সার্থক জীবন-যাপন করা

সমস্ত প্রাণী, বিশেষ করে মানুষের মধ্যে সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ, কোনটা ক্ষতিকারক এবং কোনটা লাভদায়ক, এদের পার্থক্য করার সামর্থ্য আছে। উক্ত বিভিন্ন প্রকারের অনুভূতিকে জানার এবং পার্থক্য করার সামর্থ্য থাকার কারণে সুখের কামনা করা এবং দুঃখের কামনা করার ক্ষেত্রে আমরা সবাই সমান।

যদিও আমি এখানে এই বিভিন্ন প্রকারের অনুভূতি কীভাবে জাগে তাহার উৎসটাকে অনুসন্ধান করার জটিলতায় যেতে পারি না, তবুও আমাদের জন্য যেটা স্পষ্ট এবং পরিষ্কার সেটা হল আমরা সুখের প্রশংসা করি এবং দুঃখ-কষ্টের অনুভূতিকে অপছন্দ করি। সুতরাং আমাদের এমন একটা জীবন-যাপন করা খুবই প্রয়োজন যা আমাদের জীবনে সাদৃশ্যতা এবং শান্তি আনতে পারে, বিশৃঙ্খলা এবং গোলমাল নয়।

যখন শান্তি এবং সুখ অর্জনের প্রশ্নটা ওঠে তখন এটা ভাবা ঠিক নয় যে আমাদের সমস্ত সুখ-শান্তি শুধু বাহ্য বস্তুর সমৃদ্ধির থেকে অর্জন হয়। ভৌতিক সুযোগ-সুবিধার উপর নির্ভর করে আমরা আমাদের শারীরিক আনন্দ ও সুখ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হই, এবং কিছু শারীরিক অসুবিধাও নিবারণ করতে পারি। কিন্তু ভৌতিক সুযোগ-সুবিধা তো শারীরিক অনুভূতি পর্যন্ত সীমিত থাকে।

অন্য প্রাণী-শ্রেণীর থেকে আলাদা মানুষের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা করা, গণনা করা, বিচার করা এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করার অসাধারণ ক্ষমতা আছে। সুতরাং মানুষ হিসাবে আমরা যে সমস্ত সুখ-দুঃখ ভোগ করি সেগুলিও বেশি শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী হয়। এর কারণে এটা সম্ভব যে মানুষ যে অতিরিক্ত দুঃখ ভোগ করে সেটা মানুষের চিন্তা-ভাবনার সামর্থ্য-এর সঙ্গে যুক্ত থাকে।

যেমন- মানুষের ক্ষেত্রে, পশুদের থেকে আলাদা, আমরা কয়েক রকমের অস্থায়ী সুখ লাভ করে সন্তুষ্ট হই না এবং কয়েক রকমের দুঃখ দূর করতে সক্ষম হই না। এর কারণ হচ্ছে মানুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা এবং হিসাব করার ক্ষমতা আছে। এর ফলে আমরা নিজেদের মধ্যে এবং অপরের মধ্যে পার্থক্য করে থাকি। এই পার্থক্য-এর আধারে আমরা আলাদা রাষ্ট্র, আলাদা জাতি, এবং আলাদা ধর্মের বিষয়ে কথা বলি। আমরা অসংখ্য বিভাজন করে থাকি এবং এর ভিত্তিতে আমরা অনেক রকমের অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা-ভাবনা এবং ভুল ধারণা জন্ম দিয়ে থাকি। ঐ সবের কারণে কখনও কখনও আমাদের মধ্যে অত্যধিক আশা জাগে, আবার কখনও বেশী সন্দেহ।

