দুটি সত্য থেকে চারটি সত্য

আধ্যাত্মিক লক্ষ্যের জন্য কাজ করা

একটা আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জন করার দুটি উপায় আছেঃ

  • শ্রদ্ধার ভিত্তিতে- আমাদের মধ্যে শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস আছে যে, ঐ লক্ষ্যটি অর্জন করা সম্ভব। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে আপনি সেটার জন্য কাজ করেন এবং আপনার প্রশিক্ষণে আরও এগিয়ে যাওয়ার সাথে-সাথে অবশেষে আপনি নিশ্চিত হন যে, লক্ষ্যটি অর্জন করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার লক্ষ্যটি দুঃখকে চিরতরে অভিভূত করা এবং নির্মূল করার জন্য হয় আর আপনি বিশ্বাস করেন যে এটা করা সম্ভব, কারণ আপনি এটার জন্য কাজ করেন, এরফলে যদি আপনার দুঃখের হ্রাস হয়, তাহলে আপনি নিশ্চিত হয়ে যান যে আপনার লক্ষ্যটি অর্জন করা সম্ভব। আপনার অগ্রগতির অংশ হিসাবে আপনি আরও অধ্যয়ন ও ধ্যান করেন। এর মাধ্যমে আপনি যুক্তিসঙ্গত ভাবেও নিশ্চিত হন যে লক্ষ্যটি অর্জনযোগ্য।
  • দৃঢ় বিশ্বাসের ভিত্তিতে- আপনি প্রথমে কারণ এবং যুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে লক্ষ্যটি অর্জনযোগ্য এবং তার পরেই আপনি এটার জন্য কাজ করেন।

 আমরা যদি শাস্ত্রীয় বৌদ্ধ সূত্রে এটা রাখতে চাই, তাহলে বোধিচিত্ত বিকাশের দুটি পদ্ধতির ক্ষেত্রে সাধারণতঃ এই দুটি পন্থা আলোচিত হয়।

প্রথমতঃ আমরা আমাদের ভবিষ্যতে বোধিলাভ করার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ ক’রে আপেক্ষিক বা সংবৃতি বোধিচিত্ত বিকাশ করি যা এখনও বিকশিত হয়নি, তবে হতে পারে। আমরা প্রত্যেকের কল্যাণের জন্য এটা করতে চাই কারণ আমরা দেখতে পাই যে, শুধুমাত্র ঐ অবস্থাটি লাভ করার পরেই আমরা সত্যিকারেই সকলের কল্যাণ করতে পারি। ঐ অবস্থায় আমরা হেতু এবং ফল আর অন্যের কল্যাণ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলি পুরোপুরি বুঝতে পারি। তদতিরিক্ত, আমাদের মধ্যে বিশ্বাস জাগে যে, এটা অর্জন করা সম্ভব।

আরও অগ্রগতির সাথে-সাথে আমরা গভীরতম বোধিচিত্ত নামক জিনিসটা বিকাশ করি যা শূন্যতার (রিক্ততা) বোধগম্যতাকে বোঝায়। এটা সেই সত্য যা বর্ণনা করে যে, অসম্ভব উপায়ে বস্তুর কোন অস্তিত্ব নেই। আমরা বাস্তবতা বুঝতে পারি এবং দেখতেও পাই যে মনের স্বভাব কল্পনাকে অভিক্ষেপ করতে সক্ষম হয় না। তবে প্রকৃতপক্ষে কেবল বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। সেটা বুঝতে পেরে আমরা যুক্তিসঙ্গত ভাবে নিশ্চিত হয়ে উঠি যে, লক্ষ্যটি অর্জনযোগ্য। আমাদের শ্রদ্ধা তখন দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়।

অন্য পদ্ধতি অনুযায়ী বাস্তবতার এই বোধগম্যতা বিকাশ করাটা হল প্রথম পদক্ষেপ যেখানে আমরা বুঝতে পারি যে বোধিলাভ করা সম্ভব। অতএব গভীরতম বোধিচিত্তটি আগে বিকাশ করতে হবে। এর ভিত্তিতে আমরা নিশ্চিত হয়ে উঠি যে, আমরা বোধিলাভ করতে পারি। এই দৃঢ় বিশ্বাসের কারণে আমরা এটাকে লাভ করার জন্য কাজ করি। একজন মহান ভারতীয় আচার্য নাগার্জুনের একটা গ্রন্থে এই দ্বিতীয় পন্থাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। সংস্কৃত ভাষায় উক্ত গ্রন্থটি “বোধিচিত্ত-বিবরণ” নামে পরিচিত। আমরা আগে যে শ্লোকটা দেখেছি তাতে এই দৃষ্টিভঙ্গিটি উপস্থাপন করা হয়েছে যে, আমরা কীভাবে দুটি সত্য থেকে চার আর্যসত্য আর চার আর্যসত্য থেকে ত্রিরত্ন প্রাপ্ত হয়েছে। এই উপস্থাপনাটির উদ্দেশ্য হ’ল আমাদের বুঝতে সাহায্য করা যে, মুক্তি এবং বোধিলাভ করা সম্ভব কারণ তারা বাস্তবতার ভিত্তিতে আধারিত।

  • মুক্তির অর্থ হল অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম থেকে চিরকাল মুক্ত থাকার অবস্থা অর্থাৎ সংসার থেকে পূর্ণ মুক্তি, যাতে আমরা চিরতরে দুঃখ থেকে মুক্তি পাই। যারা মুক্তি লাভ করেছেন তারা হলেন “অর্হৎ”, মুক্ত সত্ত্ব।
  • বোধি হ’ল সমস্ত আবরণ থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত থাকার অবস্থা যে আবরণ আপনাকে সকল সীমাবদ্ধ সত্ত্বদেরও মুক্তি ও বোধিলাভের জন্য সাহায্য করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলি বুঝতে প্রতিরোধ করে। বোধিলাভ করা সত্ত্ব “বুদ্ধ” নামে পরিচিত।

