একটি আদর্শ নৈতিক জীবনের ভিত হল স্বার্থ বনাম পরার্থ ভাবনা।
আমরা যদি অপরকে সাহায্য করতে পারি, তাহলে আমাদের তা করা উচিৎ। আর যদি না পারি, তবে অন্তত অপরের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা; এই হল একটি আদর্শ নির্ভর জীবন-যাপনের মূলাধার। তাই হল বৌদ্ধ ধর্মের সারাৎসার।
প্রতিটি কর্ম একটি গভীর ইচ্ছা সঞ্জাত। আমরা যদি কারও ক্ষতি করি, তা এই ইচ্ছা থেকেই আসে। আবার যদি, কারও সাহায্য করি; তাও এই গভীর ইচ্ছা প্রসূত। অতএব, পরার্থের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ইচ্ছা থাকা প্রয়োজন। কেন সাহায্য করব আর কেনই বা অহিত করব না, তার জন্য আমাদের একটি স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
উদাহরণ স্বরূপ, ধরুন আমরা কোন ব্যক্তির ক্ষতি করতে যাচ্ছি। সেই মুহুর্তে এক ধরনের চেতনা আমাদের মধ্যে জাগে এবং সেই কারণেই আমরা বিরত হই। অর্থাৎ ক্ষতি না করার জন্য আমাদের কিছুটা দৃঢ়তা প্রয়োজন। আমাদের মনের একদিক অপরের ক্ষতি করতে চায়। কিন্তু মনের একটি বিশেষ অবস্থার দরুন ওপর দিকটি বলে- না এটি ভুল, তা ঠিক হবে না। কারণ দেখতে পাচ্ছি এটি ভুল। এরপর আমরা ইচ্ছাশক্তি জাগিয়ে তা থেকে বিরত থাকি। দুটি বিষয় অর্থাৎ হিত-অহিত কে বেছে নেওয়ার সময় আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তা এই জন্য যে উদ্বিষ্ট কর্মটি দীর্ঘমেয়াদী ফল দিতে যাচ্ছে। মানুষ হিসেবে সুদূর প্রসারি ফলটি বোঝার মতো বুদ্ধি আমাদের আছে। তারপর, যখন তাদের দেখতে পাই, তৎক্ষণাৎ তা থেকে আমরা বিরত থাকি; আমরা তা পারি।
এই বিষয়ে আমরা দুটি পথ অনুসরণ করতে পারি। প্রথমতঃ আমরা আমাদের স্বার্থের কথা আগে ভাবি। তারপর যদি সাহায্য করতে পারি, করি। কিন্তু যদি সাহায্য করতে না পারি, সেক্ষেত্রে কোন ক্ষতি না করে বিরত থাকি। অন্য পথটি হল পরার্থ ভাবনা। এখানেও, যদি সাহায্য করার মতো হয়, করি। আর না পারলে ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকি। অপরকে ক্ষতি না করার পিছনে ভাবনাটি হল- “আমি যদি তা করি, পরিনামে আইনি ঝামেলা সহ অকুশল ফল ভোগ করতে হবে। এক্ষেত্রে নিজেকে সরিয়ে আনার কারণ স্বার্থ। এখন পরার্থ ভাবনায় নিজেকে সরিয়ে আনতে ভাবব যে- ‘অন্যরাও ঠিক আমারই মতো। ওরা দুঃখ-কষ্ট চায় না, আমি তাদের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকব”।
যখন আমরা মনকে প্রশিক্ষিত করি, প্রথমে আমরা ভাবি স্বার্থের কথা। তারপর দৃঢ়ভাবে করি পরার্থের ভাবনা। কার্যকারিতার দিক থেকে পরার্থ ভাবনা অনেক বেশী শক্তিশালী। প্রাতিমোক্ষ- যা স্ব-মুক্তির শীল এবং ভিক্ষুদের আচরণীয় বিনয় পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত; এর ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে স্বার্থের চিন্তাই করা হয়। এই কারণে আমরা অহিত করার থেকে বিরত থাকি।
মানুষ হিসেবে আমাদের প্রকৃত স্বভাব-
