পুনঃমূল্যায়ন
আমরা পরম পূজ্য দালাই লামা দ্বারা রচিত শ্লোকের উপর আমাদের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এই শ্লোকটি ব্যাখ্যা করে যে, আমরা কীভাবে দুটি সত্যের বোধগম্যতা থেকে চার আর্যসত্যের বোধগম্যতা এবং ত্রিরত্নের প্রতি আস্থা রাখার দিকে অগ্রসর হতে পারি। আমরা দেখেছি যে, এই দুটি সত্য আলোচনা করে যে কীভাবে বস্তুগুলি প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্বে রয়েছেঃ
- আপেক্ষিক বা সংবৃতি সত্য- আসলে আমাদের সম্মুখে যা কিছু উপস্থিত হয় সেটা হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর নির্ভরশীল ভাবে উত্থাপিত হয়। আমরা যদি দেখে থাকতাম যে কীভাবে বস্তুগুলি প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্বে কাজ করে তাহলে আমরা এটা দেখতে চাইতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, আমরা সাধারণতঃ বস্তুগুলিকে এইভাবে দেখি না।
- সত্যের গভীরতম স্তর- সত্যের গভীরতম স্তরে বস্তু অসম্ভব উপায়ে অস্তিত্বে নেই যা আমাদের বিভ্রান্তি তাদের উপর অভিক্ষেপ করে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা মনে করি যে, বস্তু তাদের নিজস্ব শক্তির কারণে উত্থিত হয় আর এটা ঠিক তেমনই মনে হয় যখন আমরা সেগুলিকে দেখি এবং দেখে মনে হয় যেন সেটা কোনও হেতু, প্রত্যয়, অংশ বা অন্য কিছু ব্যতীত স্বাধীনভাবে উত্থিত, কিন্তু আসলে এটা মিথ্যা।
সুতরাং এটা হ’ল আধার
চার আর্যসত্য বাস্তবতাকে সঠিকভাবে পরিবেষ্টিত ক’রে দেখার বিভ্রান্তি সম্পর্কে বর্ণনা করে। আমরা যখন বাস্তবতা সম্পর্কে বিভ্রান্ত হই, তখন এটা দুঃখের কারণ হিসাবে কাজ করে অর্থাৎ কারণরূপী দ্বিতীয় আর্যসত্য এবং স্বয়ং দুঃখরূপী প্রথম আর্যসত্য। অন্যদিকে, আমরা যদি বাস্তবতাকে সঠিকভাবে দেখি এবং সর্বদা এটাতে মনোনিবেশ করি, তাহলে আমরা তখন দুঃখের সত্য নিরোধরূপী তৃতীয় আর্যসত্যকে পাই। বোধগম্যতা হ’ল সত্য পথ অর্থাৎ চতুর্থ আর্যসত্য যা সত্যিকারের নিবৃতি নিয়ে আসে।
আমরা যখন বাস্তবতা সম্পর্কে অস্পষ্ট থাকি, তখন আমরা অসচেতনতা এবং বিভ্রান্তির ভিত্তিতে কাজ করি। ফলে আমরা আমাদের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্তিকে স্থায়ী করি। আমরা যদি নিজেকে এই অসচেতনতা থেকে মুক্ত করি, তাহলে আমরা সাংসারিক পুনর্জন্মকে প্রতিরোধ করতে পারি বা সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।
ত্রিরত্ন
এবার আমরা শ্লোকটির তৃতীয় লাইনের দিকে নজর দেবঃ
‘ত্রিরত্ন সত্য’, এটা প্রমাণের কারণে উত্থাপিত হওয়ার পর আমাদের বিশ্বাস দৃঢ় হয়।
আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি যে, ত্রিরত্ন বলতে বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘকে বোঝায়। এগুলি হ’ল সংস্কৃত শব্দ। শাক্যমুনি বুদ্ধ এবং অন্যান্য বুদ্ধরা হলেন তাঁরা যাঁরা বোধিলাভ করেছেন এবং আমাদের শিক্ষাপ্রদান করেন যে, কীভাবে তাদের মতো হওয়া যায়। ধর্ম হ’ল তাদের শিক্ষা। সংঘ হ’ল অত্যন্ত উপলব্ধি করা সমুদয়। এটা বোধগম্যতার একটা স্তর কিন্তু সেগুলির আরও গভীরতর স্তর আছে।
গভীরতর অর্থের ক্ষেত্রে, ধর্ম আসলে প্রাপ্তিকে বোঝায় অর্থাৎ তৃতীয় এবং চতুর্থ আর্যসত্যের প্রাপ্তি। আপনারা সকলে মনে রাখবেন, তৃতীয়টা হ’ল দুঃখ এবং দুঃখের কারণের সত্য নিরোধ এবং সেটা পর্যায়ক্রমে ঘটে। আমরা যখন সেটাকে পরিপূর্ণভাবে প্রাপ্ত করি, তখন আমরা অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম (সংসার) থেকে মুক্তি লাভ করি। যখন আমরা নিজেদেরকে সেই কারণগুলি থেকে মুক্ত রাখি যা আমাদের হেতু এবং ফলের বিবরণ জানতে বাধা দেয়, যাতে আমরা সর্বোত্তমভাবে অবগত হয়ে যায় যে, সবাইকে কীভাবে মুক্তির দিকে নিয়ে যেতে হয়, আমরা বোধিলাভ করা বুদ্ধ হয়ে উঠি। চতুর্থ সত্য হ’ল বোধগম্যতা যা আমাদের নিরোধ প্রাপ্ত করায় এবং সেটা নিরোধ থেকে ফলিভূত হয়।
এই দুটি একটি শরণ গঠন করে। শরণ হ’ল এমন একটা জিনিস যা আমাদের এই ক্ষেত্রে দুঃখ থেকে রক্ষা করে এবং অপরকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে আমাদের অভাব থেকে রক্ষা করে।আমরা যদি সত্য নিরোধ এবং মনের সত্য পথকে অর্জন করি, তাহলে আমরা নিজেদেরকে দুঃখ ভোগ করা থেকে এবং অপরকে সর্বোত্তমভাবে সহায়তা করার অক্ষমতা থেকে রক্ষা করতে পারি। এটা এমন কিছু নয় যে অন্য কেউ এটা অর্জন করেছে এবং আমরা শুধু তাদের কাছে নিজেদের বিশ্বাস স্থাপন (সুপুর্দ) করি আর আমরা কোনপ্রকারে যাদুকরীভাবে রক্ষা পাব।