একবার যদি আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই যে, শুধু বুদ্ধ শাক্যমুনিই নয়, বরং আমরাও মুক্তি এবং বোধিলাভ করতে পারি, তাহলে এটা আমাদের আধ্যাত্মিক অনুশীলনে প্রচুর শক্তি ও স্থায়ীত্ব প্রদান করে। তবুও এটার বিষয়ে বোধগম্য হওয়াটা খুব সহজ নয়, তবে কেউ কখনও ব্যাখ্যা করেনি যে এটা এইরকম।

দুটি সত্য

আমাদের প্রথম অধিবেশনে, আমরা প্রথম লাইনটি নিয়ে আলোচনা করেছিঃ

আধাররূপী দুটি সত্যের অর্থ জেনে, যেভাবে সব বস্তু অবস্থান করে।

দুটি সত্যের উপস্থাপনাই হ’ল আধার যার উপর সমস্ত আলোচনা নির্ভর করে আছে। সমস্ত কিছু কীভাবে অস্তিত্বে আছে এবং কীভাবে কাজ করে, এটা সেই বিষয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরী করে। অন্য কথায়, যেভাবে সব বস্তু অবস্থান করে। সবকিছুর বিষয়ে এই দুটি সত্য উভয় রূপে বৈধ এবং তাই জন্য সত্যঃ

  • সংবৃতি সত্য- হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর নির্ভর করে বস্তুগুলি উদ্ভূত হয়। অবশ্যই, বস্তুগুলির উপর নির্ভর করে এমন অন্যান্য স্তরও আছে, যেমন তাদের অঙ্গগুলি এবং এমন ধারণা যা সেগুলিকে বোঝায়। এখানে মূল বিষয়টি হ’ল একটা পরীক্ষামূলক অর্থে হেতু এবং ফল, বিশেষ করে কর্মের বাধ্যতামূলকতার ক্ষেত্রে আমাদের সুখ এবং অসুখীতার অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গে।
  • যদিও বস্তুগুলি আমাদের কাছে নির্ভরশীলভাবে এবং প্রতীত্যসমুৎপাদের আধারে উপস্থিত নাও হতে পারে, তবুও অসম্ভবভাবে অস্তিমান বস্তুর ভ্রম-উপস্থিতি বাস্তবতার সাথে মিল খায় না। আমাদের অভিক্ষেপের সাথে মিল খায় এমন একটি আসল বাস্তবতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। হেতু এবং প্রত্যয় ব্যতীত স্বাধীনভাবে এবং নিজস্বভাবে অস্তিমান বস্তুর এই সামগ্রিক অনুপস্থিতি “শূন্যতা” বা “রিক্ততা” রূপে পরিচিত।

চার আর্যসত্য

দুটি সত্যের বৈধতার ভিত্তিতে বুদ্ধ চার আর্যসত্যকে বুঝতে এবং সূত্রবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটাকে দ্বিতীয় লাইনে দেখানো হয়েছেঃ

চারটি সত্যের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হই যে, আমরা কীভাবে (সংসারে) প্রবেশ করতে থাকি এবং আমাদের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্তির পুনর্জন্ম থেকে নিবৃত্ত হতে পারি।

অত্যন্ত উপলব্ধি করা সত্ত্ব চার আর্যসত্যকে দ্বারা সত্য রূপে দেখা হয়। এটা একটা আকর্ষণপূর্ণ বিষয়, কারণ এর অর্থ হ’ল যে, শুধুমাত্র বুদ্ধগণ নয় যারা এগুলিকে সত্যরূপে দেখেন, এমনকি যারা বুদ্ধত্ব লাভের আগে একটা নিশ্চিত পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন অর্থাৎ বুদ্ধত্ব লাভের অনেক আগেই সেগুলিকে ঐ রূপে দেখেন। এটা তখন ঘটে যখন আমাদের মধ্যে শূন্যতা সম্পর্কে নির্বিকল্পিত জ্ঞান বা অন্য কথায়, গভীরতম বাস্তবতার জ্ঞান জাগে। এই বোধগম্যতাটি সম্পূর্ণ সঠিক এবং সিদ্ধান্তমূলক। যেহেতু এটা নির্বিকল্পিত, সুতরাং এর অর্থ হ’ল আমরা শ্রেণীবদ্ধভাবে জিনিসগুলি উপলব্ধি করি না।

আমরা যখন “কুকুর”-এর মতো এক শ্রেণীর মাধ্যমে চিন্তা-ভাবনা করি তখন আমাদের কাছে এমন কিছু থাকে যা একটা কুকুরকে উপস্থাপন করে। এই উপস্থাপনাটি প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে আলাদা হতে পারে, কিন্তু আমরা যখন রাস্তায় বা অন্য কোথাও একটা কুকুর দেখি তখন আমরা এটা এই শ্রেণীর কুকুরের মাধ্যমে উপলব্ধি করি। চিত্রটার আধারে আমাদের একটা কুকুর আছে, অগত্যা কোনও নির্দিষ্ট দৃষ্টিলব্ধ কুকুর নয়। চিত্রের সাথে আমরা কুকুরের ধারণাকে একসাথে মানানসই করি। আমরা যখন নির্বিকল্পিত ভাবে উপলব্ধি করি তখন সেটা কোনও শ্রেণী বা এটাকে প্রতিনিধিত্ব করে এমনকিছুর ফিল্টার ছাড়াই করি। এই কারণেই এটাকে “নগ্ন জ্ঞান” বলা হয়। আপনি সেগুলিকে বাক্সের সাথে মানানসই না করে বুঝতে পারেন।

