ক্রোধঃ অশান্তকারী আবেগের সাথে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়

48:37
ক্রোধ হল কোন কিছু বা কারও প্রতি এক ধরণের প্রবল বিকর্ষণ যা আমাদের ভয়ভীত করে বা আমরা পছন্দ করি না। একটা অশান্তকারী আবেগ বা ক্লেশ হিসাবে এটা আমাদের মনের শান্তি নষ্ট করে দেয় এবং আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। তবে বিভিন্ন অনুশীলনের মাধ্যমে ধৈর্য বিকাশ ক’রে আমরা ক্রোধকে ত্যাগ ক’রে সুখী জীবনযাপন করতে পারি।

জীবনের সমস্যা

আমাদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই মনে করে যে আমাদের জীবনে নির্দিষ্ট সমস্যা আছে। আমরা সুখী হতে চাই। আমরা কোন রকমের সমস্যা চাই না, তাসত্ত্বেও আমাদের নিয়মিতভাবে নানা রকমের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কখনো কখনো আমরা হতাশ হয়ে পড়ি; আমরা অসুবিধার সম্মুখীন হই; এবং আমরা আমাদের কাজকর্মের প্রতি কুন্ঠিত হয়ে পড়ি, আমাদের সামাজিক অবস্থান এবং জীবন যাত্রাও পারিবারিক পরিস্থিতির কারণে আমরা হতাশ অনুভব করি। আমাদের মধ্যে কাঙ্খিত বস্তু না পাওয়ার সমস্যা আছে। আমরা সফল হতে চাই। আমরা শুধুই চাই আমাদের পরিবার এবং আমাদের ব্যবসায় ভাল কিছু ঘটুক কিন্তু এটা সবসময় হয় না। পুনরায় যখন আমাদের এই ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আমরা দুঃখী হয়ে পড়ি। কখনো-কখনো আমাদের সাথে এমন কিছু ঘটে যায় যেটা আমরা কখনোই চাই না যে সেটা ঘটুক, যেমন- অসুস্থ হয়ে পড়া, বৃদ্ধা অবস্থায় দুর্বল হয়ে যাওয়া অথবা শ্রবণ শক্তি বা দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলা। নিঃসন্দেহে, কেউ চায় না যে সেগুলি তার সঙ্গে ঘটুক।

কাজকর্ম বা ব্যবসা-বানিজ্য নিয়েও আমাদের সমস্যা আছে। কখনো-কখনো সময় খারাপ যায় আর সেই কারণে আমাদের ব্যবসার পতন হয় অথবা আমরা ব্যর্থ হই। এটা স্পষ্ট যে আমরা চাই না সেগুলি আমাদের সঙ্গে ঘটুক কিন্তু সেটা কোন কারণে ঘটেই যায়। কখনো-কখনো আমাদের ক্ষতি হয়, আমরা নিজেরা নিজেদেরই ক্ষতি করি; আমাদের সাথে দুর্ঘটনা ঘটে; আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি ইত্যাদি। এই সমস্ত জিনিস আমাদের সামনে সমস্যারূপে ঘটতে থাকে আমরা যার সম্মুখীন হই।

এগুলি ছাড়াও আমরা অনেক সময় মানসিক এবং মনোবৈজ্ঞানিক সমস্যারও সম্মুখীন হই। এগুলি এমন বিষয় হতে পারে যা আমরা অন্যদের সঙ্গে আলোচনা বা অন্যের কাছে প্রকাশ করার মতো অনুভব করি না। তবে ভিতরে-ভিতরে আমরা বুঝতে পারি যে এমন কিছু বিষয় আছে যা আমাদের অশান্ত করতে থাকে, যেমন- আমাদের সন্তানদের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের উদ্বেগ অথবা আমাদের ভয়। এর কারণে আমরা অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হই এগুলিকে আমরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুনরাবৃত্ত পরিস্থিতি বা সমস্যা বলি অর্থাৎ সংসার।

অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক সমস্যা হল সংসার

আমি পটভূমি এবং প্রশিক্ষণ একজন অনুবাদক হিসাবে লাভ করেছি। একজন অনুবাদক হিসাবে আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছি এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুবাদ করেছি আর বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে বক্তৃতাও দিয়েছি। আমি দেখেছি যে, সেখানে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। আমার মনে হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে যে ভুল ধারণা রয়েছে সেটা হল মূল শব্দাবলী এবং ধারণাগুলির অনুবাদ করার জন্য বেছে নেওয়া ইংরেজী শব্দাবলীর কারণে। তাদের মধ্যে অনেকগুলি শব্দ গত শতাব্দীতে ভিক্টোরিয়ান মিশনারী দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিল এবং ঐ শব্দাবলীগুলির বেশ শক্ত অর্থ আছে যা এশিয়ার ভাষায় ব্যবহৃত মূল শব্দাবলীর সংজ্ঞা বা অর্থ থেকে ভিন্ন। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা প্রায়শই সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করি। এটাকে সাধারণত ‘দুঃখ’ রূপে অনুবাদ করা হয়। আমরা যদি দুঃখ নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে অনেক মানুষের মনে এই ধারণা জাগে যে বৌদ্ধধর্ম একটা নিরাশাবাদী ধর্ম, কারণ এই ধর্মটা বলে যে প্রত্যেকের জীবন দুঃখে পরিপূর্ণ। এমনও মনে হয়, আমাদের সুখী হওয়ার কোন অধিকার নেই। আমরা যদি একজন আরামদায়ক, সমৃদ্ধশীল এবং ধনবান ব্যক্তির সাথে আলোচনা করি এবং বলি, “আপনার জীবন দুঃখে ভরা”, তাহলে সেই ব্যক্তিটি ভীষণ ভাবে প্রতিরক্ষামূলক হয়ে উঠবে। তিনি তর্ক ক’রে বলতে পারেন, “আপনি কী বলতে চাইছেন? আমার কাছে একটা ভিডিও রেকর্ডার আছে, একটি ভাল গাড়ি আছে এবং একটা ভাল পরিবার আছে। তাই আমার কোনও দুঃখ নেই।”

এখানে তাদের দ্বারা প্রদত্ত উত্তর যুক্তিসঙ্গত, কারণ ‘দুঃখ’ একটা ভারী শব্দ। এর পরিবর্তে একই বৌদ্ধ ধারণাকে যদি ‘সমস্যা’ হিসাবে অনুবাদ করি এবং তারপর আমরা কাউকে বলিঃ “আপনি যেই হন না কেন, আপনি যতই ধনী হন না কেন, আপনার যতই সন্তান থাকুক না কেন, প্রত্যেকেরই জীবনে কোন না কোন নির্দিষ্ট সমস্যা আছে”, তাহলে এটা এমনই এক ধরণের কথা হবে যেটা সকলেই গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হবে। সুতরাং আমি তিব্বতী পরম্পরা থেকে এই বৌদ্ধ ব্যাখ্যাগুলির সম্পর্কে আলোচনা করার সময় সাধারণত যে শব্দগুলি ব্যবহার করে থাকি তার থেকে একটু আলাদা ভাবে ব্যবহার করব।

অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক সমস্যা হল সংসার। আলগা অর্থে “সংসার” বলতে এমন পরিস্থিতিগুলিকে বোঝায় যাদের উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না এবং সেগুলি বারংবার ঘটতে থাকে, যেমন- সবসময় হতাশ হওয়া অথবা সবসময় চিন্তিত থাকা এবং ভয়ে ভয়ে থাকা। এখানে এই পরিস্থিতিগুলির প্রকৃত কারণ কী? বুদ্ধ কেবল এই কথা বলেননি যে কীভাবে এই প্রকৃত সমস্যার উত্থান হয় আমরা যেগুলির সম্মুখীন হই, বরং ঐ সমস্যাগুলির প্রকৃত কারণ আছে এবং সেগুলিকে উন্মুলন করাও সম্ভব। সেগুলিকে উন্মুলন করার উপায়, নিরোধসত্যকে প্রাপ্ত করার উপায় হল মার্গসত্যকে অনুসরণ করা যার অর্থ হল মনের সত্য পথের বিকাশ করা, নির্দিষ্ট কারণ গুলিকে উন্মুলন করার বোধগম্যতা বিকাশ করা। একবার যখন আমরা এই কারণগুলি থেকে মুক্ত হয়ে যাই তখন আমরা সমস্যা থেকেও মুক্ত হয়ে যাই।

সমস্যার মূলঃ একটা মূর্ত পরিচয়কে আঁকড়ে ধরে রাখা

এই অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্তিমূলক সমস্যার প্রকৃত কারণ, আমরা আমাদের জীবনে যেটার সম্মুখীন হই, সেটা হল আমাদের মধ্যে যথার্থ জ্ঞানের অভাব আছে। আমরা যে আসলে কে, অন্য লোকজনরা আসলে কারা, জীবনের আসল উদ্দেশ্য কী, জগতে বাস্তবে কী চলছে এই সমস্ত বিষয়ে আমরা অনভিজ্ঞ। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি “অজ্ঞানতার” পরিবর্তে “অনভিজ্ঞ” শব্দটা ব্যবহার করি। “অজ্ঞান” শব্দটা প্রয়োগ করলে মনে হয় কেউ যেন আমাকে বলছে যে আপনি মুর্খ এবং কিছুই বোঝেন না। এর পরিবর্তে আমরা কেবল কোন কিছুর বিষয়ে অনভিজ্ঞ হয়ে থাকি এবং যেহেতু আমরা অনভিজ্ঞ, তাই আমরা মনোবৈজ্ঞানিক স্তরে নিরাপত্তাহীন হিসাবে এটা অনুভব করি। এই নিরাপত্তাহীনতার কারণে আমরা এক ধরণের মূর্ত পরিচয়, একধরণের “আমি”-কে আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবৃত্তি দেখাইঃ “আমি জানি না আমি কে বা আমি কীভাবে অস্তিত্বশীল এবং তাই আমি এমন একটা বস্তুকে আঁকড়ে ধরে থাকি সেটা বাস্তব হবে, তা না হলে আমার সম্পর্কে হবে কোন কল্পনা, যার কারণে আমরা বলি যে এটা আমি, এটাই আমার প্রকৃত পরিচয়।”

উদাহরণ স্বরূপ, আমরা একজন পিতা হিসাবে একটা পরিচয়কে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারিঃ “এই যে আমি, আমিই পিতা, আমার পরিবারে আমাকে সম্মান পাওয়া উচিত। আমার সন্তানদের মধ্যে অবশ্যই আমার প্রতি সম্মান এবং আনুগত্যের একটা নির্দিষ্ট মনোভাব থাকা উচিত।” যদি আমাদের জীবনের দিকটাই একজন বাবা হিসাবে দেখি, তাহলে স্পষ্টতই এটা আমাদের কিছু অসুবিধায় ফেলতে পারে। এর কারণ হল যদি আমাদের সন্তানরা ঐরকম সম্মান না দেয় তাহলে সমস্যা তৈরী হবে। আমরা যদি কোন কার্যালয়ে থাকি, তাহলে মানুষ আমাদের “পিতা” হিসাবে বা সেই ধরণের সম্মানের যোগ্য ব্যক্তি হিসাবে দেখবে না। এটাও খুব বিরক্তিকর হতে পারে। আমি যদি আমার পরিবারের শাসক হই এবং তারপর আমি যখন কার্যালয়ে যাই তখন কার্যালয়ের অন্যান্য লোকজনরা যদি আমাকে তুচ্ছ মনে করে, আমাকে নিকৃষ্ট মনে করে আর আমাকে উলটে তাদের সম্মান প্রদানের পরিচয়কে খুব শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়, তাহলে আমরা তখনই দুঃখী হয়ে পড়ব যখন কার্যালয়ে অন্যান্য লোকজনরা আমাদের সাথে তেমনভাবে আচরণ না করবে।

আমাদের পরিচয় একজন সফল ব্যবসায়ী হতে পারেঃ “আমি একজন সফল ব্যবসায়ী। আমি এইরকমই; আমাকে এইরকমই হতে হবে।” কিন্তু যদি আমাদের ব্যবসা ব্যর্থ হয়ে যায় বা যদি ব্যবসা খুব খারাপ চলে, আমরা একেবারে ভেঙে পড়ি। কিছু লোকজন তো এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বসে অথবা যে কোন ধরণের ভয়াবহ কাজ করতে পারে যদি তাদের ব্যবসা খারাপ চলে, কারণ তারা এই শক্ত পরিচয় ছাড়া জীবন-যাপন করতে পারে না যে পরিচয়কে তারা আঁকড়ে ধরে থাকে।

অথবা আমরা আমাদের পরিচয় একজন কর্মঠ পুরুষ হিসাবে আঁকড়ে ধরতে পারিঃ “এই তো আমি; আমি একজন বীর, রূপবান এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তি।” কিন্তু একবার যখন আমরা বৃদ্ধ হতে শুরু করব এবং আমাদের পুরুষত্ব হারাতে থাকব, এটা আমাদের পাগল করে ফেলতে লাগবে। কিছু লোকজন তো একেবারে ভেঙে পড়তে পারে যদি তারা তাদের আত্ম-পরিচয়কে সেইভাবে ধরে রাখে। তারা এই বিষয়টা বুঝতেই চায় না যে জীবনে সবকিছুই পরিবর্তনশীল এবং তাদের ঐ পরিচয় চিরস্থায়ী নয়।

