এস.ই.ই. শিক্ষাঃ বিশ্ব নাগরিক হওয়া

সামাজিক, আবেগপ্রবণ এবং নৈতিক শিক্ষা ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, সংক্ষেপিত ফ্রেমওয়ার্ক

সামাজিক, আবেগপ্রবণ এবং নৈতিক শিক্ষা হল ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কনটেমপ্লেটিভ সাইন্স অ্যান্ড কমপ্যাশন বেস্‌ড এথিক্স শাখার একটি কর্মসূচী। সুস্থ, আবেগপ্রবণ এবং নৈতিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি, সামাজিক গোষ্ঠী এবং বৃহত্তর সমাজকে লালন-পালন করাই হল এর লক্ষ্য। এই শিক্ষার তৃতীয় তথা অন্তিম পর্যায় হল এই এস.ই.ই. শিক্ষাঃ বিশ্ব নাগরিক হওয়ার পথ। এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি বিশ্ব কীভাবে একে অপরের উপর নির্ভরশীল; কীভাবে হয় সকল মানবের সুখ লাভের জন্য সাধারণ কামনা; আর কীভাবে পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমরা বিশ্ব স্তরে অবদান রাখতে পারি, তা আমরা বোধগম্য করতে পারি।

যে পৃথিবীতে আমরা বাস করছি তা ক্রমশ আরও বেশী জটিল, বৈশ্বিক এবং পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হয় সেটা স্বাভাবিক ভাবে ব্যাপক এবং দূরগামী। এই সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য নতুন ভাবনা এবং সমস্যার সমাধানের জন্য উপযুক্ত সহযোগীতামূলক, আন্তবিভাগীয় এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির অবশ্য প্রয়োজনীয়তা আছে। জগতের সেই দায়িত্বে যুক্ত হওয়ার জন্য শুধুমাত্র করুণা যথেষ্ট নয়। যে বৃহত্তর সমাজের গঠনতন্ত্রে আমরা বাস করি তাকে বুঝে, সেই উপলব্ধির সঙ্গে করুণাকে ওতপ্রোত করতে হবে।

প্রথম দৃষ্টিতে পৃথিবীর অবস্থা নিরুৎসাহিত করতে পারে, কিন্তু সেটা তো ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে যে জ্ঞান ও কলাকৌশলের উদ্ভাবন হয়েছে তার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। সেটা শুধু আমাদের গোষ্ঠী, সমাজ এবং বৈশ্বিক গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়েছে। আর কীভাবে পদ্ধতিটি চলে সেটা বোঝার সহজাত ক্ষমতাও জন্মায়।

জটিল সমস্যায় বিশ্লেষণাত্মক বুদ্ধির প্রয়োগ এবং উক্ত বোধটিকে গভীর করতে পারলে নৈতিকতা জাগবে। সমস্যাকে ছোট-ছোট ও বিক্ষিপ্তভাবে ত্যাগ করার আমাদের মধ্যে যে প্রবণতা থাকে তার চাইতে সমাধানের ব্যাপ্তিটি হবে আরও বিস্তৃত। নিম্নলিখিত বিষয়গুলির দ্বারা বৈশ্বিক ক্ষেত্রটি তুলে ধরা হলঃ

  • পারম্পরিক নির্ভরতাকে যথাযথ উপলব্ধি করা।
  • সাধারণ মানবতাকে স্বীকার করা।
  • গোষ্ঠী এবং বিশ্বস্তরে যোগাযোগ স্থাপন।

পারম্পরিক নির্ভরতাকে যথাযথ উপলব্ধি করা

পারম্পরিক নির্ভরতা হল এমন একটি ধারণা বা দার্শনিক মতবাদ যেখানে বলা হয় যে, কারণ ছাড়া কোন বস্তু বা বিষয়ের উৎপত্তি হয় না, বরং সৃষ্ট বস্তুর অস্তিত্ব অন্য বহুবস্তু ও বিষয়ের উপর নির্ভর করে। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের সাধারণ আহারের কথাই ধরা যাক। একটু তলিয়ে দেখলে দেখতে পাব যে এর উপাদানের সঙ্গে বহু উৎস ও লোকজন যুক্ত হয়ে আছে। পরস্পর নির্ভরশীলতা এও বোঝায় যে একটি ক্ষেত্রের পরিবর্তন অপর একটি ক্ষেত্রেও পরিবর্তন নিয়ে আসে। ফলের কারণ থাকবে, প্রকৃতপক্ষে বহু হেতু ও প্রত্যয় (সহযোগী কারণ/উপাদান) যুক্ত থাকতে পারে।

