অশান্তকারী আবেগ কী?

14:52
যখন আমাদের মন ক্রোধ, আসক্তি, স্বার্থপরতা বা লোভের কারণে অশান্ত হয়ে ওঠে তখন আমাদের শক্তিও একইভাবে বিঘ্নিত হয়। আমরা অস্বস্তি বোধ করি; আমাদের মন শান্ত থাকে না; আমাদের চিন্তা-ভাবনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আমরা এমন কিছু বলি বা করি যার কারণে আমরা পরে অনুশোচনা করি। আমরা যদি আমাদের মনে বা শক্তিতে হঠাৎ ঘটিত ব্যাঘাতকে লক্ষ্য করি তাহলে আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারব এটা কোন্‌ অশান্তকারী আবেগের কারণে ঘটেছে। এটার সাথে মোকাবিলা করার কৌশল হল এটা যখনই আমাদের মধ্যে জাগবে তখনই এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে হবে, আর মৈত্রী ও করুণার মতো তার বিপরীত মনোভাবকে কার্যকর করতে হবে যাতে আমাদের দ্বারা সৃষ্ট সমস্যাগুলিকে প্রতিরোধ করা যায়, যদি আমরা ঐ সমস্যা সৃষ্টিকারী আবেগের বশে গিয়ে থাকি আর আমরা সেটা প্রয়োগ করে থাকি।

অশান্তকারী আবেগ কী?

মনের একটি অবস্থাকে অশান্তকারী আবেগ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়; যখন এটা উৎপন্ন হয় তখন আমাদের মনের শান্তি ভঙ্গ করতে এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য এটা করে।

যেহেতু আমরা মনের শান্তি হারিয়ে ফেলি, তাই এটা হল অশান্তকারী; এটা আমাদের মনের শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটায়। আমরা যখন মনের শান্তি হারিয়ে ফেলি তখন আমরা অশান্ত হয়ে পড়ি, তাই সেই মুহুর্তে আমরা আমাদের চিন্তা-ভাবনা অথবা অনুভূতি সম্পর্কে সত্যিই স্পষ্ট থাকি না। স্পষ্টতার অভাবে আমরা প্রভেদ-বোধটি হারিয়ে ফেলি, যা আত্ম-নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন হয়। আমাদের এটা প্রভেদ করতে সক্ষম হতে হবে যে কোনটা আমাদের জন্য উপযোগী এবং কোনটা অনুপযোগী; নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনটা উপযুক্ত এবং কোনটা অনুপযুক্ত।

অশান্তকারী আবেগও মনের গঠনমূলক অবস্থার সাথে যুক্ত হতে পারে

আসক্তি অথবা লালসা, ক্রোধ, ঈর্ষা, অভিমান, অহংকার ইত্যাদি অশান্তকারী আবেগের উদাহরণ হতে পারে। এদের মধ্যে কিছু অশান্তকারী আবেগ আমাদের ধ্বংসাত্মক ভাবে কাজ করতে পরিচালিত করতে পারে কিন্তু এটা আবশ্যক নয় যে সবসময় এরকমই হবে। উদাহরণ স্বরূপ, আসক্তি এবং লালসা আমাদের ধ্বংসাত্মকভাবে কাজ করতে পরিচালিত করতে পারে, যেমন বাইরে গিয়ে কিছু চুরি করা। কিন্তু এটাও হতে পারে আমাদের মধ্যে ভালবাসা পাওয়ার লালসা বা আকুল বাসনা থাকে এবং সেই আসক্তির কারণে আমরা অপরের সহায়তা করি যাতে আমরা তাদের ভালবাসা পাই। অপরের সহায়তা করা ধ্বংসাত্মক নয়; এটা এক ধরণের গঠনমূলক কর্ম, তবে এর পিছনে একটি অশান্তকারী আবেগ থাকেঃ “আমি ভালোবাসা পেতে চাই, তাই আমি আপনাকে অনুরোধ করি যে, বিনিময়ে আপনি আমাকে ভালোবাসুন।”

