দ্বিতীয় আর্যসত্যঃ দুঃখের প্রকৃত কারণ

প্রথম আর্যসত্য দুঃখসত্যের বর্ণনা প্রস্তুত করে যা আমরা সবাই অনুভব করি। আমাদের যদি এই সমস্ত দুঃখের অবসান ঘটাতে অনুপ্রাণিত হতে হয়, তাহলে আমাদের সঠিকভাবে তাদের প্রকৃত কারণগুলি সনাক্ত করতে হবে। আমরা যে প্রকৃত সমস্যার সম্মুখীন হই সেটা বলতে শুধু অসুখীতা এবং অসন্তুষ্টিকে বোঝায় না, যা আমরা অনুভব করে থাকি, স্বল্পস্থায়ী সুখ, যা সবসময় অপ্রত্যাশিতভাবে পরিবর্তন হতে থাকে এবং যার উৎপত্তিকে আমরা চিরস্থায়ী ক’রে তুলি, সেটাকেও বোঝায়। আরও ভয়াবহ বিষয়টি হল আমরা ঐ ধরণের সীমিত শরীর এবং মনকেও চিরস্থায়ী ক’রে তুলি, যার মাধ্যমে আমরা এই অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক উত্থান এবং পতনগুলি অনুভব করি। একটা প্রবাদ আছে, “যদি আপনার মাথাই না থাকত তাহলে মাথাব্যথাও থাকত না।” যদিও প্রবাদটি রসিক বলে মনে হয়, কিন্তু এরমধ্যে কিছু সত্য আছে। আর অবিশ্বাস্যভাবে তথাগত বুদ্ধ কেবল মাথাব্যথার সত্য কারণের খোঁজ করেননি, বরং এই ধরণের মাথাব্যথার সাথে-সাথে অবিরত অস্তিত্বের কারণেরও খোঁজ করেছেন। তিনি প্রকাশ করেছেন যে আমাদের আচরণগত হেতু এবং ফল আর বাস্তবতা বিষয়ে অসচেতনতা অথবা অবিদ্যাই হল এর প্রকৃত কারণ।

আমরা যেভাবে অস্তিমান তার বিষয়ে অসচেতনতা

আমরা এখন একুশতম শতাব্দীতে এমন একটি যুগে বাস করছি যেখানে চারিদিকে ছড়িয়ে আছে গুজব আর অনেকে বিশ্বাস করে তথাকথিত “বিকল্প সত্যকে।” হাজার-হাজার বছর আগে বুদ্ধ যেটা উপলব্ধি করেছিলেন তার একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে যে, অসচেতনতা হল সমস্ত দুঃখের প্রকৃত কারণ যাকে “অবিদ্যাও” বলা হয়। এই অসচেতনতার অর্থ ইন্টারনেট কীভাবে কাজ করে তার বিষয়ে অজ্ঞতাকে বোঝায় না, বরং এটা হল আমাদের আচরণের দীর্ঘমেয়াদী ফল সম্পর্কে অসচেতনতা এবং বিভ্রান্তি। আর এর মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে বাস্তবতা সম্পর্কে, বিশেষ ক’রে, আমরা কীভাবে অস্তিমান তার সম্পর্কে অসচেতনতা এবং বিভ্রান্তি। যে জিনিসগুলি বিষয়টাকে আরও খারাপ ক’রে তোলে সেটা আমরা আমাদের মিথ্যাদৃষ্টিকে সম্পূর্ণ সত্য ব’লে মনে করি।

আসুন, আমরা বিষয়টাকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখি। আমরা সকলেই আমাদের মস্তিষ্কে “আমি, আমি, আমি” সম্পর্কে কথা বলার একটা গুঞ্জন অনুভব করি। তার উপর ভিত্তি ক’রে আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্বাস করি যে আমাদের শরীর এবং মন থেকে আলাদা একটা সন্ধানযোগ্য সত্তা আছে, যাকে বলা হয় “আমি” এবং সে সমস্ত কথা বলে। এই বিভ্রান্তিকর বিশ্বাসকে আমরা আরও দৃঢ় ক’রে ফেলি, কারণ যখনই আমরা আমাদের মাথায় অভিযোগ করি যে “আমি”-এর সাথে যা ঘটছে অথবা আমরা ভাবি, এই “আমি” পরবর্তীতে যা করতে চলেছে, তখন মনে হয় কিছু নির্দিষ্ট সত্তা অবশ্যই আছে যার নাম “আমি”, যে আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। অবশ্যই আমরা অস্তিমান এবং বুদ্ধও সেটা অস্বীকার করেননি। তবে সমস্যাটি হল আমরা যেভাবে আমাদের অস্তিত্বকে অনুভব করি সেভাবে আমরা অস্তিমান নই। আমরা সেই সত্য সম্পর্কে অবগত নই; আমরা এই বিকল্প বাস্তবতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং তাই আমরা সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্ত।

