প্রথম আর্যসত্যঃ দুঃখ সত্য

জীবনের একটা মৌলিক সত্য হল যে সবাই সুখী হতে চায় কেউ দুঃখী হতে চায় না। এটা আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই বুঝতে পারি যে, কীভাবে কেউ সমস্যা এবং দুঃখ চায় না। তা সত্ত্বেও সবরকমের সমস্যা সারাজীবন অজান্তে ঘটতে থাকে। আসলে আমরা যতই সেগুলি এড়ানোর চেষ্টা করি না কেন সেগুলি ঘটতেই থাকে। আমরা যখনই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোন সমস্যার সম্মুখীন হই, সাধারণতঃ আমরা সেটার মোকাবিলা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। তবে একের পর এক এই ধরণের সমস্যার মোকাবিলা করা একটা অন্তহীন কাজ। বুদ্ধ যখন বোধিলাভ করেছিলেন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে জীবন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য রয়েছে যা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে, সর্বত্র সত্য। আমরা এগুলিকে চার আর্যসত্য বলি। যে প্রথম সত্যকে বুদ্ধ উপলব্ধি করেছিলেন এবং যার উপর উপদেশ দিয়েছিলেন সেটা হল সত্য সমস্যা, দুঃখ সত্য যেটার আমরা সকলেই সম্মুখীন হই এবং আসলে আমরা নিজেরাই ঐ সমস্যাগুলির উৎপত্তিকে স্থায়ী করি। আমরা যদি নিজেদের জন্য আরও বেশি সমস্যা সৃষ্টি করা বন্ধ না করি, তাহলে সেগুলি কখনোই উৎপন্ন হওয়া বন্ধ হবে না। এইভাবে প্রথম পদক্ষেপটি হল প্রকৃত দুঃখসত্য কী সেটাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা।

সুখ দুঃখের উত্থান এবং পতন

সমস্যা এবং দুঃখ অনেক প্রকারের হয় যেগুলির আমরা সম্মুখীন হই। জীবন হতাশাজনক এবং চাপপূর্ণ হতে পারে। আমরা নিজেদের জন্য সুখী জীবন তৈরি করতে কঠোর পরিশ্রম করি, কিন্তু প্রায়শই বিষয়গুলি আমাদের আশানুরূপ ফলিভূত হয় না। আমাদের সাথে এমন কিছু ঘটে যা আমরা কখনোই আশা করে থাকি না, যেমন- আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়, মানুষ আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করে, আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি, আমাদের চাকরী হারিয়ে ফেলি ইত্যাদি। আমরা যতই এই ঘটনাগুলি এড়ানোর চেষ্টা করি, কোন না কোনভাবে সেগুলি ঘটতেই থাকে। প্রায়শই আমরা সেগুলি নিয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ি, অথবা সেগুলিকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করি, কিন্তু সাধারণতঃ সেটা বিষয়গুলিকে আরও খারাপ করে তোলে। ফলে আমরা আরও বেশি দুঃখী হয়ে পড়ি।

এমনকি আমরা যখন কোন সুখ অনুভব করতে সফল হই, সেই সুখের সাথেও একটি সমস্যা জড়িয়ে থাকে- এটা স্থায়ী হয় না। এটা কখনোই আমাদের সন্তুষ্ট করে না এবং তাই আমরা আরও বেশি পেতে চাই। আসলে আমরা এই “আরও” এর জন্য অনেক সময় এবং শক্তি ব্যয় করি। আমরা যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় সামান্য একটা সেলফি পোষ্ট করি তখন আমাদের মনোভাবের কথা একবার ভাবুন। প্রতিবার আমরা যখন সুখের সামান্য ডোপামিন-এর রাশিসহ একটা “লাইক” পাই সেটা কতসময় ধরে স্থায়ী থাকে? আমরা আরও বেশি “লাইক” পেয়েছি কি না সেটা দেখার জন্য কত তাড়াতাড়ি চেক করি? আর যখন সেখানে অনেকগুলি “লাইক” না থাকে, তখন আমরা কতটা ভয়ানক অনুভব করি? এটাই তো দুঃখ, তাই না?