অথবা ক্রোধের বিষয়টা বিচার করুন। ক্রোধ আমাদের ধ্বংসাত্মক ভাবে কাজ করা, বাইরে গিয়ে কারও ক্ষতি করা বা তাদের হত্যা করতে পরিচালিত করতে পারে, কারণ আমরা খুবই ক্রোধিত হয়ে থাকি। সুতরাং এটা হল ধ্বংসাত্মক আচরণ। কিন্তু ধরুণ, আমরা কোনও নির্দিষ্ট ব্যবস্থার অবিচার বা একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে ক্রোধিত হয়েছি আর আমরা এটাকে নিয়ে এতটা ক্রোধিত হয়েছি যে আমরা সত্যিই ঐ ব্যবস্থা বা পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করি। আমরা যেটা করি, অগত্যা সেটাকে হিংসাত্মক ভাবার প্রয়োজন নেই। তবে মূল বিষয়টা এমনই, এখানে গঠনমূলক বা ইতিবাচক কিছু করাটাও একটি অশান্তকারী আবেগ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। আমাদের মনে শান্তি থাকে না এবং যেহেতু আমাদের মনে শান্তি থাকে না, তাই আমরা যখন এই ইতিবাচক কর্ম করি, তখন আমাদের মন এবং অনুভূতিগুলি স্পষ্ট থাকে না, আর আমাদের আবেগগত অবস্থা খুব স্থিতিশীল হয় না।

তারপর, এক্ষেত্রে লালসা অথবা ক্রোধের বশে আমরা কামনা করি যে অন্যান্য ব্যক্তিরা আমাদের ভালোবাসুক অথবা আমরা চাই যে অন্যায়ের অবসান হোক। এগুলি মনের স্থিতিশীল অবস্থা অথবা স্থিতিশীল আবেগগত অবস্থা নয়। যেহেতু সেগুলি মনের স্পষ্ট অবস্থা অথবা স্পষ্ট আবেগগত অবস্থা নয়, তাই আমরা স্পষ্টভাবে বিচার করতে পারি না যে আমাদের কী করতে হবে এবং কীভাবে আমাদের উদ্দেশ্যটি বাস্তবায়িত করতে হবে। ফলে নিজেদের উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা কোন কাজ করার জন্য কাউকে সহযোগিতা করতে পারি। কিন্তু তাকে সহযোগিতা করার আরও ভালো উপায় হল তাকে নিজেকে এটা করতে দেওয়া। ধরুন, আমাদের একটি সাবালিকা কন্যা আছে; আমরা তাকে রান্না করতে, ঘরের যত্ন নিতে অথবা সন্তানদের যত্ন নিতে সহযোগিতা করতে চাই, তবে এটা অনেকটা হস্তক্ষেপ করা হয়ে যায়। এমনও হতে পারে আমাদের কন্যা সেটা পছন্দ করবে না যে কীভাবে রান্না করা অথবা সন্তানদের পালন-পোষণ করা হয় তার সম্পর্কে তাকে বলা হোক। কিন্তু আমরা চাই সে যেন আমাদের ভালোবাসে আর তারজন্য আমরা উপযোগী হতে চাই। তারজন্য আমরা নিজেকে তার দিকে ঠেলে দিই। এখানে আমরা অবশ্যই গঠনমূলক কিছু করি কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমরা আমাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি যা আমাদের প্রকৃতপক্ষে ভাবতে বাধ্য করতে পারে, “আমার মুখটা বন্ধ রাখা, আমার মতামত না দেওয়া এবং আমার সহযোগিতা না দেওয়াই ভাল।”

এমনকি আমরা যদি এমন কোন পরিস্থিতিকে সহায়তা করি যেখানে এটা ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সহায়তা করার জন্য উপযুক্ত, কিন্তু আমরা তার সম্পর্কে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না কারণ আমরা তার পরিবর্তে কোন কিছুর প্রত্যাশা করি। আমরা ভালোবাসা পাওয়ার কামনা করি; তাদের জন্য আমরা প্রয়োজন বোধ করতে পারি; আমরা চাই তারা আমাদের প্রশংসা করুক। আমাদের মনে এই ধরণের লালসার কারণে যখন আমাদের কন্যা তেমন ভাবে প্রতিক্রিয়া না জানায়, আমরা যেটার প্রত্যাশা করি, তখন আমাদের মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।