সংস্কৃত ভাষায় অত্যন্ত উপলব্ধি করা সত্ত্ব বা “আর্য” পুরুষরা বাস্তবতাকে “বাস্তবতার” বাক্সে না রেখেই উপলব্ধি করে, যেমনকি “আমি এখন বাস্তবতা দেখছি।” তারা এটাকে কোনও বাক্সে বা শ্রেণীতে না রেখেই সম্পূর্ণ রূপে, সঠিকভাবে এবং সিদ্ধান্তমূলকভাবে বুঝতে পারে যে, এটাই “বাস্তবতা”। এমনকি আমরা যদি প্রকাশ নাও করি যে, আমরা এর মধ্যে জিনিস রাখি, এটা সবকিছুকে বোঝার আমাদের স্বাভাবিক উপায়। আমরা জিনিসগুলিকে বাক্সে এমনভাবে রাখি, যেন সেগুলি অন্য সমস্ত কিছু থেকে আলাদা হয়ে নিজের থেকেই অস্তিত্বে আছে।

এখানে কল্পনাযুক্ত জ্ঞান সম্পর্কে আর ব্যাখ্যা করার কোন প্রয়োজন নেই। মূল বিষয়টি হ’ল, এইভাবে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার জন্য আপনাকে বুদ্ধ হতে হবে না। আমরা যখন বাস্তবতাকে নির্বিকল্পিত ভাবে উপলব্ধি করব, তখন আমরা চার আর্যসত্যকে সত্যরূপে দেখব এবং সেগুলি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে উঠব।

এই চারটি সত্য কী? প্রথমটি হ’ল দুঃখ। দ্বিতীয়টি হ’ল দুঃখ সমুদয়। তৃতীয়টি হ’ল দুঃখ এবং তার কারণের নিরোধ। চতুর্থটি হ’ল মার্গ বা বোধগম্যতা যা সেই দুঃখকে নিরোধ করে। এগুলিকে সত্য বলা হয় অর্থাৎ “দুঃখ সত্য”, “সমুদয় সত্য” ইত্যাদি।

এই পুরো আলোচনাটি পুনর্জন্মের প্রসঙ্গে নির্ধারিত অর্থাৎ অনাদি এবং অনন্ত বা অন্তহীন চিত্ত-সন্ততি প্রসঙ্গে। পুনর্জন্মটি হ’ল আধার। আমরা মুহুর্ত থেকে মুহুর্তে নির্দিষ্ট বস্তুর অনুভবের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। যদি ঐ বস্তুগুলি হেতু এবং ফলের দিক থেকে পরিচালিত হয় তাহলে তাদের কোনও পরম সূচনা (আদি) থাকতে পারে না যেখানে এটা অনস্তিমান কিছু থেকে শুরু হয়। তেমনিভাবে এমন কোনও শেষ মুহুর্ত থাকতে পারে না যেখানে এগুলি অনস্তিমান কিছুতে পরিণত হয়। এটা অসম্ভব। হেতু এবং ফলের মৌলিক সত্যের ভিত্তিতে আমাদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে যে, নির্দিষ্ট চিত্ত-সন্ততির কোনও আদি এবং অন্ত হয় না। অতএব পুনর্জন্ম অবশ্যই সত্য হবে।

দুঃখ সত্য

দুঃখ সত্যের তিনটি রূপ আছেঃ

  • প্রথমটি হ’ল আমাদের স্বাভাবিক অসুখীতা, যাকে আমরা দুঃখ-দুঃখতা বলে থাকি। আমরা সকলেই অসুখীতা অনুভব করেছি। অসুখীতাকে অগত্যা ব্যথার মতো হতে হয় না। সুখ এবং অসুখীতা আর আনন্দ এবং ব্যথা হ’ল বস্তুর দুটি আলাদা সমষ্টি। আনন্দ এবং ব্যথা হ’ল শারীরিক সংবেদন আর অন্যদিকে সুখ এবং অসুখীতা হ’ল মনের অবস্থা। কেউ হয়ত ব্যথা অনুভব করতে পারে কিন্তু এই বিষয়ে সে সুখী হতে পারে, যেমন একটা শক্তিশালী শারীরিক কাজকর্ম। অন্যদিকে কেউ আবার আনন্দ উপভোগ করতে পারে কিন্তু সেটার সম্পর্কে খুব অসুখী হতে পারে, যেমন যৌনতা করতে বাধ্য করার পর উদ্ভূত অসুখীতা। সুতরাং এই দুটি হ’ল ভিন্ন পরিবর্তনশীল বস্তু। এখানে আমরা অসুখীতার কথা বলছি না যা আমরা প্রত্যেকে জানি এটা বিভিন্ন ধরণের দুঃখে পরিপূর্ণ আরও খারাপ পুনর্জন্মের ক্ষেত্রে বর্ণনা করা হয়েছে।
  • দ্বিতীয় রকমের দুঃখকে বিপরিণাম দুঃখ এবং এটা আমাদের সাধারণ সুখকে বোঝায়। আমাদের সাধারণ সুখের একটা সমস্যা হল যে, এটা কখনও স্থায়ী হয় না বা আমাদের সন্তুষ্ট করে না। আমরা সবসময় আরও চাই কিন্তু আমাদের কাছে যদি খুব বেশী থাকে তাহলে আমরা বিরক্ত হয়ে পড়ি আর তখন সেটা অসুখীতায় পরিবর্তন হয়ে যায়। একটা সহজ উদাহরণ হ’ল- আপনার প্রিয় খাবারকে অত্যধিক পরিমাণে খাওয়া, যা বেশী খেলে আপনাকে অসুস্থ করে তোলে। ফলে, পরে আপনি আর খেতে চান না, কারণ আপনি অসুখীতা বোধ করেন। সুতরাং সমস্যাটি হ’ল আমাদের সাধারণ সুখ সন্তোষজনক নয় অথবা স্থিতিশীল নয়। আমাদের জীবনের উত্থান এবং পতন হয় অর্থাৎ আমরা কখনও সুখী হই আবার কখনও হই অসুখী, কিন্তু এতে কোনও নিরাপত্তা নেই। আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে তা নির্বিশেষে আমরা পরের মুহুর্তে কীভাবে অনুভব করব তা আমরা কখনও জানতে পারি না। অবিরতভাবে এটার উত্থান এবং পতন ............ উত্থান এবং পতন হতে থাকে।
  • তৃতীয় প্রকারের দুঃখকে সংস্কার-দুঃখ বলা হয়। এই দুঃখটা হ’ল আমাদের অসুখীতা এবং সাধারণ সুখের উত্থান এবং পতনের অনুভবের আধার। আমাদের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত অস্তিত্ব হ’ল এর আধার বা পুনর্জন্ম। এটা সংস্কৃত ভাষায় “সংসার” নামে পরিচিত। আমরা এমন ধরণের শরীর এবং মন নিয়ে বারবার পুনর্জন্ম লাভ করি যা হ’ল জীবনের উত্থান-পতন বা সাধারণ সুখ এবং দুঃখের অভিজ্ঞতার আধার। এটাই আসল দুঃখ, আসল সমস্যা। আমরা যদি বাস্তবতাকে দেখে থাকি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে এটাই আসল দুঃখ।