আমরা আমাদের শরীর এবং মনকে চিরস্থায়ী করে তুলি যার মাধ্যমে আমরা উত্থান-পতন অনুভব করি

সুতরাং, জীবনে সবসময় উত্থান এবং পতন হতেই থাকে- কখনো-কখনো আমরা সুখী হই এবং দুর্দান্ত অনুভব করি- আবার কখনো-কখনো আমরা দুঃখী এবং অসুখী হই। প্রায়শই, আমরা শুধু বলি, “এটাই জীবন।” এবং পরিস্থিতির গভীরতার দিকে তাকাই না। তবে আসলে আমরা আমাদের জীবনকে কি এইভাবেই দেখতে চাই- পরের মুহূর্তে আমরা কেমন অনুভব করব সেটা কখনো না জেনে? সৌভাগ্যবশতঃ বুদ্ধ বিষয়টা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং সবকিছুর অন্তর্নিহিত আসল সমস্যাটির খোঁজ করেছিলেন। আসল সমস্যা অর্থাৎ দুঃখসত্য হল আমাদের কাছে যে ধরণের শরীর এবং মন আছে সেটাকে বোঝায়। যে শরীর এবং মন আমাদের কাছে আছে সেটা হল আধার, যার মাধ্যমে আমরা এই উত্থান এবং পতন অনুভব করি, যা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে রাখে। আমরা যদি আরও গভীরভাবে তাকাই, আমরা বুঝতে পারব যে আসল সমস্যাটি হল এই ধরণের শরীর এবং মন থাকার কারণে আমরা এই উত্থান এবং পতনগুলি বেশি করে সৃষ্টি করি এবং সেগুলিকে চিরস্থায়ী ক’রে রাখি। আর আমরা সেটা করি শুধু এই মুহূর্ত বা আগামী সপ্তাহের জন্য নয়, বরং আমাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, বুদ্ধ বলেছেন যে আমরা আমাদের নিজেদের সমস্যাগুলিকে কেবল এই জন্মে চিরস্থায়ী করি না, বরং পরের জন্ম, ভবিষ্যতের জীবনের ক্ষেত্রেও এটাকে চিরস্থায়ী ক’রে তুলি। আমরা যদি এখনো পুনর্জন্মের অস্তিত্বকে বুঝতে না পারি এবং স্বীকার না করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কীভাবে এই সমস্যাগুলিকে চিরস্থায়ী ক’রে তুলে রাখি। বর্তমান জলবায়ু সংকটের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে আমাদের ক্রিয়াকলাপ কীভাবে সমস্যাগুলিকে চিরস্থায়ী করে যা এই গ্রহে আমাদের অস্তিত্বের বাইরেও চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।

তাহলে আমাদের শরীর এবং মনের প্রকৃত সমস্যা কী? সমস্যাটি হল তারা সীমিত। আমাদের শরীর সীমিত, কারণ এটা অসুস্থ হয় এবং বৃদ্ধ হওয়ার সাথে-সাথে এর অধঃপতন হয়। দুধের বোতলের মতো এর মেয়াদ শেষ হয়; কিন্তু দুধের চেয়েও এর খারাপ দিকটা হল এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কোন স্পষ্ট তারিখ নির্ধারিত থাকে না। আমাদের শরীরের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নেই। যখন শরীরটা স্থায়ী থাকে, আপনারা ভাবুন যে এর যত্ন নেওয়ার জন্য আমাদের কতটা সময় ব্যয় করার প্রয়োজন হয়। এটাকে আমাদের পরিষ্কার করতে হয়, পোষাক পরাতে হয়, আহার প্রদান করতে হয়, শৌচালয়ে নিয়ে যেতে হয়, ব্যায়াম করাতে হয়, বিশ্রাম দিতে হয় এবং ঘুম পাড়াতে হয় আর আহত বা অসুস্থ হলে এর যত্ন নিতে হয়। এটাকে নিয়ে কত তামাশাই না করতে হয়। একজন মহান ভারতীয় বৌদ্ধ আচার্য সুন্দরভাবে বলেছেন যে আমরা সকলেই আমাদের শরীরের দাস।

