃ “ধর্ম” শব্দটির অর্থ হল “প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা”- নিজের এবং সম্ভবতঃ অন্যদের সমস্যা রোধের জন্য আমরা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করি। এগুলি হ’ল নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ।
যদিও মূল সংস্কৃত শব্দ হল শরণ, যার অনুবাদ “আশ্রয়” রূপে করা হয়। এর অর্থ হল “সুরক্ষা” এবং এমনকি এটি “আশ্রয়” রূপেও ব্যবহৃত হতে পারে। তবে আমাদের এটিকে সঠিকভাবে বুঝতে হবে। এর অর্থ ‘ধর্ম’ শব্দের অর্থের সঙ্গে খাপ খায়। এটি এমন নয় যে, আমাদের নিজেকে কেবল নিষ্ক্রিয়ভাবে কোনও বাহ্যিক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে যে আমাদের সুরক্ষা দেবে। বৌদ্ধ প্রসঙ্গে “শরণ-গমন” খুবই সক্রিয়; নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমাদের কিছু করা দরকার।
নীচের উদাহরণটি বিবেচনা করুন যা আমার শিক্ষকরা প্রায়শই ব্যবহার করতেন। মনে করুন, এখানে বৃষ্টি হচ্ছে এবং কাছেই একটি গুহা আছে। যদি আমরা শুধু বলি, “আমি এই গুহার শরণে যাই; এর অর্থ হল আমি আশ্রয়ের জন্য গুহার দিকে যাই,” তারপর ভিতরে না গিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম এবং এই বাক্যাংশ পুনরাবৃত্তি করলাম। এতে তো আপনার কোনও উপকার হবে না। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের বাস্তবে গুহায় প্রবেশ করতে হবে। তেমনই, যদি আমরা শুধু বলি, “আমি বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের শরণে গমন করব এবং তাদের কাছে যাব আশ্রয়ের জন্য,” কিন্তু যদি আমি সত্যি-সত্যিই তাদের দিক-নির্দেশে না যাই এবং তাদের মার্গকে নিজের জীবনে প্রয়োগ না করি, এটিও কোনও সহায়ক হবে না। সমস্যা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমাদের এই কথাগুলি কার্যে পরিণত করতে হবে যেগুলি এই তিনটি প্রদর্শিত করে। এই জন্য আমি পরিভাষাটি “সুরক্ষিত দিক-নির্দেশনা” এবং “আমাদের জীবনকে সুরক্ষিত দিকে পরিচালনা করা” ব্যবহার করি।
গুহার প্রতীকের চর্চা বহাল রেখে, কেবল গুহার ভিতরে ঢুকেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা যথেষ্ট নয়, এই আশায় যে, কেবল গুহার ভিতরে থাকলেই আমরা কোনোভাবে আমাদের জীবনের সমস্ত সমস্যা থেকে রক্ষা পেয়ে যাব, শুধু ভিজে যাওয়া থেকে নয়। মূল বক্তব্যটি হ’ল বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘ যে আদর্শকে বোঝায়, সেই আদর্শের কাছে যাওয়ার জন্য আমাদের ক্রমাগত নিজের উপর কাজ করা দরকার। আমরা যখন মনে করি যে বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের শরণে যাওয়াই যথেষ্ট, তখন এটি খুব সহজেই খ্রীষ্টান ধর্মের ব্যক্তিগত রক্ষাকর্তার ধারণার সাথে মিশে যায়, এবং এটা ভাবতে থাকি যে বুদ্ধ আমাদের কোনোভাবে বাঁচাতে চলেছেন। সেই পরিস্থিতিতে, আমরা বুদ্ধকে ঈশ্বর রূপে দেখি এবং সংঘকে দেখি সাধু-সন্তদের সমূহ হিসাবে। কারণ, বেশীরভাগ পশ্চিমী সমাজগুলিতে খ্রীষ্টান ধর্মের প্রভাব অন্তর্নিহিত আছে। এরকম ভাবনার সাথে আমরা প্রার্থনা করি যে, কোনও দৈব শক্তি চমৎকারের দ্বারা আমাদের রক্ষা করতে চলেছে। বৌদ্ধ পরিভাষা ব্যবহার করলে, এটি অলৌকিকভাবে আমাদের সমস্ত সমস্যা এবং দুঃখ থেকে মুক্ত করা হয়ে যাবে।
যদি এমন হয়, আমাদের শুধু এটুকুই করতে হবে যে, তিব্বতী ভাষায় আমাদের কোনও বৌদ্ধ নাম রেখে নিই, একটি লাল বস্ত্র পরিধান করি, মন্ত্রের কয়েকটি আলৌকিক শব্দ পাঠ করি, কঠোর প্রার্থনা করি এবং কোনোভাবে আমরা রক্ষা পেয়ে যাই। বিশেষতঃ যখন আমরা তিব্বতী ভাষায় প্রার্থনা এবং সাধনাগুলি পাঠ করি, যার মধ্যে আমাদের একটি শব্দেরও অর্থ জানা থাকে না, সেই পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি যে এটার আধ্যাত্মিক শক্তি হয়তো আরও বেশি আছে। জোংসর খ্যেনত্সে রিনপোছে নামক একজন খুব বড় লামা সম্প্রতি বার্লিনে এসেছিলেন, যেখানে আমি থাকি। তিনি যা বলেছিলেন তা সত্যিই খুব গভীর। তিনি বলেছিলেন যে, যদি তিব্বতীদের তাদের সব সাধনাগুলিকে জার্মান ভাষায় উচ্চারণ করতে বলা হয়, যেগুলি তিব্বতী বর্ণমালায় অনুবাদ করা হয়েছে এবং তাদের নিজের দ্বারা উচ্চারিত কথার অর্থ সম্পর্কে তাদের যদি কোনও ধারণাই না থাকে, তাহলে কয়জন তিব্বতী ঠিকভাবে বৌদ্ধ সাধনা করতে পারবে তাতে আমার সন্দেহ আছে। অবশ্যই (তার কথা শুনে) সবাই হেসেছিল। কিন্তু আমরা যদি এটির বিষয়ে চিন্তা করি, এটি সত্যিই যথেষ্ট গভীর, তাই নয় কি? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা যদি এরকম ভাবি যে শরণ-গমন আমাদের সব সমস্যার আধ্যাত্মিক সমাধান এবং আমাদের কেবল এটুকুই করতে হবে যে, আমাদেরকে কোনও শ্রেষ্ঠতর শক্তির সামনে নিজেকে সমর্পিত করে দিতে হবে, তাহলেই আমাদের এই প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।
এখানে সংশ্লিষ্ট আসল বিষয়টি হ’লঃ “আমি আমার জীবনের সাথে কী করছি?” “আমার জীবন কি কোথাও চলে যাচ্ছে?” আমাদের মধ্যে অনেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছি যে আমাদের জীবন আর কোথাও চলে যাচ্ছে না; এটি কেবল একটি বৃত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এখানে আমাদের পুনর্জন্মের গভীর বৃত্তের বিষয়ে কথা বলতে হবে না, কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবন কোনও দিকে চলে যাচ্ছে বলে মনে হয় না বরং অর্থহীন বলে মনে হয়। আমরা আসলে জীবিত আছি কেন? এরকম অনুভব করাটা খুব দুঃখজনক অবস্থা, তাই নয় কি? এটা খুবই সুখকর অবস্থা নয়। তাই আমাদের প্রয়োজন জীবনে কিছু অর্থবহ দিক-নির্দেশনা, একধরণের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। এটি এমন কিছু যা আমাদের নিজের জীবনে প্রয়োগ করা দরকার। এটি একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া। জীবনে কিছু অর্থবহ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য থাকলে আমরা কোনও প্রকারে বুঝতে পারব যে, আমরা কী করছি। এর দ্বারা আমরা নিজেদেরকে বেশী কুশল এবং সুরক্ষিত অনুভব করব, তাই নয় কি?