কীভাবে আমাদের বৈশ্বিক ক্ষেত্রের কার্যকলাপ চলছে তা জানার জন্য নিরসভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার প্রতি আলোকপাত করার জ্ঞান বিকাশ করা এর উদ্দেশ্য নয়। আমাদের নিজের বিষয়, অপরের বিষয় এবং অবশ্যই এই গ্রহটির বিষয়ে আমাদের জ্ঞানকে যুক্ত করাই হল এর উদ্দেশ্য। এই পারম্পরিক নির্ভরশীলতাকে আমরা দুটি দৃষ্টিকোণে দেখতে পারিঃ

  • পরস্পর নির্ভরশীল পদ্ধতিটির বোধগম্যতা।
  • এই পদ্ধতির অন্তর্গত ব্যক্তি সমূহ।

পারস্পরিক নির্ভরশীল পদ্ধতির বোধগম্যতাটি আভ্যন্তরীণ বিষয়ের সাথে বাহ্য বিষয়ের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপন করে। আমরা মূলনীতিগুলি এবং বৈশ্বিক কর্মকান্ড, যেমন ধরুন, কারণ ও ফলকে বোঝার জন্য আমাদের চেতনাকে দিশা দান করি। পদ্ধতির অন্তর্গত ব্যক্তিসমূহ বিষয়ে আমাদের অস্তিত্ব এবং চারপাশে যারা আছেন তারা কীভাবে বহু ঘটনা ও কারণের নিমিত্ত যুক্ত হয়ে আছে তা বুঝতে পারি।

পরস্পর নির্ভরশীল পদ্ধতির বোধগম্যতা

পরস্পর নির্ভরশীলতা হল প্রকৃতির নিয়ম, আবার মানবজীবনের মৌলিক বাস্তবতা। অসংখ্য মানুষ যারা আমাদের নুন্যতম প্রয়োজনীয় বস্তু খাদ্য, জল এবং বাসস্থান জোগায় এবং তার সঙ্গে সহায়ক পরিকাঠামো সমূহে যারা শিক্ষা, আইন ও শৃঙ্খলা, সরকার, কৃষি, পরিবহন, স্বাস্থ্য ইত্যাদিতে যুক্ত আছেন; তাদের সহায়তা ছাড়া স্বাচ্ছন্দ্য তো দূরের কথা, কেউ ভালভাবে বাঁচতে পারবে না। ২০০৭-০৯ এর আন্তর্জাতিক মন্দার মতো বড় ও বহুল প্রচারিত সঙ্কট, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণ এবং বৈশ্বিক যুদ্ধবিগ্রহ দেখিয়ে দিচ্ছে যে আর্থিক ও বস্তুতান্ত্রিক নির্ভরশীলতায় পৃথিবী এক সূত্রে বাঁধা।

ঐতিহ্যবাহী সমাজগুলিতে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি ছিল অনেক প্রগাঢ়। অনেক সময় সম্পদের আদান-প্রদান এবং নানা রকম সামাজিক সহায়তা যেমন শস্য কাটা থেকে নির্মাণ কার্যে সহায়তা, হানাদারদের মোকাবিলা ইত্যাদি বিষয়ের উপর বেঁচে থাকা নির্ভর করত। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য আমরা হয়ে উঠেছি অনেক গতিশীল ও স্থানান্তরিত, কিন্তু গোষ্ঠী বা সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এই অবস্থা একটি মোহ মায়ার জন্ম দিল, সেটা হল স্বাধীনতা। একে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য সাবালকত্বে পৌঁছে আমাদের আর কারও দরকার আছে বলে মনে করি না। এই মিথ্যা স্ব-নির্ভরতার ধারণা ক্রমেই মানসিক ও সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্নতার অনুভব জাগিয়ে তুলেছে, আমরা একান্তভাবেই সামাজিক জীব। আমাদের বেঁচে থাকাই শুধু নয়, মানসিক সুস্থতাও অপরের সাথে সম্পর্কের উপর নির্ভর করে।

