মধ্যবর্তী এবং উন্নত স্তরের অনুপ্রেরণা

পুনঃ মূল্যায়ন

আমরা আধ্যাত্মিক মার্গের ক্রমপর্যায়গুলি সম্পর্কে কথা বলছি যেখানে আমরা মূলতঃ আমাদের অনুপ্রেরণাকে ছোট পরিধি থেকে শুরু ক’রে এটা পূর্ণ হওয়া অবধি প্রসারিত এবং বিস্তৃত করার চেষ্টা করছি। এইভাবে, প্রত্যেক অবস্থা পূর্ববর্তী একটার উপর নির্মিত হয়।

আমরা আরও দেখেছি যে, এই উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যাওয়ার দুটি উপায় আছে। আমরা একটা ধর্ম-লাইট সংস্করণ অনুসরণ করতে পারি যার মাধ্যমে আমরা এই জীবনকালকে উন্নত করা ও আমাদের জীবনকে উন্নত করার বিষয়ে যুক্ত। আমাদের মধ্যে বেশীরভাগের জন্য এখানে শুরু করা দরকার। তবে পারম্পারিক উপস্থাপনা এই স্তরটি বিচার করে না কারণ এই পরম্পরটি পুনর্জন্মের কোনও আদি বা অন্ত বিশ্বাস করে না। রিয়েল থিং ধর্ম রিয়েল থিং কোকা-কোলার মতো, পুনর্জন্মের প্রসঙ্গের মধ্যে এই বিকাশ সম্পর্কে কথা বলে।

আমরা দেখেছি যে, অনুপ্রেরণার সমস্ত স্তরের মতো, অনুপ্রেরণার প্রারম্ভিক স্তরের একটা লক্ষ্য আছে এবং সেই লক্ষ্যটা অর্জন করার কারণ আছে আর তার পিছনে আছে একটা আবেগ যা আমাদের সেই লক্ষ্য অর্জনে পরিচালনা করে। প্রারম্ভিক পর্যায়ে, আমরা আমাদের ভবিষ্যতের জীবন উন্নতির দিকে লক্ষ্য রাখি যা আমাদের মূল্যবান মানবজন্মের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে যাতে আমরা বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌছনোর জন্য নিজেদের বিকাশ চালিয়ে যেতে পারি। আমরা বুঝতে পারি যে, কেবল এই জন্মের চূড়ান্ত লক্ষ্যটা অর্জন করা কঠিন। এতে অনেক সময় লাগে এবং অনেক পরিশ্রম করতে হয়। উন্নতর পুনর্জন্ম প্রাপ্ত করার চেষ্টা করা এবং সেটা নিয়মিতভাবে প্রাপ্ত করার কারণটি হ’ল আমরা যাতে ঐ পথে চলতে পারি। 

যখন মূল্যবান মানবজন্মের লক্ষ্য অর্জন করার পর আমরা যা করার পরিকল্পনা করি সেটাই হ’ল এই। আমরা আমাদের পরজন্মে স্বর্গে যাওয়ার কথা বলছি না এবং ভাল সময় কাটানোর কথাও বলছি না। এই লক্ষ্যের মধ্যে যে আবেগ আমাদেরকে আরও ভাল পুনর্জন্মের জন্য পরিচালনা করে সেটা আরও খারাপ জন্ম পেতে ভয়ভীত হয়। এই খারাপ অবস্থাগুলির মধ্যে আমাদের নিজের উপর কাজ করা ও উন্নতি করার কোনও সুযোগ থাকবে না। কিন্তু আমাদের আত্মবিশ্বাস আছে যে, এটাকে এড়ানোর একটা উপায় আছে। আমরা নিরাপদ দিকনির্দেশ বা শরণগমণের সময় এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। এই দিকটা মূলতঃ আমাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত সীমাবদ্ধতা এবং নেতিবাচক দিকগুলি, বিশেষ করে আমাদের আচরণের সাথে যুক্ত দিকগুলি সর্বদা চেষ্টা করা এবং সম্পূর্ণরূপে বদ্ধ করা। এটা ছাড়াও, আমরা গঠনমূলক উপায়ে কর্ম করতে চাই। আমরা এটা করি আমাদের কাছে থাকা মূল্যবান মানব জীবনের সুযোগগুলির প্রশংসা করার প্রসঙ্গে এবং মৃত্যুর সময় এটা আমরা অবশ্যই হারবো, এই বোধগম্যতার সাথে। মৃত্যু নিশ্চিতভাবে আসবে কিন্তু কখন আসবে তার ধারণা আমাদের নেই।

এমনকি শ্রেষ্ঠ পুনর্জন্মের অবস্থাগুলি অসন্তুষ্টিজনক

মধ্যবর্তী সুযোগের সাথে আমরা আরও বিশ্লেষণ করি। এমনকি যদি আমাদের তথাকথিত আরও ভাল পুনর্জন্ম হয় বা এমনকি মূল্যবান মানবজন্মও থাকে, তাহলেও এইভাবে চালিয়ে যাওয়া কেবল অসন্তুষ্টিজনক। জীবন চলতে থাকে এবং এর স্বভাব এরকম হয়ে যায় যে, এটার উত্থান এবং পতন হতে থাকে। যেখানে পরের মুহূর্তে আমরা কী অনুভব করব সেটা নিয়ে কোনও নিশ্চিততা থাকে না। আমরা এখন সুখী হতে পারি কিন্তু পরক্ষণে আমরা হটাৎ করেই কম সন্তুষ্টি বোধ করতে পারি, দুঃখিত হতে পারি বা হতাশ হতে পারি। সামান্যতম বিষয়গুলি আমাদের মর্মাহত করে এবং অবশ্যই আমাদের মধ্যে পুনরাবৃত্ত সমস্যাগুলি রয়েছে যা প্রতিটি জীবনে আমাদের শারীরিক ক্রিয়াকলাপের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই জন্মগ্রহণ করতে হয় ও শিশু হতে হয়। আমাদের হাটা-চলা করা শিখতে হয় এবং কথা বলা শিখতে হয়। বার-বার এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়াটা সত্যিই বিরক্তিকর। আমাদের স্কুলে যেতে হবে; কে এর মধ্য দিয়ে আবার যেতে চায়? আমাদের একজন সঙ্গী এবং একটা কাজ খোঁজার প্রয়োজন হয় এবং তাদেরকে আবার অসুস্থতা, বার্ধক্য এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়, এগুলি শুধু আমাদের নিজের মধ্যে নয়, বরং আমরা যাদের ভালবাসি তাদের মধ্যেও।

এমনকি এই মূল্যবান মানবজীবনে অনেক অসন্তুষ্টিজনক জিনিস রয়েছে এবং তার সাথে আমাদের সমস্ত আবেগপ্রবণ সমস্যা এখনও সেখানে আছে। আমরা ক্রোধিত ও মর্মাহত হই এবং আমরা লোভও করি। আমরা মানুষ এবং বস্তুর প্রতি প্রচণ্ডভাবে আসক্ত। আমরা কারণ এবং ফল, আর বাস্তবতা সম্পর্কে নির্বোধ। সেইজন্য আমরা মূর্খভাবে আচরণ করি, এই ভেবে যে আমাদের আচরণ ও কথা বলার ভঙ্গিমার কারণে অন্যের কোনও প্রভাব পড়ে না। আমরা প্রায়শই এমন আচরণ করি যেন অন্য লোকজনরা সত্যিই উপস্থিত থাকে না এবং তাদের মধ্যে কোনও অনুভূতি থাকে না। এটা সম্পূর্ণ বোধহীনতা, তাই নয় কি?