তথাকথিত “আব্রাহামিক” ধর্ম, যেমন- ইহুদী, খ্রিষ্টান এবং ইসলাম, এগুলি ইতিহাস ভিত্তিক ধর্ম হিসাবে পরিচিত। প্রত্যেকটা ধর্মেরই একটা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব আছে। ঐতিহাসিক ঘটনায় ঈশ্বরের কাছ থেকে এরকম প্রত্যাদেশ ছিল। তারা তখন এই সত্য প্রকাশ করেছিল এবং সেটাই চূড়ান্ত। মোশি, যীশু বা মহমুদ যা করেছিলেন তা আমরা করতে পারি না, আমাদের শুধু তাদের প্রতি বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের দুঃখ থেকে রক্ষা পাব। এখানে বিশ্বাস বলতে ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানগুলির প্রতি বিশ্বাস বা তারা যা উপদেশ দিয়েছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন তার প্রতি বিশ্বাসকে বোঝায়, যেমন- ঈশ্বর দ্বারা মোশাকে প্রদত্ত এই ঐতিহাসিক ঘটনারূপী দশটি আজ্ঞা, যীশু দ্বারা প্রকাশিত নিউ টেস্টামেন্ট বা মহম্মদ দ্বারা প্রকাশিত কোরান। এই উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি উক্ত ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং জৈনধর্মের মতো ভারতীয় ধর্মগুলিকে “ধর্মীয় ধর্ম” বলা যেতে পারে, যা সম্পূর্ণ আলাদা। বুদ্ধ, কৃষ্ণ বা মহাবীর (জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা)-এর ঐতিহাসিক ঘটনা কেন্দ্রীয় ঘটনা নয়। এর পরিবর্তে, আমরা নিজেরাই এবং অন্য প্রত্যেকেও এই সত্ত্বগুলির মতো একই অবস্থা লাভ করতে পারি। বৌদ্ধ প্রসঙ্গে, আমরা সকলেই মুক্তি ও বোধিলাভ করতে পারি। অন্যান্য ধর্মগুলিও তাদের নিজস্ব স্বাধীনতার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে। এটা আমাদের পাশ্চাত্য আব্রাহামিক ধর্ম এবং ভারতীয় ধর্মগুলির মধ্যে অন্যতম মৌলিক পার্থক্য।
আমরা যখন তিনটি শরণের দিকে নজর দিই তখন আমাদের আব্রাহামিক ধর্মগুলির প্রক্ষেপণের মাধ্যমে তাদের দিকে নজর না দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যাদের সাথে আমরা বড় হয়েছি। এটা শুধু বুদ্ধই নয় যিনি একমাত্র বোধিলাভ করেছিলেন এবং তাই আমরা যদি তাঁর প্রতি বিশ্বাস করি তাহলে আমরা রক্ষা পাব। তাই সাধারণতঃ আমি “শরণ” শব্দটি এড়িয়ে চলি, কারণ এটা একটা নিষ্ক্রিয় স্বাদ প্রদান করে, এমন যেন আমাদের যা করতে হয় সেটা হ’ল, “বুদ্ধ আমায় রক্ষা কর” এবং আমরা রক্ষা পেয়ে গেলাম। এটা বৌদ্ধধর্ম নয়। আমি “নিরাপদ দিক নির্দেশ” শব্দটি ব্যবহার করতে পছন্দ করি যেখানে বুদ্ধ, ধর্ম এবং আমাদেরকে একটা নিরাপদ দিকে যেতে নির্দেশ করে। সেখানে বুদ্ধ নিজের জন্য যা লাভ করেছিলেন সেটা আমরাও লাভ করতে পারি। যদিও বুদ্ধ আমাদের নিজের রক্ষার জন্য একটা উপায় শিখিয়েছিলেন, কিন্তু স্বয়ং আমাদেরকে এটা অনুশীলন করতে হবে। এটা হ’ল আমাদের নিজস্ব প্রাপ্তির জন্য নির্ধারিত আমাদের নিজস্ব প্রচেষ্টা যা আমাদেরকে দুঃখ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে।
ধর্মরত্ন
আমরা যখন গভীরতম ধর্ম-রত্ন সম্পর্কে কথা বলি, আপনি তখন এটাকে বলতে চান যে, এটা এমন কিছু যা হ’ল দুর্লভ এবং মূল্যবান। এটা হ’ল দুটি শব্দের আভিধানিক অর্থ যেটাকে তিব্বতীরা এখানে ‘মণি’ রূপে অনুবাদ করেছে। আমরা নিরোধসত্যের প্রকৃত অবস্থা এবং মনের সত্য পথের উপলব্ধি সম্পর্কে কথা বলছি যা সেগুলিকে সেখান থেকে সংঘটিত ক’রে এবং ফল প্রদান করে। এগুলি আমাদের নিজেদেরকে প্রাপ্ত করতে হয়। এইজন্য আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে, সেগুলি প্রাপ্ত করা যায়। দুটি সত্য এবং চার আর্যসত্য সম্পর্কে আলোচনা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, সেখানে মুক্তি এবং বোধির মতো জিনিস আছে এবং আমরা সেগুলি নিজেরাই প্রাপ্ত করতে পারি।
বুদ্ধ-রত্ন
বুদ্ধ হলেন তাঁরা যাঁরা মুক্তিলাভ করেছেন এবং সম্বোধি লাভ করেছেন। এর মধ্যে শুধু শাক্যমুনি বুদ্ধ অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং অনেক অন্যান্য বুদ্ধরাও অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছেন। তাঁরা সেই উপায়টি শিখিয়েছেন এবং নির্দেশিত করেছেন যে, আমরা নিজেরাই ঐ অবস্থা প্রাপ্ত করতে পারি। তাঁরা তাদের বোধগম্যতা এবং উপলব্ধির ভিত্তিতে তাদের উপদেশ বা শিক্ষা এবং উদাহরণের মাধ্যমে আমাদের দুটি পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এটা প্রমাণ করে যে, আমরা শুধু বাচিক উপদেশের মাধ্যমে অপরকে শিক্ষা অর্জন করাতে পারি না, বরং আমরা যা কিছু উপদেশ দিচ্ছি তাঁর একটা জীবন্ত উদাহরণের মাধ্যমেও। ধর্ম কোনও বিমূর্ত শিক্ষা নয়, বরং এমন একটা জিনিস যা মানুষ এবং আমরা সত্যিই অঙ্গীভূত করতে পারি।
সংঘ রত্ন
কিছু লোক ভাবতে পারে, আমাদের আর্য সংঘরূপী এই তৃতীয় রত্নের প্রয়োজন হয় কেন? সত্যিই তো, বুদ্ধ এবং ধর্ম কি যথেষ্ট নয়? যদিও ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণীরা সংঘকে প্রতিনিধিত্ব করেন, তবে আসল সংঘ-রত্ন এটা নয়। মূর্তি এবং চিত্রগুলি যেমন বুদ্ধকে উপস্থাপন করে এবং গ্রন্থ ধর্মকে প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু সেগুলি হ’ল উপস্থাপনা মাত্র। যেমন কোনকিছু বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘকে প্রতিনিধিত্ব করে, ঠিক তেমনই এই মূর্তি, গ্রন্থ এবং ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরা আমাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য মনোনিবেশ প্রদান করে, কারণ বেশী বিমূর্ত জিনিসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সহজ নয়। এগুলির অবশ্যই একটা গভীর অর্থ আছে।
