প্রকৃত দুঃখ এবং এই দুঃখগুলির প্রকৃত কারণ
বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছিলেন যে, যদিও আমাদের জীবনে অনেক ব্যক্তিগত সমস্যা আছে যেগুলির আমরা সম্মুখীন হয়ে থাকি, তবে প্রকৃত দুঃখ বলতে এই সত্যটাকে বোঝায় যে আমরা বার বার আমাদের দুঃখের উৎপত্তিকে চিরস্থায়ী ক’রে তুলি। আমরা অনিয়ন্ত্রিত ভাবে উত্থান এবং পতন হয়ে যাওয়ার অসুখীতা এবং অতৃপ্ত সুখের অভিজ্ঞতাকে চিরস্থায়ী করি এবং প্রত্যেকটি পুনর্জন্মে আমরা এই মানসিক উত্থান-পতনগুলি ভোগ করি। এর ভিত্তি হিসাবে আমরা একটা সীমিত শরীর এবং মনকে চিরস্থায়ী করি। বুদ্ধ আরও উপদেশ দিয়েছিলেন যে এইগুলিকে চিরস্থায়ী করার প্রকৃত কারণগুলি আমাদের নিজেদের মনের মধ্যেই অস্তিমান রয়েছে।
আমাদের মন আমাদের নিজেদের এবং অন্যদের উপর আচরণের প্রভাব সম্পর্কে আর আমরা ও অন্য সবাই কীভাবে সমস্ত ধর্ম অস্তিমান তার সম্পর্কে একটি মিথ্যা বাস্তবতাকে অভিক্ষেপ করি। আমরা মিথ্যাভাবে কল্পনা করি যে আমরা কিছু নিটোল, স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তারূপে অস্তিমান, যাকে বলা হয় “আমি”। আর আমরা মিথ্যাভাবে কল্পনা করি যে আমাদের মন ও কিছু নিটোল সত্তা আমাদের মস্তিষ্কে বিদ্যমান যাকে আমরা সনাক্ত করি। এর কারণ হল আমাদের মস্তিষ্কের আওয়াজ আমাদের মনের মধ্যে রয়েছে ব’লে মনে হয় অথবা আমরা এমন কিছু একটা যন্ত্রের মতো বিবেচনা করি যেটা আমরা বস্তুকে বুঝতে এবং সেগুলির বিষয়ে ভাবতে ব্যবহার করি। আমরা অসচেতন যে এই অভিক্ষেপগুলির কোনটিই বাস্তবতার অনুরূপ হয় না, তবে খারাপ বিষয়টা হল যে আমরা বিশ্বাস করি যে সেগুলি সেরকম।
আপনারা কি কখনো এই ভেবে নিজেদের জন্য দুঃখ বোধ করেছেন, “কেউ আমাকে ভালোবাসে না; কেউ আমাকে প্রয়োজন বোধ মনে করে না?” অথবা সম্পূর্ণভাবে চাপ বোধ ক’রে ভেবেছেন, “আমি বিষয়টা পরিচালনা করতে পারছি না; এটা আমার জন্য অনেক বেশী?” এগুলি কি মনের সুখী অবস্থা? অবশ্যই না। আমরা আত্মমমতা এবং অসুখীতা বোধ করতে পারি কিন্তু তারসাথে আমরা এই কামনাও করতে পারি যে এই অনুভূতিগুলির যেন অবসান ঘটে। সমস্যাটি হল আমরা কীভাবে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে কল্পনা করি। এটা একটা রঙিন বই-এর মতো মনে হয়, যেখানে ঐ অসুখীতাটি একটা অন্ধকার মেঘ যার চারপাশে একটি কঠিন রেখার মধ্যে আছে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আর একটি “আমি” এর উপর ঝুলে রয়েছে, অর্থাৎ এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ যেটা রয়েছে একটি কঠিন রেখার মধ্যে। এই মিথ্যা চেহারাটি বাস্তবতার অনুরূপ, এমন বিশ্বাসের উপর ভিত্তি ক’রে –শুধু এটার মতো অনুভব করার কারণে- আমরা আমাদেরকে ভালোবাসার জন্য, ভালোবাসার আকাঙ্খা অথবা কেউ যখন আমাদের ভালোবাসে না তার প্রতি ক্রোধের মতো অশান্তকারী আবেগ বিকাশ করি। এই অশান্তকারী আবেগগুলি আমাদের সাথে সময় কাটাতে এবং আমাদের স্নেহ দেখানোর জন্য কারও কাছে অযৌক্তিক দাবী করতে একটা বাধ্যতামূলক কার্মিক প্ররোচনার সূত্রপাত করে। এমনকি তারা যদি আমাদের দাবী মেনে নেয়, ঐ পরিস্থিতিতে আমরা যেকোন স্বল্পমেয়াদী সুখ অনুভব করি না কেন সেটা কখনোই যথেষ্ট বলে মনে হয় না। আমরা আরও বেশি দাবী করি এবং অসুখী পরিস্থিতিকে চিরস্থায়ী ক’রে তুলি।