এই সমস্ত সমস্যা অবিরত থাকবে এবং আমাদের যে কোনও ভাগ্যবান পুনর্জন্মে এগুলির উত্থান-পতন হবে। এমন একটা সময়ও আসবে যখন আমরা ভাগ্যবান থেকে দুর্ভাগ্যবান, আরও ভাল থেকে আরও খারাপ পুনর্জন্ম এবং পরিস্থিতিতে যাব। এটা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। সংস্কৃত শব্দ “সংসার”-এর অর্থ বলতে আমরা এই অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত অস্তিত্ব বা পুনর্জন্মকে বুঝি।

ত্যাগঃ মুক্ত হওয়ার সংকল্পের সাথে মুক্তির লক্ষ্য

মধ্যবর্তী সুযোগের সাথে আমরা যে লক্ষ্যটি অর্জন করতে চাই সেটা হ’ল এই সমস্ত কিছু থেকে। আমাদের চিত্ত-সন্ততির কোনও শুরু এবং শেষ নেই আর অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মের এই আপাতদৃষ্টিতে কখনও শেষ না হওয়া চক্রটি আমরা চালিয়ে যেতে চাই না। আমরা যখন “আপাতদৃষ্টিতে শেষ না হওয়া” শব্দটি বলি, এর অর্থ বলতে বোঝায় যে, আমরা যদি এই বিষয়ে কিছু করি না তাহলে এটা চিরতরে চলতে থাকবে। আমাদেরকে এটা বন্ধ করতে হবে এবং সংসারের সত্য নিবর্তন অনুভব করতে হবে। কেন? এর কারণ হ’ল আমরা দুঃখকে নিবর্তন করতে চাই। যদিও সমস্যাগুলি ভয়াবহ আকার ধারণ করে না তাহলেও আমরা আরও সূক্ষ সমস্যাগুলির নিবর্তন করতে চাই। এটাই মোক্ষ লাভ করার ইচ্ছার কারণ।

সংস্কৃত ভাষায় “মোক্ষ”-কে নির্বাণ বলা হয় এবং যে আবেগ বা অনুভূতি আমাদের এই দিকে চালিত করে তাকে সাধারণতঃ “ত্যাগ” বলা হয়। এটা শ্রেষ্ঠ অনুবাদ নয়, তবে এটা মূলতঃ মুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্পকে বোঝায়। ত্যাগের মাধ্যমে আমরা স্থির করি যে, আমাদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমান দুঃখ রয়েছে। আমরা এতে বিরক্ত হয়ে গেছি এবং আরও গভীর স্তরে আমরা এগুলির কারণে প্রকৃতপক্ষে বিরক্ত হয়েছি। এটা ইতিমধ্যে যথেষ্ট হয়েছে; আমরা মুক্ত হতে চাই।

আমাদের বিরক্তিকর আবেগ ত্যাগ করতে ইচ্ছুক হওয়া

আমরা দেখতে পাই যে, মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদেরকে আমাদের সমস্ত সমস্যা ও দুঃখের কারণগুলি থেকে মুক্ত হতে হবে। আমরা শুধু দুঃখকে ত্যাগ করতে ইচ্ছুক নই বরং সেগুলির কারণও ত্যাগ করতে ইচ্ছুক। আমরা আইসক্রিম বা চকোলেট বা এমন কিছু ত্যাগ করার কথা বলছি না। সেটা হ’ল ত্যাগের একটা তুচ্ছ জ্ঞান। আমরা যেটা করতে সংকল্পবদ্ধ হই সেটা হ’ল- আমাদের ক্রোধ, লোভ এবং আসক্তি, সমস্ত কিছু থেকে মুক্ত ক’রে তোলা। চকোলেটের ক্ষেত্রে, আমাদের সেই বস্তুর প্রতি আসক্তিকে ত্যাগ করা প্রয়োজন যা এর ভাল গুণাবলীর অতিরঞ্জিতার উপর ভিত্তি করে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা মনে করি, “এটা বিশ্বের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এবং সুস্বাদু বস্তু, আর এটা আমাকে সুখী করতে চলেছে, সর্বশেষে সন্তুষ্ট।” যদি চকোলেট বাস্তবে এটা করতে সক্ষম হয় তাহলে আমরা যত বেশী খাব, আমরা ততই আরও সুখী হব। কিন্তু বাস্তবে যত বেশী চকোলেট খাই না কেন, শীঘ্রই অসুস্থ হয়ে পড়ব এবং আর কখনও চকোলেট দেখতে চাইব না।

আমাদের আসক্তি, ক্রোধ ইত্যাদি ত্যাগ করার ইচ্ছার ক্ষেত্রে আন্তরিক হওয়া সত্যিই গভীর এবং খুব কঠিন। আমাদেরকে এটা তুচ্ছ মনে করা উচিত না। এটা একটা রসিকতার মতো যে, কেউ যেন পাঁচিলের বিরুদ্ধে তার মাথা প্রহার করছে এবং সে এটা বন্ধ করতে ভয় পায় কারণ সে জানে না যে, সে যদি প্রহার করা বন্ধ ক’রে দেয় তাহলে পরিস্থিতিটা আরও খারাপ হয়ে যাবে কিনা। আমরা সম্পূর্ণভাবে এতে অভ্যস্ত এবং তাই জন্য আমরা অবিরাম পাঁচিলের বিরুদ্ধে মাথা প্রহার করতে থাকি। অবশ্যই, সেটা একটা চরম উদাহরণ। একটা সাধারণ উদাহরণ হতে পারে, কারও সাথে একটা অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কের ক্ষেত্রে, তবে একে বিরত রাখতে আমরা দ্বিধা বোধ করি কেননা আমরা একা হয়ে যেতে ভয় পাই। পরিণামস্বরূপ, আমরা এই অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক বজায় রাখি এবং দুঃখিত হই।

এটা বেশ সাধারণ, তাই নয় কি? আমরা নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে নির্দিষ্ট কিছু জিনিস বলতে চাই না যদি তারা আমাদের ত্যাগ করে চলে যায়। আমরা এখানে কোনও অদ্ভুদ অভিজ্ঞতার কথা বলছি না, শুধুমাত্র এমন উপাদান সম্পর্কে বলছি যা আমরা সকলে সারাক্ষণ অনুভব করি।

অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম থেকে মোক্ষ কি সম্ভব এবং আমি কি এটা অর্জন করতে সক্ষম?