আমরা এটাও অনুভব করতে পারি যে আমরা হলাম একজন ঐতিহ্যবাহী বা পরম্পরাবাদী ব্যক্তি এবং সেইজন্য আমরা চাই যে সবকিছু যেন পরম্পরাগত পদ্ধতিতে হয়। কিন্তু যখন সমাজ পরিবর্তন হয় তখন তরুণরা পরম্পরাকে অনুসরণ করে না, যার উপর ভিত্তি ক’রে আমরা আমাদের পরিচয় স্থাপন করেছি, তখন আমরা প্রচন্ড রেগে যেতে পারি, দুঃখিত হতে পারি এবং আঘাত পেতে পারি। আমরা সত্যিই কল্পনা করতে পারি না যে আমরা কীভাবে এরকম একটা জগতে বাস করতে পারি যেখানে আমাদের পরম্পরাগত সেই চীনা রীতিনীতির অনুসরণ করা হচ্ছে না যে পদ্ধতিতে আমরা বড় হয়েছি।

অন্যদিকে, একজন যুবক হিসাবে আমরা আমাদের পরিচয়কে আধুনিক ব্যক্তি রূপে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারিঃ “আমি বিশ্বের একজন আধুনিক ব্যক্তি; আমার এই পরম্পরাগত মূল্যবোধের প্রয়োজন নেই।” যদি আমরা আমাদের এই ছবিকে খুব শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে রাখি এবং তারপর আমাদের মাতা-পিতা খুব জোর দিতে শুরু করেন যে, আমাদের পরম্পরাগত মূল্যবোধকে অনুসরণ করতে হবে আর তাদের সাথে পরম্পরাগত পদ্ধতিতে আচরণ করতে হবে, তখনও কিন্তু একজন তরুণ হিসাবে আমরা তার বিরোধীতা করতে পারি, আমাদের প্রচন্ড রাগ হতে পারে। আমরা হয়তো সেটা প্রকাশ করতে পারব না, তবে ভিতরে-ভিতরে আমরা সেটা অনুভব করব। এর কারণ হল, যেহেতু আমাদের পরিচয় তো একজন আধুনিক ব্যক্তি হিসাবে, তাই চীনা নববর্ষ দিবসে আমাদের পিতা-মাতার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার কোন প্রয়োজন নেই। ফলে এখানেও আমাদের অনেক রকমের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।

আমরা আমাদের পরিচয় নিজেদের পেশার সাথে যুক্ত করেও দেখতে পারি। যখন আমাদের ব্যবসা ব্যর্থ হয় এবং আমরা শুধু ভাবি যে আমাদের কেবল এই ব্যবসাই করতে হবে, তখন আমরা এই ব্যবসার প্রতি নরম হব না। আমরা যখন ঐ কাজটা করতে না পারি যেটা আমরা আগে করেছি তখন আমরা অনুভব করি যে আমাদের জন্য পৃথিবী শেষ হয়ে গেছে। আমরা একদম ভাবতে চাই না যে আমরা অন্য ব্যবসায়ও যুক্ত হতে পারি আর এটা আবশ্যক নয় যে আমাদের সবসময় এক ধরণের পেশার অনুশীলন করতে হবে।

আমরা নিজেদেরকে নিরাপদ বোধ করার উপায় হিসাবে এই ধরণের বিভিন্ন পরিচয়কে আঁকড়ে ধরে রাখি। আমাদের মনে কিছু পূর্ণ ধারণা থাকে, যেমন- আমরা কে, আমরা কেমন ধরণের জিনিস চাই। আমরা মনে করি এগুলি হল চিরস্থায়ী, এসব হল মূর্ত, এটা সত্যিই আমি। বাস্তবে যেটা ঘটে সেটাই হল এটা, আমাদের এই ধারণার উপর ভিত্তি ক’রে, এই স্ব-চিত্রের কারণে অনেক ধরণের অশান্তকারী মনোভাব পুষ্ট হয়। এটা এইজন্যই হয় কারণ আমরা অনুভব করি যে আমাদের পরিচয় এখনও অনিরাপদ। আর সেইজন্য আমরা ভাবতে থাকি আমাদের এই পরিচয়কে প্রমাণ করতে হবে এবং দাবী করতে হবে।

উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি মনে করি, “আমিই পরিবারের পিতা,” তাহলে আমাদের পক্ষে কেবল পরিবারের পিতা মনে করা যথেষ্ট নয়; আমাদের সেই প্রভূত্বে আইনসম্মত অধিকারের উপর জোর দিতে হবে। আমাদের অবশ্যই পরিবারের উপর আমাদের শক্তির প্রমাণ করতে হবে এবং সুনিশ্চিত করতে হবে যে পরিবারের প্রত্যেকে যেন তার সামনে নত হয়, কারণ আমাদেরকে প্রত্যেকের সামনে প্রমাণ করতে হবে যে আমরা এখনও তাদের পিতা অর্থাৎ প্রধান। আমাদের পক্ষে শুধু এটা জানা যথেষ্ট নয়। আমরা যদি মনে করি যে আমাদের এই পরিচয়ের কারণে বিপদের আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে, তাহলে আমরা প্রতিরক্ষামূলকও হতে পারি অথবা নিজেকে প্রমাণ করার জন্য খুবই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারি। “আমাকে প্রমাণ করতেই হবে যে আমি কে। আমাকে প্রমাণ করতেই হবে যে আমার প্রভূত্ব এবং আকর্ষণ এখনও রয়েছে,” এবং তাই আমাদের বাইরে যেতে হবে আর আমরা পরস্ত্রী গ্রহণ করে নেব অথবা অন্য একজন যুবতীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলব যাতে আমরা প্রমাণ করতে পারব যে এটা আমাদের পরিচয় এবং এটাই আমাদের অস্তিত্ব।

অশান্তকারী আবেগ এবং মনোভাব

আকর্ষণ এবং লালসা

অশান্তকারী আবেগ এবং মনোভাব হল মনের অবস্থা যা উদ্ভূত হয় এবং যার কারণে আমরা কোন একটা মূর্ত পরিচয়কে প্রমাণ করা অথবা বজায় রাখার চেষ্টা করি। এই অশান্তকারী আবেগ অনেক রকমের হয়, যেমন- আকর্ষণ এবং লালসা। আমাদের মধ্যে লালসা তখনই জাগে যখন আমরা ঐ পরিচয়কে নিরাপদ রাখার জন্য অনুভব করি যে আমরা যেন অমুক জিনিসটা প্রাপ্ত করি এবং সেটা যেন আমাদের চারপাশে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি আমার পরিচয় আমার পরিবারের পিতা অথবা পিতৃপুরুষ হিসাবে হয় তাহলে আমি ভাবতে পারিঃ “আমার অবশ্যই সম্মান পাওয়া উচিত; আমার ইচ্ছা অনুরূপ আমার সন্তানরা অবশ্যই নববর্ষে আমার কাছে যেন আসে এবং তারা যেন আমার সমস্ত আজ্ঞা পালন করে।” কোন প্রকারে আমি এইরকম অনুভব করি যে, আমি যদি পর্যাপ্ত সম্মান পেয়ে যাই তাহলে সেটা আমাকে খুবই নিরাপদ বোধ করাবে। আর স্পষ্টতই আমি যখন সেই সম্মানটা না পাই তখন আমি আহত বোধ করি এবং খুব রেগে যেতে পারি।

এছাড়াও আমি ভাবতে পারি যে আমার পরিচয় হল আমি একজন ভাগ্যবান ব্যক্তিঃ “আমার ভাগ্য এবং কপাল ভাল থাকতে হবে এবং আমাকে সবসময় ‘মাহজোঙ্গ’ খেলায় জিততে হবে।” যদি এটাই আমার পরিচয় হয়, তাহলে আমি ভাবব যে যদি আমি সবসময় ‘মাহজোঙ্গে’ জয়লাভ করি, সবসময় বিভিন্ন প্রকারের জুয়া খেলায় জয়ী হই, তাহলে এরফলে আমি নিজেকে নিরাপদ বোধ করব। অথবা আমাকে সবসময় জ্যোতিষীদের কাছে যেতে হতে পারে বা চীনা বৌদ্ধ মন্দিরে ভাগ্যের লাঠি নিক্ষেপ করতে হবে যাতে আমি সঠিক উত্তর লাভ করতে পারি। যারফলে আমি নিশ্চিত হতে পারব যে আমি সফল, আমি ঠিক আছি। আমি আমার ব্যবসায়িক যোগ্যতা সম্পর্কে খুব নিরাপদ বোধ করি যে আমার বিশ্বাসই হয় না আমি সফল হতে পারি। আমাকে সবসময় আরও সংকেত পেতে হবে, দেবতাদের কাছ থেকে আরও বেশি সংকেত পেতে হবে অথবা কারও কাছ থেকে আরও বেশি সংকেত যা আমাকে নিরাপদ বোধ করাতে পারে, আর সেইজন্য আমাকে সবসময় বাধ্যতামূলক ভাবে এরজন্য চেষ্টা করতে হবে।

আমি এটাও অনুভব করতে পারি যে “আমি আমার ব্যবসার কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তি। ক্ষমতার প্রতি আমি আকৃষ্ট এবং ক্ষমতাই আমাকে নিরাপদ বোধ করায়।” এই মনোভাব বিভিন্ন মনোবৈজ্ঞানিক পরিকাঠামো থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এটা এই ধরণের ভাবনার উপর ভিত্তি হতে পারে যে আমি একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি অথবা এই অনুভূতির উপর ভিত্তি করে যে আমি একজন প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাবান ব্যক্তি নই কিন্তু নিজেকে সমর্থন করার জন্য আমার ঐ ক্ষমতার প্রয়োজন। ঐরকম পরিস্থিতিতে আমরা ভাবি “আমি যদি আমার কার্যালয়ের সকলকে আমার আনুগত্য বানাতে পারি, আমি তাদের যেভাবে কাজ করাতে চাই সেভাবে তারা করে তাহলে এটা আমাকে নিরাপদ করে তোলে।” অথবা যদি আমাদের বাড়িতে ভৃত্যরা কাজ করে যাতে এটা প্রমাণিত হয় যে আমি কর্তৃপক্ষের পদে আছি, আমি এই ধরণের বিচারের প্রতি আকৃষ্ট হই যে আমি যেমন ভাবে চাই তাদের তেমন ভাবে কাজ করা উচিত, আর এটা প্রমাণ করার জন্য যে ঘরে যার নিয়ন্ত্রণ আছে আমি তাদের কাজকর্ম করার জন্য আদেশ দেওয়া শুরু করতে পারি আর বলতে পারি অপ্রয়োজনীয় কিছু না করার জন্য।

ব্যক্তি ধ্যান আকৃষ্ট করার ভাবনার প্রতিও মুগ্ধ হতে পারে। একজন যুবক হিসাবে আমরা অনুভব করতে পারি যেঃ “আমার পরিচয় হল একজন আধুনিক তরুণ ফ্যাশনেবল পোশাকের শৌখিন ব্যক্তি আর আমি যদি সবসময় অত্যাধুনিক ফ্যাশন, অত্যাধুনিক ভিডিও, অত্যাধুনিক সিডি এবং অত্যাধুনিক জিনিসপত্রের সাথে চলি যা ফ্যাশন পত্রিকাতে উপলব্ধি সাম্প্রতিক তথ্যের সাথে মিল খায় তাহলে এটা আমার পরিচয় নিরাপদ ক’রে রাখবে।

এরকম অনেক উপায় আছে, অনেক জিনিস আছে যার উপর আমরা মনোনিবেশ করতে পারি এবং অনুভব করতে পারি যে, আমি যদি আমার চারপাশের জিনিসগুলি সংগ্রহ করতে পারি এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ তৈরী করতে পারি, যথেষ্ট অর্থ, যথেষ্ট সম্পদ, যথেষ্ট ক্ষমতা, পর্যাপ্ত পরিমাণ মনোযোগ অথবা যথেষ্ট পরিমাণ ভালোবাসা, তাহলে সেগুলি আমাকে নিরাপদ বানাবে। অবশ্যই তাতে কোন কাজ হয় না। বাস্তবে যদি সেটা হয়ও, হতে পারে এক পর্যায়ে পৌঁছে আমার মনে হবে যে আমাদের কাছে যথেষ্ট আছে এবং আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট। কিন্তু আমরা কখনোই মনে করি না যে আমাদের যথেষ্ট আছে এবং আমরা সবসময় আরও বেশি পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি, আর যখন সেটা না পাই আমরা ক্রোধিত হই। অতএব ক্রোধ অনেকভাবে জাগে।