পদ্ধতির অন্তর্গত ব্যক্তি সমূহের বিষয়

পরস্পর নির্ভরশীল পদ্ধতিটি অর্থপূর্ণ ভাবে বুঝতে গেলে এই বিশাল চিত্রপটে আমরা কীভাবে যুক্ত আছি সেটা বুঝতে হবে। আমরা প্রমাদবশতঃ ভাবি যে অন্যদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই এবং বৃহত্তর সমাজে আমি স্বাধীন, এরকম ভাবনা তা দূর করতে সাহায্য করে। অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী এবং সম্পর্কের জটিলতাকে আমরা এখানে পরিষ্কার ভাবে বুঝতে চেষ্টা করি। এতে তিনটি বিষয় পাওয়া যায়ঃ

  • পদ্ধতিগত স্তরে অপরের প্রতি প্রকৃত কৃতজ্ঞতা বোধ।
  • অপরের জীবন গঠনে আমাদের সম্ভাবনা বিষয়ে গভীর অনুভব।
  • বৃহত্তর কল্যাণের কাজ করা শুরু করার জন্য গভীর কামনার উন্মেষ।

আমাদের আচরণ কীভাবে অপরকে প্রভাবিত করে বা উল্টোটি দেখে আমরা কাজ শুরু করি। তারপর অন্যরা, যারা আমাদের কল্যাণে নানারকম অবদান রেখেছেন তার পর্যবেক্ষণ করি। একটি তালিকা তৈরী করে বারংবার সেটা দেখে বিষয়টি আমরা করতে পারি। সামাজিক ক্ষেত্রে কয়েকজন লোকের উপর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ না রেখে, আরও পরিসরে, যেমন- ব্যক্তি সমূহ, গোষ্ঠী, সমাজের লোকজন যাদের আমরা ব্যক্তিগত স্তরে জানি না তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করি। অসংখ্য মানুষের সহায়তা ছাড়া আমরা কিছুতেই একা বাঁচতে পারি না। তাই অপরের প্রতি সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা বিকাশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

এই বিশাল জনসমষ্টি, যারা আমাদের জীবন রক্ষায় সাহায্য করে, সবাই তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। আমরা যখন সেটা বুঝতে পারি, একই রকম ভাবে তাদের জন্যও কিছু করার ইচ্ছা আমাদের মধ্যে জাগে। যেভাবেই হোক তাতে উপকার হচ্ছে; এই সত্যটি স্বীকার করার আগে অন্যরা ঠিক কীভাবে আমাদের উপকার করে সেটা জানার দরকার নেই। এই সচেতনতা যেমনটি বাড়তে থাকবে তেমনই ক্ষুদ্র আত্ম-সর্বস্বতা ও প্রতিযোগীতামূলক দৃষ্টিকোণ ছাড়িয়ে পারম্পরিক সহমর্মীতাপূর্ণ সম্পর্ক অগ্রাধিকার পাবে। অপরের সঙ্গে এই বর্ধিত যোগসূত্রের ভাবটি সহমর্মী আনন্দ বর্ধনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সরাসরি একাকীত্ব দূর করতে সাহায্য করে। এই ভাবে অপরের জন্য কাজ করলে তার বদলে আনন্দ পাওয়া যায় এবং তা ঈর্ষা, বিদ্বেষ এমনকি প্রবল আত্ম-সমালোচনা ও অন্যদের সঙ্গে অবাস্তব তুলনার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।