অশান্তকারী আবেগের এই প্রক্রিয়াটি আমাদের মনের শান্তি এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করে আর এটা আরও বেশি স্পষ্ট হয় যখন আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাই। ঐ অন্যায়ের কারণে বিরক্ত হয়ে আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। ঐ উদ্বিগ্ন অবস্থার ভিত্তিতে আমরা যখন কিছু করতে যাই তখন সাধারণতঃ আমরা স্পষ্টভাবে বিচার করতে পারি না যে আমাদের কী করতে হবে। এইরকম পরিস্থিতিতে আমরা কোন পরিবর্তন আনতে চাইলে প্রায়শই আমরা সর্বোত্তম পথ অনুসরণ করি না।

সংক্ষেপে, আমরা ধ্বংসাত্মক ভাবে কর্ম করি অথবা গঠনমূলক কিছু করি না কেন, আমরা যেটা করি সেটা যদি অশান্তকারী আবেগ দ্বারা অনুপ্রাণিত হই বা অশান্তকারী আবেগে যুক্ত হই তাহলে আমাদের আচরণ সমস্যার কারণ হয়ে উঠবে। যদিও আমরা সঠিকভাবে ভবিষ্যবাণী করতে পারি না যে আমাদের এই আচরণ অন্যদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করবে কি না, তবে এটি মূলতঃ আমাদের জন্য সমস্যা তৈরী করে। এটা জরুরী নয় যে সমস্যাগুলি তাৎক্ষণিকভাবে তৈরী হবে; তবে এক অর্থে এগুলি হল দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা যা অশান্তকারী আবেগের প্রভাবের অধীনে কর্ম করতে থাকার কারণে বারবার অশান্তভাবে আচরণ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। এইভাবে অশান্তকারী আবেগের উপর আধারিত বাধ্যতামূলক আচরণ সমস্যাযুক্ত ভাবে আচরণ করার একটা দীর্ঘ পরিসীমা নির্মাণ করে তোলে। ফলে আমরা কখনোই মানসিক শান্তি লাভ করি না।

অন্যদের ভালোবাসা পাওয়া এবং প্রশংসা অর্জন করার প্রত্যাশায় অন্যদের সহায়তা করা এবং তাদের সাথে ভালোভাবে আচরণ করার জন্য অনুপ্রাণিত হওয়া, এর একটা সুস্পষ্ট উদাহরণ। এর পিছনে আমরা মূলতঃ অনিরাপদ থাকি। তবে এই ধরণের অনুপ্রেরণার সাথে আমরা যত বেশী কাজ কর্ম করি না কেন এটা আমাদের কখনোই সন্তুষ্ট করে না, আমরা কখনোই অনুভব করি না, “ঠিক আছে, এবার আমি ভালোবাসা পেয়ে গেছি। এটাই যথেষ্ট, আমার আর প্রয়োজন নেই।” আমরা কখনোই সেরকম অনুভব করি না আর এইভাবে আমাদের আচরণ বাধ্যতামূলকভাবে অনুভব করার অভ্যাসটি আরও প্রবল এবং শক্তিশালী করে তোলে, “আমাকে অনুভব করতে হবে যে আমাকে ভালোবাসে, আমাকে অনুভব করতে হবে যে আমার প্রশংসা করা হয়।” বাস্তবে আপনি অন্যের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনেক দূরে এগিয়ে যান কিন্তু আপনাকে হতাশই হতে হয়। আপনাকে হতাশ হতে হয় কারণ এমনকি কেউ যদি আপনাকে ধন্যবাদও জানায় আপনি মনে করেন, “তারা মন থেকে ধন্যবাদ জানায়নি।” এই ধরণের ভাবনা মনে জাগতে থাকে। এর কারণে আমরা কখনোই মানসিক শান্তি লাভ করি না। আর এই পরিস্থিতিটা খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে থাকে। এর কারণ হল ঐ লক্ষ্যটি পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। এটাকে বলা হয় সংসার অর্থাৎ এমন একটি অবস্থা যেখানে সমস্যাযুক্ত পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পুনরাবৃত্ত হতে থাকে।

