আজ আমি ধর্মনিরপেক্ষ বিধিগুলির প্রয়োগ দ্বারা চিত্তের সুখ প্রাপ্তির বিষয়ে চর্চা করব। এখানে একত্রিত অনেক বেশী সংখ্যক মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি খুশী। আমার একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র, ডেভিড লিভিংস্টোন, যিনি একজন আমেরিকাবাসী বৈজ্ঞানিক ছিলেন, এখন তিনি আমাদের মধ্যে নেই, বলেছিলেন যে, যখন কোনো সহৃদয় ব্যক্তির সাথে অন্য ব্যক্তিরা সাক্ষাৎ হয়, তখন তাদের চোখ চওড়া হয়ে যায় এবং চোখের মণি বড় হয়ে যায়। তিনি বলেছিলেন যে, যখন তিনি আমার সাথে দেখা করেছিলেন, তখন তাঁর চোখ চওড়া হয়ে গিয়েছিল এবং চোখের মণি বড় হয়ে গিয়েছিল। উক্ত ঘটনাটা শুধুমাত্র দুইজন মানুষের সাথে দেখা হওয়ার সময় ঘটেছিল, অর্থাৎ যখন তিনি আমার সাথে দেখা করেছিলেন এবং যখন তিনি তার স্ত্রীকে দেখেছিলেন। কিন্তু এখন, আমি যেখানেই যাই, সেখানকার স্থানীয় মানুষজন একই রকম হয়; তারা আমার প্রতি অকৃত্রিম আবেগপূর্ণ ভাব প্রদর্শন করেন এবং আমি এটার খুব সমাদর করি। অতএব ধন্যবাদ!
‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ মানে কী? আমি ভারতীয় পরম্পরায় ব্যবহৃত প্রয়োগ অনুসারে এর প্রয়োগ করি। আমার কিছু মুসলমান এবং খ্রীষ্টান মিত্র মনে করেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দে কিছুটা ধর্মবিরোধীতা বিদ্যমান আছে, তাই তারা আমার এই শব্দের প্রয়োগ পছন্দ করেন না। আবার কিছু মানুষ ভাবেন যে, ‘নৈতিকতা’ ধর্মের উপর আধারিত হওয়া উচিৎ। কিন্তু ভারতীয় সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার উপর আধারিত; এটা ধর্মবিরোধী নয়। ভারতবর্ষে, মানুষ ধর্মকে খুবই সম্মান করেন। গান্ধী এবং ভারতীয় সংবিধানের খসড়া নির্মাতাগণ খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। এই প্রসঙ্গে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হওয়ার অর্থ হল সকল ধর্মকে সম্মান করা, আর এটা না ভাবা যে, কোনো একটি ধর্ম বাকী সকল ধর্মের থেকে শ্রেষ্ঠতর; এবং হাজার-হাজার বছর ধরে এই ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতে অবিশ্বাসীদেরও অধিকারের সম্মান করেছেন। তাই আমি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দের প্রয়োগ এই অর্থেই করি।
যেমন মানুষ, এমনকি পশু আর কীট-পতঙ্গরাও অধিক শান্তি এবং প্রশান্তের কামনা করে। কেউই অশান্তি চায় না; প্রত্যেকেরই যে কোনো প্রকারের অশান্তি, সমস্যা এবং দুঃখকে অভিভুত করার অধিকার আছে। এই কথাটিকে তর্ক অথবা কোন প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। এটা প্রকৃতির সহজ নিয়ম; এবং সকল জীবগণ, পাখি, পশু, মানুষ, সকলেই এই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে। যেটা মহত্বপূর্ণ সেটা হল যে আমাদের এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য কী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এটাকে বাস্তবধর্মী হতেই হবে, এবং