সাধারণ মানবতা স্বীকার করা

সামাজিক পরিসরে সহমর্মীতার ক্ষেত্রে যখন নৈপুণ্যের অনুশীলনের কথা আসে তখন সেটা পরার্থ ভাবনার দিকে চালিত হওয়া উচিত। আমরা সবাই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত, সেটা এইভাবে বোঝা যাবে। আর এ শুধু পরস্পর নির্ভরশীলতার গভীর অনুধাবনেই সম্ভব। সাধারণ মানবতা বা মানবিক মূল্যবোধকে সুস্পষ্ট রূপে চিহ্নিত করে তাকে পোষণ করার মাধ্যমে একে শক্তিশালী করা যায়। এখানে আমরা বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা করে দেখি কীভাবে একেবারে মৌলিক স্তরে সকল মানুষ একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ভাগ করে নিচ্ছে। এর সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত জীবন এবং জীবনের অবস্থাটিও চিহ্নিত করা হয়। এইভাবে আমরা যে কোন ব্যক্তির, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, অথবা একেবারেই আমাদের বিপরীত, তাদেরও একটি গুণবত্তার মাপদন্ড, সহমর্মীতা এবং করুণার স্তর বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়ে উঠি। আমাদের সাধারণ মানবতাকে দুটি শিরোনামে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করতে পারিঃ

  • সকলের মৌলিক সমতার যথাযথ উপলব্ধি।
  • কীভাবে পদ্ধতি হিতকে প্রভাবিত করে তার উপলব্ধি।

সকলের মৌলিক সমতার যথাযথ উপলব্ধি হল- এখানে আমরা উপলব্ধি করি যে, সকলে অর্থাৎ আমাদের বন্ধুগণ, পরিবার থেকে অচেনা এমনকি এই গ্রহের অপরদিকে যারা বসবাস করেন, তারা সবাই সুখ, কল্যাণ এবং দুঃখ-মুক্তির মতো মৌলিক বিষয়ে একই রকম কামনা করে।

কীভাবে পদ্ধতি হিতকে প্রভাবিত করে তার উপলব্ধি হল যে বৈশ্বিক রীতিনীতি বা পদ্ধতি সদর্থক মূল্যবোধ গ্রহণ করে কল্যাণকে বর্ধিতকরণ বা সমস্যা সৃষ্টিকারী বিশ্বাস শোষণ করে এই বিষয়ে আপোষ করতে পারে।

সকলের মৌলিক সমতার যথাযথ উপলব্ধি

মানবতার মৌলিক সমতার বোধটি আমাদের গোষ্ঠীর বাইরে যারা আছেন তাদের দিকে বাড়িয়ে দেয়। শেষপর্যন্ত এই উপলব্ধি আমরা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিই। একজন মানুষ হিসেবে উন্নতির ইচ্ছায় এবং দুঃখ ও অতৃপ্তি পরিত্যাগের কামনায় যে আমরা একে অপরের অংশীদার। এই বিষয়টির উপর জোর দিয়ে আমরা সেটা করি। বিষয়টি পক্ষপাতিত্ব লাঘব করতে সাহায্য করে এবং অপরের প্রয়োজনীয়তাকে ছোট করার প্রবণতাকে রুখে দেয়।

অন্যরাও আমাদেরই মতো উপলব্ধি করে এই উপায়ে “আমাদের দলে” মনোভাবটি জাতি, ধর্ম, রাষ্ট্র নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। সমাজে নানা ভাবে এই সক্ষমতা দেখানো হয়। কেউ হয়তো রক্তদান করলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর পীড়িতদের দান করা, নিজে যুক্ত না থাকলেও অবিচারের প্রতিবাদে অন্য গোষ্ঠীর হয়ে প্রতিবাদ জানানো এর উদাহরণ। পরস্পর নির্ভরশীলতাকে বোঝার ক্ষমতা এবং সহমর্মীতা বোধ অপরের সঙ্গে মেলা মেশার অনেক বাধা দূর করে, যেমন- পক্ষপাতিত্ব, দূরত্বের মনোভাব, নিজের লোক ছাড়া অপরের প্রতি উদাসীনতা ইত্যাদি।

আমরা যখন নিজের দিকে লক্ষ্য করি, তখন বিশ্বকে ছোট মনে হয়। আর নিজের সমস্যা বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন অন্যদের দেখি পৃথিবীকে বড় মনে হয়। আমাদের সমস্যাগুলি মনের দ্বারা চালিত হয় আর সেগুলি ছোট মনে হয় এবং করুণাময় কর্ম ও অপরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