যখন অশান্তকারী আবেগ আমাদের নেতিবাচক ভাবে অথবা ধ্বংসাত্মক ভাবে কর্ম করতে বাধ্য করে তখন এই ধরণের লক্ষণকে সনাক্ত করা খুব কঠিন হয় না। উদাহরণ স্বরূপ, হতে পারে আমরা সবসময় বিরক্ত হই; যেহেতু আমরা বিরক্ত হই, সেইজন্য আমরা ছোট-ছোট কারণে ক্রোধিত হই। ঐ রকম পরিস্থিতিতে অন্যদের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কথা বলার সময় সর্বদা কঠোর ভাষা ব্যবহার করি অথবা অপ্রিয়ভাবে কথা বলি। আর এর কারণে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আমাদের কেউ পছন্দ করে না এবং মানুষ আমাদের সাথে সত্যিই থাকতে পছন্দ করে না। ফলে লোকজনদের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা তৈরী হয়। এইরকম পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে সনাক্ত করা মোটামুটি সহজ হয়ে যায় যে কী ঘটছে। তবে যখন আমাদের ইতিবাচক কর্মের পিছনে কোন অশান্তকারী আবেগের কারণে অনুপ্রাণিত হয় তখন এটাকে সনাক্ত করা ততটা সহজ হয় না। কিন্তু আমাদের উভয় পরিস্থিতিকে সনাক্ত করতে হবে।

কীভাবে সনাক্ত করা যাবে যে আমরা কখন অশান্তকারী আবেগ, মনোভাব বা মনের অবস্থার অধীনে থাকি

এখানে প্রশ্ন ওঠে তাহলে আমরা কীভাবে বুঝব যে আমরা একটি অশান্তকারী আবেগ অথবা মনোভাবের প্রভাবের অধীনে কর্ম করছি? এটা জরুরী নয় যে এটা কোন্‌ আবেগের বশে হচ্ছে; এটা জীবনের প্রতি অথবা নিজেদের প্রতি মনোভাবের কারণেও হতে পারে। এই কারণে আমাদের অন্তর্মুখী হওয়ার জন্য একটু সংবেদনশীল হতে হবে এবং লক্ষ্য করতে হবে আমরা ভিতরে-ভিতরে কেমন অনুভব করি। এটা করার জন্য অশান্তকারী আবেগ অথবা অশান্তকারী মনোভাবের সংজ্ঞাটি খুবই উপযোগী হয়; এটা আমাদের মানসিক শান্তি এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করে।

আমরা যখন কিছু বলতে যাই অথবা আমরা কিছু করতে যাই তখন আমরা যদি ভিতরে-ভিতরে একটু ঘাবড়ে যাই, তাহলে আমরা সম্পূর্ণভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। এটা হল একটা লক্ষণ যা বোঝায় যে আমাদের ভিতরে কিছু অশান্তকারী আবেগ রয়েছে।

এটা অচেতনও হতে পারে আর প্রায়শই এটা অচেতনই হয়, তবে এর পিছনে কিছু অশান্তকারী আবেগ থাকে।

ধরুন, আমরা কাউকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমরা যদি লক্ষ্য করি ঐ ব্যক্তির সাথে কথা বলার সময় আমাদের পেটে অস্বস্তি হচ্ছে তাহলে এটা একটা ভালো ইঙ্গিত যে এর পিছনে অহংকারের মতো কোন অশান্তকারী আবেগ রয়েছে। আমরা হয়তো অনুভব করতে পারি, “আমি কত চালাক, আমি এটা বুঝি। আমি আপনাকে এটা বুঝতে সহযোগিতা করব।” হতে পারে আমরা ঐ ব্যক্তিকে কিছু বুঝিয়ে আন্তরিক ভাবে সহযোগিতা করতে চাই কিন্তু ঐ সময় যদি আমরা আমাদের পেটে কোন অস্বস্তি বোধ করি তাহলে এর অর্থ হবে আমাদের মধ্যে কিছুটা অহংকার আছে। এটা বিশেষ করে ঐ সময় ঘটে যখন আমরা আমাদের কৃতিত্ব অথবা আমাদের নিজস্ব ভালো গুণাবলী সম্পর্কে কথা বলি। প্রায়শই আমরা অনুভব করি যে আমাদের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি জাগে।