নিজেদেরকে নিরাপদ বোধ করাতে অশান্তকারী আবেগ এবং বাধ্যতামূলক আচরণের জন্য নিরাপত্তাহীনতা এবং নিরর্থক প্রচেষ্টা

আমাদের সম্পর্কে একটি বিভ্রান্তিকে নিয়ে কিছু ভুল হওয়ার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত হল আমরা যখন বিশ্বাস করি যে এটি বাস্তবতার অনুরূপ, তখন আমরা নিরাপত্তাহীনতার দুঃখ অনুভব করি। নিরাপদ বোধ করার চেষ্টা করতে আমরা নিরর্থক প্রচেষ্টাই অনুভব করি যে, আমাদের নিজেদেরকেই প্রমাণ করতে হবে, নিজেদেরকেই রক্ষা করতে হবে অথবা নিজেদের দাবী করতে হবে। এই ধরণের অনুভূতি অশান্তকারী আবেগ সৃষ্টি করেঃ

  • এমন কিছু পাওয়ার আকাঙ্খা যা আমাদের নিরাপদ বোধ করাবে।
  • শত্রুতা এবং ক্রোধ আমাদের থেকে কিছুটা দূরে ঠেলে দেয় যাতে একইভাবে আমরা নিরাপদ বোধ করতে পারি।
  • নির্বোধতা (অজ্ঞতা) যার কারণে আমরা আমাদের চারপাশে প্রাচীর স্থাপন করি যাতে আমরা তার ভিতরে নিরাপদ বোধ করি।

এই অশান্তকারী আবেগগুলি আমাদের মনের শান্তি এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করে এবং এটা আমাদের পূর্বের প্রবণতা ও অভ্যাসের উপর ভিত্তি ক’রে কিছু করার বা বলার উদ্দেশ্যকে সূত্রপাত করে। এরপর একটা বাধ্যতামূলক কার্মিক প্ররোচনা বাস্তবে এটা করার বা বলার দিকে আমাদের আকৃষ্ট করে।

অসচেতনতা, অশান্তকারী আবেগ এবং বাধ্যতামূলক আচরণ হল আমাদের মানসিক উত্থান-পতনকে চিরস্থায়ী করার প্রকৃত কারণ

কার্মিক কারণ এবং ফল আমাদের আচরণের স্বল্পমেয়াদী পরিণামের উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করে না, বরং এটা করে দীর্ঘমেয়াদী পরিনামের উপর। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা নিজেদের নিয়ে নিরাপদ বোধ করি, আমরা আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার পোষ্টগুলিতে “লাইক” প্রাপ্ত করার আকাঙ্খা নিয়ে কল্পনা করি যে, সেগুলির প্রাপ্তি আমাদের অস্তিত্বকে নিশ্চিত করবে এবং আমাদের আত্ম-মূল্যের অনুভূতি প্রদান করবে। আপনি যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্ত থাকেন এবং সেখানে সেলফি পোষ্ট করেন, তখন আপনি আপনার নিজের অভিজ্ঞতা পরীক্ষা ক’রে দেখবেন। দিনে কত ঘন-ঘন ফোন চেক করার জন্য একটি বাধ্যতামূলক প্ররোচনা আপনার মধ্যে দেখা দেয় যে আপনি কতগুলি “লাইক” প্রাপ্ত করেছেন। আপনি যখন কাউকে আপনার পোষ্ট “লাইক” করতে দেখেন, তখন সেই সুখের তৎপরতা কতক্ষণ স্থায়ী হয়ে থাকে? আপনি কতক্ষণ পরে পুনরায় আপনার ফোন চেক করেন? আপনি কি পর্যাপ্ত সংখ্যায় “লাইক” প্রাপ্ত করেছেন? সারাদিন জোর ক’রে আপনার ফোন চেক করাটা কি মনের সুখের অবস্থা? এটা একটা স্পষ্ট উদাহরণ যে “লাইক”-এর আকাঙ্খার দীর্ঘমেয়াদী পরিণাম হল দুঃখ। এটা মিথ্যা কল্পনার উপর ভিত্তি করে যে একটা মূর্ত, স্বাধীনভাবে অস্তিমান “আমি” আছে যাকে যথেষ্ট পরিমাণ “লাইক” দিয়ে সুরক্ষিত করা যেতে পারে।