অতএব সম্পূর্ণভাবে মানুষের বুদ্ধি এবং কল্পনার ভিত্তিতে আমরা অনেক রকমের দুঃখ ভোগ করি।  আর্যদেব রচিত চতুঃশতক নামক গ্রন্থে স্পষ্টভাবে বর্ণন করা হয়েছে (২য়ঃ ৮ম): “শ্রেষ্ঠদের মানসিক দুঃখ  আছে এবং সাধারণ ব্যক্তিদের আছে শারীরিক দুঃখ”। এর অর্থ হল যে যদিও মানুষের বেশী অধিকার আছে, অধিক ধন-সম্পত্তি আছে, সুতরাং তাদের বেশী শারীরিক দুঃখ নাও থাকতে পারে, কিন্তু তাহারা বেশী মানসিক দুঃখ ভোগ করে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তাদের শারীরিক দুঃখ বেশী আছে। এর কারণ হল, পর্যাপ্ত পরিমাণে বস্ত্র, ভোজন ইত্যাদি প্রাপ্তি না করা। এর থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে মানুষ তাদের চিন্তা-ভাবনার কারণে অতিরিক্ত দুঃখ ভোগ করে।

যেমন- আমি আগে বলেছি, ভৌতিক বিকাশের সুযোগ অর্জন করে শারীরিক দুঃখ কম করা যেতে পারে। যাহা হোক আপনাদের মানসিক মনোভাবের কারণে যে দুঃখ ভোগ করতে হয় সেটাকে আপনার ভৌতিক সুখ বৃদ্ধি করে কমানো যায় না। এর একটা স্পষ্ট উদাহরণ হল আমরা অনেক ধনী মানুষদের দেখতে পাই যারা এত সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন যাহা ভোগ করা তাদের কাছে সম্ভব হয় না, কিছু পরিত্যাগ করে দিতেও হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাহারা অনেক রকমের দুঃখ ভোগ করতে থাকে। এরকম কিছু আমরা সবাই দেখতে পাই। সুতরাং এটা খুবই স্পষ্ট যে অস্বস্তি, সমস্যা এবং দুঃখ, যেগুলি সম্পূর্ণভাবে আপনাদের মানসিক মনোভাবের পরিণাম, সেগুলি আপনাদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে কমানো যেতে পারে এবং উচ্ছেদ করা যেতে পারে, বাহ্য ভৌতিক সুযোগ-সুবিধা দ্বারা নয়।

যদি এই বিন্দুটাকে সংক্ষিপ্ত করে বলা হয়, আমরা যখন সুখ-দুঃখ ভোগের বিষয়ে কথা বলি, সেখানে ভোগ করার দুটো দিক আছে। একটা ইন্দ্রিয় সংক্রান্ত অনুভূতির সঙ্গে বেশী সম্বন্ধ। এর মানে হল, যে সমস্ত সুখ-দুঃখগুলিকে আমরা পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা ভোগ করি তাদের বলা হয়। এছাড়া সুখ-দুঃখ ভোগের অন্য আরও একটা স্তর আছে সেটা আমাদের মন বা মানসিক মনোভাবের উপর আধারিত। এই দুটোর মধ্যে আপনারা মন দ্বারা যে সুখ-দুঃখ ভোগ করেন সেটা আপনার ইন্দ্রিয় দ্বারা যা কিছু ভোগ করেন তার থেকে বেশী শক্তিশালী এবং বেশী প্রভাবশালী।

একটা স্পষ্ট উদাহরণ হল যে আপনাদের কাছে অসীম ভৌতিক সুযোগ-সুবিধা আছে বা আপনাদের মধ্যে কোন রকমের শারীরিক সমস্যা এবং দুঃখ নেই, তা সত্ত্বেও আপনাদের মন যদি শান্ত না থাকে, আপনারা যদি মানসিক ভাবে পীড়িত হয়ে থাকেন, তাহলে এই শারীরিক সুখ ঐ দুঃখগুলিকে অতিক্রম করতে সক্ষম হবে না, যেগুলি আপনারা মানসিক স্তরে ভুগছেন। অন্য দিকে যদিও আপনারা কিছু শারীরিক অস্বস্তি এবং দুঃখ ভোগ করছেন, কিন্তু মন থেকে সেই পরিস্থিতিগুলিকে মেনে নিচ্ছেন, তাহলে আপনারা ঐ শারীরিক দুঃখকে সহ্য করতে সক্ষম হবেন।