সংঘ রত্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংঘ বলতে আর্য পুরুষদের বোঝায় যাঁরা নির্বিকল্পিতভাবে দুটি সত্যের আধারে চারটি সত্যকে বুঝেছেন। যেহেতু তাঁরা এগুলিকে নির্বিকল্পিতভাবে উপলব্ধি করেছেন, সুতরাং তাঁরা নিরোধসত্য এবং মনের সত্য মার্গের কিছু অংশ অর্জন করেছেন, পুরো অংশ নয়। আরও উন্নত আর্যগণ যতক্ষণ পর্যন্ত অবশেষে মুক্তি লাভ না করে এবং শেষ পর্যন্ত বুদ্ধত্ব লাভ না করে তাঁরা উভয়ক্ষেত্রে আরও বেশী অংশ লাভ করতে থাকে। নোবেল সত্যকে আর্যসত্য রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয় অর্থাৎ আর্য বলতে তাদেরকে বোঝায় যাঁরা বাস্তবতার নির্বিকল্পিত জ্ঞান ধারণ করেন বা সত্য রূপে দেখেন। এটা আমাদের বলে যেঃ
- এগুলি শুধু বুদ্ধরাই নয় যাঁরা এই সমস্ত কিছু উপলব্ধি করেন এবং নিরোধসত্য ও মনের সত্য মার্গ অর্জন করেন, বরং এটা হল একটা ক্রমাগত প্রক্রিয়া।
- এমনকি মুক্তি বা বোধিলাভের পূর্বেও আমরা দুঃখসত্যের বিভিন্ন দিক থেকে মুক্তি পেতে শুরু করি, কেননা আমরা তাদের বিভিন্ন সত্য কারণ থেকে মুক্ত হতে থাকি।
মুক্তি এবং বোধি ক্রমাগত প্রক্রিয়া, যা আমরা বুদ্ধ বা একটা মুক্ত সত্ত্ব হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়। প্রায়শই বুদ্ধের তুলনা আর্যদের সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করা সহজ, কারণ তাদের এখনও কিছু সমস্যা আছে, আর তাদের মধ্যে কিছু এখনও অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম থেকে মুক্ত হয়নি। তারা আংশিকভাবে তার থেকে মুক্ত হয়েছে। এইভাবে তাদের সাথে সম্বন্ধস্থাপন করা কিছুটা সহজ।
আর্য সংঘ উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা প্রদান করে যে, আমরা যদি ধাপে-ধাপে নিরাপদ দিকে এগিয়ে যাই, যেমনটি তারা করেছেন, তাহলে আমরাও মুক্তি ও বোধির মতো চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি। এমনকি আমরা যদি সমস্ত পথ অতিক্রম নাও করতে পারি তাহলে আমরা আপাতত নিজেদের কিছুটা পরিমাপের দুঃখ থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হব, কারণ আমরা নিজেদেরকে কিছুটা অসচেতনতা থেকে মুক্ত রাখতে পারব যা দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা হ’ল শুধু একটা বিষয় যে, আমরা কতটুকু বাস্তবতার উপর সম্পূর্ণ রূপে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকতে পারি। আপনি যদি এখনও একজন আর্য হন তাহলে আপনি সর্বক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকতে পারবেন না, তবে আপনি পারবেন যদি আপনি একজন বুদ্ধ হন।
মুক্তি এবং বোধি বা বুদ্ধত্ব এক নয়। মুক্তি হ’ল আমরা যখন অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম থেকে মুক্ত হই সেই অবস্থা। এর অর্থ হ’ল আমরা যখন অর্হত অর্থাৎ মুক্ত সত্ত্ব হয়ে যাই। বোধি হ’ল আমরা যখন শুধু আবেগপূর্ণ আবরণ থেকে নয় অর্থাৎ বিরক্তিকর আবেগ এবং আমরা কীভাবে অস্তিত্বে আছি সেই বিষয়ে অসচেতনতা থেকে নয় বরং আমরা জ্ঞেয় আবরণ অর্থাৎ অসচেতনতার অবিচ্ছিন্ন অভ্যাস থেকেও মুক্ত হয়ে যাই।
অন্য কথায়, যা অসম্ভব তার অভিক্ষেপগুলির প্রতি বিশ্বাস করার অভ্যাসের কারণে আমাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপ অবিরত অভিক্ষেপ করতে থাকে আর আমরা অবিরত বিশ্বাস করে চলি যে, বাস্তবতার সাথে তাদের সামঞ্জস্য আছে। এর থেকে আমাদের বিরক্তিকর আবেগ জন্ম নেয়। আমরা যখন বিশ্বাস করা বন্ধ করে দিই যে, এই ভ্রান্ত আভাসগুলির সাথে বাস্তবতার সামঞ্জস্য আছে তখন আমরা মুক্তি লাভ করি। আমরা বুঝতে পারি যে, এসব কিছু হ’ল আবর্জনা। যদিও বস্তু ঐ রূপে আভাসিত হতে পারে, তবে বাস্তবে সেগুলি ঐরকম হয় না। আমাদের জ্ঞান বা ধারণা তখনও সীমাবদ্ধ থাকে এবং বস্তুকে বাক্সে বিদ্যমান রূপে দেখার প্রবণতা দেখায় এবং সেটা নিজের থেকে, কিন্তু আমরা জানব যে, সেগুলি আসলে সেইভাবে নেই যেভাবে সেগুলি বাস্তবে বিদ্যমান আছে।
এমনকি পারমাণবিক পদার্থজ্ঞানের একটি খুব সাধারণ স্তরে, আমাদের কাছে আছে পরমাণু এবং শক্তি ক্ষেত্র ইত্যাদি, কিন্তু সেখানে বিষয়ের আশে-পাশে কোনও সুদৃঢ় রেখা নেই, যা বর্ণনা করে, “রেখাটির এই দিকে বস্তুটি রয়েছে, রেখাটির ঐদিকে নেই।” বস্তুগুলি যেভাবে আভাসিত হয় সেরকম মূর্ত নয়। আমরা যদি জ্ঞেয় আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে যাই যা আমাদের এই ভ্রান্ত আভাসগুলির জন্ম দেয়, তাহলে মন তখন সেগুলিকে অভিক্ষেপ করা বন্ধ করে দেয় আর আমরা তখন বোধি লাভ করি। আমরা যখন বোধি লাভ করি, তখন আমরা প্রত্যেক বস্তুর আন্তঃসংযোগকে দেখি। এই দর্শন আমাদের অপরকে তাদের নিজস্ব মুক্তি এবং বুদ্ধত্ব লাভের দিকে পরিচালনা করার সবচেয়ে কুশল উপায়কে দেখতে সক্ষম করে তোলে।