কীভাবে পদ্ধতি হিতকে প্রভাবিত করে তার উপলব্ধি

সাংস্কৃতিক ও কাঠামোগত স্তরে পদ্ধতি হিতকে বর্ধিতকরণ বা আপস করতে পারে। ইতিবাচক মূল্যবোধ অথবা অসাম্য ও সমস্যাসৃষ্টিকারী বদ্ধমূল বিশ্বাস হচ্ছে এর মূল। আমরা নিজেরাই যখন অসাম্য, পূর্ব নির্ধারিত ধারণা, পক্ষপাতিত্বের মতো অবস্থার শিকার হই, তখন কেমন লাগে! একটু সময় নিয়ে তাকে বুঝতে পারি। এরকম সমস্যাযুক্ত পদ্ধতি বর্ণনা করার জন্য আমরা ইতিহাস বা সমসাময়িক ঘটনা থেকে উদাহরণ ব্যবহার করতে পারি। অবশেষে, পূর্বনির্ধারিত ধারণা বা পক্ষপাতিত্ব সত্যিই যথার্থ কি না তা বিচার করতে পারি। অথবা সমস্ত মানুষ সুখের খোঁজের সমান অধিকারী কি না তা জানতে পারি।

সহমর্মীতাকে বিস্তৃত আকারে পোষণ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষ হিসাবে সহমর্মীতার জন্মলব্ধ ক্ষমতাটি বড় আকারে দুঃখ-দুর্দশা বা বৈশ্বিক স্তরে সমস্যার ক্ষেত্রেও অনায়াসে প্রকাশ পায় না। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের মধ্যে অনেকেরই অধিকাংশ নিপীড়িতের মধ্যেও একজনের দুঃখ-কষ্টের প্রতি বেশী সহমর্মীতা প্রকাশ করি। যাই হোক, কাঠামোগত এবং সাংস্কৃতিক বিষয়াদিতে অধ্যয়নের মাধ্যমে দুঃখ-কষ্টের উপলব্ধি ও অনুভবের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আর সেই সঙ্গে দুঃখ-কষ্টের প্রতি আমাদের সংবেদনশীলতা হবে বাস্তববুদ্ধি নির্ভর।

সাধারণ মানবতাকে চেনার মাধ্যমে আমরা নানা জাতিগত ও সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ ও সহযোগিতা করতে শিখতে পারি। সেই সঙ্গে অপরের আশা-আকাঙ্খাকে আরও বাস্তবোচিত ভাবে বুঝতে পারি। অপরের সঙ্গে কী ভাগ করে নিচ্ছি সেটা আরও ভাল করে অনুভব করতে পারলে অবিশ্বাস আপাত পার্থক্য যা নেতিবাচক ধ্যান ধারণা ও একাকীত্বের দিকে নিয়ে যায়; তার পরিবর্তে প্রশংসা করতে পারব। কীভাবে পদ্ধতি ব্যক্তি সাধারণের কল্যাণ আকার দেয় তার উপলব্ধির মাধ্যমে আমাদের সহমর্মীও হবে আরও গভীর ও আরও নিবিড়। তার সঙ্গে মানুষের দুঃখ নিবারণের সম্ভাব্য উপায় সম্বন্ধে আমাদের বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা হবে সমৃদ্ধ।

গোষ্ঠী ও বিশ্বস্তরে যোগাযোগ স্থাপন

আমরা যে অপরের দ্বারা উপকৃত হই এবং আমাদের সাধারণ মানবতাকে চিহ্নিত ক’রে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারলে পরস্পর নির্ভরশীলতাকে উপলব্ধি করা যাবে। এরফলে দায়িত্ব নেওয়া এবং কিছু করার ইচ্ছা জাগে। তারপর, আমরা স্বাভাবিক ভাবেই কামনা করি, সমাজ থেকে আমরা যে উপকৃত হচ্ছি তা যেন ফিরিয়ে দিতে পারি। আর যাদের প্রয়োজন আছে এবং যারা সঙ্কটাপন্ন তাদের জন্য কাজ করি। তবু এই জটিল পদ্ধতি ও আন্তর্জাতিক স্তরে কার্যকরভাবে কীভাবে কাজ করব?