নিজের জীবনে কোনো অর্থবহ লক্ষ্য নির্ধারণ করা
আমরা আমাদের জীবনের জন্য কেমন ধরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারি? সাধারণতঃ বর্তমানে আমরা যে অসন্তুষ্ট পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি এবং আমরা আমাদের জীবনে কোনও লক্ষ্য নির্ধারিত ক’রে এই পরিস্থিতি থেকে কোনো রকমভাবে বেরিয়ে আসতে চাই। একদম মৌলিক স্তরে আমরা বলতে পারি যে, সবাই সুখী হতে চায় এবং কেউ দুঃখী হতে চায় না। বৌদ্ধ ধর্মে এটি একধরণের স্বীকৃতি রূপে বলা হয় এবং এর মধ্যে একপ্রকারের জৈবিক সত্যও আছে। আমরা ব্যাথা ত্যাগ করতে চাই, দুঃখ ত্যাগ করতে চাই, বাধা এড়াতে চাই। এমনকি পোকা-মাকড় এবং কীট-পতঙ্গরাও সেটাই চায়, তাই নয় কি? এটাই আমাদের লক্ষ্য।
এবারে প্রশ্নটি হল যে, আমরা কতটা দুঃখ বা অসন্তুষ্টি দেখছি? যে লক্ষ্যটি আমরা নির্ধারিত করতে চেয়েছি, সেটা কি আমাদের বিশেষ সমস্যার সমাধান করা ছাড়াও অন্য সমস্যাগুলিও সমাধান করবে? উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সমস্যাটি দারিদ্রতাও হতে পারে, আর এটি হল অর্থনৈতিক সমস্যা। তাই আমাদের লক্ষ্য হল একটি ভালো চাকরী খুঁজে পাওয়া এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করা। যদি কোনও ভালো চাকরী নাও হয়, তাহলে সম্ভবতঃ অন্যায় কাজ করে আমাদের দ্রুত ধনী হতে হবে। যাই হোক না কেন, প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে হবে। কিন্তু আমরা যদি এমন মানুষদের দেখি যাদের কাছে প্রচুর অর্থ আছে এবং তাদের সাথে যদি আন্তরিকভাবে কথা বলি আর তারাও যদি তাদের জীবন সম্পর্কে সততার সাথে আমাদের জানায় তাহলে দেখতে পাব যে, এই মানুষগুলো মোটেই সুখী নয়। তাদের নিজের অর্থ কখনও পর্যাপ্ত মনে হয় না। তাদের কাছে কত মিলিয়ন আছে সেটা বিবেচ্য নয়, তারা সর্বদা আরও চায়। তারা কখনই সন্তুষ্ট হয় না।
আমার এটা খুব আকর্ষনীয় মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ, এমনও মানুষ আছে যাদের কাছে এক বিলিয়ন ডলার ছিল, কিন্তু বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে এখন তাদের কাছে অর্ধ বিলিয়ন ডলার রয়ে গেছে। তারা এখন কোনও রকম দান করেন না এবং কোনও প্রকারের লোকহিতকর কাজে অংশগ্রহণ করেন না। কারণ তাদের কাছে এখন অর্ধ বিলিয়ন ডলার আছে, তাই জন্য তারা নিজেকে নিরাপত্তাহীন বলে মনে করেন। তারা মনে করেন যে, এটিকে সঞ্চয় করতে হবে এবং কারও সাথে নিজের সম্পদ ভাগ করে নেওয়ার আগে কোনোভাবে এক বিলিয়নে পৌঁছতে হবে। এই পরিস্থিতিতে তারা সর্বদা শেয়ার বাজারের প্রতিবেদনগুলি দেখতে থাকে, সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকে যে, তাদের ক্ষতি না হয়ে যায় এবং তাদের বর্তমান সম্পদ না কমে যায়। তারা ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী এবং এর মতো অন্যান্য সুরক্ষা পদ্ধতিও ভাড়া করতে পারে, কারণ তারা ভয় পায় যে, লোকেরা তাদের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র চুরি করতে পারে অথবা তাদের শিশুদের অপহরণ করতে পারে। দক্ষিণ আমেরিকার ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে এটি সাধারণ ঘটনা। এছাড়াও তারা সত্যিই কখনও অনুভব করেন না যে, লোকেরা তাদের অর্থ পাওয়ার চেষ্টা ছাড়াও অন্য কোনও কারণে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করতে পারে। তারা সবসময় সন্দেহ করেন যে, অন্য ব্যক্তি যারা তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে, সেই ব্যক্তির নজর আছে তাদের অর্থের দিকে। স্পষ্টতঃ, যদিও তাদের দরিদ্র হওয়ার সমস্যা থাকতে নাও পারে, তবে অবশ্যই তাদের অন্য অনেক সমস্যা থাকতে পারে যেটা বিত্তশালীদের ক্ষেত্রে হয়।
পার্থিব লক্ষ্যের একটি অস্থায়ী ভিত্তি আছে
বৌদ্ধ ধর্মে অনেক তথাকথিত “পার্থিব লক্ষ্য” আছে, প্রচুর অর্থ ছাড়াও। কিন্তু ইংরেজী শব্দে “পার্থিব” শব্দের একটি নেতিবাচক দিক আছে এবং সেটি খুব আলোচনাত্মক বিষয়। বিষয়টা কিন্তু এটা নয়। আমার গুরু, সেরকোঙ্ রিনপোছে বলেছিলেন যে, তিব্বতী ভাষার জিগ্-তেন শব্দের অনুবাদ “পার্থিব” রূপে করা হয় এবং এর দুটি শব্দাংশই বাস্তবিক অর্থটা প্রতিপাদন করে। সেই শব্দাংশের অর্থ হল কোনও এমন জিনিস যার কোনো আধার আছে (তেন) যা ভেঙ্গে (জিগ) যেতে পারে। আমরা যদি এমন কোনো লক্ষ্য স্থির করতে চাই যা টুকরো-টুকরো হয়ে যেতে পারে, তাহলে স্পষ্টতঃ এর থেকে স্থায়ী সুখ প্রাপ্ত করা যায় না। এর দ্বারা আরও অধিক সমস্যা উৎপন্ন হয়, কারণ এর কোনো দৃঢ় আধারই নেই।
উদাহরণস্বরূপ, ভাবুন আমাদের জীবনের লক্ষ্য হল- আমাদের একটা ভালো পরিবার হোক, আমরা এই রকম পরিবারে অনেকগুলি সন্তানের লালন-পালন করব যাতে বার্ধক্যকালে তারা আমাদের যত্ন নেবে, তাহলে আমরা সুখী এবং সুরক্ষিত থাকব। কিন্তু এগুলি সবসময় আদর্শরূপে কাজ করে না, করে কি? আরও একটি উদাহরণ হল- প্রসিদ্ধি লাভ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা। বাস্তবে আমরা যতবেশী লোকপ্রিয় হয়ে যাব, মানুষ আমাদের ততবেশী বিরক্ত করবে এবং আমাদের সময় নেওয়ার প্রয়াস করবে। আমরা সিনেমার তারকাদেরই দেখতে পারি যারা ছদ্মবেশ ছাড়া বাইরে বেরোতে পারে না। কারণ মানুষে তাকে ঘিরে ধরে আর তাদের কাপড় এবং অন্যান্য জিনিস পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলতে চায়। আসলে সুপারস্টার হওয়া তাদের কাছে একটা নরক।
যদি আমরা নিজেদের জীবনকে গম্ভীরভাবে দেখি, তাহলে ভৌতিক স্তরে কোনো প্রকারের আরামদায়ক পরিস্থিতি অথবা আমাদের আশপাশের মানুষদের সঙ্গে ভাবনাত্মক স্তরে সুবিধাজনক পরিস্থিতি থাকাটা পর্যাপ্ত নয়। কারণ এর সহায়তা দ্বারা আমরা আমাদের জীবনের সব সমস্যার সমাধান করতে পারি না। এর কারণ হল, এসবকিছু থাকা সত্ত্বেও আমরা যদি ক্রোধ, আসক্তি, লোভ, অহংকার, শিশুসুলভ আচরণ ইত্যাদির মধ্যে যুক্ত থাকি, তাহলে আমাদের মধ্যে সমস্যাগুলি থেকেই যাবে, তাতে আমরা তথাকথিত “পার্থিব” স্তরে যতই সফল হই না কেন।
অশান্তকারী আবেগ
বৌদ্ধধর্ম পুনর্জন্ম প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করে এবং দুঃখ আর অপ্রীতিকর পরিস্থিতিগুলির আলোচনা করে যা অপর জন্মে সেইরকম পরিস্থিতি আমাদের সঙ্গী-সাথী হতে পারে যদি আমরা “অশান্তকারী আবেগ”-এর দ্বারা প্রভাবিত থাকি। তার ভিত্তিতে আমরা বাধ্যকারীভাবে আচরণ করতে থাকি এবং নেতিবাচক সম্ভাবনাগুলি তৈরী করতে থাকি। বৌদ্ধ উপস্থাপনায় এই কথাটি স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, এই পরিস্থিতিটি খুবই খারাপ এবং যদি আমরা জানি যে, কোনটা আমাদের জন্য হিতকারী, তাহলে আমাদের ওই পরিস্থিতিকে অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ নেতিবাচক সম্ভাবনা থেকে সমস্যা এবং দুঃখের উৎপত্তি হয়।