আমরা যখন আর্যদের কথা বলি তখন আমরা শুধু বোধিসত্ত্ব আর্যদের কথা বলি না যারা বুদ্ধত্ব লাভ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকে। ঐ সময় আমরা সেসব আর্যদের কথাও বলি যারা শুধুমাত্র মুক্তি লাভের লক্ষ্য রাখে। আমরা যখন নিরাপদ দিকনির্দেশনার প্রসঙ্গে ত্রি-রত্নের কথা বলি তখন আমরা তাদের সম্পর্কে বলি যারা শুধুমাত্র মুক্তির লক্ষ্য রাখে অথবা মুক্তি এবং বুদ্ধত্ব উভয়ের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করে, কেবল সেই বোধিসত্ত্বদের সম্পর্কে কথা বলি না যারা শুধুমাত্র বুদ্ধত্ব লাভের লক্ষ্য রাখে।
ত্রিরত্নের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের বিকাশ
আমরা যদি দুটি সত্য এবং চারটি সত্যকে বুঝতে পারি তাহলে আমরা অবগত হব যে, আমরা কীভাবে সংসারে আটকে থাকি এবং কীভাবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। ফলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বস্ত হয়ে উঠি যে, গভীরতম ধর্মরত্নটি বাস্তবে অস্তিমান এবং এটা সত্য। আমরা খুবই পরিষ্কার ভাব বুঝতে পারি যে, বিভ্রান্তিই ভ্রান্ত আভাসগুলিকে জন্ম দেয়, যা একেবারে অসম্ভব, অতএব সেগুলি আমাদের চিত্ত-সন্ততি সহজাত বৈশিষ্ট নয়। কেন? কারণ, আমরা যখন অসচেতনতার সঠিক বিপরীতে মনোনিবেশ করি আমরা এর থেকে মুক্ত হতে পারি।
অন্য কথায়, আপনি যখন বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে দুটি সত্যের সচেতনতার উপর মনোনিবেশ করেন তখন আপনার মধ্যে ভ্রান্ত আভাস থাকে না। ফলে আপনি অবশ্যই এগুলিতে বিশ্বাস করেন না। আপনি যদি মার্গ সত্যরূপী এই সচেতনতার উপর পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারেন তাহলে আপনি নিরোধসত্যকে প্রাপ্ত করতে পারবেন, আর এটা যুক্তি দ্বারা সমর্থিত। আপনি সংক্ষিপ্ত করতে পারেন যে, এটা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটা এই ফল উৎপাদন করে। আপনার মধ্যে অসুখীতার দুঃখ এবং সাধারণ সুখের আর উত্থান-পতন হবে না এবং আপনার আর অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মও থাকবে না।
আপনি আপত্তি জানাতে পারেন এবং বলতে পারেন, “বেশ, আপনি যদি সারাক্ষণ অসচেতনতার উপর মনোনিবেশ করে থাকেন, তাহলে আপনার মধ্যে বোধগম্যতা বা সচেতনতা থাকতে পারে না।” তাহলে কোনটা বেশী শক্তিশালী হবে- অসচেতনতার উপর মনোনিবেশ করা যা বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, না সচেতনতার উপর মনোনিবেশ করা যা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রাখে?
আমরা যদি এটার বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, অসচেতনতাকে সমর্থন করার বাস্তবিক কিছু নেই, যদিও যুক্তি সম্যক্ বোধগম্যতাকে সমর্থন করে। হেতু এবং প্রত্যয় থেকে বস্তুর উৎপত্তি হয় এবং তাই তারা কেবল নিজস্ব শক্তির কারণে অস্তিত্ব লাভ করে না। এছাড়াও, আমরা যদি সারাক্ষণ সম্যক্ বোধগম্যতার সাথে মনোনিবেশ স্থাপন করে থাকি, তাহলে এটা ফল উৎপাদন করে অর্থাৎ আমরা আর দুঃখ বা সাংসারিক পুনর্জন্ম অনুভব করি না।
এটা আমাদেরকে আবার চার আর্যসত্যের দিকে নিয়ে যায়। আমরা কী লক্ষ্য নির্ধারণ করছি? আমরা কি চিরকাল দুঃখ ভোগ করতে চাই? আমরা যদি এটা করি তাহলে আমরা অসচেতনতার উপর মনোনিবেশ করি। ফলে আমরা দুঃখ ভোগ করব। একদম সহজ হিসাব। আপনি এর জন্য স্বাগত। কিন্তু আপনি যদি এ সবকিছু থেকে মুক্ত হতে চান, যা হ’ল বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক পথের লক্ষ্য, তাহলে এটা পুরোপুরি স্পষ্ট যে, আপনাকে বাস্তবতার ভিত্তিতে সচেতনতার সাথে মনোনিবেশিত হতে হবে।
“শরণ”-এর বিষয়টিতে পৌঁছনোর এই উপায়টি বৈধ জ্ঞান দ্বারা নির্ধারণ করা হয়। ফলে আমাদের বিশ্বাস যে, “ত্রি-শরণ সত্য” সেটা দৃঢ় হয়। আমরা আর অনুমান বা আশা করি না যে, আমরা যদি এই দিকে যাই তাহলে আমরা দুঃখ থেকে মুক্ত হব, কারণ আমাদের মধ্যে শ্রদ্ধা বা আস্থা থাকে যে, “আমাদের শাস্তা এটা বলেছেন।” এটা বৈধ জ্ঞান-ভিত্তিক, যা অনুমান-বোধগম্যতা এবং যুক্তির উপর আধারিত।
প্রমাণ বা বৈধ জ্ঞান থাকার দুটি উপায় আছে, যথা- অনুমান প্রমাণ এবং প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এখানে প্রত্যক্ষ বলতে নির্বিকল্পিতভাবে নিজে দেখা, শোনা বা অনুভব করার মতো বোধগম্যতাকে বোঝায়। এদের মধ্যে দ্বিতীয়টা নিয়ে যে সমস্যা হয় সেটা হ’ল এটাকে স্বয়ং অনুভব করার জন্য আপনাকে খুব, খুব উন্নত হতে হবে। অতএব আপনার প্রমাণ বা বৈধ জ্ঞানের জন্য আধার হিসাবে আপনাকে অনুমান দিয়ে শুরু করতে হবে।
আধ্যাত্মিক পথে অগ্রগতি
এবার আমাদের কাছে আছে চতুর্থ লাইনটিঃ
আমাকে মনের পথের এই মূলটি রোপন করতে অনুপ্রাণিত করুন যা মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।
আমরা যখন মুক্তির পথে চলার মন নিয়ে কথা বলি, তখন এটাকে বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করা যায়। এর মধ্যে একটা হ’ল অনুপ্রেরণার তিনটি লক্ষ্য, যা সাধারণতঃ তিব্বতী শব্দ মার্গক্রম (লাম-রিম) নামে পরিচিত। এই মার্গক্রমগুলি হ’ল প্রগতিশীল লক্ষ্য-
