নৈতিকতা হল মানবিক আদর্শাবলীর একটি প্রণালী যা একটি সুখী জীবন লাভে আমাদের আচরণের নির্ধারক হয়। নৈতিকতা নিয়ে আমরা একটি সৎ জীবন-যাপন করি। আমাদের চারিপার্শ্বের মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও আস্থা অর্জনে তা আমাদের চালিত করে। সুখের চাবিকাঠি হল নৈতিকতা।
বৌদ্ধধর্মে নৈতিকতা
বৌদ্ধ মতবাদ অনুযায়ী বিভাজনের চেতনা অর্থাৎ প্রজ্ঞা হল নৈতিকতার ভিত্তি স্বরূপ। দীর্ঘমেয়াদী সুখদায়ী কী আর নিরন্তর দুঃখ কষ্টের কারণ কী, এই পার্থক্যটি বুঝতে আমরা বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করি। এটি কতগুলি নিয়মাবলী কে অন্ধের মতো মেনে নেওয়ার বিষয় নয়। বরং জন্মায় দৃঢ় প্রত্যয় এবং এই নৈতিক নির্দেশাবলী পালনের যৌক্তিকতার বোধ জাগে।
সত্যিই যদি আমরা নিজেদের কথা ভাবি, তাহলে আমাদের ধীশক্তি যেন হয় আমাদের আচার-আচরণের নির্ধারক। সবাই সুখ চায় এবং সুখ সকলের প্রাপ্য, আমরাও এর মধ্যে সামিল [দ্র. সুখ কী?]। আত্মসম্মান কে নিচে নামিয়ে আনলে তা ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবের দিকে নিয়ে যায়। আর আত্মবোধ নিয়ে যায় আত্মমর্যাদার দিকে। আর আত্মমর্যাদা থাকলে নিজের উপর আসে গভীর শ্রদ্ধা এবং তাতে অনৈতিকভাবে কোন কর্ম করতে আমরা নত হবো না; এটা একেবারে বলে মনে হয় না।
যেভাবে ফুলের বর্ণ, গন্ধকে ক্ষতি না করে ভ্রমর রস নিয়ে চলে যায়,
সেইভাবে মুনিগণ গ্রামে বিচরণ করেন। এখানে জগতে আছে।
ধর্মপদ, পুষ্পবর্গ-পদ সংখ্যা- ৪৯
‘যাহা কিছু’ গোছের মনোভাব শুধুমাত্র একাকীত্ব, হতাশা ও বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যায়। নৈতিকতার ভাবনায় আমরা সেরকম মনোভাব থেকে বেড়িয়ে আসতে পারি। একটি সুখী ও সফল জীবনের আধার হিসেবে আস্থা ও বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পারি।
যুক্তি নির্ভর নৈতিকতা ও শীল
বৌদ্ধ সাধনা নির্ভর করে সহজ বুদ্ধির উপর। আমরা অপরের প্রতি ক্রোধী, স্বার্থপর ও অনমনীয় হলে আমাদের নিজেদের জন্য শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবন কী করে আশা করতে পারি?
কোন ব্যক্তির পক্ষে গ্রহণ করার মতো বিভিন্ন পর্যায়ের শীল রয়েছে বৌদ্ধধর্মে। যেমন তিব্বতী পরম্পরায় ভিক্ষুদের ২৫৩ টি শীল পালন করতে হয়। বহু বৌদ্ধ উপাসক-উপাসকদের জন্য নির্ধারিত ‘পঞ্চশীল’ গ্রহণ করেন।
এগুলি হলঃ-
- প্রাণীহত্যা থেকে বিরত থাকা।
- অপ্রদত্ত বস্তু না নেওয়া (চুরি)।
- ব্যভিচার না করা।
- মিথ্যাকথা না বলা।
- নেশা না করা।
জীবনকে সাধনার উপযুক্ত করার জন্য বৌদ্ধসাধকগণ এগুলি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন। সঠিক পথে থাকতে এসব (শীল) সহায়তা করে এবং একটি সুখী ও সাফল্যমণ্ডিত জীবন গড়ার কারণ হয়ে উঠে।
সফল জীবনের জন্য নৈতিকতা
কতিপয় মানুষ মনে করেন যে- আমাদের প্রচুর ধনসম্পত্তি ও ক্ষমতা থাকলেই জীবন সফল। কিন্তু আমরা সেসব পেলেও সন্তুষ্ট হই না এবং এগুলি হারানোর ভয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকি। আমরা যত বেশি পাই, বিশেষ করে অপরকে বঞ্চিত করে যখন পাই, আরও বেশী শত্রুর সৃষ্টি করি। আমাকে কেউ পছন্দ করে না- এমন কথা যখন কেউ বলবে না, তা হবে সফল জীবন। আমরা যদি বহু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পারি এবং মানুষ যদি আমাদের উপস্থিতিতে সুখী হয়, তবে সেটি হল সফল জীবন। সেক্ষেত্রে আমাদের কত টাকা ও ক্ষমতা আছে তা বিচার্য্য নয়। যাই ঘটুক না কেন আমরা মানসিক সহায়তা পাবো। আর তা সেসবের মোকাবিলায় শক্তি যোগাবে।
সুখের দিশারী অথবা সমস্যাসৃষ্টিকারী আচার-আচরণ কীরকম হবে তার ইঙ্গিত দেয় নৈতিক মূল্যবোধের নির্দেশিকা সমূহ। আমরা যখন সততার সঙ্গে অপরের সুখ কামনা করি, তারা বুঝতে পারে যে আমরা তাদের ঠকানো, শোষণ বা পীড়ন করবো না। আমাদের ওপর তাদের আস্থা জন্মায়। যাদের সঙ্গেই আমরা মিলিত হই না কেন এই আস্থাটিই হয় বন্ধুত্বের ভিত্তিপ্রস্তর। কোন ভয় নেই জেনে ওরা নির্ভয় আমাদের সঙ্গ পেয়ে সুখী হয়, আরাম পায়। আমাদেরও সুখানুভব হয়। আমরা অন্যদের কাছে গেলে ওরা ভয়ে কাঁপবে, এরকম কে চায়? হাসিমুখকে সকলে স্বাগত জানায়।
মানুষ সামাজিক জীব। বাঁচতে গেলে আমাদের অপরের সহায়তার প্রয়োজন। এ শুধু সদ্যজাত শিশু বা সেবা কেন্দ্রের জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের কথা নয়, বরং জীবনভর আমাদের অপরের সেবা যত্ন প্রয়োজন হয়। ভালবাসা ডোরে বাধা বন্ধুত্ব থেকেই আমরা মানসিক ভরসা পাই এবং সেটাই জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলে। যাদের সঙ্গেই আমাদের দেখা হোক না কেন, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তুলতে চাই সামর্থ । নৈতিকতার গভীর বিশ্বাস সেই সামর্থ দেয়।