এমনকি আমাদের মধ্যে যদি ভাল অনুপ্রেরণা থাকে, যেমন- মৈত্রী, যার মাধ্যমে আমরা বাধ্যতামূলকভাবে আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের সাহায্য করি, এটা যদি নির্বোধ ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে তাহলে যেটা উপকারী বা প্রয়োজন মনে করা হয় সেটা হল, এটা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ভাল বোধ করাবে কিন্তু এর থেকে যে সুখ আমরা ভোগ করব সেটাতে আমরা তৃপ্ত হব না। সংক্ষেপে, আমাদের আবেগগত উত্থান এবং পতনের উৎপত্তির প্রকৃত কারণ হল আমাদের অসচেতনতা এবং ভুল ধারণা যে আমরা এবং অন্যরা, বাস্তবে সবকিছুই অস্তিমান; এছাড়াও অশান্তকারী আবেগ, বাধ্যতামূলক কার্মিক প্ররোচনা এবং বাধ্যতামূলক আচরণ যা সেগুলিকে সূত্রপাত করে।

অসচেতনতা, অশান্তকারী আবেগ এবং বাধ্যতামূলক আচরণ হল আমাদের অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক পুনর্জন্মকে চিরস্থায়ী করার প্রকৃত কারণ

বুদ্ধ বলেছেন যে অসচেতনতা, অশান্তকারী আবেগ এবং কার্মিক প্রবণতাগুলিও আমাদের অস্তিত্বকে বাধ্যতামূলকভাবে চিরস্থায়ী ক’রে তোলার প্রকৃত কারণ। এই জন্মে এবং ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি হিসাবে একটা সীমিত শরীর এবং মন দ্বারা অসুখীতা এবং অতৃপ্ত সুখের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। বুদ্ধ নির্দেশ করেছেন যে, এই অনুভূতির প্রতি আমাদের বিভ্রান্তিকর মনোভাবই আমাদের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্ত অস্তিত্বের প্রকৃত কারণ।

যখন স্বল্পস্থায়ী সুখের উৎপত্তি হয় আমরা সেটাকে প্রাপ্ত করার জন্য এমন তৃষ্ণা জাগাই সেটা যেন কখনোই স্থায়ী না হয়। অন্যদিকে, আমরা যখন দুঃখ বোধ করি তখন আমরা এমন তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠি যে সেটা যেন চিরতরে চলে যায়, যদিও আমাদের বাধ্যতামূলক আচরণ আরও বেশি অসুখীতার জন্ম দেয়। এমনকি আমরা যদি শক্তিশালী ব্যথানাশক ঔষধ সেবন করি যাতে আমরা কিছু অনুভব না করি অথবা আমরা গভীর ধ্যানের অবস্থায় ডুবে যাই, যেখানে আমরা আগের মতোই কোনকিছু অনুভব না করি, আমরা সেই অনুভূতির অবস্থার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠি যাতে সেটা হ্রাস না হয়ে যায়, যদিও সেটা অনিবার্যভাবে হয় না।