- প্রথম লক্ষ্যটি হ’ল খারাপ পুনর্জন্ম ত্যাগ করা এবং আরও ভাল পুনর্জন্ম লাভ করা। আমরা কম দুঃখ সহ আরও ভাল পুনর্জন্ম লাভ করতে চাই, কারণ ঐ রকম পুনর্জন্ম লাভ করতে পারলে আমাদের কাছে অবিরত ভাবে আধ্যাত্মিক পথে আসীন হয়ে থাকতে সক্ষম হওয়ার জন্য সর্বোত্তম প্রত্যয় বা পরিস্থিতি থাকবে। তার পরিবর্তে, আমরা যদি আরশোলা রূপে পুনর্জন্ম গ্রহণ করি, তাহলে আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা তেমন কিছু করতে পারব না। খারাপ পুনর্জন্ম ত্যাগ করার জন্য আমাদের আপেক্ষিক বা সংবৃতি সত্য সম্পর্কে বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে হবে অর্থাৎ হেতু এবং ফল সম্পর্কে বিভ্রান্তি। খারাপ পুনর্জন্মের মূল কারণ হ’ল ধ্বংসাত্মক আচরণ। আমরা ধ্বংসাত্মক ভাবে আচরণ করি, কারণ আমরা আমাদের কর্মের পরিণতি সম্পর্কে অসচেতন হই অথবা আমরা ভাবি যে, সেগুলি আমাদের সুখী করে তুলবে।
- মধ্যবর্তী লক্ষ্যটি হ’ল সমস্ত তিন প্রকারের দুঃখ অর্থাৎ অসুখীতা, আমাদের সাধারণ সুখ এবং এই দুটির আধার, যা হ’ল আমাদের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম, থেকে মুক্তির লক্ষ্য নির্ধারণ করা। এটা করার জন্য আমাদেরকে শূন্যতার বিষয়টি বুঝে গভীরতম সত্য সম্পর্কে আমাদের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে হবে। আসলে, আমাদের সর্বদা চার আর্যসত্য বিষয়ে বোধগম্যতা অর্জন করতে হবে। একসাথে সারাক্ষণ এই সব বিষয়গুলির উপর মনোনিবেশ করা খুব কঠিন। সুতরাং এর জন্য আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে।
- উন্নত লক্ষ্যটি হ’ল বুদ্ধের বোধিলাভ করা অবস্থাটা প্রাপ্ত করা যাতে আমরা অন্য সকলকে সর্বোত্তম উপায়ে সহায়তা করতে পারি। গভীরতম সত্যের উপর মনোনিবেশ ক’রে আমরা সংবৃতি সত্যকে পুরোপুরি বুঝতে পারি। শুধুমাত্র একজন বুদ্ধই সর্বদা একই সাথে দুটি সত্যের উপর মনোনিবেশ করতে পারেন।
আমরা লাইনটিকে আরও গভীর ভাবে লক্ষ্য করি, “দুটি সত্য থেকে চারটি সত্য; চারটি সত্য থেকে ত্রিশরণ”, এটাই উপরোক্ত তিনটি লক্ষ্য এবং ঐ লক্ষ্যে পরিচালনা করার অনুশীলনের মূল। এটা ব্যাখ্যা করে যে, এটা হ’ল মূল কিন্তু এখানে একটা মূল বলতে কোনও বীজকে বোঝায় না। একটা মূল বলতে ‘যা উদ্ভিদকে স্থিতিশীলতা এবং শক্তি দেয়’ সেটাকে বোঝায়। আমরা যদি যুক্তির ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়ে যাই যে, তিনটি লক্ষ্যই লাভ করা যায়, সেগুলির অস্তিত্ব আছে এবং এটা বাস্তবসম্মত যে, আমরা নিজেরাই এগুলিকে লাভ করতে পারি, তাহলে অবশ্যই এটা আমাদের স্থিতিশীলতা প্রদান করবে যা সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক পথটি উক্ত লক্ষ্যের জন্য সমর্থন করবে।
অন্যান্য উপস্থাপনাগুলি বলে যে, তিনটি লক্ষ্যের মূলটি হ’ল আধ্যাত্মিক শিক্ষকের সাথে একটা স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক এবং আপনি মূলতঃ এটাকে সমস্ত মার্গক্রম (লাম-রিম) গ্রন্থে পান। এই স্বাস্থ্যকর সম্পর্কটি হ’ল এই অর্থে সমস্ত আধ্যাত্মিক পথের মূল যা আমরা শিক্ষকের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা প্রাপ্ত করি। এটাই সেই অনুপ্রেরণা যা আমাদের লক্ষ্যগুলির দিকে চালিয়ে যাওয়ার বল এবং শক্তি প্রদান করে।
আবার, আমরা কীভাবে একটা স্থিতিশীল উপায়ে আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে যেতে পারি তার দুটি বৈচিত্র খুঁজে পাই-
- একটা উপায় হ’ল আমাদের আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের সাথে আমাদের সম্পর্ক থেকে শক্তি এবং অনুপ্রেরণা প্রয়োগ করা। তার ভিত্তিতে, আমরা যুক্তির একটা লাইন ব্যবহার করি যার অর্থ হ’লঃ “আমার শিক্ষক তথ্যের একটা বৈধ উৎস। সুতরাং আমার শিক্ষক যেটা বলেন যে, বোধিলাভ করা সম্ভব, সেটা সঠিক। আমার শিক্ষক সেটা কেন প্রবন্ধ করবেন তার কোনও কারণ নেই।” অতএব সেখানে একটা নির্দিষ্ট ধরণের যুক্তি আছে যেটা এখানে জড়িয়ে আছে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ আবেগপ্রবণ স্তরে এটাকে বেশী অনুভব করে, যেখানে শিক্ষক আমাদের আবেগপ্রবণ ভাবে এতটা অনুপ্রাণিত করেন যে, এটা আমাদের পথে চলার জন্য অবিশ্বাস্য শক্তি জোগায়। এটা বোধিচিত্ত বিকাশ করার দুটি পদ্ধতির মধ্যে প্রথমটির মতো। এর সাহায্যে আমরা সংবৃতি বোধিচিত্ত বিকাশ করা শুরু করি যেখানে আমরা অপরকে সাহায্য করতে আকৃষ্ট হই এবং সেখান থেকে শ্রদ্ধার ভিত্তিতে বোধিলাভ করতে আকৃষ্ট হই। এটা সম্ভব। কেবল পরে আমরা যুক্তি দ্বারা নিশ্চিত হই যে, এটা লাভ করা যায়।
- অন্যদিকে আমরা যখন অনুশীলনের পদ্ধতিকে অনুধাবন করি যার দ্বারা আমরা প্রথমে গভীরতম বোধিচিত্ত বিকাশ করি তখন আমরা উক্ত শ্লোকে বর্ণিত শূন্যতার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস বিকাশ করি। প্রথমে আমরা নিশ্চিত হই যে, এটা প্রাপ্ত করা যায় এবং তারপর আমরা প্রকৃতপক্ষে বোধিলাভের জন্য আবেগপ্রবণের দিকে কাজ ক’রে আমাদের হৃদয়কে উন্মুক্ত করে তুলি ইত্যাদি।