অবাস্তব পথ অনুসরণ করলে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে অসফলই হব। যেমন- কখনোও-কখনোও আমরা দেখি যে, কোনো পশু এতটাই ভয়ভীত হয়ে যায়, যে সে ভুল পথে দৌড়তে থাকে; তারা অনিষ্ট হওয়ার দিকেই দৌড়তে থাকে, সঠিক পথে না গিয়ে। কিন্তু আমরা মানুষ এবং আমাদের অবিশ্বাস্য বুদ্ধি আছে। সেই কারণে যুক্তি এবং বুদ্ধির প্রয়োগ দ্বারা আমাদের বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ অনুসরণ করার ক্ষমতা বেশী থাকে। তাই আমরা বেশী সফল হই। আমাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সচেতনতা আছে এবং সেই কারণে কখনও-কখনও আমরা দীর্ঘমেয়াদী সফলতার জন্য আশু লাভ ত্যাগ করে দিই। এটাই প্রমাণ করে যে, আমরা পশুদের তুলনায় বুদ্ধিমান। এই বুদ্ধির কারণেই, আমরা মনুষ্যগণ দীর্ঘকালীন লাভ প্রাপ্ত করার জন্য চেষ্টা করি।
তাহলে, প্রশ্ন হল, অনুভবের কোন স্তর আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশী সুবিধা প্রদান করে? ইন্দ্রিয়বোধ প্রধাণতঃ অস্থায়ী হয়। উদাহরণস্বরূপ- যখন আপনি কোন ছবি অথবা খেলা দেখছেন অথবা একজন পর্যটক নতুন-নতুন জায়গা, বেশ-ভূষা, মানুষ দেখার জন্য যায়, তখন চোখের দ্বারা, একপ্রকারের আনন্দ প্রাপ্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ- আমার দিল্লীর গাড়িচালক, একজন ভারতীয়, ক্রিকেট খেলা ভালোবাসে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, গত রাত্রে যখন ক্রিকেট খেলা চলছিল তখন সে কত ঘন্টা ঘুমিয়েছিল। তিনি জবাব দিয়েছিলেন চার ঘন্টা ঘুমিয়েছিলেন। তখন আমি তার সমালোচনা করে বলেছিলাম খেলা দেখার থেকে ঘোর নিদ্রা ভালো। এটা মনের জন্য খুব ভালো। এছাড়াও সঙ্গীত, সুগন্ধ, ভোজন এবং আনন্দদায়ক শারীরিক চেতনাগুলিও আছে। এই ইন্দ্রিয় স্তরের সুখ কেবলমাত্র অস্থায়ী। যখন এগুলি শেষ হয়ে যায়, তখন আমাদের কাছে এর স্মৃতিটুকুই বাকী থেকে যায়।
অন্যদিকে, কিছু অনুভবের বোধ মনের স্তরেই হয় এবং এই অনুভবগুলি ইন্দ্রিয়বোধের উপর নির্ভরশীল হয় না; এবং এই আনন্দগুলি অনেক বেশী সময় ধরে থাকে। তাই, এটা উপলব্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে সুখ এবং দুঃখ অনুভবের দুটি স্তর। এক, ইন্দ্রিয় স্তর, যা অস্থায়ী হয় এবং অন্যটি, মানসিক স্তর, যা খুবই গভীর হয়।
আমাদের এই আধুনিক সময়ে মানুষ ইন্দ্রিয় স্তরের অনুভবগুলির উপর বেশী জড়িত, আর এটাকেই খুব গুরুত্ব দেয়। সেই কারণে তারা সবসময় ভৌতিক সাধনগুলিতেই আনন্দের খোঁজ করে এবং আভ্যন্তরীণটাকে উপেক্ষা করে, যেটা গভীর স্তর। অনেক বছর পূর্বে একবার আমি জার্মানীর বার্লিন শহরে ছিলাম। সেখানে আমি যে হোটেলে ছিলাম, তার ঠিক উল্টোদিকে একটি নাইট ক্লাব ছিল। রাত্রে ৭.৩০ অথবা ৮ টার সময় যখন আমি শুতে যাচ্ছিলাম তখন বাইরে লাল, নীল ও বিভিন্ন রঙের বাতি জ্বলছিল এবং খুব জোরে সঙ্গীতের আওয়াজ হচ্ছিল। আমি ঘুমাতে চলে গেলাম এবং মধ্যরাত্রিতে যখন আমার একবার ঘুম ভাঙল, সেটা তখনও চলছিল। ভোর চারটের সময় যখন আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম, সেটা তখনও চলছিল। যে মানুষগুলো ওখানে ছিল তাদের সব শক্তি ইন্দ্রিয়স্তরেই শেষ হয়ে যাচ্ছিল। আমার মনে হয় পরদিন, সকলে সম্পূর্ণরূপে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