দুঃখ সমুদয়-সত্য

আপনি যদি বাস্তবতাকে দেখেন তাহলে আপনি সত্যকে সত্য রূপে দেখতে পাবেন অর্থাৎ আমরা যা অনুভব করি তার উত্থান এবং পতন হয়, আর সেটা একটা আধারের সাথে হয় এবং তারও উত্থান এবং পতন হয়। আমরা যখন এটা দেখি, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, এটাকে কোনও হেতু থেকে উদ্ভূত হতে হয়। আপেক্ষিক বা সংবৃতি সত্যের মূল বিষয়টি হ’ল সব বস্তু হেতু থেকেই উত্থাপিত হয়। সুতরাং অবিরত অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মের জন্য প্রবেশ করার আমাদের আসল হেতু কী যেটা শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে? অন্য কথায়, এটা কীভাবে হয়? এই পুনরাবৃত্ত চক্রকে স্থায়ী করার হেতু কী?

আমাদের শেষ অধিবেশনে আমরা দেখেছি যে, আমরা যদি অসুখীতা অনুভব করি, তাহলে এটা হবে আমাদের ধ্বংসাত্মক আচরণের পরিণাম আর আমরা যদি সাধারণ সুখ অনুভব করি তাহলে এটা হবে গঠনমূলক আচরণের পরিণাম। এর সাথে আমরা কর্মকে যোগ করি। এটাকে আমি প্রায়শই “বাধ্যতামূলকতা” রূপে অনুবাদ করি। অতএব আমরা বাধ্যতামূলক ধ্বংসাত্মক আচরণ এবং বাধ্যতামূলক গঠনমূলক আচরণ করি। এটা বুদ্ধের কোনও গঠনমূলক আচরণের মতো নয়, বরং এটা এমন আচরণ যা হ’ল বাধ্যতামূলক। এর ফলে আমরা বাধ্যতামূলকভাবে ‘অহং’ এর উপর ভিত্তি করে ভাল কর্ম করি অথবা বাধ্যতামূলকভাবে আমাদের নিখুঁত হতে হয় বা সবকিছু সঠিক করতে হয়। এটা বেশ স্নায়বিক।

আমরা যদি কোনও বাধ্যতামূলকভাবে আচরণ করি তাহলে এর কারণ হবে যে আমরা বিরক্তিকর আবেগ এবং মনোভাবের প্রভাবে আছি। আমরা ইতিমধ্যে উক্ত বাধ্যতামূলক ধ্বংসাত্মক আচরণ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি। ক্রোধবশে আমরা কারও হত্যা করি; লোভবশে আমরা কিছু চুরি করি; নির্বোধতার বশে আমরা মনে করি যে, আমাদের কর্মের কোনও পরিণতি হবে না, যেমনকি, “আমি ধরা পড়ব না। এতে কিছু আসে যায় না। আমি যদি চুরি করি, তাহলে বেশ মজা হবে।”

এই ধ্বংসাত্মক আচরণের পিছনে আছে অসচেতনতা। এটা এমন একটা শব্দাবলী যা প্রায়শই অবিদ্যা রূপে অনুবাদ করা হয় কিন্তু এটা বোঝায় না যে আমরা বোকা, বরং শুধু বিভ্রান্ত। আমরা কী সম্পর্কে অসচেতন? প্রথমতঃ, আমরা হেতু এবং ফল সম্পর্কে অসচেতন। আমরা যদি সত্যিই জানতাম এবং বিশ্বাস করতাম তাহলে আমরা ধ্বংসাত্মকভাবে আচরণ করতাম না। পরিবর্তে, আমরা সহজাতভাবে জানতাম যে, এটা আমাদের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, যেটা কোনও শাস্তি নয়, বরং আমরা যে কারণগুলি সৃষ্টি করি তার পরিণাম।