বলতে গেলে, মানুষ হিসেবে আমরা সামাজিক প্রাণী। তিনি কে, নারী না পুরুষ, তা বড় কথা নয়। বেঁচে থাকার জন্য সমগ্র মানব সমাজের উপর তাকে নির্ভর করতে হয়। যেহেতু কারও বেঁচে থাকা এবং তার মঙ্গলের জন্য সমগ্র সমাজের ওপর নির্ভর করতে হয়, তাই অপরের মঙ্গল এবং তার জন্য চিন্তা করা প্রয়োজন। এই ভাবনা আমাদের প্রকৃতির মূল থেকেই আসে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি আমরা বেবুনদের দিকে তাকাই; দেখব বয়োজ্যেষ্ঠ দলটি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছে। অন্যরা যখন আহারে ব্যস্ত, একজন জ্যেষ্ঠ পুরুষ বেবুন পাশে থাকে, পাহারা দেয়। শক্তিশালীটি অবশিষ্ট দলটির দেখাশোনায় যত্নবান হয় সমাজের জন্য।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের কোন শিক্ষা বা প্রযুক্তি ছিল না। মানব সমাজ ছিল সহজ সরল। সবাই একসঙ্গে কাজ করত এবং অংশীদার হতো, আর উপভোগ করতো সবাই। সমাজতন্ত্রীরা বলেন তা ছিল আসল সমাজতন্ত্র। কালক্রমে শিক্ষার বিকাশ ঘটল আর আমরা পেলাম সভ্যতা। মানব মন উত্তরোত্তর আধুনিক বা জটিল হল। আর সেই সঙ্গে বাড়ল লোভ। তা নিয়ে এল ঈর্ষা ও ঘৃণা এবং সময়ের সঙ্গে তা হল শক্তিশালী।
আজ একবিংশ শতাব্দীর মানব সমাজের কতই না পরিবর্তন হয়েছে। নানা ধরনের বৈসাদৃশ্য দেখা দিয়েছে আমাদের মধ্যে। শিক্ষা, জীবিকা ও সামাজিক অবস্থানেও রয়েছে পার্থক্য। এমনকি বয়স ও জাতিতেও বিভেদ। এ সবই গৌণ। বস্তুতঃ আমরা সবাই মানুষ এবং একই রকম মানুষ। হাজার হাজার বছর আগে থেকে এই ভাবেই চলে আসছে।
একটি শিশুর মনোভাবও তেমনই। ওরা অন্য শিশুদের সামাজিক অবস্থান, ধর্ম, জাতি, রং বা সম্পদের পরোয়া করে না। এক সঙ্গে খেলে ওরা এবং যতক্ষণ তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকছে, ততক্ষণ একে অপরের নির্ভেজাল খেলার সাথি হয়ে থাকে। এখন আমরা বড় হচ্ছি। আমাদের বুদ্ধি আরও উন্নত ও বিকশিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা অন্যদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে ভাবিত! ভাবি- আমি যদি হাসি, তবে যা চাই তা কি পাবো? আর যদি ভ্রুকুটি তুলি তবে কি কিছু হারাবো? এমন ভাবনাচিন্তা আসে।
সার্বজনীন দায়িত্ব
সার্বজনীন দায়িত্ববোধের ধারনাটি মানুষের মধ্যেই কাজ করে। আমরা অপরের জন্য চিন্তিত হই। কারণ “আমি তাদের একজন, আর বৈসাদৃশ্য থাকলেও আমার মঙ্গল তাদের উপরই নির্ভর করে। পার্থক্য সর্বদা থাকবে কিন্তু তা উপকারী হতে পারে। শত-শত বছর আগে এই পৃথিবীতে লোকসংখ্যা ছিল একশত কোটি। বর্তমানে তা ছয় শত কোটি ছাড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই বিপুল জন্সংখ্যার জন্য কোন একটি দেশ তাঁর জনগণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও সম্পদ জোগাতে পারে না। এই কারণে আমরা পেয়েছি বিশ্ব অর্থনীতি। বর্তমান যুগে এটি বাস্তব ঘটনা, বিশ্ব এখন অনেক ছোট হয়েছে। এবং তা ভীষণ ভাবে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এটি বাস্তব সত্য। তাঁর ওপর রয়েছে বস্তুতান্ত্রিক সমস্যা- পৃথিবীর উষ্ণায়ন। এই সমস্যা শুধুমাত্র দু-একটি দেশের সমস্যা নয়। ছয়শত কোটি বিশ্ববাসীর সমস্যা। এই নব বাস্তবতার জন্য সার্বজনীন দায়িত্ববোধের ভাবনা প্রয়োজন আছে।
যেমন ধরুন আগেকার দিনে ইংরেজরা শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবত। কোন-কোন সময় পৃথিবীর অন্য দেশে করত শোষণ। ওরা অপরাপর জনগণের চিন্তা-ভাবনার পরোয়া করত না। যাক্, তা অতীতের কথা। কিন্তু এখন বিষয়টি ভিন্ন এবং পালটেও গেছে। অতএব, এখন অন্য দেশগুলিকেও আমাদের দেখাশোনা করতে হবে।