কিন্তু পশ্চিমী জগতের অধিকাংশ মানুষ ভবিষ্য জন্মতে বা পুনর্জন্মতে বিশ্বাস করে না অথবা একে নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করেন না। সুতরাং আমরা এই বিষয়ের উপর আলোচনা কেবল এই জন্ম প্রসঙ্গে করতে পারি। আমরা যদি নিজেদের জীবনের বর্তমান পরিস্থিতিকে দেখি এবং গভীরভাবে অনুসন্ধান করি তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের আবেগপূর্ণ সমস্যাগুলির বাস্তবিক স্রোত হল আভ্যন্তরিন। বাহ্যিক বিষয়গুলি হল শুধু পরিস্থিতি যার কারণে সমস্যাগুলির সূত্রপাত হয়। এটা হল, আসলে আমাদের অশান্তকারী আবেগ- আমাদের ক্রোধ, আসক্তি, লোভ ইত্যাদি- যা আমাদের মনের শান্তি এবং সুখকে অপহরণ করে। এগুলিই আমাদের ভালো গুণগুলিকে ব্যবহার করা থেকে বাধা সৃষ্টি করে। হতে পারে যে আমরা কাউকে সাহায্য করার চেষ্টা করি এবং এটা একটা ভালো গুণ, কিন্তু কোনও কারণে আমরা সেই ব্যক্তির উপর ক্রোধিত হয়ে যাই। পরে আমরা যখন তাদের ভালো পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তারা আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করে না অথবা আমাদের সাথে তর্ক করে, আর আমরা তখন নিজের ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলি। এই অশান্তকারী আবেগগুলি আমাদের অন্য কাউকে সত্যিই সাহায্য করতে বাধা সৃষ্টি করে।
এটা ওই সময় বিশেষভাবে কঠিন হয়ে যায় যখন আমাদের সন্তানদের সাথে এই ঘটনাটি ঘটে। যখন আমরা ধৈর্য্য হারিয়ে নিজের সন্তানদের প্রতি ক্রোধ করি। কারণ আমরা মনে করি যে, আমরা জানি ওদের জন্য কোনটা ভালো এবং সন্তানরা সেটা করে না যা আমরা তাদের করতে বলি। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সন্তানদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা খুব খারাপ হয়ে যায়, তাই নয় কি? এখানে মূল বক্তব্যটি হল উপলব্ধি করা যে, আমরা যদি এই পরিস্থিতিকে ঠিক করার চেষ্টা না করি তাহলে এটি কেবল খারাপ থেকে আরও বেশী খারাপ হতে থাকবে। হতে পারে আমাদের বয়স বাড়ার সাথে-সাথে আমরাও একটু নরম হয়ে উঠব, কারণ তখন আমাদের ভিতর তেমন শক্তি থাকবে না, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের ক্রোধ এবং এই ধরণের জিনিসগুলো নিজের থেকেই দূরে চলে যাবে। সময়ের সাথে-সাথে তাদের প্রভাব কিন্তু শেষ হয়ে যায় না।
বৌদ্ধ ধর্মে এই দৃষ্টির সাথে একটা শব্দ প্রয়োগ করা হয় যা আমাদের বিকশিত করা প্রয়োজন এবং সেই শব্দটি হ’ল “ভয়”। তবে আমাদের অধিকাংশ ভাষায় “ভয়” একটি কঠিন শব্দ। এই শব্দটির ভালো সুনাম নেই। কখনও-কখনও আমি “উত্রাস” শব্দটি পছন্দ করি তবে এটা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা এত সহজ নয়। “উত্রাস” শব্দের অর্থ হল “আমি সত্যিই চাই না এরকম হোক”। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের কর্মস্থানের একটি বিরক্তিকর বৈঠকে যেতে হবে। এমন নয় যে, আমাদের ওই বৈঠকে যেতে ভয় লাগে, কিন্তু সেখানে যেতে ত্রাস লাগে। আমরা সত্যিই এটা করতে চাই না।
কিন্তু আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, আমাদের দুই রকমের ভয়কে আলাদা করতে হবে যে, আমরা ভবিষ্যতের ভয়াবহ পুনর্জন্মের ভয়ের কথা বলছি, অথবা বুড়ো বয়সের দুঃখের ভয়ের কথা বলছি, অথবা যে কোনো কিছুর ভয় সম্পর্কে বলছি। একটা এমন ধরণের ভয় আছে যার থেকে বাইরে বেরোনোর রাস্তা আমরা দেখতে পাই না এবং আমরা নিজেদের অসহায় এবং হতাশ বোধ করি। এটা আমাদের প্রায় অথর্ব করে ফেলে, তাই নয় কি? আমি মনে করি এটি একটি অস্বাস্থ্যকর ধরণের ভয়, যদিও আমরা প্রায়শই এটা অনুভব করি। কিন্তু শরণ-গমন-এর প্রসঙ্গে যে প্রকারের ভয়ের আলোচনা করা হয়, সেটা একটি বিশিষ্ট এবং ভিন্ন স্বাদের ভয়, কারণ আমরা দেখতে পাই যে সমস্যাগুলি এড়ানোর উপায় আছে। অতএব, এটি নিরাশাজনক নয়, এবং আমরা মোটেও অসহায় নই। কিন্তু যেমনটি আমি আগেও বলেছি, এমন নয় যে কোনো দৈব শক্তি অথবা সত্ত্বা আমাদেরকে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে আসবে, আর আমাদের শুধু যা করতে হবে তা হল কঠোর প্রার্থনা। ফলে আমরা ভয় থেকে মুক্ত হয়ে যাব আর আমরা রক্ষা পেয়ে যাব।
মূল বক্তব্যটি হ’ল, আমরা এক অর্থে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। এটি এমন কী, যা আমাদের সমস্ত সমস্যাগুলি এড়াতে সক্ষম করে তোলে আমরা জীবনে যেগুলির মুখোমুখি হই? সেটা কী যা এটাকে সম্ভব করে তোলে? ব্যাপক অর্থে, এটি হ’ল সেই তথ্য যে, সমস্ত অশান্তকারী আবেগগুলি যা সমস্যার সৃষ্টি করে- আমাদের ক্রোধ, লোভ, আসক্তি ইত্যাদি- এগুলির উৎপত্তি হয় বাস্তবতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি থেকে। এই সমস্ত অশান্তকারী আবেগ আসলে চিত্তের কোনোও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য নয়। এগুলি চিরতরে নিবারণ করা যেতে পারে, যাতে তারা আর কখনোই উৎপন্ন না হতে পারে। ধর্ম-রত্ন নির্দেশ দেয় যে তাদের “সত্যিই থামানো” যেতে পারে।
মন অথবা মানসিক ক্রিয়াকলাপ
যখন আমরা বৌদ্ধ ধর্মে মন বা চিত্তের কথা বলি, এটির বিশদ বিবরণে না গিয়েই, আমরা মানসিক ক্রিয়াকলাপের কথা বলি। এটি স্বতন্ত্র, প্রতিমুহুর্তের মানসিক ক্রিয়াকলাপ এবং এটা তখনও ঘটে আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি। মন সেই মানসিক ক্রিয়াকলাপের বিষয়গত পরীক্ষামূলক দিককে বোঝায়। অন্যদিকে মস্তিষ্ক বিজ্ঞান তার শারীরবৃত্তীয় ভিত্তিকে বর্ণনা করে। উভয় ক্ষেত্রেই মানসিক ক্রিয়াকলাপের মূল প্রকৃতি এমন কিছু নয় যে, অগত্যা তার সাথে ক্রোধ অথবা বিভ্রান্তিতে থাকতে হবে অথবা এই বিষয়গুলির যে কোনো একটি। মূলতঃ প্রতিটি মুহুর্তে যে জিনিসের উৎপত্তি হতে থাকে তাকে আমরা একটি মানসিক হোলোগ্রাম বলতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, শারীরিক দৃষ্টিকোণ থেকে যখন ফোটন কণাগুলি আমাদের চোখে প্রবেশ করে এবং এর থেকে একপ্রকারের বৈদ্যুতিক স্পন্দন তৈরী হয় যা নিউরো ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে মস্তিষ্কে যায় এবং মস্তিষ্ক কোনরকমভাবে এটি থেকে আভ্যন্তরীণ হোলোগ্রাম তৈরী করে। এটাকেই আমরা কোনো জিনিসকে “দেখা” বলি, তাই না? অবশ্যই, যদি এই প্রক্রিয়া মানুষের চোখের কোষগুলির বদলে কোনো মাকড়সা অথবা মাছির চোখের কোষগুলির মাধ্যমে হয়, তাহলে অনেক আলাদা হবে। তেমনই কম্পনগুলি, যাকে আমরা “শব্দ তরঙ্গ” বলি যে, এমনই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের শোনার অনুভূতি হয়। মানসিক হোলোগ্রাম যে কোনো ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্বন্ধিত হতে পারে অথবা কেবল চিন্তা-ভাবনাও হতে পারে।
দেখার প্রসঙ্গে যদি বলা হয়, এর প্রক্রিয়াটি এমন নয়, যেমন কোনো ক্যামেরায় ফোটন কণা প্রবেশ করে এবং কোনো প্রকার বৈদ্যুতিক স্পন্দনে পরিবর্তিত হয়ে কোনো ফটো-এর নির্মাণ করে। এই প্রক্রিয়াটি দেখার প্রক্রিয়ার মতো হয় না, কারণ কোনো জিনিসের মানসিক হোলোগ্রামের উৎপত্তি হওয়ার কারণ তার সঙ্গের কোনোপ্রকারের “সজ্ঞানাত্মক সম্বন্ধ”ও হয়। আমরা কোনো জিনিসের প্রতি সচেতন হই অথবা অসচেতন হই, অভিজ্ঞ হই অথবা অনভিজ্ঞ হই, তবুও এটি কিছুটা জ্ঞানগত বৈশিষ্ট্য।