এই ধরণের চক্রে আমাদের মন বিভ্রান্ত এবং মেঘলা বা আচ্ছাদিত হয়। আমরা সরাসরি চিন্তা-ভাবনা করতে পারি না; আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তবে এই বিভ্রান্তি কি মনের স্বভাব? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের জানতে হবে বৌদ্ধধর্ম মতে “মন” বলতে কী বোঝায়। মন বলতে আমাদের মাথায় এমন কিছু আছে যা স্বয়ংসম্পূর্ণ “বস্তু” নয়, বরং এটা বোঝায় মানসিক ক্রিয়াকলাপকে। এটা বস্তুকে অনুভব করার ব্যক্তিগত এবং বিষয়গত মানসিক ক্রিয়াকলাপ। এটা নিয়মিতভাবে পরিবর্তন হতে থাকে, কারণ এটা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বস্তু উপভোগ করে কিন্তু এর ব্যবহারিক স্বভাব সবসময় একইরকম থাকে। এর গভীরতম স্বভাবও সবসময় একইরকম থাকে- এটা অসম্ভব উপায়ে অস্তিমান কিছু থেকে ব্যতীত।
মনের অস্তিত্বকে মিথ্যাভাবে কল্পনা করার অনেক উপায় আছে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা মনকে একটি নিটোল সত্তার মতো মনে করি যেটা হল একটি নিটোল সত্তা “আমি” অথবা এই ধরণের “আমি” দ্বারা ব্যবহৃত অভিন্ন কিছু। যেহেতু, এই মিথ্যা দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোনটিই মনের প্রকৃত স্বভাবের সাথে মিল খায় না- সেগুলি নিছক একটি কল্পনা এবং তাই সেগুলি মনের স্বভাবের অংশ নয়- এই মিথ্যা দৃষ্টিভঙ্গিগুলির উপর আধারিত সমস্ত মানসিক অবস্থাও মনের স্বভাবের অংশ হয়। এই মানসিক অবস্থাগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে “আমি” সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা, এটা “আমি”-কে সমর্থন করার জন্য নিরর্থক কর্মের দিকে আকৃষ্ট করে। এর কারণ হল এগুলির মধ্যে কোনটিই মনের স্বভাবের অংশ নয় আর সেটা স্বভাব সম্পর্কে ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে। ঐ ভুল ধারণাগুলি একবার সম্যক্ বোধগম্যতা দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে পারলে সেগুলি চিরতরে পরিহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে, মৈত্রী এবং করুণার মতো গঠনমূলক আবেগগুলি মনের স্বভাব সম্পর্কে ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে না। ঐ বড় পার্থক্যের কারণে সম্যক্ বোধগম্যতা সেগুলিকে স্থানচ্যুত করে না।
তাই দুঃখের সত্যিকারের নিরোধ বলতে আমাদের মনের অবসানকে বোঝায় না। আমাদের মন মৈত্রী, করুণা এবং সম্যক্ বোধগম্যতার মতো ভাল গুণাবলীর সাথে জীবনকাল থেকে আজীবন পর্যন্ত চলতে থাকে। যার অবসান ঘটে সেটা হল অজ্ঞতা, অশান্তকারী আবেগ এবং বাধ্যতামূলক কার্মিক প্ররোচনের নিয়ন্ত্রণে থাকা সীমিত শরীর এবং সীমিত মনযুক্ত আমাদের অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুনরাবৃত্ত পুনর্জন্ম।