সত্যি বলতে কি, ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ কিছু ভালো কাজও করেছে। ওরা ইংরেজি ভাষায় ভারতে উন্নত শিক্ষা এনেছে। ভারত ইংরেজি শিক্ষা থেকে অনেক কিছু পেয়েছে তা স্বীকার করতেই হবে। রেলপথের মতো প্রযুক্তিও এনেছে ব্রিটেন। দোষাদি থাকলেও তা আপনাদের একটি চারিত্রিক গুণ। আমি যখন ভারতে এলাম, তখনও কতিপয় গান্ধিবাদী জীবিত ছিলেন। ওরা আমায় বোঝালেন গান্ধিবাদী অহিংসার তত্ত্ব। তখন আমার মনে হল যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ খুবই খারাপ ছিল। পরে দেখলাম স্বাধীন ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা, মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, বাক্ স্বাধীনতা ইত্যাদি রয়েছে। তাই বিষয়টি আরও গভীরভাবে ভেবেচিন্তে দেখলাম, সেগুলি ভালই তো ছিল।
আজ অর্ন্তদেশীয় এবং মহাদেশ- মহাদেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা অত্যন্ত গভীর। এই বাস্তবতার নিরিখে বিশ্বব্যাপী এক দায়বদ্ধতা আমাদের থাকা প্রয়োজন। আপনার নিজের মঙ্গল অপরের উন্নয়ন ও মঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল। তাই আপনার নিজের মঙ্গলের জন্যই আপনাকে অপরেরও যত্ন নিতে হবে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিষয়টি রয়েছে। আমরা যদিও একে অপরকে বিশ্বাস করি না, তার উপর রয়েছে মতাদর্শগত পার্থক্য; তবু পারস্পরিক নির্ভরশীল বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে মিলেমিশে আমাদের কাজ করতে হবে। অতএব, পরার্থ ভাবনায় সার্বজনীন দায়িত্ববোধ বিষয়টি খুবই মহত্বপূর্ণ।
অন্যরাও আমাদের ভাই-বোন, আত্মীয় এরকম ভাবনা প্রয়োজন। ধর্মের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। এটি সত্যিই আমাদের দরকার। বিশেষ অবস্থায় ‘আমরা-ওদের’ ধারনা অবশ্যই বলতে পারি। কিন্তু ‘ইহা আমাদেরই অংশ’ সমগ্র বিশ্বকে তা ভাবা প্রয়োজন। আমাদের প্রতিবেশীর মঙ্গল একান্তভাবে আমাদের মঙ্গল।
সন্তোষ
একজন ব্যক্তি হিসেবে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জীবনযাত্রার মানে হল অপরের ক্ষতি না করা। আর যদি সম্ভব হয়, তাদের সাহায্য করা। অপরের মঙ্গল সাধনকে যদি আমাদের নৈতিকতার আধার হিসেবে গ্রহণ করি, তবে তা নৈতিকতার এক প্রসারিত রূপ হিসেবে উঠে আসে। আমাদের জীবনশৈলীতে বিষয়গুলি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ধনী দরিদ্রের ব্যবধান খুবই বেশী। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বিত্তবান দেশ আমেরিকার দিকে যদি তাকাই; এখনও সেখানে দারিদ্রের ছাপ রয়েছে। একবার এই ধনাঢ্য দেশের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ছিলাম। দেখলাম সেখানেও অনেক দরিদ্র এলাকা আছে। ওই গরিব মানুষদের মৌলিক চাহিদাও পর্যাপ্ত পরিমাণে পূরণ হচ্ছে না। একই রকম ভাবে বিশ্ব-স্তরেও দেখা যায়, উত্তরের শিল্পোন্নত দেশগুলি অবশিষ্ট পৃথিবী থেকে অনেক উন্নত এবং ধনী। অন্যদিকে দক্ষিন গোলার্ধের বহু দেশ আজ নিরন্নতার সম্মূখীন। এই শুধু নৈতিক প্রমাদ নয়, এক মস্ত সমস্যার উৎস। তাই বিশেষ ধনী দেশগুলির নিজেদের জীবনশৈলীকে দেখা ও পরীক্ষা করা উচিৎ। তাদের সন্তুষ্টির অনুশীলন করা প্রয়োজন।