আসলে অসচেতনতা দুই প্রকারের হয়। হয় আমরা জানি না যে, ধ্বংসাত্মক ভাবে কর্ম করলে সেটা সর্বশেষে অসুখীতা নিয়ে আসবে অথবা আমরা বিপরীতভাবে ভাবি, যেমনকি, “আমি যদি ধ্বংসাত্মক ভাবে কর্ম করি তাহলে সেটা আমার জন্য সুখ নিয়ে আসবে। আমি যা চাই সেটা যদি আমি চুরি করি তাহলে সেটা আমাকে সুখী করে তুলবে। আমি যদি শত্রুকে মেরে ফেলি, সেটা আমাকে আনন্দিত করবে।” যদিও ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করার সাথে-সাথেই আমরা খুশী হতে পারি, কিন্তু, “আহা, আমি ঐ মশাটার হত্যা করেছি, এবার আমি আরাম করতে পারি।” তবুও, দীর্ঘমেয়াদী পরিণাম হিসাবে, যা ঘটেছে সেটার বিষয়ে বিবেচনা না করে অখুশী বোধ করা হচ্ছে। এটা হচ্ছে এই ধরণের ধ্বংসাত্মক আচরণের কারণে। অতএব, হেতু এবং ফল সম্পর্কে অসচেতনতা থেকে ধ্বংসাত্মক আচরণের উদয় হয়। অন্য কথায়, এটা উদয় হয় আপেক্ষিক (সংবৃতি) সত্য সম্পর্কে অসচেতনতা থেকে। আমি এখানে কোনও ভান করতে যাচ্ছি না যে, এসবকিছু বোঝা সহজ, কারণ এটা আসলে সহজ নয়, কিন্তু এটা এমনকিছু যার উপর আমরা কাজ করতে পারি।

আমরা যদি এই বিষয়টাকে সংক্ষিপ্ত করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, আমি প্রায়শই কেন অখুশী বোধ করি, কারণ হ’ল আমি হেতু এবং ফলকে বুঝতে পারিনি। আমার মন যখন ক্রোধ, লোভ, ঈর্ষা ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, এটা আমাকে ধ্বংসাত্মক পদ্ধতি বাধ্যতামূলকভাবে কর্ম করতে পরিচালনা করে। আসলে এটা ধ্বংসাত্মক, কারণ এর পরিণামস্বরূপ আমি অনেক সময় অসুখীতা বোধ করি। এটাই হ’ল সংযোগ যা আমাদের তৈরী করতে হবে।

আমরা যে সুখ অনুভব করি তাও অসচেতনতা থেকে আসে, তবে এই ক্ষেত্রে, এটা হ’ল বস্তুর গভীরতম সত্য সম্পর্কে অসচেতনতা। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, আমাদের বলতে হবে যে, গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক উভয় আচরণেই অসচেতনতা অন্তর্নিহিত থাকে। ধ্বংসাত্মক আচরণের ক্ষেত্রে, গভীরতম সত্য এবং সংবৃতি সত্য উভয় বিষয়ে অসচেতন হই। গঠনমূলক আচরণের ক্ষেত্রে, আমাদের শুধু গভীরতম সত্য সম্পর্কে অসচেতনতা থাকে। আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরণের স্বর থাকে যে চিন্তা-ভাবনা করে, “আমার কী করা উচিত? আমি আমার নিজস্ব উপায়ে চলতে চাই। আমি চিন্তিত।” দেখে মনে হয় যে, সেখানে কথা বলার জন্য সত্যিই খুঁজে পাওয়ার মতো “আমি” বলে একটা ছোট্ট কিছু আছে। কিন্তু এটা বাস্তবতার সাথে মিল খায় না। সেখানে এরকম কোনও বস্তু নেই। সেখানে আছে শুধু আমাদের ধারণার একটা মৌলিক উপাদান, “আমি” রূপী কিছু নেই যে উদ্বেগ এবং অভিযোগ করে। আমরা যখন এই বিষয়ে অসচেতন হই যে, আমাদের অস্তিত্ব কীভাবে আছে, এর অর্থ এই হয় যে, আমরা গভীরতম বাস্তবতা সম্পর্কে অসচেতন আর আমরা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান “আমি” রূপী কল্পনার অভিক্ষেপ দ্বারা সনাক্ত হই। এর কারণ হ’ল, এটা বাস্তবতার সাথে মিল খায় না; আমরা এই বিষয়ে অনিরাপদ; এবং নিজেদের সুরক্ষিত করার চেষ্টা করি। অবশ্যই আমরা কখনও এতে সফল হতে পারি না।

আমরা কাল্পনিক ছোট্ট “আমাকে” সুরক্ষিত রাখার জন্য যে কৌশলকে ব্যবহার করার চেষ্টা করি সেটা হ’ল আমাদের বিরক্তির আবেগ। আমরা অনুভব করি, “আমরা যদি কিছু অর্জন করতে পারি তাহলে আমরা নিরাপদ থাকব”, এর অর্থ এই হয়, আমাদের মধ্যে লোভ, আসক্তি এবং লালসা আছে। তারপর আমরা অনুভব করি, “আমি যদি এটাকে সরিয়ে দিতে পারি তাহলে আমি নিরাপদ থাকব।” তাই আমাদের মধ্যে ক্রোধ এবং বিকর্ষণ আছে। অথবা আমরা নির্বোধ হতে পারি এবং ভাবি, “আমি যদি কেবল ভান করি যে, আমাকে যা ভয় দেখাচ্ছে সেটা অস্তিত্বে নেই, তাহলে এটা আমাকে নিরাপদ করে তুলবে।” এই ভিত্তিতে, আমাদের মধ্যেও ধ্বংসাত্মক আচরণ আছে, যেমনকি আমরা যখন আমাদের ক্রমবর্ধমান চাপকে উপেক্ষা করি। ক্রোধের ভিত্তিতে, আমরা চিৎকার করি, আঘাত করি এবং এমনকি অন্যের হত্যা করি। লোভের কারণে আমরা চুরি করি অথবা অনুচিত যৌন আচরণে নিযুক্ত হই যা অন্যদের আঘাত করে। নির্বোধতার কারণে আমরা কাজ-পাগল হয়ে উঠি, অস্বাস্থ্যকর আহার গ্রহণ করি আর কখনও ব্যায়াম করি না। সুতরাং এসব উদিত হয় গভীরতম সত্য সম্পর্কে অবোধতার কারণে, অর্থাৎ আমরা কীভাবে অস্তিত্বে আছি হেতু এবং ফল সম্পর্কে নির্বোধতা।