মোক্ষ-এর এই লক্ষ্য অর্জন করতে এবং অবশেষে বোধি লাভ করার জন্য সর্বপ্রথম আমাদের এটা জানা দরকার এবং কীভাবে অর্জন করতে পারি সেটাও জানা দরকার। এগুলি জটিল বিষয়। যেহেতু এগুলি প্রদর্শন করা কঠিন যে, ঐ লক্ষ্যগুলিতে পৌঁছনো যায় এবং সেগুলি আমরা প্রত্যেকে অর্জন করতে পারি, সুতরাং বহু মানুষ সেগুলি এড়িয়ে যায়। এটা একটা বড় ভুল, কারণ আমরা যদি সত্যিই নিশ্চিত না হই যে, আমরা এই লক্ষ্যগুলি অর্জন করতে পারি তাহলে আমরা কেন তার জন্য কাজ করার চেষ্টা করতে মাথা ঘামাবো? আমরা শুধু একটা খেলা খেলব এবং অবশেষে এমন একটা জায়গায় পৌঁছবো যেখানে আমরা বলব যে, এটা হাস্যকর এবং ত্যাগ দেওয়া উচিত।

আমাদেরকে বুদ্ধগর্ভের (তথাগতগর্ভ) বিষয়গুলি (মোক্ষ ও বোধিলাভের কারণগুলি), মনের স্বাভাবিক পবিত্রতা ইত্যাদিকে গভীরভাবে পরীক্ষা করা উচিত। আমাদের বিরক্তিকর আবেগ এবং বিভ্রান্তি কি আমাদের মনের মৌলিক অঙ্গ? যদি তারা এরকম হতো তাহলে এর অর্থ হ’ল প্রতি মুহূর্তে তারা সেখানে থাকত। তারা যদি না হয়, তাহলে তারা অস্থায়ী। যদি এরকম হয়, তাহলে তাদের কি এমনভাবে নিবারণ করা যেতে পারে যাতে তারা আর ফিরে না আসে?

এর সম্পর্কে প্রশ্ন করা এবং এটা নিয়ে শাস্ত্রার্থ করা নিতান্ত প্রয়োজন। এটা অবশ্যই এমন কিছু নয় যা অন্ধবিশ্বাসের ভিত্তিতে বিশ্বাস করা উচিত। বাস্তবে আমরা যত প্রশ্ন করব ততই ভাল, কারণ আমাদেরকে সমস্ত রকমের সন্দেহ পরিষ্কার করতে হবে এবং আমরা যা করছি তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস জাগাতে হবে। আমাদের মধ্যে ১০০% বিশ্বাস না জাগা পর্যন্ত আমাদের কি করতে হবে? বেশ, সেটা একটা সহজ প্রশ্ন নয়। আমরা কীভাবে জানতে পারব যে, আমরা কখন পুরোপুরি নিশ্চিত হব? এটা অনেক লম্বা সময় নিতে পারে।

আমরা যদি মনে করি এটা আবর্জনা তাহলে স্পষ্টতই আমরা এটা নিয়ে কাজ করতে পারব না। কিন্তু আমরা যখন বিবেচনার দিকে গিয়ে ভাবি যে, এসব কিছু সম্ভব তাহলে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। তবুও এটা সত্য, এরকম ভাবাটা কোনও কিছুর ভিত্তিতে হওয়া উচিত, কেবল অন্ধবিশ্বাস অথবা “আমরা শিক্ষক এইরকম বলেছেন”, এসবের ভিত্তিতে নয়। বুদ্ধ নিজেই বলেছেন, “আমি বলেছি বলে শ্রদ্ধার ভিত্তিতে বিশ্বাস করবেন না, বরং এমনভাবে পরীক্ষা করুন যেন আপনি সোনা কিনছেন।” এটা আসলে সত্য কিনা সেটা আমাদের পরীক্ষা ক’রে দেখা প্রয়োজন।

পুনর্জন্মের প্রতি বিশ্বস্ত হওয়া সেরকোঙ্‌ রিনপোছের দুটি জীবনকালের ঘটনা

একটি সত্য ঘটনা হিসাবে পুনর্জন্মের প্রতি বিশ্বাস জাগানো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হতে পারে। আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি কারণ আমি বহু বছর ধরে এটা নিয়ে কাজ করেছি। আমি ৪৫ বছরেরও বেশী সময় ধরে বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়ন করছি। এক পর্যায়ে আমি অবশ্যই কারণের ভিত্তিতে একটা বৌদ্ধিক বোধগম্যতায় পৌঁছেছি যে একটি সত্য ঘটনা হিসাবে পুনর্জন্মের প্রতি বিশ্বাস জাগানো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হতে পারে। আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি কারণ আমি বহু বছর ধরে এটা নিয়ে কাজ করেছি। আমি ৪৫ বছরের বেশী সময় ধরে বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়ন করছি। এক পর্যায়ে আমি অবশ্যই কারণের ভিত্তিতে একটা বৌদ্ধিক বোধগম্যতায় পৌঁছেছি যে, কেন পুনর্জন্মের বিষয়টা অর্থপূর্ণ। তবে যে বিষয়টা আমাকে লাইন থেকে প্রক্ষিপ্ত করেছে এবং আবেগপ্রবণ অন্ত্রের স্তরে আমার মধ্যে বিশ্বাস জাগিয়েছে সেটা হ’ল জীবনের দুটি সময়কালে আমার শিক্ষকের সাথে আমার সম্পর্ক। তাঁর নাম সেরকোঙ্‌ রিনপোছে এবং তিনি হলেন পরম পূজ্য দালাই লামার একজন অন্যতম শিক্ষক; তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ শিষ্য হতে পেরে আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করতাম। আমি নয় বছর তাঁর সাথে ছিলাম। ঐ সময় আমি তাঁর জন্য অনুবাদ করেছিলাম এবং তাঁর ব্যক্তিগত সচিব রূপে কাজ করেছিলাম। আমি তাঁর সমস্ত বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলাম ও তাঁর সাথে ছিলাম আর খুব ঘনিষ্ঠভাবে তাঁর সাথে কাজ করেছিলাম। ১৯৮৩ সালে তিনি তাঁর দেহবসান ঘটে এবং পুনঃ জন্মগ্রহণ করেন আর তিব্বতী ট্রুল্কু ব্যবস্থায় তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়।

তাঁর বয়স এখন ২৫ বছর এবং তাঁর সাথে আমার এখনও একটা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে যেমনকি আগেরটার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। অবশ্যই এখন বয়সের পার্থক্যের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। 

যখন নতুন সেরকোঙ্‌ রিনপোছের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় তখন তাঁর বয়স ছিল চার বছর। তারপর আমি যখন তাঁর কক্ষে প্রবেশ করেছিলাম তখন তাঁর পরিচারকরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি কি জানেন ইনি কে?” “বোকামি কর না। আমি অবশ্যই জানি ইনি কে?”, এই ছিল তাঁর উত্তর। শুরু থেকেই একজন চার বছর বয়সী হিসাবে তাঁর দিক থেকে, তিনি আমার প্রতি অন্য লোকজনদের চেয়ে বেশী অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং স্নেহশীল ছিলেন। বড় হওয়ার সাথে-সাথে এরকমই রয়ে গেছে। 