পনেরো বছর আগে একবার জাপান গিয়ে জাপানীদের বলেছিলাম, এই যে আপনারা ধরে নিচ্ছেন প্রতিবছর আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়তেই হবে। সেই সঙ্গে প্রতি বৎসর বস্তুগত উন্নয়নও হওয়া চাই- এটি মস্ত ভুল। একদিন দেখবেন আপনাদের আর্থিক ব্যবস্থা অনেকটাই সীমিত হয়ে গেছে। আর যখন তা ঘটবে, এর জন্য আপনাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। তাতে আপনাদের মনে ভয়ানক আঘাত লাগবে না। কয়েক বৎসর পর জাপানে সত্যি তেমন অবস্থা হয়েছিল।
কতিপয় মানুষের জীবন যাত্রা অত্যাধিক বিলাসিতাপূর্ণ। কোন রকম চুরি, শোষণ বা কাউকে না ঠকিয়েও তাদের অঢেল অর্থ আছে। রোজগারের উপায় যদি অনৈতিক না হয়, তবে তাদের আপন স্বার্থের দৃষ্টিকোণে দেখলে তা দোষাবহ নয়। কিন্তু এর বিপরীতে অন্যদের কথা ভাবলে, যদি তাদের দিক থেকেও তেমন কিছু দোষের নয়, তবু নৈতিকতার মানদন্ডে তা ভাল নয়। অবশিষ্টরা তো অনাহারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সকলের যদি একইরকম উচ্চমানের বিলাসীতাপূর্ণ জীবন হয়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত তা সম্ভব না হচ্ছে; অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনযাত্রার অধিকারীদের অনেক বেশী তুষ্ট থাকা উচিৎ। জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য প্রাচুর্যে ভরা সমাজে আমি যা অনুভব করেছি, তাই মনে হয় জীবনশৈলী কিছুটা পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে।
অনেক দেশে পরিবার পিছু দুটি বা কখনো তিনটি গাড়ি থাকে। ভারত ও চীনের কথা ভাবুন একবার। এই দুটি দেশের জনসংখ্যা দু’শো কোটিরও বেশী। যদি দু’শো কোটি মানুষ দুশো কোটি বা তার বেশী গাড়ি সংগ্রহ করে, তা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। জ্বালানী, ধাতু ও প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদির ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে। বিষয়টি হয়ে উঠবে অত্যন্ত জটিল।
পরিবেশ সচেতনতা
নৈতিক আদর্শ ভিত্তিক জীবনযাত্রার একটি অতিরিক্ত বিষয় হলো পরিবেশ সচেতনতা। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের ব্যবহৃত জলের কথাই ধরুন। আমাদের নিজস্ব অবদান হয়তো তুচ্ছ, নগন্য। কিন্তু আমি বহু বছর ধরে স্নানের টবে স্নান করি না। শুধু জলধারা ব্যবহার করি। স্নানের টবে প্রচুর জল লাগে। আমার বিষয়টি হয়তো তুচ্ছ। প্রতিদিন আমি দুবার জলধারায় স্নান করি। তাতে ব্যবহৃত জলের পরিমাণ মোটামুটি একই থাকে, কম লাগে। যাইহোক বৈদ্যুতিন আলোর কথাই ধরুন, আমি সব সময় আলো নিভিয়ে কক্ষ ত্যাগ করি। বস্তুতন্ত্রে এই ভাবে আমি সামান্য অবদান রাখি। এমন ভাবেই জগতের প্রতি দায়িত্ববোধের ভাবনা থেকেই উঠে আসে একটি সদাচারী নৈতিক জীবন।
কী ভাবে অপরকে সাহায্য করা যায়