উভয়ই আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে যাওয়ার বৈধ উপায় এবং এসবকিছু আমাদের লক্ষ্য বা ক্ষমতা কী তার উপর নির্ভর করে। এই বিষয়ে গ্রন্থগুলিতে বর্ণনা করা আছে যে, যারা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ইন্দ্রিয় সম্পন্ন এবং বুদ্ধিমান তাদের ব্যক্তিত্বের পক্ষে যুক্তিসঙ্গত উপস্থাপনার উপর নির্ভর করা বেশী উপযুক্ত, আর যারা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান নয় তারা আবেগপ্রবণ স্তরে বেশী কাজ করে। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য, যা সবচেয়ে ভাল কাজ করে, সেটা হ’ল শিক্ষকের কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণার উপর নির্ভর করা এবং আধাররূপী মৈত্রী ও করুণার ক্ষেত্রে বিকশিত আবেগ।
আমি মনে করি, বিভিন্ন ভাবে, উভয় পদ্ধতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা ভাল। এসবগুলির সাথে আমরা ভক্তিমূলক দিক রূপী একটা তৃতীয় পক্ষ যোগ করতে পারি। কিছু লোক বিধি-অনুষ্ঠানগুলিতে উপস্থিত হয়ে এবং সম্পাদন ক’রে বোধিপথ অনুসরণ করার জন্য অনুপ্রেরণা লাভ করে, যে বিধিতে সাধকগণ সহস্রাব্দি ধরে নিযুক্ত থাকে। আমাদেরকে বৌদ্ধ পথে অভিমুখ করার অন্যান্য উপায়গুলি অবনমিত করা উচিত নয়, কারণ এটা আমাদের কাছে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পৌঁছনো বেশী স্বাচ্ছন্দ্যযুক্ত। আমাদের যদি নিজেকে এবং আমাদের সম্ভাব্যতাগুলিকে বিকাশ করতে হয়, তাহলে আমাদের তিনটি পদ্ধতির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
এটাই হ’ল পরম পূজ্য দালাই লামা প্রণীত বিশেষ প্রার্থনায় বিদ্যমান এই নির্দিষ্ট শ্লোকটির মূল উপস্থাপনা। যেমনকি আমার শিক্ষক সবসময় বলতেন, “আপনি যেমন একটি গরুর দুগ্ধ দোহন করেন, তেমনই এই সংক্ষিপ্ত শ্লোকগুলি থেকে অনেক অর্থ দোহন করতে পারেন।
প্রশ্ন এবং উত্তর
চার আর্যসত্যের ব্যবহারিক প্রয়োগ
আমার কোনও বন্ধু যদি সবসময় চিন্তিত থাকে, তাহলে আমি তাকে বলতে পারি যে, এটাকে সহজভাবে নেবে এবং বিষয়গুলিকে খুব গম্ভীরভাবে নেবে না। এটা একটা স্মৃতিচিহ্ন যা আমরা নিজেদেরকে এবং অপরকে দিতে পারি। কিন্তু আমি যখন স্বার্থপর হয়ে যাই এবং অন্যের সাথে কথা বলি, তখন কি তার জন্য কোনও মন্ত্র বা স্মৃতিচিহ্ন থাকে যা আমি প্রয়োগ করতে পারি যাতে আমি আমার স্বার্থকেন্দ্রিক মনের অভিক্ষেপ কোথায় এবং বাস্তবতা কোথায় সেটা পরীক্ষা করতে ভুলে যাই?
মহান তিব্বতী শিক্ষক চোঙ্খাপার মতে, আমরা যখন শূন্যতার উপর নির্বিকল্পিত ভাবে মনোনিবেশ করি, এটা ছাড়া, আমাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপ অসম্ভব উপায়ে অস্তিত্বের অভিক্ষেপ করে। এটা সবসময় ঘটেই চলে। গভীর ধ্যান অবস্থা ছাড়া, খন্ডনের বিষয়টি আমাদের অভিজ্ঞতার প্রতি মুহুর্তে ঘটে।
অনেক ছোট-ছোট জিনিস আছে যা আমাদের দ্বারা উপলব্ধি করা ভ্রান্ত আভাসগুলিকে বিনির্মাণ করতে সহায়তা করতে পারে। যে চিত্রটা সহায়ক সেটা হ’ল কল্পনার “বেলুনটি চাপড়াও”, কিন্তু এটাকে করতে হবে অদ্বৈত ভাবে, কারণ এখানে পিনের সাথে কোনও “আমি” নেই এবং সেখানে কোনও বড় বেলুনও নেই, আর নেই সেই “আমি” যে যায় এবং বেলুনটা চাপড়ায়। এটা শুধু বেলুন যেটাকে অতিশয়োক্তি করা হয় যে, বস্তু কীভাবে অস্তিমান, যেটাকে চাপড়ানো হয়। ভ্রান্ত আভাস এরকম হতে পারেঃ “আপনি খুব ভয়ঙ্কর” অথবা “আমি যে পরিস্থিতিতে আছি সেটা ভয়ঙ্কর” এবং আমরা এটাকে সমস্ত হেতু এবং প্রত্যয়ের প্রেক্ষাপটে দেখি না আর অন্য সবাই একই রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তারপর আমরা ভাবি, “বেচারা আমি!” আমরা শুধু কল্পনা করি যে, এসব টুস্কি মারে।
আরও একটা চিত্র হ’ল যে, একটা খোলা বই যাতে একটা পৃষ্ঠা রয়েছে যাতে লেখা আছেঃ “বেচারা ‘আমি’ এতে ভুগছে,” এবং অন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি যা আমরা পরিচালনা করতে পারি না। এ যেন এক ভয়াবহ রূপকথার গল্প। আমাদের কাছে বইটা বন্ধ হওয়ার মানসিক চিত্র রয়েছে এবং এটা রূপকথার সমাপ্তি। আমরা আরও বেশী অপভাষা ব্যবহার করার জন্য এটাকে “দ্বৈতবাদ বই” বন্ধ রূপে দেখি।
আপনি যদি একটা মন্ত্র চান, তাহলে আপনি মনে রাখার জন্য বলতে পারেন “নোংড়া” বা “আবর্জনা”, এটা যা কিছু আমাদের কাছে প্রদর্শিত হয় সেটা মূলতঃ আবর্জনা। মূল সমস্যাটা হ’ল আমাদের মনে রাখতে হবে। আমাদের সবচেয়ে বেশী সময় তখন প্রয়োজন হয় যখন আমরা একটা শক্তিশালী বিরক্তিকর আবেগ অনুভব করি। তিব্বতীরা যে উদাহরণটি ব্যবহার করে সেটা হ’ল- অনুভূতি, যখন তোমার বিরুদ্ধে কিছু করার মিথ্যা অভিযোগ করা হয়, তখন “আমি” সম্পর্কে একটা দৃঢ় আমি উত্থিত হয় যে, “আমি সেটা করিনি!” মানে, আমি কি মিথ্যাবাদী এবং চোর?”