যেমন- একজন ব্যক্তি যিনি পূর্ণতঃ কোন ধার্মিক অনুষ্ঠান পালন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যদিও ঐ ধার্মিক অনুষ্ঠান পালন করার সময় তাহাকে অনেক রকম শারীরিক কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়, তা সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে সন্তুষ্টি বোধ থাকা এবং উক্ত অনুশীলনটিকে পালন করার লক্ষ্যের প্রতি স্পষ্ট দৃষ্টিকোণ থাকার কারণে এই কষ্টগুলিকে অসুবিধা বোধ না ক’রে একধরনের অলঙ্কার মনে করবে। অতএব ঐ ব্যক্তিটি উক্ত শারীরিক দুঃখগুলিকে মনের তৎপরতা দ্বারা পরাভূত ক’রে বৃহত্তর উদ্দেশ্যগুলির দিকে তাকিয়ে ঐ পরিস্থিতিটাকে মেনে নেবে। এরকম অনেক উদাহরণ আমরা দেখতে পাই যে আমরা অধিক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যের জন্য কাজ করার সময় শারীরিক দুঃখগুলিকে পরাভূত করতে সক্ষম হই। এই সব ক্ষেত্রে, যদিও আমরা অনেক শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হই, তা সত্ত্বেও আমরা ঐ সমস্যাগুলিকে মহানন্দে, সহর্ষে একটা অলঙ্কার রুপে গ্রহণ করি।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, আপনারা আপনাদের ইন্দ্রিয় এবং মন দ্বারা যে দুটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন, সেই দুটির মধ্যে মন দ্বারা যেটির মুখোমুখি হয়ে থাকেন এবং অনুভব করেন সেটিই হল বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

যেমন আমি বলেছি, যখন মানসিক সমস্যার বিষয়টা সামনে আসে, সেই সমস্যাগুলি পুরোপুরি আপনাদের মানসিক মনোভাব এবং মানসিক দৃষ্টি ভঙ্গির পরিণাম। নিজের মনোভাব পরিবর্তন করে সেগুলি কম করা যেতে পারে এবং উচ্ছেদ করা যেতে পারে। অতএব মানসিক সমস্যাগুলিকে উন্মূলন করার পথ আছে, উপায় আছে এবং সাধন আছে। এই কারণে ঐ উপায় এবং ঐ সাধনটাকে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যার দ্বারা আমরা এই রকম অনেক মানসিক সমস্যা কম করতে পারি, উন্মূলনও করতে পারি। এছাড়াও, আমরা যখন এই মানসিক সমস্যাগুলিকে উন্মূলন করার উপায় এবং সাধন বিষয়ে কথা বলি, তখন আমাদের সহজাত ভাল মানবীয় গুনগুলিকে জানা এবং চেনা প্রয়োজন।

যেমন- আমি এটাকে এইভাবে বোধ করি- যদি আপনারা এই মানব সমাজের দিকে খুবই সাবধান পূর্বক তাকান, তাহলে আপনারা বুঝতে পারবেন যে আমরা সবাই সামাজিক প্রাণী। এর মানে হল যে আমরা একটা সমাজে বাস করি এবং আমরা সবাই পুরোপুরি ভাবে পরস্পর নির্ভরশীল। জন্ম-এর সময় থেকে সাবালক হওয়া পর্যন্ত এবং তারপর নিজেদের যত্ন নিতে সক্ষম হওয়া পর্যন্ত, এমনকি শারীরিক সুস্থতার জন্যও আমাদের অন্যের অনুগ্রহ-এর উপর নির্ভর হতে হয়। আমাদের জীবতত্ত্বের গঠণ ও আমাদের শারীরিক গঠনের কারণে এরকম হয়। আমরা অন্যের প্রতি যত বেশী ঘনিষ্ঠতার ভাব জাগাবো, যত বেশী করুণা জাগাবো এবং যত বেশী যত্ন নেব, তত বেশী সুখ এবং শান্তি অর্জন করতে সক্ষম হব। এই মৌলিক মানবীয় মূল্য লাভের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে এই মৌলিক মানবীয় মূল্যগুলি গুরুত্বপূর্ণ; এইগুলি প্রয়োজন; অতএব এইগুলি প্রয়োজনীয় গুণ।