গঠনমূলক আচরণের ক্ষেত্রে, এমনকি ঐ সময় যদি বিরক্তিকর আবেগের ভিত্তি নাও থাকে, তবুও সেখানে এই নির্বোধতা থাকে যার মধ্যে এই সমস্ত কিছু অন্তর্নিহিত থাকে। আমরা নিখুঁত বা ভাল হয়ে, সর্বশ্রেষ্ঠ পিতা-মাতা হয়ে অথবা যা কিছু করেই হোক, আমাদের অস্তিত্বকে প্রমাণ করার বা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করি। আর এটা করি এই ভেবে, “এটা আমার মাথায় বিদ্যমান এই ছোট্ট ‘আমিকে’ নিরাপদ বোধ করায়,” যা কখনই সফল হয় না। আমরা কখনই নিরাপদ বোধ করি না। যদিও আমরা অপরের সহায়তা করে কিছুটা সুখী অনুভব করি, তবে ঐ সুখটা কিন্তু তখনও সাধারণ সুখ হয় এবং সেই জন্য এটা স্থায়ী হয় না। আমরা এটা নিয়ে কখনই সন্তুষ্ট হতে পারি না, কারণ আমরা তখনও পর্যন্ত অনিবার্যভাবে অনুভব করি যে, আমরা যথেষ্ট ভাল নই; আমরা যথেষ্ট নিখুঁত নই। আমরা তখনও অনুভব করি যে, আমাদের কিছু প্রমাণ করতে হবে। এটা স্পষ্টভাবে আমাদের অস্তিত্বের গভীর স্তরের অসচেতনতার উপর আধারিত।

তৃতীয় প্রকারের দুঃখের জন্য, অসুখীতা এবং সাধারণ সুখের উত্থান এবং পতনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, আমাদের কাছে “প্রতীত্যসমুৎপাদের দ্বাদশ অঙ্গ” নামক জটিল পরিকল্পনা আছে যা আমি এখানে বিস্তৃতভাবে কোনও ব্যাখ্যা করব না, কিন্তু কর্ম কীভাবে কাজ করে, এটা তার সাথে সম্পর্কিত।

সহজ উপায়ে, কর্ম বলতে বাধ্যতামূলকতাকে বোঝায়। এর ভিত্তিতে আমরা নির্দিষ্ট উপায়ে কাজ করি অর্থাৎ ধ্বংসাত্মকভাবে বা গঠনমূলক ভাবে। “বাধ্যবাধকতা” বলতে আসলে কী বোঝায়? বাধ্যবাধকতার মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, আসলে কোনও কিছুর উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই, যেমন কেউ বাধ্যবাধকতামূলক ভাবে আপনার আঙ্গুল টোকে। এটা কিছু করার মতো অনুভূতি থেকেই উৎপন্ন হয়। তিব্বতী শব্দের অর্থ হ’ল “আমি এটা করতে চাই, আমি এটা করার কামনা করি, আমি এটা করতে পছন্দ করি”, যেমন চিৎকার করা, আলিঙ্গন করা বা খাওয়ার মতো অনুভূতি। তারপরে বাধ্যবাধকতার বিষয়টা তৈরী হয় এবং আমরা এটা করি। সহজভাবে, এই কর্মটার পুনরাবৃত্তি করার একটি নির্দিষ্ট প্রবণতা তৈরী হয় এবং এটা একটা ধ্বংসাত্মক কর্ম হলে অসুখীতা অনুভব করার প্রবণতা আর যদি একটা গঠনমূলক কর্ম হয় তাহলে সুখ অনুভব করার প্রবণতা তৈরী হয়। কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতির কারণে কোনও এক সময়ে এই প্রবণতাটি সক্রিয় হবে। এটা পরিপক্ক হয় এবং আমরা চিৎকার করার মতো অনুভব করি অথবা আমরা আবার আলিঙ্গন করার মতো অনুভব করি।

এটা একটা চিরস্থায়ী পরিকল্পনা যা চলতে থাকে, কারণ আমরা এই ধরণের আচরণকে অবিরত রাখার জন্য এই ইচ্ছাটি অনুভব করি। আচরণের এই ধরণটি সমাপ্ত না হয়ে পুনরাবৃত্তি হয়, কারণ আমরা নিয়মিত ভাবে এটাকে শক্তিশালী এবং অভেদ্য করতে থাকি। ফলে আমরা সবসময় এই সুখ এবং অসুখীতার উত্থান এবং পতন অনুভব করে চলি।

এখানে, সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি হ’ল, ফল উৎপাদন করার জন্য এই প্রবণতাগুলি কীভাবে সক্রিয় হয় যাতে আমাদের আচরণ পুনরাবৃত্তি করার মতো মনে হয়? এটা খুবই জটিল হলেও দ্বাদশ অঙ্গ বা দ্বাদশ নিদানের সাথে খুব মার্জিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটা নিয়মিত ভাবে আমাদের মধ্যে উত্থান এবং পতন হয়ে থাকে, আর এটাকে বিশেষভাবে নাটকীয় হওয়ার প্রয়োজন হয় না। এমনকি আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখনও আমরা সম্ভবতঃ একটি মধ্যবর্তী অবস্থায় থাকি যখন আমরা ভাল করে ঘুমাই না, এবং আমরা সুখী হই না। সুতরাং আমরা যখন অসুখীতা বা সাধারণ সুখ অনুভব করি তখন আমাদের মনের অবস্থা কেমন হয়? এর জন্য সংস্কৃত শব্দটি হ’ল “তৃষ্ণা” যার অর্থ হ’ল “পিপাসা।” এটাকে সাধারণ “তৃষ্ণা” রূপে অনুবাদ করা হয়, কিন্তু আসল শব্দের অর্থ হ’ল “পিপাসা”।