বৌদ্ধ ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মের মধ্যে পার্থক্য
আপনি বলেছেন যে, অন্যান্য ধর্ম আছে এবং প্রত্যেকটি ধর্ম বলে যে, সমস্যা আছে কিন্তু সমস্যা থেকে মুক্তিও আছে। অবশ্যই প্রত্যেকটি ধর্মই বলবে যে, তাদের পদ্ধতিগুলি শ্রেষ্ঠ। সুতরাং, আপনি কি এই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারবেন যে, বৌদ্ধধর্মে বিশেষ কী আছে?
আপনি ঠিক বলেছেন। হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং জৈনধর্ম সকলেই অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি লাভ করার কথা বলে এবং বর্ণনাও করে যে, মুক্তির অবস্থাটা কেমন হয়। এরা প্রত্যেকেই বলে যে, বাস্তবতাকে বোধগম্য করাটাই হ’ল মুক্তিলাভের উপায়। তারা বাস্তবতাকে বোঝার উপায়ও বলে। এইভাবে, বৌদ্ধধর্ম একটা ভারতীয় ধর্মের প্রসঙ্গে পুরোপুরি উপযুক্ত হয়। বৌদ্ধধর্ম যে সত্যিই বিশিষ্টসূচক সেটা হ’ল চার আর্যসত্য। বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দেয়ঃ
- অন্যরা বর্ণনা করতে পারে যে, দুঃখ কী, কিন্তু বুদ্ধ দুঃখসত্যের কথা বলেছেন।
- অন্যরা হয়ত বলতে পারে যে, একটা নির্দিষ্ট ধরণের অসচেতনতা হ’ল দুঃখের কারণ, কিন্তু বুদ্ধ বলেছেন যে, গভীরতম ধরণের অসচেতনতাই হ’ল প্রকৃত কারণ।
- অন্যান্য ধর্মগুলি নিরোধসত্য বিষয়ে যা বিবেচনা করতে পারে সেটা চিরস্থায়ী হয় না অথবা পূর্ণ মুক্ত নয়।
- অন্যান্যরা বোধগম্যতা বিষয়ে যা বলে সেটা একটা নির্দিষ্ট অবস্থাতে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু এটা মনের কোনও সত্য পথ নয় যা আপনাকে মুক্তির পথে নিয়ে যেতে পারে।
স্বাভাবিক ভাবেই, অন্যরাও বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে একই কথা বলবে। অতএব আমাদেরকে সত্যিই তদন্ত করতে হবে যে, বাস্তবতা কী। যেমনকি আমরা শ্লোকে দেখেছি যে, আধ্যাত্মিক পথের সম্পূর্ণ আধার হ’ল বাস্তবতার দর্শন। এটা শুধু বৌদ্ধধর্মের জন্য নয়, হিন্দু ধর্ম এবং জৈন ধর্মের জন্যও সত্য। এটাকে যুক্তি, অভিজ্ঞতা এবং বোধগম্যতা দ্বারা পরীক্ষা করতে হবে।
এই জীবনে একজন দয়ালু এবং আরও করুণাময় ব্যক্তি হওয়া আর মুক্তিলাভের ইচ্ছার জন্য আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমরা যদি বোধিলাভের বিষয়ে কথা বলি তাহলে কোন ব্যাখ্যাটা বেশী বৈধ, এটা দেখার জন্য আপনি যুক্তি এবং শাস্ত্রার্থের আধারে তদন্ত করতে পারেন। তবে আধ্যাত্মিক পথ অনুশীলনকারী অধিকাংশ মানুষের সত্যিকার অর্থেই মুক্তির লক্ষ্য রাখে না। তারা বলতে পারে যে, এর মানেটা যে কি সে বিষয়ে তাদের কোনও ধারণা নেই এবং তারা শুধু এই জীবনকালে তাদের জীবনটাকে উন্নতি করার চেষ্টা করছে। সেটাও ভাল, তাতে কোনও দোষ নেই।
সুতরাং যখন পরম পূজ্য দালাই লামাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, কোন ধর্মটা শ্রেষ্ঠ, তখন তিনি বলেছিলেন, যে ধর্ম স্বতঃস্ফুর্তভাবে আপনাকে একজন দয়ালু এবং আরও বেশী করুণাময় ব্যক্তি হতে সহায়তা করে সেটাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। প্রতিটি ব্যক্তি আলাদা এবং সেইজন্য আমরা সত্যিই বলতে পারি না যে, করুণা, দয়া, ধৈর্য, ক্ষমা ইত্যাদির বিকাশের জন্য আরও বৈধ পথ আছে। বিভিন্ন ধর্ম অনুযায়ী সেগুলিকে সমান ভাবে বিকাশ করা যেতে পারে। এটাই ধর্মীয় সম্প্রীতির আধার।
আধ্যাত্মিক পথে কীভাবে অগ্রগতি করবেন
আধ্যাত্মিক পথে অগ্রগতির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাই। সোভিয়েত ইউনিয়ানে, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পঞ্চবর্ষীয় পরিকল্পনা ছিল। যারা তাদের বৌদ্ধ অনুশীলন শুরু করেছেন তারা এক, তিন বা পাঁচ বছর ধরে কী করতে পারে, সেই বিষয়ে আপনি পরামর্শ দিতে পারেন যাতে তারা ভুল পথে না যায়।
সবথেকে সাধারণ এবং নির্ভরযোগ্য উপায়, অন্ততঃ আমি যে পরম্পরায় প্রশিক্ষিত হয়েছিলাম, সেটা হ’ল মার্গক্রমের (লাম-রিম) মাধ্যমে কাজ করা। এটা দেখায় যে, আধ্যাত্মিক পথে অগ্রগতির জন্য আমাদের যেটা জানতে হবে, হজম করতে হবে এবং বিকাশ করতে হবে সেটা হ’ল ধাপে-ধাপে। মার্গক্রমকে অনুসরণ করার পারম্পারিক উপায় হ’ল- আপনি একটা বিষয় পেয়ে যান এবং পরবর্তীতে কী ঘটতে চলেছে সেটা না জেনে আপনি এটার সাথে কাজ করেন। একবার যদি আপনি একটা অংশ বুঝতে পেরে যান, তখন আপনি পরবর্তী অংশে চলে যান। আজকাল সম্পূর্ণ পথগুলি গ্রন্থে সাজিয়ে রাখা আছে যাতে আপনি পুরো জিনিসটা একবারে পড়তে পারেন। তাহলেও আপনাকে প্রতিটি বিন্দুর জন্য এখনও উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করতে হবে। এমনকি পুরো জিনিসটা পড়ার পরেও আপনাকে ফিরে যেতে হবে এবং দেখতে হবে যে, প্রতিটি বিন্দু কীভাবে অন্য সবকিছুর সাথে সংযুক্ত রয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, অগ্রগতি কখনও রৈখিক হয় না, বরং সবসময় এর উত্থান এবং পতন হতে থাকে। সুতরাং, যদি একদিন এটা ভাল যায়, পরের দিন এটা সেরকম ঘটে না। সেটার সম্পর্কে বিশেষ কিছু করার নেই। আপনাকে শুধু চালিয়ে যেতে হবে। এটা ছিল আমার প্রিয় শিক্ষকের যুবক পুনর্জন্মের বাক্যাংশ, “এটা বিশেষ কিছু না।” আপনি যা অনুভব করেন সেখানে বিশেষ কিছু নেই। এটা ভাল যায়, এটা ভাল যায় না। তাতে কী?