যদি কয়েকটা অন্য উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, যেমন- যদি একটা প্রজাপতির সন্তান অথবা কচ্ছপের সন্তানকে দেখা যায়, তাহলে মনে হবে কচ্ছপ এবং প্রজাপতির মা এবং সন্তানের মধ্যে ততটা পরস্পর নির্ভরতা নেই । যেমন- প্রজাপতির ক্ষেত্রে, ডিম পাড়া হয়ে যাওয়ার পর তাহাদের সন্তানেরা তাহাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সমর্থ হয় না। কচ্ছপের ক্ষেত্রে, তাহারা শুধু ডিম পাড়ে এবং তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। আপনারা যদি তাদের মাকে তাদের কাছে নিয়েও আসেন, আমার সন্দেহ আছে যে ঐ সন্তানগুলি তাহাদের মাকে দেখে কোন সাড়া দেবে বা কোন রকমের ভালবাসা বা স্নেহ দেখাবে। তার কারণ হল তারা তাদের জন্ম থেকেই একটা স্বাধীন জীবন-যাপন করে। এটা হতে পারে যে পূর্ব জন্মের সংস্কার অথবা তাদের শারীরিক গঠনের কারণে এরকম আচরণ করে। কচ্ছপের সন্তানের ক্ষেত্রে, তাদের পুর্ব জন্মের সংস্কার অথবা শারীরিক গঠনের কারণে তারা নিজেদের যত্ন নিতে সক্ষম হয়। তারা যখন সমুদ্রের ঢেউ-এর আওয়াজ শুনতে পায়, তখন তারা ক্রমশ সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায় এবং নিজেদের যত্ন নিতে সক্ষম হয়। নিশ্চয়ই মায়েরা ঐ সন্তানদের ডাকতে আসে না এবং সাঁতার কাটতে শেখায় না ইত্যাদি। এসব ওদের ক্ষেত্রে হয় না। যেহেতু তারা স্বাধীন জীবন-যাপন করে, তাদের মা-বাবা এবং সন্তানের মধ্যে বেশী স্নেহ দেখা যায় না।

মানব জাতির ক্ষেত্রে, আমাদের শারীরিক গঠনের কারণে ঠিক আমাদের জন্মের সময় থেকে আমাদের মা-বাবা, বিশেষ করে মায়ের প্রতি প্রচণ্ড ভালবাসা এবং স্নেহ দেখাই। আমি এখানে পূর্ব এবং অপর জন্মের সত্ত্বাকে মেনে নেওয়ার ভিত্তিতে অথবা একটা ধার্মিক বিষয়কে মেনে নেওয়ার কারণে এই বিন্দুগুলির প্রতি দৃষ্টিগোচর করছি না। বরং আপনারা যদি মনযোগ দিয়ে দেখেন যে মানব জাতি কী করে বেঁচে আছে, মানুষ কী করে বিকশিত হচ্ছে, আপনারা দেখতে পাবেন যে আমরা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সম্পূর্ণভাবে মানবীয় মূল্য, মানবীয় মৈত্রী এবং করুণার উপর নির্ভরশীল। এবং মানব সন্তানের ক্ষেত্রে, ঠিক জন্মকাল থেকেই তারা তাহাদের মাতৃদুধের উপর নির্ভরশীল। এরপর ক্রমশঃ তারা যখন স্বয়ং নিজের যত্ন নিতে সক্ষম হয়ে যায়, তারা আবার তাদের মায়ের অনুগ্রহ-এর উপর নির্ভর হয়ে যায়। এছাড়া তারা যখন বড় হয়ে ওঠে তারা তখনও অন্যান্য সহযোগী মানুষের অনুগ্রহ-এর উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে।

যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার মানব-সঙ্গী থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার দেখাশোনা করার জন্য কেউ থাকে, আপনি বেশী শান্তি অনুভব করেন, বেশী নিরুদ্বেগ অনুভব করেন, নিজেকে নিজগৃহে মনে করেন। অতএব এমন একটা জীবন-যাপন করা প্রয়োজন যেখানে আপনি অন্য কারুর ক্ষতি করেন না এবং যতদূর সম্ভব সবাইকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। যদি আপনার মধ্যে অন্য প্রাণীদের প্রতি এই ধরণের মৈত্রী ভাবনা, স্নেহের ভাবনা থাকে তাহলে তার প্রত্যুত্তরে সবাই আপনাকে পছন্দ করবে এবং ভালবাসবে, আর মৃত্যুর সময়ও আপনার মধ্যে কোন রকমের ভয়, কোন মানসিক অশান্তি থাকবে না।