তদতিরিক্ত, “আমি”-কে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে রাখি যে এটা যেন একটা মূর্ত সত্তা। “বেচারা আমি” এর চিন্তার কারণেঃ “আমি এই সুখ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না; আমি এই অসুখীতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই; আমি চাই যে “কিছুই না”- এর অনুভূতি যেন বাদ পড়ে না যায়।” আমাদের মৃত্যুর সময় যখন “আমি” সম্পর্কে আমাদের বিভ্রান্তিকর ধারণা এবং আমাদের অনুভূতিগুলির প্রতি এই অশান্তকারী আবেগ জাগে তখন সেগুলি একটি কার্মিক আবেগ অর্থাৎ একটা বাধ্যতামূলক মানসিক প্ররোচনাকে সক্রিয় করে যা একটা চুম্বকের মতো আমাদের মন এবং অশান্তকারী আবেগগুলিকে একটি পুনর্জন্মের অবস্থার শরীরের দিকে আকর্ষণ করে। ফলে সেগুলির সাথে একটা পুনর্জন্ম গ্রহণ করার ইচ্ছা জাগে যাতে আমরা নিয়মিতভাবে জীবিত থাকতে পারি। এটা কিছুটা জীবিত থাকার প্রবৃত্তি সম্পর্কিত বৌদ্ধ সংস্করণের মতো।

দুঃখের প্রকৃত কারণের চারটি বৈশিষ্ট্য

এইভাবে আমাদের বিভ্রান্ত মনোভাবই হল আমাদের দুঃখের প্রকৃত কারণ। আসল বিষয়টা হল আমরা আমাদের দুঃখের অনিয়ন্ত্রিত পুনরাবৃত্তিকে চিরস্থায়ী করি। এর চারটি বৈশিষ্ট্য আছে, বিশেষ ক’রে আমাদের বারবার জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে। এই বৈশিষ্ট্যগুলির ভিত্তিতে আমরা এটাও বুঝতে পারি সেগুলি সাধারণভাবে কীভাবে দুঃখের প্রকৃত কারণ হয়ে ওঠেঃ 

  • প্রথমত, আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে অসচেতনতা আর তার সাথে যুক্ত অশান্তকারী আবেগ এবং বাধ্যতামূলক কার্মিক প্রবৃত্তি হল আমাদের দুঃখের প্রকৃত কারণ। আমাদের দুঃখ অকারণ থেকে বা কোন অসঙ্গত কারণ, যেমন জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় পদ্ধতি থেকে অথবা কেবল দুর্ভাগ্যবশতঃ উৎপন্ন হয় না।
  • দ্বিতীয়ত, সেগুলিই আমাদের দুঃখের উৎস যা আমাদের বার বার ভোগ করতে হয়। প্রত্যেক পরিস্থিতিতে দুঃখ কখনো মাত্র একটা কারণ থেকে উদ্ভূত হয় না, বরং উদ্ভূত হয় অনেক কারণ এবং অবস্থার সংমিশ্রণ থেকে।
  • তৃতীয়ত, সেগুলিই আমাদের দুঃখের প্রবল আভ্যন্তরীণ উৎপাদক। আমাদের দুঃখ বাহ্যিক উৎস থেকে উদ্ভূত হয় না, এমনকি কোন সর্বশক্তিমান দেবী-দেবতা থেকেও না।
  • চতুর্থত, সেগুলি আমাদের দুঃখের প্রত্যয়। দুঃখ স্বয়ং পার্থিব ক্রিয়াকলাপ থেকে উদ্ভূত হয় না, বরং সেগুলির প্রতি আমাদের বিভ্রান্ত মনোভাব থেকে উদ্ভূত হয়।

সারাংশ

একবার যখন আমরা আমাদের পুনরাবৃত্ত সমস্যা এবং দুঃখের আসল কারণগুলি জেনে যাই- যা আমাদের মধ্যে কেউই এখনও নিয়মিতভাবে সম্মুখীন হতে চায় না- এটা হল আমাদের নিজেদের সম্পর্কে একটি মিথ্যা বাস্তবতার নিজস্ব কল্পনা আর আমাদের অসচেতনতারূপী নিছক কল্পনা এবং সেগুলি দ্বারা সৃষ্ট অশান্তকারী আবেগ ও বাধ্যতামূলক আচরণই হল এর প্রকৃত কারণ, তখন এই সমস্ত ঝামেলা সৃষ্টিকারীদের থেকে চিরকালের জন্য নিজেদেরকে মুক্ত করতে পরিশ্রম করার কোন অর্থ হয় না কী?

Top