বিকর্ষণ এবং শত্রুতা

আরও একটি প্রক্রিয়া যেটা আমরা আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মূর্ত পরিচয়কে নিরাপদ করার চেষ্টা করি সেটা হল বিকর্ষণ, শত্রুতা এবং ক্রোধঃ “আমি যদি এমন কিছু নির্দিষ্ট বিষয় থেকে নিজেকে আলাদা করে নিতে পারি যা আমি পছন্দ করি না, যা আমার পরিচয়কে বিপদের আশঙ্কায় রাখে তাহলে এটা আমাকে নিরাপদ করে তুলবে।” সুতরাং আমি যদি আমার পরিচয়কে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ, আমার জাতি অথবা আমার সংস্কৃতির উপর ভিত্তি ক’রে রাখিঃ “আমি যদি কেবল এই ধরণের লোকজনদের দূরে রাখি যাদের মধ্যে আমার থেকে আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, যারা হল আলাদা বর্ণের মানুষ, আলাদা ধর্মে অন্তর্ভুক্ত তাহলে সেটা আমাকে নিরাপদে রাখবে।” অথবা যদি আমার ভৃত্যরা আমি যেভাবে চাই তার থেকে কিছুটা আলাদা ভাবে কাজ করে অথবা আমার কার্যালয়ে যারা কাজ করে তারা আমার ইচ্ছার বিপরীতে একটু আলাদা ভাবে কাজ করে তখন আমি মনে করি, “আমি যদি তাদের একটু শুধরাতে পারতাম, আমি যদি তাদের একটু পরিবর্তন করতে পারতাম তাহলে আমি নিরাপদ হয়ে যেতাম।” আমি চাই যে আমার ডেস্কের উপর আমার কাগজ-পত্রগুলি একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সাজিয়ে রাখা হোক কিন্তু আমার কার্যালয়ে কর্মরত ঐ ব্যক্তিটি আমার কাগজ-পত্রগুলি অন্যভাবে সাজিয়ে রাখে, ফলে এটা আমাকে নিরাপদ বোধ করায় নাঃ “আমি যদি তাদের দ্বারা আমার ইচ্ছামতো কাগজ-পত্রগুলিকে সাজাতে পারি তাহলে আমি নিরাপদ বোধ করব।” এটা কী পার্থক্য গড়ে তুলবে? এইরকম ভাবে আমাদের জন্য যা কিছু আশঙ্কা দেখা দেয় সেসব কিছুকে আমাদের থেকে দূরে রাখার জন্য আমরা অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ বা শত্রুতা প্রকাশ করি।

অথবা আমরা যখন আমাদের পরিচয় এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে কল্পনা করি, যে সবসময় নিজেকে সঠিক মনে করে তখন কোন ব্যক্তি যদি আমাদের অসম্মান করেন বা সমালোচনা করেন আমরা প্রচন্ড প্রতিরক্ষামূলক, শত্রুতাপরায়ণ এবং ক্রোধিত হয়ে উঠি। ঐ ব্যক্তির সমালোচনাকে কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ ক’রে এবং নিজেদের উন্নতি ও বিকাশ করার পরিবর্তে আমরা ঐ ব্যক্তির সাথে প্রতিকূলভাবে আচরণ করি, আর আমরা এটা করি তাদের সমালোচনা অনুচিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কাছে যে সুযোগটি থাকে সেটাকে ব্যবহার না ক’রে এবং আমরা শিথিল অথবা দোষী কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে আমরা শুধু কঠোর শব্দ প্রয়োগ করি অথবা সেই ব্যক্তিকে উপেক্ষা ক’রে আর তার সাথে কথা না বলে পরোক্ষভাবে তার সাথে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করি। আমরা এইভাবে আচরণ করি, কারণ আমরা নিজেকে অনিরাপদ এবং ভীত মনে করি। আমরা মনে করি এই ব্যক্তিটি “আমাকে” প্রত্যাখ্যান করছে, যদিও আমি সবসময় সঠিক থাকি আর এই মূর্ত “আমি”-কে রক্ষা করার জন্য আমরা ঐ ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যান করি।

মোহমূলক নির্বোধতা

আরও একটি প্রক্রিয়া হল মোহমূলক নির্বোধতা যার কারণে আমরা আমাদের চারপাশে একটা প্রাচীর তৈরী করে ফেলিঃ “যদি কোন কিছু আমার ক্ষেত্রে বিপদজনক হয়, আমার পরিচয়ের জন্য বিপদজনক হয় তাহলে আমি ভান করি যে ঐ জিনিসটার অস্তিত্ব নেই।” আমাদের পরিবারের সাথে, কাজকর্মের সাথে সমস্যা থাকে এবং পরে যখন আমরা বাড়ি ফিরি তখন আমরা পাথরের মতো মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরি, আর আমরা এমন ভান করি যেন আমাদের কিছুই বিরক্ত করে না আমরা এটা নিয়ে কোন আলোচনা করতে চাই না; ব্যস্‌ কেবল টিভি চালিয়ে দিই এবং ভান করি যে ঐ সমস্যার কোন অস্তিত্বই নেই। এটাই হল মোহমূলক নির্বোধতা। আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের সমস্যা নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করতে চায় আর আমরা তাদের দূরে সরিয়ে দিই। “আমার পরিচয় হল যে আমাদের পরিবারে কোন সমস্যা নেই; আমাদের পরিবার একেবারে নিখুঁত; এখানে সবরকমের পরম্পরাগত মূল্যবোধ অনুসরণ করা হয়। যদি তাই হয়, তাহলে আপনি কীভাবে তাদের পরামর্শ দিতে পারেন এবং এই কথা ব’লে তাদের ভারসাম্য বিপর্যস্ত করতে পারেন, সম্প্রীতি বিপর্যস্ত করতে পারেন যে সেখানে সমস্যা আছে?” আমরা মনে করি যে সমস্যা মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় হল সমস্যা না থাকার ভান করা। এই ধরণের মনোভাবকে বলা হয় মোহমূলক নির্বোধতা।

আমাদের মনে উত্থিত প্রেরণাগুলি হল কর্মের অভিব্যক্তি

যখন আমাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের অশান্তকারী আবেগ উৎপন্ন হয় তখন আমাদের মনে পরবর্তীতে যা ঘটে সেটা হল বিভিন্ন ধরণের প্রেরণা। কর্ম বলতে এটাকেই বোঝায়। কর্ম বলতে ভাগ্য বা নিয়তিকে বোঝায় না। দুর্ভাগ্যক্রমে অনেকে মনে করে কর্মের অর্থ হল এটাই। যদি কারও ব্যবসা ব্যর্থ হয়ে যায় অথবা কেউ গাড়ির ধাক্কা খায় তাহলে আমরা তখন বলি, “আরে, বড় দুর্ভাগ্য, এটাই তার কর্ম।” এটা “ঈশ্বরের ইচ্ছা” বলার মতোই।

আমরা এখানে কর্ম সম্পর্কে আলোচনায় ঈশ্বরের ইচ্ছা বা নিয়তির কথা বলছি না। আমরা প্রেরণা সম্পর্কে কথা বলছি অর্থাৎ বিভিন্ন প্রেরণা যা আমাদের মনে জাগে যা আমাদের বিভিন্ন কাজকর্ম করতে পরিচালনা করে। উদাহরণ স্বরূপ, এক প্রকারের মানসিক প্রেরণা যা আমাদের মনে জেগেছিল একটা ব্যবসার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সেটা পরে খারাপ সিদ্ধান্তে পরিণত হয়েছিল। অথবা ঐ ধরণের প্রেরণা যা আমাকে আমার সন্তানদের সম্মানের দাবী করার জন্য প্রেরিত করে। অথবা একধরণের আবেগ যার কারণে আমি আমার কার্যালয়ে কর্মরত কর্মচারীবৃন্দদের প্রতি চিৎকার করি যাতে তারা তাদের ইচ্ছামতো নয় বরং আমার পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে। আরও এক প্রকারের প্রেরণা আমাদের মনে জাগাতে পারে যে আমি লোকের সামনে পাথরের মতো মুখ দেখিয়ে বসি, টিভি চালিয়ে দিই এবং অন্য কারও কথা না শুনি। এই ধরণের প্রেরণা অথবা কর্ম আমাদের মনে জাগে আর তার কারণে আমরা বাধ্যতামূলক ভাবে কাজ করি। এরফলে আমাদের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক সমস্যা তৈরী হয়। এটাই হল এর প্রক্রিয়া।

কর্মক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান অথবা আমাদের পরিবারের সমস্যা নিয়ে আমরা সবসময় দুশ্চিন্তা এবং উদ্বিগ্ন বোধ করতে পারি। নিজের এই মূর্ত পরিচয়ের প্রতি আঁকড়ে থাকার ভিত্তিতে “আমাকে অবশ্যই সফল হতে হবে আর সফল হয়ে আমার মাতা-পিতা অথবা সমাজকে সন্তুষ্ট করতে হবে,” আমরা ঐ পরিচয়কে নিরাপদ রাখার জন্য আমাদের চিন্তা এবং উদ্বিগ্নের সমস্যার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করি। এইভাবে আমরা বদ্ধ মনের এবং বদ্ধ হৃদয়ের হয়ে যাই। তারপর যদিও আমাদের পরিবারে বা কর্মক্ষেত্রে সব ধরণের অসুবিধা থাকতে পারে কিন্তু আমরা সেগুলিকে চেপে রাখি আর নিজেরা হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু ভিতরে -ভিতরে যদিও সব রকমের চিন্তা এবং চাপ থেকে যায় যা পরবর্তীতে একটি প্রেরণা রূপে বিস্ফোরিত হতে পারে এবং যা হিংসার দৃশ্যের দিকে পরিচালিত করে, প্রায়শই আমাদের পরিবার অথবা কর্মক্ষেত্রে এমন কোন সদস্যের বিরুদ্ধে সেটা ফলিভূত হয় যার এই বিষয় থেকে কোন লেনদেন থাকে না। পরিণাম স্বরূপ, এটা তখন একটা মারাত্মক রূপ ধারণ করে।

এইগুলিই হল বিভিন্ন প্রক্রিয়া যা অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্তিমূলক সমস্যার সৃষ্টি করে। আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পারি যে এর সম্পর্ক আমাদের বিভিন্ন আবেগের সাথে জুড়ে আছে। অবশ্যই এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে, সমস্ত আবেগগুলি কি সমস্যা সৃষ্টিকারী? সমস্ত আবেগগুলি কি আমাদের জন্য সমস্যা তৈরী করে?

গঠনমূলক আবেগ

আমাদের নির্দিষ্ট আবেগের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে যে কিছু আবেগ আছে যেগুলি হল খুবই ইতিবাচক এবং গঠনমূলক, যেমন- মৈত্রী, উষ্ণতা, স্নেহ, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা এবং দয়া, আবার কিছু আবেগ আছে যেগুলি হল নেতিবাচক এবং ধ্বংসাত্মক, যেমন- লালসা, বিদ্বেষ, মোহ, অহংকার, মান, ঈর্ষা ইত্যাদি পালি, সংস্কৃত অথবা তিব্বতী ভাষায় “ইমোশন” শব্দের জন্য কোন সমানার্থক শব্দ নেই। আমরা ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক ভাব সম্পর্কে কথা তো বলতে পারি কিন্তু সেখানে ইংরেজী ভাষার মতো উভয় ভাবকে ব্যক্ত করার জন্য কোন সাধারণ শব্দ নেই।

আমরা যখন কোন নির্দিষ্ট আবেগ অথবা মনোভাব সম্পর্কে কথা বলি সেটা জাগ্রত হওয়ার কারণে আমাদের মধ্যে অস্বস্তি বা অসহজ বোধ করায়, সেগুলিকে অশান্তকারী আবেগ বা অশান্তকারী মনোভাব বলা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি প্রমত্ততা বা আবেশ থাকতে পারে যা আমাদের অত্যন্ত অসহজ বোধ করায়। হতে পারে যে আমরা সম্মান লাভ করার জন্য আতুঁড় হয়ে থাকি, কোন ব্যক্তির ভালবাসার জন্য লালায়িত হই, অথবা তার মনোযোগ বা অনুমোদন লাভ করার জন্য কাঙ্খিত হই, কারণ আমরা ঐ ব্যক্তির প্রতি আসক্ত এবং নিজে যোগ্য ও নিরাপদ বোধ করার জন্য তার অনুমোদন লাভ করতে চাই। লালসার মতো অশান্তকারী আবেগ ও মনোভাবের কারণে এইসব অসুবিধা উৎপন্ন হয়। আমরা যখনই বিদ্বেষী হয়ে উঠি তখনই আমরা অসহজ বোধ করি; আমরা যদি অবরুদ্ধ মনের হই তাহলে সেটাও একটা অসহজ অনুভূতি হয়ে যায়। অতএব এই সমস্ত মনোভাবগুলি হল সমস্যাসৃষ্টিকারী। সুতরাং আমাদের নেতিবাচক আবেগ থেকে ইতিবাচক আবেগকে পার্থক্য করে দেখতে হবে, যেমনকি প্রেম বা মৈত্রী।