যাহা হোক, আপনি যখন বড় হয়ে ওঠেন, কখনও-কখনও এক প্রকারের মানবীয় বুদ্ধি প্রবলভাবে ছবির আকারে ভেসে ওঠে এবং কখনও-কখনও এই মানবীয় বুদ্ধি শূন্য আশা প্রদান করে। আমরা আমাদের মানবীয় বুদ্ধি দ্বারা নতুন বিষয় শিখি, নতুন জ্ঞান অর্জন করি। এই রকম জ্ঞান দিয়ে আমরা কখনও-কখনও, বিশেষ করে আপনারা যখন খুবই সফল হয়ে থাকেন, চিন্তা-ভাবনা করি, “আমি অন্যদের  উৎপীড়ন করতে পারি; আমি অন্যদের শোষণ করতে পারি কেননা আমার কাছে মৌলিক মানবীয় মূল্যের কোন গুরুত্ব নেই।” আপনার মধ্যে এই ধরনের শূন্য আশার বিচারশক্তি থাকতে পারে। এইভাবে আপনারা এরকম একটা আলাদা ধরনের মানসিক মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশ করেন এবং আপনারা অন্যদের শোষণ এবং উৎপীড়ন করতে দ্বিধা করেন না। এমন ভাব করেন যেন আপনারা ঐ রকম আচরণ ক’রে কোন লাভ অর্জন করতে সক্ষম হয়ে থাকেন।

তা সত্ত্বেও বাস্তবে আপনারা যদি এমন একটা জীবন-যাপন করেন যেখানে অন্যের সুখকে অবহেলা করা হয়, তাহলে আপনি দেখবেন ক্রমশ সবাই আপনার শত্রু হয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি ডান অথবা বাম, সামনে অথবা পিছনে তাকান, তাহলে কষ্টসহকারে কাউকে পাবেন যে তিনি আপনাকে পছন্দ করেন। এরকম নেতিবাচক জীবন-যাপন করার কারণে আপনার মৃত্যুর সময়ও, আপনি এখন মারা যাবেন, এ কথা জেনে, সম্ভবত: সবাই আনন্দিত হবে। ঐ সময় আপনি স্বয়ং নিজের অতীতের দিকে তাকিয়ে অনুতাপ করতে লাগবেন এবং নিজে যে ভাবে জীবন-যাপন করেছিলেন তার ওপর অবলম্বন করতে লাগবেন। আপনি আবার খুব হতাশও হবেন, এ বিষয়টা জেনে যে আপনার ঐ জীবন প্রণালীর জন্য কেহই আর আপনার যত্ন নিচ্ছে না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে আপনি যদি এই মৌলিক মানবীয় মূল্যকে অবহেলা করেন তাহলে বাস্তবিক সুখ বা দীর্ঘস্থায়ী সুখের আশা করা মূর্খতা হবে। এবং যখন আপনার মৃত্যু হবে কেহই আপনার যত্ন নেবে না, কেহই ভালোবাসবে না; খালি হাতে একটা শূন্যতার মহাবোধ, হতাশার মহাভাবনা সহ আপনাকে এই জগৎটাকে ত্যাগ করতে হবে। অতএব অন্যের অবহেলা করে জীবন-যাপন করাটা সত্যিই একটা মূর্খতাপূর্ণ জীবন-যাপন।

অন্যদিকে, যদি আপনি মানবীয় মহাবুদ্ধি এবং জ্ঞানের সহযোগিতার মাধ্যমে এই মৌলিক মানবীয় মূল্যগুলিকে প্রতিপালন এবং লালন-পালন করতে সক্ষম হন, তাহলে আপনি এই মানবীয় করুণাকে অপার সীমা পর্যন্ত বিকাশ করতে সক্ষম হবেন। এইরূপ জীবন-যাপনই হল জ্ঞানী মানুষের জীবন-যাপন; এই পথটাই আমাদের জীবন সার্থকভাবে গড়ে তোলে।

Top