বিভিন্ন সময়ে আমরা তাঁর পূর্ব জীবনের ভিডিওগুলি দেখেছি। ভিডিওগুলি দেখে তিনি আমাকে বলতেন, তিনি কোনও নিরর্থক কথা বলতেন না, “ওহ আমার ঐ কথা মনে আছে।” সমস্ত যুক্তি এবং কারণ ছাড়াও সত্যিই এই অভিজ্ঞতাটি অর্থাৎ “ভাল, হতে পারে, সম্ভবতঃ…”, এই অনুভূতির বাইরে যেতে সাহায্য করেছিল। এটা আমাকে নিশ্চিত করেছিল। 

এই জিনিসগুলি সহজ নয়। আসলে মোক্ষ লাভ করা কি সম্ভব? চিত্তের স্বভাব কি সত্যিই শুদ্ধ? এমনকি আমরা যদি যুক্তিসঙ্গতভাবে বুঝতেও পারি, কিন্তু আবেগপ্রবণভাবে বুঝতে আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। তবেই আমরা ধীরে-ধীরে এটা নিয়ে কাজ করতে পারব। 

অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মের কারণ হিসাবে বাস্তবতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি

মার্গক্রমে (লাম-রিম) অনুপ্রেরণার মধ্যবর্তী স্তরে আমাদের কাছে পুনর্জন্ম পদ্ধতির এক খুব বিশদ ব্যাখ্যা আছে যা প্রতীত্যসম্যুৎপাদের দ্বাদশ অঙ্গের সাথে যুক্ত। এটা একটা খুবই জটিল পদ্ধতির নাম যা কর্ম, কর্মফল ইত্যাদি, এর পুরো বিষয়টার সাথে সম্পর্কিত। ক্রোধ ও লোভের মতো বিভিন্ন ধরণের বিরক্তির আবেগগুলি কীভাবে উত্থাপিত হয় এবং কার কারণে সেগুলি অন্তর্নিহিত হয় সেটাকে আমাদের গভীরভাবে বুঝতে হবে। খুব সাধারণভাবে, আমি এই অন্তর্নিহিত উপাদানটিকে “বিভ্রান্তি” হিসাবে উল্লেখ করি যেখানে আমরা অন্যের উপর এবং নিজের উপর আমাদের আচরণের প্রভাব সম্পর্কে বিভ্রান্ত। আরও গভীরভাবে বলতে গেলে, আমরা বাস্তবে কীভাবে আমাদের অস্তিত্ব এবং অন্যের অস্তিত্ব এবং সমস্ত কিছু কীভাবে বিদ্যমান সেগুলির সম্পর্কে বিভ্রান্ত।

আমার অন্যের উপর এবং নিজের উপর আমাদের আচরণের প্রভাব সম্পর্কে বিভ্রান্ত। আরও গভীরভাবে বলতে গেলে, আমরা বাস্তবে কীভাবে আমাদের অস্তিত্ব এবং অন্যের অস্তিত্ব এবং সমস্ত কিছু কীভাবে বিদ্যমান সেগুলির সম্পর্কে বিভ্রান্ত।

মূলতঃ আমরা ভাবি যে, বস্তু স্বাধীনভাবে বিদ্যমান, সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব শক্তি দ্বারা, এবং অন্য সবকিছু থেকে পৃথক, এমন যেন সেগুলি প্লাস্টিকে মোড়া। এমনকি আমরা যদি মনে করি যে, সবকিছু একে-অপরের সাথে সম্পর্কিত তাহলে আমরা ভাবব যে, সেগুলি নিজেরাই প্লাস্টিকে মোড়া কিন্তু লাঠিগুলির সাথে সংযুক্ত। সূক্ষ্মতার অনেক স্তর আছে যেগুলিকে বিদ্যমান থাকা রূপে আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, অসম্ভবটা কী এবং আমাদের বিভ্রান্তিটি প্রত্যেককে এবং সমস্ত কিছুর উপরে ঠিক কীভাবে অভিক্ষেপ করে, সেটাও অবশ্যই আমাদের বুঝতে হবে।

শূন্যতাঃ অস্তিত্বের সম্ভাব্য উপায়গুলির পূর্ণ অনুপস্থিতি

আমাদের যা বোঝার প্রয়োজন সেটাকে “শূন্যতা” বলা হয়। শূন্যতা মানে পূর্ণ অনুপস্থিতি অর্থাৎ সেখানে কিছু নেই। সেখানে যেটা নেই সেটা হ’ল এই অভিক্ষেপগুলির প্রকৃত রেফারেন্ট। সেগুলি বাস্তবের সঙ্গে মেল খায় না। 

আমরা সান্তা ক্লজের উদাহরণ ব্যবহার করতে পারি। ধরুন, আমরা লাল স্যুট পরা লম্বা সাদা দাড়িযুক্ত কাউকে দেখতে পাই এবং তাঁকে আমরা “সান্তা ক্লজ” নামে অভিহিত করি। আমাদের মনে হয় সে সান্তা ক্লজ। তবে কেন? ঠিক আছে, কারণ তাকে সান্তা ক্লজের মতো দেখায়। তবে সান্তা ক্লজের উপস্থিতি বাস্তবের সাথে কোনও মেল খায় না কারণ সেখানে কোনও আসল সান্তা ক্লজ নেই। এটাই তাই যা শূন্যতা রূপে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ সত্যিকারের সান্তা ক্লজের অনুপস্থিতি যা এই ব্যক্তির উপস্থিতির সাথে মেল খায়। এটা কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না যে সেখানে একজন ব্যক্তি আছে এবং সে সান্তা ক্লজের মতো দেখতে। আমরা শুধু স্পষ্ট করি যে লোকটা আমাদের কাছে যেভাবে প্রদর্শিত হয় সেটা হ’ল ভ্রম। এটা সান্তা ক্লজের মতো দেখতে কিন্তু আসল সান্তা ক্লজ নয় কারণ সেখানে এমন কোনও বস্তু নেই।

আমাদের মন সবসময় এইভাবে কাজ করে। আমরা সব ধরণের বাজে কথা অভিক্ষেপ করি, যেমন এই ব্যক্তিটি সবচেয়ে সুন্দর ব্যক্তি, বা ঐ ব্যক্তিটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যক্তি, অথবা আমরা বিশ্বের জন্য ঈশ্বরের উপহার অথবা তাঁর পরিবর্তে আমরা একবারে অনর্থক। আমরা এই বিষয়গুলি এমনভাবে অভিক্ষেপ করি যেন আমরা বা তারা সেরকম ভাবে অস্তিত্বে ছিলাম যা অন্য সবকিছুর থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন আর এমন যেন এটা সত্যি এবং অপরিবর্তনশীল।

বাস্তবে কেউ সেভাবে অস্তিত্বে নেই। আসলে এটা অসম্ভব কারণ সবকিছু অন্যান্য বস্তুর সাপেক্ষে বিদ্যমান। পরম পূজ্য দালাই লামা সবসময় আমাদের আঙ্গুলের উদাহরণ ব্যবহার করেন। যেমন, আমাদের চতুর্থ আঙ্গুলটি বড় না ছোট? বেশ, এটা পঞ্চম আঙ্গুলের তুলনায় বড় তবে মধ্যম আঙ্গুলের তুলনায় ছোট। সুতরাং নিজের দিক থেকে, নিজের শক্তিতে এটা বড় না ছোট? কোনও উত্তর নেই, কারণ এটা অন্যান্য জিনিসের সাপেক্ষে কেবল বড় বা ছোট। এটা সম্পূর্ণরূপে অন্যান্য জিনিসের উপর নির্ভরশীল। এবং কোনটা বড় বা কোনটা ছোট সেটা আমাদের ধারণার উপর নির্ভর করে। মনে হয়, আপনারা ধারণাটা বুঝতে পেরেছেন।