বৌদ্ধ পরম্পরায় মৈত্রীকে এমন একটা ইতিবাচক মনোভাব হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যার ভিত্তিতে আমরা কামনা করি অন্য সকলেই যেন সুখী হয় এবং সুখের কারণে সম্পন্ন হয়। এই বিষয়টি এই যুক্তির উপর আধারিত যে আমরা সকলেই সমান এবং প্রত্যেকেই সমান ভাবে সুখী হতে চায়, কেউ সমস্যার সম্মুখীন হতে চায় না। সকলেরই সুখী হওয়ার সমান অধিকার আছে। আমরা নিজেদের যতটা যত্ন নিই ঠিক ততটা অন্যের যত্ন নেওয়া এবং তাদের প্রিয় মনে করাটাই হল মৈত্রী। এই ভাবনাটা হল অন্যরা সুখী হওয়ার কামনা করার ভাবনা যেখানে কখনও বিচার করা হয় না যে তারা কী করে। এই মৈত্রী হল নিজের সন্তানের প্রতি একজন মায়ের ভালোবাসার মতো, যিনি তার সন্তানকে তখনও ভালোবাসতে থাকেন যখন তার সন্তান তার বস্ত্র নোংরা করে ফেলে অথবা তার উপর বমি করে দেয়। এতে তার মায়ের কিছু যায় আসে না; সেই মা তার সন্তানকে ভালোবাসা বন্ধ করে দেয় না; তাতে তার সন্তান যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার মায়ের উপর বমি করেও দেয়। মা কিন্তু তার সন্তানের জন্য নিয়মিত ভাবে উদ্বিগ্ন থাকে অর্থাৎ সন্তানের সুখী হওয়ার কামনা করে। অন্যদিকে আমরা সাধারণতঃ যে ভাবনাটিকে প্রেম হিসাবে সংজ্ঞায়িত করি সেটা হল নির্ভরশীলতা অথবা আবশ্যকতার একটি অভিব্যক্তি। “আমি তোমাকে ভালোবাসি” এর অর্থ হল আমাকে তোমার প্রয়োজন, কখনো আমায় ত্যাগ কোরো না, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না এবং তুমি এটা করলে ভালো হয় আর ওটা করলে ভালো হয়, একজন ভালো স্ত্রী বা স্বামী হও, প্রত্যেকে ভ্যালেন্টাইন দিবসে আমাকে ফুল উপহার দাও এবং আমার যেটা ভালো লাগে শুধু সেটাই কর। তুমি যদি সেটা না কর তাহলে এবার থেকে আমি তোমাকে ঘৃণা করব, কারণ আমি যা চেয়েছিলাম সেটা তুমি করনি আর আমার যখন প্রয়োজন ছিল তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না।

এই ধরণের মনোভাব হল একটা অশান্তকারী অবেগ আর বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী এটাকে মৈত্রী বলা যাবে না। মৈত্রীর অভিপ্রায় তো কারও জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার ভাবনাকে বোঝায়, সেখানে সে আমার জন্য ফুল পাঠিয়ে থাকুক বা না থাকুক, আমাদের কথা শুনুক বা না শুনুক, আমাদের জন্য দয়ালু এবং প্রিয় হোক বা না হোক অথবা ভয়াবহ ভাবে আচরণ করুক এবং এমনকি আমাদের অস্বীকার করুক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। এটার অভিপ্রায় হল ঐ ব্যক্তি সুখী হওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার ভাবনা। আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা যখন মৈত্রী অথবা এই ধরণের আবেগ সম্পর্কে কথা বলি সেখানে একটা ইতিবাচকের পাশাপাশি অশান্তকারী আবেগের মতো উভয় প্রকারের আবেগ থাকতে পারে।

ক্রোধ সর্বদা একটা অশান্তকারী আবেগ

সর্বশেষে, এবার আমরা ক্রোধ সম্পর্কে আলোচনা করব। ক্রোধ জিনিসটা কী? ক্রোধ হল এমন একটা ভাব যা সর্বদা অশান্তকারী হয়। ক্রোধিত হয়ে কেউ কখনও সুখী হতে পারেনি। ক্রোধিত হলে আমরা কখনও স্বস্তিবোধ করতে পারি না। এর কারণে আমাদের আহারের স্বাদ ভালো লাগে না। আমরা যখন ক্রোধিত এবং বিক্ষুব্ধ হই তখন আমরা স্বস্তি পাই না এবং আমাদের ঘুম আসে না। আমাদের বিশাল বড় একটা দৃশ্য বানানো, জোরে চিৎকার-চেঁচামেচি করার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু আমাদের কার্যালয় অথবা পরিবারের কোন ঘটনার কারণে যদি ভিতরে ভিতরে ক্রোধিত হই তাহলে তারফলে আমাদের মধ্যে হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে অথবা আমাদের আলস্য ভাব হতে পারে বা রাত্রে ঘুমোতে পারি না। ক্রোধকে ধারণ ক’রে রাখার কারণে আমাদের অনেক রকমের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় আর আমরা যদি ঐ ক্রোধকে প্রকৃতপক্ষে প্রকট করতে শুরু করি আর অন্যকে বিদ্বেষপূর্ণ ভাবে দেখি আর অন্যের প্রতি শত্রুতা ভাব প্রদর্শণ করি তাহলে কুকুর, বিড়ালও আমাদের আশেপাশে থাকতে চাইবে না। তারা আস্তে আস্তে পাশ কেটে চলে যাবে কারণ তারা আমাদের ক্রোধের কারণে আমাদের উপস্থিতিকে অস্বস্তি বোধ করবে।

ক্রোধ এমনই একটা জিনিস যার কোন প্রকৃত লাভ নেই। যদি আমাদের ক্রোধ ভীষণ প্রবল হয় বা আমরা এতটাই হতাশ হয়ে যাই, যারফলে আমাদের মনে হয় যে, যেমন করেই হোক আমরা সেটাকে প্রকাশ করব, আর সেটার যখন বিস্ফোরণ ঘটে তখন তার কারণে আমরা কাউকে অভিশাপ দিয়ে দিই বা তার বিরুদ্ধে কু-মন্ত্রনা প্রয়োগ করি, এরকম আচরণ করে কি আমাদের আরও ভাল বোধ করাবে? অন্য কাউকে আহত হয়েছে দেখে বা দুঃখিত দেখে আমরা কি ভাল থাকতে পারি? অথবা আমরা এতটাই ক্রোধিত হয়ে পড়ি যে, মনে হয় যেন পাঁচিলে ঘুষি মেরে দিই। পাঁচিলে ঘুষি মারলে কি সত্যিই আমাদের ভাল অনুভব হবে? না, অবশ্যই না, বরং উলটে নিজের হাতেই চোট লাগবে। প্রকৃতপক্ষে, ক্রোধ আমাদের কোনভাবেই সহায়তা করে না। আমরা যখন ট্রাফিকে ফেঁসে যাই তখন আমরা এতটা রেগে যাই যারফলে আমরা হর্ণ বাজাতে শুরু করে দিই, অন্যদের প্রতি চিৎকার করতে লাগি আর যাকে তাকে বাজে কথা বলতে লাগি। এরকম করলে কী লাভ হয়? এরকম করলে কি সেটা আমাদের স্বস্তি বোধ করায়? এরকম করলে কি আমাদের গাড়ি আরও দ্রুত চলতে পারবে? না, এটা শুধু সকলের সামনে আমাদের ছবি খারাপ ক’রে ফেলে কারণ তখন তারা সবাই বলতে লাগবে, “এই মূর্খ ব্যক্তিটা কে যে হর্ণ বাজাচ্ছে?” এটা পরিষ্কার যে এরকম করলে পরিস্থিতিকে শুধরাতে সহায়তা করবে না।

আমাদের কি ক্রোধিত হওয়া প্রয়োজন?

যদি ক্রোধের মতো অশান্তকারী আবেগ আর অন্যদের প্রতি চিৎকার- চেঁচামেচি করার মতো প্রেরণাদায়ক আচরণের ভিত্তিতে অথবা শত্রুতার কারণে অন্যদের থেকে আলাদা থাকা বা তাদের অস্বীকার করার কারণে আমাদের সমস্যা উৎপন্ন হয় তাহলে তাদের কারণে কি সবসময় আমাদের সমস্যা হয়? আমাদের কি সবসময় এটা অনুভব করতে হবে? না, ব্যাপারটা তা নয় কারণ অশান্তকারী আবেগ আমাদের মনের স্বাভাবিক অংশ নয়। যদি তাই হতো তাহলে আমাদের মন সবসময় অশান্ত হয়ে থাকত। এমনকি সবচেয়ে গুরুতর বিষয় সম্পর্কে এমন এমন মুহুর্ত আসে যখন আমরা ক্রোধের কারণে অশান্ত হই না। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যখন অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ি, তখন আর আমরা ক্রোধ অনুভব করি না।

অতএব, এটা সম্ভব যে কিছু এমন মুহুর্ত আছে যখন ক্রোধ, বিদ্বেষ এবং আক্রোশের মতো অশান্তকারী আবেগ উপস্থিত থাকে না। এরফলে এটা প্রমাণিত হয় যে এই ধ্বংসাত্মক আবেগগুলি স্থায়ী নয়; এগুলিই আমাদের মনের স্বাভাবিক অংশ নয় আর সেইজন্য এগুলি এমনই জিনিস যার থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। আমরা যদি ক্রোধের কারণগুলি সমাপ্ত করে দিই আর সেটা হলকা ভাবে নয় বরং গভীরতম স্তরে তাহলে ক্রোধকে নিশ্চিত ভাবে কাটিয়ে ওঠা আর মনের শান্তি লাভ করা সম্ভব।

এর অর্থ এই নয় যে স্টার ট্রেক (Star Trek)-এর স্পোক-এর মতো আমাদেরকে সমস্ত আবেগ এবং অনুভূতিগুলি থেকে মুক্ত হয়ে একটা রোবট বা কম্পিউটারের মতো আবেগ শূন্য হয়ে যাওয়া উচিত। পরিবর্তে আমরা যেটা চাই সেটা হল ভ্রমের উপর আধারিত আমাদের অশান্তকারী আবেগ ও অশান্তকারী মনোভাব এবং বাস্তবিকতা সম্পর্কে বোধগম্যতার অভাব থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই। বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা এটাকে সম্ভব ক’রে তোলার উপায়ের ক্ষেত্রে খুবই ধনী।

ক্রোধের উপর নিয়ন্ত্রণঃ আমাদের জীবনের গুণাবলীকে পরিবর্তন করা

সর্বপ্রথম আমাদের একটি নির্দিষ্ট প্রেরণা অথবা একটা আধারের প্রয়োজন যেটা ক্রোধ এবং সমস্ত অশান্তকারী আবেগ ও মনোভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নিজেদের শুধরাতে আমাদের প্রেরণা জোগাতে পারে। এরকম করার জন্য যদি আমাদের কাছে কোন কারণ না থাকে তাহলে আমরা এরকম কাজ কেন করব? সুতরাং প্রেরণা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।

এই ধরণের প্রেরণা বিকাশ করার জন্য আমরা এইভাবে চিন্তা-ভাবনা ক’রে শুরু করতে পারিঃ “আমি সুখী হতে চাই এবং কোন রকমের সমস্যার সম্মুখীন হতে চাই না। আমি আমার জীবনের গুণাবলীকে উন্নতি করতে চাই। আমার জীবন খুবই সুখকর নয় কারণ আমি সবসময় ভিতরে-ভিতরে ক্রোধ এবং বিদ্বেষ অনুভব করি। প্রায়শই আমি ক্রোধিত হই। হতে পারে আমি সেটা প্রকাশ করি না কিন্তু এটা সেখানে আছে এবং এটা আমাকে সবসময় অত্যন্ত দুঃখী, অত্যন্ত বিপর্যস্ত বোধ করায় এবং তাই এটা আমার জীবনের খুব ভালো গুণাবলী নয়। এছাড়াও এটা আমার হজম প্রণালী খারাপ করে যার কারণে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। এমনকি আমি যে খাবার পছন্দ করি সেটা ভালোভাবে উপভোগ করতে পারি না।

সর্বোপরি, আমাদের জীবনের গুণাবলী হল এমন কিছু যা আমাদের নিজেদের হাতের মধ্যে আছে। ভগবান বুদ্ধ দ্বারা প্রদত্ত উপদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় বার্তাটি হল আমরা আমাদের জীবনের গুণাবলীকে শুধরানোর জন্য কিছু করতে পারি। আমাদের পুরো জীবন দুঃখ-কষ্টে কাটানোর জন্য অভিশপ্ত নয়। এই পরিস্থিতিকে শুধরানোর জন্য আমরা কিছু করতে পারি।

এরপর আমরা এইভাবে বিচার করতে পারি, “আমি কেবল আমার বর্তমান জীবনের গুণাবলীকে শুধরাতে চাই, অথবা এই মুহূর্তের জন্য বা অল্প সময়ের জন্য, ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে আমি এটা শুধরাতে চাই। আমি আর এই পরিস্থিতিকে খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে দিতে চাই না। এর কারণ হল, যেমন- আমি যদি বিদ্বেষ এবং ক্রোধ থেকে মুক্ত না হয়ে এগুলিকে ভিতরে পুষে রাখি তাহলে এগুলি আরও খারাপ অবস্থায় চলে যাবে। ফলে এমনও হতে পারে আমি আলসারে আক্রান্ত হয়ে যাব। হতে পারে আমি এগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করতে না পেরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভয়াবহ কিছু করে ফেলব, যেমন- কাউকে অভিশাপ দেওয়া, কারও উপর যাদুমন্ত্র প্রয়োগ করা এবং তার সর্বনাশ করার চেষ্টা করা। পরিণাম স্বরূপ, অন্য ব্যক্তিও প্রতিশোধমূলকরূপে আমাকে এবং আমার পরিবারকে অভিশাপ দেবে আর এর কারণে হঠাৎ করে ভিডিও বা সিনেমার জন্য একটা নতুন আদর্শ চিত্রনাট্য তৈরী হয়ে যাবে।”