অথবা অশান্তকারী আবেগের বিষয়টি বিবেচনা করুন। উদাহরণ স্বরূপ, ধরুন, এমন একটি মনোভাব, “প্রত্যেকের মনোযোগ আমার উপর থাকা উচিত।” যা প্রায়শই আমাদের মধ্যে থাকে। আমরা কখনোই উপেক্ষিত হওয়া পছন্দ করি না- কেউ-ই উপেক্ষিত হওয়া পছন্দ করে না- তাই আমাদের মনে হয়, “লোকজনরা যেন আমার উপর মনোযোগ দেয় আর আমি যা বলি তারা যেন সেটা শোনে।” ইত্যাদি, ইত্যাদি। দেখুন, এরকম পরিস্থিতিতেও আমাদের ভিতরে ভয় থাকে, বিশেষ করে যদি মানুষ আমাদের প্রতি মনোযোগ না দেয়। তারা কেনই বা আমাদের প্রতি মনোযোগ দেবে? আপনি যখন এটার সম্পর্কে ভাবেন তখন সেখানে কোন বিশেষ কারণ থাকে না।

সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ “ক্লেশ”, তিব্বতী ভাষায় “ঞোন্‌- মোঙ্‌” রূপে প্রয়োগ করা হয়। এটা একটা খুবই কঠিন শব্দ, কারণ এমন কিছু জিনিস আছে যা সত্যিই খুব সুন্দরভাবে কোন আবেগের অথবা মনোভাবের শ্রেণীতে উপযুক্ত ভাবে মিল খায় না, উদাহরণ স্বরূপ, নির্বোধতা। আমরা এতটা নির্বোধ হই যে আমরা বুঝতেই পারি না আমাদের আচরণ অন্যের উপর অথবা নিজের উপর কতটা প্রভাব ফেলবে। অথবা আমরা কোন্‌ পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ হতে পারি যে বাস্তবিকতার সম্পর্কে আমরা বুঝতেই পারি না কী হতে চলেছে। উদাহরণ স্বরূপ, ধরুন, কেউ ভালো অনুভব করছে না অথবা কেউ বিরক্ত হয়ে আছে, এই বিষয়ে আমরা নির্বোধ। এই রকম পরিস্থিতিতে আমরা নিশ্চয়ই সেই বিষয়ে নির্বোধ হয়ে থাকি যে আমরা তাদের যা কিছু বলেছি তার ফলাফল কী হতে পারে; আমাদের উদ্দেশ্য ভালো থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদের উপর ভীষণভাবে বিরক্ত হতে পারে।

আমাদের মধ্যে যখন এই ধরণের মনের অবস্থা জাগে যাকে আমরা অশান্তকারী আবেগ বলি, এটা জরুরী নয় যে ঐ সময় আমরা অস্বস্তি বোধ করব। তবে যেমন আমরা দেখেছি, আমরা যখন আমাদের মনের শান্তি হারিয়ে ফেলি তখন আমাদের মন অস্পষ্ট হয়ে যায়। আর আমরা যখন নির্বোধ হয়ে যাই আমাদের মন সত্যিই স্পষ্ট থাকে না; আমরা তখন আমাদের ছোট্ট পৃথিবীতে থেকে যাই। এই অর্থে আমরা আমাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি যেহেতু আমরা আমাদের ছোট্ট পৃথিবীতে থেকে যাই। ফলে আমরা পার্থক্য করতে পারি না যে কোন্‌ পরিস্থিতিতে কোনটা লাভদায়ক, উপযুক্ত এবং কোনটা উপযুক্ত নয়। প্রভেদমূলক বোধ শক্তির অভাবে আমরা সঠিকভাবে এবং সংবেদনশীল ভাবে আচরণ করতে পারি না। অন্যকথায়, সঠিকভাবে আচরণ করতে অনুচিত কিছু করা থেকে বিরত থাকতে সক্ষম হয়ে ওঠার জন্য আমাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এইভাবে মনের অশান্তকারী অবস্থার সংজ্ঞার জন্য নির্বোধতা শব্দটি উপযুক্ত হয়, যদিও নির্বোধতাকে একটি আবেগ অথবা মনোভাব হিসাবে ভাবা কঠিন। যেমনটি আমি বলেছি “ক্লেশ” এমন একটি কঠিন শব্দ যার সত্যিই ভালো অনুবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