আমাদের আবেগ এবং অনুভূতি সহ আমাদের মনও সীমিত। আমাদের মনকে শিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ দিতে হয়, কিন্তু তার পরেও এমন অনেক কিছু অবশিষ্ট রয়ে যায় যা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা কোন কিছুর পূর্ণ চিত্র দেখতে পাই না- উদাহরণ স্বরূপ, বৈশ্বিক উষ্ণতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আন্তর্জালিক তত্ত্ব পরিবেশ (ভারচুয়াল রিয়েলিটি এনভায়রনমেন্ট) ইত্যাদির পরিণতি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা ঘটছে সেটা তো ছেড়েই দিন। আর এর থেকে আরও খারাপ হল, আমাদের শরীরের মতো মনও আমাদের বার্ধক্যের সাথে ক্ষয়প্রাপ্ত করে, যেমন- আমাদের স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিশক্তির অবসান ঘটে, আমাদের মন আরও ধীরে-ধীরে কাজ করতে লাগে আর আমরা সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।

এসব কিছুর উপরে, আমাদের অনুভূতিগুলি সহজেই আঘাত পায় এবং আমাদের আবেগগুলি হিংস্র হয়ে ওঠে যা আমাদের স্পষ্টভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে বাধা সৃষ্টি করে। তবে এসব নিয়ে আসল সমস্যা যা হয় সেটা হল আমাদের সীমিত শরীর, মন, আবেগ এবং অনুভূতিগুলি নিজেদেরকে চিরস্থায়ী ক’রে রাখে; সেগুলি শুধু নিজেদের আঁকড়ে ধরে রাখে।

দুঃখ-সত্যের চারটি বৈশিষ্ট্যকে আমাদের সীমিত শরীর দ্বারা উদাহরণ প্রস্তুত করা হয়

বুদ্ধ আমাদের সীমিত শরীরের চারটি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে দুঃখ-সত্যের উদাহরণ প্রস্তুত করেছেনঃ