আমরা যদি আগে বিচার করি যে আমরা এরকম কিছু ঘটতে দিতে চাই না, তাহলে আমরা এটাকে শুধরাবো  এবং ক্রোধ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করব যাতে সমস্যাগুলি আরও তীব্র না হয়ে যায়। এছাড়াও আমরা না কেবল আমাদের সমস্যাগুলিকে কম করার জন্য আকুল ভাবে কামনা করব, বরং এর চেয়ে বেশী, আমাদের সমস্ত সমস্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়ার কামনা করব, কারণ আমাদের মধ্যে স্বল্প পরিমাণ ক্রোধ এবং বিদ্বেষ থাকলে সেটা আমাদের কোন আনন্দ প্রদান করে নাঃ “সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাকে দৃঢ় সংকল্প বিকাশ করা উচিত।”

মুক্ত হওয়ার সংকল্প

সাধারণতঃ আমি যাকে “মুক্ত হওয়ার সংকল্প”, বলি সেটাকে ত্যাগ (নিঃসরণ) রূপে অনুবাদ করা হয় যা হল একটি বিভ্রান্তিকর অনুবাদ। এটা এমন একটি ধারণা যা বোঝায় যে আমাদের সবকিছু ত্যাগ ক’রে দেওয়া উচিত এবং একটা গুহায় গিয়ে বসবাস করা উচিত। এখানে সেই জিনিসটা একেবারে বলা হচ্ছে না। এখানে যে বিষয়ের উপর আলোচনা করা হচ্ছে সেটা হল আমাদের সততার সাথে এবং সাহসের সাথে আমাদের সমস্যার নিরীক্ষণ করতে হবে এবং সেগুলির সাথে জীবন-যাপন করাটা যে কতটা হাস্যকর সেটাকে দেখে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবেঃ “আমি এভাবে আর চলতে চাই না। অনেক হয়েছে। আমি তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেছি; আমি তাদের প্রতি নিরাশ হয়ে পড়েছি। আমাকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।”

এখানে যে মনোভাব বিকাশ করতে হবে সেটা হল মুক্ত হওয়ার সংকল্প এবং তার সাথে আমাদের পুরনো ও অশান্তকারী চিন্তা-ভাবনা, কথা বলা আর আচরণের নিদর্শনগুলি ত্যাগ করতে হবে। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ আমরা আমাদের মনকে খুব শক্ত না করব ততক্ষণ আমরা আমাদের সর্বস্ব শক্তি এই কাজে লাগাতে পারব না। আমরা যতক্ষণ না আমাদের সর্বস্ব শক্তি এতে নিয়োজিত না করব, মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অপূর্ণ হয়ে থাকবে আর আমরা কোনদিকেই থাকব না। আমরা সুখ লাভ করতে চাই কিন্তু আমরা নেতিবাচক অভ্যাস এবং আবেগ ত্যাগ করতে চাই না। এরকম করলে তো আমরা কখনোই সফল হব না। সুতরাং এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে এই ধরণের দৃঢ় সংকল্প করতে হবে যাতে আমরা আমাদের সমস্যাকে উৎপন্ন হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারি আর ঐ সমস্যা এবং তাদের কারণগুলিকে ত্যাগ করার জন্য ইচ্ছুক হতে পারি।

পরবর্তী উচ্চতর স্তরে আমাদের ভাবতে হবেঃ “আমাকে অবশ্যই আমার ক্রোধ থেকে মুক্ত হতে হবে শুধু নিজের সুখ অর্জনের জন্য নয়, বরং আমার আশপাশের প্রত্যেকের জন্য। আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী এবং সমাজের স্বার্থে আমাকে অবশ্যই আমার ক্রোধ থেকে মুক্ত হতে হবে। অন্যদের খেয়াল রেখে আমাকে এটাকে কাটিয়ে উঠতেই হবে। আমি তাদের কষ্ট দিতে চাই না এবং অসুখী করতে চাই না। আমি যদি আমার ক্রোধ প্রকাশ করি, তাহলে কেবল আমি লজ্জিত হব না, বরং আমার পুরো পরিবারকে লজ্জিত হতে হবে। এর কারণে আমার সব সহযোগীদের লজ্জিত হতে হবে। সুতরাং তাদের কথা বিবেচনা ক’রে আমাকে অবশ্যই আমার মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে, মোকাবিলা করতে এবং এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সক্ষম হতে শিখতে হবে।

অনুধাবনের কারণে প্রেরণা আরও বেশী প্রবল হয়ঃ “আমাকে অবশ্যই এই ক্রোধ থেকে মুক্ত হতে হবে, কারণ এই ক্রোধ আমাকে পরোপকার করতে বাধা দেয়। যদি অন্যদের আমার সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, যেমন আমার সন্তান, কর্মস্থলে আমার সহযোগীরা অথবা আমার মাতা-পিতার, আমি যদি তখন আমার ক্রোধ বা বিদ্বেষের কারণে দুঃখী বা বিরক্ত হয়ে উঠি, তাহলে আমি কীভাবে তাদের সহায়তা করতে পারব? এটি একটি বড় বাধা এবং সেইজন্য অনুপ্রেরণার এই বিভিন্ন স্তরকে আন্তরিকভাবে বিকাশ করার জন্য নিজেদেরকে শুধরানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রোধের সাথে মোকাবিলা করার জন্য আমাদের পদ্ধতি যতই অত্যাধুনিক হোক না কেন, যদি আমাদের মধ্যে এটাকে প্রয়োগ করার দৃঢ় প্রেরণা না থাকে তাহলে আমরা সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। আর আমরা যে পদ্ধতিগুলি শিখি সেগুলিকে যদি প্রয়োগ না করি তাহলে তাতে কী লাভ? সুতরাং প্রথম পদক্ষেপটি হল প্রেরণার দিকে থেকে চিন্তা-ভাবনা করা।

ক্রোধকে কাটিয়ে ওঠার উপায়

ক্রোধকে কাটিয়ে ওঠার আসল পদ্ধতি গুলি কী কী? ক্রোধকে মনের একটি উত্তেজিত অবস্থা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যা কোন সজীব অথবা নির্জীব বস্তুর বিরুদ্ধে হিংসা সৃষ্টি করতে চায়। আমরা যদি একজন ব্যক্তি, একটি পশু, কোন একটি পরিস্থিতি অথবা কোন একটি বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করি আর সেটা আমাদের পছন্দ না হয়, আমরা তার প্রতি হিংসা এবং উত্তেজনা ব্যক্ত করতে চাই আর সেটাকে হিংসামূলক ভাবে পরিবর্তন করতে চাই তাহলে সেটা হবে ক্রোধ। অতএব ক্রোধ হল অসহিষ্ণুতা এবং ধৈর্যের অভাবের একটি অবস্থা যা আমরা সহ্য করতে পারি না এবং তার ক্ষতি করার ইচ্ছা। এর বিপরীতে একদিকে ধৈর্য হল অসহিষ্ণুতার বিপরীত এবং অন্যদিকে হল মৈত্রী, কারণ মৈত্রী হল অন্যদের জন্য সুখী হওয়ার কামনা করা। অতএব কাউকে ক্ষতি করার বিপরীত ভাবনা হল মৈত্রী।

প্রায়শই আমরা এমন পরিস্থিতিতে ক্রোধিত হই যেখানে আমাদের সাথে এমন কিছু ঘটে যা আমরা পছন্দ করি না যে সেটা ঘটুক। আমরা যেমন চাই মানুষ সেভাবে কাজ করে না। উদাহরণ স্বরূপ, তারা আমাদের সম্মান দেয় না, কর্মস্থলে তারা আদেশ পালন করে না অথবা ব্যবসা-বানিজ্যে তারা আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে তারা সেটা করে না। যেহেতু তারা আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করে না তাই আমরা তাদের উপর অত্যন্ত ক্রোধিত হই। আরও একটি উদাহরণ স্বরূপ, কেউ হয়তো আমাদের পায়ের আঙুল মাড়িয়ে দেয় আর তার কারণে আমরা তাদের উপর ক্রোধিত হই কারণ আমরা এরকম কিছু ঘটতে পছন্দ করি না। কিন্তু এরকম অনেক উপায় আছে যার মাধ্যমে আমরা ক্রোধিত না হয়ে সেগুলির মোকাবিলা করতে পারি।

ধৈর্য বিকশিত করার জন্য শান্তিদেবের উপদেশ

অষ্টম শতাব্দীর একজন মহান ভারতীয় বৌদ্ধ আচার্য শান্তিদেব এই বিষয়ে এরকম অনেক মতামত প্রস্তুত করেছেন যেগুলি খুবই সহায়ক। তার দ্বারা লিখিত কয়েকটি কথা আমরা ব্যাখ্যা করব। তিনি বলেছেনঃ “যদি কোন কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে সেটাকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয় তাহলে তার জন্য কেন চিন্তিত এবং ক্রোধিত হব? শুধু সেটাকে পরিবর্তন করব। যদি সেটাকে পরিবর্তন করার কিছু না থাকে তাহলে চিন্তিত এবং ক্রোধিত হয়েই বা কী লাভ? যদি সেটাকে পরিবর্তন করা না যায় তাহলে ক্রোধিত হলে কোন লাভ হয় না।”

উদাহরণ স্বরূপ, আমরা পেনাঙ্‌-এর এখান থেকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য বিমানে চাপতে চাই কিন্তু তার জন্য আমরা যখন বিমানবন্দরে পৌঁছোই তখন আমরা দেখতে পাই আমাদের আগে অনেক যাত্রীরা তার আসন পুরোপুরি আরক্ষিত করে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের তো ক্রোধিত হয়ে কোন লাভ নেই। ক্রোধ করলে তো বিমানে আসন পেতে কোন সাহায্য করবে না। তবে ঐ পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার জন্য আমরা অবশ্যই কিছু করতে পারি অর্থাৎ আমরা পরবর্তী বিমানে চাপতে পারি। তাই আমরা অকারণে কেন ক্রোধিত হব? পরিবর্তে আমরা পরের বিমানের জন্য আসন আরক্ষিত করব আর সিঙ্গাপুরে আমার বন্ধুদের ফোন করে জানিয়ে দেব যে আমরা দেরি ক’রে পৌঁছচ্ছি; তাহলেই তো কাজটা হয়ে যায়। আমরা এই উপায়ের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারি। যদি আমাদের টিভি ঠিকঠাক কাজ না করে তাহলে তার উপর রাগ ক’রে, লাথি মেরে বা অভিশাপ দিয়ে কী লাভ? তার পরিবর্তে সেটাকে ঠিক করে নিন। এটা একটা খুবই স্পষ্ট বিষয়। যদি এমন কোন পরিস্থিতি থাকে যা আমরা পরিবর্তন করতে পারি তাহলে সেখানে ক্রোধিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই; শুধু ঐ পরিস্থিতিটাকেই পরিবর্তন করে নিন।

যদি কোন পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার জন্য আমাদের কাছে কোন কিছুই করার না থাকে তাহলে আমাদের সেটাকে মেনে নিতে হবে, যেমন- ভিড়ের সময় ট্রাফিকে আটকে থাকার মতো। আমাদের গাড়ির সামনে কোন লেজার রশ্মির বন্দুক লাগানো থাকে না যার সহায়তায় আমরা আমাদের সামনের সব গাড়িগুলিকে ধাক্কা মেরে নষ্ট ক’রে দেব অথবা ট্রাফিকের উপর দিয়ে উড়ে চলে যাব, যেমনকি কিছু জাপানি কার্টুনে সেটা দেখা যায়। অতএব আমাদের ঐ পরিস্থিতিকে সুষ্ঠুভাবে মেনে নিতে হবে আর ভাবতে হবেঃ “ঠিক আছে আমি ট্রাফিকে আটকে আছি, আমি রেডিও চালিয়ে দেব অথবা ক্যাসেট রেকর্ডার চালাবো এবং কোন বৌদ্ধ উপদেশ অথবা মধুর সংগীত শুনব।” বেশির ভাগ সময় আমাদের জানা থাকে যে আমরা ভিড়ের সময় ট্রাফিকে আটকে পড়ব এবং সেইজন্য আমরা আমাদের সাথে একটা টেপ নিয়ে সংগীত শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে পারি। আমরা যদি জানি যে এই ধরণের ট্রাফিকের মধ্যে আমাদের গাড়ি চালাতে হবে তাহলে আমরা ঐ সময়টাকে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করতে পারি। আমরা আমাদের কার্যালয়ের, আমাদের পরিবারের অথবা অন্য কোন সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি এবং ঐ সমস্যার একটা ভালো সমাধান বের করার চেষ্টা করতে পারি।

যদি কোন কঠিন পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার জন্য আমাদের কাছে কোন কিছু করার না থাকে তাহলে সেটাকে মেনে নিতে হবে এবং সর্বোত্তম উপায়ে তার মোকাবিলা করতে হবে। আমরা যদি অন্ধকারে আমাদের পায়ের আঙুলে আঘাত করি আর তার কারণে আমরা লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে চিৎকার করতে লাগি তাহলে কি আমাদের আঙুলের ব্যথা কিছুটা কমে যাবে? আমেরিকান ভাষায় আমরা একে “আঘাত নৃত্য” বলি। আঘাত লাগার কারণে আপনি এতটাই ব্যথা অনুভব করেন যে তার কারণে আপনি লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে নাচতে শুরু করেন; কিন্তু এর কারণে আপনার ব্যথা কখনো কম হয় না। ঐ পরিস্থিতিতে আমরা খুব বেশি কিছু করতে পারি না। শুধু আমরা যেটা করতে পারি সেটা হল আমরা যে কাজটা শুরু করেছিলাম সেটাকে ক’রে যেতে হবে। ব্যথা হল অস্থায়ী। এটা এমনই জিনিস যা চলে যায়। এটা চিরকালের জন্য স্থায়ী হয়ে থাকে না আর উপর-নীচে লাফালে-ঝাঁপালে আর চিৎকার-চেঁচামেচি করলে আমাদের ব্যথা কখনো কম হয়ে যায় না। আমরা কী চাই? আমরা কি চাই সবাই আসুক এবং এসে বলুক, “ঈশ্‌, তোমার আঙুলে চোট লেগেছে।” যদি একটা শিশু বা বাচ্চা চোট পায় তাহলে তখন তার মা এসে তাকে চুমু খায় যা তাকে স্বস্তি বোধ করায়। তাহলে আমরাও কি সেই আশা করে থাকব যে লোকজন আমাদের সাথে একই রকমভাবে আচরণ করুক যেমনটা একটা শিশুর সাথে করা হয়?

লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় আমরা যদি সত্যতার কথা ভাবি- যে আমি এই লাইনে কখনোই ৩২ বা ৯ নং-এ দাঁড়াব না, তাহলে অবশেষে আমারই পালা আসবে, আর এটা আমাদের ঐ পরিস্থিতিকে সহ্য করতে সহায়তা করবে এবং আমরা ঐ সময়টাকে অন্য কোন কাজে লাগাতে পারব। ভারতে একটা প্রবাদ আছেঃ “অপেক্ষা করার নিজস্ব একটা আনন্দ আছে।” এটা সত্য, কারণ যদি লাইনে বা বাসের জন্য আমার পালার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে আমরা সেই সময়টাকে লাইনে, বাসস্টান্ডে অন্যান্য লোকজনদের সম্পর্কে সচেতন হতে ব্যবহার করতে পারি এবং তার সাথে কার্যালয়ে যা কিছু ঘটছে অথবা অন্য কোন বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য ব্যবহার করতে পারি। এটা আমাদেরকে অন্যদের সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হওয়া এবং করুণা বিকাশ করতে সহায়তা করে। যদি আমরা সেখানে আটকে থাকি, তাহলে আধঘন্টা ধরে অন্য কাউকে গালাগালি করার পরিবর্তে সেই সময়টাকে গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করতে পারি।

পরামর্শপূর্ণ একটি লাইন প্রস্তুত ক’রে শান্তিদেব বলেনঃ “যদি কোন ব্যক্তি আমাদের লাঠি দিয়ে আঘাত করে তখন আমাদের কার উপর রাগ করা উচিত? আমরা কি ঐ ব্যক্তির উপর রাগ করব না লাঠিটির উপর?” আমরা যদি এটার সম্পর্ককে যুক্তিসঙ্গতভাবে ভাবি তাহলে তো আমাদের ঐ লাঠির উপর ক্রোধিত হওয়া উচিত, কারণ ঐ লাঠিটিই তো আমাদের আঘাত করেছিল। কিন্তু এটা এরকম করলে তো বোকামি হবে। কেউ কখনো লাঠির প্রতি ক্রোধিত হয় না; আমরা ক্রোধিত হই ঐ ব্যক্তির উপর। আমরা কেন ঐ ব্যক্তির উপর ক্রোধিত হই? এর কারণ হল লাঠিটি ঐ ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। একইভাবে আমরা যদি আরও চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে ঐ ব্যক্তি তার অশান্তকারী আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। সুতরাং যদি আমাদের ক্রোধিত হতেই হয় তাহলে আমাদের ঐ ব্যক্তির অশান্তকারী আবেগের উপর ক্রোধিত হওয়া উচিত যা তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে প্রেরিত করেছিল।

তারপর আমরা বিচার করতে পারিঃ “এই অশান্তকারী আবেগ কোথা থেকে এসেছে? এটা কোথাও থেকে উদ্ভূত হয়নি। আমি এমন কিছু করেছিলাম যার কারণে এটা উদ্ভূত হয়েছিল। আমি এমন কিছু করেছিলাম যার কারণে ঐ ব্যক্তির মধ্যে ক্রোধ জেগেছিল আর তারপর সে আমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিল। ঠিক একইরকম ভাবে আমি হয়তো কাউকে আমার উপকার করতে বলেছিলাম এবং সে যখন সেটা করতে অস্বীকার করেছিল আমিই ক্রোধিত হয়ে উঠেছিলাম। এর কারণে আমি আঘাত পেয়েছিলাম। দেখুন আমি যদি এই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে আমি বুঝতে পারব এটা আসলে আমার নিজের দোষ ছিল। আমি খুব অলস ছিলাম এবং সেইজন্য ঐ কাজটা আমি নিজে করিনি। আমি ঐ ব্যক্তিকে আমার উপকার করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম এবং যখন সে এটা করতে অস্বীকার করেছিল আমি ক্রোধিত হয়ে উঠেছিলাম। আমি নিজে যদি এতটা অলস না হতাম তাহলে আমি ঐ ব্যক্তিকে কখনো অনুরোধ করতাম না। ফলে পুরো সমস্যাটাও কখনো উদ্ভূত হতো না। অতএব আমাকে যদি ক্রোধিত হতেই হয় তাহলে নিজের উপর ক্রোধিত হওয়া উচিত। কারণ আমি এত বোকা এবং অলস যে আমার উপকারের জন্য আমি ঐ ব্যক্তিকে অনুরোধ করেছিলাম।”

এমনকি যখন সেখানে আমাদের আংশিক দোষ না থাকে তাহলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা নিজেরাই এই অশান্তকারী আবেগ থেকে মুক্ত কিনা যা অন্য ব্যক্তিকে এরকম আচরণ করতে পরিচালনা করে, যেমন- স্বার্থপরতাঃ “তিনি আমার একটা উপকার করতে অস্বীকার করেছিলেন। আচ্ছা, তবে আমি কি সবসময় অন্যদের উপকার করি? আমি কি এমন একজন কেউ যে সবসময় অন্যদের সহযোগিতা করতে তৎপর থাকে আর অবিলম্বে সেটা করে দেয়? যদি আমি না হই বা না হয়ে থাকি তাহলে আমি কেন অন্য লোকজনদের সবসময় আমার জন্য কষ্ট ক’রে সহায়তা করার আশা করব? ক্রোধকে মোকাবিলা করার এটা আর একটি উপায়।

আমি আগে উল্লেখ করেছি যে ক্রোধকে সবসময় অন্যের প্রতি চিৎকার-চেঁচামেচি ক’রে বা আঘাত ক’রে প্রকাশ করতে হবে তার কোন মানে নেই। সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্রোধ হল একটা অশান্তকারী আবেগ, যখন এটা উদ্ভূত হয় তখন আমরা অস্বস্তি বোধ করি। সেইজন্য আমরা যদি এটাকে নিজেদের ভিতরে চেপে রাখি এবং কখনো সেটা প্রকাশ না করি, তবুও ক্রোধ আমাদের ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক ভাবে কাজ করতে থাকবে এবং আমাদের ভীষণ অশান্ত করবে। পরবর্তীতে সেটা ভীষণ ধ্বংসাত্মক ভাবে বাইরে প্রকাশ হবে। ভিতরে চেপে রাখা এই ক্রোধকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য আমাদের ঐ একই পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করতে হবে যা আমি এখন ব্যাখ্যা করেছি। আমাদের অবশ্যই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের ধৈর্য ভাব অবশ্যই বিকাশ করতে হবে।

ধৈর্যের বিভিন্ন ভেদ

লক্ষ্য- ধৈর্য

ধৈর্য অনেক প্রকারের হয়। প্রথমটা হল লক্ষ্য-ধৈর্য। এর অভিপ্রায় হল আপনি যদি কোন লক্ষ্য নির্ধারণ না করেন তাহলে কেউ এটার দিকে নিশানা লাগাতে পারবে না। আমেরিকায় ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের জন্য একটা খেলা আছে। তারা পিন অথবা আঠা দিয়ে তাদের বন্ধুর প্যান্টের আসনে একটা কাগজের টুকরো লাগিয়ে দেয়। ঐ কাগজের টুকরোতে তারা লিখে দেয় “আমাকে লাথি মার” আর সেইজন্য এটাকে “লাথি মার” চিহ্ন বলা হয়। তারপর যে কেউ ঐ ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের পিছনে “লাথি মার” লেখাটা দেখে সে তাকে লাথি মারে। ঠিক একই রকম এই ধরণের ধৈর্যের মাধ্যমে আমরা বিচার করি কীভাবে আমরা অতীতে আমাদের নিজেদের নেতিবাচক এবং ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের পিছনে এইরকম একটা “লাথি মার” চিহ্নটি লাগিয়ে রেখেছি যা এখন এই ধরণের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উদাহরণ স্বরূপ, ধরুন কোন একটা রাস্তায় আমাদের ছিনতাই হল। আমরা ভাবব, “আমি যদি অতীতে বা পুনর্জন্মে নেতিবাচক এবং ধ্বংসাত্মক ভাবে আচরণ ক’রে এই লক্ষ্যটি নির্ধারণ না করতাম তাহলে আমার মনে এই তীব্র ইচ্ছাটি জাগত না যে ঐ অন্ধকার রাস্তা দিয়ে ঠিক ঐ সময় যাতায়াত করব যখন কোন ছিনতাইকারী আমাকে ছিনতাই করার জন্য এবং মারার জন্য অপেক্ষা করবে। সাধারণতঃ আমি ঐ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করি না কিন্তু আমার মনে এই ইচ্ছা জেগেছিল যে আমি এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করব। মোটামুটি আমি অনেক আগেই বাড়ি ফিরে যাই কিন্তু সেই রাতে আমার মনে এই ইচ্ছাটি জেগেছিল আমি আরও কিছুক্ষণ আমার বন্ধুদের সাথে কাটাবো। এছাড়াও আমি ঠিক সেই সময় ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম যখন সেখানে একজন ডাকাত কারও আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। কেন আমার মস্তিষ্কে এই প্রেরণাটা জেগেছিল? এই কারণে এরকম ঘটেছিল যে আমি নিশ্চয় অতীতে এমন কিছু করেছিলাম যার কারণে এই ব্যক্তিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আর সেটা এখন হেতু এবং ফলের ভিত্তিতে পরিপক্ক হচ্ছে। আমাদের মনে আবেগ প্রকট হয় কর্মের অভিব্যক্তি হিসাবে। সেই জন্য আমরা ভাবতে পারিঃ “আমি আমার অতীতের নেতিবাচক কর্মফল হ্রাস করছি। আমার অত্যন্ত খুশী হওয়া উচিত যে আমি এত হালকা ভাবে বোঝাহীন হচ্ছি কারণ এটা আরও খারাপ হতে পারত। এই ব্যক্তিটি কেবল আমাকে ছিনতাই করেছে সে কিন্তু আমাকে গুলিও করতে পারত, সুতরাং আমাকে খুব স্বস্তিবোধ করা উচিত যে এই নেতিবাচকতা আমার উপর এত হালকাভাবে পরিপক্ক হয়েছে এবং আমি এর থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছি। ফলটা এতটা খারাপ ছিল না। আর ভালো বিষয়টা হল আমি এটার থেকে পরিত্রাণ পেয়ে গিয়েছি, আমি বেঁচে গিয়েছি। ঐ কর্মের ঋণ আর আমার উপর নেই।”

এই ধরণের চিন্তা-ভাবনা খুবই সহায়ক। আমার মনে আছে একবার আমি আমার বন্ধুর সাথে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছিলাম, আমরা বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে গাড়ি চালাচ্ছিলাম আর আমাদের গন্তব্য স্থলটি শহর থেকে অনেক দূরে ছিল। প্রায় দেড় ঘন্টা গাড়ি চালানোর পর আমরা গাড়ি থেকে একটা বিচিত্র আওয়াজ শুনতে পাই। আমরা রাস্তার পাশে একটা স্টেশনে একজন মেকানিকের কাছে গাড়িটা থামাই। গাড়িটি পরীক্ষা ক’রে মিস্ত্রি বলে যে গাড়ির এক্সেলটা ফেটে গেছে যার কারণে গাড়িটা আর চালিয়ে নিয়ে যেতে পারা যাবে না। সেই কারণে গাড়িটিকে একটা বড় শহরে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি টানা ট্রাক জোগাড় করতে হয়েছিল। ঐ সময় আমি এবং আমার বন্ধু কিন্তু ভীষণ রেগে যেতে পারতাম এবং বিচলিত হতে পারতাম কারণ আমরা সপ্তাহান্তে বিশ্রামের জন্য একটা সুন্দর সমুদ্র সৈকতে গিয়ে ছুটি কাটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা আলাদা দৃষ্টিকোণের সাথে আমরা ঐ ঘটনাটিকে একেবারে আলাদা ভাবে দেখেছিলামঃ “বাঃ এটা তো চমৎকার! ভালো হয়েছে যে এরকম ঘটেছে কারণ আমরা যদি নিয়মিত ভাবে গাড়ি চালিয়ে যেতাম তাহলে চলন্ত গাড়ির এক্সেলটা ভেঙে যেতে পারত। আমাদের সাথে একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটতে পারত এবং আমাদের দুজনের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারত। সুতরাং খুব ভালো হয়েছে যে কর্মফলটা এইভাবে পরিপক্ক হয়েছে। আমরা বড় ক্ষতি থেকে বেঁচে গিয়েছি।” সুতরাং স্বাচ্ছন্দ্য মনে গাড়ি টানা ট্রাকের সাহায্যে আমরা গাড়িটিকে শহরে নিয়ে গিয়েছিলাম আর সেখানে গিয়ে অন্য একটি গাড়ি ধার করেছিলাম আর তারপর আমরা অন্যস্থানের জন্য রওনা দিয়েছিলাম।