মানসিক ক্রিয়াকলাপও কম্পিউটারের মতো হয় না। আমরা কম্পিউটারের ছোট-ছোট চাবিগুলি টিপলে কোনো বৈদ্যুতিক স্পন্দন মেশিনে পৌঁছায়, এবং মেশিন সেই স্পন্দনকে কোনো ছবিতে পরিবর্তন করে দেয় যা পর্দায় দেখা যায় অথবা কোনো শব্দে পরিবর্তন করে দেয় যা স্পিকারের মাধ্যমে শোনা যায়। আমরা বলতে পারি যে কম্পিউটার এক অর্থে কোনো প্রকারের জ্ঞানগত সচেতনতার সঙ্গে যুক্ত, কারণ সেটি কৃত্রিম বুদ্ধি দ্বারা তথ্য নির্মাণ ও সরবরাহ করে। কিন্তু কম্পিউটার কোনো জীবিত মানুষের মতো একরকম নয়। কম্পিউটারের থেকে আমাদের যা আলাদা করে তোলে তা হ’ল, আমাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপের সাথে কোনো না কোনো স্তরে সুখ অথবা দুঃখ যুক্ত থাকে যা আমরা অনুভব করি। কম্পিউটার এটা করতে পারে না। একটি কম্পিউটার কোনো কিছুতেই খুশী বা অখুশী বোধ করে না। এটা ভাবে না, “ওহ্! আমার শুধুমাত্র একটি ত্রুটি ছিল এবং আমি যখন রিবুট করলাম, তখন আমি সেই ফাইলটি মুছে ফেললাম যাতে আমি কাজ করছিলাম”। এতে অখুশী বোধ হল; এটা এমন হয় না, তাই না? অন্যদিকে, যখন আমাদের সঙ্গে এরকম কিছু ঘটে তখন আমরা খুব দুঃখী হয়ে পড়ি।
এই ধরণের মানসিক ক্রিয়াকলাপ আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণেই চলতে থাকে। তার দ্বারাই কোনো প্রকারের মানসিক হোলোগ্রাম উৎপন্ন হয়, তার সাথে কোনো প্রকারের মানসিক সম্বন্ধ থাকে এবং কোনো না কোনো স্তরের সুখ অথবা দুঃখের অনুভব জড়িত থাকে। এমনকি যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি তখন উৎপন্ন হওয়া হোলোগ্রাম অন্ধকার হতে পারে এবং তার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের থাকে অজানা। তবে তখনও কিছু না কিছু চেতনা থাকে। যদি এরকম না হতো তাহলে আমরা ঘড়ির এলার্ম-এর আওয়াজ কখনও শুনতে পেতাম না। এটা পুরোপুরি বন্ধ থাকে না। যখন আমরা কোনো স্বপ্ন দেখি না, তখনও কোনো না কোনো অনুভূতি থাকে, এমনকি এটা নিরপেক্ষ অনুভূতিও হতে পারে, যেটা সুখীও নয় অসুখীও নয়। যখন আমরা কোনো স্বপ্ন দেখি, তখন তার মধ্যে ক্রোধ, লোভ এবং অন্যান্য মনোভাবের পাশাপাশি সুখী বা অসুখী, কোনো না কোনো অনুভূতি থাকতে পারে। কিন্তু এই অশান্তকারী আবেগগুলি প্রতিক্ষণে চলা এই পুরো প্রক্রিয়ার আবশ্যক ভাগ নয়।
স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা-ভাবনার অনেকগুলি জটিল পঙ্ক্তি আছে যার সাহায্যে আমরা আমাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপের মূল বিশুদ্ধতার জন্য আরও বেশী নিশ্চিত হয়ে উঠতে পারি। এখন এর সম্পর্কে আলোচনা করার সময় নয়। তবে আমরা এই বিষয়ে যত বেশী চিন্তা করব তত বেশী আমরা নিশ্চিত হয়ে উঠব যে, আমাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপের সমস্ত অশান্তকারী বিষয়গুলি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
একটি অশান্তকারী আবেগের সংজ্ঞা হল- সর্বোপরি এটি যখন উৎপন্ন হয় তখন আমরা আমাদের মনের শান্তি হারাই এবং হারাই আত্ম-নিয়ন্ত্রণও। ফলস্বরূপ আমরা ক্রোধ, লোভ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রকারের বাধ্যকারী আচরণ করতে থাকি। এই কারণে অনেক প্রকারের সমস্যাও উৎপন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে কোনও চিন্তা-ভাবনা না করে কারও উপর চিৎকার করতে থাকি এবং পরে তার জন্য সত্যই অনুশোচনা করি। এর কারণে তথাকথিত “নেতিবাচক সাম্ভাব্য বিষয়” তৈরী হয়ে যায়, যার কারণে আমাদের পরে দুঃখ ভোগ করতে হয়।
যদি আমরা ভবিষ্যতে সমস্যাগুলি আরও গভীর স্তরে এড়াতে চাই তাহলে আমাদের এই সমস্ত অশান্তকারী আবেগ এবং বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার। বাস্তবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, কারণ এই আবেগগুলি মনের সহজাত স্বভাব, এটা মানসিক ক্রিয়াকলাপের অংশ নয়। এছাড়াও, আমরা যদি প্রতি মুহুর্তে চলা এই মানসিক ক্রিয়াকলাপের ব্যাপারে আরও বেশী চিন্তা করি, তাহলে এর একটি দুর্দান্ত বৈশিষ্ট্য হল যে, এই মানসিক ক্রিয়াকলাপের সহায়তায় বিষয় সম্পর্কে আমরা কিছু জানতে পারি। আমাদের মধ্যে মৈত্রী এবং করুণা ইত্যাদির মতো আরও ইতিবাচক গুণও থাকতে পারে। এই ইতিবাচক গুণগুলি এমন জিনিস যা অধিক পরিমাণে বিকশিত করা যায়।
এখন এর মধ্যে পার্থক্য কী আছে? অশান্তকারী দিকগুলি বিভ্রান্তি ভিত্তিক। জ্ঞানের মতো ইতিবাচক দিকগুলি বাস্তবতা ভিত্তিক। একটি খুব সাধারণ উদাহরণ হ’ল- বিভ্রান্তি ভাবতে পারে, “আমি এই জগতের কেন্দ্রবিন্দু। আমি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। সবসময় আমার মর্জি চলবে। সকলের মনোযোগ সবসময় আমার উপরই কেন্দ্রিত থাকতে হবে,” ইত্যাদি। অতএব, যখন আমরা মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু না হই এবং যদি আমার মর্জি না চলে, আমরা ক্রোধিত হয়ে যাই। কুকুরের মতো আমরা হয় কারও উপর চিৎকার করি অথবা গর্জন করতে থাকি। “আপনি কাজটি তেমনভাবে করেননি যেমনভাবে আমি চেয়েছিলাম”। এগুলি সব বিভ্রান্তির কারণে হয়। বাস্তবতা হল যে, এখানে আমরা সকলেই সমান। সকলেই চায় যে কাজ তাদের নিজের ইচ্ছা মতোই হোক, কিন্তু এটা সম্ভব নয়। বাস্তবতা হল যে আমাদের সকলকে একসাথে মিলেমিশে থাকা শিখতে হবে।
সত্য নিবর্তন
আমরা এই কথার যত বেশী অনুসন্ধান করি ততই আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের বিভ্রান্তি নিজে থেকে টিকে থাকে না। এটি হল মিথ্যা। অন্যদিকে সঠিক জ্ঞান হল যাচাইযোগ্য আর এটা সত্য। এটাই কারণ যে, সত্য জ্ঞান শক্তিশালী হয় এবং হয় বিভ্রান্তি থেকে বেশী ভারী। যদি আমাদের মধ্যে সর্বক্ষণ একাগ্রতা এবং অনুশাসন দ্বারা বাস্তবতার সঠিক জ্ঞান থাকে, তাহলে বিভ্রান্তি উৎপন্ন হওয়ার সুযোগই পাবে না; সেটি সমাপ্ত হয়ে যাবে।
এটি শরণ-গমনের মুখ্য বিন্দু। আমরা আমাদের জীবনকে কী ধরণের দিক-নির্দেশনা দিচ্ছি? কী ধরণের অর্থ প্রাপ্ত করতে চলেছি? আমরা আমাদের জন্য কী ধরণের লক্ষ্য অর্জন করতে যাচ্ছি? এই লক্ষ্যটি হ’ল, সমস্ত ধরণের বিভ্রান্তির “সত্য নিবর্তন” অর্জন করা। এটিকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা যাতে এটি আর কখনও উৎপন্ন না হয়। আমরা এই জন্মের জন্য বলি অথবা আমাদের পরজন্মের কথা বলি না কেন এই বিভ্রান্তিই হল আমাদের সমস্যার আসল কারণ। এর থেকে সম্পূর্ণরূপে চিরকালের জন্য মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কারণ এটি আমাদের মানসিক কার্যকলাপের কোনো জন্মগত বৈশিষ্ট্য নয়। সঠিক জ্ঞান দ্বারা এটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যখন আমরা বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে যাই তখন আমাদের ভিতরের অশান্তকারী আবেগও উৎপন্ন হওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং আমরা আর নিজেদের জন্য সমস্যা এবং দুঃখ উৎপন্ন করি না।