এই মধ্যবর্তী স্তরে আমরা শূন্যতাকে বোঝার মাধ্যমে এই মৌলিক ভুল বোঝাবুঝি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কাজ করি। এই চরম বিভ্রান্তিই অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুনর্জন্মের কারণ হয় কারণ এটা কর্ম ও কর্মফলকে সক্রিয় করে, যেমন- প্রতীত্যসমুৎপাদের দ্বাদশ অঙ্গের জটিল ব্যবস্থায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

একাগ্রতা এবং নৈতিক-স্ব-অনুশাসনের প্রয়োজন

শূন্যতার বোধিগম্যতা অর্জনের জন্য আমাদের মধ্যে একাগ্রতা থাকা দরকার। একাগ্রতা বিকাশের জন্য আমাদের নৈতিক অনুশাসন থাকা দরকার। প্রদত্ত উদাহরণটি হ’ল একটা গাছ কাটাকে বোঝার মতো। বোধগম্যতা হ’ল একটা ধারালো কুঠারের মতো কিন্তু বাস্তবে একটা গাছ কেটে ফেলার জন্য আমাদের সবসময় একই জায়গায় আঘাত করা উচিত। একই জায়গায় ক্রমাগত আঘাত করা হ’ল একাগ্রতার মতো। প্রকৃতপক্ষে কুঠারটিতে তুলতে, দুলতে এবং একই জায়গায় আঘাত করতে আমাদের প্রয়োজন শক্তি। এই শক্তি জন্ম নেয় নৈতিক আত্ম-শৃঙ্খলা থেকে যেখানে আমরা ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করা থেকে বিরত থাকি।

মধ্যবর্তী সুযোগটিও সম্বরের বিভিন্ন বর্গ উপস্থাপন করে যা গ্রহণ করা যেতে পারে। এর মধ্যে ভিক্ষু, শ্রামণের বা শ্রামণেরিকা, অথবা উপাসক বা উপাসিকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উপাসক বলতে এমন কাউকে বোঝায় যে মঠে বা বিহারের থেকে জীবন-যাপন করে না। কিন্তু এর অর্থ অগত্যা এই নয় যে তাঁর পরিবার আছে; এটা একজন একক ব্যক্তিকেও বোঝায়। প্রাচীন ভারতে, বাস্তবে এটা খুবই বিরল ছিল, কারণ গৃহস্থ, উপাসকদের প্রায় সবসময় একটা পরিবার থাকত। এই ভিক্ষু এবং গৃহস্থ উপাসক সম্বরকে সম্মিলিতভাবে “প্রাতিমোক্ষ সম্বর” বলা হয় কারণ এগুলি নিজস্ব মুক্তির জন্য নির্ধারিত। এই সম্বরগুলি আমাদের বিভিন্ন ধরণের চর্যা বা আচরণ ত্যাগ করতে সহায়তা করে যা সম্ভবতঃ বিরক্তিকর আবেগের কারণে অনুপ্রাণিত এবং যা আমাদের ধ্যান অনুশীলন ও ইতিবাচক বিষয়গুলিতে হস্তক্ষেপ করে।

বাস্তবে সম্বর গ্রহণ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেন? কারণ আমরা যখন কখনও কিছু পুনরায় না করার সম্বর গ্রহণ করি তখন সেটা আমাদের দ্বিধা থেকে মুক্তি দেয়। উদাহরণস্বরূপ, কল্পনা করুন যে, আমরা মদ বা সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রত্যেক বার আমরা মদ্যপান করা বা ধূমপান করা লোকেদের সাথে থাকি এবং তখন আমাদের মধ্যে একটা দ্বিধা থাকে যে আমাদেরও এটা পান করা উচিত অথবা এখন আমাদের বলা উচিত “না”। এমনকি আমরা যদি সত্যিই ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করি তাহলেও প্রতিবার যখন এই পরিস্থিতি ঘটে তখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং চাপ যদি নাও হয়, এটা একটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

আমরা যদি সম্বর গ্রহণ করি তাহলে সেটা হবে চূড়ান্ত। কারণ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, “আমি মদ্য পান করব না। আমি ধূমপান করব না।” অথবা এটা যাই হোক না কেন। তাহলে আমাদের চারপাশের প্রত্যেকে মদ্যপান করে কিনা তাতে আসলে আমাদের কিছু যায় আসে না, কারণ আমরা এর জন্য মনস্থির করে ফেলেছি। কোনও বিধিনিষেধ বা শাস্তির পরিবর্তে এই সম্বরগুলি গ্রহণ করলে আমাদের প্রচুর শক্তি প্রদান করতে পারে এবং আমাদেরকে দ্বিধা থেকে মুক্তি দিতে পারে, বিশেষ করে এমন বিষয়গুলির সম্পর্কে যা আমাদের চূড়ান্ত মুক্তি অর্জনের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

বৌদ্ধধর্মে কোনও সম্বর গ্রহণ করার বাধ্য-বাধকতা নেই। আমাদের অবশ্যই এটা বুঝতে হবে। কেউ বলতে পারে না যে আপনাকে এই সম্বরটা বা ঐ সম্বরটা গ্রহণ করতে হবে এবং কেউ বলে না যে আপনাকে ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী হয়ে মঠে থাকতে হবে। তবে আপনি যদি মঠে থাকতে এবং নিজেকে চিরকাল রাগ, আসক্তি, লোভ ইত্যাদির হাথ থেকে মুক্ত করার বিষয়ে গম্ভীর হন তাহলে নির্দিষ্ট সম্বর গ্রহণ করাটা এরজন্য অবশ্যই সহজসাধ্য হবে। সম্ভবতঃ আমরা এখনই তাঁর জন্য প্রস্তুত নই, তবে এটা একদম সঠিক। আমাদের নিজেকে এবং নিজস্ব পরিস্থিতিকে সৎভাবে মূল্যায়ন করা দরকার।

এটাই মধ্যবর্তী সুযোগ। যদিও একাগ্রতা এবং শূন্যতা এটার একটা অংশ কিন্তু সেগুলি এখনও পুরোপুরি আলোচনা হয়নি। এই বিষয়গুলি সম্পূর্ণরূপে উন্নতমানের সুযোগ-শিক্ষায় দেখা যায়। 

অনুপ্রেরণার উন্নত স্তরঃ অন্য সকলের চিন্তা-ভাবনা

একটা উন্নত সুযোগের সাথে আমরা জগতের একমাত্র জীব না হওয়ার প্রসঙ্গে চিন্তা-ভাবনা করি। যেমন- অন্য সকলেই সেখানে আছে এবং অন্য সকলে ঠিক সেই পরিস্থিতিতে আছে যেমনকি আমরা আছি। সকলেই দুঃখ ভোগ করছে এবং অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মগ্রহণ করে চলছে। আমরা চাই স্থিতিশীল সুখ আর চাই দুঃখ এড়াতে। ঠিক একইভাবে অন্য সকলেই চায়। এইভাবে আমরা সকলে একেবারে সমান। এটা শুধু আমি এবং বাছাই করা কয়েকজনকে বোঝায় না, বরং প্রত্যেক সত্ত্বকে বোঝায়। আমরা সকলেই একে-অপরের সাথে পরস্পর নির্ভরশীল। আমরা কেউ নিজের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বে নেই। বাস্তবে আমরা সেভাবে জীবিত থাকতে পারি না।