আপনারা দেখুন, এই ধরণের পরিস্থিতিতে আমরা অনেক রকমের প্রতিক্রিয়া দেখতে পারি তবে ক্রোধিত এবং বিরক্ত হলে কোনভাবেই সেটা সহায়ক হয় না। আমরা যদি এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখিঃ “এইভাবে আমার অতীতের নেতিবাচক কর্মফল হ্রাস হচ্ছে। ঐ কর্মের ঋণ এখন পরিপক্ক হয়েছে। চমৎকার, এটার এখন নির্মূল হয়ে গেল। অন্যথায় এটা আরও খারাপ হতে পারত।” ঐ পরিস্থিতিকে পরিচালনা করার এটা একটা বিবেকশীল উপায়।

মৈত্রী এবং করুণা সাদৃশ্য ধৈর্য

আরও এক প্রকারের ধৈর্য আছে যাকে “মৈত্রী এবং করুণা সাদৃশ্য ধৈর্য” বলা হয়। এই ধরণের ধৈর্য ধারণ ক’রে আমরা কোন ব্যক্তিকে পাগল ব্যক্তি অথবা মানসিকভাবে বিপর্যস্তরূপে বিবেচনা করি যে আমাদের উপর ক্রোধিত হয় অথবা চিৎকার চেঁচামেচি করে। এই ধরণের ধৈর্য এমন কারও ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে যে আমাদের অন্যদের সামনে লজ্জিত করে অথবা আমরা সমালোচিত হই। এর কারণে আমাদের দুর্নাম হতে পারে আর সেইজন্য আমরা তার উপর ক্রোধিত হতে পারি। উদাহরণ স্বরূপ, যদি একটা টিয়া পাখি অন্যদের সামনে আমাদের নাম ধরে ডাকে অর্থাৎ দুর্নাম করে তাহলে এর কারণে আমাদের দুর্নাম হয় না, হয় কি? সেখানে পাখিটির উপর ক্রোধিত হবার কোন মানে হয় না। এটা একটা বোকামির পরিচয় হবে। একইভাবে যদি একটা পাগল আমাদের প্রতি চিৎকার-চেঁচামেচি করা শুরু করে, তাতেও আমাদের দুর্নাম হয় না। সবাই জানে শিশুরা কখনো-কখনো মেজাজ হারিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। এছাড়াও একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কখনো একজন রোগীর প্রতি ক্রোধিত হয় না কেননা সেই রোগী নিজেই ক্রোধিত হয়। পরিবর্তে তিনিই রোগীর প্রতি করুণাভাব বজায় রাখেন।

একইভাবে আমাদেরকেও এরকম সকলের প্রতি করুণাভাব বিকাশ করা উচিত যারা আমাদের বিরক্ত করে, আমাদের উপর ক্রোধিত হয় অথবা লজ্জিত করে। আমাদের বুঝতে হবে যে প্রকৃতপক্ষে দুর্নাম তাদেরই হয়, তাই নয় কি? আমাদের দুর্নাম হয় না সবাই দেখতে পায় এবং বুঝতে পারে যে এই ব্যক্তিটিই হলেন তিনি যিনি নিজেকে মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছেন। এইরকম পরিস্থিতিতে আমাদেরকে ঐ ব্যক্তির প্রতি ক্রোধিত হওয়ার পরিবর্তে করুণাভাব জাগানো উচিত।

এর অর্থ এই নয় যে যদি কোন ব্যক্তি আমাদের আঘাত করার চেষ্টা করে তাহলে আমরা তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করব না। আমাদের ছেলে-মেয়েরা যদি চিৎকার চেঁচামেচি করে আমরা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করি। আমরা তাদেরকে আমাদের, অন্যদের অথবা নিজেদের ক্ষতি করা থেকে বাধা দিতে চাই। মূল বিষয়টা হল সেখানে বাধা দেওয়াটা ক্রোধিত হয়ে না করা। আমাদের ছেলে-মেয়েরা যদি দুষ্টুমি করে তাহলে আমরা ক্রোধিত হয়ে নয় বরং তাদের ভালোর জন্য শাসন করি। আমরা চাই যে আমাদের সন্তানের যেন দুর্নাম না হয় এবং মানুষ তার সম্পর্কে খারাপ সমালোচনা না করে। এইভাবে আমরা আমাদের সন্তানকে ক্রোধিত না হয়ে বরং তারজন্য উদ্বিগ্ন হয়ে শাসন করি।

গুরু-শিষ্য-এর মতো ধৈর্য

এরপর আর একটা ধৈর্য আছে সেটা হল “গুরু-শিষ্য-এর মতো ধৈর্য।” এই বিষয়টি এই তথ্যের উপর নির্ভর করে যে গুরু ছাড়া কোন শিষ্য জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। সেইজন্য যদি কেউ আমাদের পরীক্ষা না করত তাহলে আমরা ধৈর্য বিকাশ করতে পারতাম না। দশম শতাব্দীতে ভারতের মহান আচার্য অতীশ দীপঙ্করকে তীব্বতে বৌদ্ধধর্মকে পুনর্জীবিত করার জন্য আমন্ত্রিত করা হয়েছিল। ঐ ভারতীয় আচার্য তার সাথে একজন রাঁধুনীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঐ ভারতীয় রাঁধুনীটা কখনোই সঠিক ভাবে বা সম্মানের সাথে কাজ করত না। তার কাজ সম্পূর্ণভাবে অপ্রীতিকর এবং নিন্দনীয় ছিল। তিব্বতী জনগণ অতীশকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। আর সেইজন্য তারা তাকে অনুরোধ করেছিলেনঃ “আচার্য আপনি কেন এই অপ্রীতিকর রাঁধুনীটাকে আপনার সাথে ভারত থেকে নিয়ে এসেছেন? আপনি কেন এনাকে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছেন না? আমরা আপনার জন্য রান্না করতে পারব; আমরা খুব ভালো রান্না করতে পারি।” অতীশ তাদের উত্তর দিয়েছিলেনঃ “ওহ্‌, তিনি কেবল একজন রাঁধুনী নন। আমি তাকে আমার সাথে নিয়ে এসেছি কারণ তিনি হলেন আমার ধৈর্যের শিক্ষক!”

একইভাবে যদি আমাদের কার্যালয়ে এমন অপ্রীতিকর কেউ থাকে যে সবসময় আমাদের বিরক্তিকর কথা বলে, আমরা ঐ ব্যক্তিকে আমাদের ধৈর্যের শিক্ষক হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। এরকম কিছু লোক আছে যাদের অভ্যাস অত্যন্ত বিরক্তিকর হয় যেমন- সবসময় আঙুল ফোটানো। যদি কেউ কখনো আমাদের পরীক্ষা না করে তাহলে আমরা কীভাবে নিজেদের বিকাশ করব। আমরা যদি বিমানবন্দর বা বাসস্ট্যান্ডে দীর্ঘসময় ধরে বিলম্ব করার মতো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হই তাহলে আমরা ধৈর্য অনুশীলন করার সুবর্ণ সুযোগ হিসাবে এটাকে ব্যবহার করতে পারিঃ “আহ্‌! আমি তো ধৈর্যের প্রশিক্ষণ নিয়েই চলেছি। আমি ধৈর্য বিকশিত করার প্রশিক্ষণ নিয়ে চলেছি। এবার আমি একটা সুযোগ পেয়েছি এটা দেখার জন্য যে আমি বাস্তবে ধৈর্য অনুশীলন করতে পারি কিনা।” অথবা আমাদের যদি কোন কার্যালয় থেকে আমলাতান্ত্রিক ফর্ম পেতে অসুবিধা হয় তাহলে আমরা এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। “এটার অনুশীলন তো এমনই, যেমন আমি কিছু সময় ধ’রে যুদ্ধকলা শেখার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে চলেছি। আর যখন আমি আমার দক্ষতা প্রদর্শন করার সুযোগ পেয়েছি এতে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।” একইভাবে আমরা যদি ধৈর্য এবং সহনশীলতার প্রশিক্ষণ নিয়ে চলি আর এর মধ্যে যদি কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হই তাহলে আমরা এটাকে অত্যন্ত আনন্দের সাথে দেখবঃ “আহ্‌! এটা তো একটা চ্যালেঞ্জ দেখা যাক আমি আমার মেজাজ না হারিয়ে, ক্রোধিত না হয়ে, এমনকি মনে-মনে খারাপ না ভেবে এটাকে সামলাতে পারি কিনা।”

আমাদের ধৈর্য না হারানো যুদ্ধকলার কোন মোকাবিলার থেকেও অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এর কারণ হল যে এখানে আমাদের চ্যালেঞ্জটা আমাদের শারীরিক বল এবং শারীরিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আমাদের মন এবং আমাদের অনুভূতির মাধ্যমে করতে হয়। যদি অন্য কেউ আমাদের সমালোচনা করে তাহলে আমাদের ঐ সমালোচনাকে দেখতে হবে যে, আমরা আমাদের বিকাশের পথে কত দূর উন্নতি করেছি আর এটাকে নিয়ে ক্রোধিত হওয়া উচিত না। “এই ব্যক্তিটি যিনি আমরা সমালোচনা করছেন, হতে পারে তিনি আমার সম্পর্কে এমন কিছু নির্দেশ করছেন যা থেকে আমি কিছু শিখতে পারি।” এই অর্থে আমাদের সমালোচনাকে সহ্য করার চেষ্টা করতে হবে এবং আমাদের মনোভাব পরিবর্তন ক’রে কীভাবে এটাকে পরিচালনা করা যায় সেটা শিখতে হবে। আমরা যদি বিক্ষুব্ধ হয়ে যাই তাহলে এর কারণে আমাদের যা দুর্নাম হবে সেটা কোন পাগল ব্যক্তি দ্বারা সমালোচনা এবং চিৎকার-চেঁচামেচি করার ফলে যে দুর্নাম অর্জন করে তার থেকে অনেক বেশি হবে।

বস্তুর স্বভাবের প্রতি ধৈর্য রাখা

ক্রোধের সাথে মোকাবিলা করা অথবা ধৈর্যকে বিকাশ করার আর একটি উপায় হল “বস্তুর স্বভাবের প্রতি ধৈর্য রাখা।” এটা হল শিশুসুলভ মানুষের খারাপ এবং অসভ্য স্বভাবের মতো। যদি কোথাও আগুন থাকে তাহলে সেখানে গরম হাওয়া এবং জ্বালিয়ে দেওয়া হল তার স্বভাব। তাই আমরা যদি ঐ আগুনে হাত রাখি আর তখন যদি হাত পুড়ে যায় তাহলে আমরা তার থেকে আর কী আশা করতে পারি? আগুন তো গরমই হয়; এইজন্য আগুন পুড়িয়ে দেয়। আমরা যদি দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার সময় শহরের দিকে গাড়ি চালাই তাহলে আমরা তার থেকে কী আশা করতে পারি? সময়টাতো মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় আর সেইজন্য রাস্তার ভিড়-ভাট্টা তো হবেই- এটাতো বস্তুর স্বভাব। আমরা যদি একটা শিশুকে একটা ট্রে অথবা এককাপ গরম চা নিয়ে যেতে বলি, সে তো ফেলে দেবেই। আমরা তার থেকে কী আশাই বা করতে পারি? সে তো একটা শিশু এবং সেইজন্য আমরা তার থেকে এই আশা করতে পারি না যে সে কিছুই ফেলে দেবে না। একইভাবে আমরা যদি অন্য লোকজনদের অনুরোধ করি যে তারা আমাদের কোন কাজ ক’রে দিক অথবা আমাদের ব্যবসা-বানিজ্যের লাভের জন্য কিছু করুক, এরজন্য আমরা তারসাথে চুক্তি করি আর তারপর তারা যদি আমাদের হতাশ ক’রে দেয় তাহলে আমাদের তার থেকে কী আশা করা উচিত? মানুষ তো শিশুসুলভ আচরণ করে; আমরা কারও উপর ভরসা করতে পারি না। ভারতের মহান আচার্য শান্তিদেব বলেছেনঃ “আপনি যদি কোন ইতিবাচক বা গঠনমূলক কিছু করতে চান তাহলে আপনি নিজেই সেটা করুন। অন্য কারও উপর নির্ভর করবেন না। এর কারণ হল আপনি যদি কারও উপর নির্ভর করেন তাহলে এটা নিশ্চিত সে আপনাকে নত এবং নিরাশ করবেই।” এই ধরণের পরিস্থিতির প্রতি আমাদের দৃষ্টিকোণ এইরকম হওয়া উচিতঃ “ঠিক আছে আমি কী আশা করতে পারতাম? যদি মানুষের স্বভাব অন্যদের নত ক’রে হতাশ করা হয় তাহলে আমাদের তো ক্রোধিত হওয়ার কোন মানে হয় না।”