এখানে এর দুটি দিক জড়িত আছে। একটি হ’ল আমরা এই সমস্ত অশান্তকারী দিক থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে পারি এবং দ্বিতীয়টি হ’ল আমরা ইতিবাচক দিকটির বৃদ্ধি ও বিকাশ করতে পারি। সঠিক বোধ হল এর ইতিবাচক দিক। আমরা এটির প্রসঙ্গে বিবেচনা করতে পারি যেটাকে “চার আর্যসত্য” রূপে অনুবাদ করা হয়েছে অথবা এটাই হল প্রমুখ বিষয় যার উপর বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছেন। প্রথম সত্যটি হল- দুঃখসত্য যা আমাদের বিভিন্ন প্রকারের সমস্যাকে উল্লেখ করে। পরবর্তী সত্য হল- এই দুঃখের যথার্থ কারণ আছে এবং কারণটি হল আমাদের বিভ্রান্তি। তৃতীয় সত্য হল- এই বিভ্রান্তিকে সত্যিই নিবর্তন করা সম্ভব যাতে এটি আর কখনও উৎপন্ন না হয়। শেষে আমরা এই সত্য নিবর্তনকে “যথার্থ মার্গ”-এর মাধ্যমে অর্জন করতে পারি। কিন্তু “মার্গ” শব্দের প্রয়োগ করার সময় আমাদের এটিকে “বোঝার উপায় যা মার্গ রূপে কাজ করে” এই হিসাবে বুঝতে হবে। এই বোধই “সত্য নিবর্তন” কে প্রাপ্ত করিয়ে দেয় এবং এই বোধ সকল অশান্তকারী উপাদানগুলি থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে।
স্পষ্টতই এই দিকটিই আমরা আমাদের জীবনে স্থাপন করতে চাই। এই দিকটি হল-নিরোধ সত্য এবং মার্গ সত্য প্রাপ্ত করার দিক। একেই ধর্মের শরণে গমন করা বলা হয়। যখন আমরা বলি আমরা নিজেদের উপর কাজ করছি এবং আমরা এই পরিভাষা ব্যবহার করি তখন সেটা এটিকেই বোঝায়।
আমাদের এই অশান্তকারী দিক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আরও বেশি করে চেষ্টা করতে হবে। আর এই ইতিবাচক দিকটিকে উপলব্ধি করার জন্য নিজের ক্ষমতার আরও বেশি বিকাশ করতে প্রয়াস করতে হবে। আমরা এটা করি কারণ আমরা ভয় পাই, যেটা হল ইতিবাচক দিক। এর পরিবর্তে যদি আমরা যেমন আছি তেমনই থাকি, তাহলে যদিও আমরা অনেক অর্থ পাই, আমাদের অনেক বন্ধু হয় এবং খুব বিখ্যাত হয়ে যাই, সমস্যাগুলি কিন্তু থেকেই যাবে। এর কারণ হল, আমরা তখনও লোভী এবং নিরাপত্তাহীন হয়ে থাকি; আমরা তখনও ক্রোধিত হই ইত্যাদি। আমরা এর জন্য ভয়ভীত হই কিন্তু দেখতে পাই এটাকে এড়ানোর একটি উপায় আছে। এটা হল- এমনই যে আমরা আগুনে পুড়ে যেতে ভয় পাই কিন্তু আমরা এটাও জানি যে আমরা যদি সাবধানে থাকি, তাহলে আমরা ঐ আঘাত এড়াতে পারি। একটা ভয় আছে তবে এটি একটি স্বাস্থ্যকর ভয়। এখানে আমরা বিভ্রান্তির কথা বলছি না।
আমরা এটা বুঝতে পারি যে, আমরা যদি বিশেষ করে নিজের আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুদের উপর ক্রুদ্ধ হই, তাদের উপর চিৎকার করি, তাহলে আমরা যখন বুড়ো হয়ে যাব তখন আমাদের কী হবে? আমরা এমন একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা রূপে একা থাকব যার সাথে কেউ দেখা করতে আসতে চাইবে না, কেউ যত্ন নিতে চাইবে না, কারণ আমাদের সাথে থাকা খুবই কষ্টকর হবে। কেননা আমরা লোকের সাথে খারাপ ব্যবহার করি ও অভিযোগ করি। সুতরাং কে আমাদের সাথে থাকতে চাইবে? কেউ না। এর সমাধান এটা নয় যে আমাদের অনেক ছেলে-মেয়ে থাকবে যারা আমাদের যত্ন নেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে অথবা ব্যাংকে আমাদের নামে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ থাকবে যাতে আমরা কোনো আরামদায়ক নার্সিংহোমে ভর্তি হতে পারব। তাসত্ত্বেও কিন্তু আমরা দুঃখীই থাকব। পরিষ্কার শব্দে বলতে গেলে বাস্তবে আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হল আমাদের নিজের ব্যক্তিত্বের উপর কাজ করতে হবে।
প্রত্যেকেই পরিবর্তন হতে সক্ষম
আমরা প্রায়শই ভাবি যে আমাদের ব্যক্তিত্ব হল স্থায়ী এবং আমরা তো এমনই। “আমার মেজাজটা খারাপ এবং আপনি এটির সাথে মানিয়ে চলতে শিখুন”। এটি কাজ করে না, করে কি? এই সমস্ত অশান্তকারী দিক থেকে মুক্তি পাওয়া এবং আমাদের সমস্ত ভালো গুণগুলি উপলব্ধি করা সম্ভব। যদি আমরা নিজেদের না শোধরাই তাহলে এই স্বাস্থ্যকর ভয়ের প্রভাবে আমাদের কী হবে? পাশাপাশি এই বিশ্বাসের সঙ্গে যে এই সব অশান্তকারী অবস্থাগুলি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব এবং ইতিবাচক দিকের বৃদ্ধি এবং তাদের বিকশিত করা সম্ভব, আমরা আমাদের জীবনকে এই সুরক্ষিত দিক প্রদান করতে পারি।
যদি আমরা এই কাজটি তথাকথিত “মহাযান” পদ্ধতি অনুযায়ী করতে চাই, তাহলে আমরা এর সাথে করুণার ভাবও জুড়ে দেবো। মূলতঃ মহাযান দৃষ্টি হ’ল, যদি আমরা কারও উপর রেগে যাই, তাহলে আমরা এটা দেখার প্রয়াস করি যে, আমরা তাদের কীভাবে সহায়তা করতে পারি? আমরা সত্যিই অন্যকে সহায়তা করতে সক্ষম হতে চাই এবং আমাদের এই আশঙ্কা থাকে যে, যদি আমরা সেই ব্যক্তির উপর রেগে যাই অথবা তার প্রতি আসক্তি থাকে অথবা ঈর্ষা থাকে তাহলে আমরা পরিস্থিতিকে পুরোপুরি গোলমাল করে ফেলবো। আমাদের জন্য এই সব অশান্তকারী আবেগ এবং বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হওয়া আবশ্যক, যাতে আমরা অন্যদের আরও বেশী সহায়তা করতে পারি। আমাদের অনুভূতি হয় আমরা যেন অন্যকে সহায়তা করতে সক্ষম হতে পারি। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা হয় যে আমরা সত্যিই বেশি কিছু করতে সক্ষম হব না। আমাদের যথেষ্ট ধৈর্য্য নেই, অথবা আমাদের যথেষ্ট বোধগম্যতা নেই। আমাদের আশঙ্কা হয় যে, আমরা অন্যদের ভালো করার পরিবর্তে ক্ষতি না করে ফেলি। সম্ভবতঃ আমরা এটা নিয়েও ভয় পাই যে, আমরা নিজেদের সন্তানদেরও লালন-পালন করতে ব্যর্থ হব। এই পরিস্থিতিটা খুব ভয়ঙ্কর হবে, তাই নয় কি? এই ভয়ই আমাদের নিজেদের উপর কাজ করার ক্ষেত্রে সুরক্ষিত এবং সুস্পষ্ট দিক নির্দেশ স্থাপন করতে পরিচালিত করে।
সত্যিই এই ধার্মিক কাজটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সাথে খুবই প্রাসঙ্গিক। শরণ-গমনের ক্ষেত্রে, এটি আমাদের পরিস্থিতি এবং সমস্যাগুলির সম্পর্কে খুব সৎ হয়। আমাদের সকলের মধ্যে এগুলি আছে। আমাদের সকলের মধ্যে এই অশান্তকারী আবেগ আছে। সেটা বিশেষ কিছু না। কিছু অশান্তকারী মনোভাব অন্যদের থেকে বেশী শক্তিশালী হতে পারে এবং তারা অনেক প্রকারের হতে পারে কিন্তু আমাদের সকলের এই আবেগপ্রবণ অসুবিধাগুলি আছে। আমরা এখানে এমন ব্যক্তির কথা বলছি না যে মনস্তাত্ত্বিকভাবে এবং গভীরভাবে আবেগপ্রবণ। আমরা তাদের সম্পর্কে বলছি যাদের অধিকাংশ মানুষ স্বাভাবিক বলে। কিন্তু বিপদটি হ’ল আমরা এটিকে স্বাভাবিক হিসাবে বিবেচনা করি যে, আমরা কখনও ক্রুদ্ধ হতে পারি, কখনও লোভী, স্বার্থপর এবং ঈর্ষাপরায়ণও হতে পারি। আমরা মনে করি এটা স্বাভাবিক এবং ঠিক। কিন্তু এটা ঠিক নয়, কারণ এটি আমাদের এবং অন্যদের জন্য সমস্যা তৈরী করে যাদের আমরা সহায়তা করার চেষ্টা করি।
আমাদের লক্ষ্য কেবল এটা নয় যে ক্রোধের সাথে কী করে বাঁচবো অথবা আমাদের মধ্যে যখন ক্রোধ মন্থন হয় তখন এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখব। আমাদের লক্ষ্য কেবল এটিকে দুর্বল করা নয় বরং এই সমস্ত অশান্তকারী মনোভাবগুলি থেকে পুরোপুরিভাবে মুক্ত হওয়া। আমরা কেবল কিছু সময়ের জন্য কিছুটা বোধশক্তি বিকশিত করতে চাই না, বরং বাস্তবতার সম্পূর্ণ বোধশক্তির বিকশিত করতে চাই। বোধশক্তিটা হ’ল এটা জানার জন্য যে, আমাদের অস্তিত্বের আধার কী, অন্যদের অস্তিত্বের আধার কী, বিশ্বের অস্তিত্বের আধার কী এবং আমরা চাই এমনকিছুর বোধশক্তি যেন সবসময় আমাদের মধ্যে থাকে। এটা সম্পূর্ণভাবে সম্ভব, কারণ মানসিক ক্রিয়াকলাপের স্বভাব মূলতঃ শুদ্ধ এবং তার মধ্যে সব ভালো গুণগুলিকে বিকশিত করার সমস্ত সম্ভাবনা রয়েছে।