সকলকে সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমাদের হৃদয়কে প্রসারিত করার জন্য বেশ কয়েকটি বাস্তব কৌশলগত পদ্ধতি আছে। এই বিষয়ে আমরা আগে কিছুটা আলোচনা করেছি যে, সকল প্রাণীদের নিজের মা সমান স্বীকার করতে হবে এবং তারা অবিশ্বাস্যভাবে আমাদের প্রতি সদয় হয়ে আছেন। একটা ধর্ম-লাইট সংস্করণ আছে যেখানে আমরা দেখতে পাই যে, অন্যরা কীভাবে আমাদের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে মায়ের মতো হওয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে এর সীমাবদ্ধতা আছে, কারণ এটাকে আমাদের বন্ধু মশার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা কঠিন।

মৈত্রী

আমাদের হৃদয় প্রসারিত করতে শুরু করার জন্য, আমরা যাকে “মৈত্রী” বলি তাঁর বিকাশ করতে শুরু করি। প্রক্রিয়াটি আসলে সমতার সাথে শুরু হয় যেখানে আমরা কিছু লোকের প্রতি আকৃষ্ট হই না, অন্যদের দ্বারা প্রতিহত করা হয় এবং বাকীগুলির প্রতি নিরপেক্ষ। আমরা সকলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার জন্য কাজ করি এবং এর ভিত্তিতে প্রত্যেকের সাথে আমাদের আন্তঃসংযোক স্বীকার করি। যুক্তির মাধ্যমে এটা বিকাশ করা যেতে পারে যে, প্রত্যেক প্রাণী পূর্বজন্মে আমাদের মা ছিলেন এবং তারা আমাদের প্রতি অত্যন্ত সদয় ছিলেন অথবা শুধু এটা স্বীকার ক’রে যে, আমরা যে সমস্ত কিছু উপভোগ করি এবং ব্যবহার করি সে সবকিছু কীভাবে অন্যের কর্মের কারণে আসে। একবার শুধু আপনার পায়ের নীচের মেঝেটাকে, যে ভবনে আপনি রয়েছেন, যে জল আপনি পান করেন সেগুলি দেখুন। আমরা কি একবারও ভাবি যে, এসবকিছু কোথা থেকে আসে? আমাদের জল এবং আহার এখানে আসল কীভাবে? এসবকিছু অন্যের পরিশ্রম আমাদের চারপাশের প্রত্যেকের প্রচেষ্টা থেকে আসে। আমরা সকলেই সমান এবং তাই জন্য শুধু আমাদের নিজেদের লাভের জন্য কাজ করা অযৌক্তিক, কারণ প্রকৃতপক্ষে নিজের উপকার করতে হলে, আমাদেরকে সকলের উপকার করতে হবে।

এর ভিত্তিতে আমরা প্রত্যেকের জন্য সমানভাবে মৈত্রী বিকাশ করতে সক্ষম হই। এই মৈত্রী প্রত্যেকটা সত্ত্ব সুখী হওয়ার জন্য এবং সুখের কারণে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা হিসাবে সঞ্চায়িত করা হয়। প্রণয়মূলক প্রেমের সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই, যা সাধারণতঃ গভীর আসক্তির সাথে মিশ্রিত থাকে। আমরা যখন বলি, “আমি তোমাকে ভালবাসি”, এর অর্থ সাধারণত এই হয় যে, আমার তোমাকে দরকার। আমাকে কখনও ত্যাগ কর না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।” আমরা যখন অন্য ব্যক্তির কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত মনোযোগ না পাই বা যখন তারা অশ্লীল কিছু বলে তখন শীঘ্রই এটা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, যেমন, “আমি তোমাকে আর ভালবাসি না।”

বৌদ্ধধর্মে আমরা যে ধরণের প্রেমের (মৈত্রী) কথা বলছি তার মানে অন্যরা কীভাবে আচরণ করে বা তারা আমাদের প্রতি কী করে তার সাথে একেবারেই কোন সম্পর্ক নেই। এটা কেবল ইচ্ছা যে আপনি সুখী হন। এটার মানে অন্য সবাই আমার শরীরের একটা অংশের মতো অর্থাৎ যেমন আমরা চাই যে, আমাদের সমস্ত পায়ের আঙ্গুঁলগুলি যেন সুখী হয়, শুধু কয়েকটা বিশেষ আঙ্গুঁল নয়। আমাদের পায়ের আঙ্গুঁলগুলি আমাদের জন্য কী করে সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়।

করুণা

মৈত্রীর সাথে আমরা এবার “করুণার” বিকাশ করি। এটা হ’ল অপরের জন্য একটা ইচ্ছা যে তারা দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হোক। এখানে দুঃখ বলতে শুধু অগভীর স্তরের দুঃখ, জীবনের উত্থান এবং পতনকে বোঝায় না, বরং অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্মের মতো গভীরতর প্রকারের দুঃখকেও বোঝায়। করুণাবোধের অর্থ এই নয় যে, আমরা অন্যের দিকে তাকালাম আর তাদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করলাম, যেমন, “ওহে, বেচারা!” বৌদ্ধ করুণা শ্রদ্ধা এবং এক প্রকারের বোধগম্যতার উপর আধারিত যে, অন্য সকলের পক্ষে দুঃখ এবং দুঃখের কারণ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। এটা শুধু একটি সুন্দর ইচ্ছা বা মিষ্টি শব্দকে বোঝায় না। করুণার মাধ্যমে আমরা সত্যিই দুঃখমুক্ত অবস্থা গঠনের দায়িত্ব নিতে শুরু করি। সেখানে থাকে অনেকানেক সাহস। 

আমরা যখন একটা জিনিস বিকাশ করি যা “মহাকরুণা” নামে পরিচিত, তখন আমাদের করুণা সমস্ত প্রাণীর প্রতি সমানভাবে লক্ষ্য করা হয় এবং প্রত্যেককেই এমনভাবে বিবেচনা করা হয় যেমন একজন স্নেহময়ী মা তার একমাত্র সন্তানের প্রতি উদ্বিগ্ন থাকে। আমাদের মহাকরুণার অনুভূতিতেও প্রত্যেককে আর বেশী দুঃখ ভোগ করার হাত রক্ষা করার ইচ্ছা থাকে।

অধ্যাশয় (ব্যতিক্রমী সংকল্প)

আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপটি হ’ল “ব্যতিক্রমী সংকল্প” নামে মানবিক অবস্থার বিকাশ করা। এটা একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত যার ফলে আমরা অন্যকে আরও বেশী অগভীর মাত্রায় নয়, বরং আরও গভীরভাবে সহায়তা করার জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করি। আমরা অন্যকে বুদ্ধের সম্পূর্ণ জ্ঞানদীপ্ত অবস্থায় পৌঁছতে সহায়তা করার জন্য দায়িত্ব নেওয়ার সংকল্প করি। আমরা কেবল এটা করার ইচ্ছা করি না, বরং মনস্থির করে ফেলি যে, আমরা অবশ্যই এটা করতে যাচ্ছি।