অপরকে সাহায্য করার জন্য অনেক উপায় আছে। তা অনেকটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। আমি যখন ছোট ছিলাম, এই সাত-আট বছর বয়স হবে; এবং পড়াশোনা করতাম; আমার শিক্ষক মহাশয় লিঙ্ রিনপোছে সব সময় একটি চাবুক রাখতেন। সেই সময় আমার বড় ভাই ও আমি একসঙ্গে পড়তাম। আসলে সেখানে দুটি চাবুক ছিল। একটি ছিল হলুদ বর্ণের, আর একটি পবিত্র চাবুক। এটি পরম পবিত্র দলাই লামার জন্য। আপনি যদি পবিত্র চাবুক ব্যবহার করেন; মনে হয় না সেখানে কোনও পবিত্র ব্যাখ্যা ছিল। উপায় হিসেবে কঠোর ঠিকই কিন্তু তা খুবই উপকারী ছিল।
কোনও কর্ম উপকারী না ক্ষতিকর হবে তার শেষ পর্যন্ত নির্ধারক হয় ঐকান্তিক ইচ্ছার কারণে। অপরের সুদূর প্রসারী মঙ্গলের কথা চিন্তা করলে পদ্ধতি কখনও কোমল, কখনও বা কঠিন হতে পারে। কোন সময় তো সামান্য একটি মিথ্যাও সাহায্য করতে পারে। ধরুণ, কোন প্রিয় বন্ধু বা কারো মাতা-পিতা বিদেশে থাকেন। ওরা অসুস্থ বা মরণাপন্ন এবং আপনি তা জানেন। এমন অবস্থায় আপনি যদি জানেন তার মাতা-পিতা মরণাপন্ন, তিনি হয়তো ভয়ঙ্কর ভাবে মুষড়ে পড়বেন। এমনকি উদ্বিগ্ন হয়ে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন। অতএব আপনি বলুন, ওরা ভাল আছেন। আপনি যদি কাউকে দুঃখ দিতে না চান তবে ওরকম ক্ষেত্রে তা বলা যেতে পারে। মিথ্যা বলা যদিও কোন ব্যক্তির আপন হিতের পক্ষে অনৈতিক ও অকুশল, তবু অন্যের জন্য এমন পরিপ্রেক্ষিতে তা যথোচিত হতে পারে।
অহিংস বনাম সহিংস উপায়
তাহলে অপরকে সাহায্য করার সর্বোত্তম উপায় কী? তা বলা কঠিন। আমাদের প্রয়োজন জ্ঞানের; পারিপার্ষিক অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের পূর্ণ সচেতন হওয়া প্রয়োজন, এবং অবস্থানুযায়ী বিভিন্ন উপায় বা পদ্ধতি ব্যবহার করার মতো নমনীয়তা থাকতে হবে। সর্বোপরি যা খুবই মহত্বপূর্ণ- সেটা হল মনের ঐকান্তিক ইচ্ছা; অপরের জন্য সত্যিকারের ভাবনা থাকতে হবে আমাদের।
উদাহরণ স্বরুপ, উপায় বা পদ্ধতিটি হিংসাত্মক না অহিংসাত্মক হবে তা মনের ঐকান্তিক ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। সামান্য মিথ্যা বলা যদিও হিংসাত্মক, কিন্তু ঐকান্তিক ইচ্ছানুযায়ী তা অন্যদের সহায়তা করার উপায়ও হতে পারে। অন্যদিকে কাউকে ঠকানো বা সুযোগ নেবার মনোভাব নিয়ে কোন ব্যক্তিকে উপহার দিলে তা দেখতে অহিংসাত্মক হলেও মূলতঃ হিংসাত্মক কর্ম। কারণ কাউকে ঠকাতে চাইছি। অতএব, হিংসাত্মক বা অহিংসাত্মক যাই হোক না কেন তা মনের গভীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তারপরও কিছুটা নির্ভর করে লক্ষ্যের উপর। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য যদি শুধু লক্ষ্যই হয় আর ঐকান্তিক ইচ্ছাটি হয় ক্রোধ, তাহলে তো মুশকিল। সুতরাং সারমর্ম হল- ঐকান্তিক ইচ্ছাটুকু খুবই মহত্বপূর্ণ।
সর্বধর্ম সমন্বয়
এখানের প্রবচন থেকে আপনারা বাড়ি কী নিয়ে যাবেন? অন্তরে শান্তি আসুক, এই চেষ্টা করুন, তা খুবই মহত্বপূর্ণ। অবশ্যই এই বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে এবং আমাদের মধ্যেই তা আনতে হবে। এছাড়া এখানে দর্শকদের যদি কোন অন্যধর্মে বিশ্বাসী অনুগামী থাকেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি আমি সর্বদা বিবিধ বিষয়ের সঙ্গে মূখ্যরূপে সর্বধর্ম সমন্বয়ে জোর দেই। আমি মনে করি প্রধানধর্মগুলির নিজস্ব দর্শন ও তত্ত্ব রয়েছে। তবে খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয় এমন ধর্মমতগুলো যারা চন্দ্র-সূর্য পূজো করে, তাদের হয়তো তেমন দর্শন নেই। প্রধান ধর্মগুলি নির্দিষ্ট দর্শন ভিত্তিক হওয়ায় তা হাজার হাজার বছর ধরে চলছে। দার্শনিক মতপার্থক্য থাকলেও সকল ধর্ম মনে করে মৈত্রী ও করুণার সাধনাই সর্বশ্রেষ্ঠ।