বুদ্ধের প্রতীয়মান স্তরের ভালো গুণাবলী
আমরা যখন এমন বস্তুর কথা বলি যেটা নিরাপদ দিক অথবা শরণ-গমনকে নির্দেশ করে, তখন কিন্তু আমরা বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘ সম্পর্কেই কথা বলি। এই তিনটিকে বোঝার বিভিন্ন স্তর আছে। প্রত্যেকের একটি প্রতীয়মান ও একটি গভীরতম স্তর আছে এবং আছে আরও এমন কিছু যা তাদের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথমে প্রতিটির প্রতীয়মান স্তরের ভালো গুণগুলির দিকে নজর দেওয়া যাক—
বুদ্ধের শরীরে আসাধারণ শারীরিক গুণাবলী এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। উদাহরণস্বরূপ বুদ্ধরা মূহুর্তের মধ্যে কোথাও যেতে সক্ষম, নিজের শরীরকে একসাথে অসংখ্যরূপে নির্মাণ করতে পারেন, একইসময়ে সর্বত্র উপস্থিত থাকতে পারেন ইত্যাদি। এইসব একটু কাল্পনিক মনে হয়, এবং এটা বিশ্বাস করা এত সহজও নয়। এছাড়াও যখন বুদ্ধ কোনো উপদেশ দেন, প্রত্যেকে নিজের-নিজের ভাষায় বুঝতে পারেন এবং তারা যত দূরেই থাকুক না কেন, তারা বুদ্ধের বানী পরিষ্কারভাবে শুনতে পান। এর চেয়েও বড় কথা, বুদ্ধ হলেন সর্বপ্রেমী, সর্বজ্ঞ সত্ত্ব যিনি সকলকেই সমানভাবে ভালোবাসেন, এবং তিনি একই সময়ে সবকিছু বোধগম্য করতে পারেন আর বুঝতে পারেন।
এই বিবরণগুলিও খুবই কাল্পনিক এবং অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। সুতরাং যদি আমরা বুদ্ধদের সম্পর্কে এই স্তরে বিবেচনা করতে থাকি তাহলে সেখানে ভুল ধারণা জাগার একটা বিপদ ঘটতে পারে। এই বিবরণ থেকে মনে হয় যে আমরা কোনো কাল্পনিক জ্ঞানাতীত সত্ত্বের কথা বলছি, যিনি প্রায় একজন ঈশ্বরের মতো, তাই নয় কি? উদাহরণস্বরূপ, সর্বজ্ঞ বলার বিষয়টি এই নয় যে, বুদ্ধ এই গ্রহের সকলের টেলিফোন নাম্বার জানেন। এর অভিপ্রায় হল যে, বুদ্ধ প্রত্যেকের পরিস্থিতির মূল কারণগুলি জানেন এবং তাদের প্রভাবিত করার সমস্ত কারণগুলিও জানেন। যখন কোনো বুদ্ধ কাউকে কোনো শিক্ষা প্রদান করেন এই বোধের সাথে যে, এর পরিণাম কী হবে, কেবল সেই ব্যক্তির পরিণামই নয়, তাদের সবার পরিণাম যাদের সাথে এই ব্যক্তিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করবে। ফলস্বরূপ, বুদ্ধ প্রত্যেককে শিক্ষা প্রদান করার সঠিক পদ্ধতিটি জানেন। এটা বেশ ভালো কথা, তাই না? এটা করতে সক্ষম হওয়াটা খুব ভালো কথা।
আমাদের বিশ্বাস আছে যে বুদ্ধ হলেন জ্ঞানী এবং তিনি জানেন যে, আমাদের সহায়তা করার সবথেকে ভালো জিনিস কোনটি হতে পারে। বুদ্ধ আমার ভাষায় কথা বলেন এবং যখনই আমার দরকার হবে তখনই তিনি আমার সহায়তার জন্য উপস্থিত হতে পারেন। যদি আমরা বুদ্ধকে ঈশ্বর রূপে দেখতে থাকি, তাহলে এটা একটু ব্যক্তিগত হয়ে উঠবে— “তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করবেন। তিনি আমাকে বুঝবেন। কেউ আমাকে না বুঝলেও, বুদ্ধ কিন্তু বুঝবেন”। কিন্তু আমরা জানি যে বুদ্ধের মধ্যে সকলের প্রতি সমান ভালোবাসা আছে— “খুব ভালো। আরও ভালো হতো তিনি যদি সবার চেয়ে আমাকে বেশি ভালোবাসতেন। তবে এটাও ঠিক আছে”। একজন বুদ্ধের মধ্যে সকলের প্রতি সমান ভালোবাসা থাকে এবং সুখকর হল এটা যে, তার ভালোবাসা এটার দ্বারা প্রভাবিত নয় যে আমরা কি আচরণ করি। আমাদের বুদ্ধের কাছে প্রার্থণা করতে হবে না বা নৈবেদ্যও দিতে হবে না। বুদ্ধ আমাদের যেভাবেই হোক সাহায্য করবেন। এর জন্য এটা খুবই সহজলভ্য। আমাদের এর জন্য কোনো পারিশ্রমিকও দিতে হবে না। কী চুক্তি! এছাড়াও, বুদ্ধের অনেক ধৈর্য্য আছে। কারণ আমরা যদি অন্য কোনো পরম্পরার শিক্ষকের শরণে যাই, তখনও তিনি ঈর্ষা করতে যাবেন না; ক্রোধিত হয়ে আমাদের উপর বজ্রপাত করবেন না অথবা অন্য অপ্রিয় কিছু করবেন না, এটা খুবই নিরাপদ।
এটি সচেতনভাবেই হোক অথবা অসচেতনভাবে, এটা একটা সাধারণ ভুল। কারণ, আমরা বুদ্ধকে ঈশ্বরের কোনো প্রতিরূপে দেখি, আর ভাবি তার সাথে লাভজনক চুক্তি করা যায় যা সুরক্ষিত। শিক্ষাগুলিতে এরকম বলা আছে যে, বুদ্ধ কখনও আপনাকে নিরাশ করবেন না ইত্যাদি। এটা শুনতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু আমরা যখন পড়ি যে, বুদ্ধ আমাদের পা থেকে কাঁটা বের করার মতো আমাদের দুঃখকে সত্যিই নিবারণ করতে পারে না। বুদ্ধ সর্বশক্তিমান নন। কিন্তু আমরা এই বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব সহকারে এবং গম্ভীরভাবে দেখি না। এটা হল বুদ্ধের প্রতীয়মান স্তর, অর্থাৎ কোনো বুদ্ধের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সাধারণ উপায়। কিন্তু গভীর স্তরের বোধগম্যতা অর্জন না করে একে এই স্তরেই ছেড়ে দিলে এটা বিপদ ঘটায়। কেননা আমরা বুদ্ধকে কোনো ঈশ্বরের বৈকল্পিক রূপে দেখতে থাকি যিনি আমাদের রক্ষা করবেন।
বুদ্ধকে মূর্তি এবং চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়। ঠিক আছে তিনি সুদর্শন, কিন্তু আমরা কি এই কারণে তাকে গোঁড়া খ্রীষ্টানদের মূর্তির মতো ভেবে বিভ্রান্ত হব? এটা কী? আমরা কি মূর্তি পূজার কথা বলছি, যেমন মুসলমানরা দোষারোপ করে? আসলে এখানে কী চলছে? আমাদের কি সত্যিই কোনো মূর্তির সামনে মাথা নত করতে হবে? আমি মনে করি যে, আমরা যদি বুদ্ধের সম্পর্কে আমাদের বোধগম্যতা এই স্তরেই ছেড়ে দিই তাহলে এর থেকে সমস্যা উৎপন্ন হবে। এর কারণে বিভ্রান্তি উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিছু মানুষের জন্য বুদ্ধের সম্পর্কে এরকমভাবে ভাবা খুব লাভজনক হতে পারে, কিন্তু এটা গভীরতম বোধশক্তি নয়। এই স্তরে, এটা দেখে মনে হয় যেন, কোনো ঈশ্বরের মতো শক্তিকে মূর্তি এবং চিত্রের আকারে প্রদর্শিত করা হয়েছে এবং আমরা তার পূজা-অর্চনা করছি।
ধর্মের প্রতীয়মান স্তরের ভালো গুণাবলী
সমস্ত শিক্ষাগুলি হল ধর্মের প্রতীয়মান স্তর। বুদ্ধ এটি নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন এবং তিনি এগুলির সম্বন্ধেই শিক্ষা দিয়েছিলেন। এটাকে বোঝার সাধারণ উপায় হ’ল- আমাদের ব্যক্তিগত ঈশ্বর হলেন বুদ্ধ এবং আমাদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ আছে। কোনো বাইবেল অথবা কোরাণের পরিবর্তে এখন আমার কাছে আছে বৌদ্ধ গ্রন্থ। এটি আমার কাছে বৌদ্ধ বাইবেলের মতো এবং এর প্রতিটি শব্দই আমরা পবিত্র বলে গ্রহণ করি। হ্যাঁ, এটির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকা দরকার কিন্তু বুদ্ধ স্বয়ং বলেছিলেনঃ “আমি যা বলেছি সেটা শ্রদ্ধার কারণে বিশ্বাস করো না শুধু আমি বলেছি বলে, বরং আপনি আমার কথাকে এমনভাবে পরীক্ষা করুন যেমন আপনি সোনা কেনার সময় করে থাকেন”। বুদ্ধ সবসময় তার শিষ্যদের যা শিখিয়েছিলেন তার সমালোচনা করার জন্য উৎসাহিত করতেন। কিন্তু অলসতার কারণে আমরা সমস্ত কিছু বিশ্লেষণ করতে চাই না এবং পরীক্ষা করতে চাই না। দৈনন্দিন জীবনের নিরিখে, এই স্তরে এর প্রাসঙ্গিকতা হল যে, বুদ্ধ আমাদের ভালোবাসেন, বুদ্ধ আমাদের বোঝেন এবং তার দ্বারা নির্ধারিত সমস্ত নিয়ম পবিত্র গ্রন্থে দেওয়া আছে, আমরা সেটা অনুসরণ করি। অবশ্যই দৈনন্দিন জীবনে এর স্থান এবং গুরুত্ব আছে। কিন্তু বাস্তবে শুধু এটাই বৌদ্ধ ধর্ম নয়। এটা কিছু মানুষের কাজে লাগতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য এটা নয় যে বৌদ্ধ ধর্মকে খ্রীষ্টান মতেরই অন্য রূপ হিসাবে পরিণত করা।