বোধিচিত্তঃ অন্য সকলের কল্যাণের জন্য বোধিলাভের লক্ষ্য

এই অনুক্রমের চুড়ান্ত পর্যায়টি হ’ল আমরা যাকে “বোধিচিত্ত” বলি তার বিকাশ করা। এটাই মৈত্রী, করুণা এবং অধ্যাশয় (ব্যতিক্রমী সংকল্প)-এর আধার। এর বিকাশ করলে আমরা বুঝতে পারব যে, যদি আমরা নিজেরাই বুদ্ধের অবস্থা লাভ করি তাহলে সেটাই হবে একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে আমরা সকলকে সর্বোত্তম ভাবে সহায়তা করতে পারব। তবে, এই আকাঙ্ক্ষাটি বাস্তবসম্মত হওয়ার জন্য আমাদের বুঝতে হবে যে, বুদ্ধ কী, কীভাবে বুদ্ধ অপরের সহায়তা করতে পারে এবং কীভাবে পারে না। মনে রাখবেন, বুদ্ধ কোনও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নয় যে নিজের চুটকি বাজিয়ে দিল আর সকলের দুঃখ দূর হয়ে গেল। একজন বুদ্ধ অবশ্যই অন্যদের মার্গদর্শন করতে পারে এবং তাদের প্রেরণা দিতে পারে, তবে সমস্ত কাজ কিন্তু আমাদের নিজেকে করতে হবে। অন্য কেউ আমাদের বাস্তবতা বুঝতে পারে না; এটা আমাদের নিজেকেই বুঝতে হবে।

এই ভাবে মৈত্রী এবং করুণা দ্বারা পরিচালিত বোধিচিত্তকে আমাদের নিজস্ব ভবিষ্যতের বোধিলাভের জন্য দৃষ্টিনিবদ্ধ করা হয়। এটা আমাদের নিজস্ব বোধি, বুদ্ধ শাক্যমুনির বোধি বা অন্য সাধারণ বোধি নয়। আমাদের বোধি এখনও লাভ হয়নি তবে আমাদের চিত্ত-সন্ততিতে বিদ্যমান তথাগতগর্ভ-এর কারণগুলির ভিত্তিতে এটা হতে পারে এবং হবে।

এই কারণগুলি এর মৌলিক নির্মল স্বভাব এবং এর সমস্ত সম্ভাব্যতা ও সম্ভাবনা অন্তর্ভুক্ত করে। আমরা এটাকে লাভ করার উদ্দেশ্যের সাথে এখনও অনুপলব্ধ বোধিকে মনোনিবেশ করি যাতে আমরা যতটা সম্ভব অপরের কল্যাণ করার ইচ্ছা করতে পারি।

এটাই বোধিচিত্ত। এটা একটা অবিশ্বাস্যরূপে বিশাল অবস্থা এবং চিত্ত, আর শুধু মৈত্রী এবং করুণার উপর ধ্যান করার জন্য আমাদের এটাকে ভুল করা উচিত না। এটা শুধু তাই নয়। মৈত্রী এবং করুণা হ’ল আধার, কিন্তু বোধিচিত্ত অনেক বেশী, আরও অনেক কিছু।

ষট্‌ পারমিতা (ছয়টি পারমিতা)

যেমনটি আমরা দেখেছি, উন্নত সুযোগের মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্যটি হ’ল বুদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত করা যাতে আমরা যতটা সম্ভব অপরের সহায়তা করতে পারি। আমরা মৈত্রী, করুণা এবং ব্যতিক্রমী সংকল্প দ্বারা পরিচালিত হই। কিন্তু বাস্তবে আমরা এই বোধিটা লাভ করব কীভাবে? এটা আমাদেরকে ছয়টি পারমিতার উপস্থাপনায় যুক্ত করে। একে সংস্কৃত ভাষায় “ষট্‌ পারমিতা” বলা হয় আর আমি সাধারণত এটাকে “ছয়টি সুদূরপ্রসারী মনোভাব” রূপে অনুবাদ করি। আমি এই শব্দাবলীটা পছন্দ করি কারণ তারা অনেক দূরে নিয়ে যায় আর আমাদের বুদ্ধের জ্ঞানদীপ্ত অবস্থানে নিয়ে যায়। কিছু লোকের জন্য, “পারমিতা” শব্দটি ব্যবহার করা হয় যার অর্থ দাঁড়ায় যে, তাদেরকে নিখুঁত হতে হবে যারা এখনও হয়নি, যার কারণে তারা অপর্যাপ্ত বোধ করেন। এখানে এই শব্দাবলীটা ঐ অর্থ উৎযাপন করে না।

দান

আমাদের সর্বপ্রথম যে মনোভাবটা বিকাশ করা প্রয়োজন সেটা হল দান, যেখানে আমরা অপরকে কেবল বস্তুগত জিনিস দিই না বরং তার সাথে পরামর্শ, শিক্ষা এবং নির্ভয় প্রদান করি। আমাদের কাছে অর্পন করার মতো কোন উপাদান না থাকলেও যা প্রয়োজন আমরা সেটা দেওয়ার জন্য আগ্রহী মনোভাব গড়ে তুলি। আর একটি উপহার যেটা আমরা দিতে পারি সেটা আমরা কীভাবে অন্যের সাথে আচরণ করি। যেহেতু আমাদেরকে সমতা বিকাশ করতে হয় অতএব এর অর্থ এই বোঝায় যে, অন্যদেরকে আমাদের কাছে ভয় পাওয়ার কিছু থাকে না। আমরা অন্যের উপর রাগ করব না, তাদের প্রতি আসক্ত হব না বা তাদের কাছ থেকে কিছু পেতে চাইব না। আমরা অন্যদের অগ্রাহ্য করব না বা যখন তারা এমন কিছু করে যা আমরা পছন্দ করি না তখনও আমরা তাদের প্রত্যাখ্যান করব না। তদতিরিক্ত আমরা সত্যিই এবং আন্তরিকভাবে তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করে যাব। এটা আসলে একটা অবিশ্বাস্য উপহার যা আমরা কাউকে দিতে পারি, একটা বিশাল উপহার যা আমরা দানের সাথে বিকাশ করি।

নৈতিক স্ব-অনুশাসন

পরবর্তী সুদূরপ্রসারী মনোভাব যা আমরা বিকাশ করি যেটা হল নৈতিক আত্মশৃঙ্খলা যেখানে আমরা ধ্বংসাত্মকভাবে কর্ম করি না বরং যতটা সম্ভব গঠনমূলক কর্ম করি। অধ্যয়ন ও ধ্যান করা এবং অন্যদের সহায়তা করার জন্য আমাদের কাছে নৈতিকতা থাকে। আমরা কাউকে সহায়তা করতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি না এবং অন্যদের অবহেলা করি না কারণ তখন আমরা সহায়তা করার মতো অনুভব করি না।