এস.ই.ই. (SEE) শিক্ষার সার্বিক উদ্দেশ্য হল একজন করুণাময় আন্তর্জাতিক নাগরিক হিসেবে আমাদের নিজস্ব সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করে অনুভবের মাধ্যমে নিজেকে শক্তিশালী করা। এটা অর্জন করার জন্য দুটো স্তরকে উন্মোচিত করতে হয়ঃ

  • গোষ্ঠী ও বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য আমাদের সম্ভাবনা।
  • গোষ্ঠীগত এবং বিশ্ব স্তরে সমাধানে যুক্ত হওয়া।

এই দুটি বিষয় প্রায় একই রকম, কিন্তু প্রথমটি সুযোগ ও আমাদের সক্ষমতার ভিত্তিতে আমরা কী ইতিবাচক পরিবর্তন করতে পারি যেটা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়টি, আমাদের গোষ্ঠী এবং বিশ্বে যে সকল সমস্যা আছে সেগুলির সৃষ্টিশীল সমাধান খুঁজতে সাহায্য করে।

গোষ্ঠী ও বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য আমাদের সম্ভাবনা

যদি গোষ্ঠী ও বিশ্বের প্রয়োজনীয়তার দিকে নজর দিয়ে কাজ করতে হয় যাতে স্ব-পরের উপকার হতে পারে, তাহলে তাতে যে ব্যর্থতা আসবে না এমন নয়। বাস্তবমুখী এবং কার্যকর ভাবে আমাদের সামর্থ্য ও অক্ষমতাকে বুঝতে হবে। সবকিছু আমাদের মুষ্ঠিবদ্ধ নয়, এই বিষয়টি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গভীরে প্রোথিত সমস্যাগুলির পরিবর্তনও সময় সাপেক্ষ। তার মানে এই নয় যে আমরা কার্যকরভাবে কর্ম করতে পারব না। কঠিন সমস্যার সামনে যদি আমরা অসহায় হয়ে পড়ি তাহলে স্ব-পরের উপর করুণার পোষণ অবশ্যই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এর কারণ হল করুণা- দুঃখ মুক্তির কামনা বা ইচ্ছা, আশার উপর নির্ভর করে। দুঃখ থেকে মুক্তি পাব, এটা একটা দৃঢ় বিশ্বাস।

আমরা হয়তো পদ্ধতি বা সিস্টেমের সবটা পরিবর্তন করতে পারি না। তবুও এই পদ্ধতির মধ্যেই মূল উপাদানগুলির যথাসম্ভব পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারি। আন্তর্জাতিক বা সিস্টেম এর স্তরে এর ফলে অত্যন্ত উৎফুল্ল না হয়েও এক ধরণের শক্তিলাভের অনুভব করতে পারি। সিস্টেমের প্রধান ও প্রভাবশালী উপাদানগুলিকে যদি চিহ্নিত করে কাজ করা যায়, উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেতে পারি। তৎক্ষণাৎ বড় মাপের পরিবর্তন না আনতে পারলেও আমাদের দ্বারা যদি ক্ষুদ্র পরিবর্তনও সাধিত হয়; তারও মূল্য যথেষ্ট। বর্তমানের ক্ষুদ্র পরিবর্তন ভবিষ্যতের বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আস্তাকুড় থেকে পুনঃ ব্যবহার্য্য বস্তু সরানোর মতো ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাগুলি জড়ো হয়ে বড় পরিবর্তন ঘটায়। পারম্পরিক নির্ভরতাকে পূর্ণরূপে বুঝতে পারলে এক ধরণের আত্মবিশ্বাস লাভ করি যে আজকের ক্ষুদ্র কর্ম ও আচরণ ভবিষ্যতে বড় প্রভাব ফেলার ভীত তৈরী করল। আমরা হয়তো সরাসরি এর ফল নাও দেখতে পারি।