অবিরক্তিকর আবেগ

সংস্কৃত এবং তিব্বতী ভাষায় ইংরেজী শব্দ “ইমোশন”-এর কোন শব্দ নেই। এই ভাষাগুলিতে মানসিক কারণ অথবা চৈত্তের কথা বলে যেটা হল আমাদের মানসিক অবস্থার প্রতিটি মুহুর্ত তৈরী করার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদান। এরা এই মানসিক কারণগুলিকে অশান্তকারী এবং অবিরক্তিকর আর গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মকরূপে বিভাজন করে। এই দুটি জুটি একে অপরের উপর পুরোপুরিভাবে চাপিয়ে দেয় না। তদতিরিক্ত, এমন মানসিক কারণ আছে যেগুলি এই দুটি ভাগের কোনটার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় না। সুতরাং, পাশ্চাত্য জগতে আমরা যাকে “আবেগ” বলি তাদের মধ্যে কিছুটা হল অশান্তকারী এবং কিছুটা অশান্তকারী নয়। এর অর্থ এই নয় বৌদ্ধ ধর্মে আমরা সমস্ত আবেগের অবসান ঘটাতে চাই। এটা মোটেও সেরকম নয়। আমরা কেবল অশান্তকারী আবেগগুলি থেকে মুক্ত হতে চাই। এটা দুটি পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়ঃ প্রথমটি হল তাদের নিয়ন্ত্রণে না আসা এবং দ্বিতীয়টি হল তাদের এমনভাবে অবসান ঘটাতে হবে যাতে তারা আর উৎপন্ন হতে না পারে।

অশান্তকারী আবেগ কাকে বলা যেতে পারে? দেখুন, আমরা ভাবতে পারি “মৈত্রী”, “করুণা” অথবা “ধৈর্য” হল অবিরক্তিকর আবেগ। তবে আমরা যখন ইউরোপীয় ভাষাতে বিদ্যমান এই শব্দগুলি বিশ্লেষণ করি তখন আমরা দেখতে পাই যে এই আবেগগুলির মধ্যে প্রত্যেকটির একটি অশান্তকারী এবং অশান্তকারী ব্যতীত স্বরূপ আছে। সুতরাং, আমাদের একটু সতর্ক হতে হবে। যদি মৈত্রী অথবা প্রেম এমন একটি অনুভূতি হয় যার মাধ্যমে আমরা এরকম অনুভব করি “আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, আমার তোমাকে প্রয়োজন, আমাকে কখনো ত্যাগ কোরো না।” তখন এই ধরণের প্রেম আসলে মনের একটি অশান্তকারী অবস্থা হবে। এটা অশান্তকারী, কারণ যদি ঐ ব্যক্তিটি প্রত্যুত্তরে আমাদের ভালো না বাসে অথবা আমাদের প্রয়োজন বোধ না করে তাহলে আমরা দুঃখী হয়ে যাই। আমরা খুব রেগে যাই এবং হঠাৎ আমাদের আবেগের পরিবর্তন ঘটে, “আমরা তোমাকে আর ভালবাসি না।”

অতএব, আমরা যখন কোন মনের অবস্থাকে বিশ্লেষণ করি, তখন যদি আমরা সেটাকে আবেগময় রূপে ভাবতে পারি এবং এটাকে “প্রেম”-এর সংজ্ঞা দিতে পারি, তাহলে বাস্তবে মনের এই অবস্থাটি হবে অনেকগুলি মানসিক কারণের সংমিশ্রণ। আমরা কোন আবেগকে নিজের থেকে অনুভব করি না। আমাদের আবেগগত অবস্থাগুলি সর্বদা একটি সংমিশ্রণরূপে থাকে; সেখানে বিভিন্ন উপাদান থাকে। যেখানে আমরা এই ধরণের প্রেম অনুভব করি “আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না” সেটা হবে একধরণের নির্ভরশীলতা এবং এটা হবে এক ধরণের অশান্তকারী আবেগ। কিন্তু এটা ছাড়াও একটি অশান্তকারী আবেগ ব্যতীত প্রেমও আছে যার অর্থ হল “অন্য ব্যক্তিরা সুখ এবং সুখের কারণে যুক্ত হোক”, এই ধরণের কামনা মাত্র, তাতে ব্যক্তি যে কেউ হোক না কেন। পরিবর্তে আমরা তাদের কাছ থেকে কোন কিছুর প্রত্যাশা করি না।

উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের মনে সন্তানদের প্রতি এই ধরণের অবিরক্তিকর প্রেম থাকতে পারে। আমরা সত্যিই তার বদলে তাদের কাছ থেকে কোন কিছু পাওয়ার আশা করি না। হ্যাঁ, অবশ্যই কিছু মা-বাবারা এরকম আশা করতেও পারেন। তবে সাধারণত একটা সন্তান যাই-ই করুক না কেন তবুও আমরা তাকে ভালোবাসি। আমরা চাই সন্তানটি সুখে থাকুক। তবে আবার প্রায়শই এই ভাবনাটি অন্য ধরণের অশান্তকারী অবস্থার সাথে সংমিশ্রণ হয়ে যায়; আমরা চাই আমরা নিজেরাই তাদের সুখী করার জন্য সক্ষম হতে চাই। আমাদের সন্তানকে সুখী করার উদ্দেশ্যে তাদের জন্য যদি কিছু করি, যেমন- তাদেরকে পুতুল নাচ দেখাতে নিয়ে যাওয়া, কিন্তু তাতে সফল হই না, কারণ এটা তাদের সন্তুষ্ট করে না। এর কারণ হল তাঁরা এর বদলে কম্পিউটার গেম খেলতে চায়। ফলে আমরা দুঃখ বোধ করি। আমাদের খারাপ লাগে কারণ কম্পিউটার গেমের পরিবর্তে আমরা আমাদের সন্তানদের সুখের কারণ হতে চেয়েছিলাম। তাসত্ত্বেও সন্তানদের প্রতি আমাদের এই অনুভূতিকে আমরা বলি “প্রেম”। “আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই, আমি তোমাকে সুখী করার চেষ্টা করব, তবে আমি চাই যে আমি যেন তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠি, যে তোমার সুখের জন্য কাজকর্ম করে।”

সুতরাং, এই সমস্ত বিস্তৃত আলোচনার মূল বিষয়টি হল আমাদেরকে সত্যিই আবেগগত অবস্থাগুলিকে খুবই সতর্কের সাথে দেখতে হবে আর আমাদের বিভিন্ন আবেগকে ব্যক্ত করার জন্য যে সমস্ত ব্যবহার করি তাতে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে আমাদের মানসিক অবস্থার কোন্‌ দিক্‌গুলি আমাদের মনকে অশান্ত করছে এবং আমাদের মানসিক শান্তি হারাতে, মনের স্পষ্টতা হারাতে এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করছে। আমাদের এই বিষয়গুলির উপর কাজ করতে হবে।

অশান্তকারী আবেগের অন্তর্নিহিত কারণ হিসাবে অসচেতনতা

আমরা যদি মনের এই অশান্তকারী অবস্থা, আবেগ অথবা মনোভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাই তাহলে আমাদেরকে তাদের জড় অর্থাৎ কারণ পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। আমরা যদি তাদের অন্তর্নিহিত কারণগুলি উন্মুলন করতে পারি তাহলে আমরা সেগুলি থেকে মুক্ত হতে পারব। বিষয়টা শুধু অশান্তকারী আবেগ থেকে নিজেদের মুক্ত করা নয় যা আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে; বাস্তবে আমাদের অশান্তকারী আবেগগুলির জড় পর্যন্ত যেতে হবে এবং সেগুলি থেকে মুক্ত হতে হবে।