সংঘের প্রতীয়মান স্তরের ভালো গুণাবলী
এবারে সংঘের মানে কী? দুর্ভাগ্যক্রমে পশ্চিমে আমরা এটাকে একটা অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছি যে, আমরা যে ধর্মকেন্দ্রে যাই, সেখানকার সব সদস্যদের আমরা নিজের “সংঘ” বলে সম্বোধিত করি। কিন্তু সংস্কৃত অথবা তিব্বতী ভাষায় এই শব্দের উদ্দেশ্য নিশ্চিতভাবে এটা নয়। তবে অনেক মানুষের কাছে, “সংঘ” বলতে কেবল আমাদের ধার্মিক সভা, নিজেদের বৌদ্ধ মঠের সদস্যদের বোঝায়। যখন এই সদস্যদের মধ্যে কিছু সদস্য যখন খুবই অশান্ত প্রকৃতির হয় তখন কি আমরা সত্যিই তাদের শরণ-গমন করব? এখন আমি বলতে চাই না যে, একই ধরণের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করা সমমনস্ক মানুষদের এমন কোনো আধ্যাত্মিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বকে হ্রাস করে দেওয়া হোক যারা আমাদের কোনো প্রকারের সহায়তা, কিছু রায় দিতে পারে ইত্যাদি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেটা শরণ-গমনের বিষয় নয়।
সংঘের অন্য স্তর হল- আমরা এটিকে মঠীয় সম্প্রদায় হিসাবে বুঝতে পারি, যেমন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীগণ। কিন্তু আমরা আবার এখানে নিখুঁত ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীর উদাহরণ খুঁজে পাই না, পাই কি? এখানে কিছু খুব অশান্ত মানুষ থাকেন যারা জাফরান বস্ত্র বা পীত বস্ত্র ধারণ করেন। তবুও যদি তারা মঠবাসী হয়ে নিজেদের উপর কাজ করার চেষ্টা করেন, তাহলে তাদের সম্মান এবং সমর্থন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিছু ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণী এমনও আছে যারা জীবনের অসুবিধা থেকে বাঁচতে এই বস্ত্র ধারণ করেন। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন যে, নিখরচায় দুপুরের খাবারের জন্য এরা ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীর বস্ত্র ধারণ করেন!
সংঘের আরও একটি স্তর আছে। তান্ত্রিক আচার্যদের থেকে আমরা জানতে পারি যে, সংঘ হ’ল আমাদের এই তথাকথিত “তান্ত্রিক দেব-দেবীগণ”, যেমন- অবলোকিতেশ্বর, তারা, মঞ্জুশ্রী ইত্যাদি। এখন আমরা পবিত্র মাতা বা সন্ত তারার প্রার্থনা করা শুরু করতে পারি এবং তিনি আমাদের রক্ষা করবেন। অবশ্যই এই বৌদ্ধ মূর্তিগুলি, যেমন আমি তাদের বলি এই তথাকথিত তান্ত্রিক দেব-দেবীগণ কোনোভাবেই এমন সন্ত নন যারা কোনো প্রকার মধ্যস্থতা করবেন এবং আমাদের ভগবান বুদ্ধের নিকটবর্তী হতে সাহায্য করবেন।
বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের গভীরতম অর্থ
যদি আমরা ধর্ম এবং সংঘের গূঢ়তম অর্থের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে আমরা আবিষ্কার করব যে, ধর্মের গূঢ়তম অর্থ হল আমাদের সমস্ত বিভ্রান্তির যথার্থ রোধ, সত্য উপলব্ধি, সত্য পথ অথবা মানসিক সন্ততির (ধারাবাহিকতার) পথ। এটাই হল আসল ধর্ম। যদি আমরা নিজস্ব মানসিক সন্ততি অর্জন করতে পারি তাহলে এটাই দুঃখ থেকে আমাদের রক্ষা করবে। আমরা নিজের বিভ্রান্তি, অশান্তকারী আবেগ, মনোভাব এবং সমস্যাগুলি থেকে মুক্তি প্রাপ্ত করে, এবং পূর্ণবোধ প্রাপ্ত করে এই অবস্থাকে প্রাপ্ত করতে পারি। বুদ্ধ হলেন তারা, যারা একে পূর্ণতঃ প্রাপ্ত করেছেন এবং আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা স্বয়ং এটাকে কীভাবে প্রাপ্ত করতে পারবো। সংঘ আসলে তাদেরকে বলা হয় যারা “আর্য সংঘ” হিসাবে খ্যাত। যারা হলেন অনেক উচ্চ সিদ্ধি প্রাপ্ত সাধক, যারা কিছুটা, পূর্ণতঃ নয়, দুঃখের যথার্থ রোধ প্রাপ্ত করেছেন এবং যথার্থ বোধশক্তি প্রাপ্ত করেছেন। বস্তুতঃ বিভ্রান্তির অনেকগুলি স্তর হয় যার থেকে আমাদের মুক্তি প্রাপ্ত করা আবশ্যক এবং বোধের উত্তরোত্তর রূপেরও কিছু স্তর আছে যা এই বিভ্রান্তিগুলিকে প্রতিকার করে। সেগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটি ধাপে-ধাপে হয়। আর্য সংঘ এখনও পর্যন্ত পূর্ণতঃ মুক্তির স্তর অর্জন করতে পারেননি, কিন্তু কিছুটা এর থেকে মুক্তি পেয়েছেন, এবং তারা আরও অর্জনের পথে আসীন হয়ে রয়েছেন।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বুদ্ধ এবং আর্য সংঘ, আমাদের এই প্রাচীন এবং বর্তমান সময়ের কিছু ভারতীয় এবং তিব্বতী আচার্যরা আমাদের অনেক প্রেরণা প্রদান করেন। এটি আমাদেরকে অনেক আশা প্রদান করে। আমরা পরম পূজ্য দালাই লামার মতো কোনো প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্বের দর্শন করার অথবা তাদের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাই। তারা নিজেদেরকে এমন করলেন কী করে? ধর্মের মাধ্যমে। এখানে এই কথাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, তারা বুদ্ধ কি না অথবা এখনও তারা বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত করেননি। যদি আমরা তাদের মতো হয়ে উঠতে পারতাম তাহলে সেটা খুব ভালো হতো। এখানে আমি কেবল তার যোগ্যতার কথা বলছি না যে তিনি ধর্ম সম্বন্ধীয় যেকোন বিষয়ের উপর উপদেশ দিতে পারেন, অথবা তিনি হলেন বিশেষজ্ঞ, সর্বাধিক জ্ঞানী অথবা শিক্ষকদের মধ্যে নিপুণ শিক্ষক। শুধু এটাই নয় যে তার ব্যস্ত কর্মসূচী, তিনি সারা বিশ্বে ভ্রমণ করেন, অন্যদের শিক্ষা প্রদান করেন এবং সহায়তা করার চেষ্টা করেন ইত্যাদি। এর থেকেও বড় কথা হল— তাকে চীন দেশে সবথেকে বড় জনশত্রু হিসাবে দেখা হয়। আপনি কি কল্পনা করতে পারবেন যে, এক বিলিয়ন-এর থেকেও বেশী মানুষ আপনাকে শয়তান মনে করে এবং আপনার সমুদায়ের মানুষদের সাথে সবরকম দুর্ব্যবহার করে, তাসত্ত্বেও আপনি যদি তাদের প্রতি মৈত্রী এবং করুণার ভাব রাখেন, তাহলে সেই পরিস্থিতিটা কেমন হবে? তিনি কখনও বিচলিত হন না, বরং সুখী, শান্ত চিত্তের মাধ্যমে নিজের সব কাজ করেন। এটা অবিশ্বাস্য, তাই নয় কি? যদি আমরা এই অশান্তকারী আবেগগুলি থেকে মুক্ত না হতে পারি এবং আমরা বোধশক্তি প্রাপ্ত না করতে পারি, তাহলে আমরা এতকিছু কেমন করে করতে পারব? এমন পরিস্থিতিতে এত কিছু করা সম্ভব নয়। এখানে এই প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক যে, তিনি বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি পর্যন্ত পৌঁছেছেন, না পৌঁছতে পারেননি।
হতে পারে যে আমরা বুদ্ধের সব গুণগুলি বুঝতে না পারি, কিন্তু আমরা কমপক্ষে পরম পূজ্য দালাই লামার মতো কারও গুণগুলিকে তো দেখতেই পারি। এটা সত্যিই অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক। যদি তার মতো কোনো ব্যক্তির জন্য এই স্তরের সিদ্ধি প্রাপ্ত করা সম্ভব হতে পারে, তাহলে এমন কোনো কারণ নেই যে, আমাদের মতো মানুষ সেই গুণগুলিকে বিকশিত করতে পারবে না। কারণ, সকলের চিত্তের স্বভাব তো শুদ্ধ এবং এই সমস্ত সম্ভাবনা যুক্ত। অতএব প্রত্যেককে এটি না করতে পারার কোনো কারণ নেই। স্পষ্টতঃ এর জন্য অনেক কঠিন পরিশ্রমের দরকার পড়ে, কিন্তু এরকম করা সম্ভব এবং ঐ দিকে অগ্রসর হওয়া খুবই উপযুক্ত। যদি দালাই লামাকে বুদ্ধের সদৃশ মেনে নেওয়া যায়, তাহলে কিছু বর্তমান মহান লামা যারা শিক্ষা প্রদান করেন, সম্ভবতঃ তাদের মধ্যে দালাই লামার সব গুণ থাকতে নাও পারে, কিন্তু তারা সংঘের সদৃশ, তাদের মধ্যেও এই ধরণের কয়েকটি গুণ রয়েছে, এটিও খুব অনুপ্রেরণাদায়ক।