সহজেই করুণার মাধ্যমে ক্ষমার ভাবনা আসে। তারপর আসে ধৈর্য্য ও সন্তুষ্টি। সব ধর্মই একথা বলে। নূন্যতম মানবিক মূল্যবোধের বিষয়ে আমরা যা বলে আসছি তার বিকাশে এসব বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, আমাদের সুখের মূলাধার- নৈতিক জীবনচর্যা বা সদাচারী জীবনচর্যা। এই বিষয়ে সকল ধর্ম হয় সহায়ক। অতএব, যেহেতু সকল ধর্ম একইরকম বার্তা বহন করে, তাদের মধ্যে মানবজাতিকে সাহায্য করার মত একইরকম সম্ভাবনা রয়েছে।
যুগ যুগান্তরে, নানা স্থানে উঠে এসেছে বিবিধ মতবাদ। তার প্রয়োজন আছে। জলবায়ুর পার্থক্যজনিত কারণে এই কাল ভেদ, স্থান ও বিচিত্র জীবনযাত্রার উদ্ভব হয়েছে। সে কারণে ধর্মগুলির মধ্যে বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। প্রতিটি যুগে একটি নির্দিষ্ট ধর্মমত কালোপযুগী ছিল। অতএব তদনুসার সেটা গৃহীত হয়েছে। সেই কারণে হাজার বছরের প্রাচীন প্রতিটি ধর্মের নিজস্ব পরম্পরা আছে। এই বিচিত্র এবং সমৃদ্ধ পরম্পরাগুলির প্রয়োজন আছে আমাদের। বৈচিত্রপূর্ণ মানবজাতির সেবা করছে তারা। একটি মাত্র ধর্ম কখনও সবার পক্ষে গ্রহণযোগ্য ও মঙ্গলদায়ক হতে পারে না।
বুদ্ধের সময় ভারতে অনেক অবৌদ্ধ পরম্পরা ছিল। বুদ্ধ সকল ভারতবাসীকে বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেন নি। অপর ধর্মগুলিও ছিল উত্তম। কখনও-সখনও তারা নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক করত। বিশেষ করে বুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শত-শত বৎসর ধরে আচার্যগণ একে অপরের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। বিশেষত ধর্মতত্ত্বের বিষয়ে এই বিতর্ক খুবই উপকারী। ভিন্ন পরম্পরার একজন বিদ্বান অপর একটি দর্শন ও মতবাদের সূক্ষাতিসূক্ষ বিশ্লেষণ করেছে, এই বিষয়টি প্রত্যেককে তার স্বধর্ম ও পরম্পরা সম্পর্কে ভাবিয়েছে এবং অংশ নিয়েছে বিতর্কে। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে এসেছে সমৃদ্ধি। কিন্তু ঘটনার এই বিতর্কগুলিতে হয়তো সামান্য হিংস্রতা ছিল। এবং ছিল অনভিপ্রেত। কিন্তু ছিল জ্ঞানের এক অনিন্দ বিকাশ।
প্রাচীন ভারতবর্ষ ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পরম্পরা হিসেবে তা শত-শত বৎসর টিকে ছিল। ভারতে এখনও এই পরম্পরা সজীব। অবশিষ্ট পৃথিবীর কাছে এই বিষয়টি একটি সুন্দর উদাহরণ।
প্রাচীন কালে মানুষ ছিল বিচ্ছিন্ন, তা ঠিক আছে। কিন্তু এখন আমরা ভিন্ন পরিস্থিতিতে বাস করছি। যেমন ধরুন- লন্ডন, সেটি একটি বহু ধর্ম বিশিষ্ট সমাজ। তাহলে দেখা যাচ্ছে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা খুবই মহত্বপূর্ণ বিষয়। সুতরাং আপনারা যারা একটি ধর্মে আস্থাবান, আপনাদের মধ্যে সমন্বয় ও সহিষ্ণুতা খুবই মহত্বপূর্ণ। আপনারা যখনই সুযোগ পাবেন এই বিষয়ে অবদান রাখবেন।