  • প্রথমত, সেগুলি অস্থায়ী। কখনো-কখনো আমরা সু-স্বাস্থ্যের মধ্যে থাকি এবং ভাল অনুভব করি, তবে একটু সামান্যতম জিনিস আমাদের শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে। এরফলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং ভয়াবহ অনুভব করি। শুধু একটু দেখুন আমাদের শরীরটা কত ভঙ্গুর- একটু সামান্য জিনিস এটাকে আঘাত করতে পারে এবং ব্যথা দিতে পারে। এসব কিছুর অন্তর্নিহিত বিষয়টি হল যে প্রতিটি মুহূর্ত এটা আমাদের মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমরা কল্পনা করি, আমরা আমাদের শরীরকে চিরকালের জন্য সুস্থ এবং শক্তিশালী রাখতে পারি। ফলে আমরা যখন বৃদ্ধ অবস্থায় পৌঁছে যাই আমরা ভাবি যে আমরা কখনো একইরকম ভাবে খাওয়া-দাওয়া করতে পারব এবং কাজকর্ম করতে পারব যা আমরা যুবাবস্থায় ক’রে থাকি। কিন্তু বাস্তবে আমরা নিজেদের বোকা বানাই; তরুণ হয়ে থাকার জন্য আমাদের অন্তহীন প্রচেষ্টা আমাদের জন্য উদ্বেগ এবং চাপ সৃষ্টি করে।
  • দ্বিতীয়ত, আমাদের শরীর স্বয়ংই সমস্যায় পরিপূর্ণ। আমরা হয়তো ভাবতে পারি যে আমরা যদি সুগন্ধী এবং সাজ-সজ্জা ব্যবহার ক’রে অথবা আরও বেশি পেশী বৃদ্ধি ক’রে আমাদের শরীরকে আকর্ষণীয় বানাই, তাহলে আমরা আরও সুখী হব কিন্তু আমরা নিজেদেরকে যতই সুন্দর দেখানোর চেষ্টা করি না কেন আমাদের মধ্যে চিন্তা থেকেই যায় যে আমরা যথেষ্ট সুন্দর দেখাই না অথবা আমরা আমাদের সুন্দর চেহারা হারিয়ে ফেলতে চলেছি। আমরা যতই সাজ-সজ্জা ব্যবহার করি না কেন, পেশী তৈরি করি না কেন অথবা আমরা যতই স্বাস্থ্যকর আহার অনুসরণ করি না কেন, আমাদের শরীরের সমস্যাটি হল, এত কিছু করা সত্ত্বেও আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি, আমরা বৃদ্ধ হয়ে যাই এবং দুর্ঘটনা ঘটাতে পারি আর আঘাত পেতে পারি।
  • তৃতীয়ত, আমরা যদি আমাদের শরীরকে পরিষ্কার না করি তাহলে এতে দুর্গন্ধ হয়, দাঁত না মাজলে আমাদের শ্বাসকষ্ট হয় আর প্রস্রাব ও মল থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। আমরা যদি কোন খাবারকে কয়েকবার চিবিয়ে থুতু ফেলি এবং কাউকে সেটা দিই তাহলে কে এটাকে পরিষ্কার এবং খাওয়ার উপযোগী মনে করবে? এখানে সমস্যাটি হল আমরা “আমি” নামে স্বাধীনভাবে অস্তিমান কোন সত্তা নই যা আমাদের শরীর থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে এবং “সুন্দর শরীর”-এর কাল্পনিক জগতে বাস করতে পারে। আমরা এই শরীরের সাথে আটকে থাকি। তার মধ্যে দোষ থাকা সত্ত্বেও দুঃখ-কষ্ট কাটিয়ে উঠতে এবং অন্যদের সহযোগীতা করতে এর যত্ন নেওয়া এবং এর যথাযথ ব্যবহার করা প্রয়োজন।
  • চতুর্থত, বাস্তব জীবনে অন্যরা আমাদের শরীর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। আমরা একটা ভিডিও গেমে আমাদেরকে দেখতে অন্যদের জন্য একটা আন্তর্জালিক অবতার সৃষ্টি করতে পারি কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন কেউ “বাস্তব জগতে” আমাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে তারা আমাদের শরীরকে তাদের মতো দেখতে পায়। এমনকি আমরা যদি মনে-মনে কল্পনা করি আমাদের বয়স ষাট হওয়া সত্ত্বেও আমরা কুড়ি বছর বয়সী দেখাবো, তখনও কিন্তু অন্যরা আমাদের দিকে তাকালে আমাদের ষাট বছর বয়সী শরীরের মতো দেখতে পাবে। আমরা যদি এটা বুঝতে না পারি এবং মেনে না নিই তাহলে আমরা কেবল নিজেদেরকেই বোকা বানাব আর অনুপযুক্ত উপায়ে বয়স প্রদর্শন করার আচরণের মাধ্যমে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারি।

সারাংশ

আমাদের সীমিত শরীর হল দুঃখসত্যের উদাহরণ যে, সেটা অনিত্য এবং সমস্যাযুক্ত আর আমরা এর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারি না এবং অন্যরা এটাকে যেমন দেখতে পায় এটা বাস্তবে এমনই থাকে, তাতে আমরা পছন্দ করি বা না করি কিছু আসে যায় না। এই ধরণের শরীর থাকাটা যথেষ্ট সমস্যায় পরিপূর্ণ, কিন্তু বুদ্ধ বলেছেন যে আমাদেরকে সুঃখসত্যকে চিনতে হবে আর সেটা হল আমরা এমন একটা শরীরকে জীবন থেকে আজীবন পর্যন্ত চিরস্থায়ী ক’রে রাখি। যারফলে আমরা আপাত দৃষ্টিতে অবিরাম পুনরাবৃত্তভাবে ঘটতে থাকা দুঃখ-চক্র এবং অতৃপ্ত পরিতোষ ও সুখ ভোগ করার ভিত্তি হয়ে ওঠে। আপনারা কি সত্যিই সেটা চান?

Top