ধৈর্য

ধৈর্য হ’ল ক্ষুব্ধ বা বিচলিত না হয়ে দুঃখ-কষ্ট ও অসুবিধা সহ্য করার ক্ষমতা। নিজের উপর কাজ করা এবং অপরকে সহায়তা করার চেষ্টা করা সহজ নয়; তার উপর অনেক লোককে সহায়তা করাটাতো মোটেই সহজ নয়। তারা আমাদের একটা কঠিন সময় দেয় এবং আমাদের তখন ধৈর্যের প্রয়োজন হয় যাতে আমরা রাগ না করি। অন্যান্য সমস্ত সুদূরপ্রসারী মনোভাবের মতো ধৈর্য বিকাশ করার অনেকগুলি পদ্ধতি আছে।

অধ্যাবসায় (প্রচেষ্টা)

পরবর্তী মনোভাব হল অধ্যাবসায় যেখানে আমরা কাউকে ত্যাগ করি না তা যতই কঠিন হোক না কেন। এই অর্থে এই সুদূরপ্রসারী মনোভাবটি হল বীরের সাহসের মতো। এখানে আমরা কেবল হাল ছেড়ে দিই না বরং অপরকে সহায়তা করার ক্ষেত্রেও আনন্দ বোধ করি আর সহায়তা করার সুযোগ পেয়ে সত্যিই খুশি হই। এটাকে কীভাবে বিকাশ করা যায় তার সম্পর্কে অনেক নির্দেশনা নির্ধারণ করা আছে এবং এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যে, এটাকে কখন শীথিল করা যায় এবং এর থেকে কখন বিরতি নেওয়া উচিত। আমরা যদি নিজের উপর প্রচন্ডভাবে চাপ সৃষ্টি করি তাহলে আমরা কাউকে সহায়তা করতে সক্ষম হব না। এর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরণের অলসতা কাটিয়ে ওঠার অনেকগুলি পদ্ধতি আছে। এই অলসতা আমাদের নিজের উপর কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং অপরকে সহায়তা করতে বাধার সৃষ্টি করে।

মানসিক স্থিতিশীলতা (ধ্যান)

এটা অনুসরণ ক’রে আমরা মানসিক স্থিতিশীলতা বিকাশের জন্য অনুশীলন করি। এটাতে শুধু সমাধি ছাড়াও আরও কিছু অন্তর্ভুক্ত হয়, যেমন, আবেগগত স্থিতিশিলতাও এর অন্তর্গতে আসে। আমাদের সেটা প্রয়োজন যেটা হ’ল মনের একটা স্থিতিশীল অবস্থা যা মানসিক বিক্ষেপতার প্রভাবের মধ্যে আসে না, আমাদের মন যখন আকর্ষণীয় বস্তুর দিকে উড়তে থাকে এবং মনটা যখন নিস্তেজ ও নিদ্রামগ্ন থাকে, তখনও স্থিতিশীলতা জাগে না। এই মনকে আমরা যেদিকে মনোনিবেশ করাতে চাই সেই দিকেই মনোনিবেশিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যখন আমাদের সাথে কথা বলে আমাদের মন বিক্ষিপ্ত হয় না অন্যান্য বিষয়ের কথা ভেবে। আমরা এই অর্থে স্থিতিশীল যে, আমাদের মধ্যে বিরক্তিকর আবেগ থাকে না যে আমাদের স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করে; আমরা গম্ভীর হয়ে যাই না। এর অর্থ হ’ল আমরা অতিরিক্ত সংবেদনশীল বা অসংবেদনশীল হই না, বরং ভারসাম্য এবং স্থিতিশীল হই।

প্রভেদমূলক সচেতনতা (প্রজ্ঞা)

এটাকে প্রায়শই “জ্ঞান” হিসাবে অনুবাদ করা হয় এবং সংস্কৃত ভাষায় এটা হ’ল প্রজ্ঞাপারমিতা। এই চুড়ান্ত মনোভাবটা বলতে বস্তু কীভাবে অস্তিত্বে আছে এবং কী অসম্ভব তার পার্থক্য করার ক্ষমতাকে বোঝায়। এটি একটি খুবই নির্দিষ্ট সচেতনতা এবং তাই জন্য “জ্ঞান” শব্দটা কিছুটা অস্পষ্ট। অসম্ভব জিনিসটা কী সেটা জানার জন্য আমরা সচেতনতার বিষয়ে কথা বলছি যার মধ্যে শূন্যতার জ্ঞান জড়িয়ে আছে। আমরা পার্থক্য করি যে, কিছু নির্দিষ্ট বিষয় হাস্যকর, কিছু অসম্ভব এবং কিছু কোনকিছুকে বোঝায় না।

আমরা সুদূরপ্রসারী মনোভাব, আমাদের লক্ষ্য, অনুপ্রেরণা, সংকল্প এবং বোধিচিত্ত বিকাশের এই অনুশীলন এবং পদ্ধতির সাথে কাজ করি। এই সমস্ত কিছুই অনুপ্রেরণার উন্নত সুযোগ গঠিত হয়।

সারাংশ

মধ্যবর্তী সুযোগের সাথে প্রাথমিক স্তরের ভিত্তি নির্মাণ ক’রে আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের আরও ভাল অবস্থায় পুনর্জন্ম হলেও তখনও আমাদের দুঃখ ভোগ করতে হবে। আমরা তখনও সমস্যাগুলি মুখোমুখি হব, অসুস্থ হতে হবে এবং মরে যেতে হবে। এরপরে এসব কিছু আবার করব; তারপর আবার। এর কারণে বিরক্ত হয়ে আমরা বুঝতে পারি যে, এই সমস্ত অনিয়ন্ত্রিত পুনর্জন্মগুলির মধ্যে নির্দিষ্ট বিশেষ কিছুই নেই। সেই জন্য আমরা এর থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্য রাখি।

আমরা যখন উন্নত স্তরের দিকে এগিয়ে যাই তখন আমরা নিজেকে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, জগতের কেন্দ্র হিসাবে চিন্তা-ভাবনা করা বন্ধ করে দিই। আমরা বুঝতে পারি যে, সুখ লাভ করতে এবং দুঃখ ত্যাগ করতে চাওয়াটা প্রত্যেকেই ঠিক আমার মতো। শুধু এটাই নয়, আমরা দেখতে পাই যে, সকল প্রাণী পূর্ববর্তী এবং বর্তমান উভয় জীবনে আমাদের প্রতি অবিশ্বাস্যভাবে সদয় হয়েছে। তারা না থাকলে আমরা খেতে বা পান করতে, পড়তে বা লিখতে, দোকানে যেতে, সিনেমা উপভোগ করতে অথবা কিছুই করতে সক্ষম হতাম না। এই কৃতজ্ঞতাটিকে উপেক্ষা করা আমাদের জন্য লজ্জাজনক হয়ে উঠেছে। ফলে বোধিচিত্ত বিকাশ করে আমরা তাদের প্রতি করুণা ও মৈত্রীর কারণে অনুপ্রাণিত হয়েছি এবং এর মাধ্যমে অপরের চূড়ান্ত কল্যাণ করার জন্য আমরা আমাদের নিজস্ব বোধি লাভ করতে ইচ্ছুক।

Top