মূলতঃ আমরা যখন অসুখীতা অনুভব করি, তখন আমরা এর থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে মরে যাই, যেমন আপনি তৃষ্ণার্ত হওয়া থেকে মুক্তি পেতে চান। আমরা যখন সুখ অনুভব করি, তখন আমরা এর থেকে আলাদা হতে চাই না, বরং আরও তৃষ্ণার্ত হয়ে যাই। এটা ঠিক যে, আপনি যখন সত্যিই তৃষ্ণার্ত হন এবং প্রথম চুমুকটি দেন, সেটা আপনার জন্য যথেষ্ট হয় না, তাই নয় কি? আপনি এটা থেকে আলাদা হতে চান না, বরং আপনি আরও এবং আরও চান। তারপরে, যা আঘাত করে সেটা হ’ল “আমি”-এর প্রতি একটা দৃঢ় ধারণা (লোলুপ) যার কারণে আমরা ভাবি, “আমাকে এই অসুখীতা থেকে মুক্ত হতে হবে”, “আমাকে এই সুখ থেকে মুক্ত হলে হবে না”।  এই ভাবনাটা কার্মিক প্রবণতাগুলিকে সক্রিয় ক’রে তোলে। এটাই হ’ল সংস্কার দুঃখের আসল কারণ। অতএব সুখ, অসুখীতা আর অন্যান্য অভিজ্ঞতা অর্জন করার প্রবণতাগুলি বিরক্তিকর আবেগের সাথে মিশ্রিত বাধ্যবাধকতামূলক আচরণ থেকে উৎপন্ন হয় আর এটা উৎপন্ন হয় তাদের গভীরতর স্তরে বাস্তবতার বিষয়ে আমাদের অসচেতনতা থেকে। এখানে অসচেতনতার অর্থ হ’ল আমাদের অনুভূতিগুলি কীভাবে অস্তিত্বে আছে (সেগুলি সর্বক্ষণ পরিবর্তন হয়) এবং আমরা আসলে কীভাবে অস্তিত্বে আছি (এমন সন্ধানযোগ্য অনিরাপদ সত্তা নয় যা আমাদের মস্তিষ্কে আছে এবং যা কোনভাবে ধারণা দ্বারা নিরাপদ করা যায়)।

এই অসচেতনতাই হ’ল মূল কারণ। এটা আমাদের গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক আচরণ উভয়ের সাথে যুক্ত। এটাই হ’ল আসল সমস্যাসৃষ্টিকর্তা যা আমাদের প্রবণতাগুলিকে সুখী, অসুখী করে এবং আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটায় ও প্রকৃতপক্ষে অস্তিমান হওয়ার প্রবণতা তৈরী করে। আমরা যদি এই তৃষ্ণার দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, এটা কীভাবে আভ্যন্তরীণভাবে আমাদের অস্তিত্বের অসচেতনতার সাথে যুক্ত। আমরা ভাবি, “আমিই ‘আমি’, একমাত্র যিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং তাই জন্য আমাকে এই সুখ থেকে বিচ্ছেদ হওয়া উচিত না। এটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে, আমি অসুখী নই,” এর পরিবর্তে, “ঠিক আছে, আমি সুখী আছি বা অসুখী, তাতে কী হয়েছে?” দুটি সত্য সম্পর্কে আমাদের অসচেতনতাই হ’ল নিয়মিত অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মের আসল কারণ।

দুঃখের কারণগুলির সত্য নিরোধ

তৃতীয় সত্যটি হ’ল সত্য নিরোধ যেখানে দুঃখের কারণগুলি নিবৃত্ত হয়ে যায় এবং তাই জন্য দুঃখও নিবৃত্ত হয়ে যায়। বাস্তবতা সম্পর্কে এই অসচেতনতাকে কীভাবে চিরতরে মুছে ফেলা সম্ভব? আপনি যখন উপলব্ধি করেন যে, যেটা বাস্তবতার সাথে মিল খায় না, এর কোনও আধার থাকতে পারে না। এটা বাস্তব কোনকিছুর সাথে মিল খায় না এবং তাই জন্য সেখানে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য কিছুই থাকে না।

উদাহরণস্বরূপ, থিয়েটার প্রযোজনায় যদি আপনার কোনও দৃশ্য থাকে তখন পিছনে এমন একটা লাঠি থাকে যা সেটাকে ধরে রাখে। তিব্বতী শব্দটার অর্থ হ’ল সেখানে লাঠিগুলির মতো কিছুই থাকে না যা আমাদের অসম্ভব অভিক্ষেপকে ধরে রাখে। যখন দৃশ্যকে ধরে রাখার মতো কিছুই থাকে না তখন কী ঘটে? এটা নীচে পড়ে যায়।

একবার যদি আপনি এই সত্যের দিকে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়ে যান যে, আমাদের মধ্যে মিথ্যা অভিক্ষেপকে ধরে রাখার মতো কিছু নেই, তাহলে, অবশেষে আপনি চিরকাল এই উপলব্ধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখতে পারবেন। দৃশ্যটি কখনও পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারার কোনও উপায় থাকে না। আমার মস্তিষ্কের মধ্যে থাকা এই ছোট্ট “আমি”-এর নাটকটি উদ্বিগ্ন হওয়া, “আমার কী করা উচিত?”, “আমাকে নিখুঁত হতে হবে” এবং “আমাকে নিজের পথে যেতে হবে” নিবৃত্ত হয়ে যাবে। আমরা যখন দেখি যে, আমাদের অভিক্ষেপগুলিকে ধরে রাখার মতো কখনও কিছুই ছিল না, তখন আমাদের মন আর অসম্ভব এমন কিছু অভিক্ষেপ করে না। এর ভিত্তিতে আমরা ঐ প্রবণতাগুলির মধ্যে আর কোনোটাকে সক্রিয় করব না, কারণ সেখানে সক্রিয় করার মতো কিছুই থাকবে না। সেখানে আর থাকবে না, “আমি, আমি, আমি, আমাকে সুখী হতে হবে এবং আমি অসুখী হতে পারব না।”