দালাই লামা এবং এই মহান আচার্যদের মধ্যে কী মিল আছে? তারা বিভিন্ন স্তরের ক্রোধ, লোভ, ঘৃণা, ঈর্ষা এবং এই ধরণের সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন। তারা জ্ঞান, করুণা, ধৈর্য্য ইত্যাদির মতো অসাধারণ ভালো গুণ অর্জন করেছেন। আমরা বিভিন্ন লামাদের থেকে এটা বুঝতে পারি যে, এই গুণগুলিকে কীভাবে আলাদা-আলাদা স্তরে অর্জন করতে পারা যায়। আমি তো বলি যে, বুদ্ধ অথবা মিলারেপা এবং আরও অন্য ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তগুলি যাদের বোঝা আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত কঠিন, আমাদের জন্য এই মানুষগুলি (যদি আমরা তাদের সান্নিধ্য পেয়ে থাকি) বেশী জীবন্ত উদাহরণ হবে। আমাদের মনে হয় তাদের ব্যাপারে প্রচলিত গল্পগুলি খুব ভালো, কিন্তু আমরা কি এই কথা বিশ্বাস করি যে আদৌ তার মতো কোনো ব্যক্তি সত্যিই ছিল? আমরা পড়ি যে গুরু রিনপোছে (পদ্মসম্ভব) একটি পদ্ম থেকেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমরা কি এই কথাটি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারি? এটা বোঝা সত্যিই কঠিন। কিন্তু তার পরিবর্তে আমরা এই নেতিবাচক গুণের অভাব এবং এমন ইতিবাচক গুণের উপস্থিতির উপর আমাদের মনোনিবেশ করতে পারি যার উদাহরণ দালাই লামা এবং মহান আচার্যরা প্রস্তুত করেছেন। তারাই এইসময় আমাদের জন্য বুদ্ধ এবং সংঘ সদৃশ্য। আমরা বুঝতে পারি যে আমরা এটি করতেও সক্ষম, এটিই ধর্ম এবং চিত্তের এই সত্য নিবর্তন আর সত্য পথ হল এমন লক্ষ্য যা প্রাপ্ত করা সম্ভব। এটাকে করা সম্ভব এবং এটা আমাদের একটা সুরক্ষিত, স্থির এবং অর্থবহ দিক প্রদান করে যাকে আমরা নিজের জীবনে যোগ করতে পারি।
শরণ অথবা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সুরক্ষিত দিক
ব্যবহারিক স্তরে, বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের দিক-নির্দেশকে নিজের জীবনে যোগ করার অর্থ কী? এর অর্থ হল- আমরা সর্বদা নিজের উপর কাজ করে যাচ্ছি। উদাহরণস্বরূপ, এরকম করার সময় যদি আমরা বিচলিত হয়ে যাই, ক্রোধিত হয়ে যাই অথবা স্বার্থপরের মতো আচরণ করি, তখন আমরা সেই সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হয়ে উঠি। আমরা এটা লক্ষ্য করি, এটা এমন নয় যে, যদি এমন পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের জন্যই দুঃখী হয়ে পড়ি, তাহলে আমরা এটা ভেবে নিজেদেরকে দন্ড দিই যে, “আমি খুব খারাপ অথবা আমি খুব ভয়ঙ্কর। কারণ আমি এখনও ক্রোধিত হয়ে যাই”। অবশ্যই এটা নয়, এবং নিশ্চিতভাবে এমনও নয় যে অন্যদিকে আমরা এটা ভাবতে থাকি যে এগুলি সব সাধারণ বিষয়। সেক্ষেত্রে আমরা কেবল এটা লক্ষ্য করি এবং ভাবি “তাহলে কী আমি সারাক্ষণ এরকমই থাকব”। কোনও পরিস্থিতিই নয়। এমনকি আমাদের নেতিবাচক আবেগগুলির প্রতি সচেতন হয়ে যাওয়া থেকে এবং তার থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা থাকলেই এর শক্তি কমে যায়।
তবে মূল বক্তব্যটি হ’ল, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যখন এই অশান্তকারী নেতিবাচক আবেগ উৎপন্ন হয় এবং আমরা সেগুলি লক্ষ্য করি, ঐ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে আদর্শ জিনিস হ’ল, কিছু পদ্ধতি শিখে এবং সেগুলিকে অতিক্রম করার চেষ্টা করা। আমাদের বুঝতে হবে যে, যদি আমরা ক্রোধিত হয়ে যাই তাহলে ঐ পরিস্থিতিতে আমাদের বিকশিত করতে হবে ধৈর্য্য। যদি কোনো ব্যক্তি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে, তাহলে এর মানে হ’ল ঐ ব্যক্তি খুব দুঃখী, কোনো কিছু তাকে অশান্ত করে রেখেছে। এমন ব্যক্তির উপর ক্রোধিত না হয়ে তার প্রতি কিছুটা করুণা ভাব রাখা দরকার।
স্পষ্ট করে বলতে গেলে, আমরা একদিক থেকে, আমরা ক্রোধিত হওয়ার জন্য নিজের উপর ক্রোধিত হই না। অন্যদিকে, আমরা নিজেদেরকে কোনো শিশু ভেবে এটা বলি না যে ‘ঠিক আছে’ অথবা ‘আচ্ছা বেশ’। কিন্তু, আমরা আমাদের ক্রোধকে দমন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব, কারণ আমরা বুঝতে পারি যে এটা করা সম্ভব। তবে হতে পারে আমরা তাড়াতাড়ি এর থেকে মুক্তি পাব না, কিন্তু এটাই হল সেই দিক যে রাস্তায় সারা জীবন চলার জন্য আমাদের প্রয়াস করতে হবে। আমরা এটা এই জন্য করব কারণ আমরা জানি যে বাস্তবে এই মনোবৃত্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এই দিকে এগোনোর জন্য এটা কোনো নিষ্ফল আদর্শবাদী প্রয়াস নয়।
যখন আমরা কোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, এবং ঐ সময় আমরা যদি কিছুটা ধৈর্য্য রাখতে পারি, বুঝতে পারি, অথবা কিছুটা উদারতা রাখতে পারি, তখন আমাদের বুঝতে হবে যে এটা এমন কিছু যার বৃদ্ধি হতে পারে। আমরা এটিকে আরও শক্তিশালী করতে পারি। এরকম করা সম্ভব। অন্যরা এটা করে দেখিয়েছে, এবং আমরাও এটা করতে পারি। অন্যরাও বিশেষ কিছু নয় এবং আমরাও বিশেষ কিছু নই। এটাই আমাদের শরণ, এটাই আমাদের জীবনের সুরক্ষিত দিক, কারণ আমরা এই দিকে যত বেশী গমন করব, তত বেশী আমরা আমাদের সমস্যা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করতে পারব।
সারাংশ
আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, শরণ, এই সুরক্ষিত দিকের অর্থ কী? এবং এটা আমাদের জীবনে রাখার কারণগুলি কী? বৌদ্ধ সাধনায় এটাকে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবথেকে মৌলিক বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অনেক মানুষ এটিকে তুচ্ছ করে দেখায়, যা সত্যিই লজ্জাজনক। আমাদের জীবনে এই দিকটা থাকা বা না থাকাকে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বলে মনে করা হয়, এবং এটাই আমাদের জীবনে সবথেকে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। শরণ-এর মানে কেবল এটাই হওয়া নয় যে, আমরা কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম এবং সেখানে আমাদের একটু চুল কাটলাম, একটি তিব্বতী নাম রেখে নিলাম, এবং গলায় একটা লাল সুতো ধারণ করে একটি সমুদায়ে যোগ দিলাম। এটি সত্যিই পুরো বিষয়টিকে তুচ্ছ করে দিয়ে একদম নিরর্থক বানিয়ে দেয়।
আমাদের সবাইকে নিজেদেরকে এই প্রশ্নটি করতে হবেঃ “শরণ-গমন নেওয়ার সাথে-সাথে বৌদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমরা কি সত্যিই আমাদের জীবনকে এই দিকে নিয়ে যাচ্ছি? কেবল একটি সমুদায়-এর সদস্যতা নেওয়া ছাড়া জীবনে এর কি আর কোনো তাৎপর্য আছে?” যদি শরণ-গমন আমাদের জীবনে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য না এনে থাকে, তাহলে এটি এমন একটা বিষয় যার উপর সত্যিই আমাদের কাজ করা উচিত। এই আধারভূত বিষয়কে অনুসরণ না করে অন্য কোনও উন্নত সাধনাগুলিকে অনুসরণ করে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।