অতএব, পঞ্চবর্ষীয় পরিকল্পনা নির্ধারণ করাটা অবাস্তব, কারণ প্রত্যেক ব্যক্তি আলাদা ভাবে অগ্রগতি করে। তবে পরম পূজ্য দালাই লামা বলেন যে, আপনি অগ্রগতি করেছেন কিনা সেটা জানার উপায়টি দিনে-দিনের অথবা মাসে-মাসের আধারে অনুসন্ধান করা হয় না, বরং পঞ্চবর্ষীয় সময়ের পর্যায়ে বিবেচনা করা উচিত। আমরা আগে কীভাবে অসুবিধার মোকাবিলা করেছি এবং এখন আমরা তাদের সাথে কীভাবে মোকাবিলা করব, তার তুলনা করতে পারি। এইভাবেই আমরা আমাদের অগ্রগতি দেখতে পাব।
এর অন্য ধরণও আছে, যেমন- “আদ্য সাধনা” বা “পূর্ব সাধনা”-এর অনুশীলন যেখানে আপনি এক লাখ বার সাষ্টাঙ্গ প্রণাম, শতাক্ষর-ধারণীমন্ত্র পাঠ ইত্যাদি করেন। মানুষ প্রায়শই এইভাবে শুরু করে। আমি মনে করি, ধর্ম-শিক্ষার কাছে পৌঁছনোর জন্য এই দুটি পদ্ধতি প্রতিফলিত হয়েছে। আপনি যখন “আদ্য সাধনা” আরম্ভ করেন, এটা সাধারণতঃ একজন শিক্ষকের অনুপ্রেরণার ভিত্তিতেই করা হয়। আপনি হয়ত বেশী কিছু জানেন না, কিন্তু আপনি অবিশ্বাস্যভাবে শিক্ষক দ্বারা এতটা অনুপ্রাণিত হয়ে যান এবং আপনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন যে, তিনি যা ব্যাখ্যা করেছেন সেটা উপকারী হবে এবং তাই জন্য আপনি “আদ্য সাধনার” সেটটা অনুশীলন করেন।
আমি যে পদ্ধতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত করেছি সেটা হ’ল ঐ পদ্ধতি যা আমি শ্লোকটির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেছিলাম এবং সেটাই সাধারণতঃ দালাই লামা নিজেই শিক্ষা প্রদান করেন। প্রথমে আপনি দৃঢ় বিশ্বাস লাভ করুন এবং এর সাথে পথ সম্পর্কে বোধগম্যতা অর্থাৎ এটা সম্ভব, লক্ষ্যটা কী ইত্যাদি। তারপরে আপনি কোনও “আদ্য সাধনা” অনুশীলন করুন।
স্পষ্টতই, যে কেউ তাদের মধ্যে একটা মধ্যম মার্গ অনুশীলন করতে পারে। আদ্য সাধনা দিয়ে প্রথমে শুরু করার সময়, আপনি লক্ষ্যটা অর্জন করার সম্ভাবনায় দৃঢ় বিশ্বাস অর্জনের জন্য কাজ শুরু করেন। অথবা অধ্যয়ন এবং অনুশীলন করার সময় আপনি ইতিমধ্যে আদ্য সাধনা অনুশীলন করা শুরু করতে পারেন। সুতরাং সেগুলিকে একত্র রাখার বিভিন্ন উপায় আছে। আমি মনে করি যে, এটা ঠিকঠাক বসে, যদি কেউ সত্যিই ভাবতে শুরু করে যে, আমি যা ব্যাখ্যা করছি সেই পরিকাঠামোর মধ্যে যেভাবে বিভিন্ন তিব্বতী শিক্ষকরা ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করেন। এটা নাগার্জুন এবং বোধিচিত্তকে বিকাশ করার দুটি পদ্ধতির দিকে ফিরে যায়- প্রথমে সংবৃতি এবং তারপর গভীরতম অথবা প্রথমে গভীরতমটি এবং তারপর সংবৃতি বা আপেক্ষিক। এখানে স্বয়ং নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কোনটা তার জন্য সব থেকে বেশী উপযুক্ত।
সারাংশ
চার আর্যসত্য যে কীভাবে দুটি সত্যের বাস্তবতা সম্পর্কিত বৌদ্ধ শিক্ষার সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করে এবং পালাক্রমে ত্রিরত্নের সাথে এটা একটা অত্যন্ত উন্নত বিশ্লেষণ। এটা শুধু সত্য এবং রত্নগুলি কী, তার উপর আলোকপাত করে না, বরং বৌদ্ধ দর্শন এবং অনুশীলনেও একটা সুস্পষ্ট কাঠামো সরবরাহ করে। এই উপলব্ধিগুলির আরও তদন্ত হিসাবে আমরা পরম পূজ্য দালাই লামা রচিত একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ শ্লোক ব্যবহার করেছি। অসাধারণ ফলাফলটি শুধু আমাদের বোধগম্যতা বৃদ্ধির জন্য একটা যুক্তিসঙ্গত ক্রম-ই প্রদর্শন করে না, বরং প্রতিটি অত্যাবশ্যক বৌদ্ধ উপলব্ধি কীভাবে একে অপরকে সমর্থন করে তাও দেখায়। সুতরাং একটা জটিল এবং অখন্ড আধ্যাত্মিক পথ প্রকাশিত হয়।