সম্প্রতি এক ভারতীয় পরিবারের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। পরিবারটিতে পিতা-মাতার সহিত তাহাদের কিছু শিশু ছিল, এবং আমরা উদ্দেশ্যহীন বার্তালাপ করছিলাম। আমি বলেছিলাম বিগত দুই-তিন বছর ধরে আমি টিভি দেখি না; আমি শুধু বি.বি.সি. রেডিওতে খবর শুনি। সেই ভারতীয় পরিবারের যুব সদস্যগণ আমাকে বলেছিল, “টেলিভিশন না দেখলে তো আপনি বিষন্ন হয়ে যাবেন!” এই কথাটি এটাই বোঝায় যে তারা খুব টেলিভিশন দেখেন। বিশেষত, আমেরিকা এবং ইউরোপের শিশুরা প্রচন্ড টিভি দেখে। এটা খুব ভালো কথা নয়; কারণ এর দ্বারা শিশুদের প্রখর বুদ্ধি দ্বারা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। অতএব, আনন্দ প্রাপ্তির মার্গ রূপে মানসিক স্তরে আরও বেশী কার্য করা কেবলমাত্র ইন্দ্রিয় স্তরের থেকে অনেক ভালো।
আরও একটি বিন্দু হল যে, বাস্তবিক বিশৃঙ্খল আবেগ মুখ্যতঃ মানসিক স্তরেই উৎপন্ন হয়; এই কারণে আনন্দময় জীবনের জন্য আমাদের চিত্তের শান্তি আবশ্যক। যেহেতু অশান্তির স্রোত মানসিক স্তরেই হয়, এই কারণে আনন্দপ্রাপ্তির জন্য মানসিক স্তরকে নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। তাই, প্রথমতঃ, আমরা নিজের অন্তরজগৎ এবং আভ্যন্তরীণ মানকে অধিক নজর দিতে হবে। মস্তিষ্কের ছোট জায়গার মধ্যে আমরা মনের ভিতরের বিশাল জায়গা অন্বেষণ করতে পারি, কিন্তু আমরা এই ভিতরের জায়গা সম্বন্ধে খুবই কম জানি। তাই, আমাদের এই আবেগকে পরীক্ষা করতে হবে। যখন শক্তিশালী আবেগ উদিত হবে, তখন মনের একটি অংশ দ্বারা এই আবেগের পরীক্ষা করতে হবে, তখন আমরা দেখব এই আবেগ ক্রমশ হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে ক্রোধের আয়ত্তে থাকা চিত্তকে দেখার ক্ষমতা আছে। যখনই আমরা পরীক্ষা করব, এই প্রবলতা হ্রাস পেতে থাকে। মনের গভীরে দৃষ্টিপাত করা খুবই আকর্ষণপূর্ণ।
আমরা এখন একুশ শতাব্দীতে বাস করছি। বিংশ শতাব্দী মনে হয় মানব ইতিহাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শতাব্দী ছিল। কারণ এই শতাব্দীতে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছিল। তাই আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি হয়েছিল; আমাদের জীবনের মানোন্নয়ন ঘটেছিল। কিন্তু, একই সঙ্গে, এই শতাব্দী রক্তক্ষয়ীও বটে। আপনার মাতা-পিতা, দাদু-দিদা-রা গুরুতর অশান্তি এবং কষ্ট দেখেছেন। দুই শত মিলিয়নেরও বেশী মানুষ নিহত হয়েছিল যারমধ্যে কিছু মানুষ পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগে নিহত হয়েছিল। এই বিপুল হিংস্রতা যদি কিছু নতুন ব্যবস্থার জন্ম দিতো, তাহলে আমরা এটাকে ন্যায্য বলতে পারতাম। কিন্তু এরকম তো হয়নি। এখনও, একুশ শতাব্দীর শুরুতেই ইরাক, ইরান, এবং আফগানিস্থান-এ কত রকমের সমস্যা আছে, কত পরিমাণে সন্ত্রাসবাদ আছে। এগুলি সব বিগত ভুল এবং উপেক্ষার ফল। বিগতকালে, বাহ্যিক বস্তুর উপরে অত্যধিক জোর দেওয়া হয়েছিল। এখন, আমরা বেশী করে আভ্যন্তরীণ মূল্যের উপর চিন্তা-ভাবনা করব, শুধু বাহ্যিক বস্তুর উপর নয়।
ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে বৈসাদৃশ্য একটি বিশাল সমস্যা, যদিও বস্তুগত প্রগতি সাধারণত ঠিক-ঠাক আছে। এখানে, অষ্ট্রিয়াতে বৈসাদৃশ্য-এর স্তর বেশ ভালো। কিন্তু গতবছর আমি মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল গিয়েছিলাম এবং আমি ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যেকার বৈসাদৃশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, এটা বড় না ছোট। তারা বলেছিলেন যে ওখানে এটা খুব বড়। অষ্ট্রিয়াতে মনে হয় এই বৈসাদৃশ্য খুব কম।
আমি এই প্রশ্নটাও করেছিলাম, “এখানে দুর্নীতির স্তর বড় না ছোট?” গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে কথা বলায় স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকতায় স্বাধীনতা আছে, সেখানেও প্রচুর পরিমাণে দুর্নীতিও থাকতে পারে। এটা হল আত্ম-অনুশাসনের অভাব এবং নৈতিক-সিদ্ধান্তের অভাব। উদাহরণস্বরূপ, ভারত একটি ধার্মিক-প্রবণ দেশ, এবং সেখানেও অনেক দুর্নীতি আছে। অনেক ভারতীয় তাদের ঘরে দেব-দেবীর মূর্তি রাখেন, তারা ধূপ এবং ফুল অর্পণ করেন এবং প্রার্থনা করেন, কিন্তু কখনও-কখনও আমি রসিকতা করে বলি যে ওনাদের প্রার্থনা হল, “আমাদের দুর্নীতি সফল হোক!” এটা খুব দুঃখজনক! তারা ধার্মিক মনোবিশিষ্ট এবং তাও অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্থ। তাহাদের আস্তিক বলে মানা হয়, কিন্তু তাহারা সে সীমা পর্যন্ত আস্তিক নয় যেখানে নিজের ধর্মের সিদ্ধান্ত বাস্তবিক অর্থে পালন করতে পারে এবং ধর্মপরায়ণ হতে পারে।
কয়েক বছর পূর্বে, আমি একজন পণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে বহুরাষ্ট্রীয় কোম্পানীগুলি সম্বন্ধে এবং কী করে তেদের মুনাফা স্বচ্ছ হয় না, এই বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম এবং বলেছিলাম, “এই কোম্পানীগুলি চালনা করার মানুষজন ধর্মপরায়ণ মনে হয়, এই কারণে তাদের কিছু অনুশাসন থাকা উচিৎ”। তিনি বলেছিলেন “এটা তো আঠারো শতাব্দীর ধারণা”। এইজন্য, যদিও এই মানুষগুলি ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনা করেন, কিন্তু যদি তারা গম্ভীর হতো, তাহলে সৎ, যত্নশীল এবং নীতিপরায়ণতা হওয়ার জন্য ঈশ্বরের উপদেশ অনুসরণ করত। তাই, আমাদের অপরের প্রতিও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন এবং পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। অতএব, আমাদের নৈতিকতার উপর বেশী জোর দেওয়া আবশ্যক। এর অর্থ হল আত্ম-অনুশাসনের উপর আরও বেশী জোর দেওয়া, যেটা কর্তব্যবোধ অথবা ভয়ের দ্বারা নয়, বরং স্বেচ্ছায় করা। এটা জানার উপর ভিত্তি করে যে, “আমি যদি এই কাজে রত হই, তাহলে এটা নৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হবে”।