বাস্তব ধৈর্যের ক্ষেত্র

ধৈর্যকে মোকাবিলা করার জন্য ব্যবহৃত শেষ পদ্ধতিটিকে “বাস্তব ধৈর্যের ক্ষেত্র” বলা হয়। আমাদের প্রবৃত্তিটি হল আমরা নিজেরা নিজেদেরকে, অন্যদেরকে এবং বস্তুকে এক ধরণের মূর্ত পরিচয় রূপে কল্পনা ক’রে বিচার করি। এটা এরকম যে আমরা আমাদের কল্পনার চারপাশে একটি বড় কঠিন রেখা আঁকি। আর তারপর সেটাকে একটা মূর্ত পরিচয় রূপে প্রদর্শন করিঃ “এটাই আমি; এভাবেই আমাকে সবসময় থাকতে হবে।” উদাহরণ স্বরূপ, “আমি জগতের জন্য ঈশ্বরের বরদান” অথবা “আমি একজন অসফল ব্যর্থ ব্যক্তি।” অথবা আমরা অন্য কারও চারপাশে একটা বড় শক্ত রেখা টেনে রাখি এবং বলিঃ “সে অপ্রীতিকর, সে একজন সমস্যাসৃষ্টিকারী ব্যক্তি।” তবে সেটা যদি এই ব্যক্তির বাস্তবিক এবং মূর্ত পরিচয় হতো তাহলে তাকে সবসময় এইভাবেই থাকতে হতো। একটা ছোট্ট শিশু হিসাবেও তাকে এইভাবে থাকতে হতো। তাকে সকলের জন্য অপ্রীতিকর হতে হতো, তার স্ত্রী, তার কুকুর, তার বিড়াল এবং তার মাতা-পিতার প্রতিও, কারণ সে একজন সত্যিকার অপ্রীতিকর ব্যক্তি।

আমরা যদি বুঝতে পারি যে মানুষের চারপাশে কোন বড় মূর্ত রেখার অস্তিত্ব নেই যে তার মূর্ত এবং সত্য পরিচয় বা স্বভাবকে বর্ণনা করে, তাহলে এর কারণে আমাদের স্বস্তি লাভ হতো আর আমরা তাদের প্রতি ক্রোধিত হতাম না। আমরা বুঝে যাই যে এই ব্যক্তির অপ্রীতিকর আচরণটি একটি ক্ষণস্থায়ী ঘটনা ছিল- এমনকি সেটা যদি বার বার ঘটেও থাকে- আর ঐ আচরণ নিশ্চিত করে না যে তাকে সবসময় ঐ রকমই থাকতে হবে।

লাভদায়ক অভ্যাস বিকাশ করা

কঠিন পরিস্থিতিতে এই সমস্ত বিষয়গুলিকে প্রয়োগ করা ততটা সহজ নাও হতে পারে। যুক্তির এই সমস্ত বিভিন্ন পদ্ধতি “প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে পরিচিত। এইভাবে আমি “ধর্ম” শব্দটার অনুবাদ করি। “ধর্ম” হল একটা পরিমাপ যা আমরা সমস্যা প্রতিরোধের জন্য গ্রহণ করি। আমরা বিভিন্ন ধরণের ধৈর্যকে লাভদায়ক অভ্যাস হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা ক’রে ক্রোধিত হওয়া থেকে রেহাই পেতে চাই। এটাই তো ধ্যান-সাধনা। তিব্বতী ভাষায় ধ্যান-সাধনার জন্য ব্যবহৃত শব্দের অর্থ কিছু লাভদায়ক বিষয়বস্তুর জন্য নিজেকে অভ্যস্থ করার উদ্দেশ্যে কোন কিছুর অভ্যাসে পরিণত করা।

সর্বপ্রথম আমাদের ধৈর্য সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরণের ব্যাখ্যার শ্রবণ করতে হবে। এরপর আমাদেরকে তাদের সম্পর্কে বিচার করতে হবে, যাতে আমরা বুঝতে পারি এবং দেখতে পারি সেগুলি সঠিক কিনা। যদি সেগুলি অর্থপূর্ণ হয় এবং আমরা সেগুলি বুঝতে পারি আর তার সাথে আমরা সেগুলিকে প্রয়োগ করতে অনুপ্রেরিত হই, তাহলে সেগুলিকে বার-বার অনুশীলন করার মাধ্যমে তাদের একটি উপকারী অভ্যাস হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করব।

এটা করার জন্য আমাদের সর্বপ্রথম এর সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে হবে। এই বিষয়গুলি সম্পর্কে পর্যালোচনা করার পর আমাদেরকে সেগুলিকে যথাযথ ভাবে দেখতে হবে এবং অনুভব করতে হবে। আমাদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার ক’রে আমাদের মনের পরিস্থিতিকে চিত্রিত করতে হবে। আমরা এমন একটি পরিস্থিতির কল্পনা করতে পারি যেখানে আমরা প্রায়শই ক্রোধিত হই এবং বিরক্ত হয়ে উঠি। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের কার্যালয়ে এরকম আচরণ করতে পারে এমন কোন ব্যক্তি থাকতে পারে যাকে আমরা পছন্দ করি না। এই পরিস্থিতিতে প্রথমতঃ ঐ ব্যক্তিকে তার বাস্তবিক স্বরূপে, একজন মানুষ হিসাবে দেখার চেষ্টা করতে হবে যিনি সুখী হতে চান, দুঃখী নয়। যদিও তিনি তার পক্ষ থেকে সর্বস্ব করার চেষ্টা করেন তবুও তিনি একজন শিশুর মতো আর নিজেই জানেন না তিনি আসলে কী করছেন। যদি আমরা তার দিক থেকে এইভাবে দেখার এবং অনুভব করার চেষ্টা করি আর বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকার সময় নিজের মনে এর অনুশীলন করি তাহলে আমরা যত বেশি অনুশীলন করব, কার্যালয়ে থাকাকালীন আমরা ঐ ব্যক্তির প্রতি তত বেশী ইতিবাচক ভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবো, যখন তিনি আমাদের বিপরীতে অপ্রীতিকরভাবে আচরণ করা শুরু করবেন। ফলে তার প্রতি ক্রোধিত হওয়ার আবেগে ভেসে থাকার পরিবর্তে আমাদের মনে একটি নতুন প্রেরণা জাগবে যেটা হল আরও ধৈর্যশীল হয়ে কাজ করা, আরও সহনশীল হওয়ার প্রেরণা লাভ করা।

ঐ ব্যক্তির দুষ্টু আচরণের প্রতি ধৈর্য বিকাশ করার দৃষ্টিতে তাকে একটা শিশুর মতো দেখার অভ্যাস গড়ে তোলার পর আমরা আমাদের অনুশীলনকে আরও একধাপ আগে নিয়ে যেতে পারি। আমরা দেখতে পাই যে যখন তিনি অপ্রীতিকরভাবে আচরণ করেন তখন তার দুর্ণাম হয়ে যায়। এইভাবে আমরা তার প্রতি করুণা ভাব বিকাশ করি। ধ্যানের মাধ্যমে আমরা এইভাবে দেখার এবং অনুভব করার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি। যখন ধৈর্যের সাথে যেকোন বস্তুকে দেখার এবং অনুভব করার একটা লাভদায়ক অভ্যাস গড়ে ওঠে তখন এটা আমাদের অস্তিত্বের একটা অংশ তৈরী হয়ে যায়। কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সময় এটা আমাদের স্বাভাবিক পদ্ধতি হয়ে ওঠে। যখন আমাদের মনে ক্রোধিত হওয়ার প্রেরণা উৎপন্ন হয় তখন ক্রোধিত হওয়ার আগে সেখানে একটা অন্তরাল তৈরী হয়। ফলে আমরা তাৎক্ষণিক ভাবে ক্রোধিত হই না, পরিবর্তে আরও ইতিবাচক আবেগ জাগে লাভদায়ক ভাবে কাজ করার জন্য।

বৌদ্ধধর্মের বক্তৃতায় সাধারণতঃ আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুভূতির উপর মনোনিবেশ করি। আর প্রতিটি কথোপকথনের শুরুতে আমরা আমাদের শ্বাসকে একুশবার গণনা করি। যখন আমরা লক্ষ্য করি যে আমাদের মধ্যে ক্রোধ জাগতে চলেছে ঐ সময় এই অনুশীলনটি খুব উপকারী হয়। এটা এমন একটি স্থান তৈরি করে যেখানে আমরা তাৎক্ষণিক ভাবে কঠোর কিছু বলার জন্য নেতিবাচক আবেগকে কার্যকর করি না। উদাহরণ স্বরূপ, এটা আমাদের চিন্তা-ভাবনা করার জন্য একটা অন্তরাল তৈরি ক’রে দেয় যে আমরা ক্রোধিত এবং বিরক্ত হব কিনা। আমরা ভাবি, “আমি কি সত্যিই অযথা একটা দৃশ্য তৈরি করতে চাই অথবা এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য কি কোন বিকল্প উপায় নেই?” ধ্যান-সাধনা এবং আরও বেশি লাভদায়ক অভ্যাস গড়ে তোলার পরিণাম স্বরূপ আমরা পরিস্থিতিকে আরও বেশি ধৈর্যের সাথে বিচার করতে পারব এবং তার প্রতি আরও বেশি সহনশীল বোধ করব। ফলে আমাদের মস্তিষ্কে আরও বেশি ইতিবাচক বিকল্প জাগবে এবং আমরা সেগুলিকে স্বাভাবিক ভাবে বেছে নেব। যেহেতু আমরা সুখী হতে চাই, তাই আমরা বুঝতে পারব যে এই বিকল্পগুলি আমাদের কাঙ্খিত পরিণাম প্রাপ্ত করতে সহায়তা করবে।

এটা করার জন্য আমাদের একাগ্রতা প্রয়োজন। এই কারণে একাগ্রতা (সমাধি) বিকাশের জন্য বৌদ্ধধর্মে বিভিন্ন ধ্যান পদ্ধতি নির্ধারিত আছে। এই পদ্ধতিগুলি কেবল একটা মূর্ত ব্যায়াম হিসাবে শেখা হয় না; পরিবর্তে এগুলি ব্যবহার এবং প্রয়োগ করার জন্য শেখা হয়। আমরা কখন সেগুলিকে প্রয়োগ করব? আমরা সেগুলি কঠিন পরিস্থিতিতে যখন আমরা অপ্রীতিকর ব্যক্তি বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হই তখন প্রয়োগ করব। এই পদ্ধতিগুলি আমাদের মনকে ধৈর্য রাখতে সহায়তা করে।

সারাংশ

আমরা কেবল আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলা (শীল) পালন ক’রে নিজেদেরকে নেতিবাচক এবং ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত রাখতে পারি না। আমরা যদি কেবল আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলার সহায়তায় এটা করি তাহলে ক্রোধ আমাদের ভিতরেই থেকে যাবে। আমরা কেবল বাহ্যরূপে কঠোর ভাব দেখাই কিন্তু ভিতরে ক্রোধের আগুন জ্বলতে থাকে আর এটা করলে আমাদের মধ্যে আলসার রোগের বিকাশ হয়। কিন্তু তার বিপরীতে আমরা যখন এই পদ্ধতিগুলি সঠিকভাবে প্রয়োগ করি তখন আমাদের মধ্যে আর ক্রোধ জাগে না। এখানে বিষয়টা হল ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সেটাকে ভিতরে চেপে রাখা নয়; বরং আমাদের মধ্যে যে আবেগগুলি জাগে সেগুলিকে প্রতিস্থাপন করার বিষয়। এরফলে যখন নেতিবাচক আবেগ উৎপন্ন হবে সেগুলিকে ভিতরে-ভিতরে নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে আমাদের ভিতরে ইতিবাচক আবেগ উৎপন্ন হবে।

একবার যদি আমরা এটা করতে পারি তাহলে আমাদের প্রেরণার ভিত্তিকে আমরা আমাদের বর্তমান সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারব আর ভবিষ্যতে আমাদের পরিস্থিতি আর বেশি গুরুতর হবে না, অথবা আমাদের কোন রকমের সমস্যা থাকবে না, অথবা প্রবলতম এবং সর্বাধিক উন্নত প্রেরণার মাধ্যমে আমরা আমাদের পরিবার, আমাদের বন্ধু-বান্ধব এবং আমাদের আশপাশের লোকজনদের জন্য কোন সমস্যার সৃষ্টি করব না। তার পরিবর্তে আমরা অপরদের পূর্ণাঙ্গ উপকার করতে সক্ষম হব। আমরা সেটা এইজন্যই করতে সক্ষম হব কারণ তখন আমরা আমাদের অশান্তকারী আবেগ এবং সমস্যার কারণে সীমাবদ্ধ থাকব না। এইভাবে আমরা আমাদের পূর্ণ সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়ে উঠব।

Top