জটিল সামাজিক ও বৈশ্বিক সমস্যাগুলিকে ক্ষুদ্রাকারে ভেঙ্গে পর্যালোচনা করে কাজ করা যায়। যখন দেখব যে আমাদের কর্ম এই ক্ষুদ্র সমস্যাটির সমাধান করছে এবং এই কর্ম কীভাবে পরস্পর নির্ভর হয়ে বৃহত্তর পদ্ধতির সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে, আমাদের মধ্যে তখন জাগবে শক্তি ও আত্মবিশ্বাস। এর জন্য আমাদের বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। মৌলিক মানবিক গুণাবলীর মাধ্যমে দেখা জটিল বিষয়কে বিশ্লেষণ করতে হলে সেই রকমই চিন্তা-শক্তির দরকার হয়। তাতে অবশ্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া যায় না যে, কৃতকর্মটি অন্যদেরও একইরকম উপকারে আসবে। বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা-ভাবনা একটি সৃষ্টিশীল ফলের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।

গোষ্ঠিগত এবং বৈশ্বিক স্তরে সমাধানে যুক্ত হওয়া

এমনকি সমাধান যদি আমাদের জন্য অসাধ্য হয় তবুও সমস্যাটির এবং সম্ভাব্য সমাধানের উপর লক্ষ্য রাখতে পারি। নিম্নলিখিত উপায়ে দৃশ্য সমস্যাগুলির সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারেঃ

  • পদ্ধতিগুলি এবং তাদের জটিলতাকে চিহ্নিতকরণ।
  • কর্মের স্বল্প ও দীর্ঘকালীন প্রভাবের মূল্যায়ন।
  • মৌলিক মানবিক গুণাবলীর আওতার মধ্যে রেখে অবস্থার মূল্যায়ন।
  • নেতিবাচক আবেগ এবং পক্ষপাতমূলক প্রভাবের সীমিতকরণ।
  • উদার, সহযোগীতামূলক এবং বুদ্ধি যুক্ত বিনয়ী মনোভাবের চর্যা।
  • নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার সুবিধা ও অসুবিধার চিন্তারিত আলোচনা।

এরপরও কখনও-কখনও স্বল্প ও দীর্ঘকালীন ফলের কথা না ভেবেই কর্ম করা হয়। যখন আমরা কোন একটি বিষয় পরীক্ষা করি, যারা এই কর্মের ফলে প্রভাবিত হবেন তাদের কথা আমাদের ভাবতে হবে। আমরা যদি এই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করি এবং অভ্যস্থ হয়ে যাই তাহলে আমরা সহজেই বড় কর্ম্পরিকল্পনা করতে পারব। কীভাবে তা মানুষকে প্রভাবিত করবে যা প্রথমে দেখলে মনে হতে পারে কর্মটি বিষয় বহির্ভুত। বিষয় কী ক’রে মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করছে তা আমাদের দেখতে হবে। তার সঙ্গে দেখতে হবে কীভাবে সমাধানগুলি ব্যক্তি, সমাজ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র সমৃদ্ধ করছে।

নিজের গোষ্ঠী এবং বিশ্বের জন্য কাজ করতে গেলে চাই একটি খোলা ও উদার মন। যেমন অপরের সঙ্গে এক সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক এবং অপরের ভাবনা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা লাভ করবে। সুস্থ ও সদর্থক বিতর্ক তখনই সম্ভব যখন প্রতিপক্ষ, তিনি আমাদের মতো না হলেও তাকে সাদরে বিবেচনা করতে পারব যে তিনিও প্রাজ্ঞ তাই তিনি এই জায়গায় এসেছেন। বুদ্ধিগত বিনয় এবং উদার মন ছাড়া বিতর্ক এবং সহমতে পৌঁছনো অসম্ভব। তাতে আলোচনা ভেস্তে গিয়ে ঝগড়া ও শক্তি প্রদর্শনের জায়গায় পৌঁছতে পারে।