তাহলে মনের এই অশান্তকারী অবস্থার গভীরতম কারণ কী? আমরা এর যে মূল কারণটা খুঁজে পাই সেটাকে প্রায়শই “অজ্ঞতা বা অজ্ঞানতা” রূপে অনুবাদ করা হয় অথবা আমি এটাকে “অসচেতনতা” রূপে অনুবাদ করতে পছন্দ করি। আমরা কোনকিছুর সম্পর্কে অসচেতন হয়ে থাকি, সেই জিনিসটার বিষয়ে আমাদের কাছে কোন তথ্য থাকে না। অজ্ঞতা শব্দটি শুনে মনে হয় যেন আমরা মূর্খ। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে আমরা মূর্খ। এর অর্থ হল কেবল আমরা সেই বিষয়ে কিছু জানি না অথবা এমনও হতে পারে যে আমরা তার সম্পর্কে বিভ্রান্ত অর্থাৎ আমরা কোন কিছুর সম্পর্কে ভুল বুঝি।

আমরা কিসের সম্পর্কে বিভ্রান্ত বা কোন বিষয়ে অসচেতন? মূলতঃ এটা হল, আমাদের আচরণ এবং তার পরিস্থিতির পরিণতি। আমরা কোন কারণে খুবই ক্রোধিত হই, আসক্ত হই অথবা দুঃখিত হয়ে পড়ি এবং এর কারণে আমরা পূর্ববর্তী অভ্যাস এবং প্রবণতার ভিত্তিতে বাধ্যতামূলক ভাবে আচরণ করি। এটাই হল কর্ম যেটা বোঝায় যে আমরা অশান্তকারী আবেগ অথবা অশান্তকারী মনোভাবের ভিত্তিতে আমরা আচরণ করতে বাধ্য হই আর এর উপর আমাদের কোন আত্ম-নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

আমাদের অসচেতনতা হল এই বাধ্যতামূলক আচরণের অন্তর্নিহিত আধারঃ আমরা জানি না যে আমরা যা কিছু করেছি অথবা যা বলেছি তার পরিণতি কী হবে। অথবা আমরা বিভ্রান্ত হয়ে থাকিঃ আমরা ভাবি চুরি করলে আমরা সুখী হব কিন্তু সেটা কখনো হয় না। অথবা আমরা ভেবেছিলাম আপনাকে সহায়তা করলে আমি ভাবব আমাকে আপনার প্রয়োজন এবং আপনি আমাকে ভালোবাসেন; কিন্তু সেটা হয়নি। সুতরাং, আমরা জানতাম না যে এর প্রভাব কী হবে। “আমি জানতাম না যে আমি যদি এরকম বলি তাহলে এটা আপনাকে কষ্ট দেবে” অথবা আমরা এর সম্পর্কে বিভ্রান্ত ছিলাম। “আমি ভেবেছিলাম এটা আপনাকে সাহায্য করবে কিন্তু সেটা হয়নি।” “আমি ভেবেছিলাম এর কারণে আমি সুখী হব কিন্তু সেটা হয়নি।” অথবা এটা আপনাকে সুখী ক’রে তুলবে কিন্তু সেটা হয়নি। অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে, “আমি জানতাম না যে আপনি ব্যস্ত ছিলেন।” অথবা “আমি জানতাম না যে আপনি বিবাহিত।” অথবা হতে পারে আমরা বিভ্রান্ত ছিলাম, “আমি ভেবেছিলাম আপনার কাছে পর্যাপ্ত সময় আছে।” কিন্তু আসলে সেটা ছিল না। “আমি ভেবেছিলাম আপনি অবিবাহিত, কারও সাথে সম্বন্ধ রাখেন না, তাই আমি আপনার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়তে চেয়েছিলাম, যেটা উচিত ছিল না।” সুতরাং আবার আমরা পরিস্থিতি সম্পর্কে অসচেতনঃ হয় আমরা তাদের চিনি না অথবা তাদের সম্পর্কে আমরা বিভ্রান্তঃ তাদেরকে আমরা ভূলভাবে চিনি।

এটা সত্য যে সচেতনতার অভাব হল আমাদের বাধ্যতামূলক ভাবে কর্ম করার মূল, তবে এটা এতটা স্পষ্ট নয় যে এটাই হল অশান্তকারী আবেগের মূল আর অশান্তকারী আবেগগুলি বাধ্যতামূলক আচরণের সাথে খুব বেশি সংযুক্ত। সুতরাং আমাদের এই বিষয়গুলিকে আরও একটু বেশি সতর্কতার সাথে দেখতে হবে।

Top