আমাদের নৈতিকতার উপর জোর দিতে হবে, নাহলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সম্পদ হ্রাসের কারণে সমস্যা বাড়তেই থাকবে। তাই, আমাদের এই একুশ শতাব্দীকে এমন এক শতাব্দী বানাতে হবে, যেখানে আমাদের প্রয়াস হবে এটাকে করুণাময় শতাব্দী হিসাবে গড়ে তোলা। নৈতিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ আচরণের মূল সিদ্ধান্ত এটাই।
নৈতিকতার সঙ্গে স্নেহময় আচরণের গভীর সম্বন্ধ আছে। এটার মানে হল, অপরের প্রতি আরও বেশী যত্নশীল হওয়া। তারাও সুখী হতে চায়; তারা অসুখী হতে চায় না এবং আমরা সকলে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। তাদের সুখই আমাদের সুখের স্রোত। আমরা যখন এটা হৃদয়াঙ্গম করে নেব, তখন সেখানে মিথ্যা, প্রতারণা, ভয় দেখানো অথবা শোষণ করার কোন জায়গা থাকবে না। এই অর্থে স্নেহময় আচরণ হল আনন্দের স্রোত। এবং এটা আসে মায়েদের একটি জীবতত্ত্বিক উপাদান থেকে: আমরা বেঁচে থাকি আমাদের মায়েদের স্নেহ-ভালোবাসা এবং তাহাদের দুগ্ধের কারণে। এই অনুভব আমাদের জীন এবং রক্তে নিবিষ্ট হয়ে আছে। এবারে প্রশ্ন হল- শিশুরা অন্যদের থেকে টাকা-পয়সা এবং সাংস্কৃতিক জিনিসের থেকে বেশী স্নেহ পাওয়ার জন্য উৎসুক থাকে। কিন্তু যখন তারা বড় হয়ে যায়, এবং যদি জ্ঞানী না হয়, তাদের মূল্য হ্রাস হতে থাকে। কেন? কারণ তারা বেশী আত্ম-কেন্দ্রিক হয়ে যায়। তারা যদি অন্যদের সাহায্য করে, তখন তাদের মনে হয় “এর বদলে আমরা কী ফেরত পাব?” এইরকম আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার প্রবৃত্তি ‘আমিত্ব’ কে বাড়িয়ে দেয়, যা বড় সমস্যার মূল হয়ে দাড়াঁয়। অতএব, পুরো মানব সমাজটাকেই আমাদের ‘আমরা’ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে, সেটা ইউরোপ সংঘ হোক বা পুরো বিশ্ব হোক। আমাদেরকে ভাবতে হবে যে, পুরো বিশ্বের সাতশো কোটি মানুষই ‘আমরা’, এবং এটাও বুঝতে হবে যে, আমরাও এই ‘আমরা’-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত; আমাদের নিজেদের ছোট্ট ‘আমিত্ব’ যেন কোথাও না দেখা যায়। এইভাবে, আমাদের সকলকে সম্মান করতে হবে, ধনী ও গরীব উভয়কে। সকলের সমান অধিকার থাকা উচিৎ, আর্থিক দিক থেকে এবং অন্য সকল দিক থেকে। যদি আমরা অন্যদের কল্যাণ করার চিন্তা-ভাবনা করি, তাহলে সম্মান নিজে থেকেই উৎপন্ন হবে।
এটা ধর্মের কোন অংশ নয়; ধর্ম তো একটা ব্যক্তিগত বিষয়। এগুলি হল সম্পূর্ণ মানবতার ভাবনা। যদি আমরা সকলকেই সম্মান করি, তাহলে কারোরই শোষণ হবে না। তাছাড়াও, স্নেহময় ব্যবহার শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই লাভদায়ক। কিছু বৈজ্ঞানিক বলেন যে, অবিরত বিপত্তি আর ভয় আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। এই কারণে যখন আমরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠি, তখন আমাদের নিজেদের তরফ থেকেই বড় ভয় হয় আর অন্যদের নিয়ে আমাদের মনে অবিশ্বাস জাগে। এর কারণে একাকীত্ব এবং ভয়ের ভাব জাগৃত হয়, যার কারণে হতাশার জন্ম হয় আর অত্যন্ত ক্রোধ উৎপন্ন হয়। কিন্তু যখন আমরা নিজেদের হৃদয়ের দরজাগুলি খুলে দিই আর মনে অপরের কল্যাণের জন্য ভাবী তখন আমাদের ভিতরে আত্মবিশ্বাস বিকশিত হয়। সেই কারণে আমরা বেশী খোলাখুলিভাবে এবং পারদর্শীতার সাথে ব্যবহার করতে পারি। এই পরিস্থিতিতে আমরা যখন কারোর সাথে সাক্ষাৎ করব বা দেখা করব, আমাদের আসে-পাসের সকলকে নিজের ভাই অথবা বোনের মতো ব্যবহার করব; এবং যদি আমাদের ব্যবহার স্নেহময় হয় এবং আমাদের মনে অন্যদের কল্যাণ করার চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে অধিকাংশ মানুষের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হবে। কিন্তু সবসময় এমন হয় না। যখনই আমাকে গাড়িতে করে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমি রাস্তায় চলমান মানুষদের দেখি এবং তাদের দেখে হাসি। একবার জার্মানীতে যখন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলাকে দেখে হেসেছিলাম তখন তিনি খুব সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। এইভাবে আমার হাসি ঐ মহিলাকে খুশী করার বদলে ভয়ভীত করে দিয়েছিল। এই কারণে আমি আমার মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু সাধারণত আমি এটা করি না।
স্নেহময় ব্যবহার আমরা আমাদের মায়েদের থেকে শিখি, আর এটা এমন একটি জিনিস যেটা আমাদের সারাজীবন নিজেদের মধ্যে রাখা উচিৎ। বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় বৈঠকে আমাদের স্লোগান আছে- “সুস্থ মন, সুস্থ শরীর”। এটার জন্য আমাদের বাস্তবের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে; আমাদের মনকে শান্ত করতে হবে। যদি আমরা উত্তেজিত হয়ে যাই, আমরা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ি এবং আমরা বাস্তবকে দেখতে না পাই, তাহলে অনেক সমস্যা ডেকে আনি। তাই স্নেহময় ব্যবহার সাহায্য করে মনের শান্তিকে বিকশিত করতে।
যদি আমাদের চিত্ত শান্ত না থাকে, তাহলে এটি শিক্ষা গ্রহণে সমস্যা উৎপন্ন করে। যদি আমাদের চিত্ত শান্ত এবং খুশী না থাকে, তাহলে কিছু শেখা খুব কঠিন হয়; অতএব শান্ত চিত্ত সব ধরণের কাজ করতে আর রাজনীতি সহিত সকলপ্রকার পেশাকে চালনা করতে সক্ষম করে। সংক্ষেপে, চিত্তের শান্তির ফলে আত্মবিশ্বাস বিকশিত হয়, আর আত্মবিশ্বাস আমাদেরকে বাস্তবিকতাকে আরও স্পষ্টভাবে দেখতে সক্ষম করে। এর ভিত্তিতে আমরা নিজেদের স্নেহশীলতা আরও অধিক বিকশিত করতে পারি।
এইগুলি সব ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতার মূল সিদ্ধান্ত এবং সুখের চাবিকাঠি। আমার মতে, এটা খুবই উপযোগী। যদি আপনার মনে হয় এটা ঠিক, তাহলে আপনি এটা অভ্যাসের জন্য প্রয়াস করুন। আর যদি এটা আপনার ঠিক না মনে হয়, তাহলে এটি ভুলে যান। ধন্যবাদ!