এমনকিছু গম্ভীর সমস্যা আছে যা আমরা ব্যক্তিগতভাবে অন্য কারও সাহায্য ছাড়াই করতে পারি। তার জন্য প্রয়োজন অন্যদের সঙ্গে মত বিনিময় এবং মূল্যবোধ পরিষ্কার করে বলার ক্ষমতা। গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কাজ করতে গেলে আমাদের অবস্থাটিকে আগে তুলে ধরতে হবে। তারপর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, অপরের কাছ থেকে শিখে, গঠনমূলক বিতর্কের মাধ্যমে তা করতে হবে। একটি চিন্তাশীল মন ও গভীর মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত মন দ্বারা পরিষ্কার ভাবে বোঝান এবং চিত্রায়িত করে কাউকে উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত করতে পারলে যারা মূক (বোবা) তাদের হয়েও বিতর্কে অংশ নিয়ে নেতৃত্বে পরিণত হওয়া সম্ভব।

সারাংশ

প্রথম দুটি অংশে আমরা আমাদের আবেগকে দিশা দিয়ে পরিবার বন্ধুবর্গ এবং সহকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় যুক্ত করতে শিখেছি। এই তৃতীয় ও শেষ অংশে, কীভাবে বিশ্ব পরস্পর নির্ভরশীল, কী করে সমস্ত মানুষের একটিই ইচ্ছা ও কামনা সুখলাভ ও দুঃখ পরিহারে সমানভাবে অংশীদার হয় এবং কীভাবে আমাদের কর্ম বিশ্ব স্তরে পরিবর্তন আনতে পারে তা শিখতে শুরু করেছি।

যে বিশ্বে আমরা বাস করি তা জটিল। একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে দেখলে আমরা দেখি যে অপরের সহায়তা ছাড়া আমাদের নিজের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। আমাদের চারপাশের মানুষজন, পৃথিবীর সকলের দিকে তাকালে মনে হয় ওরা আমাদের থেকে কতই না আলাদা। কোনো কোনো সময় মনে হয় পৃথিবীতে সত্যিকারের পরিবর্তন আনা বোধ হয় অসম্ভব। যখন আমরা আমাদের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারি- যেমন আমাদের আহার, পরিধেয় বস্ত্র, যে গাড়িটি আমরা চালাই তা সবকিছুই আসে অপরের কর্ম থেকে; তাদের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই মনে কৃতজ্ঞতার অনুভব জন্মায়। যখন দেখি এই লোকগুলিও আমারই মতো সুখী হতে চায়; ওরা যেন সুখী হন এই কামনা আমাদের মনে জাগে। অবশেষে, ক্ষুদ্র কর্মও বৃহৎ ফল দিতে পারে এই জ্ঞানলাভে আমরা আত্মবিশ্বাসী হই যে, গঠনমূলক যেকোন ক্ষুদ্র কর্ম করি না কেন, তাতে বিশ্বের হিত হবে।

এই প্রশিক্ষণ সুচিটির অর্থ শুধু এই নয় যে, পড়ো আর ভুলে যাও। একে এর বিষয়কে ধরে-ধরে অনুশীলন করতে হবে। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই আলাদা, কিন্তু চলার পথে আমাদেরকে অসংখ্য মানুষ ও সমাজের নানারকম প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। জীবনের এই উত্থান-পতনের মোকাবিলা করার সময় স্বার্থ-পরার্থ ভাবনায় কর্ম চলেই আসে। আমাদের আবেগ ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিস্থিতিকে পূর্ণ সচেতন হয়ে বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা জীবনে যে কোনও পরিস্থিতিতে উতরে যেতে পারি। শুভ শক্তি হওয়ার মতো প্রচন্ড এক সম্ভাবনা আমাদের আছে যে আমরা অনুভব করে জীবনে এগিয়ে যেতে পারি। এতে রয়েছে আমাদের কল্যাণ, পরকল্যাণ তথা বিশ্বের কল্যাণ।

আপনি যদি আরও বিশদে পড়তে চান এস.ই.ই. কাঠামো-এর পূর্ণ বর্ণনা এবং সেন্টার ফর কনটেমপ্লেটিভ সাইন্স অ্যান্ড কমপ্যাশন বেস্‌ড এথিক্স-এর অন্য কার্যক্রমসমূহ দেখুন।

Top