যদি প্রবণতাটিকে সক্রিয় করার মতো কিছু না থাকে, তাহলে আপনি বলতে পারবেন না যে, আপনার প্রবণতাটি এখনও আছে। শুধু কোনকিছুতে একটা ফলের প্রবণতা থাকতে পারে যদি সেখানে কোনও ফল ফলিভূত হতে পারে। অন্য কথায়, একটি প্রবণতার সম্পূর্ণ ধারণাটি ফল হওয়ার উপর নির্ভর করে। যদি সেখানে ফল বিদ্যমান না থাকে, তাহলে এটাকে উৎপাদন করার প্রবণতা আর থাকবে না।

এইভাবেই আমরা অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মকে প্রতিলোম করতে পারি। যদিও আমাদের মন অনাদিকাল থেকে প্রবণতায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে, কিন্তু যদি তাদের সক্রিয় করার মতো কিছু না থাকে, তাহলে সেগুলি আর অস্তিত্বে থাকে না। আমরা যখন বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতনতার সাথে থাকি, আমরা আর বাধ্যতামূলক আচরণ তৈরী করি না যা আরও প্রবণতার জন্ম দেয়। সুতরাং অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম এবং আমাদের উত্থান-পতনের অনুভূতির আধার সমাপ্ত হয়ে যায়, চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। এটাই হ’ল নিরোধসত্য এবং আমরা মুক্তি লাভ করি।

নিরোধসত্য প্রাপ্ত করার জন্য মনের সত্য পথ

চতুর্থ আর্যসত্যকে সাধারণতঃ “সত্য পথ” রূপে অনুবাদ করা হয়। এটা মনের অবস্থাগুলিকে বা বোধগম্যতাকে বোঝায় যে, এটা একটা পথের মতো আপনাকে একটা লক্ষ্যে নিয়ে যায়। এটি সত্যের সঠিক এবং সিদ্ধান্তমূলক বোধগম্যতা। আমরা এর সাথে যত বেশী অভ্যস্ত হয়ে উঠি, অবশেষে আমরা এটাকে সবসময় পাই। এটা এমন একটা পথ হয়ে ওঠে যা অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মের সত্যিকারের নিরোধ অবস্থা প্রশস্থ করে তোলে।

উপসংহার

এই হ’ল সেই উপায় যার মাধ্যমে আমরা দুটি সত্য থেকে চারটি সত্য অর্জন করি।

আমরা কীভাবে সংসারে প্রবেশ করি? আমরা যে শ্লোকটি দেখছিলাম সেটা অনুযায়ী এটা চারটি আর্য সত্যের প্রথম দুটি অর্থাৎ সত্য দুঃখ এবং সত্য কারণগুলির মধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। মূলতঃ আমাদের মধ্যে বিদ্যমান দুটি সত্য সম্পর্কে বিভ্রান্তির কারণে আমরা সংসারে প্রবেশ করি। হয় আমরা বাস্তবতা জানি না, বা আসলে বাস্তবতা যে কী আমরা আলাদা ভাবে তার কল্পনা করি। আমরা কীভাবে এই কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসব? (এর জন্য উপদিষ্ট) তৃতীয় এবং চতুর্থ আর্যসত্য বা সত্য নিরোধ এবং মনের সত্য পথ রয়েছে। সুতরাং বাস্তবতার দুটি সত্য না জেনে আমরা চারটি আর্যসত্যের প্রথম দুটি পাই এবং এই দুটিকে জানার পর আমরা দ্বিতীয় দুটি পাই।

যদিও এটা একটা খুবই জটিল বিষয়, তবুও বৌদ্ধধর্ম যা বর্ণনা করে যে আসলে ঐ লক্ষ্যটা অর্জন করা সম্ভব এবং তাই জন্য চেষ্টা করা ও কিছু বিশ্বাস লাভ করার জন্য আমরা বৌদ্ধ শিক্ষা অনুযায়ী এইভাবে কাজ করি এবং আমাদের অনুশীলনের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করি। একবার আমরা এসবকিছু সঠিকভাবে বুঝতে পারলে এটার প্রয়োগ অন্যান্য সবকিছুর সাথে একসঙ্গে রাখতে পারি। তারপরে, ধ্যানের মাধ্যমে আমরা স্বয়ং এটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠি অর্থাৎ আমরা এটাকে বাস্তবতাকে দেখার অভ্যাসে পরিণত করি।

শ্রবণ, চিন্তন এবং ধ্যানের ভিত্তিতে আমরা দৃঢ় বিশ্বাস অর্জন করতে পারি যে, আমরা আমাদের অনুশীলন দ্বারা যে লক্ষ্যটি নির্ধারণ করছি সেটা আসলে প্রাপ্ত করা সম্ভব। তাছাড়া এটা সত্য যে, এটা লাভ করা সম্ভব এবং আমরা নিজেরাই এটা লাভ করতে পারি যদি আমরা এর জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা করি। এইভাবে আমাদের অনুশীলন আরও বেশী স্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এর কারণ হ’ল এটা তখন কেবল একটা নড়বড়ে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে না যে, আমরা যে লক্ষ্যটি নির্ধারণ করছি সেটা হয়ত সম্ভব হতে পারে। পরিবর্তে আমরা নিশ্চিত হয়ে উঠি।

Top